বাংলাদেশে আবদুল মান্নান সৈয়দ নামটি জীবনানন্দ দাশের নামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। তিনিই প্রথম জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত কবিতাগুলোর একটা বড় অংশ গ্রন্থনা করে প্রকাশ করেছিলেন যা দুই বাংলার জীবনানন্দ চর্চাকারীদের উদ্দীপিত করেছিল। একটা সময় তিনি প্রায় একাকীই জীবনানন্দ গবেষণা চালিয়ে গেছেন।
সত্তরের দশকে আমার আব্বা সে-কালের বহুল প্রচারিত পত্রিকা সাপ্তাহিক বিচিত্রা রাখতেন বাড়িতে। আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম শুনি স্কুলপড়ুয়া বয়সে সেই সাপ্তাহিক বিচিত্রার সূত্রেই। সেটা ১৯৭৬ বা ৭৭ সালে কথা। একবার বিচিত্রা প্রচ্ছদ-কাহিনি করেছিল বাংলাদেশের কবি ও কবিতাকে বিষয় করে। বাংলাদেশের সমসাময়িক কালের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের অনেকেরই ছবি ছাপা হয়েছিল সে-সংখ্যায়, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়ও ছিল সেখানে। যতদূর মনে পড়ে আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম আমি তখন থেকেই জানি। তখনকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আমার কাকা আবদুল গনির সূত্রে তাঁর সহপাঠী বন্ধু আতাহারুল ইসলামের সঙ্গে আমার সখ্য হয়েছিল সাহিত্য পাঠে আমার আগ্রহের কারণে। সমসাময়িক কোন লেখকের লেখা পড়া উচিত জানতে চাইলে তিনি যাঁদের কথা বলেছিলেন তার মধ্যে আবদুল মান্নান সৈয়দের নাম ছিল। পরে ১৯৭৮ সালে, কলেজের লাইব্রেরিতে চোখে পড়ল তাঁর গল্পের বই চলো যাই পরোক্ষে। বলা বাহুল্য আমার তখনকার সাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতায় এই নাম খুব আলাদা লেগেছিল। তখন ছিলাম সর্বগ্রাসী পাঠক। বুঝি বা না-বুঝি সবই পড়তে চাই এমন মানসিক অবস্থা। বইটা পড়ে তেমন একটা না বুঝলেও অনুভব করেছিলাম যে এই লেখক সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। সে-সময়ই কলেজে সহপাঠী মোস্তফা জামানের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। তখন সে ছিল আমার তুলনায় বেশ অগ্রসর পাঠক। দেখলাম সমকালীন সাহিত্যের খোঁজ আমার চেয়ে তার অনেক বেশি জানা। তার হাতেই একদিন দেখলাম চারিত্র নামে একটি পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকা যে ঠিক বিচিত্রার মতো পত্রিকা নয় তা সবে বুঝতে শুরু করেছি তখন। মোস্তফা জামান তার সংগৃহীত পত্রিকাটি আমাকে পড়তে দিলো। আমরা দুজনেই খুব বিভোর ছিলাম কয়েকদিন পত্রিকাটি নিয়ে। সেখানে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন থেকেই তাঁর একটি বইয়ের নাম জানলাম, দশ দিগন্তের দ্রষ্টা। এই নামটিও অসাধারণ লেগেছিল আমাদের। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রকাশিত হলো করতলে মহাদেশ। বইয়ের পেছনে নাকি ভেতরে আলাদা ছাপা ছিল মনে নেই, খ্যাতিমান আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনের তোলা একটা অসাধারণ পোর্ট্রেট ছিল তাঁর সে-বইটাতে, আমাদের দুজনেরই খুব ভালো লেগেছিল। তাঁকে অবশ্য প্রথম সামনা-সামনি দেখি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে, ১৯৮২ সালে। দেখা হবার আগে টেলিফোনে তাঁর কণ্ঠ শুনি একদিন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তখন ইন্দিরা রোডে। তিনি একদিন ফোন করলে আমিই রিসিভার তুলেছিলাম। বলিষ্ঠ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘সায়ীদ ভাই’ আছেন? আমি তাঁর নাম জিজ্ঞাসা করলে স্পষ্ট উচ্চারণে নিজের নাম বলেছিলেন। তখন আমার বয়স অল্প, যে কোনো বিখ্যাত মানুষকে সামনা-সামনি দেখলে বা তাঁদের সঙ্গে একটু কথা বলবার সুযোগ পেলে খুব খুশি হই। বিশেষ করে আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে আমার বিস্ময় তখন প্রবল। মনে আছে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে পেরে খুবই ভালো লেগেছিল। এরপর একদিন তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে এলে সায়ীদ স্যার তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দেন। আমি ততদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও সায়ীদ স্যারের কণ্ঠস্বর পত্রিকার সঙ্গে কর্মী হিসেবে জড়িয়ে গেছি। আবদুল মান্নান সৈয়দ সরাসরি আমার শিক্ষক ছিলেন না আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো। আমি তাঁকে মান্নান ভাই বলে ডাকতে শুরু করি। তিনিও আমাকে সস্নেহ প্রশ্রয় দিতে থাকেন। ঐ সময় আমরা কতিপয় তরুণ লেখক-যশোপ্রার্থী বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একত্র হয়েছিলাম। সায়ীদ স্যার তখনও পর্যন্ত যৌবনতাড়িতের উদ্যমে শশব্যস্ত থাকেন। তাঁরই উৎসাহে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটা সাহিত্যসভা নিয়মিত চালানোর প্রয়াস নেয়া হয়েছিল। সেই সাহিত্যসভায় প্রতিষ্ঠিত লেখকদের অনেকেই আসতেন। মনে আছে সেই সাহিত্য সভায় এসেছিলেন আল মাহমুদ, আবদুশ শাকুর, রাহাত খানদের মতো প্রতিষ্ঠিত লেখকেরাও। আবদুল মান্নান সৈয়দও এসেছিলেন একদিন। আল মাহমুদের সঙ্গেও আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল সেই সময়ই। মনে পড়ে একদিনের সাহিত্যসভায় আমি একটা প্রবন্ধ পড়েছিলাম নজরুলের শিশুসাহিত্য বিষয়ে। তখন মাত্রই কলকাতার হরফ প্রকাশনী থেকে আবদুল আজিজ আল আমানের সম্পাদনায় নজরুল কিশোর সমগ্র বেরিয়েছে। আমার প্রবন্ধটি রচিত হয়েছিল ঐ বই অবলম্বন করে। প্রবন্ধটির রচনারীতিতে অনেক দুর্বলতা সত্ত্বেও আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রশংসা করেছিলেন। বলেছিলেন নজরুলের শিশুসাহিত্য নিয়ে আগে যে-সব লেখা হয়েছে তার তুলনায় কিছু নতুন উপলব্ধির পরিচয় রয়েছে এই প্রবন্ধে। নজরুলের শিশুসাহিত্যকে বড় মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মনে আছে সায়ীদ স্যার ছিলেন শেষের বক্তা। সায়ীদ স্যারও মোটের ওপর প্রশংসাই করেছিলেন প্রবন্ধটির। আমরা তখন সংবেদ বের করবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। গল্পকার পারভেজ হোসেন সাহস দেখাল পত্রিকা বের করবার। নজরুলের শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে আমার লেখাটি সংবেদ-এর প্রথম সংখ্যাতেই প্রকাশিত হলো। সেশনজটের কারণে আমি তখনও ঢাকা কলেজের স্নাতক পর্যায়ের ছাত্র। সায়ীদ স্যার দায়িত্ব পেলেন ঢাকা কলেজ বার্ষিকীর অভিভাবকত্বের। নজরুলের শিশু-কিশোর সাহিত্যের ওপর আমার লেখাটি ঢাকা কলেজ বার্ষিকীরও অন্তর্ভুক্ত করলেন। অনেক পরে মান্নান ভাইকে জিজ্ঞাসা করলে মান্নান ভাই সে-কথা মনে করতে পারেননি। কিন্তু ঐ সময়ে মান্নান ভাইয়ের সামান্য প্রশংসা পরোক্ষে আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাস দিয়েছিল। মান্নান ভাইদের গ্রিন রোডের পুরোনো বাড়িতে কত গেছি! বাড়িতে গেছি মানে তাঁর বাড়ির ভিতরে নয়, নীচ থেকে জোরে ‘মান্নান ভাই’ বলে ডাকলে তিনি দোতলার বরান্দায় এসে দেখা দিতেন। প্রায়শই শুধু গেঞ্জি গায়ে থাকা অবস্থায় দেখা দিয়েই শার্টে হাত গলাতে গলাতে নেমে আসতেন নিচে। তারপর কখনও তাঁর বড়ভাইয়ের ওষুধের দোকানে গিয়ে বসতাম আমরা। কখনও গিয়ে বসতাম গ্রিন রোডের কোনো খাবারের দোকানে। ‘ভোজনবিলাস’ নামে একটি দোকান সম্ভবত এখনও আছে। আর একটা মিষ্টির দোকান ছিল, নাম মনে নেই, সেখানে আমরা দীর্ঘ আড্ডা দিতাম। বালুশাই মিষ্টি খুব পছন্দ ছিল মান্নান ভাইয়ের। আমাদেরও সেটা খেতে বলতেন। মান্নান ভাই তখনও জীবনানন্দ নিয়ে নিমগ্ন। আমি তাঁর জীবনানন্দ-নিমগ্নতার যুগেই তাঁকে দেখেছি। তাঁর কাছেই প্রথম শুনেছিলাম যে জীবনানন্দ দাশের অনেক গল্প ও উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। তিনি ধারণা দিয়েছিলেন অন্তত ১৫টি উপন্যাস বা উপন্যাসোপম রচনা রয়েছে। গল্প আছে অন্তত ৫০টি। সাপ্তাহিক রোববার বা সাপ্তাহিক সচিত্র সন্ধানী পত্রিকায় তিনি জীবনানন্দ দাশ নিয়ে লিখছেন তখন। বাংলাদেশে আবদুল মান্নান সৈয়দ নামটি জীবনানন্দ দাশের নামের সঙ্গে ওতপ্রোত জড়িয়ে আছে। তিনিই প্রথম জীবনানন্দ দাশের অগ্রন্থিত কবিতাগুলোর একটা বড় অংশ গ্রন্থনা করে প্রকাশ করেছিলেন যা দুই বাংলার জীবনানন্দ চর্চাকারীদের উদ্দীপিত করেছিল। একটা সময় তিনি প্রায় একাকীই জীবনানন্দ গবেষণা চালিয়ে গেছেন। জীবনানন্দ দাশ নিয়ে তাঁর মত্ততা এতটাই প্রবল ছিল যে ১৯৮৪ সালে, একটা লিটল ম্যাগাজিনই প্রকাশ করলেন জীবনানন্দ নামে। যে দুটি সংখ্যা বেরিয়েছিল তার প্রতিটিতেই আমাকে লিখবার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বলা যায় জীবনানন্দ পত্রিকার সূত্রে আমাকেও তাঁর জীবনানন্দ চর্চার অংশী করে নেন। মান্নান ভাইয়ের আহ্বানে জীবনানন্দ পত্রিকায় জীবনানন্দের মাল্যবান উপন্যাসের ওপর আমি যখন সমালোচনা লিখি তখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কেউ বইটি নিয়ে লিখেছিলেন বলে মনে পড়ে না। পশ্চিমবঙ্গে অতীন্দ্রিয় পাঠক লিখেছিলেন শিবনারায়ণ রায়ের জিজ্ঞাসা পত্রিকায়। তার আগে বোধ হয় শুধু লিখেছিলেন অমলেন্দু বসু। আরেকটি রচনা ছিল, তাঁরই জীবনানন্দ দাশের সমালোচনাসমগ্র সম্পর্কে আলোচনা। আমি লক্ষ্য করেছি আমার নিজের জীবনানন্দ বিষয়ক লেখালিখির উদ্বোধন ঘটিয়েছিলেন তিনি। কয়েকদিন আগে আমাকে একদিন বলেছিলেন, ‘সায়ীদ ভাইকে এবং মনজুরে মওলা ভাইকে রবীন্দ্র চর্চায় নামিয়েছিলাম আমি। সায়ীদ ভাই তো লিখবেন না অন্যদের কথা, মওলা ভাই অবশ্য আমার কথা বইয়ের ফ্ল্যাপে উল্লেখ করেছেন। আপনিও লিখবেন! সম্পাদক হিশাবে আমারও কিছু অবদান আছে এই রকম!’ আজ তাঁর এইসব কথা মনে করে চোখ ভিজে আসছে। মান্নান ভাইও তাঁর জীবনের নানা অনুষঙ্গে সম্পৃক্ত অনেকের কথা লিখে গেছেন।
ব্যক্তি-সম্পর্ককে ভীষণ মূল্য দিতেন তিনি। দৈনিক সংগ্রামে লিখতেন বলে অনেক সময় আমি তিরস্কার করেছি তাঁকে। কয়েকমাস আগে এমন কথাও একদিন বলেছি যে, লোকে বলে জামাতিদের ভাতাপ্রাপ্ত লোক আপনি। আমার কথা শুনে খুবই কাতর হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সংগ্রামে আমার যেটুকু লেখালিখি তা আমার প্রথম দিককার শিক্ষকতা জীবনের ছাত্র সাজ্জাদ হোসাইন খানের জন্য। আপনি দেখুন দীর্ঘকালের ব্যক্তিগত সম্পর্ক তার সঙ্গে। এর মধ্যে কোনও জামাতি সংযোগ নেই। আমার লেখার বিষয় কী। আমি কী লিখি! টাকার বিনিময়ে আমি তো আমার অন্তরাত্মার কথাকে জলাঞ্জলি দিইনি কখনও!’
