১। যেভাবে প্রথম পরিচয়
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের এক হিম হিম বিকেলে শাহীন আখতারের লেখাপত্রের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। যদিও শীতকাল এবং হিমের দাপট, তবুও, শাহবাগ কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর চত্বর সেদিন আলোকিত হয়ে ছিল শেষবিকেলের মিঠে রৌদ্দুরে। দেশের বৃহৎ দুটি প্রকাশনা সংস্থার নিজস্ব উদ্যোগে লাইব্রেরী চত্বরে আয়োজিত হচ্ছিল ক’দিন ব্যাপী এক বইমেলা যেন। হাকিমের ঝাঁঝালো হালিম আর টিএসসির সড়কদ্বীপের ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে, চারুকলার জয়নুল গ্যালারীতে কোন এক ডিপার্টমেন্টের যেন বাৎসরিক এক্সিবিশন ঘুরে দেখে অনেকটা আচমকা গিয়ে হাজির হয়েছিলাম ঐ বইমেলায়। সঙ্গে ছিল তৎকালীন প্রেমিকা। চত্বরের আগামাথা একবার চক্কর দিয়েই মনে হলো, বাংলা বইয়ের বদলে কিছু বদলেয়র, নেরুদা, বা নিদেনপক্ষে রবার্ট ফ্রস্টের ইংরেজি কবিতার কেতাব থাকলে স্ট্র্যাটেজিক্যালি খানিক সুবিধা হতো। মূল ফরাসি বা স্প্যানিশ ভাষার পাশের পৃষ্ঠায় উপস্থিত ইংরেজি অনুবাদে তাদের কবিতার বই হাতে তুলে নিতাম। পূর্বপঠিত দু’ চারটে কবিতার চেনা দু’ চার পঙক্তি প্রথমে ভুলভাল ফরাসি বা স্প্যানিশে, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় গোপীবাগ থাকাকালে যত্ন করে রপ্ত করা গোপীবাগি এক্সেন্টের ইংরেজিতে আউড়ে নিজেকে অস্তিত্বের প্রেষণে, বা গভীর দার্শনিক ভাবনায় হাবুডুবু খেতে থাকা এক মানুষ হিসেবে প্রেমিকার সামনে নিজেকে উপস্থাপন করতে পারতাম। তৎকালীন সময়ে ফেসবুক বায়োতে ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’ সেঁটে রাখা মাছেদের ছিপে গেঁথে তোলার জন্য এ ছিল এক মোক্ষম দাওয়াই (এখন যেমন গত কয়েক বছরে তাদের ঝোঁক বদলে গেছে গালিব, মীর ত্বকী মীর, বা মির্জা মাজহার জানে জানার উর্দু শায়েরির প্রতি)। কিন্তু নিজেকে ‘স্যাপিওসেক্সুয়াল’ হিসেবে উপস্থাপন করবার জন্য দরকারি কোন ইংরেজি বই তাদের স্টলে ছিল না।
আমরা জানি তিনি মূলত একটি গল্প বলতে চান, এবং তার গল্পকার সত্ত্বার ওপর ঈমান এনেই আমরা এগিয়ে চলি উপন্যাসের এক পাতা থেকে পরবর্তী পাতায় এবং ভাষার নির্মোহতার মাঝেও খুঁজে পাই কথকের অত্যন্ত মানবিক হৃদয়ের উপস্থিতি। ভাষা তার লেখায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কখনো তার গুরুত্ব গল্পকে ছাপিয়ে যায় না।
এদিকে কিছুদিন আগে মাত্র ভারতীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের ওপর পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ (পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী যাকে পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্সে জ্ঞান দাদু বলে শ্রদ্ধাভরে কানে হাত ঠ্যাকান) -এর লেখা তেহজিবে মৌসিকি মাত্র পড়ে শেষ করেছি। একই বিষয়ে বাসায় থাকা কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কুদরত রঙ্গিবিরঙ্গী নামক আরেক গ্রন্থের বয়ন ও বয়ানভঙ্গীর সঙ্গে খুব একটা খাপ খাইয়ে উঠতে পারছি না। ফলে হঠাৎ করেই শঙ্করলাল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ওস্তাদ ভিলায়েৎ খাঁ সা’ব আর পণ্ডিত রবিশংকর জী’র আত্মজৈবনিকঃ ‘রবিশঙ্কর – বিলায়েতঃ এক অশ্রুত যুগলবন্দী’ -র ওপর চোখ পড়ে, এবং সেটা কিনে নেই। এরপর ঘুরতে থাকি উভয় প্রকাশনা সংস্থার কথাসাহিত্যের অংশে। আর ঠিক তখনি, নক্ষত্রের যোগে আমার চোখ আটকে যায় শাহীন আখতারের ময়ূর সিংহাসন উপন্যাসটিতে। মুঘল মিনিয়েচার আর্টফর্মে অঙ্কিত প্রচ্ছদ, এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের বহিঃশত্রু হিসেবে চিহ্নিত মোঘলদের ইতিহাস বইটার উপজীব্য বিষয় দেখে সেটা কিনে নিই। মনের গহীনে টিমটিম করে এ তথ্যটুকুও আলো দিচ্ছিল যে, ২০১৫ বা ‘১৬ সালে, সম্ভবত এই উপন্যাসটির জন্যই শাহীন আখতার আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কথাসাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছিলেন।
তারপর, ‘নস্টালজিয়ার দ্বারে টোকা দেয়’ এমন এক প্রচ্ছদের প্রতি আকর্ষিত হয়ে হাতে তুলে নিই একই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত তার আর একটি উপন্যাসঃ অসুখী দিন। কাগজের মূল্য বৃদ্ধি, আর সে সূত্রে বইয়ের দাম বৃদ্ধি ব্যাপারটা তখনো অতোটা মারমার কাটকাট হয়ে ওঠেনি। দাম ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকায় অসুখী দিনও আমার বগলের নীচে স্থান পেলো। টাকা পরিশোধ করবার পর মনে পড়লো, পাশের প্রকাশনা সংস্থাটিতেও সম্ভবত শাহীন আখতারের আর একটি উপন্যাস দেখেছি। দুটো উপন্যাস কেনা হলো, ওটা আর বাদ রাখা কেন – বিবেচনায় তার সখী রঙ্গমালা উপন্যাসটিও কিনে নেয়া।
তখন না জানলেও এখন জানি, ওগুলো ছিল শাহীন আখতারের সাম্প্রতিকতম কাজ। শুরুর শাহীন আখতারের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে তারও বছরখানেক পর। করোনা লকডাউনের সময় বাসায় বসে অনলাইনে সংগ্রহ করি তার সবচেয়ে আলোচিত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমাদৃত উপন্যাস তালাশ, এবং তার প্রথম উপন্যাস – পালাবার পথ নেই। এবং তার গল্পসংগ্রহ ১।
