আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সেতু সংস্কারের আহ্বান: চার দশকের মেরামতি | কাজী মহম্মদ আশরাফ

 

আমরা বাংলাদেশ নামের একটি বর্ধিষ্ণু গ্রামের অধিবাসী। এখানে উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত নামে তিনটি লোকালয় রয়েছে। এসব লোকালয়ের মানুষদের সহজ চলাচলের উপযোগী সেতুর অবস্থা ভগ্ন, সংস্কৃতির ভারী কোনও যান এ সেতু পার হতে পারে না… অবিলেম্বের সেতুটি মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

                                                                        এলাকাবাসীর পক্ষে
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের আবেদনটি কি আসলে এমন ছিল? ‘সংস্কৃতির ভাঙ্গাসেতু’ প্রবন্ধটি প্রকাশের চার দশক পূর্ণ হতে যাচ্ছে এ বছর। বিগত চল্লিশ বছরে এ প্রবন্ধটির পাঠের ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক, যাঁরা প্রবন্ধটি এখনও পড়েন নাই, তাঁদের বেশিরভাগ মানুষই মনে করেন, সেতুটি বোধহয় সাতচল্লিশে ভেঙেছে, আর এর পেছনে দায়ী দেশভাগ। ব্যাপারটি কি তাই? সে উত্তর অনুসন্ধান করার আগে কয়েকটি অনিবার্য সহজ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতেই হবে।

১। এ প্রবন্ধের সেতুটি ভাঙা কেন? কে ভেঙেছে? কবে ভেঙেছে? কেন এবং কীভাবে ভেঙেছে?

২। ইলিয়াস বলেছেন সংস্কৃতির সেতুর কথা, সংস্কৃতির সেতু ভাঙা হয় কেমন করে? আর এ ধরনের সেতু সংস্কারের উপায় কী?

৩। সেতুর দুই পারে কারা বাস করেন, তা ওপরের ছোট অক্ষরে এবং ডানদিকে কাত করে লেখা কাল্পনিক আবেদনপত্রটি থেকে বোঝা যাচ্ছে একই সমাজের কয়েকটি শ্রেণীর চলাচলের জন্য তৈরি করা ছিল, তা কোনও কারণে ভেঙে গেছে। সমাজের সাংস্কৃতিক সেতু কোনও না কোনও কারণে তা ভাঙা যেতেই পারে, ইলিয়াস কি সেই সেতু নতুন করে নির্মাণের কথা লিখেছেন নাকি ভাঙা অংশ মেরামত করার কথা বলতে চেয়েছেন? সেখানে কি আগে থেকে আদৌ কোনও সেতু ছিল? 

তিনটি প্রশ্নই সংলগ্ন, তাই উত্তরসন্ধানে যুগপৎ অভিযান চালাতে হবে। প্রথমেই তো জেনে নেওয়া উচিত সংস্কৃতি কাকে বলে, তার ধরন কী। উনিশশ চুরাশি সালে লেখা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এ প্রবন্ধের প্রথম অনুচ্ছেদে অপসংস্কৃতির কথাটা শ্লেষের সাথে লিখেছেন, অপসংস্কৃতি বিষয়টা না বুঝলে শ্লেষটা বোঝা যাবে না; আর অপসংস্কৃতি বুঝতে হলে সংস্কৃতি বুঝতে হবে।

সংস্কৃতি সম্পর্কে পূর্বধারণা: সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা করা কলমি খেতের মধ্যে মূল খুঁজে বের করার মতো। ড. আহমদ শরীফ বিষয়টিকে বলেছেন অন্ধের হস্তী দেখার মতো কাজ। দেশ-বিদেশের মনীষীদের মধ্যে সংস্কৃতি নিয়ে অনেক বাক্যব্যয় হয়েছে। তবে এখানে সংক্ষেপে একটু ধারণা নেওয়া যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, অন্নদাশঙ্কর রায়, গোপল হালদার, বিনয় ঘোষসহ অনেকেই বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। এপার বাংলায় আবুল ফজল, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আহমদ শরীফ, বদরুদ্দীন উমর, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, যতীন সরকার, আবুল কাসেম ফজলুল হকসহ অনেকেই লিখেছেন। প্রথমেই দেখা যাক গোপাল হালদারের কথা। তিনি লিখেছেন,

সংস্কৃতি বলিতে তাই শুধু যে ঘরবাড়ি, ধন-দৌলত, যানবাহন বুঝায় তাহাও নহে। শুধু যে রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান বুঝায় তাহাও নয়। সংস্কৃতি বলিতে মানবসম্পদও বুঝায়—চিন্তা, কল্পনা, দর্শন, ধ্যান-ধারণা, এই সবও বুঝায়,—তাহাও আমরা জানি। আসলে বাস্তব ও মানসিক সমস্ত ‘কৃতি’ বা সৃষ্টি লইয়াই সংস্কৃতি—মানুষের জীবনসংগ্রামের মোট প্রচেষ্টার এই নাম

            শ্রদ্ধেয় গোপল হালদার মানুষের সব রকমের কৃতির সমষ্টিকেই সবশেষে সংস্কৃতি বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। এই কৃতির মধ্যে আছে তাদের চিন্তা, কল্পনা, দর্শন, ধ্যান-ধারণা ইত্যাদি। এবার দেখা যাক ড. আহমদ শরীফের উক্তি, আগেই সংস্কৃতির আলোচনা সম্পর্কে তাঁর পূর্বধারণাটি উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি মনে করেন,  

যদিও সংস্কৃতিকে যদিও ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, স্পর্শ করা যায় না, কোন বস্তুর মত মূর্তিমান দেখা যায় না, তবু মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ডের মধ্যেই—অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিক, ধর্মীয়, ব্যবহারিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত ইত্যাদি সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই তার সংস্কৃতি নিহিত থাকে।

            আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতিভাবনা কিন্তু এই দুজনের চিন্তা থেকে বেশি দূরের নয়।