আবদুল মান্নান সৈয়দ ঠিক প্রচলিত অর্থে ধার্মিক না হলেও মুসলিম সমাজের মানুষ বলে মুসলিম ঐতিহ্যকে গ্রাহ্য করতেন।
আমি বললাম, বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না এসব। আপনার সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। আপনি অযথা কেন নিজের ওপর এ দায় নেবেন। আমি তাঁকে বারণ করলাম দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় না-লিখতে। এরপর সম্ভবত তিনি অবশিষ্ট লেখাগুলো প্রকাশ করা থেকে বিরত থেকেছিলেন। ব্যক্তি-সম্পর্কের ভালোবাসাকে তিনি যে খুবই গুরুত্ব দিতেন তার পরিচয় আমার বইয়ের জগৎ নিয়ে তাঁর মনোযোগ। আমার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি বিষয় নির্বাচন করতেন। আমি বলেছিলাম পত্রিকার পাতা আপনার ইচ্ছের পরিমাণে বরাদ্দ হলো। তাঁর লেখার যে স্টাইল সম্প্রতি গড়ে উঠেছিল তা নিয়ে বিশেষ করে লেখক-সাহিত্যিকদের মধ্যে এক ধরনের সংশয় ছিল। এ নিয়ে বইয়ের জগৎ তাঁর ওপর কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করেনি। তাঁর রচনাকে স্বাধীন সংরূপে সম্পন্ন হতে দিয়েছে। ঠিক একই ভাবে পুলক হাসান সম্পাদিত খেয়া এবং বিহঙ্গকাল পত্রিকায় লিখতে পছন্দ করতেন তিনি। ফোনে আমাকে বলতেন- ‘আমি এখন লেখা নিয়ে খালি পুলক আর মাযহার করছি’। মনে আছে ঈদসংখ্যার লেখা স্থগিত করে বইয়ের জগৎ-এর লেখা শেষ করেছেন। এইজন্য তাঁর রণেশ দাশগুপ্ত সম্পর্কিত দীর্ঘ অসাধারণ রচনাটি আমরা দিতে পেরেছিলাম বইয়ের জগৎ-এর ৪র্থ সংকলনে। আবদুল মান্নান সৈয়দ ঠিক প্রচলিত অর্থে ধার্মিক না হলেও মুসলিম সমাজের মানুষ বলে মুসলিম ঐতিহ্যকে গ্রাহ্য করতেন। প্রায়শই বলতেন, ‘আমি ভাই আল্লাওয়ালা লোক, তাই আল্লাই আমাকে অনেক কিছু পাইয়ে দেন।’ তাঁর সঙ্গে ইসলামি রাজনীতিপন্থী কিছু মানুষের ঘনিষ্ঠতা ছিল যা নিয়ে আমি অনেক কটু কথাও বলেছি বিভিন্ন সময়। কিন্তু তাঁকে মৌলবাদ সমর্থক মানুষ মনে হয়নি কখনো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধীও মনে হয়নি। তবে এ-কথা ঠিক সৈয়দ আলী আহসান, আল মাহমুদ প্রমুখের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল, বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক হয়েছিলেন সে-সরকারে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত কতিপয় মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কসূত্রে, রাজনৈতিক সংলগ্নতার কারণে নয়। কিন্তু নজরুল ইনস্টিটিউটের পরিচালক হিসাবে কি নজরুল চর্চায় কোনও প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছিলেন? তিনি যখন নজরুল ইনস্টিটিউটে কর্মরত তখন আমি চাকরিগত ব্যস্ততার কারণে সাহিত্যিক মহল থেকে দূরে ছিলাম। তখন একটি ছোট্ট ব্যাপারে তিনি আমার পরামর্শ নিয়েছিলেন। তিনি