যা হোক, এতোগুলো বইয়ের মধ্যে সবার আগে আমি পড়া শুরু করি ময়ূর সিংহাসন-ই। আমার প্রেমিকার সঙ্গে বিবিধ রেস্টুরেন্ট বা কফিশপে তোলা সে সময়ের ছবিগুলিতে, টেবিলে, কফির মগের পাশে শোভা পেতে দেখা যায় ময়ূর সিংহাসনকে। আপন ভাইয়ের সঙ্গে মুঘল সালতানাতের তখতের দখল নিয়ে শাহজাদা শাহ সুজার লড়াইকে উৎযাপন করতে আমরা টেবিলের ওপরেই লিপ্ত হচ্ছি থাম্ব ফাইটে – এমন ভিডিও এখনও আমাদের সংগ্রহে আছে। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবার আগে, ঐ ছবি অথবা ভিডিওগুলো এখনও আমাদের কাছে নারীপুরুষের সম্পর্কের জটিল বুনন সম্পর্কে অনবহিত অপেক্ষাকৃত অবোধ দুই তরুণ – তরুণীর বিবাহপূর্বক জীবনের সরল, প্রাণবন্ত, ও প্রেমময় ডকুমেন্টেশন।
ময়ূর সিংহাসনের পর একটা বিরতি দিয়ে তালাশ উপন্যাসটা পড়ি করোনা লকডাউনের সময়। বৈশ্বিক একটা বিপর্যয়ের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও এক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তখন। এক কাপড়ে বাড়ির বাইরে সাত দিন। শুধু সঙ্গে একটা বই না থাকলে নিজেকে ন্যাংটো ন্যাংটো লাগে বলে হাতে করে তালাশ নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলাম বাড়ি থেকে। অন্য একজনের বাড়িতে আশ্রিত অবস্থায় তালাশ পড়ে শেষ করি। পঠনের সময় আমার ভাঙ্গা মন, এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের আখ্যানকে কেন্দ্র করে রচিত এ উপন্যাস একে অপরের সঙ্গে এতো দারুণভাবে সিঙ্ক করে যে আমি থম মেরে বসেছিলাম একটা লম্বা সময়। এরপর শাহীন আখতারের ‘লেখক অরা’ র ওপর আমার ঈমান চলে এসেছিল। কাজেই টানের ওপর পড়লাম ওনার অসুখী দিন, পালাবার পথ নেই (বাংলাদেশে নারীজীবনের ওপর এতোটা শৈল্পিক, এতোটা ক্ষুরধার, বেপরোয়া লেখা আমি তো আগে পড়িনি কখনো। এবং, এটাই নাকি তার প্রথম উপন্যাস! কি আশ্চর্য ব্যাপার!), এবং অনেকটা কষ্ট করে – সখী রঙ্গমালা (কেননা এর বিষয় এবং ভাষা আমাকে টানছিল না, কিন্তু যেহেতু ঔপন্যাসিক শাহীন আখতারের লেখনীর কুশলতার ওপর ঈমান ততদিনে এনে ফেলেছি, ফলে ওটাকে নিজের অযোগ্যতা বিবেচনাতেই জোর করে পড়ে শেষ করি।)। তার সর্বশেষ উপন্যাস এক শ এক রাতের গল্প যতদিনে বাজারে বেরিয়েছে, ততদিনে আমার তার অন্তত তিনটে উপন্যাসের ওপর সব মিলিয়ে প্রায় ৬ – ৭ হাজার শব্দের রিভিউ লেখা শেষ।
একটি বই, অথবা নির্দিষ্ট একজন লেখকের লেখাপত্র কীভাবে পাঠকের নিজের হয়ে ওঠে, সে গল্পটি গুরুত্বপূর্ণ। কিছু বই আমাদের শৈশবের বাতাবীনেবু ঘ্রাণবাহী, কিছু বই আমাদের যৌবনের উন্মেষকালের স্মৃতিবাহী, কিছু বই আমাদের ভেতরের আরেকটা আমিকে আবিষ্কার করতে সহায়তা করে, কিছু বই আমাদের চিন্তাচেতনার পরিপক্কতার স্মারক। শাহীন আখতার আমি যখন পড়েছি, ততদিনে আমার ঢাবির ইংরেজি বিভাগে অনার্স মাস্টার্স শেষ, এবং সে সূত্রে মূল ইংরেজি ভাষায় কিংবা ইংরেজি অনুবাদে সারা বিশ্বের ক্লাসিক সব সাহিত্য পড়া সমাপ্ত। হুমায়ূন আহমেদ, কিংবা পশ্চিমবঙ্গের স্বাদু গদ্যের জগত থেকে উৎরে এসে ঘোরাঘুরি করছি নওরোজ কিতাবিস্তান, মাওলা ব্রাদার্স, কিংবা পাঠক সমাবেশের এদিক-সেদিক। সমগ্র ধরে ধরে শেষ করেছি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ ছফা, ও শহীদুল জহিরের সমস্ত কথাসাহিত্য। পড়েছি হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি ও শ্রেষ্ঠ গল্প। শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল, একজন কমলালেবু, আধো ঘুমে কাস্ত্রোর সঙ্গেসহ গল্প সংগ্রহ পড়েছি। জনপ্রিয় ধারার লেখা আমায় টানে না। ভাবের জগতে ঘাই মারে, এমন সিরিয়াস সব লেখাপত্রের সঙ্গে যুঝবার জেহাদি জোশ মনে মনে। এরপর কি? এমনটা ভাবতে ভাবতেই পড়ার টেবিলে, বা ঢাকার রাস্তায় জ্যামের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করি শাহীন আখতারের বই হাতে বসা অবস্থায়।
২। প্রথম প্রেম
শাহীন আখতারের লেখা ভালো লাগার প্রথম কারণ হচ্ছে, নারী অভিজ্ঞতা বিষয়ে তার রাখঢাকহীন বয়ান। আমাদের পুরুষশাসিত ‘কলা’ জগতে যে যা আদতে না, তাকে নিজেকে সেভাবেই উপস্থাপনের প্রবণতা দেখা যায় বেশী। সেকুলার, মার্ক্সবাদী, নারীবাদী, জাতিবাদি, ধর্মবাদী – ইত্যাদি বিবিধ ‘বাদী’ টেক্সট তৈরির কসরতে গল্প বলার ফুসরত মেলে না কারো। কিন্তু শাহীন আখতারকে তার লেখনীতে বিশেষ কিছু হয়ে ওঠার, বা নিজেকে বিশেষ কিছু হিসেবে উপস্থাপনের কসরতরত অবস্থায় আমি আবিষ্কার করিনি কোনদিন। বরং দেখেছি যে তিনি নিজে যেমন, তার আশেপাশের পৃথিবী যেমন, ঠিক সেভাবেই তিনি বিষয়গুলিকে তার উপন্যাসের দুনিয়ায় উপস্থাপন করেন। তার সৃষ্ট কথাসাহিত্য নারীচরিত্র প্রধান। তবে তার সেসমস্ত ‘সখী’গন শিক্ষা – পেশাগত জীবন – পারিবারিক কিংবা দাম্পত্য জীবনে সমঅধিকার নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করে না। (দু’ একটা ব্যতিক্রমবাদে, আর সে ব্যতিক্রমেরা তার উপন্যাসের মুখ্য চরিত্রও নয়) তারা ঠিক সেভাবে ডাকাবুকোও নয়, বরং অনেকাংশেই জীবনের কাছে মার খাওয়া প্রান্তিক মানুষ। তবে তাদের শক্তির জায়গা হচ্ছে তাদের ত্যাড়ামো, ঠোঁটের কোনে এক অবজ্ঞাসুলভ বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে জীবনকে দেখার ব্যাপারটা। এবং ক্ষেপে গেলে তারা ‘ব্যাটাদের’ মতই ভায়োলেন্ট।
উদাহরণ হিসেবে এ মুহূর্তে মনে পড়ছে তালাশ উপন্যাসে (কেতাবি ভাষায়) বীরাঙ্গনা, বা (সাধারণ্যের ভাষায়) আর্মির ভুসিমাল মরিয়মের কথা।
