কবি ফরহাদ মজহার: ‘ভাবকথা ও তৎপরতা’ | মোহাম্মদ আজম

মোটের উপর বিস্তারের এবং অনুপুঙ্খ বয়ানের ঝোঁকই তাঁর মূল কাব্যপ্রবণতা। চিত্রকল্প তাঁর প্রধান বাহন নয় বলে তিনি খুব স্বাভাবিক কায়দায় দ্বারস্থ হয়েছেন উপমা ও রূপকের; আর বিশেষণখচিত নজিরের পুনরাবৃত্তিতে ভাবকে প্রসারিত করেছেন। কবিতায় যাকে তালিকাধর্মিতা বলা হয়, পদ্ধতিটি তার খুব কাছাকাছি।


প্রস্তাব

কোনো কাব্যধারার প্রভাবশালী মহলে যশপ্রার্থী নবীন কবি অনায়াস আরাম এবং সম্ভাবনায় শরিক হন। কাব্যকলার অতীত ও চলমান ভাঁজে নতুন কবিতার সম্ভাবনাগুলোও সুপ্ত থাকে। ষাটের দশকের শেষভাগে একজন তরুণ কবি হিসাবে ফরহাদ মজহার যখন শব্দ-সাজানো শুরু করেছিলেন, তখন তিনি সম্ভবত চলমান কাব্যপ্রবাহের এই আরাম ও সম্ভাবনার সুযোগ না নিয়ে বরং অনেকাংশে পাশ কাটিয়ে যাবারই পথ খুঁজেছিলেন। তাঁর শুরুর দিকের কবিতা পড়লে ধারণা হয়, কবিতা পড়ার অভিজ্ঞতার তুলনায় চারপাশের জীবিত ও বিচরণশীল জীবনের প্রতিই তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রবল। এই আকর্ষণে সাড়া দিয়ে ‘নিজ’কে এবং ‘অপর’কে কবিতায় চিনে নেয়ার তাগিদ তিনি বোধ করেছিলেন; আর এভাবেই আয় করেছিলেন নিজের আলাদা ভাব ও ভাষা। এ ব্যাপারে তাঁর আত্মবিশ্বাস, কবিতাগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে, বেশ জোরালো ছিল। প্রথম থেকেই একদিকে নিজস্ব কাব্য-ইশতেহার, অন্যদিকে মূলধারার বাংলা কবিতার সমালোচনায় মুখর ছিল তাঁর কবিতা।

সুভাকুসুম দুইফর্মা কাব্যের ‘কুয়াশা’ নামের এক কবিতায় আধুনিক বাংলা কবিতার মহামহিম সম্রাট জীবনানন্দ দাশ ও কুয়াশাচ্ছন্ন বাংলা কবিতাকে তিনি বেশ এক হাত দেখে নিয়েছেন। অন্য অনেক কবিতার মধ্য থেকে একই কাব্যের ‘ফয়সালা’ এবং ‘অনন্তের শাশ্বতের তর্ক’ কবিতা দুটিকে এ ব্যাপারে সাক্ষী মানা যায়, যেখানে বাংলা কবিতার প্রভাবশালী অঙ্গনটি কবি ও কবিতাসমেত তাঁর রাখঢাকহীন আক্রমণের শিকার হয়েছে।

কবিতাসংগ্রহের ভূমিকায় বিনয় ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অবকাশে নিজের কাব্যখনির খননপথ এবং স্বাতন্ত্র্য বিষয়ে কবির সচেতনতা পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি লিখেছেন : ‘কসম কবিতার, আমার জীবনের বাইরে আমার কোনো কবিতা নাই।’ আরো লিখেছেন: ‘কৃষ্ণদাস কবিরাজ কিম্বা তাঁর আগে থেকেও শুরু করে এই কালের ফকির, দরবেশ, আউল বাউল, বয়াতি পর্যন্ত যে কাব্য, আমি তাকেই … বাংলার প্রধান ধারা বলে গণ্য করি।’
নিজের কবিতা সম্পর্কে কবির এ ধরনের প্রত্যয় পাঠকের জন্য একই সঙ্গে স্বস্তিদায়ক ও বিব্রতকর। এই অর্থে যে, এই বয়ানের সঙ্গে কাব্যপাঠলব্ধ অভিজ্ঞতার সাযুজ্য আবিষ্কারপূর্বক পাঠক যেমন অভাবিত আনন্দ ও স্বস্তি পেতে পারে, ঠিক তেমনি কবিতায় বিকীর্ণ গোপন বা প্রকাশ্য চিহ্নসকল ভাঁজ খুলে খুলে দেখার ক্ষেত্রে কুণ্ঠিতও হতে পারে। অন্তত আমাদের মতো কাব্য-ব্যবসায়ীদের জন্য তাতে বেজায় লোকসান।

আমাদের বর্তমান রচনায় আমরা এই কবিতাসংগ্রহের একাংশ পাঠের ক্ষেত্রে কবির বয়ানকে অগ্রাহ্য করে কাব্যের বয়ান বিচড়ে দেখার চেষ্টা করব। সুভাকুসুম দুইফর্মা কাব্যের ‘বাংলা কবিতার প্রতি’ কবিতায় কবির যে কাব্য-আকাঙ্ক্ষা করুণ আর্তিসমেত বেজে গেছে, তাকেই মনোযোগের প্রধান অবলম্বন হিসাবে নেব। কবি লিখেছেন :

আমি আর্ত রিসিভার তুলে নিয়ে ত্রস্ত হাতছানি
দিয়ে যাচ্ছি বারবার, টেলিফোন বাজে, বেজে যায়
কেবল বাজো না তুমি। …

তাহলে রবীন্দ্রনাথ পেয়ে যেত তোমাকে কি করে
অত দ্রুত অনায়াসে। ব্যক্তিগত তোমার নাম্বার
তাঁকে দিয়েছিলে কেন? …

যে কাব্যধারার প্রধান ঠাকুর শ্রী রবীন্দ্রনাথ, তারই বলয়ে কবি তাঁর পঙ্ক্তিসকল সহজাত প্রতিভায় প্রকাশিত দেখতে চেয়েছেন। আমরা এই কাব্যপ্রবাহের চলিষ্ণু বর্তমান রূপেই কবি ফরহাদ মজহারের কবিতার কিছু অংশ পাঠ করব।

অবশ্য অন্য বিবেচনাও জরুরি। মেঘ মেশিনের সঙ্গীত কাব্যগ্রন্থের ‘কবি ও কবিতা’ শীর্ষক কবিতাটি সম্ভবত এই কবির সবচেয়ে বিস্তৃত আর নগ্ন কাব্য-ইশতেহার। এই পদ্যের সিদ্ধান্ত-পঙ্ক্তি কটি উদ্ধার করছি :

লড়াকু এবং মনীষাদীপ্ত
থেকে যে পদ্য নিজেই লিপ্ত
ভেতর বাহির বদলের কাজে তার দু একটি কলি
লিখে যেতে চাই সবিনয়ে শুধু এই শেষ কথা বলি।

কবিতা এক দিকে লড়াকু আর অন্যদিকে মনীষার বাহন হতে পারে— এই সংবাদ আধুনিক জমানার বাংলা মুল্লুকে বিশেষ প্রচারিত নয়। ভেতর-বাহির বদলের কাজে লিপ্ত কবিতার কাব্য-সম্ভাবনার যথাবিহিত সীমা-নির্দেশ বাংলা কবিতাপাঠের ইতিবৃত্তে খুব একটা দেখা যায় না। যাক বা না যাক, আমাদের এই আলোচনায় আমরা কবিতার এ সম্ভাবনাকে স্বাগত জানাব; আর ফরহাদ মজহারের কবিতা বাংলা কবিতার পরিধি বরাবর যদি কোনো টেনশন তৈরি করেই থাকে, অথবা পরিধিকে দুমড়ে-মুচড়ে নতুন কোনো পরিসর আমদানি করে থাকে, তবে তার প্রাথমিক রূপ ও রেখা প্রণয়নের চেষ্টা করব।

সেই সাথে আরো কিছু কাব্য-চিহ্নের সঙ্গে মোলাকাত, তাঁর কবিতার নানা কোণে মিশে থেকে যারা হাতছানি দিয়ে জানান দিয়ে গেছে নিজেদের ক্রীড়া-প্রতিভা। শিরোনামের ‘ভাবকথা ও তৎপরতা’ কথাটি ধার করেছি ফরহাদ মজহারের এক প্রবন্ধের নাম থেকে। তাঁর কাব্যসমগ্র এবং আমাদের আলোচ্য কাব্যাংশের জন্য সম্ভবত এটাই হতে পারে সবচেয়ে জুতসই শিরোনাম।

 

মোকাবেলা

অনেক পরে প্রকাশিত মজহারের একটি সাবালক গদ্যপুস্তক মোকাবেলা। কিন্তু প্রথম থেকেই গদ্য-পদ্য মিলিয়ে তাঁর সমগ্র রচনাতে মোকাবেলার নানা ধরন চোখে পড়ে। অসংখ্য প্রতিপক্ষ তাঁর। কী গদ্যে কী পদ্যে তিনি তাদের সাথে লড়েছেন সাহস আর কুশলতার সাথে। কখনো উচ্চকণ্ঠে; ব্যঙ্গ আর ঠাট্টায় সওয়ার হয়ে কখনো বা। কিন্তু প্রধানত জ্ঞান-প্রজ্ঞা-চিন্তার এক অনায়াস মিশেলে তৈরি করেছেন বিচিত্র লীলা। মোটেই কাকতালীয় নয়, তাঁর পয়লা কেতাবের নাম খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ

এই কাব্যে বেশ জমেছে নিজের সাথে নিজের লড়াই। তিনি এগিয়েছেন আরোহ পদ্ধতিতে। ভূমার তুলনায় ভূমি তাঁর কাছে অধিকতর কাব্যসম্ভব মনে হয়েছে। অথবা তিনি আদৌ ‘কাব্য’ করতে চান নাই। চেয়েছেন এই ভূমিকে চিনে নিতে, আর তার মধ্যে ক্রীড়া ও লীলায় মশগুল মানব-সম্পর্কের বিচিত্র বিভঙ্গে নিজের জায়গাটা বুঝে নিতে।

