অমায়িক খচ্চর | সেলিম মোরশেদ

সুবিমলদা বসেন ‘জারি বোবাযুদ্ধ’র টেবিলে, প্রচেতার সঙ্গে। প্রচেতা ঘোষ উপন্যাস লেখেন, বোবাযুদ্ধের দু’জন সম্পাদকের একজন, তার গায়ের রঙ ভয়ানক শাদা, কালো ঘন চুল, মুখের গড়ন ভারী, লম্বা চওড়া শরীর, থুতনি আর ঠোঁটের সঙ্গে মিলিয়ে থাকা অভিজাত শ্মশ্রু। কোলকাতায় এমন সুপুরুষ মনে হয় হাতে-গোণা।

 

    কোলকাতা বইমেলায় জীবনে আটবার গিয়েছি, লেখাটা কোনো একবারের কিংবা চার-পাঁচবারের অবলোকন; সময়ও ঠিকমতো না-ও থাকতে পারে, বস্তুনিষ্ঠতা তাতে ব্যাহত হবে না।

     যে হোটেলে উঠি সেটা পার্ক স্ট্রিটে। চিনিয়ে দিয়েছিলেন খান ভাই। বিল্ডিংটা সামন্ত ঐতিহ্যের সম্পন্নতা নিয়ে। চুন-সুরকির খসে যাওয়া অবয়বে রঙ দেওয়া পরিচ্ছন্নতা, তাই, নিজের বাড়ি-বাড়ি এরকম একটা অনুভব। রুমগুলো বড়ো বড়ো, যথেষ্ট দূরত্ব রেখেই চার-পাঁচজন থাকা যায়। ভাড়া কম। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটা হোটেলের সামনে। রাস্তায় ঝিম মেরে থাকা সারি সারি হলুদ আর কালো ট্যাক্সিগুলো বসে পাখিদের মতো।

     বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলার জন্যে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান রাস্তার ওপাশে। বয়ে যাওয়া সামনের রাস্তাটা মৃদু নির্জনতা নিয়ে একা। বাউন্ডারির বাইরে পাঁচিলের একপাশের গা ঘেঁষে বেঞ্চপাতা ছোটো একটা দোকান। ঘন দুধের চা, গ্লাসে। পাউরুটির পাইসে ডিম দিয়ে ভেজে পরে চিনি দেয়। টোস্টের ধরন কড়কড়ে বা মচমচে না। কোলকাতার বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন স্টল খুব কম, টেবিল আর চেয়ার শ’য়ে শ’য়ে। ব্যতিক্রম শুভংকর আর শর্মীর গ্রাফিত্তি, অখ্যাত অথচ উপযুক্ত, অবশ্যই বৈষয়িক অর্থে লাভশূন্য, এতো বই ঘরের পয়সা দিয়ে বের করে বলে এদের একটা স্টল নিতে হয়। বাংলাদেশে ‘উলুখড়’ও এমনই একটা কাজ করছে, একসময় ওদেরও একটা স্টল নিতে হবে।

     বয়োজ্যেষ্ঠদের ভেতর সুবিমলদা বসেন ‘জারি বোবাযুদ্ধ’র টেবিলে, প্রচেতার সঙ্গে। প্রচেতা ঘোষ উপন্যাস লেখেন, বোবাযুদ্ধের দু’জন সম্পাদকের একজন, তার গায়ের রঙ ভয়ানক শাদা, কালো ঘন চুল, মুখের গড়ন ভারী, লম্বা চওড়া শরীর, থুতনি আর ঠোঁটের সঙ্গে মিলিয়ে থাকা অভিজাত শ্মশ্রু। কোলকাতায় এমন সুপুরুষ মনে হয় হাতে-গোণা। কলকাতায় বোবাযুদ্ধসহ কয়েকটি ছোটো কাগজ আমার প্রিয়, লেখা চেয়েছেন শুভংকরের বেশ কয়েকজন সম্পাদক-বন্ধু, দেওয়া হয়নি, ভালো কোনো লেখা হলে হয়তো দেবো। শুভংকরসহ ওখানে আমার কিছু বন্ধু আছে যাদের আমি ভালোবাসি। স্বতঃস্ফূর্ত থাকি। ওরা পছন্দ করে। একটা বিষয় ভিতরে রাখি, যদিও বন্ধুত্বে কোনো চিড় ধরেনি, ভালোবাসা কমেনি-কিন্তু আমাকে সতর্ক রাখে। ছোটো কাগজ বড়ো কাগজ মেজো কাগজ নিয়ে এতো ফাটাফাটি, নানামুখি বিস্ময়কর ডিসকোর্সের আর ঐক্যের ভেতরেও একটা পয়েন্ট সংগুপ্ত অর্থে সবাই যেন লালন করেন, কলকাতার কৃপা ছাড়া বাংলা সাহিত্যে দাঁড়ানো মুশকিল। গোটা বাংলা সাহিত্যের একক উত্তরাধিকার তারা ধারণ করেন। এরকম ভাবনাটা কেন মনে হয় জানি না। তিনশো বছরের মিডল ক্লাস, একটা ধারাবাহিক স্থিরতা এসেছে সত্য, মননের দিকটাও পুষ্ট। সিপিএম-এর রাজনীতি অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত তাদের চেতনান্তরকে অগ্রবর্তী করেছে। ব্যাসিক কিছু বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গে ইনস্টিটিউশনগুলো যথেষ্ট সৃজনশীল হওয়ায় পরিশীলন মননের সূক্ষ্ম দিকগুলোও অগ্রবর্তী।

