হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের বিশেষ করিয়া মূল পাত্র-পাত্রীদের উপস্থাপনে তিনি বিলম্ব করেন না। বহু উপন্যাসে তাহার এই বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করিয়াছি।
চল্লিশ বছরের লেখক জীবনের শেষ ভাগে উপনীত হইয়া হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাস-আশ্রয়ী কাহিনী লেখায় প্রলুব্ধ হইয়াছিলেন। ‘মাতাল হাওয়া’ উপন্যাসে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকার আন্দোলন উপজীব্য করিয়াছেন। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে লিখিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’। তাহারও আগে তিনি বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মানুষ ও সমাজের স্বভাব ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে লিখিয়াছেন ‘মধ্যাহ্ন’। যে কালপরিধি অবলম্বন করিয়া ‘মধ্যাহ্ন’ উপন্যাসটির আখ্যানভাগ রচিত তাহার সীমা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ভারত বিভক্ত হইল এবং একই সূত্রে বাংলা বিভক্ত হইল। বঙ্গভঙ্গের (১৯৪৭) বেদনা ও ক্ষত লইয়া অনেক উপন্যাস রচিত হইয়াছে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ এই বিষয় নিয়ে ফোকাসড্ কোন উপন্যাস লিখিবার বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করিবার আগেই ব্যাধিগ্রস্ত হইয়া পড়েন। আমাদের দুভার্গ্য: ২০১২ সালের অকাল জীবনাবসানের কারণে লেখার সুযোগই লাভ করেন নাই।
বাংলাদেশের ইতিহাস নাটকীয়তার সমৃদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হইয়াছিল। ১৯৭৫ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে সামরিক বাহিনীর একটি দল। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে কয়েকজন সেনা অফিসার যাহাদের প্রকৃত মদদদাতার পরিচয় আজও অনুদঘাটিত রহিয়াছে। সেনাপ্রধান এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া ক্ষমতা দখল করেন ১৯৮২ সালে। ক্রমাগত আন্দোলনের মুখে তাহার পতন হয় ১৯৯১ সালে। কিন্ত এইসব নাটকীয় ঘটনার তথ্যনির্ভর ও বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। ফলে পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষভাবে ইতিহাস রচনা কঠিন। একই কারণে উপন্যাস লেখার সুযোগ প্রশস্ত নয়।
২.
সমাজ-সম্পৃক্ত মানুষের কথা হুমায়ূন আহমেদের প্রধান উপজীব্য। ‘দেয়াল’ উপন্যাসটি শুরু হইয়াছে প্রকৃতির বর্ণনা দিয়া। হুমায়ূন আহমেদ লিখিয়াছেন, “ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয় না। তবে দেখায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।”
বহু গল্প উপন্যাসের শুরুতে প্রকৃতির বর্ণনা প্রদান প্রচলন বাংলা কথাসাহিত্যিকদের অন্যতম প্রবণতা। ইহার বিকল্প হইল যে প্রেক্ষাপটে গল্পটি শুরু হইতে যাইতেছে তাহার বর্ণনা। বহু উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ এই দুই বিকল্পের পরিবর্তে সরাসরি ঘটনার উল্লেখ করিয়া গল্পের সূত্রপাত করিয়াছেন। এই উপন্যাস দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ দিয়াও হুমায়ূন আহমেদ শুরু করিতে পারিতেন: “শফিক চা খেতে খেতে আকাশে রঙের খেলা দেখছে। সে চা খাচ্ছে ধানমণ্ডির দশ নম্বর রোডের মাঝখানে একটি চায়ের দোকানে। অস্থায়ী দোকান ছিল, এখন মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। হালকা-পাতলা শিরিষ গাছের পাশে দোকান। শিরিষ গাছের মধ্যে তেজীভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সে আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে।”
লেখক শফিককে দেখিতেছেন ও তাহাকে পাঠকের নিকট পরিচয় করাইয়া দিতেছেন। এই পরিচয়পর্ব অতি সংক্ষিপ্ত। এত সংক্ষিপ্ত যে প্রথম ও দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ বর্জন করিয়া তৃতীয় স্তবক হইতে উপন্যাস শুরু করিলে ক্ষতি-বৃদ্ধি হয় না। তৃতীয় অনুচ্ছেদটি এই রূপ: “শফিক চা শেষ করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে সে মানিব্যাগ আনেনি। এরকম ভুল তার সচরাচর হয় না। তার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। শফিক মনস্থির করতে পারছে না সঙ্গে মানিব্যাগ নেই—এই তথ্য দোকানীকে আগে দেবে, না কি চা সিগারেট খেয়ে তারপর দেবে।”
হুমায়ূন আহমেদ তৃতীয় অনুচ্ছেদ দিয়া উপন্যাস শুরু করেন নাই। তিনি উপন্যাসের তৃতীয় অনুচ্ছেদের আগে উপর্যুক্ত আরও দুইটি ক্ষুদ্র অনুচ্ছেদ লিখিয়াছেন। যে অবস্থায় শফিক চা পান করিতেছে তাহার দূর প্রেক্ষাপট (প্রকৃতি) এবং উপস্থিত প্রেক্ষাপট উভয়ই তিনি সংক্ষেপে উপস্থাপনা করিয়া উপন্যাসের নায়ক শফিককে লইয়া ঘটনা শুরু করিতেছেন।
ইহা হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যে উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীদের বিশেষ করিয়া মূল পাত্র-পাত্রীদের উপস্থাপনে তিনি বিলম্ব করেন না। বহু উপন্যাসে তাহার এই বৈশিষ্ট্য আমরা লক্ষ্য করিয়াছি। অধিকন্তু কে নায়ক আর কে প্রতিনায়ক তাহা চিহ্নিত করিতেও বিলম্ব করেন না।
চতুর্থ অনুচ্ছেদে উপন্যাসের দ্বিতীয় মূল চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হইবে। পাঠক পড়িবেন: “শফিকের হাতে বিভূতিভূষণের একটা উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ‘ইছামতি’। বইটির দ্বিতীয় পাতায় শফিক লিখেছে—‘অবন্তিকে শুভ জন্মদিন’। বইটা নিয়ে শফিক বিব্রত অবস্থায় আছে। বইটা অবন্তিকে সে দিবে, নাকি ফেরত নিয়ে যাবে? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে ফেরত নেওয়াই ভালো।” পরবর্তী অনুচ্ছেদে অবন্তির কথা আরও রহিয়াছে। অবন্তী শফিকের প্রইভেট টুইশনির ছাত্রী। তাহাকে এ গল্পের নায়িকা বলা যাইতে পারে।
শফিক আর অবন্তি এই উপন্যাসের মূল দুইটি চরিত্র। তাহারা দুইটি পৃথক আখ্যানের সূত্রধর। শফিকের গল্প ও অবন্তির গল্প সমান্তরালভাবে অগ্রসর হইয়াছে। কখনও কখনও একই অনুচ্ছেদে শফিকের সহিত অবন্তির সাক্ষাৎ হইয়াছে। এইটুকুই সম্পর্ক। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়া দুইটি আখ্যান একটি আখ্যানে উন্নীত হইয়াছে।
উপন্যাসের প্রথম অংশেই অবন্তির দাদা সরফরাজ খান এবং তাহার বন্ধু ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে পরিচয় করাইয়া দেওয়া হইয়াছে। তাহারা অবন্তির পক্ষের লোক। অব্যবহিত পরেই শফিকের পক্ষের অন্যতম চরিত্র রাধানাথ বাবুর কথা আসিয়া পড়িয়াছে। প্রেসের মালিক রাধানাথ বাবু ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধধর্ম’ নামে একটি বই লিখিতেছেন। তাহার নানান রকম অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য দরকার হয়। শফিকের দায়িত্ব তথ্য সংগ্রহ। প্রতিটি তথ্যের জন্য শফিককে তিনি কুড়ি টাকা দেন। তবে একটি বিশেষ প্রশ্নের উত্তর বাবদ শফিকের চল্লিশ টাকা পাওনা হইয়াছে। এই অর্থ তাহার বিশেষ প্রয়োজন। তাহার আয়ের উৎস তেমন কিছু নাই। সে দরিদ্র পরিবারের সন্তান।
কাহিনীর শুরুতেই পাত্র-পাত্রীদের পরিচয় করাইয়া দেওয়া একটি কার্যকর প্রকরণ। কেবল হুমায়ূন আহমেদ নহে, তাবৎ পৃথিবীর অনেকানেক বড় লেখকের গল্প-উপন্যাসে এবম্বিধ অ্যাপ্রোচ লক্ষ্য করা যায়। তবে হুমায়ূন আহমেদের বৈশিষ্ট্য হইল তিনি সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই কাজটি সারিয়াছেন। নিজের ভাষ্যের পরিবর্তে তিনি ছোট ছোট ঘটনার কথা উল্লেখ করিয়াছেন। এইসব ঘটনার মধ্য দিয়া একদিকে পাত্র-পাত্রীর চরিত্র সম্বন্ধে ইংগিত পাওয়া যাইতেছে—অন্য দিকে তাহাদের সমস্যার কথাও উঠিয়া আসিয়াছে। ইহাকে ‘ডাইরেক্ট এপ্রোচ’ বলা যাইতে পারে। পাঠককে সামগ্রিক আখ্যানের জন্য তৈরী করিতে ইহা কার্যকর।
পাঠক প্রথমেই বুঝিয়া লইতে চাহেন একটি উপন্যাসে তাহার প্রাপ্তিযোগ কী। তিনি যখন অনুধাবন করেন তাহার প্রাপ্তিযোগ উপেক্ষণীয় নহে তখন পাঠে আগ্রহী হইয়া উঠেন। পাঠকের এই সরল মনঃস্তত্ত্বের কথা লেখকেরা মনে রাখিলে নিজেদের উপকার করিবেন।
৩.
সমস্যা প্রসঙ্গে কথা বলিতে হয়। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসে আমরা দেখিতে পাই মূল পাত্র-পাত্রীসহ প্রায় সকলের কিছু না কিছু সমস্যা রহিয়াছে। সমস্যার বর্ণনা এবং সমাধানের সূত্রোল্লেখের মধ্য দিয়া উপন্যাসের কলেবর বিকশিত হয়। সমস্যা পাঠককে দুশ্চিন্তায় নিপতিত করে। সমাধান তাহাকে মুগ্ধ করে, তৃপ্ত করে। পাঠকমাত্রই তৃপ্তি লাভ করিতে চায়। সমাধান কখন আসিল তাহাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সমাধানে পৌঁছাইতে বিলম্ব সাসপেন্সের সৃষ্টি করে। হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস লিখিতে গিয়া পদে পদে সমস্যার সৃষ্টি করেন। এই বিষয়ে উদাহরণসহ বিশদ আলোচনার সুযোগ রহিয়াছে।
৪.
‘দেয়াল’ উপন্যাসটি শফিক ও অবন্তির গল্প। বিশ্বসাহিত্যের দিকে লক্ষ্য করিলে আমরা দেখিতে পাই যে-কোন উপন্যাসই কার্যতঃ দুইটি (কমপক্ষে) আখ্যানের সহ-অবস্থান। বলা যাইতে পারে দুইটি আখ্যান মিলিত হইয়া তৃতীয় আখ্যান প্রণয়ন করে। এই উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ স্পষ্টতঃ শফিক ও অবন্তিকে সমান্তরালভাবে উপস্থাপন করিয়াাছেন। তবে এই শফিক ও অবন্তির গল্প বর্ণনা করিতে গিয়া তিনি যে প্রেক্ষাপটটি বাছিয়া লইয়াছেন তাহা কৌতূহলোদ্দীপক। কার্যতঃ এই প্রেক্ষাপটটি প্রাধান্য লাভ করিয়াছে।
‘দেয়াল’-এর প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ যখন ‘বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ একবেলা রুটি খাচ্ছে’ এবং অবন্তির স্পেনবাসী মা ইসাবেলা যারপরনাই চিন্তিত হইয়া অবন্তিকে লিখেতেছেন, “এখন আমি তোমার ভবিষৎ পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি। তুমি কি আসবে এখানে? যুদ্ধবিধস্ত একটি হতদরিদ্র দেশে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তোমার বৃদ্ধ দাদাজানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে দেশে পড়ে থাকতে হবে—এটা কোনো কাজের কথা না।”
আরও সুনির্দ্দিষ্ট করিয়া বলিতে গেলে এই উপন্যাসে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ইতিহাসের মর্মান্তিক ও ক্রিটিক্যাল একটি অধ্যায়ের প্রত্যক্ষ বর্ণনা রহিয়াছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড ছিল নির্মম। এই হত্যাকাণ্ডের পরে আওয়ামী লীগের নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে পরবর্তী সরকার গঠিত হইল ও ক্ষমতার পালাবদল হইল। কার্যতঃ বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অভিষেক হইল। কয়েক মাস পরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে আটক করিলেন। আরেক দল কয়েক দিন পর জেনারেল খালেদ মোশাররফকে নির্মমভাবে হত্যা করিল। জিয়াউর রহমান মুক্ত হইলেন। কালক্রমে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হইয়া বসিলেন।
হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসবেত্তার ভূমিকা পালন করেন নাই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিশদ বিবরণ প্রদান করেন নাই। এই নৃশংস ঘটনা সুবিদিত। তবে বাড়ির কাজের ছেলে আব্দুর রহমান শেখ আদালতে যে লিখিত জবানবন্দী প্রদান করিয়াছিলেন হুমায়ূন আহমেদ তাহা উপন্যাসের মূলাংশে অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন। হুমায়ূন আহমেদ আওয়ামী নেতা ও নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের গল্প বলিয়াছেন। অতঃপর, শেষাংশে তিনি রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার কিছু গল্প বলিয়াছেন। এইসব গল্প শফিক ও অবন্তির গল্প স্পর্শ করিয়াছে মাত্র। আখ্যানের দাবী অনুযায়ী পাঠক বিভিন্ন পর্যায়ে কর্ণেল ফারুক, মেজর রশিদ, কর্ণেল ওসমানী, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, জেনারেল মঞ্জুর, কর্ণেল তাহের প্রমুখের কণ্ঠস্বর শুনিয়াছেন।
এই রাজনৈতিক কাহিনী ব্যাতিরেকেই শফিক ও অবন্তির গল্প অনায়াসে জমজমাট আরেকটি স্বাবলম্বী উপন্যাস হইয়া উঠিতে পারিত। অতি সহজে হুমায়ূন আহমেদ এইরূপ উপন্যাস লিখিয়া ফেলিতে সক্ষম ছিলেন। ইহা তাহার ঈশ্বরপ্রদত্ব প্রতিভা। বর্ণিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যুক্ত করিয়া তিনি ‘দেয়াল’ উপন্যাসটিতে একটি আকর্ষণীয় মাত্রা যোগ করিয়াছেন। এই প্রেক্ষাপট বিশদ। ফলে তাহা এই উপন্যাসের তৃতীয় এবং কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী হিসাবে গণ্য।
হুমায়ূন আহমেদ জানেন পাঠক এই কৌতুকচিত্র উপভোগ করিতে ব্যর্থ হয় না। এই প্রসঙ্গে মহামতি অস্কার ওয়াইল্ডের একটি প্রবচন মনে পড়েতেছে। লেখককূলের উদ্দেশে তাহার উপদেশ ছিল: পাঠকের নিকট সত্য তুলিয়া ধরিতে চাহিলে তাহাদের হাসাইয়া দিন। নচেৎ তাহারা আপনাকেই শেষ করিয়া দিবে।
৫.
হুমায়ূন আহমেদের রসবোধ তীক্ষ্ম। এই রসবোধের প্রমাণ হিসাবে ঘটনার বর্ণনা ও সংলাপ উভয়ই উল্লেখ করা যাইতে পারে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের একটি বিষয়ে সংশয় ছিল আর তাহা হইল তাহার হত্যাকাণ্ডের পর কাহাকে প্রধান করিয়া পরবর্তী সরকার গঠন করা হইবে। জনশ্রুতি আছে নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, কামারুজ্জামান প্রমুখ অনেকের কাছেই পরোক্ষে প্রস্তাব করা হইয়াছিল। খন্দকার মোশতাক সম্ভবতঃ রাজী হইয়াছিলেন। অতএব ১৫ আগস্ট সকালে মেজর রশিদ পুরানো ঢাকা শহরের আগা মসিহ লেনে গিয়াছিলেন তাহাকে সাথে করিয়া আনিবার জন্য। খন্দকার মোশতাক এবং মেজর রশিদের মধ্যে কী আলোচনা হইয়াছিল তাহার সাক্ষী কেহ নাই―তাহা অবলোকনপূর্বক কেহ দিনপঞ্জি বা আত্মজীবনীতে লিখিয়া যায় নাই। লেখককে এই কথোপকথন কল্পনা হইতে লিখিতে হইয়াছে। ‘দেয়াল’ লিখিতে হুমায়ূন আহমেদ কী রূপে এই অংশটি লিখিয়াছেন তাহা উৎকলন করিতেছি:
“সিঁড়িতে বুটজুতার শব্দ হচ্ছে। খন্দকার মোশতাক একমনে দোয়ায়ে ইউনুস পড়তে লাগলেন। এই দোয়া পাঠ করে ইউনুস নবি মাছের পেট থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বিপদ ইউনুস নবির চেয়ে বেশি।
দরজা খুলে মেজর রশীদ ঢুকলেন। তাঁর হাতে স্টেনগান। তাঁর পেছনে দু’জন সৈনিক। তাদের হাতেও স্টেনগান। সৈনিক দু’জন স্টেনগান মোশতাকের দিকে তাক করে আছে।
মোশতাক নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে আল্লাহপাকের কাছে তওবা করলেন। মেজর রশীদ বললেন, ‘স্যার চলুন। মোশতাক বললেন, কোথায় যাব?’
‘প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন। প্রথমে রেডিওস্টেশনে যাবেন। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন।’
‘ট্যাংক এসেছে কেন?’
‘প্রেসিডেন্টের মর্যাদা রক্ষার জন্যে ট্যাংক এসেছে।’
মোশতাক বললেন, ‘শুক্রবারে আমি জুম্মার নামাজের আগে কোনো কাজকর্ম করি না। দায়িত্ব যদি গ্রহণ করতে হয় জুম্মার নামাজের পর।’
মেজর রশীদ কঠিন গলায় বললেন, ‘আপনাকে আমি নিতে এসেছি, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। অর্থহীন কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই।’
মোশতাক বললেন, ‘অবশ্যই অবশ্যই। তবে আমাকে কিছু সময় দিতে হবে।’
‘আপনাকে কোনো সময় দেওয়া হবে না।’
‘কাপড় চেঞ্জ করার সময় দিতে হবে। আমি নিশ্চয়ই লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিব না?’―”
এই অংশটি যে কৌতুকাবহ তাহা ব্যাখ্যা করিয়া বলিবার প্রয়োজন নাই। হুমায়ূন আহমেদ জানেন পাঠক এই কৌতুকচিত্র উপভোগ করিতে ব্যর্থ হয় না। এই প্রসঙ্গে মহামতি অস্কার ওয়াইল্ডের একটি প্রবচন মনে পড়েতেছে। লেখককূলের উদ্দেশে তাহার উপদেশ ছিল: পাঠকের নিকট সত্য তুলিয়া ধরিতে চাহিলে তাহাদের হাসাইয়া দিন। নচেৎ তাহারা আপনাকেই শেষ করিয়া দিবে। হুমায়ূন আহমেদের কথাসাহিত্য লেখকদের উদ্দেশে সর্বদাই অভিন্ন উপদেশ দিয়া যাইতেছে। তাহার কৌতুকবোধ অসামান্য। তাহার সূক্ষ্ম রসিকতা মানুষ ঢের উপভোগ করে।
৬.
উপর্যুক্ত অনুচ্ছেদ যে কেবল কৌতুকাবহ তাহা নহে, ইহার উপযোগিতা সম্বন্ধে আরও কয়েকটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইয়াছে। যথা:
প্রথমতঃ খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হইলেও সেনাবাহিনীর মেজররাই যে কার্যতঃ নিয়ন্ত্রক হইবেন তাহার ইঙ্গিত পরিস্ফুট হইয়াছে। মেজর রশিদের কর্তৃত্বসুলভ আচরণ ও কথাবার্তার মধ্য দিয়া হুমায়ূন আহমেদ সেই অবস্থার জন্য পাঠককে প্রস্তুত করিয়া রাখিলেন।
দ্বিতীয়তঃ খন্দকার মোশতাক ঝানু রাজনীতিবিদ ও মন্ত্রী হইলেও তিনি যে কার্যতঃ ‘শক্তের ভক্ত’ তাহাও প্রতিপাদিত হইল। ভবিষ্যতেও তাহা দেখা যাইবে। ইহার জন্যও পাঠককে প্রস্তুত করিয়া রাখা হইল।
তৃতীয়তঃ খন্দকার মোশতাক ভীরু বা ‘শক্তের ভক্ত’ হইলেও সুযোগ পাওয়া মাত্র যুক্তি উত্থাপন করিতে বিলম্ব করেন না তাহাও প্রতিপন্ন হইল। খন্দকার মোশতাক ভবিষ্যতে এইরূপ কথাবার্তা বলিবেন।
চতুর্থতঃ খন্দকার মোশতাকের যে রসিকতার প্রবণতা রহিয়াছে তাহাও পাঠককে জানাইয়া দেওয়া হইল। হুমায়ূন আহমেদ সম্যক অবহিত যে পাঠক কৌতুক ও রসিকতা পছন্দ করে।
প্রণিধানযোগ্য বিষয় হইল, মোশতাকের চরিত্র চিত্রণের জন্যই শুদ্ধ উপরিউক্ত উনিশ-কুড়িটি বাক্য রচনা করা হইয়াছে তাহা নহে। এই অংশ কাহিনীর একটি আবশ্যিক ঘটনা। কিন্তু সংক্ষেপে বিবৃত এই আবশ্যিক ঘটনার মধ্য দিয়া নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এবং সেনাবাহিনীর অস্ত্রধারী ব্যক্তিদের সম্পর্ক যে মধুর হইবে না লেখক তাহার ইশারা দিয়া রাখিলেন।
সাহিত্য আর চিত্রকর্মের পার্থক্য হইল চিত্রকর্মের সম্পূর্ণাংশ একযোগে দর্শকের সম্মুখে উন্মোচিত হয়, অন্যদিকে উপন্যাসের কাহিনী পাঠকের চোখে ক্রমে ক্রমে উন্মোচিত হয়। উপন্যাস গঠিত হয় বিভিন্ন ঘটনার সমবায়ে। ঘটনার পরম্পরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই উন্মোচন প্রক্রিয়ার ক্রমপর্যায়, ধারাবাহিকতার যুক্তিসূত্র এবং বিভিন্ন ঘটনার অন্তর্সংহতি বজায় না-থাকিলে গল্পের কাঠামো রুগ্ন হইয়া পড়ে।
উপন্যাসে কৌতুক ও নাটকীয়তা থাকিলে পাঠক তাহা উপভোগ করে। কিন্তু পাঠককে নাটকীয়তার জন্য প্রস্তুত করিতে হয়। পাঠককে যুক্তিশীলভাবে অগ্রে প্রস্তুত করিয়া না-রাখিলে নাটকীয়তা বাস্তবতার চৌহদ্দি অতিক্রম করিয়া প্রশ্নযোগ্য হইয়া উঠে। হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস নানাবিধ নাটকীয় ঘটনায় পরিকীর্ণ। আমরা দেখিতেছি হুমায়ূন আহমেদ নাটকীয় ঘটনার জন্য পাঠককে প্রথমেই প্রস্তুত করিয়া রাখেন। তাই তাহার কলমে নাটকীয়তা কখনই অতিনাটকীয়তায় পর্যবসিত হয় না। হুমায়ূন আহমেদের এবম্বিধ কাহিনীনির্মাণ শৈলী আবিষ্কার করিতে পারিলে একজন লেখক নিজেকে উপকৃত করিবেন।
উপর্যুক্ত চতুর্থ বিষয়ে খন্দকার মোশতাকের রসিকতার প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। পাঠক প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছেন। অতএব পরবর্তীকালে খন্দকার মোশতাকের রসিকতায় পাঠক বিস্মিত হইবে না। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করার পরের দিন খন্দকার মোশতাক আর সেক্রেটারি মাহবুব আলম চাষীর মধ্যকার কথোপকথন কিছু অংশ নিম্নরূপ:
“খন্দকার মোশতাক বললেন, আমি খালেদ ছোকড়ার কাছে বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে একটা জিনিস চাইব। দিবে কি-না কে জানে।
― স্যার, কী চাইবেন?
― একটা ট্যাংক চাইব। ট্যাংকে করে মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে যাব। মাঝে মাঝে নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারে যাব পাবদা মাছ কিনতে।
চাষী বললেন, চরম দুঃসময়েও আপনার রসবোধ দেখে ভালো লাগল।”
এই কথোপকথনের রসসিক্ত চিত্রায়ন হুমায়ূন আহমেদের অন্যতম কৃতিত্ব। সংলাপ তৈরীতে তাহার মতো কারিকর পৃথিবীতে আর আছে কি-না সন্দেহ। এই বিষয়ে পৃথক আলোচনার অবকাশ রহিয়াছে।
লেখক হিসাবে হুমায়ূন আহমেদের একটি বৈশিষ্ট্য হইল তাহার অবস্থান নিরপেক্ষ। তাহার বিবেচনায় কোনো মানুষের গায়ে সাদা বা কালো যে-কোনো এক একটি তকমা আঁটিয়া দিলে তাহার প্রতি সুবিচার করা হয় না।
৭.
যে পাঁচ-ছয়টি ইতিহাস সম্পৃক্ত উপন্যাস হুমায়ূন আহমেদ লিখিয়েছেন সেইগুলিতে তিনি হিস্টোরিওগ্রাফারের দায়িত্ব পালন করেন নাই। হুমায়ূন আহমেদ কেবল গল্প বলিতে চাহিয়াছেন। এইসব গল্পে বাস্তবের মানুষ প্রবেশ করিয়াছে যাহাদের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়া কাহিনী বিকশিত হইয়াছে। তবে ইতিহাসাশ্রয়ী হইলেই একটি জনপ্রিয় উপন্যাস উপজীব্য ব্যক্তি ও সমাজ সম্বন্ধে একটি ‘ন্যারেটিভ’ তৈরী করে। পাঠক সচেতনভাবে এই ন্যারেটিভের ভোক্তায় পরিণত হইয়া যায়। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তারিখে রাধানাথ বাবু এবং তাহার সহকারী শফিকের মধ্যে যে কথোপথন হইল তাহা নিম্নরূপ :
“রাধানাথ বললেন, শচীনকর্তা মারা গেছেন, এই খবর জানো?
― না।
উনি আজ মারা গেছেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা শচীনকর্তার মৃত্যুতে যতটা শোক পেয়েছেন, তার এক শ’ ভাগের এক ভাগ শোকও তাদের জাতির পিতার মৃত্যুতে পায় নি।”
লেখক হিসাবে হুমায়ূন আহমেদের একটি বৈশিষ্ট্য হইল তাহার অবস্থান নিরপেক্ষ। তাহার বিবেচনায় কোনো মানুষের গায়ে সাদা বা কালো যে-কোনো এক একটি তকমা আঁটিয়া দিলে তাহার প্রতি সুবিচার করা হয় না। তিনি কাহাকেও বাতিল করিবার উদ্দেশ্য লইয়া কাহিনী লিখিতে বসেন না। তিনি সম্যক অবহিত যে আদর্শগত অবস্থান এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য উপন্যাসের নৈর্ব্যক্তিকতা ক্ষুণ্ণ করে। একজন সৎ লেখক পাঠকের কেবল সন্তুষ্টির জন্য কলম ধরেন না। তাহাকে সত্যে উপনীত হইতে হয়।
‘দেয়াল’ উপন্যাস মূলতঃ শফিক ও অবন্তির কাহিনী হইলেও রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ড, আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার মোশতাক আহমদের রাষ্ট্রপতির, সেনাবাহিনীর চেইন কম্যান্ডার ভঙ্গ করিয়া জুনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তার শাসন, খালেদ মোশাররফের অভ্যূত্থান, খন্দকার মোশতাকের পতন, জেল হত্যা, জেনারেল জিয়াকে পদচ্যুতি ও আটক, কর্নেল তাহেরের বিচার ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসের পুনরুৎপাদন করিতে বসেন নাই। এই সময়ে অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনা ঘটিয়াছে। উপন্যাসের প্রয়োজনে তিনি কয়েকটি মাত্র ঘটনা বাছিয়া লইয়াছেন। তবে কোথাও কোথাও তাহার পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য রহিয়াছে। তিনি লেখক হিসাবে প্রভাবশালী। তাই তাহার একটি হালকা মন্তব্যও পাঠকের কাছে তাৎপর্যময় প্রতীয়মান হইতে পারে।
খালেদ মোশাররফ অবন্তিকে ‘আমার রাজকন্যা মা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন। খালেদ মোশাররফ ২ নভেম্বর সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল জিয়াকে পদচ্যুত ও বন্দী করেন এবং একই সঙ্গে নিজে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। পরদিন তাহার মায়ের নেতৃত্বে একটি মিছিল হইল। হুমায়ূন আহমেদ লিখিয়াছেন, “ওই দিনের মিছিলটি ছিল খালেদ মোশাররফের মৃত্যুর ঘণ্টা। মিছিল দেখে লোকজন আঁতকে উঠল। ধারণা করল, খালেদ মোশাররফ ভারতের চর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে তখন ভারত বিদ্বেষ সর্বোচ্চ পর্যায়ে। কারও মনেই নেই বা মনে রাখার চেষ্টা নেই যে, আমাদের স্বাধীনতার পেছনে হাজার হাজার ভারতীয় সৈনিকের জীবনাবসানের মতো ঘটনা ঘটেছে।”
উপন্যাস কী করিয়া ইতিহাসের বিশ্বাসযোগ্য বয়ান তৈরী করিতে পারে তাহার উদাহরণস্বরূপ আরেকটি ঘটানা উদ্ধারণযোগ্য। খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিদেশে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। জেনারেল জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি তখন তাহাদের কেহ কেহ হঠাৎ করিয়া দেশে প্রত্যাবর্তন করে। কর্ণেল ফারুক তাহাদের অন্যতম। উপন্যাসের শেষভাগে এই সূত্রে জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মঞ্জুরের কথোপকথন শোনা যাইতেছে:
“শুক্রবার ভোরে প্রেসিডেন্ট জিয়া নাশতা খাচ্ছিলেন। আয়োজন সামান্য
চারটা লাল আটার রুটি
দুই পিস বেগুন ভাজি
একটা ডিম সিদ্ধ ।
জিয়ার সঙ্গে নাশতার টেবিলে বসেছেন তাঁর বন্ধু এবং সহযোদ্ধা জেনারেল মঞ্জুর। জেনারেল মঞ্জুর বিস্মিত হয়ে বললেন, এই আপনার নাশতা ?
প্রেসিডেন্ট বললেন, হতদরিদ্র একটি দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এই নাশতা কি যথেষ্ট না ?
জেনারেল মঞ্জুর প্রসঙ্গ বদলে বললেন, এই মুহূর্তে ঢাকা এয়ারপোর্টে একজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষ কফির মগ হাতে ঘুরছেন। সবার সঙ্গে গল্পগুজব করছেন। হাত মেলাচ্ছেন। কোলাকুলি করছেন। এই তথ্য কি আপনার কাছে আছে ?
জিয়া বললেন, আছে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আছে।
আমি কি জানতে পারি ?
পারো। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, কর্নেল ফারুক উঠবে ক্যান্টনমেন্টে রশীদের বাসায়। সেখান থেকে সে যাবে ফার্স্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিতে।
বলেন কী ? এই অবস্থায় আপনি নির্বিকারে নাশতা করছেন ?
জিয়া শান্ত গলায় বললেন, তুমি হলে কী করতে ? নাশতা খাওয়া বন্ধ করে ফার্স্ট বেঙ্গল ক্যাভালরিতে ছুটে যেতে ?
মঞ্জুর চুপ করে রইলেন। জিয়া বললেন, হিটলারের ডেজার্ট ফক্স জেনারেল রোমেলের একটি কথা আমার খুব পছন্দ। জেনারেল রোমেল বলতেন, সবাই চোখ-কান খোলা রাখে। আমি নাকও খোলা রাখি। গন্ধ শুঁকি। বিপদের গন্ধ শোঁকা যায়।
আপনি তাহলে নাক খোলা রেখেছেন ?
Yes, my noses are open.”
৮.
‘দেয়াল’ হুমায়ূন আহমেদের সর্বশেষ উপন্যাস। ইহাতে সুকৌশলে রাজনৈতিক উপাদান ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হইয়াছে। অদ্যকার আলোচনায় মূলতঃ হুমায়ন আহমেদের প্রকরণগত কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর সংক্ষেপে আলোকপাত করা হইয়াছে। তাহার উপন্যাসের স্থাপত্য বিশ্লেষণ করিলে এমন সব উপাদান দৃষ্টিযোগ্য হয়, যাহা লেখকদের জন্য অনুসরণীয়। এইসব উপাদান ও তাহাদের সংস্থাপনার কৌশল যে কোনও উপন্যাসকে মনোগ্রাহী ও কার্যকর বয়ানে পরিণত করিতে সক্ষম।
ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
জন্ম ১৯৫৯ সালের ৩ জুন, ময়মনসিংহ শহরে। অর্থনীতিবিদ, কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্যসমালোচক। ২০১০ থেকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ—এ অর্থনীতি, গবেষণা পদ্ধতি ও ব্যবসায় প্রশাসনের অধ্যাপক। ২০১৪—২০১৮ পর্বে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন প্রায় তিন যুগ ধরে। জীবনানন্দ দাশের লেখার খাতা থেকে অনেক কবিতার মূলানুগ পাঠ তৈরি করেছেন ও প্রকাশ করেছেন যার মধ্যে ’রূপসী বাংলা’র সংশোধিত তথা মূলানুগ সংস্করণ, বেসরকারি সেক্টরে অধিক মাত্রার দুনীর্তির ব্যাখ্যা সম্বলিত গ্রন্থ ‘করাপ্ট ব্যুরোক্রেসি ও প্রাইভেটাইজেশান অফ ট্যাক্স ইনফোর্সমেন্ট‘ বহুল পঠিত। প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের একত্রিশ ও সাতাশ নম্বর কবিতার খাতার সচিত্র মূলানুগ পাঠ। কয়েকটি
উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা: চটি সাহিত্যের পূর্ব—পশ্চিম, হালেদের বাংলা ব্যাকরণ, জীবনানন্দ দাশের পত্রাবলী, জীবনানন্দ দাশের প্রবন্ধ সমগ্র, Essays on Jibanananda Das, Time Stars and Women, জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাণ্ডুলিপি চিত্র, On Language and Literature by Jibananada Das এবং জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (একত্রে দুই খণ্ড) ইত্যাদি। তার তিনটি উপন্যাস ‘দুর্দানা খানের চিঠি’, ‘কক্সবাজার’ এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘উনিশ শ’ একাত্তর’ সম্প্রতিকালে প্রকাশিত। প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কার্ল মাক্সের্র সমাধিতে হুমায়ূন আহমেদ’ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘আপনার বান্ধবীকে কি আজ সন্ধ্যার জন্য ধার পেতে পারি’ এবং তিনটি উপন্যাস ‘ভালোবাসাবাসি’, ‘প্রশ্নোত্তর কেন্দ্র’ এবং ‘সাঙ্ঘাতিক বাড়ীওয়ালী’ অচিরেই প্রকাশিত হবে। অর্থনীতি বিষয়ে তার পরবতী গ্রন্থ Economics of a Rent-Seeking Nation। সম্প্রতিকালে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মৌলিক গবেষণা করছেন।