ফরহাদ সুদূরের কবি নন মোটেই। অবশ্য ঘরোয়া আর নিত্যও নন। বুদ্ধি আর চিন্তা তাঁর প্রধান অস্ত্র— ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য মহাপৃথিবীর রস-রূপ আস্বাদনের তুলনায় মওকামতো বিচারের নিক্তিতে বসিয়ে দেয়াই তাঁর লক্ষ্য। মননের বাড়াবাড়ি তাঁকে আবার আসমানি করে তোলে নাই, মাটিতেই রেখেছে। আর বাস্তবের যেসব চড়াই-উৎরাই বা খানখন্দ মাড়াতে হয়েছে তাঁকে, যেমন, মুক্তিযুদ্ধ বা হুমায়ুন-তাহেরদের মৃত্যু, সেগুলোও তাঁর কাছে দূরবর্তী বা মোক্ষম কোনো ‘শিল্প’ নয়। বরং নিজেকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার বাহ্য মন্ত্রণা। নিজেকে বিযুক্ত রেখে ফরহাদ সাধারণভাবে কবিতা লিখতে চান নাই।

শামসুর রাহমানের সাথে একটা ছোট্ট তুলনা টানলে এই যুক্ততার ব্যাপারটা পষ্ট হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক ঘটনাধারা রাহমানের কবিতায় গণগ্রাহ্য ভঙ্গিমায় অসামান্য রূপ পেয়েছে। ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘বারবার ফিরে আসে’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতায় বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহের সাথে ব্যক্তি-কবির যোগ পরীক্ষা করলে আমরা এ দুয়ের দূরত্ব টের পাব। একজন দর্শক হিসাবে রাহমান মিছিলকে দেখেছেন, মিছিলের মধ্যে নির্বিশেষ সৌন্দর্য-বীরত্ব-বিদ্রোহের বিভা প্রস্ফুটিত দেখে উল্লাস ও বিস্ময় বোধ করেছেন — সেই বোধ চারিয়ে দিয়ে পঙ্ক্তিগুলোকে কবিতা করে তুলেছেন। তিনি যখন যুদ্ধ বা সম্ভাব্য যুদ্ধের আগ্রাসন দ্বারা আলোড়িত হয়েছেন, তখন একদিকে বীভৎসতা তাঁকে বিষণ্ণ করেছে, অন্যদিকে লড়াইরত তারুণ্যের উদ্যম-উৎসাহ আশাবাদী করেছে। কবিতার ছত্রে সেই বিষণ্ণতা বা সম্ভাবনার রূপায়ণ করেছেন তিনি।

আমাদের ঐতিহাসিক বাস্তবতা এবং স্মৃতি-শ্রুতির অমোঘ উপস্থিতিতে মিছিল বা সংগ্রাম বা যুদ্ধের এই রূপটি নিশ্চয়ই ‘বিশেষ’। কিন্তু ব্যক্তি-কবির দিক থেকে দেখলে পুরা কাব্যিক আয়োজনটিকে, কিংবা কবির সাথে এ বিষয়ের সম্পর্কটিকে, ‘নির্বিশেষ’ রূপেই পাওয়া যাবে। এ জন্যই কথক কবিটি এসব কবিতায় সহসা রূপান্তরিত হতে পারে প্রান্তরের কৃষক, কর্মরত তাঁতি, ক্রন্দসী মাতা, কিংবা উদ্বুদ্ধ-উত্তেজিত ছাত্র-জনতায়। এর অন্যথা হলে সম্ভবত কবিতাগুলো আবেদনের পরিসর হারাত, অর্থাৎ এতটা গণগ্রাহ্য হত না।

শুধু শামসুর রাহমান নন, তাঁর অনুজ কবিদের মধ্যে যাঁরা ষাটের আন্দোলন-সংগ্রাম বা একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামকে কবিতায় তুলে এনেছেন, তাঁদের প্রায় সব রচনা এ ধারাতেই পড়বে। বাংলাদেশের কবিতার বড় অংশ যে বহির্চারী এবং বর্ণনাত্মক, তার একটা প্রধান কারণ এই কাব্যভঙ্গির অবারিত প্রশ্রয়।

কবিতার বহির্চারী ও বর্ণনাত্মক রূপ ফরহাদ মজহারেও প্রধান; যুদ্ধ স্ব-রূপে বা একটু বিশেষায়িত রূপে তাঁর কবিতারও প্রথমাংশ অধিকার করে আছে। মুক্তিযুদ্ধকে মজহারও ‘দেখেছেন’; তাঁর নিজের মতো করে ‘রূপায়ণ’ করেছেন; প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু এর কোনোটাই ব্যক্তি-কবি থেকে বিযুক্ত হয়ে হাজির হয় নাই। তাঁর প্রথম কবিতাসংগ্রহ খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ-এ বাইরের লড়াই-সংগ্রামের সমান্তরালে দেখতে পাচ্ছি অন্য এক লড়াই— নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ের রক্তিমতা।

এ লড়াই নিজের এক রূপকে অতিক্রম করে যাওয়ার লড়াই। রক্তজবা বা সবুজ যে-আমিকে নাড়া দেয় নাই, সাত কোটি হৃৎপিণ্ডকে যে-আমি কর্মের আর পরিবর্তনের প্রাত্যহিকতায় যুক্ত করে নিতে পারে নাই, সে ‘আমি’কে অতিক্রম করে যাবার মরণ-পণ:

বাইরে স্লোগান বাইরে যুদ্ধ সাত কোটি হৃৎপিণ্ড জ্বলছে
তোমায় আমি খুন করবো খুন সেরে আজ বাইরে যাবো।

বহির্জগতই, দেখা যাচ্ছে, এই অন্তর্গত বোঝাপড়ার নিয়ামক। সেখানে সমষ্টির সাথে ব্যক্তির সম্পর্ক নতুন করে তৈরি হচ্ছে, অথবা তৈরি করার জোর ‘দায়’ অনুভূত হচ্ছে। এই দায় পালন করে নাই বলেই ‘তুমি’ আজ বন্দি। যে-আমি নিঃসঙ্গ, দেশের-দশের সঙ্গবর্জিত আর অক্রিয়, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ‘বিপ্লব-বিদ্রোহের স্পর্শে হৃষ্টপুষ্ট’ ‘আমি’র উত্থান।

পরিষ্কার বোঝা যায়, মজহারের কবিতার ‘আমি’ রোমান্টিকদের সাথে কোথাও কোথাও মিলতে পারে— বেশ ঘুরপথে; বিপ্লবী মনোভঙ্গির পক্ষে কল্পনা আর দূরবর্তিতার রোমান্টিসিজম ধারণ করা যতটা সম্ভব, ঠিক ততটা। কিন্তু ‘আধুনিক’ কবিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ব্যক্তির ধারণার সাথে এ বস্তুর একরত্তিও দোস্তি নাই। সত্যি বলতে কী, ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবাদীর মতলব আর ধ্যান-ধারণার বিপরীতেই মজহার গুছিয়েছেন তাঁর কথামালা। তাই তাঁর কবিতায় পাই তিরিশ-পরবর্তী বাংলা কবিতার প্রভাবশালী ভাবমণ্ডলের এন্টিথিসিস। মজহারের কবিতা-সমগ্রের পাঠসূত্র হিসাবে এই বাক্য সম্ভবত সরলই হলো; কিন্তু এর মজাও আছে, লাভও আছে। তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে সুবিধাবাদী ভদ্রলোক আর জনবিচ্ছিন্ন নন্দনতাত্ত্বিকের হাল-সাকিন; অন্যদিকে বাংলা মুল্লুকের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক রাজনীতি সম্পর্কে আপ-টু-ডেট হলে মজহারের কবিতার বাঁকাত্যাড়া কোণাকাঞ্চির বহু জট খোলাসা হয়ে যায়।

যাই হোক, আমরা খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ কাব্যের ‘আমি’র খবর নিচ্ছিলাম। সদ্যোজাত হলেও বোধ-বুদ্ধির পক্বতায় এই ‘আমি’ বেশ ‘রেশন্যাল’। ‘যুদ্ধে খোকনের (নিখুঁত) স্ট্র্যাটেজি’ কবিতায় ‘প্রকৃতি’, ‘সংসার’ আর ‘অন্তর্গত পাপ’-এর বিরুদ্ধে বেশ এক হাত কাব্যিক লড়াই লড়েছেন কবি। নানা জটিলতা সত্ত্বেও এখনকার মতো এ লড়াইয়ের এক প্রকার মীমাংসা হয়েছে; কিন্তু এই ত্রিশত্রুসংহারী লড়াই তাঁর উত্তরকালীন কবিতাসমগ্রে সম্ভবত সবচেয়ে প্রভাবশালী অন্তঃস্রোত হিসাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে। ‘প্রকৃতি’ বা নারী বা প্রেম বা শিল্প বা সৌন্দর্য তাঁর কাছে তন্ময় বা মন্ময় অনুধ্যানের বিষয় না হয়ে হয়েছে পারস্পরিক সম্পর্কগুলো বুঝে নেয়ার বা রচনা করার সাধনা। মনে পড়বে হয়ত, তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম বৃক্ষ : মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক বিষয়ক কবিতা। নামটি এ গ্রন্থভুক্ত বেশিরভাগ কবিতার ক্ষেত্রে তো বটেই, তাঁর সমগ্র কবিতার লক্ষণ-বিচারেও খুব তাৎপর্যবহ। ‘সংসার’, কথাটি যে-অর্থেই ব্যবহৃত হোক না কেন, কখনো কখনো তাঁকে আমূল নাড়িয়ে দিয়ে গেছে ভিতরে-বাইরে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর আরাধ্য থেকেছে এক বিকল্প সংসার— অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিক্রমায় বদলে যাওয়া সংসার, যার রূপরেখা এবং আকর্ষণের ধরনটি ঠিক পরিষ্কার নয়; আর ‘অন্তর্গত পাপ’-এর সাথে ‘রিয়েল’ লড়াই তাঁকে আবশ্যিকভাবে নিয়ে গেছে নানা দার্শনিক-আধ্যাত্মিক অন্বেষণে।

খোকনের প্রতিপুরুষ খোকনের সাথে লড়াইয়ে পুরোপুরি জিতে গেছে ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ কবিতায়ও— নিরঙ্কুশ বিজয়; সেসঙ্গে রেখে গেছে নিজের উত্থানের পক্ষে বাস্তবলিপ্ত কিছু লজিক। কিন্তু ‘বাহাত্তুরের এই অগাস্টে’ যার ‘পঁচিশ বছর পুরবে’, যার অস্তিত্বে কবিতা ও জীবন বেশ জুতসই ‘খোকন’ হয়ে বয়ে যাচ্ছে লোভাতুর হাতছানি হয়ে, তার পক্ষে এই মীমাংসা খুব সহজ হয় নাই। মনের দোলাচল আর দ্বন্দ্বে কেটেছে বেশ কিছু কাল, অন্তত যতক্ষণ পর্যন্ত না সম্পূর্ণরূপে বহির্লিপ্ত এক কবি দাঁড়িয়ে গেছে ‘বিপ্লবের সামনে’। তার আগে দ্বন্দ্বের খুনরাঙা রোশনাই ধরা পড়েছে বেশ কিছু কবিতায়। অন্য অনেকগুলোর মধ্যে উল্লেখ করতে চাই দুটির নাম— ‘খোকন-প্রতিখোকন/ পুরুষ-প্রতিপুরুষ কিম্বা’ এবং ‘খোকন/ প্রতিপুরুষ প্রভৃতির সিম্বায়োসিস’— যেখানে চতুর্পার্বিক-চতুর্মাত্রিক-চতুর্প্রকোষ্ট-পুনরাবৃত্তিময় সংশয়াকুল স্বরবৃত্তে আধার স্বয়ং হয়ে উঠেছে আধেয়, আধেয় বাহুল্য মাত্র।

 

কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী

‘বিপ্লব’ মজহারের কবিতার প্রধান চাবিশব্দ। রাজনৈতিক ‘কাজ’ হিসাবে জগত বদলানোর স্বপ্ন তাঁর কবিতায় আছে, আছে মার্কসীয় বিপ্লবের রূপরেখা অনুসরণ করে রচিত বহু পঙ্ক্তি। এমনকি বাংলাদেশের নিত্য রাজনৈতিক ঘটনা উপলক্ষে লেখা উচ্চকণ্ঠ কবিতাগুলো কিংবা অসময়ের নোটগুলোতেও বাম রাজনীতির শিক্ষা ও আকাঙ্ক্ষা সহজলভ্য। তাহলেও মজহারের কবিতায় বিপ্লবের এ ধরনটি প্রধান ধরন নয়; সম্ভবত এটা তাঁর সাফল্যের এলাকাও নয়। তাঁর বিপ্লবী চিন্তা ও কাব্যিক তৎপরতা ফলবান হয়েছে মানবসম্পর্কের অন্য বহু পরিবর্তন-প্রস্তাবে, যার অনেকটাই বাংলা কবিতায় বা চিন্তাজগতে ইতিপূর্বে অনুচ্চারিত ছিল।

ফরহাদ মজহারের কাব্যপ্রজ্ঞা এবং বিপ্লবী চৈতন্যের এই ধরনটি বিশেষভাবে বোঝার জন্য তাঁর নারী এবং প্রেম বিষয়ক কিছু কবিতা পড়া যেতে পারে। আমরা দেখব, তিনি সম্পর্কের নানা নতুন ধরন প্রস্তাব করেছেন, বহু নতুন সংজ্ঞায়ন করেছেন, এবং সামগ্রিকভাবে বিষয়গুলোর সম্ভাবনা ও সীমা বহুদূর বাড়িয়ে দিয়েছেন।

তার মানে, তিনি অনেককিছু বাদও দিয়েছেন। কী সেই বস্তু? মূলত পুঁজির প্রতাপের কালে পুঁজি-নির্দেশিত ও পুঁজি-শাসিত নারীমুক্তির যেসব ধারণা হাওয়াই-পথে এসে পৌঁছেছে আমাদের এই মুল্লুকে, সেগুলোকে তিনি কার্যকরভাবে চ্যালেঞ্জ করেছেন। পুঁজির ইশারায় নারীদের একাংশ কর্মের-ক্রয়ের-গতিবিধির যে-স্বাধীনতা পেয়েছে, তাকেই পরম নারীমুক্তি ধরে নিয়ে, এবং বাজারের উন্মুক্ত পরিসরে নারী-পুরুষ সম্পর্কিত হওয়ার যে-অবারিত সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাকেই প্রেমের মোক্ষ ভেবে নিয়ে, আমরা ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ হয়েছি।

বাংলাদেশের কবিতার একটা বড় অংশ হাজির করেছে এই প্রকৃতির নারী ও প্রেম-সম্পর্ক, যেখানে উৎপাদনসম্পর্ক এবং ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা থেকে পুরোপুরি বিচ্যুত হয়ে নারী-ধারণা মাটির বেশ খানিকটা উপরে হাওয়ায় ঝুলে থেকেছে, আর তার কমনীয়-মোহনীয় অবয়বে কবি-ভেদে যুক্ত হয়েছে কামনা-বাসনার বিচিত্র ছলাকলা।


‘আধুনিক’ হওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে অথবা প্রাচীনপন্থি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে আমরা আমলে আনি নাই, এমন বহু মাল-সামানা তিনি কুড়িয়ে নিয়েছেন বসতভিটার আশপাশ থেকে। সেগুলোকে সাফসুতরা করে, বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সাথে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মিশিয়ে, তুলে এনেছেন কবিতার সীমায়।


প্রচলিত প্রভাবশালী বয়ানগুলো নারীমুক্তির কোনো প্রস্তাব পেশ করে নাই, এমন বলা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ‘ভালো’ কবিতা সম্ভব নয়, তাও নয়। বরং দেখতেই পাচ্ছি, বহু কবি এই ধারণাগুলোর মধ্যেই চমৎকার সব কবিতা লিখেছেন। অন্তত বুর্জোয়া নন্দনতত্ত্বের সাথে এর কোনো বিরোধ দেখা যায় নাই। আমাদের বক্তব্য হল, ফরহাদ মজহার কাব্য করার এই ‘সুবিধা’ নেন নাই। সম্ভবত তাঁর দরকারও হয়নি। তাঁর আছে বিকল্প বহু কাব্যখনি। দৈনন্দিনতার নিত্য সম্পর্কের ছবিটিকে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে পেতে চাইলে নারী তো আপনা-আপনিই একটা পরিসর বা রূপ পেয়ে যায়, যেমন পায় ‘পুরুষ’। সেই রূপটি ‘আধুনিক’ বা ‘প্রগতিশীল’ নাও হতে পারে; কিন্তু উপলব্ধ বা অভিজ্ঞতায়-পাওয়া সম্পর্কজালের সুবাদে তা যে খাঁটি বস্তু হবে, তা নিশ্চয় করে বলা যায়। ফরহাদের কবিতায় এই খাঁটিত্বের একটা মূল্যবান রূপ ধরা পড়েছে।

এটা বেশ আমোদজনক, ফরহাদ মজহার তাঁর প্রথম যৌবনে কোনো ‘প্রেমের কবিতা’ লেখেননি। বরং ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি গ্রন্থভুক্ত ‘রমণী’ কবিতায় ভালোবাসার ধারণাকে প্রচ্ছন্ন চাবুকে শায়েস্তা করেছেন তিনি; কামনা করেছেন এক অন্যতর দার্শনিক প্রাপ্তি। ‘রমণী’ শব্দটির মধ্যে ঐতিহাসিকভাবে পুরুষতন্ত্রের যে-বিষ লীন হয়ে আছে, তাকে নাড়িয়ে দিয়ে নর-নারীর নতুন সম্পর্কের ইশারা রচনা করেছেন তিনি। রমণীর মতো নারী শব্দের সমার্থক আরো কটি শব্দকে প্রশ্নবিদ্ধ করে জায়মান হয়েছে তাঁর একটি তীব্র রচনা ‘কর্তৃত্ব গ্রহণ কর, নারী’। নারী-পুরুষ সম্পর্কের দ্বৈরথে নারীর ঐতিহাসিক পরাজয় এবং পুরুষের সাপেক্ষে নারীর ক্রমশ পণ্য হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে এ কবিতায় কবি এ সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ প্রস্তাব করেছেন।

সাধারণভাবে যে বস্তুকে আমরা প্রেম বলি, তাতে মজহার কখনোই আকুল হন নাই। মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসার ছকটি বরং তাঁর করুণাই কামিয়েছে। মেঘমেশিনের সঙ্গীত কাব্যের ‘প্রেমসঙ্গীত’ কবিতায় এক কর্পোরেট প্রেমিকের দিন-ক্ষণ-ঠিক-করা প্রেমের গান গেয়েছেন তিনি, যেখানে প্রেম করার কাজটি আর-সব দিন ও কাজকে অনাহত রেখে থিতু হয়েছে ছুটি-নেওয়া মঙ্গলবারে। অসময়ের নোটবই কাব্যের ‘প্রেম’ কবিতায় কবি ঠাট্টার চোখে পরখ করেছেন বিজ্ঞাপন ও প্যাকেজ নাটকের প্রতাপে শাসিত আমাদের প্রেমিক-মন; কয়েকটি কৌতুককর ও কৌতূহলোদ্দীপক প্রেম-চিত্রে বন্দি করেছেন আধুনিক ঢাকার প্রেমতত্ত্ব।

অবশ্য অন্তত কিছু সময়ের জন্য, সুভাকুসুম দুইফর্মা কাব্যের চিলতে পরিসরে, প্রেমে মজেছিলেন এই মননশীল কবি; রচনা করেছেন কয়েকটি প্রথানুগ প্রেমের কবিতা— ‘ভালোবাসার নির্বাচিত কবিতা’ ধরনের সংকলনে যেগুলো বেশ মানানসই হবে। ধরা যাক, ‘তোমার স্পন্দন’ কবিতার জলের মতো স্বচ্ছ আর জটিল পঙ্ক্তি চতুর্দশী, স্রোতময় অথচ নিশ্চল বুদবুদ হয়ে যেখানে এক অনুভবসঞ্চারী সত্তা ক্রীড়ারত থেকেছে অনুক্ষণ। এই ঘরানার সম্ভবত সবচেয়ে উপভোগ্য কবিতাটি রয়েছে মেঘ মেশিনের সঙ্গীত কাব্যে ‘তোমার ইস্টিশান’ শিরোনামে। রেলগাড়ি আর স্টেশনের পরিচিত রূপকল্পে কবি এখানে নিজের অনুভবকে বিস্তৃত করেছেন দিগন্ত অবধি, তৈরি করেছেন একই আধারে নিকট ও সুদূরের বোধ, আর শেষে চৈতন্যের ইতস্তত পরিক্রমায় পেয়ে গেছেন অপরিচিতের পরিসরে পরিচিতের স্বাদ। এ দুই কবিতা, বা তাঁর এ ধরনের আরো কিছু কবিতা, অনায়াসেই পাঠ করা যাবে অধ্যাত্ম-উপলব্ধির রূপকল্প রূপে, যেমনটি ঘটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা আল মাহমুদের কোনো কোনো কবিতায়— একই পুকুরে ফোটা দুটি শাপলা ফুলের মতো আলগোছে ভাসমান থাকে দেবী আর মানবী। কিন্তু ‘অনিন্দ্যসুন্দরী তুমি’, ‘আমি চাই সমগ্রতা’ কিংবা ‘নির্মাণ করেছি শিল্পে’ ইত্যাদি কবিতায় ধুলোমাখা পায়ে মাটিতে বিচরণশীল এক মানবীকে সাদা চোখেই দেখতে পাই; টের পাই আকাঙ্ক্ষা আর আবেগের পরিষ্কার রূপরেখা।

প্রেম মজহারের কাছে আকাঙ্ক্ষা মাত্র নয়, কিংবা হয়তবা আকাঙ্ক্ষাই, কিন্তু কখনোই এমন নয় যে, মানব-সম্পর্ক বা মানব-মনের আর দশটা প্রবণতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ধাবমান তীরের মতো একরোখা হবে। মজহারের প্রেম বা আকাঙ্ক্ষা সবসময়ই হিসাবি— অস্তিত্ববান ‘নিজ’-এর জন্য যা যা তাঁর কাঙ্ক্ষিত, সেসবের সমানুপাতিক সংশ্লেষে সে এক সর্বব্যাপি নির্মাণ। তাই যেসব মুহূর্তে কবি সবচেয়ে নতজানু, সবচেয়ে দেওয়ানা, সেসব জায়গায়ও মননের একটি সতর্ক বিচ্ছুরণ নির্নিমেষ চোখের মতো পাহারায় থেকেছে। তাঁর প্রেমাকুল কবিতাগুলো মূলত চতুর্দশপদী— এই তথ্যের সাথে তাঁর কবিস্বভাবের গভীর যোগ আছে।

তিরিশি আধুনিক কবিতার একদেশদর্শিতা এবং সীমাবদ্ধ দৃষ্টির এক নজির এই যে, তাঁরা সকলেই, যেনবা যুক্তি-পরামর্শ করে, রচনা করেছেন নর-নারী সম্পর্কের একটি মাত্র দিক— প্রেমসম্পর্কই কেবল তাঁদের রচনার বিষয় হয়েছে। শামসুর রাহমান মা-পুতের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু সুন্দর কবিতা, লিখেছেন বাপ-বেটার সম্পর্ক নিয়েও। আল মাহমুদের কবিতায় স্ত্রী আর প্রেমিকা প্রায়ই একাকার হয়ে গিয়ে রচেছে সম্পর্কের নতুন ধরন। অন্য অনেক কিছুর মতো এসব তথ্যও প্রমাণ করে, বাংলাদেশের কবিতায় তিরিশের কবিদের একচ্ছত্র প্রভাবের কথা যে মাত্রায় চাউর আছে, প্রকৃত বাস্তবতা তা নয়। যাই হোক, ফরহাদ মজহার এ বাবদ গেছেন আরো অনেক দূর। ‘আধুনিক’ হওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে অথবা প্রাচীনপন্থি হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়ে আমরা আমলে আনি নাই, এমন বহু মাল-সামানা তিনি কুড়িয়ে নিয়েছেন বসতভিটার আশপাশ থেকে। সেগুলোকে সাফসুতরা করে, বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সাথে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মিশিয়ে, তুলে এনেছেন কবিতার সীমায়। যেমন, সুভাকুসুম দুইফর্মা কাব্যের ‘পিতৃস্নেহ’ কবিতায় ধরা পড়েছে নারী-পুরুষ সম্পর্কের এক অচর্চিত ধরন— পিতা-কন্যা সম্পর্ক। এই কবিতায় কবি প্রস্তাব করেছেন অন্যতর এক অপার সম্ভাবনা :

                                  প্রেমেই পুরুষতন্ত্র ভেঙে পড়ে
পিতা ছাড়া এই সত্য এ জগতে কে আর জেনেছে?
কন্যার সত্য যিনি— পিতা যিনি কন্যার কারণে।

এ কবিতার শেষ পঙক্তি— ‘লিঙ্গভেদ লুপ্ত হলে কাব্যযুগে পিতৃস্নেহ হবে’— এই নারীবাদ-কণ্টকিত বিভেদের যুগে এক সুদূর আশাবাদের মতো শোনায়।

মজহারের কবিতাসংগ্রহে এরূপ আশাবাদের বাস্তবসম্মত আশ্বাস আছে। ‘বিবি খাদিজা’ (এবাদতনামা ৩৬) কবিতাটি এই নিরিখে পাঠ করা যাক :

তুমি ডাঁট মারিও না— নবী ছিল তোমার হাবীব
কিন্তু খাদিজার ছিল বেতনের বাঁধা কর্মচারী—

সব নারী জানে তুমি খাটো হয়ে আছো এইখানে
তোমার খাতিরে তবু প্রকাশ্যে তা জাহির করে না।

এবাদতনামার অন্য অনেক কবিতার মতো এ রচনাটিতেও আছে কবি ফরহাদ মজহারের প্রায় অতুলনীয় সরস কথকতার মায়াজাল, আছে বুদ্ধির নিশ্চিন্ত প্রস্তাবে খোদ খোদাকে সওয়াল করার কারিগরি। একটি কাহিনিকথার মধ্য থেকে ঠিক অংশটি বেছে নিয়ে কথা শুরু ও শেষ করতে পারার মুনশিয়ানায় কবিতাটি নিজেকে কেন্দ্র ও পরিধির সুষম আয়তনে সজ্জিত করতে পেরেছে। এসব বাহারি আহ্বানের মজমায় খোদেজা নামের ঐতিহাসিক নারীটি কিন্তু তীক্ষ্ণভাবে হাজির আর সক্রিয়। খোদার নবিকে ‘বেতনের বাঁধা কর্মচারী’ বানানোর ঐতিহাসিক ঘটনাটির কর্তা হয়ে যে কিনা নারীদের জন্য তৈরি করেছে এক স্বস্তিদায়ক পরিসর। নারীজাতির এক প্রতিনিধি খোদেজাকে ‘পুরুষকুলশিরোমণি’ মুহম্মদের সাথে এরূপ সম্পর্কে ক্রীড়ারত দেখে একদিকে আমাদের চেনা ইতিহাস পুনরাবিষ্কারের আকস্মিকতায় আমরা বিনম্র হই, অন্যদিকে আবার উৎপাদন-সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে সুবিধাজনক অবস্থিতিই-যে পুরুষের পৌরুষ— এই সত্যটিও সামনে চলে আসে।

‘বোরখা’ (এবাদতনামা ৩৫) কবিতায়ও পাই প্রায় সমধর্মী সওয়ালের কাব্যোচিত নির্মাণ ও আকস্মিকতা— নারী-পুরুষ বিভেদের প্রভাবশালী চিহ্ন বোরখা যেখানে লম্পটের চোখে কালো পট্টি হয়ে প্রচলিত চিহ্নব্যবস্থায় গুরুতর টেনশন তৈরি করে। তবে ‘শ্রীরাধিকা’ (এবাদতনামা ৬২) কবিতায় পুরানা দর্শনের ছায়ায় ঘটেছে নারী-পুরুষ ভেদলুপ্তির মোক্ষম প্রস্তাবনা :

পরজন্মে মেয়ে হবো, মেয়ে হয়ে স্বয়ং তোমাকে
আস্বাদন করে আমি নাম নেবো শ্রীমতি রাধিকা।

পরম ও প্রকৃতির সম্পর্কের মধ্যে নারীভাবের সুবিধাজনক অবস্থিতিই এই আকাঙ্ক্ষার কাব্য-উৎস; একই সঙ্গে এটি একটি দার্শনিক অনুসন্ধানও বটে। ‘নারীবাদী’ ভাষার প্রভাবশালী ছাঁচের বিপরীতে এই ভাষা একদিকে লোকায়ত, অন্যদিকে বাংলার দর্শনের ঐতিহাসিক চর্চার পরম্পরায় যথেষ্ট পরিমাণে বৈধ।

