অযৌক্তিকতা নিয়া স্পষ্ট করে খোলাসা হওয়া জটিল কর্ম। কিংবা জীবন যেই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে যৌক্তিকতা আর অযৌক্তিক আচরণ, সত্য আর মিথ্যা, ভালো আর মন্দের ফারাক অন্তর্হিত করে, সেই অবস্থানের প্রাবল্য বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া।
বেকেটের নাটক বিষয়ে বলছিলাম।
কোন নাটকের দিকে ইঙ্গিত করে শুরু করব ভেবে ‘Quad’ দিয়ে শুরু করি। সেখানে পর্দা উঠলে দেখা যায় যে, মঞ্চে চারজন শব্দবিহীন অদ্ভুত melodic চরিত্র চারটি ভিন্ন রঙের cowl gown দিয়ে যাঁদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত মোড়ানো। লাল, হলুদ, সাদা এবং নীল। সবার উচ্চতা, শারীরিক গঠন যতদূর সম্ভব একই হবে। বেকেট সেক্ষেত্রে লিখেছেন, বেটে এবং কৃশকায় হলে কর্ম নিষ্পাদনের জন্য ভালো। আর মঞ্চটি হলো একটি কেন্দ্রবিন্দু সংবলিত চতুর্ভুজ। যে চতুর্ভুজের চারকোণায় এই চারজন চরিত্র অবস্থান করবেন এবং act শুরু হলে বাদ্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট জ্যামিতিক নকশায় চারজনে চলমান হবেন। একেক সিরিজে পৃথক গমন আগমন, পৃথক চলন দেখা যাবে। পৃথক টেম্পো, পৃথক percussion থাকলেও লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, একটা নির্দিষ্ট প্রবণতা চার চরিত্রের জন্যই সংগত, তা হলো, যেন সবাই-ই কোনো না কোনো গতি ধরে, ত্রিকোণাকারে, চতুর্ভুজের বাহু ধরে, ক্লকওয়াইজ, এন্টি ক্লকওয়াইজ হেঁটে বারংবার সেই কেন্দ্রে পৌঁছাতে চাচ্ছেন, কিন্তু ultimately সে কাজ কিন্তু সম্পন্ন হচ্ছে না। তাঁরা কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারছেন না। কিংবা কোনো অবচেতন প্রবণতায় কেন্দ্রে পৌঁছানোর পথে থাকলেও শেষপর্যন্ত গন্তব্য এড়িয়ে চলে যাচ্ছেন। চলনের মোড়ে মোড়ে বাজনার climax-এ বদল ঘটছে।
এবার, এই যে কেন্দ্র আর এই চার চরিত্রই বা, একটু স্থির হলেই বোঝা যাচ্ছে যে, এঁরা প্রতীকী ভাষ্যে আমাদের জীবনেরই কোনো না কোনো পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেমন হতে পারেন, এঁরা একটি পরিবার। পরিবারের চার সদস্য। সন্তান মাতা পিতা। ব্যক্তিগত প্রাপ্তবয়স্ক বিছিন্নতার কারণে sentimentally প্রয়োজনের সময় একত্রে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারছেন না। দরকার মতো একে অপরের জন্য উপস্থিত থাকতে পারছেন না। কিংবা এই চারটা rhythm হতে পারে আমাদের দৈনিক রুটিনও, যা নিজেদের দৈনন্দিন কার্যসিদ্ধির উদ্দেশ্য কিংবা জীবনের লক্ষ্য স্পর্শ করতে পারছে না। ঐ কেন্দ্র হতে পারে আমাদের ভেতরকার ultimate passion-এর জায়গা, যাকে রুজি-রোজগারের প্রাথমিক ধান্দায় একটি বারও সময় করে ছুঁতে পারছি না আমরা।
পিকাসো যেমন বলছেন যে, তুমি কলার কোনো অঙ্গন আর তার অন্তর্নিহিত নিয়ম, শাসন এমন ভাবে আত্মস্থ করো যেন তা একজন অধিপতির মতো ভেঙে ফেলতে পারো। নাটকে বেকেটের উপস্থিতির ক্ষেত্রেও তা সত্য হয়। মূলত সব মাস্টারের ক্ষেত্রেই তা সমান সত্য। ভাঙো। ভেঙে ফেলা। ধ্বংসের মূলেই পুনঃ সৃষ্টি।
বেকেটের নাটকে মিউজিক, জ্যামিতি আর মিথোলজিক্যাল তত্ত্বের অংশগ্রহণের সূক্ষ্মতা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। “Act without words” নামে আছে দুটি পর্ব। দুটি ভিন্ন নাটক। ‘I’ আর ‘ll’.
প্রথম পর্বে আমরা দেখতে পাই, একটা একক খেজুরগাছ সংবলিত তপ্ত ধূ ধূ মরুভূমি। একজন চরিত্রকে যেন সেখানে অকস্মাৎ ছুঁড়ে ফেলা হলো। চরিত্র ক্লান্ত, জড়সড় এবং ঘটনার আকস্মিকতায় মুহ্যমান। খেজুর পাতা হঠাৎ লোভ দেখিয়ে ছাতার মতো বেড়ে গিয়ে ছায়া দেয়। চরিত্র খুশি হয়ে সেখানে ছায়া নিতে গেলে গাছ তার পাতা গুটিয়ে ফেলে। একটা দড়ি বাঁধা পানির বোতল উপর থেকে হঠাৎ নিচে নামতে থাকে। চরিত্র দৌড়ে পানি আনতে গেলে সেটি চট করে আরেকটু উপরে উঠে যায়। একটা কাঁচি নেমে আসে। চরিত্র তা দেখতে পান। তা দিয়ে হাতের নখ কাটতে থাকেন। ক্রিটিক একে হাইডেগারের existing objects এর সাথে তুলনা করেছেন। তুমি প্রাথমিক অবস্থায় কোনো বস্তু পাওয়ার পর তা কাজে লাগানোর বাসনা অনুভব করলে। অতঃপর যথারীতি কাজে লাগাতে সচেষ্ট হলে। কারণ এছাড়া আর কী-ইবা করার আছে? একটা উঁচু চৌকোনা ঢিপি। যেন বোতলটা এবার নাগাল পাওয়ার ব্যবস্থা হবে। যেন কেটে নামিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করা যাবে এমন সুযোগ। মঞ্চের চরিত্রও সেমত চেষ্টা করে যান। নাগাড়ে। কিন্তু জল হাতে আসে না। কর্ম, পুনঃ পুনঃ চেষ্টা চরিত্রকে ক্লান্ত করে দেয়। কিংবা আমরা কি এখানে বলতে পারি যে, কর্মই এই কারণ-শূন্য অঞ্চলে ছল করে চরিত্রকে ব্যস্ত করে রাখে? যেমন আমরা ব্যস্ত আছি বেঁচে থাকায়। দানাপানির সংস্থানে। একটি বিশেষ স্বপ্ন বা অবস্থানের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা বুঝি যে, accomplishment মূলত বায়বীয় জিনিস। সে তোমাকে লোভে বাঁচিয়ে রাখে কিন্তু আইটেম গানের নটী শিলার যৌবনের মতো তোমার হাতে এসে পৌঁছাতে অস্বীকৃতি জানায়। চরিত্র ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে। দাসত্ব ত্যাগ করে। যাদেরকে আমরা মতান্তরে pessimistic nihilistic কখনোওবা stoic বলে থাকি।
“Act without words II” আরেকটু অস্পষ্ট, জটিল আর ইন্টারেস্টিং ; কিন্তু বার্তাটা সহজ। দুই থলের মধ্যে দুই চরিত্র পাশাপাশি অবস্থান করেন। সিনেমা রিলের মতো circumstance পরপর সংযুক্ত। চরিত্ররা খানিকটা কৃত্রিম চলাচলে তাঁদের কার্য সম্পাদন করবেন। যেন সিনেমার রিলের ভেতরে থাকা অসংখ্য স্থির ছবি সচল হলো। সিনেমার রিল চলার শব্দ হয়। একটি সচল pointed স্কেল এসে থলেটিতে খোঁচা দেয়। যেন সময় হলো, কিংবা এলার্ম। থলে থেকে একজন চরিত্র বের হয়ে আসেন। দুখী, বিষণ্ণ মুখ। আস্তে হামাগুড়ি দেন। হাঁটুতে বসেন। উঠে দাঁড়ান, চলতে শুরু করেন। দুখী বিষণ্ণ মুখ। যেন সদ্য জন্মের পর একটি প্রাণ দুনিয়ার সাথে তাল মেলাতে চেষ্টা করছে এবং ভীষণ বিষণ্ণ। সে চলে, ওষুধ খায়, প্রার্থনা করে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাজের পোশাক পরিধান করে, খাবার মুখে নেয় এবং বিষণ্ণ থাকে। সে পাশে থাকা ভর্তি থলেটি কাঁধে নিয়ে পরের স্তরে যায় এবং নামিয়ে রাখে। ওষুধ খায়, পোশাক ছাড়ে, প্রার্থনা করে এবং আবার ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়ে। দ্বিতীয় থলে থেকে অ্যালার্মের শব্দে আরেকজন লোক বের হয়। উৎফুল্ল দেখায় তাঁকে। কিংবা সে দেখানোর চেষ্টা করে। পকেট-ঘড়ি দেখে, শারীরিক ব্যায়াম করে, চুল পরিপাটি করে, ফুর্তির সাথে পোশাক পরে, খাবার খায়, পত্রিকা পড়ে, ঘড়ি দেখে, আয়না দেখে, দৈনিক কর্ম করে। সব রুটিন মাফিক চলে। তারপর পোশাক পরে থলেতে ঢুকে পড়ে। এই cycle-ই চলতে থাকে। যেন আমাদের দৈনিক জীবন। একদিন ভালো এবং একদিন বিষণ্ণতায় নিমজ্জিত। দুইটি ভিন্ন জীবন একই আমরা একসাথে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। disscociativity.
“Ghost Trio” নাটকটি বেকেট Beethoven এর Fifth piano trio-কে কেন্দ্র করে, যেটিকে কিনা The Ghost-ও বলা হতো- তৈরি করেছেন। পেছন থেকে উপরিউক্ত মিউজিক বাজবে। একজন লোক একটি কক্ষে দরজার পাশে বসা। আর আছে একটা জানালা। একটি আয়না। মেঝেতে মিশে থাকা একটা বিছানা।
সাদা উসকোখুসকো চুল, নুয়ে থাকা শরীর। মাথা প্রায় হাঁটুর কাছে। হাতে থাকা রেডিওটা বাজাচ্ছেন। আওয়াজ কমাচ্ছেন, বাড়াচ্ছেন। রেডিওতে থাকা নারী কণ্ঠ যেন ফরমায়েশ দিয়ে সব করাচ্ছেন। মাঝেমধ্যে দরজা খুলে কী যেন দেখার চেষ্টা করছেন। কারোর উপস্থিতি আছে কী না? মাঝেমধ্যে জানালা খোলেন, কেউ নেই, Nobody. বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। আবার এসে বসে রেডিওটি হাতে নিচ্ছেন। কারোর পায়ের নুন্যতম আওয়াজ হলো? আবার রেডিও বন্ধ করছেন৷ কান পাতছেন। স্লথ লয়। শেষে ধীর পায়ে আয়নার কাছে। palate. ধূসর, ভাঁজ হওয়া চামড়া। ফ্যাকাশে মুখ। আবার দরজার কাছে। এবার দরজায় একটি বালক। রেইনকোট পরা। তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সহবতের হাসি। তারপর চলে গেল। ব্যক্তির ছোটবেলা হতে পারেন। চরিত্র দরজা বন্ধ করে ফিরে আসেন। টোলে বসেন এবং পুনরায় রেডিওতে বিটোভেন চালান। তাতে নিমগ্ন হন। আওয়াজ কম করেন, বাড়িয়ে দেন। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকান, যেহেতু এই নাটক টিভির জন্য তৈরি ছিল। দর্শকের দিকে, আমাদের দিকে তাকান, মুখে অল্প lunatic হাসি নিয়ে। বেকেটের নাটকে রেডিওর গুরুতর ব্যবহার, রেডিওর প্রতি দুর্বলতা দেখতে পাওয়া যায়।
বেকেট অন্যান্য মানব পর্যায়ের তুলনায় বার্ধক্য ও সে সংক্রান্ত সংকট এবং বার্ধক্যের সাথে বাদবাকি পর্যায়ের যে সূক্ষ্ম সংযোগ, তা তুলে ধরতে বেশি প্রয়াস করেছেন।