    

দুই

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধটি মূলত বাংলাদেশের বাম রাজনীতির এবং বাম আন্দোলনের কর্মীদের সাংস্কৃতিক শূন্যতা এবং গণবিচ্ছিন্নতার দলিল। এখানে তিনি বিচ্ছিন্নতার কারণগুলো নিজের মতো করে বলার চেষ্টা করেছেন। রচনাটিকে বদরুদ্দীন উমরের বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা (১৯৭৬) নামের গ্রন্থটি বোঝার ক্ষেত্রে কিছু অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দান করে, তাই এটিকে পরিপূরক প্রবন্ধও বলা যেতে পারে। প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিতও হয়েছিল বদরুদ্দীন উমরের সংস্কৃতি পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। স্মরণ রাখার বিষয় হলো সেবছরই তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরে যোগদান করে, সাংগঠনিকভাবে বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। বদরুদ্দীন উমর তাঁর গ্রন্থটিকে কাঠামোগতভাবে বিন্যাস করেছেন, সেখানে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনও বক্তব্য উপস্থাপন করা হয় নাই, স্বগোত্রীয় লেখক ইলিয়াস সে বিষয়গুলো সহজভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি তাঁর পাঠকদেরকে বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত করতে চেয়েছেন।

এখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, যাঁরা বাম ধারার রাজনীতি করেন না, কিংবা এ ধারার আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টতা নাই এবং সে মত ও পথকে সমর্থনও করেন না, তাঁদের কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এ প্রবন্ধটি আজ চার দশক পরে কোনও গুরুত্ব বহন করে কিনা। হ্যাঁ করে। আর সে দিক থেকে রচনাটির গুরুত্ব রয়েছে বলেই এখানে আলোচনা করা হচ্ছে। যাঁরা বাম রাজনীতি করেন না, কিন্তু সমাজ নিয়ে ভাবেন, কিংবা সমাজ নিয়েও ভাবেন না, শুধু সাহিত্য নিয়ে ভাবেন এমন যাঁরা আছেন, তাঁদের কাছে ইলিয়াসের প্রবন্ধটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। তাছাড়া যাঁরা ইলিয়াসের সাহিত্যের পাঠক, তাঁদেরও চার দশকের পুরনো এ লেখাটির পাঠ ও পুনঃপাঠ অনিবার্য।

ইলিয়াস এ-দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ঘোরবিরোধী ছিলেন। সুযোগ পেলেই তিনি মধ্যবিত্তের নানা রকম সমালোচনা করতেন। গল্পের ভেতর দিয়ে এ শ্রেণীটাকে বেশ নাজেহালই করেছেন। প্রশান্ত মৃধা ও আলাউদ্দিন মণ্ডল।] একটা সমস্যাকে উল্লেখ করেছেন এভাবে,

বুর্জোয়া দেশগুলোর উচ্চবিত্তের জীবনযাপনকে আদর্শ ধরে নিয়ে সেটাকেই অন্ধভাবে অনুসরণ করতে শুরু করে। কিন্তু বুর্জোয়া মূল্যবোধ ও মানসিকতা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ওদিকে উপরের ধাপে ওঠার জন্য মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত এতই উদগ্রীব ও অস্থির যে এজন্য হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা-ই সে আঁকড়ে ধরে।

ইলিয়াস যে প্রবণতার কথা এখানে লিখেছেন, গত চল্লিশ বছরে কি তা বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজ ও সংস্কৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়েছে? না। হ্রাস পেয়েছে? তা-ও না। তাহলে? বৃদ্ধিটা সবার চোখেই পড়ে। ইলিয়াস সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটা শুরুতেই উল্লখ করেছেন। এ শব্দটা নিয়ে অনেক কথা আছে। অনেকেই এর অস্তিত্ব স্বীকার করেন না। ইলিয়াস সেটির একটা রূপ দেখাতে চেষ্টা করেছেন এভাবে,

আমাদের মধ্যবিত্তের জীবনযাপন কিংবা ইপ্সিত জীবনযাপন এবং মূল্যবোধ পরস্পরবিরোধী। এদের জীবন তাই নিরালম্ব, এই জীবনের ভিত্তি, বিন্যাস ও তাৎপর্য খুঁজে বের করা কঠিন। এদের সংস্কৃতিও উটকো ধরনের হবে এতে সন্দেহ কী? সামন্ত ও গ্রাম্য মূল্যবোধের সঙ্গে বুর্জোয়া জীবনযাপনের এই উৎকট মাখামাখির ফলে যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে তাও অনেকের চোখে উটকো ঠেকে এবং তখন তাকে অপসংস্কৃতি বলে গাল দেওয়া হয়।

            লক্ষ্যণীয় যে, ইলিয়াস এখানে বলেছেন “গাল দেওয়া হয়।” বিষয়টি মনে রাখার মতো। কারণ, কারা দেয় তা স্পষ্ট করেন নাই। তিনি মনে করেন বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যাঁরা বিশুদ্ধ সংস্কৃতিচর্চা করছেন, সংস্কৃতির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা নিম্নবিত্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষ তো দূরের কথা, সাধারণ এবং ‘আরোগ্যপিপাসু’ মধ্যবিত্তের মধ্যেও তাঁরা কোনও রকম সাড়া জাগাতে পারছেন না। সৃষ্টিশীল শিল্পীদের হাতে সংস্কৃতির যে নান্দনিক ও উদ্দীপনাময় প্রকাশ ঘটার কথা তাও তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। সংস্কৃতিচর্চার সাংগঠনিক প্রকাশ শিল্প-সাহিত্যের মাধ্যমগুলোতে যা দেখা যেত তখন, তা দিন দিন নির্জীব ও একঘেয়ে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। সাহিত্য-চলচ্চিত্র এবং সংগীতে কেবল পানসে এবং পুনরাবৃত্তি চলেছে মনে হয় হয় তাঁর।

            আবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক, ইলিয়াসের এই অনুভব ১৯৮৪ সালের। বিগত চল্লিশ বছরে কি সে অবস্থার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে? তখন একটাই টেলিভিশন ছিল, এখন দেশি-বিদেশি মিলিয়ে শত শত, ইলিয়াস এ অবস্থা দেখে যেতে পারেন নাই। এখন আকাশসংস্কৃতি উন্মুক্ত, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো নানা সুবিধাজনক উপায় আবিষ্কৃত হয়েছে, জনপ্রিয়ও হয়ে উঠেছে, কিন্তু ইলিয়াসের মন্তব্যগুলোর যুক্তিখণ্ডন করার মতো সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কি ঘটেছে?

