শহরপুরাণ ও ধান-হাওরের কথা | মোস্তাক আহমাদ দীন


সেইসময় সকালে হোটেল থেকে বের হই, দুপুরে-রাতে লঞ্চঘাটের রেস্টুরেন্টে খাই, আর কাফকার চরিত্রের মতো একা একা আদালতপাড়ায়, কখনো-বা মহল্লার যানজটহীন অলিগলিতে ঘুরি-যেন কেউ শহরের সমস্ত পাড়ামহল্লার নামধাম মুখস্ত-করার অলিখিত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে আমাকে।

 

একটানা সতেরো দিন সুনামগঞ্জ শহরে কাটিয়ে বাড়ির আলঘাটায় পা রেখে দেখি, দাদা-দাদির জোড়া কবরের গায়ে তাদের নামের পাশে আনাড়ি হাতে কেউ-একজন আলকাতরা দিয়ে আমার নামটিও লিখে রেখে গেছে! ‘তাহলে বাড়ির সবার কাছে কি মরে গেছি আমি?’…‘মরে গিয়ে থাকলে আমার দেহ কীভাবে হেঁটে এল এখানে?’…‘রাতে আমার এই দেহটাই কি আবার ঘোড়াখানি দেও হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে?’-অভিমানবশত এইসব আবোলতাবোল যখন ভাবছিলাম তখন মনে পড়ে সেই বয়সে কবিতাগ্রস্ত আমি শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাটি দেওয়ার জন্য প্রথমে যেতেই চাইনি, অথচ প্রথম পরীক্ষা দেওয়ার পর বিকালে  স্নিগ্ধশান্ত শহরে ঘুরতে গিয়ে কী রকম এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। একেকটি পরীক্ষার পর দুই-তিন দিনের বিরতি : সেইসময় সকালে হোটেল থেকে বের হই, দুপুরে-রাতে লঞ্চঘাটের রেস্টুরেন্টে খাই, আর কাফকার চরিত্রের মতো একা একা আদালতপাড়ায়, কখনো-বা মহল্লার যানজটহীন অলিগলিতে ঘুরি-যেন কেউ শহরের সমস্ত পাড়ামহল্লার নামধাম মুখস্ত-করার অলিখিত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছে আমাকে। এইসব ঘোরগ্রস্ত আনন্দস্মৃতির মধ্যে ধাক্কা-খাওয়ার মতো ঘটনাটি ছিল বাড়িফেরার আগে আগে শহরের এক পুকুরপাড়ে গলায়-দড়ি-দিয়ে-মারা-যাওয়া এক মহিলার ঝুলন্ত লাশ দেখার হতবিহ্বলকর অভিজ্ঞতা। পরদিন, লেটারপ্রেসে-ছাপা-হওয়া শহরের একমাত্র সংবদপত্রের ভাষ্যের সঙ্গে আমার দেখা-অভিজ্ঞতা মেলাতে মেলাতে বাড়ি ফিরে নিজের মৃত্যুলেখার মুখোমুখি-হওয়া।

তবে আমার মৃত্যুলেখা ভুলতে বেশি সময় লাগেনি, কিন্তু জীবনের প্রথম কোনো শহরে দীর্ঘসময় থাকার অভিজ্ঞতা আজও ভোলা সম্ভব হয়নি। তখনো কবীর সুমনের ‘এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু/পালাতে চাই যত, সে আসে আমার পিছু পিছু’ গানটি শোনা হয়নি, তাই মমিনুল মউজদীনের এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায় বইটি যখন উপহার পেলাম তখন সেটি নিয়ে স্মৃতিকাতরতার কারণেই প্রথমে নামকবিতার খোঁজ করলাম এবং দেখলাম এ নামে কোনো কবিতা নেই বইয়ে, তবে এই পঙ্ক্তি রয়েছে ‘ভালোবাসার শহর’ শিরোনামের একটি কবিতায় :

এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়
যেদিকে তাকাই দেখি সারাটি ভুবনময়
আলো আর মৃত্তিকার বুকের ভিতর
তোমার দু’চোখ
সুরভিত শস্যময় সজল দু’চোখ

না, এই কবিতাটি কেবল নিরেট শহর আর শাহরিক প্রকৃতিপ্রেমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে সবিশেষ জড়িয়ে আছে কোনো-এক নারীপ্রতিমার সশরীর উপস্থিতিও : ‘একজোড়া কালো চোখ বসে থাকে যে শহরে/অপেক্ষার প্রদীপ জ্বালিয়ে/সে শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়!’ খেয়াল করলাম, বইয়ে শহরের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ নিয়ে আরও একাধিক কবিতা আছে যেখানে আমার দেখা উকিলপাড়া, পুরোনো বাস-স্টেশন, ট্রাফিক পয়েন্ট সবই আছে, আছে যানজটমুক্ত নিরিবিলি রাস্তাঘাটের কথাও, কিন্তু এই সবকিছুই এসেছে কোথাও-না-কোথাও পৌঁছবার নিবিড় আকুতি নিয়ে। বোঝা যায়, শহর এখানে গৌণ, মুখ্য হলো তেমনই একজন যার কাছে শহর [গঞ্জ] হলো এক অবনত উজ্জ্বল প্রতীকের [সু]নাম। একথার সপক্ষে পড়ে নিতে পারি মমিনুল মউজদীনের ‘তরুণী’ শিরোনামের ছোট্টো কবিতাটি :