“Come and Go”-তে আমরা দেখি তিন বান্ধবীর একটি গ্রুপ। তাঁরা সময় পার করেন একটা cycle ধরে একে অন্যের সাথে আবার নিজস্ব পৃথক পৃথক গোপনীয়তা লেনদেন করে। একে অন্যকে প্রতিজ্ঞা করেন যে, আমরা একে অন্যের গোপন কেচ্ছা অন্যের থেকে গোপন রাখব। তাঁরা যেন পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করেন। তিনজনে মিলে একে অন্যের হাত ধরেন; Infinity symbol (∞) এর ন্যায়। এতো বছর ধরে চলে আসা বন্ধুত্ব যেন ভবিষ্যতেও অটুট থাকবে, তাঁরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবু তাঁরা স্মৃতিচারণ করেন। হতে পারে যৌবনের, প্রেমের, ভেঙে যাওয়া বিবাহের। যেন, তবুও সব আর আগের মতো নেই। তাঁরা হাত ধরে একে অন্যের অনামিকার পেটি স্পর্শ করেন। খালি হাত, খালি আঙুল। তবু বলেন, I can feel the ring. তাঁরা একে অন্যের দুঃখ, অতীত, বয়ে বেড়ানো একাকিত্ব কিংবা আক্ষেপ কিংবা অনুতাপ অনুভব করতে পারেন। বেকেটের Come and Go এর এই বন্ধুত্বের সাথে critic-রা রোমান মিথোলজিক্যাল ইতিহাস “The Three Graces (Gratiae)” এর এবং পরিচালক Fritz lang এর ক্রাইম থ্রিলার ‘M’ মুভিটির পরোক্ষ প্রভাব কিংবা ছাপ খুঁজে পান।
বেকেটের নাটকে বিস্তারিতভাবে এবং দৃঢ় রূপে যে একটি act বরাবর ঘুরেঘুরে আসে, তা হলো নিরন্তর অপেক্ষা। কিংবা অপেক্ষা আর বার্ধক্যের সংমিশ্রণ। সেক্ষেত্রে আমি নতুন করে “Waiting For Godot” এর কথা বলবো না। এ নাটক নিয়ে নানান আলোচনা সহজেই হাতের কাছে পাওয়া যায়। বেকেটের অন্যতম পছন্দের একটি কাজ প্রসঙ্গে আমি বলবো “Happy Day” এর কথা। এই এক নাটক নিয়েই দেড় বিঘৎ লেখা লিখে ফেলা যায়। বিশেষত যে কাজ তোমাকে নিশ্চিতভাবেই গভীর পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারে, তা নিয়ে ঘণ্টা বকবক করা আরামেরও বৈকি।
এই নাটকটির শুরু হয় এরকম, Winnie, একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ যাঁর কোমর পর্যন্ত মাটির ঢিবির নিচে আবদ্ধ, সামনের দিকে ঝুঁকে মাটিতে মাথা রাখা, যেন শুয়ে আছেন। অ্যালার্ম বাজতেই তাঁর ঘুৃম ভাঙল। “আরেকটি নৈসর্গিক দিন”, তিনি হাত জোর করে প্রার্থনা করলেন। পাশে ব্যাগ থেকে ব্রাশ আর টুথপেষ্ট বের করে দাঁত মাজলেন। আয়না দিয়ে দাঁত এবং মুখ পর্যবেক্ষণ করলেন। “No better no worse”. কোনোকিছুই ভালো করে আর পড়া যায় না। ” Old those things” সব পুরনো হয়ে গেছে। পেস্ট শেষ, লিপস্টিক শেষ, সর্বার্থসাধক হোমিওপ্যাথি তরল ঔষধি শেষ। পুরাতন চশমা। পুরানা চোখ। পেছনে আরেকজন পুরুষ চরিত্রের গৌণ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় Willie বলে। সম্ভবত সঙ্গী। কিছু পড়ে গেলে মাঝেমধ্যে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেন। দেড় ঘণ্টায় এক-আধা টুকরা কথা হয়। পেছন থেকে মুখে ঘাৎঘুৎ শব্দ করেন। যেন বিপাকক্রিয়ার এসিডিও সমস্যা। মূল চরিত্রের দিকে কোনো উৎসাহ বা ভ্রুক্ষেপ নেই। একটু ঘষাঘষির শব্দ আসে যেন, কিংবা হতেও পারে পেছনের লোকটি হস্তমৈথুন করছেন। Winnie খুশি হয়ে তাকান। যেন ঐ কাজে নির্দেশনা দেন। হাতের movement করে দেখান, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ভালো করে, এই দিকটায়, এভাবেই।” সঙ্গী এক-দুটি কথা বললে অতি উৎফুল্ল হয়ে উঠেন। বলেন, “আরেকটি বিস্ময়কর সুখী দিন।” আয়না দেখেন। নাটকের শেষতক তাঁর বিশাল মনোলগ চলমান থাকে। ঐ স্মৃতিচারণ, প্রথম চুম্বন, প্রথম বল-এ যাওয়া, প্রথম কোলে বসা কারোর। কিছুটা বার্ধক্যজনিত উন্মাদনা। কখনো কান্না পায়। “What is the alternative?” কখনো কিশোরীর মতো হাসেন। হাতের রুমাল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করেন। লিপস্টিক মাখেন। চুল আঁচড়ান। পেছন থেকে কোনো শব্দ না এলে পুরুষ সঙ্গীকে নিয়ে মাঝেমধ্যে উৎকণ্ঠা হয়। সে কি মরে গেল? শব্দ আসে না কেন? “এখানে ঘুমায় না, নিজের গর্তে যাও, এই তো, ভালো ছেলে। এমনে না, মাথাটা আগে দাও। লেজটি নামিয়ে রাখো। কষ্টকর, আমি জানি।”
উইনির পুরুষ সঙ্গীটি চার পায়ে হেঁটে নিজের গর্তে ঢুকে পড়েন৷ শুয়োরের মতো।
“তুমি তোমার চুলগুলোকে কী বলো? them নাকি it, উইলি, উইলি…?”
-it
“তুমি আজকে আমার সাথে কথা বলবে? ahh! another happy day!”
নিজের সবরকম ত্রুটি নিয়ে সচেতন আর উৎকণ্ঠায় থাকেন উইনি। মনোলগে নিজের ধারণা ব্যক্ত করে সেটাকে আবার “Old style, পুরাতন রীতি, পুরাতন নিয়ম, পুরাতন দিনের মতো” বলে বর্তমান বিষয়ে সচেতন হন। মাঝেমধ্যে সাধারণ গতির মনোলগ আসে। মাঝেমধ্যে দ্রুতবেগের। যেমন কিনা আমরা Waiting for Godot তে Lucky চরিত্রের মুখ থেকেও একসময় শুনতে পেয়েছি।
এই কোমর পড়ে যাওয়া মধ্যবয়স্কা নারীটি, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষারত। সে শঙ্কা করে অকেজো অথচ পাশে পড়ে থাকা সঙ্গীটিও মরে যাবে কয়েকদিনের ভেতর, আগে কিংবা পরে। “তুমি কি আমাকে দেখতে পাও? তুমি কি আমাকে শুনতে পাও? এবার? এখন?”
পাশে একটি ব্যাগ আছে, তাঁর সব সরঞ্জাম সেখানে থাকে। সব পুরাতন জিনিস, এবং সবই শেষ হয়ে আসছে। সে তবু পরিপাটি থাকার ভান আর চেষ্টা করে। তাঁর আলগা হয়ে আয়েশ করে বসতে কষ্ট হয়। সে বলে “পৃথিবী আজকে সত্যিই বেশ আঁটসাঁট।” সে তাঁর সঙ্গীটির উপেক্ষা অবহেলা নিয়ে সহানুভূতিশীল হয়। পেছন থেকে হাসির শব্দ এলে সে-ও হাসিতে লুটিয়ে পড়ে।
ধীরেধীরে দেখা যায়, তাঁর ব্যাগ থেকে সে একটি রিভলবার বের করছে। “কতদিন ধরে কোনো পরিবর্তন নেই! কী বিস্ময়কর!”
দ্বিতীয় দৃশ্যে দেখা যায় মূখ্য চরিত্র উইনি এবার গলা অবধি মাটির তলে দেবে গেছেন। দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম অঙ্কের তুলনায় আরেকটু বেশি নিরানন্দ। আশ্রয়হীন। ধরে নেওয়া যায়, বার্ধক্যে এবার গলা অবধি বিকলাঙ্গ মহিলা। paralyzed. পাশে থাকা রিভলবারটি কিংবা ছাতাটি, ব্যাগের সরঞ্জামগুলা ব্যবহারের তাঁর আর কোনো শক্তি নেই। অ্যালার্মে তিনি জেগে উঠেন আবার। আরো এক খাবলা মনোলগ চলতে থাকে। আরো উদ্দেশ্যহীন। কখনো চিৎকার। কখনো দ্রুত, কখনো সাধারণ বেগে। কিন্তু জগতের সকল মানব দ্বারাই অনুভূত হবার যোগ্য। তৃতীয় দৃশ্যে উইলির দেখা পাওয়া যায়। মনোলগের মাঝখানে চারপেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে আসে বৃদ্ধ। অস্থিতিশীল। মাথাটি বারবার লুটিয়ে মাটিতে লাগছে। পরিপাটি পোশাক, হেট পরা। “কী চমৎকার! তোমাকে ঐদিনের মতো দেখাচ্ছে, যেদিন তুমি আমাকে চাইতে আমাদের বাড়িতে এসেছিলে। বায়ুচলাচল বিহীন, উপহাসময় জীবন। খিকখিক! ঐ ফুলগুলো কোথায়? তুমি কি এবার এই দিকে এসে আমার পাশে কয়েকদিন কাটানোর কথা ভাবছ? চেষ্টা করো, আমি তোমাকে উৎসাহ দিচ্ছি।” উইলি হামাগুড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গিয়ে বারবার লুটিয়ে পড়ে যেতে থাকেন। উইনি ক্লান্ত চোখে, হাসি নিয়ে, উন্মত্ততা নিয়ে একটি গান গুনগুন করতে থাকেন।
এভাবেই এই নাটকের শেষ হয়।
যখন মার্কিন ঔপন্যাসিক এবং গল্প লেখক Kay Boyle বেকেটকে জিজ্ঞেস করেন, শেষ দৃশ্যে উইলি হামাগুড়ি দিয়ে উইনির দিকে পৌঁছাতে চায় কেন? বেকেট বলেন যে, প্রশ্নটি হলো, উইলি কি উইনির দিকে যাচ্ছিল, নাকি ঐ রিভলবারের দিকে যাচ্ছিল? একই প্রশ্ন আমরা করতে পারি “All That Fall” এর ক্ষেত্রেও। যে, মিস্টার রুনি ছোট বাচ্চাটিকে রেলওয়ে ক্যারেজ থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন কিনা। এবং দুইটারই উত্তর হলো, “আমি জানি না। আমরা জানি না।” উইনির তরফ থেকেও একই প্রশ্ন আসে। “উইলি, তুমি কি আমার দিকে আসছ? নাকি অন্য কিছুর উদ্দেশে?”
কিন্তু শেষতক উদ্দেশে, প্রবণতায় অস্পষ্টতা থাকলেও কেন্দ্রীয় রূপক আমাদের কাছে স্পষ্ট, তা হলো, উইনি, আমাদের মূখ্য নারী চরিত্র ধীরগতিতে হতাশার আর মহাকালের বালিতে ডুবে যাচ্ছেন।
একইরকম মৃত্যুর অপেক্ষা আমরা দেখি “Rockaby” নাটকেও। অভিনেত্রী Billie রকিং চেয়ারে বসে মৃত্যুর অপেক্ষা করছেন৷ শেষের দিকে নিঃশ্বাস বুজে আসছে, যেন ঘুমের কোলে ঢলে পড়ছেন। পেছনে মনোলগ চলে। যেন lullaby.
তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি আরো একটি নাটকের সঙ্গে বেশ নৈকট্য অনুভব করি বলে মনে হয়, কিংবা নিজস্ব ভবিষ্যত নিয়ে আমার যত অনিশ্চিত আশঙ্কা ও মনোবৈকল্য সেসকল বিকার এই নাটকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা অনুভব করে, সে কাজটি হলো “Krapp’s Last Tape”, একটি এক অঙ্কের নাটক। বেকেট প্রথম এই নাটক লেখার কথা ভাবেন তথা লেখেন আইরিশ অভিনেতা Patrick Magee কে তাঁর উপন্যাস Molloy থেকে কিয়দংশ বিবিসি রেডিওতে পড়তে শোনে। প্রথমে এই নাটকটির নামকরণ হয়, “Magee’s Monologue.”
পর্দা ওঠার পর আমরা দেখতে পাবো একজন বৃদ্ধ, নিজের কুঠুরির ন্যায় অন্ধকার ঘরে অবস্থান করছেন৷ চোখেমুখে বিভ্রান্তি, দুঃখ মেশানো অস্থিরতা। অনেকক্ষণ ধরে নিমগ্ন। টেবিলে বসা। টেবিলের উপরে একটি টেপ রেকর্ডার। তিনি ড্রয়ার থেকে একটি কলা বের করলেন। ছিলে মুখে দিলেন। দ্বিতীয় কলা। তৃতীয় কলা, এবার একটু দ্রুত, মুখে দিয়ে থু করে ফেলে দিলেন।
টেবিলের উপরে একটা ল্যাম্প জ্বালানো। টেপ রেকর্ডারের পাশে তাক করা কিছু টিন রাখা। টিনে রেকর্ড ভরা রিল। তিনি একটা খাতা খুলে তালিকা ধরে কোনো একটি রিল খোঁজেন। “Box 3, spool 5.” spoool.. Spoolll 5.” চোখের সামনে অন্যান্য টেপ এলেও নির্দিষ্ট টেপটি আসতে চায় না। spool, এই spool শব্দটি উচ্চারণ করা তাঁকে একপ্রকার বালকোচিত আরাম দেয়। নানান ভঙ্গিতে তিনি spool শব্দটি উচ্চারণ করেন। SPOOL. একটি রিল খুলে তিনি টেপে ভরে চলতে দেন। তাঁর ৩৯তম জন্মদিনের রেকর্ড। একটি পানশালায় একা একা দিবসটি পালিত হয়েছিল। রেকর্ডগুলো সবই তাঁর নিজের করা। নিজের ডায়েরি। নিজের স্মৃতি। এছাড়াও উল্লেখ আছে আরোও পূর্বের বিশ বছর বয়স পরবর্তী কোনো এক রেকর্ডের, যা তিনি ঐদিন রেকর্ডকালীন সময়ে রিভিউ করেছিলেন। তারপর আরেকটি রিল। সেখানে তাঁর মধ্যবয়স্ক নড়বড়ে যৌন জীবন আর এক পুরাতন বেশ্যার উল্লেখ আছে। আরেকটি রিল। সেখানে তাঁর যৌবনের প্রেমিকার উল্লেখ। আরেকটি রিল, কী করে দেখা হয়েছিল আরেক নারীর সাথে; নারীটি বৈচি তুলতে এসেছিল। আরেক রিলে নার্সিংহোমের সামনে তাঁর অপেক্ষার সাক্ষী, কখন মায়ের মৃত্যু সংবাদ আসে ভেতর থেকে। আরেক রিলে তাঁর বইয়ের পাবলিশিং এবং সে সংক্রান্ত সূচনীয় খবর। এগারোটি বই বিক্রি হয়েছে৷ তাঁর মধ্যে আটটিই যাচ্ছে অন্য দেশের কোনো লাইব্রেরিতে। পাঠক কিচ্ছু কিনেনি। আরেকটি রিলে সন্ধ্যায় তাঁর কুকুর নিয়ে হেঁটে চলার বর্ণনা। নানান বয়সের ; ঊনত্রিশ, বিশ পরবর্তী, একত্রিশের…
প্রত্যেকবার নিজের কণ্ঠ আর বর্ণনা শোনার সময় Krapp ঐ নির্দিষ্ট সময়ে হারিয়ে যান। আফসোস, হতাশা, আনন্দ, খেদ তাঁকে আঘাত করে করে যায়।
শেষ দিকে তিনি ভাবেন রেকর্ডটি আবার চালাবেন। ঊনচল্লিশ বৎসরের অই সময়কার। এবার শেষ থেকে। এবার আর যেন তাঁর পূর্বের নেয়া সিদ্ধান্ত তাঁর ভেতর নতুন করে কোনো খেদ তৈরি করতে না পারে। সেই টেপটি শুনতে শুনতেই নাটকটি শেষ হয়ে যায়। অন্ধকার নেমে আসে। পর্দা পড়ে।
শুধু অমীমাংসিত থেকে গেল কেন এই নাটকের নাম হলো krapp এর শেষ টেপ? এরপরে কি যন্ত্র-আসক্ত চরিত্রটি নিজের জীবন রেকর্ড করা ছেড়ে দেন? কিংবা রেকর্ড শোনা ছেড়ে দেন? কিংবা সেদিন রাতে কি তাঁর মৃত্যু ঘটে? ফেলে দেওয়া কলার খোসায় পা পিছলে, কিংবা হার্ট অ্যাটাকে? অথবা আসলে Last অর্থ কি সে Last নয়? হতে পারে সেদিনের সর্বশেষ টেপ। পরে হয়তো তিনি আরো রেকর্ড তৈরি করবেন। আরো রিল শুনবেন। এরকম কি? উত্তর হলো, আমরা জানি না।
সমালোচক Anthony Cronin এই নাটকে আলো আঁধারির দ্বিবিভাজন কিংবা বিন্যাস বিশ্লেষণ করে এই নাটক খানিকটা Manichaeism দ্বারা উদ্ভুদ্ধও ধারণা করেছেন। কলা রহস্যের এতো সূক্ষ্ম পাঠোদ্ধার কিংবা একটা ধারণা আন্দাজ করতে চাওয়া ব্যক্তিগতভাবে আমায় টানে না। কে করলো না করলো কখনো, তাতেও কিছু যায় আসে না।
কেবল মনোলগ কেমন করে এতো fascinating হয়ে উঠতে পারে, একটি আস্ত নাটক হয়ে উঠতে পারে, আমরা বেকেটের “Not I” নাটকটিতেও দেখতে পাই। যা অভিনেত্রী Billie Whitelaw-কে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়েছিল। একজোড়া ঠোঁট সংলাপ বলে যাচ্ছে। কৈশোর, insecurity, trauma, sudden flash of thought, bugging so cold, scream, and the brain,the brain…. “What? Who? No…SHE..”, “Tiny little girl..” একজোড়া ঠোঁটের উপর একটি স্পটলাইট স্থির করা। বাকি সব কালিমাখা অন্ধকার। বাস্তবতায় বেকেটের চরিত্ররা সবাই পাগল।
“Ohio Impromptu”-তে দেখা যায় দুই doppelganger কাছাকাছি টেবিলে বসা। যমজের মতো। একজন একটি বইয়ের একটি পৃষ্ঠা পড়ছেন। শেষ পৃষ্ঠাটি। যেন নিজে নিজের মুখোমুখি, নিজের জীবন নিয়ে। “Alone together”, ” A little is left to tell.” “Nothing is left to tell.”
“Play” নাটকটি আরো ভৌতিক। যেন মহাশ্মশানে তিনটি শবাধার রাখা। সেখানে তিন চরিত্র। দগ্ধ গলা চামড়া, মুখে বিভৎস ফোসকা। একজন পুরুষ আর দুই নারী চরিত্র। তিনজনে পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের মধ্যবর্তী ত্রিকোণা প্রেমের ঘটনা বর্ণনা করছেন। স্বভাবতই অস্পষ্ট। ধীরে, এবং খুবই দ্রুত। “Endgame” এর ডাস্টবিন দুটির মতো শবাধারগুলো। না, “Endgame” নাটকটি নিয়েও নতুন করে কিছু লিখব না। যথেষ্ট লেখা, যথেষ্ট রিভিউ হয়ে গেছে হাতের কাছে।
নাটকগুলোর ভালো পরিচালনা ইউটিউবেই পাওয়া যায়৷ এখন locally যা হয় কদাচিৎ, তা সরাসরি বসে দেখার থেকে আমার ধারণা উপাদেয়গুলো ইউটিউবে দেখা-ই ভালো, যতক্ষণ পর্যন্ত না ভালো পরিচালনা ফিরে আসে।
বেকেটের নাটক lucidly vague, mystical. বেকেট অত্যন্ত আধুনিক। সবচেয়ে বেশি যা, তা হলো সকলের সাথে আত্মীয়গতভাবে সংলগ্ন। অস্পষ্ট আর্ট বুঝতেই কসরত বরং কম হয়। যা মন করে ভাবো। তর্ক করো। ধানাইপানাই করো। অমীমাংসীত থাকো, কিংবা থাকুক। জীবনে আরো অনেকবার বেকেটের মঞ্চে ফিরে ফিরে যাবো মনে করি।
দৃষ্টি দিজা
কবি, কথাসাহিত্যিক
‘বিলুপ্তি ফেরাতে আসা রানী মাছ’ একমাত্র প্রকাশিত বই।