মুক্তিযুদ্ধের আগে আগে তাকে সন্তানসম্ভবা করে জীবন থেকে ছিটকে যাওয়া প্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাক আর্মিদের দ্বারা, এবং মুক্তিযুদ্ধের পর নিজের পরিবার, নিজের দেশের মানুষদের দ্বারা উপর্যুপরি নির্যাতিত হতে থাকা এ নারী চেষ্টা করছে জীবনে কোন একভাবে থিতু হবার। এমতাবস্থায় জীবন তার সঙ্গে এমন এক নির্মম বিদ্রুপ করে, যে পাঠক হিসেবে আমরা হাসব না মরিয়মের দুঃখে মুখ জোর করে বেজার করে রাখবো – সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধায় ভুগি। ততদিনে মুক্তিযুদ্ধ অনেক পেছনের ইতিহাস, বুড়িগঙ্গা দিয়ে শ্যাওলা জমা অনেক পানি প্রবাহিত হয়ে গেছে, যেদিকে তার প্রবাহিত হবার কথা। এমতাবস্থায় বিয়েশাদি করে থিতু হবার আকাঙ্ক্ষায় থাকা মেরির অজান্তেই ওর জীবনে এসে হাজির হয় এক হিন্দু সমকামী পুরুষ। ঘটনার পাকেচক্রে এ দু’জনকে মহল্লার সবাই সাতসকালে আবিষ্কার করে একই ছাদের নীচে। তারপর তাদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়। এতে করে অবশ্যই সমস্যার সমাধান হয় না, বরং সমস্যা আরও প্রকট হয়। সমকামী সে পুরুষের মরিয়মের শরীরে কোন আগ্রহ থাকে না। সে তরুণ ছেলেদের ধরে নিয়ে আসে মেরির ডেরায়। গেট আটকে বসে থাকে দিন রাত। শারীরিকভাবে দীর্ঘদিনের অভুক্ত মরিয়ম তখন জান্তব যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। তার সামনে জলজ্যান্ত এক পুরুষ শরীর, নিজ শরীরে ভরপুর যৌবন নিয়েও সে তাকে তাঁতিয়ে তুলতে পারছে না। আমার স্বল্প পঠনে, বাংলা সাহিত্যে প্রদর্শিত নারীজীবনের এহেন ক্রাইসিস আগে কখনোই ধরা পড়েনি। কি নিপুণ ভাষায় ও দারুণ সততার সাথে শাহীন আখতার বর্ণনা করেন সে দৃশ্য –
“সারা রাত কামার্ত বাঘিনীর মতো বারান্দায় এমাথা – ওমাথা পায়চারি করেছে মরিয়ম … এভাবে বঞ্চিত হওয়া কি ধর্ষণের চেয়ে খারাপ? মরিয়ম অতীতের ধর্ষকদের একে একে স্মরণ করে। বাড়ির উঠোন থেকে গলির শেষ মাথা পর্যন্ত তাদের লম্বা লাইন … আবেদ জাহাঙ্গীর, মেজর ইশতিয়াককেও তার আর মনে ধরে না। এ রাতে দেবাশিসকেই তার চাই – যে তার শরীর চায় না।
…
তুমি অসুস্থ অসুস্থ, আমি বলছি, মেরি,’ দেবাশিস দিনের বেলা চ্যাঁচ্যায়, ‘তুমি ডাক্তার দেখাও।’ মরিয়ম অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ‘দূর হ হারামজাদা,’ বলে দেবাশিসের গায়ে পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে মারে সে।”
দ্বিতীয় একটি উদাহরণে আসি। উপন্যাস অসুখী দিনে মুখ্য এক চরিত্র, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের বামপন্থী নারী অ্যাক্টিভিস্ট, কমরেড অনিতা সেন জীবনে নানা ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় পার করে তার দীর্ঘদিনের এক কমরেডকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে মেঘালয়ে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তখন মেঘালয়ে শুরু হয় প্রাদেশিক স্বাধীনতার সংগ্রাম। মেঘালয়ের ভূমিপুত্ররা বহিরাগতদের ‘উডখার’ তকমা দিয়ে তাদের মেঘালয় ছেড়ে যেতে বলে। একপর্যায়ে, সে ধর্ষিত হয় মেঘালয়ের আদিবাসিদের দ্বারা। গর্ভসঞ্চার হলে তার স্বামী তাকে গর্ভপাতের পরামর্শ দেয়। কমরেড অনিতার ঝলসে ওঠা প্রত্যুত্তর, বইয়ের পাতা থেকে যদি উদ্ধৃত করি –
“… অরুণের বোধগম্য হচ্ছে না, গুণ্ডা – বদমাইশের বাচ্চা, যা আবার ধর্ষণজাত, আমি কেন ভূমিষ্ঠ হতে দিচ্ছি। পেটেই বা ধরে রেখেছি কীভাবে – ঘেন্না হয় না? ‘না, হয় না।’ আমি কাওয়ালদের মতো মাথা ঝাঁকি দিয়ে চুল সব সামনে নিয়ে আসি। ‘এ শুধু গুণ্ডা – বদমাইশের, আমার নয়? আমি কি কখনো বলেছি, বাচ্চা চাই না!’
কমরেড অরুণের মুখ চুন হয়ে গেলো। ভাবছে হয়তো বাচ্চা দিতে না পারার জন্য আমি ওকে আঘাত করেছি। তা কিন্তু নয়। আর তাই যদি হবে, আমি কুড়িটা বছর চুপ করে ছিলাম কেন।”
পুরুষ পাঠক হিসেবে আমাদের বোবা হয়ে যাওয়া লাগে। আমরা টের পাই, ধর্ষণজাত সন্তানকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে এক নারীর মুখ থেকে এহেন অবস্থান, এহেন বক্তব্য – আমরা আগে কখনো শুনিনি, যেমন শুনিনি তালাশে কামার্ত এক নারীর সমকামী পুরুষের দরোজায় দাঁড়িয়ে এ চিন্তায় মত্ত হওয়া যে, এর চে’ ধর্ষিত হওয়া খারাপ ছিল কোন অর্থে? আদর্শবাদী অবস্থান থেকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে নারীকণ্ঠের এসমস্ত স্বর, এসমস্ত দাবী শাহীন আখতারকে সিরিয়াসলি নিতে বাধ্য করে আমায়। আমি টের পাই, এ আমার পূর্বের পঠন পাঠনের অভিজ্ঞতার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগত।
৩। ভাষিক কুশলতা
প্রতিটি উপন্যাস ভিন্ন ভিন্ন ভাষা নির্মাণের প্রস্তুতি তাকে তার সমসাময়িক অন্য সকল স্পন্টানিয়াস রাইটারদের থেকে আলাদা করে। নব্বইয়ের দশকের কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে যারা শেষমেশ টিকে গেছেন নিজ নিজ সাহিত্যগুণে, তার মধ্যে কথাসাহিত্যের ভাষিক জগত নির্মাণে শাহীন আখতারের মতো পরিশ্রমী লেখক সম্ভবত আর পাওয়া যায় না। প্রথম উপন্যাস পালাবার পথ নেই ফ্ল্যাশব্যাকের দারুণ টানাপোড়েনে পাঠকের ভালো পরীক্ষা নেয়। সেদিক থেকে তালাশ কিংবা সখী রঙ্গমালার বর্ণনা অপেক্ষাকৃত একরৈখিক। উপন্যাস অসুখী দিনের অর্ধেকটা বর্ণিত হয় ডায়রির আদলে, বাকি অর্ধেক থার্ড পারসনে। ময়ূর সিংহাসন, আর এক শ এক রাতের গল্পে বিবিধ চরিত্র হাল আমলের তুর্কি ঔপন্যাসিকদের মতো ফার্স্ট পারসনে কথা বলে।
গল্প বলার ভঙ্গীর এ বৈচিত্র্যের পাশাপাশি অতুলনীয় যত্নের সঙ্গে তিনি বুনে চলেন একটির পর একটি লাইন। লাইনের পর লাইন মিলিয়ে একটি প্যারাগ্রাফ। প্যারাগ্রাফের পর প্যারাগ্রাফ মিলিয়ে একটি চ্যাপ্টার। চ্যাপ্টারের পর চ্যাপ্টার মিলিয়ে গোটা একটি বই। পালাবার পথ নেই, তালাশ, অসুখী দিন অপেক্ষাকৃত সমসাময়িক বিষয়বস্তুর উপন্যাস হওয়ার কারণে তার ভাষিক কাঠামোও আমাদের সাধারণ কথ্যভাষার মতো। বিপরীতে সখী রঙ্গমালার কাহিনী দক্ষিণ সমতট / নোয়াখালী অঞ্চলে প্রায় দু’শ বছর আগে থেকে প্রচলিত পালাগান চৌধুরীর লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটে বলে, তার ভাষিক কাঠামোতে নোয়াখালীর ডায়ালেক্ট রাজত্ব করে, এবং আমাদের মতো যাদের নোয়াখালীর সমঝদারীর দৌড় – ‘ঔগগা চোবাড় মারি গালের ছাল ছোলাই আলাম’ পর্যন্ত, তাদের সে ভাষার সামনে পাঠক হিসেবে জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া তেমন কিছু করার থাকে না। তবুও আমরা এগিয়ে চলি তার বইয়ের পাতার বুক চিড়ে, শাহীন আখতার শুধু ভাষার দেয়াল তুলে দেওয়ার জন্য দেয়াল তোলেন না, নিজের বাহাদুরি বা কেরদানি দেখানোর জন্য ভাষা নিয়ে জিমনাস্টিক করেন না, তার ভাষায় শহর নগর বন্দর – ঠিক কি ডমিনেট করে এ নিয়ে তার আজান দেয়া লাগে না, কিন্তু আমরা জানি তিনি মূলত একটি গল্প বলতে চান, এবং তার গল্পকার সত্ত্বার ওপর ঈমান এনেই আমরা এগিয়ে চলি উপন্যাসের এক পাতা থেকে পরবর্তী পাতায় এবং ভাষার নির্মোহতার মাঝেও খুঁজে পাই কথকের অত্যন্ত মানবিক হৃদয়ের উপস্থিতি। ভাষা তার লেখায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কখনো তার গুরুত্ব গল্পকে ছাপিয়ে যায় না। সমসাময়িক, বা শাহীন আখতারের আগে বাংলাভাষার অনেক লেখকই ভিন্ন এক ভাষা ও রচনাশৈলী তৈরির নিয়তে দেদার কেরদানি দেখিয়েছেন, কিন্তু গল্প হৃদয়গ্রাহী না হওয়ার কারণে বই পড়ার নামে পাথর ভাঙ্গা শেষ করে শেষমেশ কি নিয়ে যে উঠলাম পড়ার টেবিল থেকে, তা আর টের পাওয়া যায় না। তারপর ময়ূর সিংহাসন কিংবা এক শ এক রাতের গল্পে সেকুলারজীবীদের মুখে ছাই দিয়ে, যে মায়া নিয়ে বাংলার পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক হিন্দি উর্দু আরবি ফারসি শব্দ ও শায়েরি ব্যবহার করেছেন, আমাদের মুগ্ধ না হয়ে উপায় থাকে না। তার ওপর ভাষার পরতে পরতে, ক্ষীরের মাঝে ছিটিয়ে দেওয়া কাজু পেশতা বাদাম ও কিসমিসের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে কাব্যিকতা, কৌতুকময়তা, ইঙ্গিতময়তা। এসব কিছু মিলিয়েই তার সমসাময়িক ঔপন্যাসিকদের মধ্যে শাহীন আখতারের কথাসাহিত্যের ভাষা অনন্য।
বাস্তব অবাস্তবের বিলীয়মান মধ্যরেখায় দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে দারুণ এক অ্যাকশন প্যাকড দৃশ্যের নির্মাণে শাহীন আখতারের কুশলতা বিশ্বমানের। তার ছ’টি উপন্যাসের অন্তত তিনটে দৃশ্য আমার মনে দাগ কেটেছে (সম্ভবত) চিরদিনের জন্য।
একদম উদাহরণ না দিয়ে শেষ করলে খারাপ দেখাবে। ধরা যাক পালাবার পথ নেই, তার উপন্যাস তালাশ-এ একটা দৃশ্যে সরকারি বীরাঙ্গনা অফিসে এক ফটোগ্রাফার এসেছে বীরাঙ্গনাদের ছবি তুলবে বলে। এখানে শাহীন আখতার এভাবে লেখেন যে –
“ঘোমটার আড়ালে মুখ লুকনো সম্ভব হলেও, পেটে তখন টাইমবোমা, বাচ্চারা টিকটিক করে বাড়ছে। যে কোন সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নতুন দেশের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিতে পারে।”
একদিকে শত্রুসেনার ভ্রূণকে ‘টাইমবোমা’র মেটাফোরে উপস্থাপন, ঠিক সে লাইনেই স্রেফ শত্রুসন্তান ভূমিষ্ঠকরণের মাধ্যমে নতুন দেশের পুরো ভবিষ্যৎ ছারখার করে দেওয়ার সম্ভাব্যতা উল্লেখ করে অর্জিত স্বাধীনতা যে আদতে ব্যক্তিমানুষের জন্য কতটা ঠুনকো, তা উপস্থাপন করা হয় কুশলতার সঙ্গে।
ইঙ্গিতময়তার জন্য পালাবার পথ নেই উপন্যাসে বারবার লেমিং বার্ডের প্রতীকের ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। দেশ থেকে পালিয়ে সুইডেনে সংসার পেতে বসা বুলবুলি নামের চরিত্রটি শেষমেশ সুইসাইড করে, যে সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি লেমিং পাখির মাঝেও দেখা যায় বলে মিথ প্রচলিত আছে। আবার তালাশ-এ যীশু মাতা মেরীর আদলে ‘৭১-এর সর্বংসহা মুখ্য নারী চরিত্র মরিয়ম বা মেরির নামকরণও অনেকটা প্রতীকী। এছাড়াও তার প্রায় সকল উপন্যাসে নারী পুরুষের সম্পর্কের আদল বোঝাতে প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় সাপ – লুডু খেলা।
৪। ঘোরের দৃশ্যনির্মাণে কুশলতা
বাস্তব অবাস্তবের বিলীয়মান মধ্যরেখায় দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে দারুণ এক অ্যাকশন প্যাকড দৃশ্যের নির্মাণে শাহীন আখতারের কুশলতা বিশ্বমানের। তার ছ’টি উপন্যাসের অন্তত তিনটে দৃশ্য আমার মনে দাগ কেটেছে (সম্ভবত) চিরদিনের জন্য। দৃশ্যত্রয়ীর প্রথমটি তার প্রথম উপন্যাস, পালাবার পথ নেই – এর। শুরুটা এমন –
” ‘রানি, সিদ্ধার্থ তোমাকে নিতে আসছে। ঐ দেখো, ড্রয়িং রুমের কোনার চেয়ারটিতে বসে আছে,’ অ্যাকুরিয়ামের সন্তরণশীল মাছেদের মাঝ থেকে ঠোঁট ফাঁক করে ভুরভুরিয়ে বলে দীপা।
ও কি মাছ, না মানুষ?
আমি চমকে উঠি। দীপার ছেলে পাপ্পার অ্যাকুরিয়ামের আলোটা চোখ খোলা মাত্র মশারি গলে আমার নাকে – মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীপা কোথায়? বাড়ির সবাই তো ঘুমাচ্ছে। এমনকি মাছগুলিও। দীপা শুতে যাবার আগে আমার গায়ের লেপের ওপর আরও একটা ভারী কম্বল চাপিয়ে দিয়ে যায়। তারপর ওর স্বামী শাহাবুদ্দিন থার্মোমিটার আলোতে ধরে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘১০৪!’ ঘুমিয়ে পড়ার আগে এটুকুই শুনেছিলাম।”
বোঝা যায়, উপন্যাসের কথক রানি জ্বরে আক্রান্ত। তাকে সিদ্ধার্থ, তার ছেড়ে আসা স্বামী নিতে এসেছে, বা আদৌ এসেছে কিনা আমরা বুঝতে পারি না, কারণ রানি শরীরে ১০৪ জ্বর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল, এবং ঘুম থেকে উঠে সে তার আশ্রয়দাতা বান্ধবী দীপাকে মাছের মতো অ্যাকুরিয়ামে সন্তরণশীল অবস্থায় দেখতে পায়।
এরপর এ অধ্যায় যত আগায়, জ্বরের ঘোরে কাৎরাতে থাকা এক নারীর বাস্তব অবাস্তব গুলিয়ে যাওয়া আখ্যানের মাধ্যমে আমরা উপন্যাসের পূর্বাপর আরও অনেক তথ্য পেতে থাকি। আমরা জানতে পারি, রানির বুলা ফুফু নামে এক মৃত আত্মীয়া ছিল, যে পালিয়ে এসেছিল তার শ্বশুরবাড়ি থেকে কোন এক কারণে। তার স্বামী প্রায়ই এসে রানিদের বাড়িতে বসে থাকতো তার শাদী করা বৌকে জবরদস্তী বাড়িতে নিয়ে যেতে, কিন্তু রানির মা, অর্থাৎ বুলা ফুফুর ভাবী তাকে জামাই এলেই সাহায্য করতে বাড়ি থেকে পালিয়ে অন্য কোথাও লুকিয়ে পড়তে। এই ব্যাপারটাই জ্বরের ঘোরে কাতর রানী স্বপ্নে দেখে। স্বপ্নে দেখে, তার বুলা ফুফুর জামাইয়ের মতো তার ছেড়ে আসা কলকাতাই স্বামী সিদ্ধার্থ এসে হাজির হয়েছে ঢাকায় রানীকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে।
“সিদ্ধার্থ ড্রয়িংরুম থেকে বেরিয়ে আসে, হাতে ওর মেশিনগান। আমি ভয়ে দু’হাত মাথার ওপরে তুলতেও ভুলে গেছি। সিদ্ধার্থ সাপের মতো শরীর দুলিয়ে ঠ্যা ঠ্যা গুলি ছোড়ে। আমি মাটিতে পড়ে যেতে যেতে একটা ধবধবে সাদা বালিশের ওপর পড়ি। বালিশ – বিছানার চাদর থেকে গরম ভাপ উঠছে। এখন ঘরময় দু’ পাক ঘুরলে, বুলা ফুফু, সিদ্ধার্থ, দীপা অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে।
মাথাটা ভীষণ ভারী। ভেতরে যেন ঘুণপোকা কুড়কুড়িয়ে কামড়াচ্ছে। অথচ লেগেছে তো গুলি। আমি সিদ্ধার্থকে বলি, ‘তুমি আমাকে মেরে ফেললে?’ “
জ্বরগ্রস্থ নারীর ঘোরগ্রস্থ বয়ানে উপন্যাসের পূর্বাপর জুড়বার এমন নিপুণ কৌশল আমার স্বল্পপঠনে আগে ধরা পড়েনি বাংলা উপন্যাসে।
তার দ্বিতীয় উপন্যাস তালাশ-এ আমার প্রিয় দুটি দৃশ্য আছে। বীরাঙ্গনা মরিয়মের ভাই, কিশোর মন্টু পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয় এবং এক অভিযানে গ্রেনেড নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক হানাদারদের জিপের ওপর। দৃশ্যটা দারুণ কাব্যিক, বীররসে জারিত, এবং ঘোরগ্রস্থ। বইয়ের পাতা থেকে উদ্ধৃত করলে –
“সহযোদ্ধারা পালালেও মন্টু নড়ে না। চোখের ভুল বুঝতে পেরে মিলন আগের জায়গায় ফিরে আসে। পজিশন নিয়ে বলে, ‘আমি ভয় পাইছিলাম মন্টু, তুমি ভয় পাও নাই?’ মন্টু তার কথার জবাব দেয় না। সে তখনো চোর বরাবর স্টেনগানের নিশানা করে শার্দূলের মতো মাটি আঁকড়ে পড়ে রয়েছে …
সবাই দৌড়াচ্ছে, পালাচ্ছে। মন্টু কোথায়? বিস্ফোরণের আর সামান্য বাকি। আর গাড়িটাও দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমিনুল ঘাড় ফিরিয়ে সেদিন যা দেখেছিল, তা আজও তার অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে ঘটনাস্থলের তখন এতোটা কাছাকাছি, তীব্র আলোর ঝলকানি আর বিকট শব্দে ব্রিজটা যখন ভেঙ্গে পড়ে তখন উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। আর অনুভব করে, বুকের নীচের মাটি ধাক্কা দিয়ে তাকে আসমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অবশ্য বিস্ফোরণের আগে ঘাড় ফিরিয়ে আমিনুল যা দেখেছিল, সেই দৃশ্যটার তুলনায় এ কিছুই নয়। তখন মন্টুর গায়ে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি, কাঁধে স্টেনগান। সেফটি ফিউজের ম্লান আলোয় তার ভুতুড়ে ছায়াটা প্রথম ব্রিজের কিনারায় উদয় হয়। তারপর সে জ্বলন্ত ব্রিজ ডিঙ্গিয়ে নদীর ওপারের ঝোপঝাড় পার হয়ে আর্মির জিপের হেডলাইটের ওপর পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।
তখন মন্টুর স্টেনগানের নিশানা ছিল না।”
এই যে আগুনের ওপর শামা পোকার ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেওয়া, এবং আত্মাহুতি দেয়ার মাধ্যমেই জীবনের উদ্দেশ্য হাসিল – ঠিক একই পরিণতি আমরা দেখি পতঙ্গের মতো আর্মি জিপের ওপর স্টেনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া কিশোর মন্টুর।
একই রকম পরাবাস্তব সৌন্দর্য দেখি উপন্যাসটির শেষ দৃশ্যে, বীরাঙ্গনা মরিয়ম যখন গৃহপরিচারিকা টুকিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে জাজমেন্টাল জনতার চোখ থেকে চিরতরে দূরে কোথাও হারিয়ে যেতে, নদীপথে, এক নৌকায় চড়ে। তার নৌকায় একে একে চড়ে বসে উপন্যাসের সকল হতভাগ্য যারা ১৯৭১ সালে বিভিন্ন ঘটনার পাকেচক্রে ধর্ষিত, নির্যাতিত ও নিহত হয়েছিল; তারপর হারিয়ে গিয়েছিল যে যার মতো। বইয়ের ভাষায় –
“সপ্তম দিনে টুকি ও মরিয়ম মানুষের ভবিষ্যৎ বাণীর সংকীর্ণ সীমানা অতিক্রম করে যায়। আর তখনই দেখে, অনুরাধা দূরের এক বেলাভুমি থেকে সাদা রুমাল নেড়ে তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মুর্দার গাম্ভীর্য ঝেড়ে ফেলে মরিয়ম এখন বেশ উতফুল্ল। আরেকটু এগোলে হয়তো রমিজ শেখ ও মন্টুর দেখা পাওয়া যাবে। এদিকে তরতর করে চালকহীন নৌকাটা পৌঁছে গেছে অনুরাধার নিকটে। শূন্যে ঝুলে থাকা একটা বরফ শীতল হাত মরিয়ম ধরতেই গলুই বেয়ে অনুরাধা পাটাতনে উঠে আসে। তারপরও একজন আরেকজনের হাত ছাড়ে না। ইশ, কতো দিন পর দেখা! পানিতে ভাসতে ভাসতে অনুরাধার সারা গায় শ্যাওলা পড়ে গেছে। তবে তাদের দুটি হাতই এখন বেশ উষ্ণ। অনুরাধাও প্রাণবন্ত সেই কিশোরী। মরিয়ম নিজেকে নিজে দেখতে পাচ্ছে না। তার সামনে পেটিকোট – ব্লাউজবিহীন শাড়ি পরে টুকি বেগম, চৌধুরীবাড়ির কাজের মেয়ে, বন্দি হওয়ার বয়সে ফিরে গেছে। শাড়ির আঁচলটা মুঠো করে ধরা তার মুখের ওপর। পৃথিবীর আকাশে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। টুকির চোখে পেছনে ফেলে আসা সেই স্থলভূমি, যা রক্তিম দিগন্তে মাথার চুলের মতো ভাসছে। অনুরাধা সেদিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে, ‘কী সুন্দর আমাদের দেশটা!’ “
একঝাঁক মানুষ, মুখ্যত যারা নারী, দেশ স্বাধীন হোক বা পরাধীন – তাতে করে যাদের ভাগ্যের রকমফের খুব একটা হয় না, একটা যুদ্ধ এলো, এসে তাদের নারীশরীরের ওপর দিয়ে স্টিমরোলার চালিয়ে গেলো, এবং শেষমেশ যারা নিজ দেশে, নিজ মানুষজনের কাছে ঠাই পেলো না, পুরোটা জীবন ভুগেই গেলো অন্যের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে, এমন একদল মানুষের জীবনের সমাপ্তি – এরচে’ সুন্দর আর কিছু কি হতে পারে?
খুঁজলে এরকম আরও অনেক দৃশ্য, যারা শক্তিশালী, ভাষা ভারী ও জমাট বাধা কিন্তু উপন্যাসের প্লটকে তরল গতিশীল রাখে – তাদের খুঁজলে পাওয়া যাবে অন্যান্য উপন্যাসগুলিতে।
উপন্যাসটি পড়তে বসলে আপনার অনুভব হবে যেন আপনি একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন, আর চারদিক থেকে ফিসফিস করে ভেসে আসছে কিছু কণ্ঠস্বর।
৫। নির্মিত চরিত্রের পূর্ণতা প্রদান
শাহীন আখতারের উপন্যাসে প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র তাদের আবেগ – অনুভূতির সকল তলকে স্পর্শ করে। সহজে অনুমেয়, জগাখিচুড়ি পাকানো, আধখেঁচড়া চরিত্রের নির্মাণ ও বিস্তার লেখক হিসেবে তার চরিত্র নয়। তার মুখ্য চরিত্রগুলি জলজ্যান্ত মানুষের মতোই জটিল, এবং বিস্তৃত।
সখী রঙ্গমালায় রঙ্গি এবং ফুলেশ্বরী – দুটো একে অপরের অলটার ইগো। এদের একজনকে বুঝলে অপরজন আদতে কি না – তা বুঝতে সহজ হয়। এতো সুন্দর ও সর্বাঙ্গীণভাবে, একটা সার্কুলার মোশনে গল্পের সুঁই সুতোর ফোঁড়ে তাদের চরিত্রের বুনন এগোয় এবং পরিণতি লাভ করে, তা বলার নয়। একইভাবে তালাশ উপন্যাসে বীরাঙ্গনা মেরীদের একাত্তরের আগের নারীজীবন, যুদ্ধকালীন বাস্তবতার কদর্যতা, পুনর্বাসনের সময়ে নিজ দেশের, নিজ পরিবারের মানুষজনের কাছ থেকে পাওয়া নির্মম রসিকতা, সবশেষে জনতার স্রোতে ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাওয়া বা মুছে যাওয়ার মধ্যেই যে মেরীর মতো বীরাঙ্গনা মেয়েগুলির একমাত্র ভবিতব্য, তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে চরিত্রটির পূর্ণতা টানা হয়। অসুখী দিন-এ কথক সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম হক, নেতাজী সুভাষ বোসের আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে বার্মায় যুদ্ধ করে এসে কুঁচকিতে বুলেটের ক্ষত বিঁধিয়ে এসে হাজির হয় পূর্ব পাকিস্তানে। এসে দেখেন যে ততদিনে আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছে, কিন্তু সে সংগ্রামে তার আর কোন জায়গা নাই। এখন জাতির কেবলাও বদলে গেছে। নেতাজীর বদলে এসেছে মাওলানা ভাসানি, শেরে বাংলা, শেখ মুজিবুর রহমানেরা। একজন দারুণ স্পিরিটেড মানুষের এহেন আত্মসমর্পণ আমাদের পাঠক হিসেবেও কষ্ট দেয়। অথবা অনিতা সেন, ডায়রির আদলে যার লেখা ছড়িয়ে থাকে পুরো উপন্যাসের পাতা জুড়ে, তারও চরিত্রের এক ট্র্যাজিক (অনিতা সেন হয়তো মানবেন না) দিক থাকে, যা উপন্যাসের শেষ দিকে আমরা চিহ্নিত করতে পারি। পালাবার পথ নেই উপন্যাসে আশির দশকের বাংলাদেশে দুই তরুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে রাজনৈতিক স্থবিরতা, সাম্প্রদায়িকতা, ও নারীজীবনের কায়ক্লেশের গণ্ডি ছেড়ে উড়াল দেয়ার পরিকল্পনা করে দেশের বাইরে, যথাক্রমে কলকাতা ও ইউরোপে। বিবিধ অভিজ্ঞতার আনুপুঙ্খিকতায় পাঠক প্রকৃতঅর্থেই উপলব্ধি করতে সক্ষম হন, কেন শেষমেশ নারীর পালাবার পথ থাকে না কখনো।
৬। সর্বশেষ উপন্যাস এক শ এক রাতের গল্পের ব্যাপারে আলাদা দু’ ছত্র
শাহীন আখতারের এক শ এক রাতের গল্প তার এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সর্বশেষ উপন্যাস। ২০১৬ সালে সংঘটিত হলি আর্টিজন হামলার প্রেক্ষিতে রচিত এ উপন্যাসটি নিয়ে আলাদা কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি।
সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাস হিসেবে, পাঠকের প্রেক্ষিতে একে আমরা শাহীন আখতারের সবচেয়ে পরিপক্ক কাজ হিসেবে আশা করতে পারি। কিন্তু প্রকাশের পর এর রিসিপশানে কিছুটা শীতলতা আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের পাঠক কমিউনিটিতে। অর্থাৎ, যতটা তাদের আশা ছিল এ উপন্যাস থেকে, ততোটা তারা পাননি – কারো কারো বক্তব্য ছিল এমন। আমার যেটা মনে হয়েছে, পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দেওয়া সন্ত্রাসী হামলায় সংশ্লিষ্ট এক জঙ্গির লাশের তালাশে মর্গে মর্গে ঘুরে বেড়ানো জঙ্গি – বোনের বয়ানে রচিত এ উপন্যাস স্বাভাবিকভাবেই কি সেকুলার, কি ধার্মিক কোন পক্ষকেই খুশী করতে পারার কথা না। উপন্যাসটি পড়তে বসলে আপনার অনুভব হবে যেন আপনি একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকে পড়েছেন, আর চারদিক থেকে ফিসফিস করে ভেসে আসছে কিছু কণ্ঠস্বর। ভেসে আসা এসব কণ্ঠের উদ্দেশ্য জঙ্গিদের সরাসরি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা নয়, অথবা, তারা জিহাদি জজবায়ও উদ্বেলিত নয়। তবে আপনার উপলব্ধি হবে, কেউ যদি এ উপন্যাসটি পড়ে, এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রমে জড়িত মানুষের পরিবার জীবিত অবস্থাতেই কোন ধরনের জাহান্নামের মধ্য দিয়ে যায় – এটা উপলব্ধি করে, তবে তার পক্ষে আত্মঘাতী ফিদায়ি হওয়া সম্ভব নয়।
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছিল যে, শফি মোহম্মদের বয়ানে ধর্মের নামে আত্মঘাতী হামলার যে ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে এ উপন্যাসে উঠে এসেছে, তা আরও বিস্তৃত করা যেত। বিশেষ করে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে যে ধর্মযুদ্ধগুলো সংঘটিত হয়েছে তার আরও বিস্তার আমি ব্যক্তিগতভাবে কাঙ্ক্ষা করেছিলাম। কিন্তু সম্ভবত ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অহিংস চেহারার ওপর জোর দিতে গিয়ে তা আর হয়ে ওঠেনি।
৭। শাহীন আখতার কি প্রোজেক্ট রাইটার? তিনি ট্র্যাজেডির ফেরিওয়ালা?
হ্যাঁ, এ নিয়ে শাহীন আখতারের সমালোচনা করাই যায় যে তিনি যে সমস্ত বিষয়বস্তুকে উপজীব্য করে উপন্যাস লেখেন, তার ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। কেবল তার প্রথম উপন্যাস, পালাবার পথ নেই-ই একমাত্র ব্যতিক্রম, যেখানে ইতিহাস মূল চালিকাশক্তি নয়, বরং সাধারণ নারীজীবনই মুখ্য। কিন্তু রানি আর বুলবুলি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীর জীবনের ট্র্যাজেডি নিয়ে রচিত এ উপন্যাসও অতি নির্মমভাবে নারী পক্ষাপাতি হবার কারণ, ওটাকেও ঠিক (নারীবাদী) প্রোজেক্টের বাইরে ফেলা যাচ্ছে না।
অপর দিকে উপন্যাস তালাশ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, বীরাঙ্গনাদের নিয়ে। কাজেই এতে ইতিহাস অনুষঙ্গ, অনুষঙ্গ যুদ্ধে ধর্ষিতা নারীর আখ্যান। কাজেই এটাও মোটা দাগে প্রোজেক্ট উপন্যাস। উপন্যাসের মূল চরিত্র মরিয়ম শুরু থেকেই ধর্ষিতা। কখনো প্রেমিকের কাছে, কখনো পাক আর্মির কাছে, পরবর্তীতে বীরাঙ্গনাদের নিয়ে পুরুষ সমাজের ছোঁকছোঁকানোর কাছে। মরিয়ম এক পর্যায়ে ঠোঁটের কোনে পুরো পৃথিবীর প্রতি বিদ্রূপের হাসি নিয়ে ঘুরলেও, বীরাঙ্গনা হিসেবে তার যে নিয়তি আমরা দেয়ালের ওপর পেরেকে ঠুকে সাঁটিয়ে দিয়েছি – তা আর বদলায় না। দগদগে ট্র্যাজেডি হয়েই থাকে।
একইভাবে বাজারি আওরাত রঙ্গী, এবং তার অলটার ইগো, জমিদারনন্দিনী ফুলেশ্বরীকে নিয়ে উপন্যাস সখী রঙ্গমালা ইতিহাসভিত্তিক অতোটা না হলেও ট্র্যাজেডি তার মুখ্য উপাদান। একজনের বাজারি চরিত্র, এবং অপরজনের সন্তচিত চরিত্র হবার পরেও, দুজনেরই পরিণতি হয় প্রায় একই। রঙ্গমালার মাথা কাটা পড়ে চান্দা বীরের নাঙ্গা খড়গে। আর যৌবনের স্পর্শ পাওয়া জমিদার স্ত্রী ফুলেশ্বরী গর্ভপাতের পর যেন পুনরায় পরিণত হয় শিশুতে। অধিকার হারায় স্বামীর সংসার করার।
অসুখী দিন-এ কথক সাবিনার বাবা, ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক হঠাৎ করেই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে বোঝেন তার জীবনের সংগ্রাম বৃথা গেছে। অনিতা সেন নাম্নী চরিত্রটি ধর্ষণের শিকার হয়ে ধর্ষণসূত্রে লভ্য পুত্রসন্তানকে পুঁজি করেই কাটিয়ে দেন পুরো জীবন। আর শাহীন আখতারের সবশেষ উপন্যাস, এক শ এক রাতের গল্প তো হলি আর্টিজনে জঙ্গি হামলারই গল্প, স্রেফ চরিত্রগুলির নাম ভিন্ন। দুটো উপন্যাসই ট্র্যাজিক, এবং ইতিহাসকে পুঁজি করে লেখা।
তার গল্প বয়ন ও বয়ানের কুশলতার মুগ্ধতাজনিত ঘোর একবার কাটিয়ে উঠলে নারী – পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে নারী হিসেবে তার যে একপেশে অবস্থান, তা পুরুষ পাঠক হিসেবে মনের মধ্যে বিবমিষা তৈরি করে। কিন্তু, এই বিবমিষা সৃষ্টি করার সক্ষমতাই তার নারীদের আখ্যান রচয়িতা হিসেবে সাফল্য।
শাহীন আখতারকে এককথায় প্রোজেক্ট রাইটার বলে অভিযুক্ত করার বদলে আমরা উল্টো প্রশ্ন রাখতে পারি, আদতে কোন ভালো সাহিত্যকর্মটি ইতিহাসের গর্ভে পুষ্ট নয়, বা ট্র্যাজেডির জঙ্ঘাস্থান থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে নি? পৃথিবী জুড়ে সাহিত্য যখন একটু একটু করে পোক্ত হয়ে আসছে, সে এলিজাবেথান ইংরেজি সাহিত্যের মাথার মণি শেক্সপিয়রের নাটকেই তো ট্র্যাজেডি খুব বড় ভূমিকা রেখে এসেছে। এবং রাজবংশের ইতিহাস ছিল তার অধিকাংশ নাটকের মূল চালিকাশক্তি। তারপর রেস্টোরেশন পিরিয়ডের সেরা কাজ, মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট, রোম্যান্টিক পিরিয়ডের কবিতার মাঝে উইলিয়াম ব্লেকের দা চিমনি সুইপারস, ভিক্টোরিয়ান আমলে কৌম জনব্যবস্থার ধ্বস, গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষের ঢল, কৃষিভিত্তিক মরালিটির পতন, আধুনিক সাহিত্যে এলিয়টের দা ওয়েস্টল্যান্ড, লাভ সং অফ জে আলফ্রেড প্রুফ্রক থেকে নিয়ে উত্তরাধুনিক মানুষের ক্রাইসিস – বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে মানুষ থেকে তেলাপোকায় পরিণত হওয়া কাফকার বড়গল্প মেটামরফসিস-এর প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা, হেমিংওয়ের সমুদ্রে ঘুরতে থাকা বৃদ্ধলোকটির শেষমেশ বড় মাছটিকে নিয়ে ডাঙ্গায় ফিরতে না পারা, অথবা কামুর আউটসাইডার-এর মুখ্য চরিত্র মারস’র নিজের মায়ের মৃত্যুর দিনক্ষণ ভুলে যাওয়া থেকে নিয়ে হাল আমলের কুন্দেরার সাহিত্যে উপস্থিত সোভিয়েত রাশিয়ার কুক্ষিগত পোল্যান্ড, অমিতাভ ঘোষের শ্যাডো লাইনস-এ ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের রক্তের ছোপ, ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড-এ নাসারাদের রিয়েলিস্টিক পেইন্টিং-এর দাপটে অটোম্যান ওস্তাদ চিত্রকরদের মিনিয়েচার আর্ট ফর্মের অসহায় আত্মসমর্পণ, এলিফ শাফাকের বাস্টার্ডস অফ ইস্তাম্বুল-এ আর্মেনিয়ান ম্যাসাকার, খালিদ হোসাইনির দা কাইট রানার বা থাউসেন্ড স্প্লেন্ডিড সানস-এ সোভিয়েত-তালেবান লড়াইয়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হওয়া আফগান জনজীবন—এ সবই তো ইতিহাস ও ট্র্যাজেডিকে মিলিয়ে মিশিয়ে উপজীব্য করে লেখা আখ্যান।
শাহীন আখতার যখন লেখা শুরু করেন, যখন কেউ তাকে লেখক হিসেবে আলাদা করে চেনে না, যখন ব্যক্তি শাহীন আখতার কি চিন্তা করছে— তা নিয়ে এমনকি সাহিত্যপাড়ার কারো তেমন মাথাব্যাথা নেই, তখন তিনি স্রেফ লেখার জন্য আরেকটা উপন্যাস লিখবার বদলে পড়লেন, ফিল্ডওয়ার্ক করলেন, ইতিহাসকে তুলে আনলেন, এবং ইতিহাসের ট্র্যাজিক অংশকে তার উপন্যাসের হৃদপিণ্ডে পরিণত করলেন, সাহিত্য পদবাচ্য করে। এটা কি আদৌ দোষ? বরং তালাশে, অসুখী দিনে, কিংবা এক শ এক রাতের গল্প উপন্যাসে তিনি যেভাবে ইতিহাসের প্রচলিত ন্যারেটিভের বিরুদ্ধ স্রোতে দাঁড়িয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েছেন, তা তার প্রতি শ্রদ্ধা উদ্রেক করে।
৮। শাহীন আখতারের বর্শাছোঁড়া প্রকল্পের প্রতি শুভকামনা
ঔপন্যাসিক শাহীন আখতার এখনও সুস্থ আছেন, লিখছেন, তার উনুন থেকে নামানো টাটকা লেখাপত্র প্রায়ই পত্রপত্রিকায়, বা বইমেলায় পাওয়া যাচ্ছে— বাংলা সাহিত্যের পাঠক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য এ এক অনন্য সময়। তবুও যেতে যেতে এ মহান লেখিকার একটু কুৎসা গাইতে চাই এ বলে যে, তার গল্প বয়ন ও বয়ানের কুশলতার মুগ্ধতাজনিত ঘোর একবার কাটিয়ে উঠলে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে নারী হিসেবে তার যে একপেশে অবস্থান, তা পুরুষ পাঠক হিসেবে মনের মধ্যে বিবমিষা তৈরি করে। কিন্তু, এই বিবমিষা সৃষ্টি করার সক্ষমতাই তার নারীদের আখ্যান রচয়িতা হিসেবে সাফল্য। নারী-পুরুষ সম্পর্কের যে চিরায়ত রূপ, যা পান থেকে চুন খসলে আমরা হায় হায় গেল গেল রব তুলি, নারী লেখিকা হিসেবে তার কাজই ছিল তাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং তিনি তা অত্যন্ত সফলভাবে করেছেন। করেছেন নিজের অভিজ্ঞতার জগত থেকেই। যেমনটা নিজের লেখাপত্রের ব্যাপারে তিনি প্রায়ই বলেন, এসবই আমার মা-খালাদের গল্প। পুরুষশাসিত শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনে শাহীন আখতার যে তার সময়ের, তার জেনারেশনের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, এবং তার লেখা তালাশ বা অসুখী দিন-এর মতো উপন্যাসগুলো যে অলরেডি ‘মাজার’ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে, এটা অনেকে স্বীকার করতে চান না। কিন্তু তাতে কি খুব বেশী কিছু যায় আসে? তদবির সাহিত্যের দুনিয়ায় শাহীন আখতার হলেন সে ঔপন্যাসিক, যাকে পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উক্ত সাহিত্য পুরষ্কার নিজে সম্মানিত হয়। যাকে কোন সাহিত্য পুরষ্কার দিলে সেই পুরষ্কারটি বরং জাস্টিফাইড হয়ে ওঠে। উপন্যাস বা অন্য যেকোনো জনরার মহৎ শিল্পকর্ম সৃষ্টির প্রক্রিয়াটি আমার কাছে আকাশে বর্শা নিক্ষেপের মতো। শাহীন আখতার আকাশে বর্শা নিক্ষেপ করে হরহামেশাই দু’চারটে নক্ষত্র পেড়ে ফেলতে পারেন। তা আর কয়জনই বা পারে?
সাজিদ উল হক আবির
সাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক পরিচয়ে। প্রকাশিত উপন্যাস – শহরনামা (মাওলা ব্রাদার্স, ২০২২), গল্পগ্রন্থ – শেষ বসন্তের গল্প (শব্দশিল্প, ২০১৪), আয়াজ আলীর ডানা (শব্দশিল্প, ২০১৬), কোমা ও অন্যান্য গল্প (শব্দশিল্প, ২০১৮), কাঁচের দেয়াল (চমন প্রকাশ, ২০১৯), নির্বাচিত দেবদূত (অনুবাদ প্রকাশন, ২০২৪), কাব্যগ্রন্থ – হেমন্তের মর্সিয়া (শব্দশিল্প, ২০১৮), অনুবাদ – উপন্যাস ‘মিসিং পারসন’ – প্যাট্রিক মোদিয়ানো (চমন প্রকাশ, ২০২০), মুরাকামির শেহেরজাদ ও অন্যান্য গল্প (অনুবাদ প্রকাশন, ২০২৩), উপন্যাস ‘দ্য ফরটি রুলস অফ লাভ’ / দেওয়ানেগির চল্লিশ কানুন – এলিফ শাফাক (ঐতিহ্য, ২০২৪)।
জন্ম পুরনো ঢাকার আইজিগেইট, ফরিদাবাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। পড়াশোনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে। শিক্ষকতা করেছেন ইউনিভার্সিটি অফ এশিয়া প্যাসিফিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগে। বর্তমানে অধ্যাপনা করছেন ইস্টওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি বিভাগে (পূর্ণকালীন) এবং জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির বঙ্গবন্ধু ইন্সটিটিউট অফ কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড কালচারে (খণ্ডকালীন)।