            ইলিয়াস স্বীকার করেছেন যে, কথাসাহিত্যে তখন আঙ্গিকগতভাবে আগের চেয়ে মার্জিত এবং পরিণত হয়ে উঠেছিল। সুখপাঠ্য অনেক গল্প-উপন্যাস  বেরিয়েছে, কিন্তু সেগুলো নিয়ে তাঁর মনে হয়েছে,

একই ব্যক্তি বিভিন্ন নামে নানা কায়দায় একটিমাত্র কাহিনী বয়ান করছেন। সেই কাহিনীও আবার নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে লেখা নয়, তিরিশের দশকের কোনো প্রতিভাবান বা চল্লিশের কোনো বুদ্ধিমান লেখকের অভিজ্ঞতা বা পর্যবেক্ষণের তরল ও বিকৃত সংস্করণ। ঢাকার রম্য সাপ্তাহিকগুলোতে বিভিন্ন পালাপার্বণে বছরে কম করে ডজন দেড়েক উপন্যাস বেরোয়। ঈদের জুতো-কাপড়ের সঙ্গে মধ্যবিত্ত ঐসব পত্রিকার দু-একটি কেনে এবং কয়েকদিনের মধ্যে সব লেখা পড়েও ফেলে। একটু তদন্ত করলে দেখা যায় যে এগুলোর বিষয়বস্তু প্রায় একই ধরনের—ছিঁচকাঁদুনে প্রেম ও ধরি-মাছ-না-ছুঁই পানিমার্কা সেক্সের সঙ্গে উদ্ভট ও অভিনব বিপ্লবী চটকাবার ফলে এগুলো বেশ আঠালো হয় এবং পাঠক একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা এর সঙ্গে সেঁটে থাকেন। পাঠকদের সেঁটে রাখার কায়দা লেখকদের বেশ ভালোই রপ্ত হয়েছে। এজন্য এদের জাদুগির বলে হাততালি দেওয়া যায়, কিন্তু শিল্প বলে মেনে নেওয়া মুশকিল।

            গত চল্লিশ বছরে এ অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে? সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ঈদসংখ্যা বিচিত্রা, রোববার, পূর্বাণী, চিত্রালী এসবের জায়গায় এখন আছে দৈনিকগুলো। আর আশির দশকের মাঝামাঝির ওই সময়ের জনপ্রিয় যেসব লেখকের কথা ইলিয়াস এখানে ইঙ্গিতে বলেছেন তারা কারা? প্রথমেই তো চোখ যাবে হুমায়ূন আহমেদের দিকে তাই না? এছাড়া রশীদ করীম, সৈয়দ শামসুল হক, রাহাত খান, হাসনাত আবদুল হাই, আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন, আমজাদ হোসেন, জুবাইদা গুলশনা আরা, দিলারা হাশেম, রাজিয়া শামস, রিজিয়া রহমান, সেলিনা হোসেন, মকবুলা মনজুর, ঝর্নাদাস পুরকায়স্থ প্রমুখ,—এঁরাই তো ছিলেন তখনকার জনপ্রিয় লেখক। 

            এবার মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক। ইলিয়াস জানেন বলেই উল্লেখ করেছেন, এদেশের বামপন্থী ধারার রাজনৈতিক কর্মীদের অধিকাংশই আসেন সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণী থেকে। ছোটবেলা থেকে তাঁরা মেধাবী হন, তাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্থাৎ সিলেবাসভুক্ত পরীক্ষাপাসের পড়াশোনার বাইরেও তাদের পড়শোনার অভ্যাস থাকে, দেশ-বিদেশের নানা ধরনের বই-পুস্তক পড়ে থাকেন। বয়সবৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁরা নিজেদের পঠিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে নিজের বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে চারপাশের সমাজ ও পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন। এভাবে মেলাতে গিয়ে তাঁদের আত্মপরিচয় গড়ে ওঠে, নিজেদের করণীয়গুলো সম্পর্কেও তাঁরা সচেতন হন। এর ফলে তাঁরা পরিবারের দাবিগুলো, শ্রেণী উত্তরণের প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেন না। ন্যায়-নীতি, বোধ ও বিবেচনা নিয়ে সব রকমের অন্যায়-অনিয়ম, দুষ্কৃতী-দুর্নীতি এড়িয়ে চলেন। সমাজের শ্রেণীবিভাজন ও শোষণের স্বরূপটা অনুধাবন করেন। রাজনৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক অভিজ্ঞতা থেকে তাঁদের মনে আসে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয় এবং সমাজে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি। মনের গোপনে লালিত এই সংকল্পগুলো দিনে দিনে বড় হতে থাকে বলে কারও মধ্যে অপরাধবোধ কাঁটার মতো মনে গেঁথে যায়। সুবিধাপ্রাপ্তি এবং সুবিধাভোগ তার কাছে অন্যায় বলে বিবেচিত হয়। এভাবে তারা নতুন সমাজ নির্মাণ এবং শ্রেণীহীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে বাম ধারার রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রামে যোগ দিতে ইচ্ছুক হন।

