সংযোগ ও অতিক্রমণের মাসুদ খান | মোস্তফা হামেদী

একটা কমন কথা শোনা যায়, মাসুদ খান ‘কসমিক রিয়েলিটি’র কবি। আমি বহুদিন ধরে এই বিষয়ে ভাবছি। বিজ্ঞানের বিষয়-আশয় যুক্ত হওয়াটারে এত বেশি নম্বর দিলে, খানের কবিতার বড় দিক বাদ পড়ে যায়।


মাসুদ খানের কবিতার সাথে পয়লা পরিচয় কবে, তা আর মনে নাই। তবে তার লগে দেখা হওয়ার কথা আলবৎ মনে আছে পূর্ণাঙ্গ দৃশ্যসহ। কবিতা লেখার নাম করে তখন ফেব্রুয়ারি এলেই মেলার বহেরাতলায় দিন পার করি। একদিন সন্ধ্যায় শিক্ষাগুরু মোহাম্মদ আজম এক গোঁফঅলা লম্বাটে ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করাই দিলেন। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে স্যার বললেন, হেই হামেদী, মাসুদ খানকে চিনো? স্যারের কণ্ঠে আমাকে বিস্মিত করতে পারার আনন্দ। কারণ কবিতা শিখতে চাওয়ার কালে যে জীবিত কবিদের আমরা কিংবদন্তিতুল্য ভাবতাম, তার মধ্যে খান বড় একটা ফিগার। স্মিত হাসিতে তিনি শুভেচ্ছার প্রত্যুত্তর করলেন। তার বই `সরাইখানা ও হারানো মানুষ’ কিনে কবির স্বাক্ষর খোদাই করলাম। এক ঝলক খানকে দেখার সেই স্মৃতি একটা বড় স্মারক হয়ে থাকলো জীবনে। সেই অমূল্য দৃশ্যকে সরিয়ে নজর ফেরাতে চাই কবিতার দিকে। কেননা কবি সোহবতে থাকবার সবচেয়ে বড় উপায় তার টেক্সটের মধ্যে বিহার করা। গত তিন দশকে আমার ধারণা বহুল পঠিত যদি কেউ হয়ে থাকেন, তার মধ্যে খান থাকবেন। তবে পাঠক শ্রেণির ক্যাটাগরি করলে হয়তো ‘বোদ্ধা’ পাঠকই তার পাঠকের বড় অংশ হয়ে রবে। সে আলাপ পরে করা যাবে। তবে আগে তার কবিতার সাথে আমার সংযোগের ও অতিক্রমণের দিকগুলারে তালাশ করে লই।

টেক্সটের সাথে ব্যক্তি, তার ছোটবেলার জীবন এসবের সম্পর্ক হামেশাই পাই/খুঁজি আমরা। খানে নিশ্চয়ই এসবের যোগ আছে। তবে নতুন যোগ হইছে তার বিজ্ঞান শিক্ষার অভিজ্ঞতা। মাসুদ খানের কবিতা নিয়ে ম্যালা আলাপ হইছে দেশে। একটা কমন কথা শোনা যায়, মাসুদ খান ‘কসমিক রিয়েলিটি’র কবি। আমি বহুদিন ধরে এই বিষয়ে ভাবছি। বিজ্ঞানের বিষয়-আশয় যুক্ত হওয়াটারে এত বেশি নম্বর দিলে, খানের কবিতার বড় দিক বাদ পড়ে যায়। পরে আমি পড়ে যা পাইলাম, মাসুদ খানের পয়লা দিকের কবিতার মূল জায়গাটা হইলো শব্দ, সুর আর আইডিয়া। এইগুলা যদিও সব কবিরই বেসিক। কিন্তু মাসুদ খান বড় কবির মুন্সিয়ানায় এই দিকরে যথেষ্ট সামাল দিতে সচেষ্ট আছিলেন। যদিও তার কান আদি ও অকৃত্রিম বাঙাল সুরের লগে এঙ্গেজড আছিল, কিন্তু তার ডিকশনের খরখরা ভাবটা কোথাও না কোথাও রয়ে গেছিলো। এইটারে ‘কালের দোষ’ হিসাবে পাঠ করন যায়।