বাংলা কবিতায় বেশ খানিকটা চর্চিত মাতা-পুত্র সম্পর্কের মধ্যে ফরহাদ, বোধ হয়, কোনো কাব্য-সম্ভাবনা খোঁজেন নাই। বরং ‘কর্তারূপী পুরুষ আর বিষয়রূপী রমণী’-র ছকে আঁটানো পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত সম্পর্ককে কিছুটা বিব্রত করেছেন ভাই-বোন সম্পর্কের বিচিত্র প্রতিভায়। ধারণাটির উন্মেষ লক্ষ করি সুভাকুসুম দুইফর্মা কাব্যের ‘স্নেহে যৌনাকাঙ্ক্ষা হয়’ নামের পদ্যে। স্নেহ, কাম, যৌনতা— শব্দ তিনটির অর্থে ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় যেসব ফারাক আর মিলমিশ গুপ্ত আছে, তাদের সজল মিশ্রণে এই কবিতার আত্মাটি অগম্য অগ্রজার লালিত্যে বালক-ভ্রাতার ঈর্ষামিশ্রিত দীর্ঘশ্বাসের মতো সুখকর হয়ে উঠেছে। ভাবনার এই বীজ ফুলে-ফসলে ধনী মহীরুহের আকারে বিকশিত হয়েছে কবিতার বোনের সঙ্গে আবার কাব্যে।

কবিতার বোনের সঙ্গে আবার একটি উপভোগ্য রচনা। চার মাত্রার স্বরবৃত্তে দুই পর্বের দ্রুত নৃত্যে এখানে ভারি কথারা ভারহীন পালকের মতো চোখে ও কানে বেজেছে। বহুরঙা পেখমের আড়ালে বাংলাদেশের নিকট ও দূর অতীতের সাংস্কৃতিক রাজনীতির কুলজি নিয়ে খেলেছেন কবি। একইসঙ্গে কাব্য করা ও লিপ্ত থাকার মতো দ্বিধাকে এক ধারায় বশ মানানোর উপযোগী লায়েক ভাষা ও রূপকল্প তৈরি হয়েছে কাব্যটিতে। তবে এখানে আমরা নজর দেব দিদি-ছোট ভাই সম্পর্কের বিচিত্র প্রতিভা প্রকাশের ক্ষেত্রে এ কাব্যের সাফল্যের দিকে। প্রকৃতপক্ষে ‘দিদি’ শব্দটিতে আমাদের সামাজিক ভাষার মধ্যে যতগুলো সম্ভাবনা একত্রে খলবলিয়ে ওঠে, তার প্রায় সব কটিকে শুষে নিয়ে এই রূপকল্পের বিকাশ। শব্দটি সম্বোধনসূত্রে হিন্দুসম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত, বয়সে বড়, বিবাহসূত্রে দূরের কিন্তু গর্ভস্মৃতি আর শৈশব-কৈশোরের প্রাপ্তিসূত্রে কাছের এক নারীর ইশারা বহন করে। এই দিদিটির বিয়ে যদি হয় আবার বড় ঘরে, তাহলে দেখা দেবে আকাঙ্ক্ষা ও অভিমানের নতুন তরঙ্গ। এখন উনিশ শতকে নতুন রূপ লাভ করা বাঙালি হিন্দুর দ্রুত সাবালক হয়ে ওঠা, এবং পরে ভারতবর্ষের অংশ হিসাবে রাষ্ট্রীয় পরিচয় লাভ করার পাশে বাঙালি মুসলমানের বিলম্বিত বিকাশ এবং দুই দফা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে থিতু হবার ইতিবৃত্তকে যদি দিদি-ভ্রাতা সম্পর্কের আমেজে পাঠ করি, তাহলে ইতিহাস পাঠের সাথে সাথে আমোদেরও নানান খোরাক হয়। সাথে ব্যক্তি কবির খুনসুটি যোগ হলে মূল সুরটি ব্যাহত হয় না— মজা বাড়ে মাত্র। দিদি-ছোটভাই সম্পর্কের আরেক সুবিধা নিয়েছেন কবি: কয়েকটি স্বীকারোক্তি গোছের কবিতায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করার মওকা পেয়েছেন। অবশ্য এ কাব্যে স্বাভাবিকভাবেই কবির ব্যক্তিসত্তা অত প্রবল নয়, তিনি সমষ্টির প্রতিনিধি মাত্র। এর বাইরে আছে অভিমান বা অভিযোগের কয়েকটি ছত্র। দিদির কাছে তো অভিযোগ করাই যায়। আর দিদি যদি যথেষ্ট পাত্তা না দেয়, তাহলে যেতে হবে মায়ের কাছে— সরস্বতীর দরবারে। সরস্বতী তো কবিতা— মানে ভাষা, যে সূত্রে ভাই-বোনের অচ্ছেদ্য বন্ধনে আজো এই দুই বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী। ‘মোরা একটি বৃন্তে দুইটি কুসুম’ ধরনের পুরানা উচ্চারণের সর্বসাম্প্রতিক— বেশ চৌকস আর কেজো— ভাষ্য হাজির করেছে কাব্যটি।

সম্ভবত ভাই-বোন রিশতা বাংলা ভাষায় আর কখনোই এতটা কাব্যসম্ভব হয়ে ওঠে নাই।

 

অসময়ের নোটবই

লোভনীয় দুর্লভকে কবিতার রূপকল্পে সম্ভবপর করে তোলার যেসব বহুব্যবহৃত আয়োজন আধুনিক বাংলা কবিতায় লভ্য, মজহারের কবিতায় সেসব অব্যবহৃতই থেকে গেছে। এমনকি বিপ্লব-বিদ্রোহের কবিতাগুলোতেও সুন্দর আগামী তৈরির প্রস্তাবনা তাঁর কবিসত্তাকে বিশেষ প্রগলভ করে তোলে নাই। মজহার কোনো অর্থেই সুদূরের কবি নন— রোমান্টিক অর্থে তো ননই, এমনকি আধুনিক অর্থেও নন। তাঁর কবিতার সিংহভাগই সদর্থে ‘বর্তমান’-এর মোকাবেলায় রক্তস্নাত। অসময়ের নোটবই নামে তাঁর যে কাব্যটি আছে, তার বাইরেও বহু কবিতার জন্য এ নামটি বেশ জুতসই। বলা যায়, ‘অসময়’ চিহ্নিত করার নিজস্ব তরিকা তাঁর বহু কবিতার বলার-ভঙ্গি নির্ধারণ করে দিয়েছে।

প্রথম কাব্যগ্রন্থেই বক্তব্যকে উপমা ও রূপকের সবাক সহায়তায় বিস্তৃত করার দিকে তাঁর ঝোঁক লক্ষ করা গেছে। অবশ্য সবসময় ঠিক এলানো নয় তাঁর পঙ্ক্তিমালা; বরং সুভাকুসুম দুইফর্মা, মেঘমেশিনের সঙ্গীত বা এবাদতনামার অনায়াস সুমিতি বেশ উপাদেয় হয়েছে। কিন্তু মোটের উপর বিস্তারের এবং অনুপুঙ্খ বয়ানের ঝোঁকই তাঁর মূল কাব্যপ্রবণতা। চিত্রকল্প তাঁর প্রধান বাহন নয় বলে তিনি খুব স্বাভাবিক কায়দায় দ্বারস্থ হয়েছেন উপমা ও রূপকের; আর বিশেষণখচিত নজিরের পুনরাবৃত্তিতে ভাবকে প্রসারিত করেছেন। কবিতায় যাকে তালিকাধর্মিতা বলা হয়, পদ্ধতিটি তার খুব কাছাকাছি। শামসুর রাহমান ও পরের প্রজন্মের ঢাকাই কবিদের অনেকের সাথে এ দিক থেকে ফরহাদ মজহারের সখ্য আছে।

এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে, মজহারের কবিতায় বুঝে নেয়া ও বোঝানোর প্রবণতা প্রবল। তাঁর বিবৃতিতে বেশ টের পাওয়া যায় ভাঁজ খুলে খুলে দেখা ও দেখানোর কোশেশ। যেনবা খুব বেশি তাড়া নাই তাঁর। যে প্রস্তাবটি ইতিমধ্যে পেশ করা গেছে, তাকেই বিচিত্র আলোর আলাদা আলাদা বিচ্ছুরণে নানা পাশ থেকে দেখানো।

একসাথে অনেক আলো নয়, বরং কোনো একটির সতর্ক প্রক্ষেপণে সম্ভাব্য গভীরতম প্রদেশে চোখ ফেলা। তারপর আবার প্রত্যাবর্তন। অর্থাৎ, এ ধরনের একেকটি কবিতায় যুগপৎ কবি স্বয়ং এবং পাঠক অতিক্রম করে যায় অনেক বৃত্ত, একেকটি বৃত্ত পরস্পর থেকে সরে যায় খানিকটা— সামনে বা কাছাকাছি যে কোনো দিকে। তৈরি হয় বেশ অনেকটা নতুন চোখ।

পদ্ধতিটি বোঝার জন্য আমরা এখানে তিনটি কবিতার নাম নেব। ‘আমি ডেকে বলতে পারতাম হুমায়ুন’ কবিতাটি আছে খোকন এবং তার প্রতিপুরুষ কাব্যে। কবিতার মূল প্রস্তাবটা প্রথম স্তবকেই আছে। নিহত হুমায়ুন ‘কিচ্ছু না-ছুঁয়ে’ সংসার, কবিতা বা প্রেম নিয়ে কাটাতে পারত একটি জীবন। সমাজ, সংসার ও রাষ্ট্র এরকম জীবনই হয়ত চায়। কিন্তু কবিতা যতই এগিয়েছে, ততই উন্মোচিত হয়েছে অন্যরকম হুমায়ুন বা হুমায়ুনগণ— জীবনযাপনের ভিতর দিয়ে সংগঠন, কবিতা, সংসার, প্রেম ইত্যাদির অন্যরকম সংজ্ঞায়ন যাদের নিয়তি। ভরকেন্দ্র স্থির রেখে পরের স্তবকগুলো আস্তে আস্তে সরে গেছে ওই দ্বান্দ্বিক প্রতিসরণের দিকে। ঈষৎ বেঁকে অগ্রসর হওয়া সে স্তবকগুলোতে এরকম জরুরি বোঝাপড়ার উন্মোচন ঘটেছে বিষণ্ণ আর্তিমাখা সুরে।