আমাকে একদিন বললেন আমার সূত্রেই জেনেছেন যে আবদুল হকের নজরুল চর্চা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং আবদুল হকের নজরুল বিষয়ক রচনার একটি সংকলন করতে চান। তিনি আরও বললেন যে একই ভাবে কাজী মোতাহার হোসেনের নজরুল বিষয়ক রচনা সংকলনও তিনি প্রকাশ করতে চান নজরুলন ইনস্টিটিউট থেকে। প্রয়াত কবি আতাউর রহমানের নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধেরও একটি সংকলন তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন বা করেছিলেন একই বিবেচনায় ।
যে-কয়জন লেখকের কথা বললাম এঁরা সকলেই প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির সাহিত্যিক ছিলেন। নজরুল চর্চায় তাঁর অবদানকে তো স্বীকার না করে উপায় নেই! এ-কথা ঠিক যে, তাঁর মধ্যে কিছু অপ্রকৃতিস্থতাও ছিল যা কখনও কখনও সীমা অতিক্রম করে যেত। সেটা আমরা জানি। জীবদ্দশায় অনেক খেসারতও তিনি দিয়েছেন এর জন্য। কারও স্মৃতিকথায় হয়তো তাঁর পাগলামির দিকও কিছু উঠে আসবে। কিন্তু তাঁকে আমি সাহিত্যনিমগ্ন হিসাবেই দেখেছি, ধান্ধাবাজ বুদ্ধিজীবী হিশেবে নয়। ব্যক্তিত্বের দুর্বলতা তাঁর অনেকই ছিল কিন্তু সাহিত্যের বাইরে অন্য আপসকে জীবনে বড় হয়ে উঠতে দেখিনি।
আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পর্কে কেউ কেউ বিরূপ ছিলেন ধর্মীয় মৌলবাদী ধারার কোনো কোনো মানুষের সঙ্গে তাঁর সখ্যের কারণে। আমি লক্ষ করেছি, নিজের সুবিধার জন্য তাদের কাছে যাননি তিনি। বরং সুবিধা নেয়ার জন্য তারাই মান্নান ভাইকে কাছে টেনে নিয়েছেন। আমার ধারণা একটু গভীরভাবে তাকালে লক্ষ্য করব, কেউ কেউ যে আপসের অভিযোগ আনেন তাঁর ওপর তার চেয়ে অনেক বেশি ধান্ধাবাজ আমাদের অনেক আপাত প্রগতিশীল লেখক আছেন যাঁদের প্রশস্তি চলে প্রগতিশীল মহলে।
আরও যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায় এই যে, আধুনিক কবি বা সাহিত্যিকদের মূল্যায়নের সময় গোটা কালের সাহিত্য-মানচিত্র বিবেচনা না করলে মূল্যায়ন সম্পন্ন হয় না।
মনে পড়ছে মান্নান ভাই ‘অন্তরাত্মা’ কথাটি বলতেন সবসময়। নিজের আব্বা-আম্মার কথা বলতেন। বলতেন তাঁর আব্বা যদি তাঁকে ঠিকমতো কৈশোর-তারুণ্যের কালটাকে গড়ে না-দিতেন তাহলে তিনি এতদূর আসতে পারতেন না। বলতেন তাঁর আম্মা তাঁকে বুঝতেন। কর্মজীবন ঠিক করবার পেছনেও আব্বার ভূমিকাকে মূল্য দিতেন। আমি মান্নান ভাইয়ের আব্বাকে দেখেছি বহুবার। মান্নান ভাইদের গ্রিন রোডের বাড়িটি যখন আদিরূপে ছিল তখন দেখেছি। মান্নান ভাইয়ের খোঁজে তাঁকে মূল ফটকের নিচ থেকে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ডাকতাম। মান্নান ভাই যদি বাড়িতে না থাকতেন তাহলে বারান্দায় এসে গম্ভীর কণ্ঠে তাঁর আব্বা বলতেন, “আবদুল মান্নান তো বাড়িতে নেই!”