কবিতা যেমন গোপন থাকে না
তুমিও থাকো না তেমনি
নিজেকে ওড়াও বাতাসে ও মেঘে
শহর কাঁপাও তোলপাড় বেগে
শত যুবকের বিস্মিত চোখে
জ্বলে না-পাওয়ার বহ্নি

নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে কোনো-এক বিকালে সুনামগঞ্জে তাঁর সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন আমার মনে তাঁর কবিতাপাঠের স্মৃতি উজ্জ্বল। তাঁর অফিস থেকে একসঙ্গে বাসায় ফেরার পথে তিনি বারবার আমার সম্পাদনায় সদ্যপ্রকাশিত বাউলকবি মকদ্দস আলম উদাসীর পরার জমিন বইয়ের কিছু মরমি গানের কথা তুলে সেই কবির জন্য কিছু-একটা করার কথা বলছিলেন। মরমি গানের প্রতি তাঁর আগ্রহ দেখে পূর্বপুরুষ হাছন রাজার পাশাপাশি আমার মনে পড়ছিল তাঁর সেই উজ্জ্বল দুটি পঙ্ক্তির কথাও : ‘আমাকে দিও না কেউ বন্ধনের মায়া/তার বুকে জ্বলে উঠবে চিতার আগুন।’

গাড়িতে ফেরার পথে শেষবিকেলের আভায় তার চেহারা তখন সুদূর মনে হচ্ছিল : এই কবিই কি তাহলে জ্যোৎস্নারাতে শহরের বিদ্যুৎবাতিগুলো নিভিয়ে রাখেন? শহওে অবস্থান করেও শহরকে অস্বীকার করার কী দুঃসাহস ছিল তাঁর! কিন্তু তা অল্প সময়ের জন্য, কেননা শহরের বাস্তবতা আসলেই কঠিন। তবে নাগরিক সুবিধার জন্য তাঁর প্রিয় শহরকে যাচ্ছেতাইভাবে শেষ করে ফেলেননি একসময়কার জনপ্রতিনিধি মমিনুল মউজদীন। আমরা লক্ষ করলে দেখব, মমিনুল মউজদীনসহ যে-কজন কবি একসময় আমরা কতিপয় সাহিত্যসেবী নামে সংগঠন করে সুনামগঞ্জ শহরকে প্রায় কবিতার শহরে পরিণত করেছিলেন, যাঁদের কবিতাপাঠ দর্শনীর বিনিময়ে শুনতেন পাঠক শ্রোতারা, তাঁরা সকলেই এ-বিষয়ে ছিলেন সচেতন। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ওই সংগঠনের অগ্রণী ব্যক্তি কবি মুতাসিম আলীর ‘আমি যা বলতে এসেছি’ কবিতাটির কথা যেখানে তিনি এ-বিষয়ে কখনো ক্ষোভ কখনো-বা বিদ্রুপ প্রকাশ করেছেন :

আমাদের আশপাশের ঝোপঝাড় জঙ্গল
সবকিছু উজাড় হয়ে যাচ্ছে-
ফসলের মাঠজুড়ে দাঁড়াচ্ছে
গ্রাম্য বুর্জোয়াদের এক একটি সুবর্ণ সোমত্ত বাড়ি,
এদের আগমনে শহরের শোভা বাড়ছে
বাড়ছে মেদ।

 


একজন সংবেদনশীল মানুষ তীব্র দায়িত্ববোধ থেকে কবিতা লিখতে পারেন, আবার দায়িত্বপূর্ণ কবিতা লিখেও তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি ও প্রতিফলন যদি কোথাও না-দেখা যায় তাহলে কবিতালেখায় কিছুটা ভিন্ন ভাবনাও আসতে পারে।

 

এই বিদ্রুপের পরিচয় রয়েছে কবিতাটির শেষের স্তবকেও যেখানে বৈদ্যুতিক বৃক্ষ আর পাথরের শাপলাশোভিত শহরের উচ্চকিত প্রশংসা, যা মূলত নিন্দারই অন্য নাম। মুতাসিম আলীর দূরে নেই দূরত্বে আছি বইয়ে এরকম কবিতা আরও আছে যেখানে তিনি আশেপাশের ফুল, প্রজাপতি আর লাল-নীল-হলুদের সমারোহ না-দেখার কথা স্পষ্টভাবে বলেছেন। তাঁর এই স্পষ্টতা, ধারণা করি, এসেছে আদর্শনিষ্ঠার জায়গা থেকে, যে-আদর্শে তিনি আস্থাবান তো বটেই, আশাবাদীও। বইয়ের ফ্ল্যাপে খোলাখুলিই বলা আছে : ‘স্বপ্ন তো অমর, আশা তো পুনরুজ্জীবিত হয় প্রতি বসন্তে। আমি তো এখনো আছি সময়ের শেষ্ঠ সন্তান। আমরা এখনো আছি, দূরে নেই, একদম দূরে নেই, শুধুমাত্র সামান্য দূরত্বে আছি।’ এই তীব্র আশাবাদই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছে এমন কিছু কবিতা যেখানে শোষক-বঞ্চকদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান সুদৃঢ় :

আজকাল কবিতা লিখতে খুব কষ্ট হয়
মনে হয় নিজ হাতে নির্মম সিরিঞ্জ দিয়ে
যৌবনের রক্ত আমি খুলে নিচ্ছি হৃৎপিণ্ড থেকে।
যখন আমি আমার মায়ের দুঃখ দেখি
দেখি তার দুই হাতের মরে যাওয়া নখ
সময় আর সংসারের শেওলা-পড়া
দশটি আঙুল, তার ভাঙা শরীর

একজন সংবেদনশীল মানুষ তীব্র দায়িত্ববোধ থেকে কবিতা লিখতে পারেন, আবার দায়িত্বপূর্ণ কবিতা লিখেও তার কাঙ্ক্ষিত পরিণতি ও প্রতিফলন যদি কোথাও না-দেখা যায় তাহলে কবিতালেখায় কিছুটা ভিন্ন ভাবনাও আসতে পারে। উক্ত কবিতায় এমন দ্বন্দ্বের খানিকটা আভাস থাকলেও কবিতার প্রতি এই মা, মাটি আর মাটির মানুষকে বিশাল বিস্ফোরণে জ্বলে-ওঠার আহ্বান করেছেন এই কবি। তাঁর অন্য আরেকটি কবিতার শিরোনাম ‘সেই কবিতাটি এখনো লিখতে পারিনি’, যেখানে তিনি সেই মহত্তম কবিতা লেখার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করেছেন যেটি হবে ‘শানিত ইস্পাতে মোড়া’, ‘হৃদয়-নিংরানো রক্তের অক্ষরে গড়া, যার অঙ্গে মাখা থাকবে এদেশের সবুজ ক্লোরোফিল‘ আর ‘দুকূল প্লাবনকামী প্রবল প্রবাহ’।

মা মাটি আর মানুষের প্রতি জেগে-ওঠার আহ্বান আর এই আকাক্সক্ষার সূত্রে মনে পড়ছে ১৯৮৮ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কারাবরণেরও আট বছর আগে লেখা ইকবাল কাগজীর ‘মুক্তি’ কবিতাটির কথা যেখানে তিনি তেজস্ক্রিয় বাতাসকে নীল কারাগারের বন্দিত্ব বলে চিহ্নিত করেছিলেন। কবিতার প্রথম দুটি স্তবকে পূর্বপুরুষকে সম্বোধন করে তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা :

আমি চাই নি মা
এই মায়াহীন মাটি
ছায়াহীন বন

আমি তো চাইনি পিতা
এই দূষিত সমুদ্র আর
বিষাক্ত আকাশ

এরকম স্পষ্ট ঘোষণার নেপথ্যে সক্রিয় থাকে তীব্র আশাবাদ, যে-কারণে একালে দাঁিড়য়ে তিমিরকালের কোলে-শুয়ে-থাকা বিদ্রোহে দুর্বার এক শিশুকে কল্পনা করতে পারেন। ইকবাল কাগজীর নষ্ট কুসুমের কষ্ট বইয়ে দ্রোহচিহ্নিত কবিতাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের এমন কিছু কবিতা রয়েছে যেগুলোর স্বর ও সম্বোধনের কারণে কখনো কখনো নীরব হয়ে যেতে হয়। এখানে পড়া যেতে পারে ‘বারণ’ কবিতাটি :

গোলাপের গন্ধ নিতে গিয়ে
ছাফছফা গন্ধধোয়ামোছা
রঙিন পাপড়িগুলো কোমল কাগজ

ফুলের বুকের এই কষ্ট
এই নষ্ট বায়ু
কারও কোনো দুঃখ নয়

নষ্ট কুসুমের কষ্ট নিয়ে কবিতা লিখো না

এমনিতে মনে হয় কবিতাটি সহজ, কিন্তু ভালোভাবে পড়লে দেখব তিনটি স্তবকেই রয়েছে একাধিক অর্থের সম্ভাবনা। প্রথম স্তবকে উল্লিখিত গোলাপটিকে আসল বা নকল দুভাবেই পড়া যায়। আসল বা নকল যা-ই হোক, একথা ধরে নেওয়া যায়, ফুলের প্রতি অবহেলার কথাটাই এখানে বলা হচ্ছে। আবার দ্বিতীয় স্তবকের ফুলের বুকের কষ্ট এবং নষ্ট বায়ু আবার কারও কোনো দুঃখ নয়; এটি কি তবে সাধারণ তথ্য? না অভিমান, নাকি বিস্ময়? এছাড়া একপঙ্ক্তির তৃতীয় স্তবকের ভাষ্যটি কার উদ্দেশ্যে লিখিত? অন্য কারও প্রতি, না নিজের প্রতি? তিন স্তবকের এই ছোট্টো কবিতাটি এই যে বিভিন্ন ভাবনার মুখোমুখি করে দেয়, তা এর দুর্বলতা নয়, সবলতা।

 


‘অজ্ঞাত উপাখ্যান’ নামের একটি কবিতায় একজন মানুষের কথা আছে, যে কি-না গুহার মানুষের মতো শহরে বাস করে, জ্যোৎস্নার কাছে তৃষ্ণার কথা বলে এবং তার চিৎকারগুলো নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে শহরে থাকে। এরকম বহু অজ্ঞাত উপাখ্যান প্রায় প্রতিদিনই শহরের আদাড়েবাদাড়ে কোথাও-না-কোথাও রচিত হয়ে চলেছে, আমরা কয়টা উপাখ্যানের খবর রাখি।

 

বইয়ের কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আন্দাজ করি, তাঁর কবিতার এই প্রবণতা এসেছে শের ও গজলের আঙ্গিক থেকে। গালিব কি তাঁর পছন্দের কবি? অথবা ফয়েজ আহমদ ফয়েজ? উৎসর্গপত্রের কথা মনে পড়ে : ‘কাগজী/তুমি কী যে ভঙ্গি ধরেছ/এমন ছদ্মবেশ/ছিঁড়তে পারে না কেউ/খুলতে পারে না/বিবর্ণ বাকল।’ মনে পড়ে ‘অবজ্ঞা’ কবিতাটির কথা :

ভালবাসা আর ঘৃণা আসলে
একই মৃদ্রার এপিঠ ওপিঠ
কিন্তু উদাসীনতা প্রিয়জনের হাতে
এমন এক অস্ত্র
যাতে আছে মৃত্যুর স্বাদ
কিন্তু মৃত্যু নেই

কাগজী তুমি তো সেই লোক
বেঁচে থাকতে কেউ ফিরেও চাইবে না
মরে গেলে হা হুতাশে পড়শিদের
ঘুম কেড়ে নেবে

এরকম কবিতায় বেদনার আড়ালে একপ্রকার চাপা অভিমান মিশে থাকে, এখানেও আছে। কিন্তু এ-বইয়ে এই ধরনের কবিতা ছাড়াও একাধিক কবিতায় আছে নিজেদের ব্যর্থতার প্রতি বিদ্রুপ, কখনো কখনো সমাজের বিশেষ শে্িরণর প্রতি প্রতিবাদী হতে না-পারার আক্ষেপের কথাও। ‘শ্রুত’ কবিতায় আছে কোনো এক শীতকালের মধ্যরাতে কারা এসে ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার পর ফলে সকালবেলা ন্যাড়া মাঠে স্তব্ধতার হাাঁটাহাঁটি লক্ষ করেন কবি, হাজার বছরের পুরোনো সেই সুখের প্রেতাত্মাকে দেখেন, শোনেন কান্না আর হাহাকার।

বিষয় কিছুটা ভিন্ন হলেও কবিতার অনুষঙ্গগত কারণে বিশেভাবে মনে পড়ল কবি আশরাফ আহমদের ‘চিহ্ন’ কবিতাটির কথা। কবিতাটি জটিল, বলা উচিৎ বহুমাত্রিক; সেখানে নিজের অনস্তিত্বের কথা কথা আছে, একালের কথায় অতীতকালের মন্দ্রধ্বনি আছে; একটির বুকঘেঁষে অথবা বুকের ওপরে যখন চর বাড়তে থাকে তখন তার শরীরে নদীর শ্বাসকষ্টের কথা ভাবেন। তাঁর নির্বাচিত কবিতা বইয়ের ফ্ল্যাপে রয়েছে : ‘ব্যক্তিজীবনে একদিকে কর্পোরেট জগতের তুখোড় নির্বাহী অন্যদিকে এলায়িত আলাভোলা এক নির্জন সন্ন্যাসী। দ্বৈতসত্তা নিয়ে নিজের অবস্থান অনির্ধারিত জেনেও আউটসাইডারের জীবন আর কবিতা নিয়ে তিনি সুখী।’ এখন পড়ে দেখা যেতে পারে তাঁর কবিতার প্রথম স্তবক :

না, ওটা কোনো শুশুকের কুঁজো পিঠ না,
নদী ফুঁড়ে জেগে ওঠা চর।
ভাবছেন-সম্ভাবনা? আগামী আগামী।
আমি দেখছি পরিযায়ী পাখির পালক।
দেখছেন-উড়াল-স্বপ্ন?
স্বপ্নই যদিই তবে, সুইফট পাখিই!
আমি দেখছি-চিহ্ন
কীভাবে চিহ্ন রাখি?

এ-পর্যন্ত পড়ে বোঝা যায় কবিতাটি একস্তরিক নয় কোনোভাবেই : একদিকে রূপান্তরের ঘটনা ঘটে চলেছে, দৃশ্যের পর দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে, যেগুলোকে কবি চিহ্ন হিসাবেই দেখছেন এবং প্রশ্ন করছেন কীভাবে সেই চিহ্ন ধরে রাখবেন। কবিতাটির দ্বিতীয় স্তবকে পৌঁছে মনে হয়, চিহ্ন রাখা আসলে কঠিনই, নেই নেই জিগির ওঠে এবং তা নাম না-থাকার মতো সর্বনামে পরিণত হয়। এমনতি সমুদ্রের পাশে লাল কাঁকড়ারা ‘আশরাফ’-এর বিপ্রতীপ ‘আতরাফ’ লিখে বালিতে লুকোনোর সঙ্গে ঢেউ এসে তা মুছে দিয়ে যায়।

সময়ের এই কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরতে কবিতার মসৃণ গীতলতা আর চলতি পয়ারের স্বস্তিকর চাল বর্জন করে গনগনে প্রতীকী গদ্যভাষা তৈরি করেছেন আশরাফ আহমদ। তিনি ১৯৭৬ সালে শান্ত-গীতল শহর সুনামগঞ্জ ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় পৌঁছে সেই শহরটিকে কতটা গ্রহণ করতে পেরেছিলেন আশরাফ, তা তার একাধিক কবিতায় আছে। পথের মানুষ কবিতায় জানিয়েছেন, তিনি পকেটে রুমাল, কলম এবং নোটবইয়ের পরিবর্তে বুকপকেটে যত্ন করে মাছরাঙা পাখির পালক রেখেছেন; তা না রেখে স্বর্ণলতা থেকে একটি পাতা যদি রাখতেন তাহলে ঢাকার বাতাস অক্সিজেনে ভরে উঠত, কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন :

আসলে আমার বুকে অস্থির সময়-লাভা গড়িয়ে চলেছে
ভয়ে আমি নিজ বুকে হাতও রাখি না

আপনারা অনুগ্রহ করে
পকেট হাতড়ে এই কোমলটা বের করে
তার স্থলে রেখে দিন টাকা বা আধুলি
আপনি সওয়াব আর অমি পাব রুটি

সময় এবং সময়পীড়িত বাস্তবতা যেন নগরজীবনের নিরাময়ের অযোগ্য দগদগে ক্ষতগুলোকে খুলে দেখাচ্ছে এই বইয়ের কিছু কবিতা। ‘দাম্পত্য’ কবিতায় দেখি ক্যাজুয়াল অভ্যাস কীভাবে বিষণ্ন ক্রোধ আর প্রতিশোধস্পৃহার জন্ম দেয় এবং স্বামী-স্ত্রী দুজন ব্ল্যাকহোলে ঢুকে পড়েন। ‘অজ্ঞাত উপাখ্যান’ নামের একটি কবিতায় একজন মানুষের কথা আছে, যে কি-না গুহার মানুষের মতো শহরে বাস করে, জ্যোৎস্নার কাছে তৃষ্ণার কথা বলে এবং তার চিৎকারগুলো নিজের বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখে শহরে থাকে। এরকম বহু অজ্ঞাত উপাখ্যান প্রায় প্রতিদিনই শহরের আদাড়েবাদাড়ে কোথাও-না-কোথাও রচিত হয়ে চলেছে, আমরা কয়টা উপাখ্যানের খবর রাখি।

এইসব উপাখ্যানের প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ এমনভাবে উঠে আসে তাঁর কবিতায় যেখানে এই যন্ত্রণার তিনিও এক নিরূপায় যাপক। ফলে কখনো কখনো ভিন্ন ভিন্ন সূত্রে তার যদিও মনে হয় যে পূর্বপুরুষ সমুদ্রে না-হলেও হাওরে ছিলেন, কিন্তু কালের বিবর্তনে শেষমেশ তাকেও শীতনিদ্রায় চলে যেতে হয়। এরপরও জিজ্ঞাসা তৈরি হয় ‘যাবতীয় নির্জনতা নিয়ে সন্তরণ-ডুবই কি ব্যাঙের জীবন! তার কাছ থেকে মুক্তি আছে? এ-এক ভয়াবহ যাপন-বাস্তবতা :

শীতনিদ্রা ভেঙে এই নিষ্ক্রমণই ক্ষমাহীন ভুল,
ভুল-ঘ্যাঙঘুং-ঘ্যানর-ঘ্যানর, মাথা কুটছি,
চিৎকারে কাঁপাচ্ছি তল্লাট, ভুল ঘ্যাঙঘুং-!
স্ফীতচক্ষু রাগে ব্যাঙোমিকে ঝাপটে ধরি, ঘ্যান-ঘ্যান-
যৌথ লাফে আছড়ে পড়ি, কিছুতে ছাড়ি না।
ফিতা ছাড়ি, ফিতায় ছাড়ি উগ্র বীজ।
ক্লান্তির অবশ ফেনা নাকে-মুখে-চোখে।
বৃত্ত খুঁজি? না পেয়ে বিন্দু খুঁজি, বিন্দু মানে মজা এক অন্ধকার কূপ।

এই অবস্থায় কেউ সুখী হতে পারেন কি না তা জানি না, কিন্তু শিল্পীকে তো কখনো ট্রাজিক নায়কের চরিত্রে দাঁড়িয়ে এইসব কিছু দেখে যেতে হয়। তাই ‘শিলাবৃষ্টি’ কবিতায় লোকাচারনিষ্ঠ হিরালীকেও যে এই সময়ে এসে দুরবস্থার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তার বর্ণনা দিতেও তিনি অকুণ্ঠ। ব্যর্থ হিরালী যখন বজ্রাহত এবং বিশ্বাস যখন ভেঙে যায় তখন ‘টুপ করে একটি বরফখণ্ড মুখে পুরে/নেচে ওঠে হিরালীর ছেলে/বলে-/আইচ্ক্লীম আইচক্লীম’। সময়ের এইসব বিবর্তনের চিত্র একেকজন কবির চোখে একেকভাবে ধরা পড়ে। জড়-বজ্র আর শিলাবৃষ্টি থামানোর কথা যে-হিরালীর, তার ছেলের মুখে আজ বরফখণ্ড আর আইসক্রিমের ধ্বনি দিয়ে দিয়ে কবি এইসময়কার অবস্থান স্পষ্ট করেন। এই সূত্রে মনে পড়ছে কবি মোহাম্মদ সাদিকের বহুলপঠিত কবিতা হিরালীর কথা।

 


বাস্তবে আমরা যে জানি শহরেরই বাসিন্দা এবং তাও নাগরিক স্থিতিব্যবস্থার উচ্চ আসনেই তাঁর অবস্থান। তারপরও একথাও তো অন্যায্য নয় যে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় কবি অবস্থান করেন না। কথাটি আরও বেশি সত্য মনে হবে তাঁর একটি চিহ্নায়ক কবিতা ‘রাখালের রূপকথা’ পড়লে।

 

কবিতার প্রারম্ভকথনে মোহাম্মদ সাদিক জানান, ‘তাঁদের বিশ্বাস, হিরালী মন্ত্র পড়ে এই ঝড় ও শিলাবৃষ্টির গতিপথ বদলে দিতে পারে। হাঁক দিয়ে হিরালী বুকবরাবর ছুটে যায়। বিবস্ত্র নগ্ন। মন্ত্র পড়ছে সে।’ ‘তাঁদের বিশ্বাস’-এই কথাটি বলেছেন বটে, কিন্তু এরপরও হিরালীকে লক্ষ্য করে ‘মন্ত্র পড়ো আজ মন্ত্র দাও’ বলে হাওরের বেফানা লোকদের কাতারে দাঁড়িয়ে এমন একাত্ম হয়ে উত্তম পুরুষে কবিতাটি শুরু করেছেন কবি, মনে হয় দুর্যোগ থেকে বাঁচবার জন্য হাওরবাসীদের চেয়েও তাঁর নিজের উৎকণ্ঠা বেশি :

নতুন পোশাকের নতুন রঙে
হিরালী, তোমাকে সাজাব ফের
উঠোনে আঁকা হবে নতুন আলপনা, জ্বালব রাতে সেই
মোহন বাতি

বাছাই বীজধান তোমাকে দেব
গাভী ও মোরগের নিখুঁত জোড়া
হিরালী, হুংকারে বৃষ্টি ও বিনাশ থামাও শুধু
থামাও আজ এই পাষাণ খেলা

মনে হয় নির্দিষ্ট কোনো ঝড়-শিলাবৃষ্টির কথা বলা হচ্ছে না এখানে, রোজ কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে, ইয়া নফসি ইয়া নফসি জপছেন কবি, আর এভাবেই এ-পরিস্থিতিও যেন স্বতন্ত্র প্রতীকের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়ে যায়।

কিন্তু, এরপরও, কবিতাটির সমাপ্তিকথার মধ্য দিয়ে নতুন প্রযুক্তি বা উপাদান-উপকরণের উল্লেখ না-করেও প্রকৃতির কাছে মানুষের অসহায়ত্বের কথা বলে নিজের অবস্থান চিহ্নিত করছেন কবি : ‘তবু ঝড় আসে। নিষ্ঠুরতম শিলাবৃষ্টি হয়। সমস্ত হাওড়ের প্রায়-পাকা ধান ঝরে যায়। বিবর্ণ হাওড় ধর্ষিতা নারীর মতো পড়ে থাকে। রাত নামে, গাঢ় কালো রাত। হাওড়ের তীরে কারও ঘরে বাতি জ্বলে না।’ হাওরপারের মানুষের এই অসহায়ত্ব আজও শেষ হয়নি, হিরালীর মন্ত্রপাঠ কাজে লাগুক বা না-লাগুক, তাদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায়নি এখনো, যতদিন এই অবস্থা থাকবে ততদিন এই কবি হাওরের বাইরে অবস্থান করেও হাওরেরই একজন, বলা যায় তাঁদের ঐকতান-এরই ঘনিষ্ঠ প্রতিভূ।

বাস্তবে আমরা যে জানি শহরেরই বাসিন্দা এবং তাও নাগরিক স্থিতিব্যবস্থার উচ্চ আসনেই তাঁর অবস্থান। তারপরও একথাও তো অন্যায্য নয় যে, কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় কবি অবস্থান করেন না। কথাটি আরও বেশি সত্য মনে হবে তাঁর একটি চিহ্নায়ক কবিতা ‘রাখালের রূপকথা’ পড়লে।

তিনটি পর্বে রচিত এই নাতিদীর্ঘ কবিতাটি প্রথম পাঠে মনে হয় খুব সহজ, কিন্তু আসুন একটু ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করি :

এই যে শহর দেখ তুমি এ শহরে একদিন
বাদামি রঙের আরো এক নিরীহ রাখাল ছিল
তার হাতে ধরা ছিল কামধেনু, রাখালের বাঁশি
এখানে চরাত নিয়মিত প্রাণের পরাগ

এ কোন শহরের কথা বলছেন মোহাম্মদ সাদিক? ঢাকা শহরের কথা, নাকি দৃশ্যত ফেলে-আসা আধাগ্রাম-আধাশহর সুনামগঞ্জের কথা? শহরে রাখালের বিচরণের কথাই বা উঠে এল কেন, নাকি কৃষ্ণের পৌরাণিক নগরের কথা মনে করেই লেখা হয়েছে? এইসব কারণে সহজ কবিতাটিও সহজ না-হয়ে, হয়ে-ওঠে ধাঁধাময়। আবার এইসব আক্ষরিক জ্ঞানতথ্যের বাইরে গিয়ে কবিতাটির দ্বিতীয় পর্বের শেষ স্তবকটি যদি পড়ি : ‘শুধু সে রাখাল আর এ শহরে হাঁটে না কোথাও/শুধু সে বাঁশির সুর এ শহরে শুনি না কখনো/শুধু সে মৃত্তিকা আর নিরিবিলি হয় না সবুজ/শুধু সে সাদিক আর ভালোবেসে লেখে না কবিতা’, তখন, বুকে এমনই এক হাহাকার তৈরি হয় যা আর সহজে থামে না এবং না-থেমে আমাদের অর্থারিক্ত ব্যঞ্জনার দিকে ধাবিত করে, সকল পাঠকেরই নিজেকে সাদিক বলে মনে হয়। এভাবেই আমরা পড়তে বাধ্য হই তিন পঙ্ক্তির, মূলত ধুয়ার মতো করে লিখিত, ‘রাখালের রূপকথা’র তৃতীয় পর্বটিও :

এই যে শহর দেখ তুমি এ শহরে একদিন
বাদামি রঙের আরো এক নিরীহ রাখাল ছিল
আজ আর খুঁজে খুঁজে তাকে তুমি পাবে না কোথাও

এখন এ-কবিতাটি একাধিক অর্থে পড়তে পারি। পড়তে পারি আগের মতো শিল্পে অখণ্ড মনোযাগ দিতে না-পারা কোনো কবির আত্মযন্ত্রণা হিসাবেও, এমনকি পড়তে পারি রাজনৈতিক কবিতা হিসাবেও। কারণ কবিতার দ্বিতীয় পর্বে আমরা পড়েছি শহরে রাখালের বুকে এখন ট্রাক, রোলার আর মোটরের ঝাঁক চলছে। তবে এই শহরের রাখালের বুকে যতই যন্ত্র চলুক তাঁর শহর শেষপর্যন্ত আধাগ্রাম-আধাশহরেরই সমন্বয়। তাঁর ‘ঋণাত্মক’ শিরোনামের কবিতায় আছে ‘ধারারগাঁ থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে ধারার গাঁ/যুদ্ধ আর সন্ত্রাসের এ শহরে এই পাথুরে প্রতীক’-একথা তো ঠিক যে আলাদা বিষয় ও তাৎপর্যে ব্যবহৃত না-হলে এই গ্রাম আর এই রাজধানী শুধুই নামমাত্র, অন্য কিছু নয়। ‘পরিচয়-পত্র’ কবিতায় তিনি স্পষ্টভাবেই লিখেছেন :

তাড়িত কুকুর যেন এ শহরে ছুটে আসি; বেহায়া মাটিতে
মুখে রেখে মৌন, ভাবি- স্বর্গের ঠিকানা পেয়ে ধন্য এ জীবন।

আমি তো চাষার ছেলে কর্দমাক্ত ঘামে-শ্রমে নিরীহ মানুষ
দেহের শোভন ছায়া মাছ-জল খানাখন্দ বিলের আকাশ

তাড়িত কুকুর যেন এ শহরে ছুটে আসি; কেউ নেই পাশে
ওরা তো হৃদয় খুঁড়ে এ বেলায় বেদনা জাগাতে ভালোভাসে

কবির এই স্পষ্ট স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত তা ভুল না সত্য এই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হয় না পাঠককে, কারণ লক্ষ করলে দেখব বিশেষ কোনো স্থানে ও কালে জন্মগ্রহণ করেছেন বটে, কিন্তু মনে ধারণ করেন এক সারভৌম দেশের অস্তিত্ব আর চেতনায় চিরকালের অমোঘ সংবেদন। মাতৃভূমির কঠিনতম সময়ে তিনি লিখেছিলেন, বাংলাদেশ সিন্দুকে-রাখা সেরকম একটি মূল্যবান দলিল, যা আসলে নেই, অথবা থাকলেও তা স্বাক্ষরহীন; লিখেছিলেন এমন উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তিও : ‘আমি আমাদের স্বাধীনতার মতাই ব্যর্থ হয়ে গেছি, পিতা’, আবার তিনিই লেখেন, ‘শ্মশানে হরিশচন্দ্র’-এর চিরকালীন অভিব্যক্তি ধারণকারী এক আশ্চর্য কবিতা।
এইসব কথা লিখতে গিয়ে আজ মনে পড়ছে একসময় আগুনে হাত রেখে যে-কবির যাত্রা শুরু হয়েছিল হঠাৎ একদিন এক দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তাঁর একটি কবিতাবিষয়ক কবিতা পড়ে তার চিন্তার নতুনত্বে এবং বিষয়ের ব্যথিত অভিব্যক্তিতে আলোড়িত হয়েছিলাম, সেই কবিতাটির নাম ‘বিদায় কবিতা ও অন্যান্য শব্দ’ :

আঙুলের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাচ্ছে ধান শব্দ রাত
বিদায় কবিতা
তোমাকে বিদায়
যেরকম আকাশ বিদায় করে বৃষ্টি যেরকম বৃষ্টিও বিদায়
করে আলো, যেরকম ভালোবাসাও বিদায় করে তার
সম্মানিত স্মৃতি

প্রথম পঙ্ক্তিতে আলাদা আলাদাভাবে ব্যবহৃত তিনটি শব্দ ‘ধান শব্দ রাত’-এর ব্যঞ্জনা ভীষণ তাড়িত করেছিল, আজও করছে, ভাটির সন্তান আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল ধান-মাড়াইয়ের সেইসব ধানগন্ধ ধানশব্দময় রাতের স্মৃতি। তবে একথাও ঠিক সেদিন পুরাটা বুঝে উঠতে পারিনি তখনই কী অভিমানে ‘কবিতা’কে বিদায় জানাচ্ছেন কবি। এরপর কবিতাটি যে-বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হয় সেখানে ‘বাংলা কবিতা’ শিরোনামের একটি কবিতা খুঁজে পাই যার প্রথম পঙ্ক্তি ‘যার হরিণ হবার কথা ছিল/সেই বাংলা কবিতা যেন এক হালের বলদ’, আর কবিতাটি শেষ পঙ্ক্তিগুলো হলো :