            তবে তাঁরা যখন সংগঠনের প্রয়োজনে কাজে নেমে পড়েন, তখন নানা রকম সমস্যায় পতিত হন। এ বিষয়টা নিয়ে ইলিয়াস লিখেছেন ক্রমান্বয়ে, এভাবে,

কিন্তু সৎ ও নিষ্ঠাবান দৃঢ়চেতা ও সংকল্পবদ্ধ রাজনৈতিক কর্মী শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে নানারকম অসুবিধার সম্মুখীন হন। শ্রমজীবীদের মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগ বাস করেন গ্রামে, তাঁরা প্রায় সবাই নিরক্ষর। সৎ ও নিষ্ঠাবান শিক্ষিকত মানুষের সঙ্গে তাঁদের পরিচয় একেবারেই নেই বললেই চলে। কিন্তু শৈশবকাল থেকে তাঁরা বড় হন কঠোর পরিশ্রমের মধ্যে। নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও ঘোরতর প্রতিকূলতার মধ্যে মানুষ হওয়ায় বুদ্ধিশুদ্ধি তাঁদের কম নয়, বামপন্থি কর্মী ছেলেদের ঠিকভাবে শনাক্ত করতে তাঁদের ভুল হয় না। শ্রমজীবী মানুষ বোঝেন যে লেখাপড়া  শিখেও এই ছেলেগুলো টাউট হয়নি এবং ধর্ম বা জাতীয়তাবাদ বা গণতন্ত্রের বুলি কপচানো ও ভোট বাগানো তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। বামপন্থি কর্মীদের নিষ্ঠা ও সততা সম্পর্কে তাঁরা নিঃসন্দেহ।

            আশির দশকের বামপন্থী রাজনৈতিক তরুণ কর্মীদের প্রশংসা ইলিয়াস শ্রমিক শ্রেণীর মুখ দিয়ে বের করেই যেন এখানে ছািপয়ে দিয়েছেন। সে সময়কার বামদলের কর্মীদের এ পরিচয়টা সর্বজনবিদিত, এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এত ত্যাগ ও নিষ্ঠা নিয়ে কেন বাম আন্দোলন দেশে দিনে দিনে সংকুচিত হয়ে আসছে? কেন এই তরুণরা ব্যর্থ হচ্ছে? ইলিয়াসও সে কথাটা বলেছেন, তিনি মনে করেন উনসত্তরের গণ-আন্দোলনটা বামপন্থীরা শুরু করলেও তাঁরা সমাজ-পরিবর্তনের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে পারেন নাই। এরপর তিনি প্রশ্ন রেখেছেন,

আন্তরিকতা, নিষ্ঠা ও সংকল্প নিয়েও বামপন্থি কর্মীগণ শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে পারছে না কেন? পার্লামেন্টারি রাজনীতির টাউট নেতাদের ওপর বীতশ্রদ্ধ শ্রমজীবীগণ বামপন্থি কর্মীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ না কেন? এর প্রধান কারণ শ্রমজীবীদের সঙ্গে বামপন্থি কর্মীদের সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা দূর করতে না পারলে শ্রমজীবী মানুষের আস্থা ও আত্মীয়তা লাভ করা অসম্ভব।  

            এতক্ষণে কি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই সংস্কৃতির ভাঙ্গাসেতু প্রবন্ধটির চার দশক পরে এর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। এ সময় কি বাম দলের নেতা ও কর্মীদের অবস্থা কিংবা অবস্থান আগের মতো আছে? বিগত চল্লিশ বছরে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু সেই ত্যাগী কর্মীর সংখ্যা আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কিংবা জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে বৃদ্ধি পেয়েছে? কেন পায় নাই? ওই যে বিচ্ছিন্নতা—ওটাই মূল কারণ। ইলিয়াস যেটি বলেছেন তা হলো, দেশের শ্রমজীবী জনসাধারণ তাঁদেরকে চেনে, কিন্তু যেটি বলেন নাই সেটি হলো, “এঁরা জনগণকে চিনতে পারে নাই।” বাম রাজনীতির ছোট লাইফবোটে চড়ে স্রোত পেরিয়ে বুর্জোয়া জাহাজে উঠতে পারলেই যেন তাঁরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। লেজুড়বৃত্তি থেকে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাওয়ার নতুন প্রবণতা এখন জাতির সামনে উদাহরণ হয়ে আছে।                     

            এবার যাওয়া যাক পরিপূরকহিসাবে বিবেচিত প্রবন্ধটির উৎসে, মানে বদরুদ্দীন উমরের কথায়। তাঁর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৬ সালে। এর বেশিরভাগ লেখা এবং পর্যবেক্ষণ পাকিস্তানি আমলের। দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে সামান্য সঞ্চয় হয়তো গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে পরবর্তী সংস্করণগুলোতে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতির সারাংশও সন্নিবেশিত করেছেন। ইলিয়াস তরুণ কর্মীদের যতটা ন¤্রভাবে দেখেছেন, উমর সেভাবে দেখেন নাই, আর দীর্ঘদিনের বাম রাজনীতির তত্ত্ব ও বাস্তবতা তঁকে যে অভিজ্ঞতা দিয়েছে, তার গভীরতা বেশি, তাই তিনি বলতে পারেন,

এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে তত্ত্বচর্চা ও তাত্ত্বিক বিতর্কের নামে যা হয়েছে তার মধ্যে প্রকৃত তত্ত্বের দেখা কদাচিৎ পাওয়া যায়। অধিকাংশই মুখস্ত বিদ্যা, তোতাপাখির বুলি অথবা নিতান্তই আত্মমুখী চিন্তা। সেগুলির সাথে মার্কসীয় বিপ্লব তত্ত্বের কোন সম্পর্ক নেই, দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাস্তবতারও নেই কোন সম্পর্ক। ১০

           

                বদরুদ্দীন উমর এখানে সুঁইয়ের খোঁচায় রঙিন বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন। যাঁরা শিল্প-সাহিত্য ও রাজনীতির নানা তত্ত্ব ও তথ্যের ভারে নিজেদেরকে সমাজের অন্য দশজনের থেকে ভিন্ন মনে করেন, বুর্জোয়া জাহাজে উঠে অনেক উঁচু থেকে নিরক্ষর জনগণের দিকে করুণভাবে তাকান, প্রতিপক্ষের বিভিন্ন পেশাজীবীদেরকে ‘তোতাপাখি’ আখ্যায়িত করে বলে অভ্যাস রপ্ত করে নিয়েছেন, তাঁদেরকেই উমর তোতাপাখি বলে অভিহিত করেছেন। লাইফবোট হারিয়ে তাঁরা আর কোনওদিন কিনারে ওটার সুযোগ পাবেন না।

            একই গ্রন্থের বাঙলাদেশের বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা প্রবন্ধে বদরুদ্দীন উমর আরেকটু ভিন্নভাবে বিষয়টি তুলে এনেছেন। এখানে বুদ্ধিজীবী বলা হয়েছে কাদের? বুর্জোয়া শ্রেণীর যে-সব বুদ্ধিজীবী আছেন, দেশের সবাই যাঁদেরকে গণমাধ্যমে চেহারা দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তাঁরা নন, তিনি মনে করেন, “বুদ্ধিজীবী মাত্রই কমিউনিস্ট নন, কিন্তু কমিউনিস্ট মাত্রই বুদ্ধিজীবী।” ১১ এই সংজ্ঞাটা মাথায় থাকলে উমরের এবং ইলিয়াসের কথাগুলো ত্রিভুজের তৃতীয় বিন্দুতে মেলানো সম্ভব হবে। না, জোর করে নয়, আপনা থেকেই দুজনের চিন্তা একটি জায়গায় পৌঁছে যাবে। সেটি হলো, ইলিয়াস নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে উঠে আসা তরুণ বামপন্থি কর্মী বলেছেন যাঁদেরকে, উমর তাঁদেরকেই বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন, ওপরের ছোট সংজ্ঞাবাচক বাক্যটি তাই বোঝায়।

            বদরুদ্দীন উমর কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা আলোচনা করতে গিয়ে প্রধানত তিনটি ক্ষেত্রে তাঁদের বাস্তবকাজের পর্যালোচনা করার কথা বলেছেন, এগুলো হলো:

(ক) মার্কসবাদের সাধারণ প্রচার এবং সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতির বিরোধিতা;
(খ) শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে রাজনৈতিক কাজ এবং
(গ) রাজনৈতিক কাজের সাথে সাথে শ্রমিক কৃষক ক্যাডারদের আদর্শগত ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়ন ও তাদেরকে নেতৃত্বের উপযোগী করে তোলা।

উমর তৃতীয় এ ধারাটিকে তিনটি উপধারায় ভাগ করে আলোচনা করেছেন। এরমধ্যে দ্বিতীয় বা (খ) উপধারায় তিনি যে কথাটি বলেছেন সেটিই গিয়ে মিলিত হয় ত্রিভুজের তৃতীয় কোণে, ইলিয়াসের কথার সাথে, দেখা যাক তাঁর উক্তিটি:

বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীরা এদেশের শ্রমিক কৃষকদের মধ্যে কাজ করেছেন। তাঁরা রাজনৈতিক প্রচার কার্য চালিয়েছেন এবং সংগঠনের কাজও করেছেন। এইভাবে কাজ করার ফলে শ্রমিক আন্দোলন ও কৃষক আন্দোলন এ দুইই এদেশে অনেকখানি সংগঠিত হয়েছে এবং সময়ে সময়ে সেইসব আন্দোলন অনেক জোরদারও হয়েছে। কিন্তু এইভাবে কাজ করার সময় তাঁদের কাজের ধারা ও পদ্ধতির মধ্যে অনেক রকম মারাত্মকত্রুটি থাকার জন্যে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীদের সাথে সেই কৃষক আন্দোলন একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ক্রমশঃ উচ্চ থেকে উচ্চতর পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এই ব্যর্থতার কারণ তাঁদের মধ্যে কাজ করা সত্ত্বেও শ্রমিকদের কৃষকদের থেকে বুদ্ধিজীবীদের একটা বিচ্ছিন্নতা।১২

            বদরুদ্দীন উমর যে বিচ্ছিন্নতার কথা আগে বলেছেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস পরে সেই বিচ্ছিন্নতার কথাই লিখেছেন তাঁর সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু প্রবন্ধে, আর সেতুটির ভাঙনটাই সেখানে। ওখানেই তো প্রয়োজনীয় পিলার, বিম, স্প্যানগুলো তৈরি করে যুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশের বামপন্থী কর্মীদের এই গণবিচ্ছিন্নতার কথা যদি তাঁরা স্বীকার না করেন, কিংবা সেটি দূর করার চিন্তাটি গভীরভাবে না ভাবেন, তাহলে তাদের মস্তিষ্কই ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। যদি ভাঙন হয় কোনও ব্যক্তির হাতে বা পায়ে, তাহলে ওখানেই তো সুচিকিৎসার প্রয়োজন, হাড় জোড়া লাগানো, কাঁটা-ছেঁড়া-সেলাই সব করার কথা এবং যথারীতি ব্যান্ডেজ করার কথা, তাতে কাজ হয়তো থেমে থাকত, কিন্তু চিন্তা এবং চেতনার পথ রুদ্ধ হতো না, যা এখন খুবই প্রকটভাবে দেখা যাচ্ছে।  

            এই বিচ্ছিন্নতার কারণ এবং পরিণতি কী? সেটা ইলিয়াসের রচনা থেকেই দেখা সম্ভব, আর সেটাই উচিত। তিনি কয়েকটি কারণকে মুখ্য বলে মেনে করে আলোচনা করেছেন। যেমন:

                        ১। দারিদ্র্য: বামপন্থী কর্মীরা দেশের দরিদ্র মানুষকে শুধু দরিদ্রহিসাবেই জানে। মানুষকে এভাবে দেখা এবং চেনাটা ইলিয়াসের মতে ‘মানব অপমান’। মানব-অপমানের এই দিকটি বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সপ্তরথীর অন্যতম আবুল ফজলের (১৯০৩—৮৩) চিন্তাপ্রসূত। তিনি তাঁর মানবতন্ত্র গ্রন্থের ‘মানব-কল্যাণ’ প্রবন্ধে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন; মানুষকে ছোটভাবা, করুণা করা, সামান্য একমুষ্ঠি ভিক্ষা দেওয়া মানুষের মর্যাদা হ্রাস করে। ইলিয়াসও তাই মনে করেন।

দারিদ্র্য দিয়েই নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীকে সম্পূর্ণ চেনা যায় না। তাঁর জীবনযাপনেনে মানবিক মূল্যবোধসমূহের বিকাশ আছে এবং হাজার হাজার বছরের শোষণ তাঁর সুকুমার বৃত্তিকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। তাই তাঁর যথার্থ পরিচয় লাভের জন্য তাঁর সংস্কৃতিকে জানা একেবারে প্রথম ও প্রধান শর্ত।১৩

                        দারিদ্র্য কারও পরিচয় হতে পারে না। তা যত ভয়াবহ হোক, যত প্রকট হোক। মানুষহিসাবে তাঁকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার কথা বলেছেন ইলিয়াস। তিনি আরেকটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, “দারিদ্র্যের সঙ্গে একটি ধর্মবিশ্বাসও তিনি বাপ-দাদার কাছ থেকে বহন করে এনেছেন। যদিও ধর্মচর্চার ব্যাপারে ভদ্রলোকদের সঙ্গে তাঁর সম্পূর্ণ মিল নেই।”১৪ ইলিয়াসকে এ বিষয়গুলো লিখতে হয়েছে কেন? তাঁর চোখে ধর্মসম্পর্কিত পার্টির কর্মীদের চিন্তাগুলোত্রুটিহিসাবে ধরা দিয়েছে। দরিদ্রশ্রেণীর বা নিম্নবিত্তের মানুষের ধর্ম ও দর্শন কিংবা বিজ্ঞান-প্রযুক্তিবিষয়ক ধারণাগুলো এই চল্লিশ বছর পরেও বামপন্থী, বস্তুবাদী কিংবা প্রগতিশীল শ্রেণীর মানুষের কাছে হাসি-ঠাট্টা ও তামাশার বিষয় বলে গণ্য হয়। আর এই ধর্মপালনকে কেন্দ্র করে সমকালীন প্রগতিশীল তরুণদেরকে সমাজের শাসকের বিপরীতে কথা না বলে শাসিত দরিদ্র মানুষদের বিপক্ষেই সোচ্চার হতে দেখা যায়।

                        ২। সংস্কৃতি: ইলিয়াস মনে করেন “আস্ত মানুষ কখনো সংস্কৃতিশূন্য জীবনযাপন করতে পারে না।”১৫ যে মানুষ সমাজে বাস করেন, যাঁর চিন্তা-ভাবনা আছে, শোক-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, রাগ-অনুরাগ ও ক্রোধ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করার ভাষা ব্যবহার করতে জানেন তাঁর সংস্কৃতিচর্চা আছে বলেই ধরে নিতে হবে। কিন্তু আমাদেরটা সংষ্কৃতি, আর ওদেরটা অপসংস্কৃতি, অনুন্নত সংস্কৃতি এভাবে দেখলে বিচ্ছিন্নতা তো সৃষ্টি হবেই, দূরত্বও বৃদ্ধি পাবে। দরিদ্র বা নিম্নশ্রেণীর মানুষের সাংস্কৃতিক পরিচয় জানা না থাকলে বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য তা হবে চরম একটা ভ্রান্তি। ইলিয়াস বলেন,

তাঁর সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে পরিচিত হতে না-পারলে তাঁকে অন্তরঙ্গভাবে চেনা খুব কঠিন, অসম্ভবও বলা চলে। কিন্তু শিক্ষিত বামপন্থি বেশিরভাগ সময় ব্যাপারটি খেয়াল করেন না। তাঁরা মনে করেন যে, সংস্কৃতিচর্চা সীমাবদ্ধ কেবল মধ্যবিত্তের মধ্যে। বর্তমান সমাজব্যবস্থা ভেঙে ফেলবার পক্ষে একটি প্রধান যুক্তি হল এই যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষ কেবল খাওয়া-পরা থেকে বঞ্চিত নন, সংস্কৃতিশূন্য একটি জীবনযাপন করতে তাঁরা বাধ্য হচ্ছেন।১৬             

            এই যে, নিম্নবিত্তের মানুষকে সংস্কৃতিহীন বা আনকালচার্ড মনে করা, এটা ইলিয়াস ভালো করেই লক্ষ্য করেছিলেন। ঔপনিবেশিক প্রভুশক্তিগুলো যেমন ‘আমরা’ আর ‘ওরা’, এভাবে জনগণকে দুইভাগে ভাগ করে, ঠিক তেমনই এদেশের বামপন্থী কর্মীরাও নিজেদের শিক্ষিত, মুক্তমনা, প্রগতিশীল, সংস্কারমুক্ত, বস্তুবাদী-বাস্তববাদী বলে দাবি করে, আর অনুন্নত শ্রেণীর মানুষদেরকে ঠিক বিপরীত মনে করে, এই কলোনিয়াল মানসিকতা ইলিয়াসের দৃষ্টিতে পড়েছে বলেই তিনি বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন। অপরের সংস্কৃতি মানেই অপসংস্কৃতি, অপছন্দের সংস্কৃতি মানেই অপসংস্কৃতি—এ ধারণাটা যে কত বড় ভুল, সেটিই ইলিয়াস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।