তাঁর আব্বার রাশভারি ব্যক্তিত্বের খানিকটা তিনি নিজেও পেয়েছিলেন। অবশ্য কণ্ঠস্বরের মন্দ্রতা তাঁর আব্বার ছিল অনেক বেশি। কতদিন যে তাঁর আব্বা-আম্মার কথা আমাকে বলেছেন! ‘মান্নান সৈয়দ শিল্পকেন্দ্র’ থেকে মাঝে মাঝে চার বা আট পৃষ্ঠার ফোল্ডার বের করতেন তিনি। এর মধ্যে ছিল আমাদের আব্বা-আম্মা। এই প্রকাশনাগুলোকেও তিনি লিটল ম্যাগাজিন মনে করতেন। আমাকে প্রতিবার বেশ কয়েক কপি দিতেন বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে বিলি করবার জন্য। আশির দশকেই তিনি প্রধানত মুসলিম সমাজের বিস্মৃতপ্রায় লেখকদের নিয়ে লেখালিখি করতে শুরু করেন। আমার কাছে বৈপরীত্যময় মনে হতো ব্যাপারটা। যিনি লেখক হিসাবে এতটা আধুনিক, জীবননন্দ দাশের মতো কবিতে যিনি এতটা মজেছেন সেই তিনি কীভাবে অনাধুনিক মুসলিম লেখকদের নিয়ে অনুপুঙ্খ গবেষণায় নিমগ্ন থাকতে পারেন ভেবে অবাক লাগত। আশির দশকের শেষের দিকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম এর কারণ। বলেছিলেন, আমি যে সমাজের মানুষ সে-সমাজের সাহিত্যকে উপলব্ধি না করে আমরা সামনে যেতে পারব না। আমার সমাজের প্রতিও আমার কর্তব্য রয়েছে। আরও যা বলেছিলেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায় এই যে, আধুনিক কবি বা সাহিত্যিকদের মূল্যায়নের সময় গোটা কালের সাহিত্য-মানচিত্র বিবেচনা না করলে মূল্যায়ন সম্পন্ন হয় না। মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী বা কায়কোবাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-সাধকদের রচনাবলি সম্পাদনার পেছনেও ছিল তাঁর এই অর্থে সামাজিক দায় মোচনের প্রেরণা।
আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে গত কয়েক বছর এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলাম যে তাঁর বহু স্মৃতি এসে ভিড় করছে মনে। একটির সূত্রে মনে পড়ে অন্যটি। পারম্পর্য ধরে রাখাও কঠিন। তা ছাড়া আপাদমস্তক এমনই সাহিত্যনিমগ্ন ছিলেন তিনি যে তাঁর সঙ্গে আমার যে-সব স্মৃতি আছে সেগুলোও সাহিত্য সংশ্লিষ্ট বা সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি সংশ্লিষ্ট। ফলে তাঁর সম্পর্কিত স্মৃতিকথায়ও তাঁর সাহিত্যদৃষ্টির কথা আসবে। মনে হচ্ছে তাঁর একটা স্মৃতি যেন টেনে আনছে আরেকটা স্মৃতিকে! সুতরাং এই পারম্পর্যহীন স্মৃতিমালিকার একটা টুকরোই এখানে পেশ করা গেল। আরও অনেক স্মৃতির কথা আমি লিখতে থাকব।
১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১০
আহমাদ মাযহার
প্রাবন্ধিক-গবেষক-শিশুসাহিত্যিক-অনুবাদক-সম্পাদক। জন্ম ২৭ মার্চ ১৯৬৩, ঢাকায়। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। ২০১৭ থেকে নিউ ইয়র্কবাসী। বাংলা ভাষার লেখক, সাহিত্য-গবেষক ও সাংবাদিক। লেখার মাধ্যম: ছোটদের জন্য গল্প কবিতা ও নানা ধরনের গদ্য; সমাজ ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ ও সাহিত্য-সমালোচনা, অনুবাদ-রূপান্তর ও পুনর্কথনমূলক রচনা। রচিত-অনূদিত-সম্পাদিত বইয়ের সংখ্যা ষাটের অধিক। শিক্ষা ও সংস্কৃতিধর্মী প্রতিষ্ঠান বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গঠন যুগের দীর্ঘ ১৭ বছরের কর্মী। এছাড়াও ‘বইয়ের জগৎ’ নামে বই-সমালোচনা বিষয়ক একটি ত্রৈমাসিক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক।