সাজ্জাদ পিপলু গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে অকপট হুমায়ূন আহমেদ বলেন ‘আসলে গদ্যের মাধ্যমটিতে আমি অনেক বেশি সাচ্ছন্দ বোধ করি। কবিতার মাধ্যমটি হচ্ছে দুরূহ মাধ্যম, এ মাধ্যমটিতে আমি যেতে চাই না। আরো অনেক কবি আছে, তারা লিখবেন, আমি গদ্য লিখেই সন্তুষ্ট।’ (অন্যদিন, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬)
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না পাঠক নন্দিত হুমায়ূন আহমেদ শুধু গদ্য লিখে সন্তুষ্ট থাকেননি, তার সন্তুষ্টি বিস্তৃত করেছে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিনাকে। বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে পাঠক প্রিয় গদ্যকার তিনি। গদ্যের প্রায় সকল গলিপথ, রাজপথে তিনি নিজের চলার স্বাক্ষর রেখেছেন। গল্প, উপন্যাস, নাটক (মঞ্চ ও টিভি), আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ গদ্য, শিশুসাহিত্য এমনকি গাছ নিয়েও রচনা করেছেন অনবদ্য সাহিত্য কর্ম। তবে পদ্য বা কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অতোটা একছত্র বিচরণ করেননি।
এমন একটা বাজে কথা, প্রায়শ শোনা যায়, ‘বাংলাদেশে কাকের চেয়ে কবি বেশি।’ সেটা যদি হয়ও দোষের কিছু নাই। মানুষ দুর্নীতি করার চেয়ে, একে অন্যের ক্ষতি করার চেয়ে, পরিবেশ দূষণ করার চেয়ে কবিতা লিখলে ভালোই হতো। যাহোক, এই চলতি ফাজলামি মার্কা সস্তা কথাটার উৎসমূল জানি না। তবে ধারণা করি, কম-বেশি কাব্য বোধ কৈশোরে এবং যৌবনে সকল প্রেমিক কিংবা সৃজনশীল মানুষের মধ্যেই দেখা যায়। দীর্ঘ চর্চার অভাবে তা আর একটা পরিণতিতে যায় না। কিন্তু অপরিণত, কেবল আবেগতাড়িত কবিদের কবিতা লেখা ও বেশ-ভূষা-চাল-চলনে কবি হওয়ার প্রক্রিয়াটি হয়তো কাউকে কাউকে বিরক্ত করে। তবে আমার প্রতিপাদ্য কথাটি হলো, এ দেশের প্রায় নব্বই ভাগ সাহিত্যিকই কবিতা লেখা দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে ‘গদ্যের গহন অরণ্যে’ হারিয়ে যায়। কবিতা, ভাষার শুদ্ধতম এবং পরিণততম প্রকাশ হলেও আবেগের কারণেই তাৎক্ষণিক একটা কবিতা লেখা যেতে পারে। সেই দিক থেকে অধিকাংশ লেখকের লেখালেখির সূচনাটা কবিতা দিয়েই, যার বিরাট একটা অংশ কবিতার রহস্যময়তায় আর থিতু না-থেকে গদ্যের গহীনে চলে যান।
এ প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের আরেকটি সাক্ষাকারের দীর্ঘ বয়ন উল্লেখ করছি—
‘‘আমাদের সবার ভেতরে কবিতাটা আছে। জাতিগতভাবেই আমাদের চেতনায় কবিতা আছে বলে আমি মনে করি। মিছিল, দেয়াল লিখন, ইত্যাদির শ্লোগানগুলো দেখলেও কবিতার ব্যাপারটি দেখা যায়। যেমন— অমুক ভাইয়ের চরিত্র/ফুলের মতো পবিত্র, সারা বাংলার ধানের শীষে/শহীদ জিয়া আছে মিশে, লা ইলাহা ইল্লালাহ/ নৌকার মালিক তুই আল্লাহ। এই কবিতার ব্যাপারটি আমাদের অন্তরের অন্তস্থলের একটা ব্যাপার বলে আমি মনে করি। এটা অন্তর্গত ব্যাপার। যার কারণে লেখালেখির শুরুটা আমরা কবিতার মাধ্যমেই করি। কবিতা ধরেই এগিয়ে যেতে চাই, কিন্তু পারি না। তারপর গদ্যে চলে আসি। গদ্যে এসে দেখি সেটা আরো কঠিন। একটা ব্যাপার, আমাদের বাংলা ভাষার আদি সাহিত্য হচ্ছে কবিতা। কবিতা দিয়েই আমাদের সাহিত্যের সূচনা। সেই চর্যাপদ থেকে শুরু, গদ্য ব্যাপারটা তো অনেক পরে এসেছে।’
– (বিপুল হাসান ও মোমিন রহমান গৃহীত সাক্ষাৎকার, অন্যদিন, নভেম্বর ২০০১)
আমাদের অনেক কবি, কথাকারের মতো হুমায়ূন আহমেদও কবিতা দিয়েই তার সাহিত্য চর্চা শুরু করেছিলেন। আমাদের বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে সুনীল, সৈয়দ হক সবাই কথাসাহিত্যের পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন। কোন এক রহস্যময় কারণে হুমায়ূন সে পথে যাননি। অথচ আমরা তার স্মৃতিকথা থেকেই জানি তার জীবনের প্রথম লেখাটি কবিতা। ছোটবোন সেফুর নামে ইত্তেফাকের নারীদের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছিলো তার কবিতা। সেটিই প্রকাশনার বিবেচনায় তার প্রথম ও শেষ কবিতা। পরবর্তীতে তিনি আর সরাসরি কবিতা লেখেননি। তার সেই কবিতা ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছিল।
‘দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস ওড়াই৷’
মাত্র দুই লাইনের এই কবিতাতেও হুমায়ূন আহমেদ যে কবি তা স্পষ্টতই বোঝা যায়। এমনকি কখনোবা তার গদ্যভঙ্গিতেও আমরা কবিতার আভাস স্পষ্টতই পাই। বলছি না যে, হুমায়ূন আহমেদ একজন কবি, কারণ সেটুকু বলার মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত হাতে নেই। কিন্তু এটা তো বলাই যায়, হুমায়ূন আহমেদের রচনায় কবিত্বের শক্তি প্রায়শই প্রকাশিত। গদ্যকার হুমায়ূন চাইলেই একজন কবি হিসেবে নিজেকে বিকশিত করতে পারতেন। সাহিত্যের নানা মাধ্যমে তো তিনি কাজ করেছেনই, শিল্পকলার নানা মাধ্যমেও কাজ করেছেন তিনি অকাতরে, অবলীলায়। টিভি নাটক, বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র নির্মাণের মতো যৌগিক শিল্পকলায় কাজ করেছেন তিনি, গীতিকার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন এবং জীবনের শেষ পর্যায়ে চিত্রকর হুমায়ূন আহমেদকেও আমরা পাই। ধারণা করা কঠিন নয় যে, চাইলেই তিনি ‘কবি হুমায়ূন’ হয়ে উঠতে পারতেন।
আমি বরং পাঠকের সুবিধার জন্য সরাসরি তার একটি গদ্য রচনা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি সংযুক্ত করি। ‘আমার ছেলেবেলা’ গ্রন্থে তিনি গভীর রাতে মশারিতে জোৎস্নার ফুল দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা লিখেছিলেন—
‘আমি হাত বাড়াতেই সেই আলোর ফুল উঠে এল
কিন্তু ধরা পড়ল না।
বাকি রাতটা আমার নির্ঘুম কাটল।
কতবার সেই ফুল ধরতে চেষ্টা করলাম—
পারলাম না।
সৌন্দর্যকে ধরতে না-পারার বেদনায়
কাটল আমার শৈশব,
কৌশোর ও যৌবন।
আমি জানি সম্ভব না,
তবু এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি
যদি একবার জোছনার ফুল ধরতে পারি—
মাত্র একবার।
এই পৃথিবীর কাছে
আমার এর চেয়ে বেশি কিছু চাইবার নেই।’
(হুমায়ূন আহমেদ, আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই, আমার ছেলেবেলা, শেষ পর্বে শঙ্খনদী, পৃষ্ঠা ৮৬)
উল্লেখ করা দরকার, এই উদ্ধৃতাংশটুকু বইতে টানা গদ্যে লেখা। কিন্তু এর কবিত্ব শক্তিকে প্রকট করে প্রকাশিত করতেই আমি ইচ্ছা করেই এর লাইন বিভাজন করেছি। কবিতার পংক্তির মতো করে লাইনগুলো আমি নিজের মতো সাজিয়েছি। প্রিয় পাঠক, দেখুন, এতে করে গদ্যের মধ্যেও কবিতার একটা আবহ পাওয়া যায় কিনা!
জীবনভর জোছনার ফুল ধরার প্রয়াসের কিছু নমুনা আমরা তার সাহিত্যে পাই। জ্যোৎস্না নানারূপে বারবার ফিরে আসে তার রচনায়। তার অসংখ্য গল্প-উপন্যাসে জ্যোৎস্না এসেছে নানা রূপ-মাধুর্য আর প্রতীক, সংকেতে। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের জ্যোৎস্নাপ্রীতির কথা সকল পাঠকই জানেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের কাব্যপ্রীতির কথা ক’জন জানেন! আমরা কি লক্ষ্য করেছি যে তার অসংখ্য বইয়ের শুরুতেই বিভিন্ন সময় বিখ্যাত সব কবিতার উদ্ধৃতি আছে, তার বহু বইয়ের নামকরণেই কাব্য প্রীতি আছে!
এইসবার আসি আসল তথ্যে। হুমায়ূন আহমেদের জীবিতকালেই তার একটি কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়েছিলো। ১৯৯৬ সালে কাকলী প্রকাশনী থেকে তার কবিতা সংকলন ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের শিরোনাম কবিতাটি পাঠ করা যাক—
‘প্রতি পূর্ণিমার মধ্যরাতে একবার আকাশের দিকে তাকাই
গৃহত্যাগী হবার মত জ্যোৎস্না কি উঠেছে ?
বালিকা ভুলানো জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্নায় বালিকারা ছাদের রেলিং ধরে ছোটাছুটি করতে করতে বলবে—
ও মাগো, কি সুন্দর চাঁদ !
নবদম্পতির জ্যোৎস্নাও নয়।
যে জ্যোৎস্না দেখে স্বামী গায় স্বরে স্ত্রীকে বলবেন—
দেখ দেখ নীতু চাঁদটা তোমার মুখের মতই সুন্দর !
কাজলা দিদির স্যাঁতস্যাতে জ্যোৎস্না নয়।
যে জ্যোৎস্না বাসি স্মৃতিপূর্ণ ডাস্টবিন উল্টে দেয় আকাশে।
কবির জ্যোৎস্না নয়। যে জ্যোৎস্না দেখে কবি বলবেন—
কি আশ্চর্য রূপার থালার মত চাঁদ !
আমি সিদ্ধার্থের মত গৃহত্যাগী জ্যোৎস্নার জন্য বসে আছি।
যে জ্যোৎস্না দেখামাত্র গৃহের সমস্ত দরজা খুলে যাবে—
ঘরের ভেতরে ঢুকে পরবে বিস্তৃত প্রান্তর।
প্রান্তর হাঁটব, হাঁটব আর হাঁটব—
পূর্নিমার চাঁদ স্থির হয়ে থাকবে মধ্য আকাশে।
চারদিক থেকে বিবিধ কন্ঠ ডাকবে- আয় আয় আয়।’
সে সময় কবিতা প্রকাশের একটা নতুন ভঙ্গি লক্ষ্য করা গিয়েছিলো। আর্টকার্ডে অনেকটা ভিউকার্ডের ভঙ্গিতে একটা ছোট্ট খামের মধ্যে ছাপা ১০-১২টি করে কবিতা। যতদূর মনে পড়ে বিভিন্ন কবির প্রেমের কবিতা, হেলাল হাফিজের কবিতা, আফজাল হোসেনের কবিতাও এভাবে ছাপা হয়েছিলো। সমর মজুমদার চিত্রায়িত বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘কবিতা-কার্ড’ প্রকাশনা সেই জোয়ারেরই ফসল। তবে বলে রাখা ভালো, এ সংকলনের জন্য হুমায়ূন আহমেদ আলাদা করে কবিতাগুলো লেখেননি। এখানে যে নয়টি কবিতা ছাপা হয়েছিলো তার সব কটিই ‘কবি’ উপন্যাস থেকে নেয়া। পার্থক্য হলো কবি উপন্যাসে এগুলোর শিরোনাম নেই। আলাদা করে কবিতা কার্ডের শিরোনামগুলো হলো, ‘অশ্রু’, ‘কাচপোকা’, ‘কব্বর’, ‘গৃহত্যাগী জোছনা’, ‘তিনি’, ‘বাবার চিঠি’, ‘সংসার’, ‘বাসর’ ও ‘রাশান রোলেট’। ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কবিতাটা দিয়েই ‘কবি’ উপন্যাসের সূচনা হয়েছে।
এ কথা সত্য, তিনি আলাদা করে কবিতা লেখেননি। গল্প, উপন্যাস, নাটক, রম্য রচনা, ভ্রমণ কাহিনি, কল্পবিজ্ঞান, ভৌতিক গল্প, শিশুতোষ মিসির আলি এবং হিমু উপাখ্যান— এক জীবনে সাহিত্যের কতো শাখাতেই হাত দিলেন হুমায়ূন। সাহিত্যের বাইরে নাটক নির্মাণ, চলচ্চিত্র নির্মাণ ইত্যাদিতেও মনোনিবেশ করেছিলেন গভীরভাবেই। যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সাফল্যের সোনার হরিণ তার করতলগত আমলকি হয়েছে। অথচ বিস্ময়কর যে তিনি কবিতা লেখেননি। পাঠক হিসাবে মনে প্রশ্ন জাগে, এতো এতো পাঠক, ভক্ত আর প্রকাশক তার— কারো কি মনে হয়নি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ একজন ছদ্মবেশি কবি। খুবই সম্ভব ছিলো তার হাত দিয়ে কবিতা লেখা।
এ প্রসঙ্গে হুমায়ূনের গদ্য থেকেই আরেকটু উদাহরণ দিতে চাই। যথাবিহিত উদ্ধৃতি হুবুহু দিচ্ছি, তবে লাইনগুলো একটু বিন্যস্ত করে নিচ্ছি—
‘এই ক্ষুদ্র জীবনে আমি বারবার দুঃখ পেয়েছি।
বারবার হৃদয় হা-হা করে উঠেছে।
চারপাশের মানুষদের নিষ্ঠুরতা,
হৃদয়হীনতায় আহত হয়ে
কতবার মনে হয়েছে—
এই পৃথিবী বড়ই বিষাদময়!
আমি এই পৃথিবী ছেড়ে
অন্য কোন পৃথিবীতে যেতে চাই,
যে পৃথিবীতে মানুষ নেই।
চারপাশে পত্রপুষ্প শোভিত বৃক্ষরাজি।
আকাশে চির পূর্ণিমার চাঁদ।
যে চাঁদের ছায়া পড়েছে মূয়রাক্ষী নামের এক নদীতে।
সেই নদীর স্বচ্ছ জলে সারাক্ষণ খেলা করে জোছনার ফুল।
দূরের বন থেকে ভেসে আসে অপার্থিব সংগীত।’
পাঠক, ‘আমার ছেলেবেলা’ নামের স্মৃতিচারণ গ্রন্থের এই অংশটুকুর মতোই অনেক জায়গায়ই হুমায়ূন দারুণ কাব্যময়। আমি আজও বিস্মিত হবো না হঠাৎ যদি কোথাও থেকে হুমায়ূন আহমেদের অপ্রকাশিত একগুচ্ছ কবিতা আবিষ্কার হয়ে যায়। যেমন জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর বিস্ময়কর আর বিশাল এক গদ্য ভাণ্ডার আবিষ্কৃত হলো। আমার মনে গোপন আশা হুমায়ূন আহমেদের কোন গোপন কুঠুরি থেকে তেমনি বেরিয়ে আসবে বিশাল কাব্য ভাণ্ডার।
প্রায়শই মনে হতো, কবিতার দিকে হুমায়ূন আহমেদ অনেক বেশি আকৃষ্ট। তার লেখা গানের মধ্যেও আমরা কবিতা পাই। তার বহু বইতে দেশি-বিদেশি অসংখ্য ভালো কবিতার উদ্ধৃতি পাই। বইয়ের নামকরণেও তিনি কবিতার হাত ধরেছেন বারবার। তার পঠন তালিকার একটা বরং অংশও কবিতাই।
বলা হয়, সাহিত্য চর্চার শুরুটাই কবিতা দিয়ে হয়। কবিতা আদতে ভাষার শুদ্ধতম মাধ্যম হলেও এবং সবচেয়ে পরিণত লেখনি ধরন হলেও কবিতা দিয়েই কম-বেশি সবার সাহিত্যচর্চার সূচনা কবিতা হয়ে থাকে। আমাদের জনপ্রিয়তম, বহুমাত্রিক কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। শৈশবে হুমায়ূন আহমেদ কবিতা লিখেছেন। তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘God’। কবিতাটির নিচে লেখা ছিলো Humayun Ahmed Class X Section B. কবিতাটি ছিলো :
“Let the earth move
Let the sun shine
Let them to prove
All are in a line.“
(হুমায়ূন আহমেদ : আমি, (ভূমিকাংশ), অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১১)
এই কবিতা move, prove আর shine, line এর অন্তমিল দশম শ্রেণির বালকের জন্যে ঠিকই আছে। তবে এ কবিতাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। হুমায়ূন যে সচেতনভাবে খুব উৎসাহে ইংরেজি কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন তাও নয়। আসলে স্কুল ম্যাগাজিনে বাংলা কবিতা প্রচুর পাওয়া গিয়েছিলো, ইংরেজি কবিতা ছিলো না— তাই শিক্ষকের নির্দেশ মতোই হুমায়ূনের এ কবিতা লেখার প্রয়াস। তারপরও চাঁদের ঘুর্ণন আর সূর্যের আলো দান এবং নির্দিষ্ট কক্ষে চাঁদ সূর্যের ঘুর্ণনের মধ্যে ঈশ্বরের লীলা দেখতে পাওয়ার মতো গভীর বিষয়ের সরল প্রকাশ এখানে আছে।
বলা দরকার, কবিতাবান্ধব এক পরিবেশে বড় হয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ। তার লেখালেখির সবচেয়ে বড় প্রেরণা তাঁর বাবা। আত্মজীবনীমূলক লেখাগুলোতে বারবার তাঁর বাবার কাব্যপ্রীতির কথা আমরা পাই। ‘আমার ছেলেবেলা’তে পাই—
‘জন্মদিন এসে গেল। গান, কবিতা আবৃত্তির পালা শেষ হবার পর আমার হাতে উপহারের প্যাকেট তুলে দেয়া হল। প্যাকেট খুলে দেখি একটা বাঁধানো ফ্রেমে দীর্ঘ একটি কবিতা। বাবা ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে একটি কবিতা লিখে ফ্রেমে বাঁধিয়ে নিয়ে এসেছেন। কবিতার প্রথম দু’টি চরণ—
সাতটি বছর গেল পরপর আজিকে পরেছো আটে,
তব জন্মদিন নয়ত মলিন ভয়াল বিশ্ব হাটে …
বাবা খুবই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে, উপহার পছন্দ হয়েছে? অনেক কষ্টে কান্না চাপা দিয়ে বললাম, হ্যাঁ।
তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে পছন্দ হয় নাই।
আমি চুপ করে রইলাম।
বাবা খানিকক্ষণ শান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, এই উপহার এখন তোর কাছে সামান্য মনে হচ্ছে। এমন একদিন আসবে যখন আর সামান্য মনে হবে না।
বাবা কবি ছিলেন না। হৃদয়ের তীব্র আবেগ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে তিনি কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁর অতি আদরের ছোটবোনের মৃত্যুর খবর পাবার পর তিনি কাঁদতে কাঁদতে কবিতা লিখতে বসেছেন। চোখের জলে লেখা সেই দীর্ঘ কবিতা হয়ত শুদ্ধতম কবিতা হয়নি। কিন্তু যে আবেগের তাড়নায় কলম হাতে নিয়েছিলেন সেই আবেগে কোন খাদ ছিল না। বাবার কাছ থেকে প্রথম শিখলাম, মনের তীব্র ব্যথা কমানোর একটি উপায় হচ্ছে কিছু লেখা। যে লেখা ব্যক্তিগত দুঃখকে ছড়িয়ে দেয় চারদিকে।
বাবা হচ্ছেন আমার দেখা প্রথম কবি।’
স্বাভাবিক কারণেই আট বছরের শিশুর জন্মদিনে হাতে লেখা কবিতা উপহার হিসাবে ভাল লাগবে না। কিন্তু যথা সময়ে সে উপহার অসামান্য হয়ে উঠবেই। হুমায়ূনের বাবা কবিতার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন সচেতনভাবেই। তিনি সন্তানদের মধ্যে কবিতাবোধ জাগানোর চেষ্টায় সদাই সচেতন ছিলেন। ‘আমার ছেলেবেলা’তেই পাই—
‘দিনের পর দিন কাঁটতো, তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হত না। এই কারণে মনে মনে চাইতাম তাঁর যেন কোন-একটা অসুখ হয়। বাবার অসুখ খুবই মজার ব্যাপার।। অসুখ হলে তিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের চারপাশে বসিয়ে উঁচুগলায় কবিতা আবৃত্তি করতেন। এতে নাকি তাঁর অসুখের আরাম হত।
এই অসুখের সময়ই তিনি একবার ঘোষণা করলেন, সঞ্চয়িতা থেকে যে একটা কবিতা মুখস্থ করে তাঁকে শোনাতে পারবে সে এক আনা পয়সা পাবে। দুটো মুখস্থ করলে দু’আনা।
আমি বিপুল উৎসাহে কবিতা মুখস্থ করতে শুরু করলাম। এর মধ্যে কোন কাব্যপ্রীতি কাজ করেনি। আর্থিক ব্যাপারটাই ছিল একমাত্র প্রেরণা। যথাসময়ে একটি কবিতা মুখস্থ হয়ে গেল। নাম ‘এবার ফেরাও মোরে’। দীর্ঘ কবিতা। এই দীর্ঘ কবিতাটা মুখস্থ করার পেছনের কারণ হল, এটা বাবার খুব প্রিয় কবিতা। তাঁদের সময় না-কি বি.এ ক্লাসে পাঠ্য ছিল।
বাবা আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলেন।
কোন ভুল না করে এই দীর্ঘ কবিতাটি বলতে পারায় তিনি আনন্দে অভিভূত হলেন। এক আনার বদলে চার আনা পেয়ে গেলাম। সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড থেকে ওটাই ছিল আমার প্রথম রোজগার।’
কবিতা রোগ নিরাময়ের হাতিয়ার এই ধারণাটা একজন লেখক ছোটবেলায় বাবার কাছেই পেয়ে গেলেন। ‘সাহিত্যবিষয়ক কর্মকাণ্ড’ করে হুমায়ূন সারা জীবনে অনেক রোজগার করেছেন। কিন্তু কবিতার এই আয় সত্যিই প্রেরণাদায়ক।
‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কাব্যসংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে, তার আগেই সে বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাস। একই শিরোনামে বাংলাসাহিত্যের আরেক দিকপাল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস আছে, যা ভীষণ জনপ্রিয়। তারাশঙ্করের ‘কবি’ উপন্যাসের তুলনায় হুমায়ূনের ‘কবি’ উপন্যাস আকারে প্রকারে বৃহৎ। তারাশঙ্করের উপন্যাসে চোর নিতাই সহসা কবি হয়ে ওঠে। আর হুমায়ূনের কবি উপন্যাসে একজন নয়, তিনজন কবির কথা বলা হয়েছে।
এই উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র আতাহার, তার বিত্তবান বন্ধু সাজ্জাদ এবং বোহেমিয়ান বন্ধু মজিদ— তিনজনই কবি। কবিতাই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। তুলনায় মজিদ ও সাজ্জাদের চেয়ে আতাহারের পড়ালেখা এবং পাগলামি দুটোই কম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মজিদ আটকা পড়ে ভালোবাসায়। জাহেদা নামের এক গ্রাম্য কিশোরীর প্রেমে পড়ে সে। বন্ধুদের চিঠি লিখে বিয়ের সংবাদ দেয় কিন্তু আসতে মানা করে। সে জানে একটি প্রিয় জিনিস পেতে হলে আরেকটি প্রিয় জিনিস ছাড়তে হবে। তাই সে কবিতাকে ছেড়ে দেয় জাহেদার জন্য। অন্যদিকে সাজ্জাদ জীবনকে নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করে। সে এমনকি ভয়াবহ নেশায় আক্রান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে মানসিক চিকিৎসা নিতে হয়। শৈশবে তাদেরকে ফেলে অন্য পুরুষের সঙ্গে মার চলে যাওয়া সে মেনে নিতে পারে না। এমনকি খুব শৈশবেই সে খুনের চেষ্টাও করে। সাজ্জাদের ছোটবোন নিতু আজাহারকে ভালবাসে। আজাহার ও নিতু আপাতভাবে মনে মনে পরস্পরকে ভীষণ অপছন্দ করে। সবকিছুর পর তিন কবির মধ্যে আতাহারই কবিতার পথে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমেরিকার অভিবাসী হওয়ার সুযোগও সে গ্রহণ করে না। এমনকি ভয়াবহ অসুস্থ আতাহার মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েও করোটিতে কবিতা অনুভব করে।
‘কবি’ উপন্যাসের শুরুতে হুমায়ূন প্রারম্ভিকে লিখছেন, ‘কবি উপন্যাসে কিছু কবিতা ব্যবহার করতে হয়েছে। অতি বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি কবিতাগুলি আমার লেখা। পাঠক পাঠিকারা আমার দুর্বল গদ্যের সঙ্গে পরিচিত। সেই গদ্য তাঁরা ক্ষমা সুন্দর চোখে গ্রহণ করেছেন। কবিতাগুলিও করবেন—এই অসম্ভব আশা নিয়ে বসে আছি। ক্ষমা পেয়ে পেয়ে আমার অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে।’ প্রিয় পাঠক, আসুন পড়ে দেখি, বিনয়ি কবির লেখা কবিতা—
একটা ঝকঝকে রঙিন কাচপোকা
হাঁটতে হাঁটতে এক ঝলক রোদের মধ্যে পড়ে গেল।
ঝিকমিকিয়ে উঠল তার নকশাকাটা লাল নীল সবুজ শরীর।
বিরক্ত হয়ে বলল, রোদ কেন?
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার
আমার ষোলটা পায়ে একটা ভারি শরীর বয়ে নিয়ে যাচ্ছি—
অন্ধকার দেখব বলে।
আমি চাই অন্ধকার। চির অন্ধকার
একটা সময়ে এসে রোদ নিভে গেল
বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল আঁধার।
কি গাঢ়, পিচ্ছিল থকথকে অন্ধকার !
কাচপোকার ষোলটা ক্লান্ত পা বার বার
সেই পিচ্ছিল আঠালো অন্ধকারে ডেবে যাচ্ছিল।
তার খুব কষ্ট হচ্ছিল হাঁটতে
তবু সে হাঁটছে—
তাকে যেতে হবে আরও গভীর অন্ধকারে।
যে অন্ধকার- আলোর জন্মদাত্রী।
(কাচপোকা)
অন্ধকার পিয়াসী এই কবিতা সেই অন্ধকারের উৎস সন্ধান করে যে অন্ধকারে আলোর জন্ম। এ যেন অন্য কোনো কৃষ্ণগহ্বরের দিকে যাত্রার কথা বলা হচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের বাংলা সাহিত্যে কল্পবিজ্ঞান কাহিনীকেও সাহিত্য মানে নিয়ে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ একাই। কাজেই ‘যে অন্ধকার- আলোর জন্মদাত্রী’ সেই কৃষ্ণগহ্বরের আঁধারকে তিনি ভালো করেই চিনতেন। অন্যদিকে কবিতা হিসাবে দেখলে ‘বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল অন্ধকার’ যেন জীবনানন্দকেই মনে করিয়ে দেয়।
তবে লক্ষ্যণীয় হুমায়ূন ‘বাদুড়ের ডানায় ভর করে নামল অন্ধকার’ না লিখে, লিখেছেন, ‘বাদুড়ে ডানায় ভর করে নামল অন্ধকার’। এখানে ‘বাদুড়ে ডানা’ একটা আলাদা বিশেষণের মর্যাদা পেয়ে যায়। ‘ সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন/ সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল’ জীবনান্দীয় এই উপমার কাছাকাছি থেকেও আলাদা। কেননা বাদুড়ের ডানার অশুভ ছায়ায় সন্ধ্যা নামা আর চিলের ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে দেওয়া শিশিরের মতো নিরব সন্ধ্যা আলাদা চিত্রকল্পই তৈরি করে।
কিন্তু জীবনান্দপ্রেমী হলেও সচেতনভাবেই হুমায়ূন কবিতা রচনায় সে বলয় থেকে বেরিয়ে আসেন। ‘কবি’ উপন্যাস এবং পরবর্তীতে ‘গৃহত্যাগী জোছনা’ কবিতা-কার্ডের আরেকটি কবিতা লক্ষ্য করা যাক—
‘শোন মিলি।
দুঃখ তার বিষমাখা তীরে তোকে
বিঁধে বারংবার।
তবুও নিশ্চিত জানি,একদিন হবে তোর
সোনার সংসার।।
উঠোনে পড়বে এসে এক ফালি রোদ
তার পাশে শিশু গুটিকয়
তাহাদের ধুলোমাখা হাতে – ধরা দেবে
পৃথিবীর সকল বিস্ময়।
(সংসার)
জীবনানন্দ দাশ যখন ‘রক্তের অন্তর্গত বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়ে কথা বলেন তখন হুমায়ূন আহমেদ কথা বলেন উঠোনে নামা এক ফালি রোদে আর শিশুর ধুলিমাখা হাতে পৃথিবীর সব বিস্ময় তুলে ধরেন। জীবনান্দনীয় বিস্ময়ের জটিলতা নয়, বরং এই কবিতায় হুমায়ূন শিশুর চোখ দিয়ে বরং ‘বিপুলা পৃথিবী’র সরল বিস্ময়কে ধরেন। এই বিস্ময়ে বেদনা নাই, আনন্দ আছে। খুব আটপৌরে সাংসারিক জীবনের আনন্দময় বিস্ময় আছে বলেই তিনি এই কবিতার গঠনটিও সরল করে তোলেন। বারংবার, সংসার, গুটিকয়, বিস্ময় ইত্যকার অন্তমিলের মধ্যেও একটা সাংসারিক আটপৌরে ভাব আছে কবিতাটিতে।
এটা নিশ্চিত, হুমায়ূন আহমেদ কবিতার গঠন কাঠামো, শব্দ ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে ভাবতেন। তার সেই সচেতনার প্রমাণও পাওয়া যায় ‘কবি’ উপন্যাসে। উইলিয়াম ব্ল্যাকের ‘দ্য মেন্টাল ট্রাভেলার’ কবিতাটি অনুবাদ করার চেষ্টা করে আতাহার।
“I traveled thro’ a Land of men,
A Land of Men and Women too,
And heard and saw such dreadful things
As cold Earth wanderers never knew…’’
আতাহারের এই কবিতা অনুবাদ ভাবনা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে হুমায়ূন আহমেদের কাব্যচিন্তারও প্রকাশ ঘটে। ‘কি রকম হতে পারে এর বঙ্গানুবাদ, আতাহার চোখ বন্ধ করে ফেলল— গদ্য হলে আক্ষরিক অনুবাদের প্রশ্ন উঠতো, যেহেতু কবিতা— মূলের কাছাকাছি থাকতে পারলেই যথেষ্ট। ভাবটা ধরা নিয়ে কথা।
মানবের মাঝে আমি পথ হাঁটিতেছি
সেই পথে মানবীও ছিল।
শুনিয়াছি দেখিয়াছি যাহা…
হচ্ছে না। জীবনানন্দ টাইপ হয়ে যাচ্ছে ‘‘পথ হাঁটিতেছি” “মানব-মানবী” এইসব জীবনানন্দ ব্যবহার করে করে লেবু কচলে শুধু তিতা না বিষ বানিয়ে ফেলেছেন— নতুন কিছু করতে হবে। জীবনানন্দের কেঁথা পুড়ি। বার্ন দ্যা ব্লাঙ্কেট অব জীবনানন্দ। কবিতা হবে আতাহারানন্দের মত।
‘‘প্রান্তরের পথে ছিল মানব ও মানবী।’’
উঁহু, হচ্ছে না। মূল কবিতায় পর্যটকের ক্লান্তি টের পাওয়া যায়। কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়— কবি ক্লান্ত— সেই ক্লান্তি অনুবাদে উঠে আসতে হবে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই জিনিস ঠিক করা যাবে না। পথে পথে হাঁটতে হবে। কবির ক্লান্তি নিজের মধ্যে অনুভব করতে হবে।’’
ব্ল্যাকের এই কবিতা অনুবাদ ভাবনার প্রসঙ্গে আতাহারের মাধ্যমে হুমায়ূন একদিকে যেমন কবিতা অনুবাদের মূলের প্রতি বিশ্বস্ততা জায়গাটি তুলে ধরেন, অন্যদিকে বাংলার কবিদের মধ্যে জীবনানন্দ’র অমোঘ প্রভাব কাটিয়ে ওঠার প্রণোদনাটিও তুলে ধরেন। তুলনায় এই বইয়ের অন্য একটি কবিতার কথা বলি, যেটিকে অনেক বেশি হুমায়ূন আহমেদের নিজস্ব কবিতা মনে হয়—
টেবিলের চারপাশে আমরা ছ’জন
চারজন চারদিকে ; দু’জন কোনাকুনি
দাবার বোড়ের মত
খেলা শুরু হলেই একজন আরেকজনকে খেয়ে ফেলতে উদ্যত ।
আমরা চারজন শান্ত, শুধু দু’জন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছে ।
তাদের স্নায়ু টানটান।
বেড়ালের নখের মত তাদের হৃদয় থেকে
বেরিয়ে আসবে তীক্ষ্ম নখ ।
খেলা শুরু হতে দেরি হচ্ছে,
আম্পায়ার এখনো আসেনি।
খেলার সরঞ্জাম একটা ধবধবে সাদা পাতা
আর একটা কলম ।
কলমটা মিউজিক্যাল পিলো হাতে হাতে ঘুরবে
আমরা চারজন চারটা পদ লিখবো ।
শুধু যে দু’জন নখ বের করে কোনাকুনি বসে আছে
তারা কিছু লিখবে না ।
তারা তাদের নখ ধারালো করবে
লেখার মত সময় তাদের কোথায়?
প্রথম কলম পেয়েছি আমি,
আম্পায়ার এসে গেছেন।
পিস্তল আকাশের দিকে তাক করে তিনি বললেন,
এ এক ভয়ংকর খেলা,
কবিতার রাশান রোলেট—
যিনি সবচে ভালো পদ লিখবেন
তাকে তৎক্ষণাৎ মেরে ফেলা হবে ।
আমার হাতে কলম কম্পমান
সবচে সুন্দর পদ এসে গেছে আমার মুঠোয়।
(রাশান রোলেট)
এই কবিতায় কবি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে গল্পকার, চিত্রনাট্যকার কিংবা ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ মিলিত হয়েছেন। ছোট্ট এই কবিতায় সাতটি চরিত্র আছে, একটা দৃশ্য বর্ণনা আছে, গল্পের মোচড় আছে, উত্তেজনা আছে, নাটকীয়তাও আছে। আবার শব্দ ব্যবহারের খেলাও এখানে আছে। সাম্প্রতিক কবিতায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের প্রবণতাও এখানে আছে। আম্পায়ার, মিউজিক্যাল পিলো, পিস্তল, রাশান রোলেট ইত্যকার শব্দ ব্যবহার কবিতার শরীরে অন্য রকম একটা পোশাক পরিয়ে দিয়েছে। শেষ লাইন ‘সবচে সুন্দর পদ এসে গেছে আমার মুঠোয়’ টানটান উত্তেজনার সৃষ্টি করে। অন্যদিকে, ‘বেড়ালের নখের মত তাদের হৃদয় থেকে/ বেরিয়ে আসবে তীক্ষ্ম নখ’— এই লাইনের উপমা লক্ষণীয়। ‘শুধু যে দু’জন নখ বের করে কোনাকুনি বসে আছে/ তারা কিছু লিখবে না।/ তারা তাদের নখ ধারালো করবে/ লেখার মত সময় তাদের কোথায়?’ এই পংক্তির মধ্যে আধুনিককালের বাংলার কবিদের কলহের ইঙ্গিতও হয়তো আছে।
তিনি শুধু আতাহারের হাত দিয়ে কবিতাই লেখাননি, কবিতা তৈরির প্রক্রিয়াটিও তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাস সাধারণ পাঠককে কবি ও কবিতার অন্দরমহলের কিছুটা খোঁজ হলেও দেবে। সেই সঙ্গে কবিতার ছন্দ, জীবনানন্দ এবং কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে টুকটাক কথা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
কবিতার মধ্যে নাটকীয়তা, গল্প খোঁজার প্রবণতা, চরিত্র নির্মাণের চেষ্টা এই গ্রন্থের একাধিক কবিতাতেই আমরা পাই। বৃদ্ধ বাবার চিঠি নিয়ে যাওয়ার সময় আতাহারের মনে যে গল্প তৈরি হয়, তারই প্রকাশভঙ্গি ঘটে কবিতায়—
‘আমি যাচ্ছি নাখালপাড়ায়।
আমার বৃদ্ধ পিতা আমাকে পাঠাচ্ছেন তাঁর
প্রথম প্রেমিকার কাছে।
আমার প্যান্টের পকেটে সাদা খামে মোড়া বাবার লেখা দীর্ঘ পত্র।
খুব যত্নে খামের উপর তিনি তাঁর প্রণণয়িণীর নাম লিখেছেন।
কে জানে চিঠিতে কী লেখা— ?
তাঁর শরীরের সাম্প্রতিক অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা ?
রাতে ঘুম হচ্ছে না, রক্তে সুগার বেড়ে গেছে
কষ্ট পাচ্ছেন হাঁপানিতে— এইসব হাবিজাবি। প্রেমিকার কাছে
লেখা চিঠি বয়সের ভারে প্রসঙ্গ পাল্টায়
অন্য রকম হয়ে যায়।
সেখানে জোছনার কথা থাকে না,
সাম্প্রতিক শ্বাসকষ্ট বড় হয়ে উঠে।
প্রেমিকাও একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর
রোগভুগের কথা পড়তে ভালবাসেন।
চিঠি পড়তে পড়তে দরদে গলিত হন—
আহা, বেচারা ইদানিং বড্ড কষ্ট পাচ্ছে তো …
(বাবার চিঠি)
এই কবিতাতেও সাম্প্রতিক, প্রণয়িণী, রোগভুগ, দরদ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার লক্ষণীয়। সাম্প্রতিক আর প্রণয়িনী, রোগভুগ আর দরদ যেন এই কবিতায় ভিন্ন রকমের বৈপরীত্য সৃষ্টি করে দেয়।
একজন পঙ্গু ও বৃদ্ধকে দেখে আতাহারের লেখা কবিতাটিও উল্লেখ্যযোগ্য মনে করি—
‘‘এক জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ছিলেন নিজ মনে
আপন ভুবনে।
জরার কারণে তিনি পুরোপুরি বৃক্ষ এক।
বাতাসে বৃক্ষের পাতা কাঁপে
তাঁর কাঁপে হাতের আঙ্গুল।
বৃদ্ধের সহযাত্রী জবুথবু-
পা নেই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে।
সেই স্মৃতি ঢাকা থাকে খয়েরি চাদরে।
জরাগ্রস্থ বৃদ্ধ ভাবে চাদরের রঙটা নীল হলে ভাল ছিল।
স্মৃতির রং সব সময় নীল।’’
‘‘পা নেই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে’’— এই লাইনের মধ্যে পরাবাস্তবতা আছে আবার অন্যদিকে এখানে গভীর সত্যও আছে। আধুনিক মেডিক্যাল সায়েন্সে ‘গোস্ট পেইন’ বলে একটি ব্যাপার থাকে। এই ব্যথা সম্পূর্ণই মানসিক। একজন রোগীর পা কেটে ফেলা হয়েছে কিন্তু তার মগজে সেই কাটা পায়ের বেদনা অনুভব হবে। এই গোস্ট পেইন সম্পর্কে জানতেন বলেই হুমায়ূন আহমেদ ‘পা নেই, শুধু পায়ের স্মৃতি পড়ে আছে’র মতো লাইন লিখতে পেরেছেন।
আমার মতে ‘কবি’ গ্রন্থের অসাধারণ একটি কবিতা ‘বাসর’। আগে কবিতাটি পড়া যাক—
“কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে তার সঙ্গে দেখা ।
লোহার তৈরি ছোট্ট একটা ঘর ।
বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোন যোগ নেই ।
ঘরটা শুধু উঠছে আর নামছে ।
নামছে আর উঠছে ।
মানুষ ক্লান্ত হয়—
এ ঘরের কোন ক্লান্তি নেই।
এ রকম একটা ঘরেই বোধহয় বেহুলার বাসর হয়েছিল ।
নিশ্ছিদ্র লোহার একটা ঘর ।
কোন সাপ সেখানে ঢুকতে পারবে না ।
হিস হিস করে বলতে পারবে না, পাপ করো। পৃথিবীর সব আনন্দ পাপে ।
পুণ্য আনন্দহীন । উল্লাসহীন ।
পুণ্য করবে আকাশের ফিরিশতারা ।
কারণ পুণ্য করার জন্যেই তাদের তৈরি করা হয়েছে ।
লোহার সেই ঘরে ঢোকার জন্য সাপটা পথ খুঁজছিলো ।
সেই ফাঁকে বেহুলা তাঁর স্বামীকে বললেন, কি হয়েছে, তুমি ঘামছ কেন ?
আর তখন একটা সুতা সাপ ঢুকে গেলো।
ফিসফিস করে কোন একটা পরামর্শ দিতে গেলো ।
বেহুলা সেই পরামর্শ শুনলেন না বলেই কি লখিন্দরকে মরতে হল ?
তার সঙ্গে আমার দেখা কপাটহীন একটা অস্থির ঘরে ।
ঘরটা শুধু ওঠে আর নামে।
আমি তাকে বলতে গেলাম – আচ্ছা শুনুন, আপনার কি মনে হচ্ছে না
এই ঘরটা আসলে আমাদের বাসর ঘর ?
আপনি আর কেউ নন, আপনি বেহুলা।
যেই আপনি ভালবেসে আমাকে কিছু বলতে যাবেন
ওম্নি একটা সুতা সাপ এসে আমাকে কামড়ে দেবে ।
আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। দয়া করে কিছু বলবেন না।”
(বাসর)
যারা উপন্যাসটি পড়েননি, কেবল কবিতাটি পড়ছেন, তাদের জন্যে বিস্ময়ের খবর হলো এই কবিতাটির বিষয়বস্তু লিফট। আতাহার তার বোনের ফ্লাটে ওঠার সময় লিফটে এক তরুণীর সাথে দেখা হয়, সেই তরুণী আতাহারকে দেখে চমকে যান। দুজন লিফটে একসাথে কিছুটা ওঠেন। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আতাহার কবিতাটি লেখেন। লিফটের মতো একটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে বেহুলার পুরাণের সাথে মিলিয়ে দেখার ভাবনাটা যথার্থই অভিনব। কবর নিয়েও একটি অভিনব কবিতা আমরা এ গ্রন্থে পাই—
“তিনি শায়িত ছিলেন গাঢ় কব্বরে
যার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ বেঁধে দেয়া,
গভীরতা নয়।
কব্বরে শুয়ে তাঁর হাত কাঁপে পা কাঁপে
গভীর বিস্ময়বোধ হয়।
মনে জাগে নানা সংশয়।
মৃত্যু তো এসে গেছে, শুয়ে আছে পাশে
তবু কেন কাটে না এ বেহুদা সংশয়?
(কব্বর)
একাধিক কবিতার পাশে এই বইয়ে আমরা একটি ছড়াও পাই।
‘‘আমার বন্ধুর বিয়ে
উপহার বগলে নিয়ে
আমি আর আতাহার,
মৌচাক মোড়ে এসে বাস থেকে নামলাম
দু’সেকেন্ড থামলাম।।
টিপটিপ ঝিপঝিপ
বৃষ্টি কি পড়ছে?
আকাশের অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা ঝরছে?
আমি আর আতাহার
বলুন কি করি আর?
উপহার বগলে নিয়ে আকাশের অশ্রু
সারা গায়ে মাখলাম।।
হি হি করে হাসলাম।।’’
(অশ্রু)
এই ছড়াটি পড়তে পড়তে আহসান হাবীবের বিখ্যাত ছড়াটির কথা মনে পড়ে যায়। উদ্ধৃতি দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না—
বাস থেকে নামলেন,
খানিকটা থামলেন,
তারপর থেমে থেমে চললেন তিনি।
দেখে দেখে ভাবলাম,
যেন ওর জানি নাম,
মনে হয় আমি এই লোকটাকে চিনি।
হুমায়ূন ‘কবি’ উপন্যাসে যে কবিতাগুলো নিজের লেখা বলে একটা কুণ্ঠার ভাব দেখিয়েছিলেন তাকে কেবল বিনয়ই বলা যায়। হুমায়ূনের গদ্য কেবল বিনয় করেই দূর্বল বলা যায় কবিতাকেও তাই বলা যায়। কিন্তু যথার্থ অর্থেই কবি উপন্যাসে ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি কবিতাই ভীষণ কাব্যময়। আরেকটি মজার কাজ তিনি করেছেন এই উপন্যাসে। তিনি শুধু আতাহারের হাত দিয়ে কবিতাই লেখাননি, কবিতা তৈরির প্রক্রিয়াটিও তুলে ধরেছেন। এই উপন্যাস সাধারণ পাঠককে কবি ও কবিতার অন্দরমহলের কিছুটা খোঁজ হলেও দেবে। সেই সঙ্গে কবিতার ছন্দ, জীবনানন্দ এবং কবিতার অনুবাদ প্রসঙ্গে টুকটাক কথা উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। কবি ও কবিতাপ্রেমীরা হুমায়ূন আহমেদের ‘কবি’ উপন্যাসটি পড়ে দেখতে পারেন। উপন্যাস থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে ‘কবি’ নিয়ে আলোচনা সমাপ্ত করছি।
‘সাজ্জাদ বলল, এই কবিতাটা কেমন দেখ তো—
‘আকাশে চাঁদের আলো— উঠোনে চাঁদের আলো— নীলাভ চাঁদের আলো
এমন চাঁদের আলো আজ
বাতাসে ঘুঘুর ডাক— অশ্বথে ঘুঘুর ডাক— হৃদয়ে ঘুঘুর যে ডাক
নরম ঘুঘুর ডাক আজ।
এই কবিতায় আমি একটা ভুল করেছি— ইচ্ছা করে করেছি। ভুলের জন্যে মাত্রায় গণ্ডগোল হয়ে গেছে। বল দেখি আতাহার ভুলটা কি?’’
‘কবি’ (১৯৯৬) প্রকাশের এক দশক পর হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন ‘কে কথা কয়’(২০০৬)। হুমায়ূনের সাহিত্য কর্মের মধ্যে ‘কে কথা কয়’ (২০০৬) আমার মতে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রচনা। এমন দাবী করার আগে অবশ্যই মনে রাখতে হবে হুমায়ূনের সবচেয়ে বড় দোষ বা অপবাদ ছিল তিনি জনপ্রিয়তম লেখক। আমাদের সময়ে হুমায়ূন একাই সৃষ্টির পরিমাণে ও মানে দশজনের সমান। তিনি জনপ্রিয় হওয়ায় গ্রহণযোগ্য ছিলেন। অন্যদিকে জনপ্রিয়তার কারণেই তাকে তথাকথিত মূল ধারার সাহিত্য সমালোচকরা এড়িয়ে গেছেন, তিনিও তাদেরকে কাছে ভিড়তে দেননি। বরাবরই তিনি নিজের লেখা নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতেন না। জনপ্রিয় হওয়ার অপরাধেই তাকে ক্লাসিক বা সিরিয়াস সাহিত্যিক হিসাবে গ্রহণ করা হয়নি। এই কারণেই সবচেয়ে বেশি আলগা মন্তব্য দেখা যায় হুমায়ূনের লেখার প্রতি। কেউ কেউ মুখস্ত বিদ্যার মতোই বলে, ‘তার শুরুর দিকে দুয়েকটা লেখা (নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার) ভালো, শেষের দিকে চর্বিত চর্বন। এই ধরণের মন্তব্যগুলোতে অবশ্যই রেফারেন্স থাকে না। কেউই আর লাইন ধরে, বই ধরে অসঙ্গতি বা দুর্বলতা তুলে ধরেন না। ফলে মতামতগুলো অনানুষ্ঠানিক বলেই গ্রহণ করতে পারি। যা হোক বলছিলাম, ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস নিয়ে। এর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব বিষয় বস্তু। অটিজম নিয়ে লেখা সত্যিই ভীষণ কঠিন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি এ বিষয়ে লিখতে গেলে প্রচুর পড়ালেখা করতে হয়।
বাংলাদেশের সাহিত্যে অটিজম নিয়ে যদি একটি উপন্যাসের কথাও বলা হয় নিঃসন্দেহে ‘কে কথা কয়’ অন্যতম। কমল নামের এক অটেস্টিক শিশুর মাধ্যমে হুমায়ূন দারুণভাবে অটিজমের রহস্যময় জগত তুলে ধরেছেন। কমলকে সঙ্গ দেয়ার দায়িত্ব পড়ে মতিন উদ্দিন নামের একজনের উপর। মতিন উদ্দিন ভিষন পড়ুয়া, কবিতা লেখেন, কমলের সঙ্গে তার বোঝাপড়াও ভালো। মতিন উদ্দিন এক উজবেক কবি নদ্দিউ নতিমকে নিয়ে পত্র পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখেন। এই নদ্দিউ নতিম আসলে কাল্পনিক চরিত্র। শেষের কবিতার নিবারণকে যেমন অমিত নিয়ে আসে নিজের সৃষ্টিকে তুলে ধরতে নদ্দিউ নতিম তেমনি মতিনের কাব্য প্রতিভাই তুলে ধরে। বিষয়বস্তু এবং বক্তব্যের চেয়েও এ আলোচনায় আমরা গুরুত্ব দিতে চাই নদ্দিউ নতিমের লেখা কবিতা নিয়ে। উল্লেখ করা দরকার এইসব কবিতাই হুমায়ন আহমেদের মৌলিক কবিতা।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার কাব্য প্রতিভা তুলে ধরেছেন নদ্দিউ নতিমের বরাত দিয়ে। বইয়ের শুরুতেই ফ্ল্যাপে যে একটি কবিতা আছে, সেটি হলো—
‘একটি গোপন কথা
পদ্ম জেনেছিল
পদ্ম তাই লজ্জায়
লুকিয়েছে মুখ
মীনদের মাঝে কোলাহল
‘পদ্মের হয়েছে আজ
কেমন অসুখ?’
– উজবেক কবি নদ্দিউ নতিম-এর একটি অপ্রকাশিত কবিতার অংশবিশেষ
ফ্ল্যাপে ঔপন্যাসিক এমন সুকৌশলে কবিতাটি ব্যবহার করেছেন যে, পাঠক ধরেই নেবেন সত্যি-সত্যি উজবেকিস্থানের কোন কবির একটি অপ্রকাশিত কবিতার অংশ বিশেষ এটি। কিন্তু ক্রমশ উপন্যাসের পাতা ধরে এগুলে পরিষ্কার হয়ে উঠবে উজবেক (উজবুক কি?) কবির কবিতার বরাত দিয়ে এ কবিতাও রচনা করেছেন হুমায়ূন আহমেদ।
‘কবি’ উপন্যাসের চেয়ে তুলনায় ‘কে কথা কয়’ উপন্যাস অনেক পরিণত। ফলে আতাহারের লেখা কবিতার চেয়ে নদ্দিউ নতিম অনেক বেশি পরিপক্ক। নদ্দিউ নতিমের আরেকটা কবিতার উদ্ধৃতি দেই—
‘ক্লান্ত দুপুর, মধ্য রজনীতে
প্রথম সকাল প্রথম সন্ধ্যারাতে
কে কথা কয়
ফিসফিসিয়ে আমার কথার সাথে?
তাকে চিনি
সত্যি চিনি না-কি?
তাকে চেনার কতটুকু বাকি?
নাকি সে স্বপ্নসম ফাঁকি?’
আত্মানুসন্ধান, নিজেকে জানা, বিশ্ব সাহিত্যের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে। গ্রীকরা বলতেন ‘গ্লোথি সয়ান্থনি’ (নিজেকে জানো), সংস্কৃত পণ্ডিতরা বলতেন, ‘আত্মানাং জ্ঞানং বিদ্ধি’ (নিজকে জানাই জ্ঞানের আসল লক্ষ্য)। ভাবগত দিক থেকে এই কবিতায় নিজেকে জানার দিকটি উঠে এসেছে। অন্যদিকে এই কবিতার সঙ্গে সুধীন্দনাথ দত্তের ‘শ্বাশতী’ কবিতার ধ্বণিগত বা সুরগত মিল খুঁজে পাই—
‘শ্রান্ত বরষা অবেলার অবসরে
প্রাঙ্গণে মেলে দিয়েছে শ্যামল কায়া ;
স্বর্ণ সুযোগে লুকাচুরি-খেলা করে
গগনে-গগনে পলাতক আলোছায়া।’
প্রিয় পাঠক, এখানে শুধু আপনাকে নজর দিতে মিনতি করি, হুমায়ূন আহমেদ নামের প্রবল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের কবিসত্তার দিকে। এই কথাসাহিত্যিক যে চাইলেই কবি হতে পারতেন নদ্দিউ নতিমের বয়ানে লেখা কবিতাগুলো তার প্রমাণ হতে পারে।
এই মিল ধারণা করি, কাকতালীয় নয়। বাংলা কবিতার সেরা নিদর্শনগুলোর সঙ্গে হুমায়ূনের পরিচয় ছিলোই। তার একাধিক রচনা সূত্রেই জানতে পারি, আমাদের কবিতাবিশ্ব সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। ভাবগত দিক থেকে তার এই কবিতায় আত্মানুসন্ধ্যানের প্রবণতাও বিদ্যমান।
‘তাকে চিনি
সত্যি চিনি না-কি?
তাকে চেনার কতটুকু বাকি?
নাকি সে স্বপ্নসম ফাঁকি?’
এই চরণের সঙ্গে লালনের চরণ মিলিয়ে পড়লেও হুমায়ূনের কাব্যে আত্মানুসন্ধ্যান লক্ষ্য করি,
‘বাড়ির কাছে আরশি নগর
সেথায় একজন পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।’
আবার বিশ্বকবিতা এবং বাংলা কবিতার তুলনামূলক পাঠ সম্পর্কেও হুমায়ূন আহমেদ ধারণা রাখতেন। ‘তেতুল বনে জোছনা’ উপন্যাসের একটা অংশ পড়া যাক।
‘‘আজ বৃহস্পতিবার। সকালের ক্লাস মিস হয়েছে। একটা টিউটোরিলে ক্লাস আছে দুপুর দুটায়। এডগার এলেন পোর কবিতা নিয়ে আলোচনা।
It was many and many a years ago
In a kingdom by the sea,
That a maiden there lived whom you may know
By the name of Annabel Lee;
And this maiden she lived with no other thought
Than to love and be loved by me.
আচ্ছা এই কবিতাটার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কবিতা একই গাঁয়ের খুব মিল আছে না?
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচজনে
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা।
এডগার এলান পোর এনাবেল লীই কি রবীন্দ্রনাথের রঞ্জনা?’’
হুমায়ূন আহমেদের ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসটি গল্পের প্রেক্ষাপট, চরিত্র নির্মাণ, বিষয় ও উপস্থাপন ভঙ্গির কারণেই আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে। প্রিয় পাঠক, এখানে শুধু আপনাকে নজর দিতে মিনতি করি, হুমায়ূন আহমেদ নামের প্রবল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের কবিসত্তার দিকে। এই কথাসাহিত্যিক যে চাইলেই কবি হতে পারতেন নদ্দিউ নতিমের বয়ানে লেখা কবিতাগুলো তার প্রমাণ হতে পারে। আধুনিক বাংলা কবিতার যে কোন সংকলনে আলাদা করে হুমায়ূন আহমেদের কবিতা ছাপা হতে পারে। ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসের আরেকটি কবিতা পড়া যাক—
‘‘জলে কার ছায়া পড়ে
কার ছায়া জলে?
সেই ছায়া ঘুরে ফিরে
কার কথা বলে?
কে ছিল সেই শিশু
কি তাহার নাম?
কেন সে ছায়ারে তার
করিছে প্রণাম?’’
জলে পড়া রহস্যময় ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকার মধ্যে মরমী ভাবনা যেমন আছে তেমনি নার্সিসাসের কথাও মনে পড়ে যায়। একজন পরিণত কবির মতো হুমায়ূন আহমেদ এ কবিতার রহস্য রেখেছেন। ইচ্ছাকৃত কিছু জটিলতাও তিনি রেখেছেন নদ্দিউ নতিমের কবিতাতে—
‘‘প্রজাপতির ডানায় তুমি বিষন্নতা খুঁজতে যেও না।
প্রজাপতির বাণিজ্য বেদনায়।
তার দুটি ডানার একটিতে লাভ
অন্যটিতে লোকসান…’’
‘কে কথা কয়’ উপন্যাসে শিরোনামসহ একটি কবিতা আছে, ‘ঘুম্র হ্রদ’। এই কবিতার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, ‘ঘুম্র’-এর মতো একটি নতুন শব্দের সৃষ্টি করা। ঘুম শব্দের মধ্যেই একটা নিদ্রালুতা আছে, তার সঙ্গে ‘র’ফলা যোগ করে হুমায়ূন আহমেদ নিদ্রাকে আরো গভীর করে তুলেছেন। অন্যদিকে হ্রদের সঙ্গে ঘুম্র শব্দ একটি বাড়তি দ্যোতনার সৃষ্টি করেছে।
‘‘অঘুমো রাজকন্যা ছিল ঘুম্র হ্রদে
তাকে ঘিরে জল নাচে শোঁ শোঁ শব্দ হয়
রাজন্যার ভয় হয় তার শরীরে অসুখ
‘অসুখের নাম কী?’ প্রশ্ন করে জলপাণি
অঘুমা রাজন্যা দেয় না উত্তর।’’
ঘুম নিয়ে আরেকটি অনু কবিতা আমরা পাই ‘ কে কথা কয়’ উপন্যাসে—
বৃদ্ধ রমিজ মিয়া ইনসমনিয়ার রোগী
দিনে কিছুক্ষণ ঘুমুলেও রাত নির্ঘুম
তাঁর কাছে রজনীও দিবসের মতোই নিঝুম ॥
ঘুম্র হ্রদ, নির্ঘুম, নিঝুমের মতো শব্দগত দ্যোতনা দেখতে পাই উপন্যাসে ব্যবহৃত আরেকটি কবিতায়—
‘ক্লান্তি ও ক্লান্তি
শন্তি ও শান্তি।
ক্লান্ত ও ক্লান্তি
শান্ত ও শান্তি । ।
এইখানে Stop
Drag and Mop
Drag and Mop.’
ক্লান্ত, ক্লান্তি, শান্ত, শান্তি, Stop, Drag and Mop কেবল কয়েকটি শব্দের বিচ্ছিন্ন ব্যবহারে কাব্য সৃষ্টির এই প্রয়াস হুমায়ূনকে কবি’র কাতারে নিয়ে আসে।
আধুনিক কবিতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরীক্ষা ‘সেইপ পোয়েট্রি’ বা ‘কনক্রিট পোয়েট্রি’। অক্ষর বুনে বুনে বিভিন্ন আকার-আকৃতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে এসব কবিতা একটা দৃশ্যগ্রাহ্য মাত্রাও সৃষ্টি করেছে। গিয়ম এপোলিনিয়ারের মতো বিশ্বখ্যাত কবিরা এই ধরণের কবিতায় চূড়ান্ত সাফল্য দেখিয়েছেন। হুমায়ূন আহমেদ যে এই ধারা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন তা ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসের একটি কবিতা থেকে সুস্পষ্ট।
কবিতাটি পড়া যাক —
‘‘ এ কি না পা
ক ং ও খি
টি বা কে
পা শ্যা পা মা
খি মা রে না
য়
ছি কা ব না।
ল ঠ লা
হ ঠো ক জা
য় ক ঠি নি
রা ন
কা হ বে না
ক তে শ
কি পা ক কে
ং রে ঠি ন?”
বা ন।
চ আ কা
ড়– বা ঠি
ই র ন্য
বাম থেকে ডানে নয়, উপর থেকে নিচে পড়ে গেলেই এই কবিতার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব। এই কবিতার সঙ্গে গিয়াম এপোলিয়ারের এল প্লাতো (বৃষ্টি ) কবিতাটি মিলিয়ে দেখলে পাঠক হয়তো আনন্দ পাবেন। আমি মূল ফরাসী কবিতাটিই এখানে তুলে ধরলাম।
আধুনিক কবিতার নানা নিরীক্ষা প্রবণতাই ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসে লক্ষ্য করা যায়। কখনোবা অতি আধুনিক হওয়ার চেষ্টায় কবিদের বাড়াবাড়ি নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করতে দেখা যায় এ উপন্যাসে। ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসের অন্যতম একটি চরিত্র আজহার উল্লাহ। তিনি ‘ভোরের স্বদেশ’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক। ষাটোর্ধ্ব এই সম্পাদকের দোহাই দিয়ে আধুনিক কবিতার বিচিত্র গতিধারা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করেছেন। এই অংশটুকু পড়লে আধুনিক কবিতার দৃষ্টিভঙ্গিও কিছুটা পাওয়া যাবে— ‘‘যাও অফ করে দাও। আলতু-ফালতু লিখে পাঠালেই ছাপতে হবে। কবিতার নাম কি— ‘শ্রীকৃষ্ণ ডট কম’। এর অর্থ কী?
আধুনিক কবিতার আধুনিক নাম।
নামের অর্থ তো থাকতে হবে। কবিতাটা পড়।
আপনি তো কবিতাই অফ করে দিচ্ছেন। পড়ার দরকার কী?
তোমাকে পড়তে বলছি পড়।
যত দোষ নন্দ ঘোষ শ্রীকৃষ্ণ পিতা
দুধ পড়ে ভিজে গেছে ভগবত গীতা’ ছাপা হবে না
আর পড়তে হবে না। স্টপ। কবিতা অফ। আমি যতদিন এই পত্রিকায় আছি ততদিন ‘দুধ পড়ে ভিজে গেছে ভগবত গীতা’ ছাপা হবে না।’’
একটি বিষয় লক্ষ্যনীয় হুমায়ূন আহমেদ তার ‘কবি’ ও ‘কে কথা কয়’ উপন্যাসদ্বয়ে গল্পের প্রয়োজনেই কবিতা এনেছেন। এ ক্ষেত্রে কবিতাগুলো লেখা হয়েছে নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। তাই এইসব কবিতা অনেকটাই বলা যায় পরিস্থিতি নির্ভর। একক সৃষ্টি হিসাবে এগুলোকে কবিতা হিসাবে বিবেচনা করতে গেলে কিছুটা শৈল্পিক সংকট তৈরি হতেই পারে। কিন্তু এটা অন্তত নিশ্চিত করেই বলা যায়, হুমায়ূন আহমেদ চাইলেই কবিতা লিখতে পারতেন। তার করতলে কাব্য সুধা ছিলো। যে কোন কারণেই হোক আমাদের পাঠকরা তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে কবি হওয়ার সাধ রেখেছিলেন। লীলাবতী উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ উৎসর্গ অংশে লিখলেন—
‘শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ
কবি, আমি কখনো গদ্যকার হতে চাই নি।
আমি আপনার মতো একজন হতে চেয়েছি।
হায়, এত প্রতিভা আমাকে দেয়া হয় নি।’
কবি হওয়ার প্রতিভা তার ছিলো কি-না সেটি তর্ক সাপেক্ষ, কিন্তু তিনি কবি হতে চেয়েছিলেন তাতে কোনো ভুল নেই। আমার কাছে অন্তত মনে হয়, শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন আহমেদ একজন কবিই ছিলেন।
লেখাটা শেষ করতে চাই শ্রীলঙ্কার কবি জেন-এর লেখা একটি কবিতা দিয়ে। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আইওয়াতে লেখক সম্মেলনে থাকার সময় তিনি এটি লিখেছিলেন। আগ্রহী পাঠক ‘মে ফ্লাওয়ার’ থেকে বিস্তারিত জেনে নেবেন। আমি অতি আগ্রহে কবিতাটা বাংলা অনুবাদও করে ফেললাম এবং এ লেখার শেষে ইংরেজি ও বাংলা কবিতাটি সংযোজন করে দিলাম।
আলপিন নামে প্রথম আলো এক সময় একটা ফান ম্যাগাজিন করতো। এই পত্রিকার চরিত্রই ছিলো হাসি-তামাশা। ১০ ডিসেম্বর ২০০১ সালে সিমু নাসের এই পত্রিকার পক্ষ হয়ে হুমায়ূনের সাথে এক লঘু ও সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় যান। এই আলাপচারিতার একটা অংশ দিয়ে লেখাটা শেষ করছি।
‘সিমু নাসের : কাক এবং কবির সংখ্যা দেশে অসংখ্য। কিন্তু প্রচুর গদ্য পড়া ছাড়াও একজন ভালো গদ্যকার হওয়ার জন্য যা করা উচিত—
হুমায়ূন: প্রচুর কবিতা পড়তে হবে এবং কলমটা এমনভাবে হাতে রাখবে যেন মনে হয় মানুষটার আসলে ছয়টা আঙুল। একটা আঙুল কলম।’
লক্ষ্যনীয় প্রশ্নকর্তা হাস্যরসের নামে যথাবিহিত কাক ও কবির সংখ্যার একঘেয়ে পুরাতন তুলনা দিয়ে শুরু করলে হুমায়ূনের সংক্ষিপ্ত উত্তরটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কবি, লেখকের সঙ্গে কলমের এমন সম্পর্কের তুলনা যথার্থই অর্থপূর্ণ। আর আমরা আজ কে না জানি, শেষ পর্যন্ত হুমায়ূন সত্যিই কলমকে তার যাদুকরী আঙুলে পরিণত করেছিলেন। সেই আঙুল থেকে গদ্যের মর্মর বের হলেও, কবিতা তুলনায় প্রকাশিত হয়নি। তবু যতটুকু কবিতা আমরা তার কলম থেকে পেয়েছি, ততটুকুই কবি হুমায়ূনকে চিনে নেয়ার জন্যে কম নয় মনে করি।
মুম রহমান
পুরো নাম : মুহম্মদ মজিবুর রহমান
লেখক নাম : মুম রহমান
জন্ম: ২৭ মার্চ ১৯৭১, ময়মনসিংহ
বাবা : মুসলেহ উদ্দীন
মা : তাহেরুন্নেসা
পড়ালেখা : এমফিল, বর্তমানে পিএইচডি করছেন
প্রকাশিত গ্রন্থ : ৬০টি