মাসুদ খানও আর বহু আশির কবির মতো তৎসম শব্দের জলদগম্ভীর আবহরে এড়াইতে পারছিলেন না। আজ এক ধরনের সহজ চলিত বাংলার কালে আমার এইসব কানে বাজতেছিল আর কী! কিন্তু এইসব গড় আলাপরে ছাপাইয়া যায়, মাসুদ খানের লোকগ্রাহ্য কবিতাগুলিরে বিবেচনায় নিলে। জনপ্রিয়তা শব্দটার বিপদ ঠাওরে আমি ‘লোকগ্রাহ্য’ শব্দটা নিলাম। বহু পড়া সেই সব কবিতা আজিও পাঠ করে মনে হইলো এক মাসুদ-এ আসলে দুই মাসুদের আবাস। একজন পিছন থেকে টেনে ধরছে, আরেকজন ‘ফিঙ দিয়া দেই তিন দোল’ করে পরকালের কবিতাভাষায় সমর্পিত হইছে। আমি মূলত সেই মাসুদকে ধরতে চাই।

মাসুদের পোয়েটিক ডিকশনের চেয়ে আমার আলাপের মূল ফোকাস হইলো মাসুদ লোকে কেন পড়ে কিংবা পড়বে ভাবীকালে?

কাগজ প্রকাশনের শ্রেষ্ঠ কবিতার পাতা উল্টাইলেই পয়লা নজরে আসে ‘কুড়িগ্রাম’ কবিতা। প্রথম লাইনটাই এক আশ্চর্য আকর্ষণ তৈয়ার করে। তারপর ক্রমাগত টানতে টানতে এক অদ্ভুত জগতে নিয়া হাজির হয়। যেখানে ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম স্থানচ্যুত হয়ে নভোলোকে গিয়ে অবস্থান চিহ্নিত করে। আর

“সেই দেশে, কুড়িগ্রামে, ওরা মাছরাঙা আর পানকৌড়ি-দুই বৈমাত্রেয় ভাই
কুড়িগ্রামের সব নদী শান্ত হয়ে এলে
দুই ভাই নদীবুকে বাসা বাঁধে
স্ত্রীপুত্রকন্যাসহ তারা কলহ করে।”

 

কন্যাসংহিতা কবিতায়,

“কন্যা বারবার ঘুমিয়ে পড়ছে নদীতীরে
আজ সকাল থেকেই।
বারবার কেন ঘুমিয়ে পড়ছে?
যদিও নদীকূলেই বাস চিরদিন আমাদের,
একেবারে নদীতীরে নয়, একটু দূরে।
তবে কি বিশ্বের সব বিস্ময়ের শুরু ওই ঘুমবিন্দু থেকে?”

 

এই যে বয়ন, সাধারণ শব্দের বিরল সমাবেশ তা পাঠকের পুলককে মুহূর্তেই সক্রিয় করতে পারে। কোনো ঘোরপ্যাঁচ নাই, কিন্তু কাব্যের সমস্ত সত্য নিয়া হাজির।

আবহের বিজ্ঞানপনা বাদ দিলে মাসুদ খানের কবিতার আরও একটা বড় গৌরবের দিক হইলো ইমেজ।কল্পনাশক্তিকে মোলায়েম করে ব্যবহার করার মনীষা তার মধ্যে খুবই সুলভ হয়ে রইছে।

“সাবস্টেশনের আলো
তরুণ প্রফেটের মতো জ্বলে।
যথাক্রমে কাঁকর ও হেলেঞ্চাশাক সুরমা হয়ে যায়।

(সাবস্টেশনে একা একজন লোক)

 