যার হরিণ হবার কথা ছিল
সে এখন হালের বলদ
যাদের ঝাঁকে ঝাঁকে বেঁচে থাকার কথা ছিল, তারা এখন
নির্বাসিত, নিঃসঙ্গ।

আমাদের সৌভাগ্য যে মোহাম্মদ সাদিকের নিজস্ব জঙ্গলে আজো বহু হরিণের চলাফেরা লক্ষ করছি।

 


মোস্তাক আহমাদ দীন

জন্ম ১৯৭৪ সালে, সুনামগঞ্জ জেলায়।

প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ
কথা ও হাড়ের বেদনা, প্রকাশক, পাঠকৃতি, সিলেট, ২০০১।
জল ও ত্রিকালদর্শী, প্রকাশক অর্কিড, সিলেট, ২০০৪।
জল ও শ্রীমতী, প্রকাশক পাঠসূত্র, ঢাকা, ২০০৮।
ভিখিরিও রাজস্থানে যায়, প্রকাশক, বইপত্র, সিলেট, ২০১২।
বানপ্রস্থের আগে, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৪।
স্ফটিকচূড়ার নিচে, প্রকাশক, বাতিঘর, ঢাকা, ২০২০।
কবিতাসংগ্রহ-১, প্রকাশক, চৈতন্য, সিলেট, ২০২০।
মাটির বইয়ের পাতা, প্রকাশক, পুণ্ড, ঢাকা, ২০২৩।

প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ
কবিতাযাপন প্রকাশক, শুদ্ধস্বর, ঢাকা, (২০১১); চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৮।
আটকুঠুরি, প্রকাশক, শস্যপর্ব, সিলেট, ২০১২; চৈতন্য সংস্করণ, সিলেট ২০১৫।
মাটির রসে ভেজা গান, চৈতন্য, সিলেট, ২০১৭।
কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০১৭।
মননচিন্তা বিবেচনা, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৮
কবিতা পড়ার পরে, জলধি, ঢাকা, ২০২৩।।

অনুবাদ
তারিখে জালালি [১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সিলেটের ইতিহাসের প্রাচীনতম গ্রন্থ] মূল মবশ্বির আলি চৌধুরী, প্রকাশক, উৎস, ঢাকা, ২০০৩।

সম্পাদিত গ্রন্থ
পরার জমিন, মকদ্দস আলম উদাসী, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
আবদুল গফ্ফার দত্তচৌধুরী : তাঁর স্মৃতি, তাঁর গান, প্রকাশক, লোকচিহ্ন, সিলেট, ১৯৯৯।
অকূল নদীর ঢেউ, শাহ সুন্দর আলী, প্রকাশক, শঙ্খ, সিলেট, ২০০৪।
মাসিং নদীর তীরে, ফকির সমছুল, প্রকাশক, বিকাশ, সিলেট, ২০০৫।
নূরে মারিফত, শাহ ছাবাল আলী, প্রকাশক শাহ তেরাব আলী কামারগাঁও, সুনামগঞ্জ, ২০০৫।
ছহি ফকির বিলাশ অর্থাৎ মারফতি ভেদ, মুন্সী মোহাম্মদ আশ্রফউদ্দিন, প্রকাশক শুদ্ধস্বর, ঢাকা, ২০১০।
কামালগীতি,কামাল উদ্দিন, শুদ্ধস্বও, ঢাকা, ২০১০।
আশিকের রত্ন সমগ্র, ফকির সমছুল, প্রকাশক শঙ্খ, সিলেট, ২০১২।
এ, জেড, আব্দুল্লাহ রচনাসমগ, কেমুসাস, সিলেট, ২০১৭।
নির্বাচিত গান, মকদ্দস আলম উদাসী, জগন্নাথপুর উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ, ২০১৭।
পূর্বাপর, রবীন্দ্রমূল্যায়নগ্রন্থ, শ্রীহট্ট ব্রাহ্ম সমাজ, সিলেট, ২০১৯।
শত জলঝর্নার ধ্বনি, শামসুল করিম কয়েস মূল্যায়নগ্রন্থ, ঘাস, সিলেট, ২০২০।
নির্বাচিত কবিতা, দিলওয়ার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০২০।
বাঙ্গালা ও বাঙ্গালার বাহিরে যে সকল দুব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক, ই.
এফ, সি ডালি, চৈতন্য, সিলেট, ২০২১।
ভেদ জহুর [নাগরী লিপিতে লিখিত ফকিরি তত্ত্বগ্রন্থ], শাহ মজিরউদ্দিন আহমদ, চৈতন্য, সিলেট, ২০২৪।
যাওয়ার পথে, ফকির সমছুল, চৈতন্য, সিলেঠ, ২০২৪।

সম্পাদিত সাহিত্যপত্রিকা
বিকাশ [১৯৯১-১৯৯৭]
মুনাজেরা [২০০৮ থেকে চলমান]

শেয়ার