‘অকস্মাৎ রপ্তানিমুখী পোশাক তৈরি কারখানার কিশোরী শ্রমিক’ কবিতাটি আছে অকস্মাৎ উৎপাদনমুখী নারীমেশিন বইতে। কবিতাটি শুরু হয়েছে উড়তে না-জানা উটপাখির প্রতীকে। শেষে দেখছি মানুষের উড়তে শেখার আশাবাদ। মাঝে এক সুবৃহৎ পরিক্রমা। পুঁজির দেশি-বিদেশি কর্তাগণের বিশৃঙ্খল লীলাক্ষেত্র হয়ে ওঠা উন্নয়নশীল বাংলাদেশ। আপাতত পোশাকশিল্পের কিশোরী শ্রমিকেরাই তাঁর লক্ষ্য। গ্রামীণ অর্থনীতি ও সমাজনীতির মধ্যে টিকতে না-পারা গরিব কিশোরীর নগরবসতি, নগরের আপাত মুক্তি ও চমকে বুঁদ হওয়ার ফাঁকে রফতানিমুখী শিল্পে জীবন ও যৌবনসহ মানুষটির হারিয়ে যাওয়া— এই ক্রমে কবিতাটি বশ করেছে বিপুল মানুষের ইতিবৃত্ত। কবিতাটি ফাটকা পুঁজির কারবারে বিশৃঙ্খল শ্রমশোষণ এবং বিশেষত নারী-শ্রমিকের উত্তম নৃবিজ্ঞান। সে বিজ্ঞান প্রণয়নে মজহার ক্লান্তি বোধ করেন নাই; বক্তব্যের বিস্তারে কার্পণ্য করেন নাই। কিন্তু ধ্রুবপদের মতো করে আরো দুটি কেবলা পুরা কবিতাতেই কার্যকর ছিল। এই নারীমেশিন-যে বৃহত্তর দেশি-বিদেশি প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সে কথা পাঠককে ভুলতে না দিয়ে, এবং ‘মানুষের জীবন’ বলতে কী বুঝব, বারংবার সে প্রস্তাব তুলে, কবিতাটি একরোখা ইমানদারের মতো মনে রেখেছে আপাত লক্ষ্যের বাইরেও তার অন্য গন্তব্য আছে। এই শেষোক্ত দুই কেবলা ধ্রুবপদের মতো ঘুরেফিরে পুনরাবৃত্ত হয়ে কবিতার নিশানা অটুট রেখেছে।
‘রাষ্ট্রদ্রোহী জাহানারা আসছে, হুঁশিয়ার!!!’ কবিতাটি আছে অসময়ের নোটবই কাব্যে। কবিতাটির অব্যবহিত স্তর তৈরি হয়েছে কয়েকটি প্রত্যক্ষ তথ্য বা সংবাদ নিয়ে। জাহানারা ইমাম বাস্তবের চরিত্র, তাঁর ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ খেতাবও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য। কিন্তু এই অব্যবহিত স্তরটি পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে যুক্ত হয়েছে দূরবর্তী আরো বহুস্তরের সাথে। সেখানে বাংলাদেশ তার ইতিহাস-ভূগোল, মিথ ও জনমিতি নিয়ে পুনরুৎপাদিত হয়েছে। শেষোক্ত স্তরটি বা স্তরগুলো কবির আবিষ্কার। কবির উপলব্ধি। স্থান-কালের দিক থেকে এ স্তরের পরিসর অনেক বড়, উপলব্ধির দিক থেকেও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। প্রাত্যহিক বা প্রত্যক্ষ তথ্যের সাথে এই আবিষ্কৃত অপ্রত্যক্ষ স্তর একাকার হয়ে তৈরি করেছে কবিতার একেকটি ইউনিট। কাজেই প্রত্যক্ষত তালিকাধর্মী বা পুনরাবৃত্তিময় হলেও অন্তর্গত মেজাজে তা গতিশীলও বটে। বলা যায়, ইউনিটগুলো ঘুরে ঘুরে এগিয়ে গেছে সামনের দিকে।
মজহারের কবিতার একাংশের ন্যারেটিভ পরীক্ষার জন্য উপরে যে-তিনটি কবিতার উল্লেখ করলাম, তার প্রতিটিতেই একটা বৈশিষ্ট্য কমন— পূর্বোক্ত দুই স্তরের মিলমিশ। এক স্তরে বাস্তবের প্রত্যক্ষতা, অন্য স্তরে আবিষ্কৃত ও উপলব্ধ সত্যের পরোক্ষতা। প্রথমটি নিশ্চিতভাবেই বিশেষ, পরেরটি অনেকটাই সার্বিক। মজহারের কবিতার জন্য দুটিই গুরুত্বপূর্ণ সত্য। আগেই বলেছি, যাপিত জীবনই তাঁর কাব্যের আশ্রয়। শিল্পের অনুরোধে সেই আশ্রয় ত্যাগ করতে তিনি সাধারণত সম্মত হন না। তাহলে বাস্তবে যাপনের সত্যের মধ্যে তাঁর কবিতায় কাব্যসত্যের সুযোগটা কোথায়? এই সুযোগ কবি তৈরি করে নেন প্রধানত আমাদের কথিত দ্বিতীয় স্তরে। সেখানে তিনি বড় পরিসরের আবিষ্কৃত বা উপলব্ধ সত্যের সাথে যাপিত জীবনের মাইক্রো-বাস্তবতার মিলমিশ তৈয়ার করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিবরণধর্মী-বহির্চারী-তালিকাধর্মী-রাজনৈতিক কবিদের সাথে মজহার এ স্তরেই পুরোপুরি আলাদা হয়ে গেছেন।


কবিতায় বিজ্ঞানের সাথে কবির যোগ প্রধানত শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে। শব্দের অর্থগত দিকটি রূপকার্থ আকারে কবিতার ভাবের সাথে যোগ হয়েছে। ধ্বনিগত দিক, এবং কবিতার ইতিহাসের দিক থেকে ব্যতিক্রমী শব্দ ব্যবহারের মজা তো থাকছেই।


মজহারের কবিতার এই আবিষ্কৃত বা উপলব্ধ সত্য তিনি যে-চোখে দেখেছেন বা দেখাতে চেয়েছেন, তা বেশ কতকটা তত্ত্বশাসিত। হামেশাই শ্রেণিতত্ত্বের মানসপুত্ররা শব্দ-অনুষঙ্গ-সম্পর্কসূত্রসহ এটা-ওটা ধার দিয়ে তাঁর দায় লাঘব করেছেন। পাঠকের সংবেদী মনের তুলনায় জানা-শোনা মনের উপর ফরহাদের নির্ভরশীলতা বেশি। কিছু জানাশোনার নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেই কেবল পাঠককে আনকোরা এলাকায় নতুন ভোজে ডেকে আনা যায়। মজহারের নির্ভরতা মূলত এ ধরনের পাঠকের উপর। মন-প্রবণ আরামপ্রিয় পাঠকের জন্য এ কবি খুব সামান্যই লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে মজহারের কাব্যসমগ্রের একটা মধুর দ্বন্দ্বের উল্লেখ করা যেতে পারে। ইউরোপি আধুনিকতা ও যুক্তিবাদিতার পর্যালোচনা এবং অনেকটা তার বিপরীতে প্রেম-প্রজ্ঞা-ভক্তিকে উচ্চকিত করা কবি ফরহাদ মজহারের অন্যতম প্রথম কাব্যপ্রকল্প। অন্য কোনো কোনো দিকের মতো এদিক থেকেও মজহার আধুনিক বাংলা কাব্যধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অ-আধুনিক কবি। কিন্তু প্রেম-প্রজ্ঞা-ভক্তির উৎসারণ তাঁর কাব্যে মোটেই আবেগপ্রবণ ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয় নাই। বরং তাঁর যে কোনো উচ্চারণে পাই বুদ্ধির ধার আর যুক্তির হিসাবি শৃঙ্খলা। মজহারের কবিতা আদ্যোপান্ত যুক্তিশাসিত নির্মাণ।

উপরে আলোচিত কবিতা তিনটির আরেকটি বিশিষ্টতা বুদ্ধিদীপ্ত ও ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরস। ফরহাদ মজহার তাঁর কবিতায় উদযাপন করেছেন একগুচ্ছ প্রবল প্রতিপক্ষ। এই দুখি বদ্বীপের মুক্তিসংগ্রাম যাদের চোখঠারে রাতারাতি পর্যবসিত হল স্বাধীনতার যুদ্ধে, যাদের অভিভাবনায় এ জনগোষ্ঠীর মনুষ্যোচিত সম্ভাবনাগুলো ঘোলা জলে খাবি খাচ্ছে আজতক, সেসব অবিকশিত পেটিবুর্জোয়া এলিট থেকে শুরু করে তাদের পূজনীয় প্রতীক ও গৌরবগাঁথাগুলো মর্মমূলে কেঁপে উঠেছে তাঁর লক্ষ্যভেদী শব্দযোজনায়। ফলে এটা খুব স্বাভাবিক, এই কবি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ আর অট্টহাস্যের ধারালো বিভায় যাপন করবেন তাঁর কাব্যযাত্রা। হয়েছেও তাই। করুণামাখা হাসির এক চিলতে আভা তাঁর কাব্যসংগ্রহের আগাপাশতলা বেশ জুতসই ভঙ্গিতে লীন হয়ে আছে। কিন্তু তাঁর নিজের পক্ষ সবসময়েই হাজির ছিল বলে, দার্শনিক প্রত্যয়ের সাথে অন্তত বাংলাদেশের আর্থসামাজিক সম্পর্কের ও ইতিবৃত্তের নতুন বয়ান তৈরির গরজ সর্বদা উপস্থিত ছিল বলে, ঠাট্টা-মশকারা মাথাচাড়া দিয়ে প্রধান হয়ে উঠতে পারে নাই। এমনকি অসময়ের নোটবই কাব্যের বর্তমানলিপ্ত কবিতামালায়ও হাস্যের সঙ্গে কারুণ্যের ও বিষাদের সুর গোপনে বেজে গেছে। সম্ভবত জমে থাকা হাস্যরসের বিভিন্ন পর্ব একীভূত হয়ে জমা হয়েছে এক পাত্রে, আর এক প্রবল উদগীরণের মতো উৎক্ষিপ্ত হয়েছে গুবরে পোকার শ্বশুর কাব্যে।

গুবরে পোকার শ্বশুর একটি সরস গদ্য-কাব্য। ফরহাদের কবিতাসমগ্রের সিরিয়াস আর গূঢ়ান্বেষী ভাঁড়ারে এ এক চণ্ডাল প্রতিপক্ষ। চণ্ডাল, কিন্তু বেশ লায়েক। সিরিয়াসনেস অবশ্য এ কাব্যেরও ভূষণ। ‘মুর্গিছানা ফুটছে’, ‘আলজিভের ফুসলানি’, ‘শয়তানের লেজকাটা’ ইত্যাদি কবিতা তো রীতিমতো গুরুগম্ভীর থিমের খোঁজে পাঠযোগ্য। কিন্তু এগুলোসহ অপরাপর প্রায় সব কবিতায় সরস কথ্যভঙ্গির চটুল নৃত্যে পড়ার আরাম আর মশকরার ভঙ্গিটাই বড় হয়ে উঠেছে। বলতে পারি, অন্য বিপুল কবিতায় চেপে-রাখা বা আড়াল-করা কৌতুক-হাস্যের কথা পাঠককে নতুন করে মনে করিয়ে দেয় এ কবিতাগুচ্ছ।


গত দুশ বছরের বাংলা কবিতার ধারাক্রমের মধ্যে কবি ফরহাদ মজহার ঠিকমতো আঁটেন না। অথবা বলা উচিত, আধুনিক বাংলা কবিতার অভ্যস্ততা ও আরামের মধ্যে তাঁর কবিতা নানা ধরনের অস্বস্তি তৈয়ার করে।


গণিত ও কানকোর নন্দনতত্ত্ব

বিজ্ঞান, দর্শন ও গণিত ফরহাদ মজহারের কবিতার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশের যুগপৎ শরীর ও মন। কখনো প্রকাশ্য, কখনো গোপন। প্রথমদিকে বিজ্ঞান-সংশ্লিষ্ট, বললে ভালো হয় প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট, শব্দকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে পুরা কবিতার আলাদা মেজাজ তৈয়ার করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। প্রথম দুই বইতে কোথাও কোথাও এরকম শব্দ ব্যবহার তাঁকে বিপজ্জনক মাত্রায় পেয়ে বসেছিল; অনেক ক্ষেত্রে কবিতা ছাড়িয়ে শব্দগুলোর জ্বলজ্বলে জটলা মূর্তিমান হয়ে উঠেছে। অবশ্য ‘দাঁড়িয়ে আছি, মধ্যদুপুর— এখন ভীষণ এসিড ঝরছে’র মতো জুতসই ব্যবহার, কিংবা ‘নজরুলের চোখ’ কবিতায় ‘রেডিও একটিভ’ শব্দযুগের ব্যঞ্জনাময় ব্যবহারের মতো কাব্যিকতাও দুর্লভ নয়। আর যেসব জায়গায় তাঁর অন্য কাব্যকৌশল একীভূত হয়েছে বিজ্ঞানের সাথে, সেখানে তৈরি হয়েছে ভিন্ন ধরনের সৌন্দর্য, বাংলাদেশের কাব্যালোকে যার জুড়ি মেলা ভার। দুটি কবিতার উদাহরণ দিই। ‘আমার আপা এবং তার বান্ধবীদের য়ুনিভার্সিটি’ একটি ব্যঙ্গাত্মক কবিতা। মননপ্রধান বিদ্রুপাত্মক কবিতাটিতে পঁচিশে মার্চের পরেও বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাভাবিক দেখাতে তৎপর অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সমালোচনা আছে। একটি স্তবক এরকম :

বেঞ্চির উপর কনুই
শেকড়ের মতো কনুই থেকে গজিয়ে ওঠা
উদ্ভিদের মতো হাত,
হাতের পল্লবিত পাঁচটি অসবুজ আঙুলের
আদরের ভিতর
ক্লোরোফিলহীন
হলুদ পুষ্পিত মুখ—

উদ্ভিদবিজ্ঞানের প্রশ্রয়ে আর আদুরে তরুণীর ক্লাসে বসার সজীব সজল চিত্রাত্মক বর্ণনায় স্তবকটি কার্জন হলের লাল-সবুজে বেশ আলগোছে ঝুলতে থাকে।

‘সন্তানের জন্ম’ কবিতার শুরুতেই হাসপাতালের ছবি আছে। শিশুর জন্ম-মুহূর্তকে সপ্রাণ ও বাস্তবসম্মত করে তোলার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রীয় শব্দের অবারিত আহ্বানে আয়োজনটি জমেছে ভালো। কবিতাটির ধীর-বিক্ষুব্ধ-বিস্রস্ত কথনভঙ্গিতে বিক্ষোভের-বিদ্রোহের সুর ধ্বনিত হয়েছে, এবং সম্ভবত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নকে স্থান-কাল ও বিবেচনার বড় প্রেক্ষাপট থেকে বিচিত্র সম্ভাবনায় বাজিয়ে দেখার রূপকল্প হিসাবেই এটি পাঠ্য। সেদিক থেকে জন্ম-মহূর্তের আধুনিক এনতেজাম এ কবিতার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে।

এসব কবিতায় বিজ্ঞানের সাথে কবির যোগ প্রধানত শব্দ ব্যবহারের দিক থেকে। শব্দের অর্থগত দিকটি রূপকার্থ আকারে কবিতার ভাবের সাথে যোগ হয়েছে। ধ্বনিগত দিক, এবং কবিতার ইতিহাসের দিক থেকে ব্যতিক্রমী শব্দ ব্যবহারের মজা তো থাকছেই। ত্রিভঙ্গের তিনটি জ্যামিতি কাব্যের দ্বিতীয় পুস্তক অর্থাৎ ‘মৃগয়া’ থেকে অন্য একটি কৌশল লক্ষ করি। পুরা কবিতাকে রূপক বা অ্যালিগরি আকারে নির্মাণ করার এ কৌশলটি মজহার বেশ আরামের সাথে অন্যত্র, এমনকি গুবরে পোকার শ্বশুর কাব্যেও, ব্যাপকভাবে ব্যবহার ও ভোগ করেছেন।

তবে ফরহাদ মজহারের বিজ্ঞানলিপ্ততার তাৎপর্যপূর্ণ রূপান্তর ঘটেছে খসড়া গদ্যের কয়েকটি চিলতে গদ্যে। এখানে প্রযুক্তির বদলে বিজ্ঞান এসেছে বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে; সাথে শামিল হয়েছে গণিত ও জ্যামিতি। যেমন, ‘বৃষ্টি ও বিজ্ঞানের কবিতা’ নামের রচনাটিতে বৃষ্টি ও কদমফুল-মথিত এক আরোহীর অনুশীলন প্রত্যাশা করেছেন কবি, যে কিনা ‘নষ্ট দিকনির্দেশহীন’ বিজ্ঞানকে চালিত করবে প্রগতির দিকে। গদ্যাক্রান্ত বৈজ্ঞানিক দর্শন এ কবিতার বৃষ্টিমুখর কাব্যলোকে একটি গভীর ও দূরসঞ্চারী আকাঙ্ক্ষার রূপকল্পে পড়ে বেশ ‘কবিতা’ হয়ে উঠেছে। এ ধরনের কবিতাগুলোর মধ্যে ‘পূর্ব-পশ্চিম’ সম্ভবত সফলতম। পূর্ব দিগন্তে উন্মীলিত আলোর ছটার সাথে মিলিয়ে উদয়লোভী ভৈরবের রাগিণী আমির খসরুর আলখেল্লায় আসীন হয়ে যেন প্রতীক্ষা করছিল য়োহান সেবাস্তিয়ান বাখ্-এর পিয়ানো আর অর্গানের জন্য। এবার তাহলে এ ‘সঙ্গীতের গায়ে হেলান দেয়া’ সকালে, সমীকরণ ও সূত্র, ব্যাকরণ ও বীজগণিত ফলবতী হবে— ‘অংকের নিয়ম থেকে অনন্তের সংখ্যাগুলো উৎপাদন করতে শিখবে’।

এবং এরপর মেঘ। মেশিন। মেঘ মেশিনের সঙ্গীত। এই যন্ত্রশাসিত পুঁজিধর্মের যুগে গতি আর পরাধীনতার যুগল চাপে বিধ্বস্ত মানুষের কান্না ছয় মাত্রার নিয়ন্ত্রিত গান হয়ে বেজে গেছে এ কাব্যের গীতল মাত্রাবৃত্তে। কর্তাসত্তা হারিয়ে যন্ত্রের বশীভূত হয়ে ওঠা সে মানুষদের ইশারা আমরা আগে খানিকটা দিয়েছি। এখানে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই চারটি কবিতার দিকে। ‘তোমার ঝাণ্ডা বইবে কে?’, ‘মেঘমেশিনের সঙ্গীত’, ‘চাঁদ/ ইলেকট্রিসিটি অথবা কবিতা/ গদ্য’, আর ‘গণিত ও কানকোর নন্দনতত্ত্ব’।

বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির ফারাক আছে। আবার যে-বিজ্ঞান বা প্রযুক্তির কাছে মানুষ তার কর্তাসত্তা হারিয়ে ফেলে বা বিসর্জন দিয়ে দাস হয়ে আছে, তার সাথে মানুষের সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের মামলা আছে। সংস্কৃতি ও মেশিনের নামে প্রকৃতির সাথে মানুষের যে বিচ্ছেদ, তার মূল্যায়নও জরুরি দার্শনিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তার সাথে যদি যুক্ত হয় মানুষের শিল্পকর্মের সাথে সামগ্রিক সম্পর্কশাস্ত্রের যোগ ও টানাপড়েন, তাহলে মীমাংসাটা আরো জটিল হয়ে ওঠে। উপরের চারটি কবিতায় কবি বিজ্ঞান-দর্শনের এসব জটিল প্রশ্নকে কবিতার ভাষায় পোষ মানিয়েছেন।
মজহার জটিলতাকে সরল করে এনেছেন। কিন্তু দার্শনিক গভীরতায় বোধ হয় ছাড় দেন নাই। তিনি গেছেন কয়েক-স্তর অনুবাদের মধ্য দিয়ে। তথ্য ও জ্ঞানের ভার লাঘব করে এসে পৌঁছেছেন এক ধরনের প্রজ্ঞাময় উপলব্ধিতে। তারপর নির্বাচন করেছেন সুবিধাজনক রূপকল্প— মেঘ, মেঘের বিদ্যুৎ, ইলেকট্রিসিটি, মেশিন, বিদ্যুতের খুঁটি, চাঁদ, মাছ ইত্যাদি। আসলে উপাদানগুলোকে সুবিধাজনক রূপকল্পে সাজিয়ে কবি রচনা করেছেন সম্পর্কশাস্ত্র। প্রশ্ন তুলেছেন, উত্তর খুঁজেছেন; জানা বা আবছা-জানা প্রশ্ন ও উত্তরকে বিন্যস্ত করেছেন খুব চেনা কাঠামোয়। নিখুঁত ছয় মাত্রার অতি সাবলীল মাত্রাবৃত্তে তখন কথাগুলো মসৃণ গানের মতো প্রবাহিত হয়েছে। কয়েকটি উদাহরণ দিই :

পৃথিবীতে আছে মেঘ ও মেশিন
কাব্য ও মেধা অগণ্য
কিন্তু কোথাও দেখি নি মানুষ
উভয়ের যোগে অনন্য। [‘তোমার ঝাণ্ডা বইবে কে?’]

ওগো মেঘ ওগো ঊর্ধ্বগামিতা ফুরায়নি তবু আশা
আজো আছি পৃথিবীতে
বিজ্ঞান জানি লক্ষ্যচ্যুত তবু সেও পাবে ভাষা
শিল্পের পরিধিতে। [‘মেঘমেশিনের সঙ্গীত’]

যামিনীর শেষ যামে উঠে আসে মাছ—
গভীর অধীর নিবিড় ভাষার রীতি,
প্রণয়ন করে আমার সকল গানে
বিদ্যুৎ আর জ্যোৎস্নার সম্প্রীতি। [‘গণিত এবং কানকোর নন্দনতত্ত্ব’]

বিজ্ঞান ও দর্শনকে কবিতার ভাষায় বশীভূত করতে পারা বাংলা কবিতায় ফরহাদ মজহারের অন্যতম প্রধান কীর্তি।

 

কাব্যভাষার আলাদা টান

দেখা যাচ্ছে, গত দুশ বছরের বাংলা কবিতার ধারাক্রমের মধ্যে কবি ফরহাদ মজহার ঠিকমতো আঁটেন না। অথবা বলা উচিত, আধুনিক বাংলা কবিতার অভ্যস্ততা ও আরামের মধ্যে তাঁর কবিতা নানা ধরনের অস্বস্তি তৈয়ার করে। এ থেকে অবশ্য পুরানা বাংলা কবিতা বা বাংলা লোক-কবিতার ভাববলয়ের সাথে তাঁর কোনো রকম আত্মীয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় না। তাঁর দাবির যে অংশটি নির্দ্বিধায় কবুল করা যায় তা হল, যাপিত জীবনের বাইরে তাঁকে কবিতা তালাশ করতে হয় নাই। বাংলা কবিতায় অত্যন্ত প্রতাপশালী মিথ, রোমান্স ও রোমান্টিক কল্পনাপ্রবণতা তাঁর কবিতায় খুব একটা দেখা যায় না। আভিধানিক শব্দ তাঁর কবিতায় নাই বললেই চলে। আর তাঁর কবিতার ভাবকথা তৎপরতার সাথে আবশ্যিক কোনো বিরোধ তৈয়ার করে না।

তিরিশ এবং তৎপরবর্তী প্রভাবশালী কাব্যভাষার সাথে মজহারের কবিতার আরেকটি বড় ফারাক আছে। ফর্মালিস্টরা যে অর্থে কবিতার ভাষাকে ‘প্রচলিত অর্থব্যবস্থায় পরিকল্পিত সন্ত্রাস’ হিসাবে সাব্যস্ত করেছিল, জীবনানন্দীয় কাব্যভাষাকে তার নিরিখে পাঠ করা চলে। মজহারের কবিতায় প্রচলিত চিহ্নব্যবস্থার ব্যত্যয় প্রবলভাবেই আছে; কিন্তু তার ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। বদলটা তিনি করেছেন মূলত চিন্তাস্তরে। ভাষা চিন্তাকে অনুসরণ করেছে। ওই চিন্তার সন্ত্রাসই তাঁর কবিভাষার সন্ত্রাস। রাজনৈতিকতার দিক থেকে চল্লিশের কবিদের সাথে তাঁর বেশ কতকটা আত্মীয়তা আছে। বাংলাদেশের ষাট ও সত্তরের প্রভাবশালী কবিভাষার সাথেও তাঁর খানিকটা মিল আছে। কিন্তু এসব আত্মীয়তা কবিভাষার বা কাব্যরূপের কোনো অন্তর্নিহিত বিশিষ্টতা নির্দেশ করে না; বাইরের কিছু মিলের জানান দেয় মাত্র। তিনি আলাদা হয়েছেন মূলত চিন্তার দিক থেকে, লিপ্ততার দিক থেকে, আর চিন্তাকে লিপ্ততার ভাষায় অনুবাদ করার ক্ষেত্রে কিছু বিরল সাফল্যের দিক থেকে। মজহারের কাব্যভাষার সাফল্য মূলত চিন্তাকে কাব্যভাষায় বশীভূত করার সাফল্য— কিছু ব্যতিক্রম সত্ত্বেও এ কথা বোধ হয় জোরের সাথে বলা যাবে।

ফরহাদ মজহারের কবিতা শ্রেষ্ঠাংশে লিরিকেল নয়, গদ্যাক্রান্ত। আবেশ তৈরি করে না, ভাবায়। দৃশ্যকল্পের কুহকী ইন্দ্রজালে বিবশ কিংবা বুঁদ হয়ে থাকার আরাম দেয় না, হাজির করে কর্কশ ও অস্বস্তিকর সব সম্পর্ক— যেসব যোগ বা বিযোগকে আমলে না এনে আমরা জানায়-অজানায় কাটিয়ে দিয়েছি গত কটি রাজনৈতিক দশক। মজহার বেশ রাজনৈতিক দিন কাটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। এই ছোট্ট দ্বীপদেশটির কেন্দ্রশাসিত রাজনৈতিক ফর্দগুলোতে তাঁর চোখ ছিল, মন ছিল, আর ছিল ইন্দ্রিয়-পথে মনে-মননে প্রবেশ-করা স্নায়বিক অনুরণন। চোখ ছিল অন্যদের উপরও— কেন্দ্র আর প্রান্তের বিচিত্র পক্ষপাতে কী চমৎকার বদলে যাচ্ছে মানুষের মুখ আর মানচিত্র। ফরহাদ মজহারের কবিতা এ অর্থে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের রাজনীতি আর রাজনৈতিক অর্থনীতির জরুরি ইতিবৃত্ত।

মজহারের কবিতার চিন্তা, রাজনীতি ও প্রজ্ঞা এক সম্পূর্ণ নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে এবাদতনামায়। রাজনীতি ও চিন্তার আরো কিছু নতুন নিরীক্ষা দেখা গেছে সাম্প্রতিক কবিতায়। তবে সে আলাপ এখানে নয়। কোনো নতুন কিস্তিতে।

 



মোহাম্মদ আজম

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক, সাহিত্য সমালোচক, গবেষক ও লেখক। তত্ত্বমূলক প্রবন্ধের কাগজ ‘তত্ত্বতালাশ’-এর সম্পাদক। জন্ম ২৩ আগস্ট, ১৯৭৫ নোয়াখালীর হাতিয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে এমএ এবং পিএইচডি। বর্তমানে ওই বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। পিএইচডি গবেষণার বিষয় ‘বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও বি-উপনিবেশায়ন’। আগ্রহের বিষয় সাহিত্য, নন্দনতত্ত্ব, ইতিহাস, রাজনীতি ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন। ছোট-বড় শতাধিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। অনুবাদ করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু তাত্ত্বিক রচনা।

প্রকাশিত গ্রন্থ:

বাংলা ভাষার উপনিবেশায়ন ও রবীন্দ্রনাথ [২০১৯]; বাংলা ও প্রমিত বাংলা সমাচার [২০১৯]; কবি ও কবিতার সন্ধানে [২০২০]; হুমায়ূন আহমেদ : পাঠপদ্ধতি ও তাৎপর্য [২০২০]; বিষয় সিনেমা : তিনটি অনূদিত প্রবন্ধ [২০২০], সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও বাংলাদেশ [২০২২], চিন্তার মুসিবত তালাল আসাদের বাতচিত [২০২৩], নির্বাচিত কবিতা : সৈয়দ আলী আহসান [২০১৬], নির্বাচিত কবিতা : কাজী নজরুল ইসলাম [২০২২]

শেয়ার