“এই সেই ফল
সেই মিরাকল
রূপকের মতো ঝুলে আছে পৃথিবীর বহু ছায়াচ্ছন্ন দেশে দেশে।
দেখতে যেন-বা এক সবুজ গ্রেনেড
আবার কিছুটা বটে হৃৎপিণ্ডের মতো-“

(আতাফল)

 

“আলফাচালিত আলোক-লতার ঝাড়
প্রতিটি লতার শীর্ষবিন্দু ধ্রুবকের মতো জ্বলে।
নদীগুলি বহুস্তর কাচের প্রবাহ।

(তূর্ণট্রেনে আলোকবধূর পিত্রালয়ে যাওয়া)

 

মাসুদ খানের কবিতা মূলত বর্ণনা অভিমুখী। বানের স্রোত যেমন সমস্ত কিছুকে টেনে নিয়ে যায়, এমন সর্বগ্রাসী ঝোঁক খানেও আছে। ফলে প্রচুর উপকরণ-উপাদানে ঠাঁসা তার কবিতা। বাক্যের পর বাক্য দুর্দম বেগে ধেয়ে চলে। ফলে গতিময়তা এখানে এক ধরনের বাড়তি যোগান হিসেবে আসছে। আর অনুষঙ্গ ও আবহ নির্মাণের অভিনবত্ব বর্ণনাকে ক্লিশে করে না। ফলে একটার পর একটা লাইন পাঠককে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সামনে এনে দাঁড় করায়।

এই যে বহুদিক থেকে বিষয়াবলি কেবলি জড়ো হইতে থাকে, তার পিছনে কাজ করে আবেগজাত উস্কানি। পঙক্তির পর পঙক্তি জুড়ে দেয় সে আবেগমথিত সুর। ফলে অবোধ্য বিষয়ও পাঠের আওতায় চলে আসে।


আমার মনে হয় ষাটকে অতিক্রম করতে যাওয়ার তাড়না বাংলা কবিতাকে যতটা দিয়েছে, নিয়েছে তারো অধিক। সেই ত্যাগের বড় একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে মাসুদ খানের কাব্যভাষা।


টানা বর্ষণের মধ্যে বিজলি চমকানোর মতো হঠাৎ হঠাৎ করে কিছু চৌম্বকীয় লাইন আঁকড়ে ধরে।

“শৈশবের কালে, এক আশ্চর্য মশলা-সুরভিত
গুহার গবাক্ষপথে আচম্বিতে ভেসে উঠেছিল মেঘ,
যার বাষ্পে বাষ্পে কূটাভাস।”

আমি থাকি দূরের রূপতরঙ্গ গাঁয়, আর তোমার সহিত
তোমার সাহিত্য দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।”

” আমার সখারা দূরের, অনেক দূরের শহরে থাকে।
শুধু
একটি সখার নদীর কিনারে বাস
বিদেশি নদীর রাংতা-মোড়ানো বাঁকে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
বন্ধু আমার নদীর কিনারে থাকে।”

(সখাসংগীত)

 

এই চমৎকার বাকপ্রতিমা মাসুদ খানের একটা শক্তির জায়গা বৈকি। কিন্তু এক আশ্চর্য আপোষে মাসুদ খান কেন জানি এই ভাষাটাকে ছেনে তুললেন না! আমার মনে হয় ষাটকে অতিক্রম করতে যাওয়ার তাড়না বাংলা কবিতাকে যতটা দিয়েছে, নিয়েছে তারো অধিক। সেই ত্যাগের বড় একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে মাসুদ খানের কাব্যভাষা। এতো মিঠা মিঠা পঙক্তি তার বিপুল সৃষ্টির মাঝারে ‘চকিত ভুক্তি’র মতো লাগে কখনো।

আমার ধারণা বাংলা ভাষা আয়েশি ভাষা। বিশেষত বাংলা ভাষা-অঞ্চলের যত পুবে যাওয়া যায়, দাঁত ও চোয়ালের জবরদস্তির চেয়ে ঠোঁটের আলতো ছোঁয়াটা শব্দচয়নে মুখ্য হয়ে ওঠে। এখানে নদীভাঙা তীরের মাটির মতোই শব্দও নরম। খানের কবিতার বড় জায়গা জুড়ে এই ‘শব্দবোধে’র খামতি কানে এসে লাগে। ‘ধীবর’, ‘বৈশ্যদের কাল’‘বৃষ্টি-১, ‘বৃষ্টি-২’, ‘বৃষ্টি-৩’, ‘বৃষ্টি-৪’, ‘বর্ষণবোধ’, ‘শৈবালিনী’ ‘হাওয়া’ ‘সখাসংগীত’ এই কারণেই হয়তো মাসুদ খানের প্রধান কাব্য প্রবণতা হয়ে উঠতে পারেনি।

মাসুদ খানের কবিতা পরে ধীরে ধীরে বৌদ্ধিক শাসনে জারিত হয়েছে ভাষা ও ছন্দের শাসন থেকে মুক্ত হয়ে। সম্ভবত একধরনের আত্মআবিষ্কার বা দার্শনিক উপলব্ধিজাত ধারণার প্রকাশ হয়েছে সেসব কবিতা। ছদ্মরূপক ও ছায়া-উপমায় মাসুদ খান ধরতে চেয়েছেন মানুষের জীবন ও সমাজের নানা চালচিত্রকে। সেসব ক্ষেত্রে সুরের চেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে বক্তব্য, আবেগের চেয়ে অভিব্যক্তি। এসব কবিতা পাঠে ইন্দ্রিয় সুখের চেয়ে মননের উৎকর্ষ সাধিত হয় বেশি। যেমন, ‘জঙ্গল’ কবিতায়-

“এই এক বিভোর জঙ্গল যেখানে বাঘকে জাগতে হয়
সূর্য-জাগারও আগে, আর ভোর থেকে সন্ধ্যা অব্দি
ধেয়ে যেতে হয় অবিরাম হরিণের ঘ্রাণে।
আবার হরিণকে ছুটতে হয় বাঘদেরও আগে।
এই জঙ্গল এক অবারিত দৌড়ক্ষেত্র, এক অবাধ ধাবনায়তন,

………………………..

এই এক অনিঃশেষ অরণ্য-অভিধান
এক ফুৎকারে সমস্ত নিয়ম-নিয়ামকের অবসান।”

 

সৌন্দর্য সৃষ্টির চেয়ে জগৎ ও জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাওয়াটাই এখানে প্রবল হয়ে উঠেছে। বক্তব্যই এখানে মহৎ। ‘রাজহাঁস’, ‘রূপান্তর’, ‘অভ্যুত্থান’, অনেকখানি এই তরিকার। তবে কোথাও কোথাও কবির দৃষ্টিসুখ তথা ইন্দ্রিয়সজ্ঞা অভিজ্ঞানের অবলম্বন হয়েছে। ‘প্রাকৃতিক’,‘আচমকা ব্রাশফায়ার, অতকিতে অচেনা বৃষ্টির’-এ তেমন কিছু আভাস পাওয়া যায়।

“গাছপালা পশুপাখিদের মতো আপনাআপনি
গজিয়ে উঠেছে বাড়িগুলি, পাহাড়ের গায়ে।
দেশলাই বাকশোর আকারে ওই সাজানো উধ্বগ আবাসন।”

(প্রাকৃতিক)

 

“ওরা সব ফেরারি তরল,
প্রতিটি ফোঁটার মধ্যে ওরা গ্রেফতার করে আনে
কতশত অচেনা প্রাণের বীজ।
মাটিতে পড়েই ফেটে যাচ্ছে বৃষ্টিফোঁটা, ডিমের মতন…
ফেটে গিয়ে উগ্র বেনজোয়িনগন্ধসহ হাওয়ায় মিশিয়ে দিচ্ছে
অগণিত অভিনব প্রাণের পরাগ।”

(আচমকা ব্রাশফায়ার, অতকিতে অচেনা বৃষ্টির)

 

নৈর্ব্যক্তিকতা মাসুদ খানের বর্ণনার সাধারণ একটা দিক। ব্যক্তিগততা খানে সুলভ নয়। ফলে তার বিষয়-অনুষঙ্গ অনেকখানি দূরাগত মনে হয়। এই ভঙ্গি প্রফেটিক বটে। কিন্তু আমরা তো নিজ রং-রূপের কবিরেও চাই। শুধু বাইরের বস্তুসংঘাতের কান্ডকারখানায় আমাদের পুরাপুরি পোষায় না। কবির অন্তর্জগত তবে কোথায় রচিল গীতি! কবির জ্ঞান ও সংবেদনের পরিচয় আমরা পাইলাম বিস্তর। কিন্তু রক্ত-মাংসের কবির দেখা পাইলাম ক্ষীণ- যেনবা মিটিমিটি তারকার মতো।

মাসুদ খানের কবিতার জগৎ কী, তাই নিয়া ভাবি! বড় কবিদের নাকি কবিতার জগৎ থাকতে হয়, হামেশাই এমন আলাপ শোনা যায়। কিন্তু খান যারা ষাটের এক রৈখিক ‘দেশ’ চেতনা আর সত্তরের ‘স্লোগান’ ধর্মীতা থেকে কবিতাকে ‘আত্মমগ্ন অভীপ্সা’র পথে নিয়ে যেতে চেয়েছেন তাদের একজন। ফলে তার দেশ ঐ ‘কাঁপা কাঁপা রূপকাহিনির মতো’। তার যে প্রসন্ন দ্বীপদেশ, সেটাও চিরপরিচিত লৌকিক বাংলা থেকে বহুপ্রস্থ দূরে বটে, তবে তা কবির মনোগত। যেন তা অযোধ্যার চেয়েও সত্য বটে। যেন কুড়িগ্রাম নয়, কুড়িগ্রাম থেকে চ্যুত এক অভিনব ভূমিখন্ড। যার অধিবাস ‘নদী’ আর ‘বৃষ্টি’র সুতায় বান্ধা কবির আপন কল্পলোকে।

ফলে মাসুদ খানের কবিতা পৃথিবীময়তাকে ছাড়াইয়া এক ঊর্ধ্বজাগতিক ভ্রমণে সদা উৎসুক। এইটা শুধু বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারই নয়, আমার ধারণা কবির যে মনোবৃত্তি তাতে দুনিয়াকে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে নয়, বরং ব্রহ্মাণ্ডের সাধারণ অংশ হিসাবে দেখার চিন্তারই প্রাধান্য। এ কারণেই বোধ’য় তার কবিতায় ঊধঃ ও অধঃজগৎ একাকার হতে বাধেনি। কাল অতিক্রমের ব্যাপারও তার কবিতার সাধারণ একটা দিক।

মাসুদ খান প্রায়শই মৌলিক সত্যকে আবিষ্কার করতে চান। সেসব ক্ষেত্রে ন্যারেটরের চেয়ে তাকে অনেক বেশি দার্শনিক মনে হয়। জীবনের ছোট ছোট ঘটনার ভিতর দিয়ে সাধারণ সত্যকে ধরা অথবা কবির দরদী মন দিয়া জগৎ ও জীবনের বিচিত্র বিষয়কে আত্মরসে জারিত করে উপস্থাপন করার কৌশলে পাঠক স্তম্ভিত না হয়ে পারে না।

“মায়েরা মৃত্যুর পর দেহ ছেড়ে চলে যান দূরের বিদেহপুরে।
তারপর প্রতিদিন ওই ব্যস্ত বিদেহনগর থেকে এসে
ঘুরে ঘুরে দেখে যান যার-যার ছেড়ে-যাওয়া সোনার সংসার।
অন্তত প্রথম ত্রিশ দিন।
কী করছে আহা সোনামণিরা তাদের,
কেমনই-বা কাটছে তাদের দিন, মাতৃহীন”

(উচ্চতর বাস্তবতা)

 

কিংবা, ‘প্রত্যাখ্যান’ কবিতার মায়ের স্তন থেকে উৎখাত হওয়া শিশুর “পিপাসার ধ্বনি” “মহিমমণ্ডলের এখানে ওখানে” যেভাবে কানে এসে লাগে; অথবা, ‘মা’ কবিতার “দূরবা আর ডেটলের মিশ্র ঢেউয়ে ঘ্রাণে রচিত সে-শয্যা”, যেখানে ধূলি-ওড়া অপরাহ্ণে খোলা আকাশের নিচে একা শয্যা পেতে মা শুয়ে থাকেন—মাতা ও সন্তান সম্বন্ধীয় এমন কবিতা ভাষা ও বিষয়ে, আবেগ ও অনুভবে অনন্য হয়ে উঠেছে।

এইভাবে বিভিন্ন কৌণিক এলাকা থেকে মাসুদ খানকে পাঠ করা যায়। দেখার লেন্সটাকে আগ-পাছ করে, কমায়ে-বাড়ায়েও খানকে পর-কালের কবি হিসাবে বিবেচনা করতে বহু সাক্ষিসাবুদ-ই যোগাড় করতে পারা যায়। তিন বা চারদশক পর আমি যেমন তার সৃজন দুগ্ধের ছানা বার করতে পারলাম, সামনের দিনেও নিশ্চয়-ই তার ব্যত্যয় ঘটবে না। কবির নিজের কনফিডেন্সও অনেকটা তেমন। কবি ঘোষণা দেন:

লণ্ঠনটা তুলে ধরো হে চারনপুত্র, দ্যাখো
আজ ভাষা ভেসে যায় সন্ধ্যা-, অপর কালের।

(চেরাগজন্ম)

 

কবির সাথে একাত্ম হয়ে তার অনিন্দ্য কবিতাসমূহ পাঠ করতে করতে বয়ে যাক শ্রবণ বধির করা মহাবৃত্তের হাওয়া। সেই হাওয়া সূচনা করুক পরাক্রম বৃষ্টি’র, যা মাসুদ খানের সৃজনকলার সবচেয়ে সফল ও সুরেলা বিষয় হিসাবে বাংলা কবিতার পাঠকের অতৃপ্ত আত্মাকে-শুষ্ক জবানকে বহুকাল ভিজায়ে যেতে থাকবে। আহা!

“ কী যে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে যায়
আর
পরধর্মে সাধ জাগে ধীরে ধীরে এমনই সন্ধ্যায়।
দূরে রূপশাসিত নদীর কিনারায়
বিদেশ অপূর্ব বৃষ্টিময়
মুহুর্মুহু বিজলি প্রতিভায়।
আর
পররূপে কাতরতা জাগে মৃদু-মৃদু
এমনই সন্ধ্যায়।”

(বৃষ্টি-১)

 



মোস্তফা হামেদী

জন্ম : ২৭ আগস্ট, ১৯৮৫ খ্রি.
ফরিদগঞ্জ, চাঁদপুর
পড়াশোনা :
স্নাতক ও স্নাতকোত্তর, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পেশা:
প্রভাষক
বাংলা বিভাগ, সরকারি মুজিব কলেজ , নোয়াখালী

প্রকাশিত বই:

১। মেঘ ও ভবঘুরে খরগোশ [কবিতা, কা বুকস, ঢাকা, ২০১৫]
২। তামার তোরঙ্গ [কবিতা, জেব্রাক্রসিং প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮]
৩। জড়োয়া [কবিতা, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ভারত, ২০১৯]
৪। শেমিজের ফুলগুলি [কবিতা, প্রিন্ট পোয়েট্রি, ঢাকা, ২০২০]
৫। ঋতুরহস্যের ধারে [কবিতা,ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০২১]

পুরস্কার:

হিমেল বরকত কবিতা পুরস্কার ২০২০ [ শেমিজের ফুলগুলি কাব্যের জন্য]

শেয়ার