                        ৩। রুচি: শিক্ষিত ও বইপড়–য়া বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীরা নিজেদেরকে যথেষ্ট উন্নত মনে করলেও নিম্নবিত্তের সাধারণ মানুষের রুচিকে উন্নত মনে করবে তো দূরের কথা সেটা রুচি বলে স্বীকারই করতে চায় না। নিচেদের রুচিকে ‘সুরুচি’ আর নিম্নবিত্তের, শ্রমিকদের, কৃষকদের বা আরও অনুন্নত পেশার অন্যদের রুচিকে ‘কুরুচি’ বলে অভিহিত করেন বলেই গণবিচ্ছিন্নতায় ভোগেন; ইলিয়াস এ  বিষয়টিও আলোচনায় এনেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীদের কথায় প্রবাদ-প্রবচন ও উপমা-উৎপ্রেক্ষা ব্যবহার করার প্রবণতা অনেক বেশি। তাঁরা প্রবাদ-প্রবচন, ডিস্টান বা দৃষ্টান্ত, শুলুক বা শ্লোক, ছড়া,  ও উপমা-উৎপ্রেক্ষার সাহায্যে তাঁরা নিজেদের বাক্য অলংকৃত ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। বেশিরভাগ সময় সরলবাক্য দিয়ে কথা বলেন, এটা তাদের সারল্যেরই অভিব্যক্তি। তবে সরল বাক্যের ভেতরও তাঁরা এসব অলংকার ব্যবহার করে বাক্যতে তীব্র কিংবা আকর্ষণীয় করে তোলেন। এর সাথে মধ্যবিত্তের বামকর্মীদের ভাষার রুচিগত বিরাট পার্থক্য রয়েছে, ইলিয়াস বলেন,

মধ্যবিত্তের রুচির সঙ্গে এসব প্রায়ই খাপ খায় না, তাদের কাছে এইসব প্রবাদ বা শ্লোক বা ছড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচনভঙ্গি পর্যন্ত অশ্লীল বিবেচিত হতে পারে। কিন্তু এই প্রকাশ তাঁদের জীবনযাপন ও চেতনার এত গভীর থেকে বেরিয়ে আসে যে শ্রমজীবীদের কাছে এসবের শ্লীল-অশ্লীলতার প্রশ্নটি একেবারে গৌণ। আর মধ্যবিত্তের রুচিরও বলিহারি! টিভি ও সিনেমায় অভিনয়ের নামে স্বদেশি-বিদেশি মেয়ে-পুরুষদের চোখমুখ ও কণ্ঠের ন্যাকামি ও ছ্যাবলামি দেখে এরা অভিভূত, আর নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীর মুখের ভাষা শুনে এঁদের কান একেবারে লাল হয়ে ওঠে।১৭   

            ওপরের আলোচনা থেকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভেতরটা যেমন দেখা যায়, ভবিষ্যতে যে তিনি খোয়াবনামার মতো এক বিশাল কীর্তি স্থাপন করবেন, তিল তির করে সঞ্চিত হচ্ছে সেই উপন্যাসের শক্ত ভিত্তি; তা অনুমান করা যায়। আরও প্রমাণ পাওয়া যাবে, তবে বিচ্ছিন্নবাদিতার আলাপটি সেরে নেওয়া যাক। এই যে রুচির পার্থক্য নিয়ে ফরাসি উপন্যাসের বুর্জোয়া চরিত্রের মতো বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের নিম্নবিত্তরুচি দেখে নাক সিঁটকানোর ব্যাপারটা ইলিয়াস আরেকটু কড়া ভাষায় লিখেছেন, “বুদ্ধিজীবীরা সেখানে ব্রাহ্মসমাজসুলভ সুরুচি ও সুনীতির বচনে মুখর। এইসব ব্যাপারে বামপন্থি বুদ্ধিজীবীরাও শুচিবায়ুগ্রস্ত।”১৮ 

            এসব লক্ষণ কি বাংলাদেশের উপন্যাসে সেই আশির দশকে ছিল? এখনও কি আছে? এই না-থাকাটাই খোয়াবনামা রচনার প্রেরণা। এদেশের কথাসাহিত্যে নিম্নবিত্ত শ্রেণীর কথা প্রচুর পাওয়া যায়, কিন্তু সেসব উপন্যাসের চরিত্র এবং গঠন কোন শ্রেণীর রুচিতে গড়ে উঠছে? ইলিয়াস এখানে প্রশ্ন রেখেছেন, “শ্রমজীবীর জীবনযাপন, তাঁর ভুলভাল বা ঠিকঠাক বিশ্বাস, তাঁর সংস্কার ও কুসংস্কার, তাঁর পছন্দ-অপছন্দ, তাঁর রুচি, তাঁর ভাষা ও প্রকাশ, তাঁর শক্তি ও দুর্বলতা, তাঁর ভালোবাসা ও হিংসা—এসব নিয়েই তো তাঁর সংস্কৃতচর্চা, তাঁর সংস্কৃতির এই পরিচয় বাংলাসাহিত্যে কোথায়?১৯

            এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই তো তাঁর কাৎলাহার বিলের চারপাশে ঘোরাঘুরি। সেখানে গিয়েই তিনি খুঁজে পেয়েছেন একটি জনগোষ্ঠীর সত্যিকার কতগুলো সত্য। সেসব সত্য তিনি উপন্যাস রচনার দশ বছর আগেই আবিষ্কার করতে শুরু করেছিলেন। এর মাঝে আরেকটি ব্যাপার ঘটেছে, সেটি হলো নাইজেরিয়ার লেখক চিনুয়া আচিবের থিংস ফল অ্যাপার্ট পাঠ করার বিশাল অভিজ্ঞতা। এ প্রবন্ধেই তিনি সে উপন্যাস পাঠের মাধ্যমে লব্ধ নতুন অভিজ্ঞতাটি তুলে ধরেছেন,

সাম্প্রতিককালে আফ্রিকান উপন্যাসে আমরা অন্যরকম দৃষ্টান্ত পাই। নাইজরিয়ি লেখক চিনুয়া আচিবির উপন্যাসে নাইজরিয়ার গ্রাম্যজীবনের গভীর ভেতরে ঢোকার সফল প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায়। সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের পরিচয় তো আছেই, উপরন্তু সেই জীবনযাপন জীবন্ত হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষার প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক এবং তাদের বিশ্বাস ও সন্দেহ, সংস্কার ও কুসংস্কারের অপূর্ব ব্যবহারের ফলে। এই উপন্যাসগুলো ইংরেজিতে লেখা। অথচ সম্পূর্ণ আলাদা—সবদিক থেকেই আলাদা—ভিন্ন মহাদেশীয়, ভিন্ন সভ্যতার, ভিন্ন রুচির, ভিন্ন সংস্কৃতির একটি ভাষায় নাইজিরিয় সংস্কৃতি উঠে এসেছে তার অস্থিমজ্জা নিয়ে।২০ 

            ইলিয়াস জানান, আমাদের শ্রেষ্ঠ লেখখগণ প্রবাদ-প্রবচন, শ্লোক, ছড়া এবং সামগ্রিকভাবে লোকসংস্কৃতির উপযুক্ত ব্যবহার করতে পারেন না।

            মর্যাদা: এদেশের বামপন্থী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের জনবিচ্ছিন্নতার আরেকটি কারণ হলো মর্যাদা। নিজেদেরকে শিক্ষিত, সুরুচিবান, মুক্তবুদ্ধির মানুষ ভাবা সত্ত্বেও নিজেদেরকে এক ধরনের অহমিকার বৃত্তে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ করে রাখেন ঐ বিচ্ছিন্নতার কারণে। উন্নাসিকতা, অপরকে ছোট ও ইতর ভাবার মতো ব্যাপারগুলো তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে মধ্যবিত্তের সাথে সেয়ানে সেয়ানে চলার অভিলাষে। তাঁদেরকে দেখা যায় বুর্জোয়া দলের কিংবা শ্রেণীর নানা পেশার মানুষের সাথে গোপন সম্পর্ক বজায় রাখতে। একসাথে দুদিকে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে তারা হয়ে ওঠে কপট ও আস্থাহীন। ইলিয়াস বলেন,

বামপন্থি রাজনীতিবিদের কাছে শ্রমজীবী মানুষ হল আন্দোলনের হাতিয়ার। তাঁকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারলেই বামপন্থি রাজনীতিবিদদের অনেকেই নিজেদের সফল বিপ্লবী ভাবেন। কিন্তু বামপন্থি রাজনৈতিক আন্দোলন তো পরিচালিত হয় শ্রমজীবীর শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তাহলে তাঁদের কেবল হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার অধিকার রাজনীতিবিদরা পান কোত্থেকে?২১

            তবে চার দশকের মূল্যায়ন করতে গেলে বলা যায় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সংস্কৃতির ভাঙ্গাসেতু প্রবন্ধটি উদ্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে। চল্লিশ বছর পরে আজকের বামপন্থি রাজনৈতিক কর্মীদের সার্বিক কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে সেটাই মনে হবে। তবে সাহিত্যের পাঠকদের কাছে প্রবন্ধটি গৃহীত হয়েছে। ঠিক সেসময় একদল সচেতন পাঠক তৈরি হয়েছে, যাঁরা মধ্যবিত্তের হয়েও নিম্নবিত্তকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। নিম্নবিত্তের ভেতরকার চিত্র চাক্ষুস করে সাহিত্যে তুলে ধরেছেন। এ প্রবন্ধের এখানেই সার্থকতা।


টীকা ও তথ্যনির্দেশ:

১। গোপাল হালদার, সংস্কৃতির রূপান্তর, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলকাতা, মার্চ ১৯৬৫, পৃষ্ঠা- ৪১।
২। আহমদ শরীফ, বাঙলার সংস্কৃতি প্রসঙ্গে, কালের দর্পণে স্বদেশ, মুক্তধারা, পৃষ্ঠা-৪৬।
৩। কাজী মহম্মদ আশরাফ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রæয়ারি, ২০১৩, পৃষ্ঠা-৭৮।
৪। ক) প্রশান্ত মৃধা, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস: কৌতুকী ক্রোধের উত্তাপ, কথাপ্রকাশ, প্রথম প্রকাশ ২০১৬, পৃষ্ঠা ১৭—১৮।
খ) আলাউদ্দিন মণ্ডল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস:নির্মাণে বিনির্মাণে, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ফেব্রæয়ারি ২০০৯, পরিশিষ্ট-১, সাক্ষাৎকার: বদরুদ্দীন উমর, পৃষ্ঠা-৫৫৪।
৫। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সংস্কৃতির ভাঙ্গাসেতু, রচনাসমগ্র-৩, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, মার্চ ২০০৪, পৃষ্ঠা ১৮—১৯।
৬। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯।
৭। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৯।
৮। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২।
৯। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩।
১০। বদরুদ্দীন উমর, বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সমস্যা, রচনাবলী ৪, বাঙ্গালা গবেষণা, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ২০২২, ভূমিকা।
১১। বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৮৯।
১২। বদরুদ্দীন উমর, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-৩৯০—৩৯১।
১৩। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪।
১৪। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৪।
১৫। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫।
১৬। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৫।
১৭। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭।
১৮। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৭।
১৯। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮।
২০। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৮।
২১। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৯।

 


কাজী মহম্মদ আশরাফ

প্রাতিষ্ঠানিক নাম: আশরাফুল আলম
প্রভাষক, রামপাল মহাবিদ্যালয়
ঠিকানা: জোড়পুকুর পার, পঞ্চসার
মুন্সীগঞ্জ সদর— ১৫০০
মোবাইল নম্বর: ০১৯১৪৬৩১৬৩৬
কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনী (বাংলা ও ইংরেজি) ১৯টি।

শেয়ার