     বাংলাদেশে বিষয়টা ভিন্ন। আধ্যাত্মিক হোক আর বাস্তবিকই হোক একাত্তরের বিপ্লবটা সগৌরবের, সন্দেহ নেই, একজন বাঙালির কাছে এর চেয়ে বড়ো অহংকার আর নেই। কিন্তু এ যুদ্ধ সাম্য তো দূরের কথা ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধারাবাহিক অনগ্রসরতা, পেছনে রয়েছে দুর্বৃত্ত পুঁজি, ফলে এক্ষেত্রে যেমন হয়-অপুষ্ট বুর্জোয়া মনন ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধির মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে কোনো পরম্পরার ক্ষীণ সুতোটা ধরে রাখা মুশকিল, পুঁজিবাদী অবস্থা শেকড়ের নামে কোথাও আটকে থাকে না। সে জমি থেকে বিচ্যুত হবে, তার দেহই সম্পদ। সে মুক্ত মানুষ হবে। এমন নির্মম একটি পরিস্থিতি। আমার কাছে বাস্তবতাটা এমন, বায়ান্ন’র ভাষা-আন্দোলন এবং একাত্তরের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা যুদ্ধ বাংলাদেশের অধিবাসীর ওপর রাজনীতিক, অর্থনীতিক, সামাজিক-(ব্যক্তিযাপন অর্থে) ও সাংস্কৃতিক মননের একটা বড়ো অংশের ওপর নতুন পরম্পরার প্রেক্ষিত তৈরি করেছে। আমি নিজে কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রটির সঙ্গে যুক্ত। সে জন্যে আমার কিছু উপলব্ধি এসেছে, অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাপক দুর্মতিও এসেছে; অন্যতম কারণ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ধারা অন্যান্য সবকিছুর মতোই আমূল বাঁক নিয়েছে। সাহিত্যের গোটা পরম্পরা, যেটা পশ্চিম বাংলার সেই ত্রিশ দশক থেকে এ বাংলাকে নিয়ে যে সঙ্গতি রক্ষা করে চলছিলো, কবে কোন অজান্তে তা লবণের বস্তার মতো এখন ম্রিয়মাণ, ও-বাংলার সেই সব লেখকরা এতোটা অনাহৃত হয়ে পড়লো যে বারবার অবাকই হই। এর সঙ্গে কোনো উগ্র স্বাদেশিকতা, প্রবল জাতীয়তাবাদী মনন বা কোনো তৈরি হওয়া নিজস্বতার বিষয় না। আমি কলকাতার তিনশো বছরের মননের সঙ্গে ঊনচল্লিশ বছরের বাংলাদেশের এলোপাতাড়ি সুশীল সমাজের কোনো প্রতিতুলনার মানসিকতা নিয়ে বলছি না। বিষয়টা একটা বিস্ময়কর প্রেক্ষিত। বাংলাদেশের পাঠককুলের ভেতর দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত অজান্তে একটা বিষয় তৈরি হয়ে উঠেছে। একদম চেনা বাস্তবতার কোনো ঘটনা, তার নিজের ঘরের একান্ত পরিপার্শ্বের যা তার প্রাত্যহিক বাস্তবতা ধারণ করে অথবা আধুনিক বা আন্তর্জাতিক মননসর্বস্বতার প্রাধান্যকেন্দ্রিক লেখা। মনোভঙ্গিটা এমন হওয়ায় এই দুটোর বাইরে কোনোকিছুই তারা নেয় না। অনুসন্ধানে জেনেছি এবং বাংলাবাজারের বই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করেছি, ও-বাংলা থেকে বই পাইরেট হয়ে এখানে যে বিক্রি হয় এগুলো খুব সত্য না। যে পরম্পরা নিয়ে বাংলাদেশের সাহিত্যের সঙ্গে কলকাতার লেখকদের যুক্ত হওয়া উচিত ছিলো, তা হয়নি। হাতে-গোণা কয়েকজন ছাড়া এখানে সেইসব লেখকের বই এখন আর চলে না। একথা বলা যায়, বিগত বছরের পর বছর পশ্চিম বাংলার লেখকেরা যে লেখাগুলো লিখেছেন, তা শিক্ষণীয়, সম্মান করার মতো। কিন্তু কোটি মানুষের সত্তার সঙ্গে তারা একাত্ম হতে পারেননি তাদের সঙ্কটের ভেতর দিয়ে। ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের অনুক্ত ক্রন্দন এবং টিকে থাকা ব্রাত্যজনের প্রতি মমতা ছাড়া কোনো অগ্রগামী সঙ্কট দেখা যায়নি লেখায়। যে ব্রাত্যজন নিজেও তার ভাগ্যকে যতোটা অতিক্রম করতে চায় লেখক সেই দিকে না গিয়ে মধ্যবিত্তের জায়গা থেকে সহমর্মিতার ভেতর দিয়ে নিজের গ্লানিবোধই প্রকাশ করেন। উঠতি পুঁজির দুর্বৃত্ততার সঙ্গে বোধ এবং যাপনের কী নির্মম আর টাইটাই লড়াই এখানে মধ্যবিত্তকে করতে হয় সেটা কল্পনাতীত। ফলে ঢাউস ঢাউস বই লেখা, চরিত্র তৈরি করে সহমর্মী হওয়া, ভাবের ঐক্য, ঘটনার বিস্তার, সাবলীল পরম্পরা এসবের প্রেক্ষিত ওভাবে নেই। সেই ক্ষীণ পরম্পরার ঐক্য বাংলাদেশের লেখক-মননের সঙ্গে যুক্ততার প্রবল সম্ভাবনা যদি থাকে-আমার প্রায়শ মনে হয়, কেবলমাত্র কয়েকজন লেখকেরই আছে এখনো। কমলকুমার মজুমদার, অমিয়ভূষণ মজুমদার, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, উদয়ন ঘোষ, বাসুদেব দাসগুপ্ত, অসীম রায়, সুবিমল মিশ্র। তরুণদের ভেতর নবারুণ ভট্টাচার্য, মুনশি এএম আফসার আমেদ ও সোহারাব হোসেন। কখনো কখনো মলয় রায় চৌধুরী, কমল চক্রবর্তী, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়, আরেকটু শিথিল হলে গুণময় মান্না ও রবিশঙ্কর বল। তাহলে ব্যাপক উচ্চারিত লেখকরা যাদের এতো নাম শুনি, বইগুলো যে আসে, দেখি-পড়ি, নিঃসন্দেহে তারা বড়ো কিন্তু জনমানসলোকে, এবং অবশ্যই শস্তা নন। কিন্তু বাংলাদেশের সাহিত্যিকদের মানসলোকে কোনো সংযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে তারা অক্ষম। বলতে চাচ্ছি এই কথাটা-এক মোমবাতি থেকে আরেক মোমবাতি জ্বালানোর যে পরম্পরা সেটা কেটে গেছে। ওই ক্ষীণ পরম্পরা ধরে রেখেছেন কেবল ওপরের লেখকরা। এটা স্বগতোক্তি, কোনো জরিপে না, কোনো বিচারে না। কথাটা বোধহয় এরকম: ‘পদ্মানদীর মাঝি’-এখন টোটাল একটা টেক্সট, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-ইনার এন্থেটিক্স আর ‘চতুষ্কোণ’ সেই বই যা নিয়ে সমসাময়িক বাংলাদেশের সাহিত্য বর্তমান পরম্পরা ধারণ করে আন্তর্জাতিকতার দিকে যেতে চায়। ক্লেভারবুক বলে যদি কিছু থাকে ‘রহু চণ্ডালের হাড়’ তেমনি একটি গ্রন্থ। হাজার বছরের ‘রহু’ আর তার সম্প্রদায়কেন্দ্রিক ঘটনাপ্রবাহ এবং তৎপরতা চল্লিশ-পঞ্চাশ পাতার পরে তরমুজ ক্ষেতের ভেতরে যুক্ত হয়। ছাড়া ছাড়াভাবে ঘটনাক্রম। যথেষ্ট তথ্য না পাওয়ায় ঘটনার বিস্তার নেই, কল্পনাশক্তির অভাবে দীর্ঘকালীন আবহ তৈরি করার অক্ষমতা, দেখা গেছে বইটা অসম্পূর্ণ। ‘দেবাংশী’ সে অর্থে পূর্ণতা দেয়। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ এবং ‘সময় অসময়ের বৃত্তান্ত’ এ সময়কার নতুন টেক্সট। যদিও সে বিশ্বায়নে যতোটা ভৌগোলিক চোখ ছিলো অন্তর্গত দৃষ্টিতে নেই ততোটা সৌন্দর্য। তবে ‘তিস্তাপুরাণ’ লেখাটা বাংলাদেশের গুণী কয়েকজন তরুণ লেখকের মানসলোকে ছাপ ফেলেছে। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের মতো লেখকের মুখেও প্রশংসা শুনেছি এবং মাহবুব মোর্শেদের ভালো লেগেছে বলে শুনেছি। সুনীল, শীর্ষেন্দু, অতীন, বরেন, মতি নন্দী এমনকি ‘অলীক মানুষ’ ও ‘তৃণভূমি’-র রচয়িতা সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের মতো লেখকও পশ্চিম বাংলার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট ধরতে ব্যর্থ হয়ে গোয়েন্দা কাহিনী লিখে চলেছেন। মহাশ্বেতা দেবী তার বিষয়বস্তু অতিক্রম করে কখনো শিল্পরূপের দিকে আজো তাকান না-বৈচিত্র্য অর্থে। ফলে তিনি না হয়েছেন ক্লাসিক না মডার্ন, পূর্ব-প্রগতির একটা সম্মান বহন করে চলছেন। মহৎ লেখক হবার অনেক উপাদান ছিলো সমরেশ বসুর ভেতর, হতে চাননি। অদ্বৈতমল্ল বর্মণ এবং সতীনাথ ভাদুড়ী প্রকৃত অর্থে ক্লাসিক। দর্শনগত দিক দিয়ে যদিও তারা একমুখী ছিলেন না। শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে। আনন্দবাজারে চাকরি করতেন তিনি, গল্প লিখতেন দুর্দান্ত, কিভাবে খণ্ড খণ্ড যোনি, উরু, শিশ্ন, মাথা আক্ষরিকভাবে দাঁড়িপাল্লায় বাজারে বিক্রি হয় এ ধরনের বিষয়বস্তু নিয়েও। বলতেন, আমরা যারা সাংবাদিক আর যারা যৌনকর্মী তারা একই। তফাৎ হচ্ছে যৌনকর্মীরা তাদের পেশা নিয়ে গর্ব করে না, আমরা করি। বাংলাদেশে লেখকদের সম্পর্কে বলতেন, ওরা কেউটে হয়ে জন্মায় আর ঢোঁড়া হয়ে মরে। কারণ কী এখন বুঝি। পশ্চিম বাংলার দিকে বরাবরই চোখটা ছিলো এদেশের লেখকদের। প্রেক্ষিত পাল্টে মানদণ্ডটি অন্যদিকে চলে গেছে। যেসব স্বগতোক্তি ভাবনা থেকে তার ডালপালাও প্রচুর। যাইহোক, একটু সরে গিয়ে অন্যভাবে পেছনে তাকালে অনেক প্রশ্নের বিষয় হিজিবিজি। কে বাঁচাবে-অতুল সুর না অন্য কেউ? বাংলার নিজস্ব ভাষা হচ্ছে বাংলা। প্রমাণিত, ভাষার ভিত্তি স্থাপন করেছে আদিম অধিবাসীরা। অর্থাৎ প্রাক্-দ্রাবিড় গোষ্ঠী। বাংলাভাষায় এই গোষ্ঠীর শব্দসমূহের প্রাচুর্য সাক্ষ্য দেয়। বাংলার প্রকৃত আদিভাষা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষা অস্ট্রিক, এই ভাষার বিস্তৃতি ছিলো পাঞ্জাব থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের ইস্টার দ্বীপ পর্যন্ত। ‘মুণ্ডারি’ এই ভাষার প্রতিভূ। এই নরগোষ্ঠীর ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে অন্যান্য নরগোষ্ঠীরা ধাপ তৈরি করেছিলো। এরপর আর্যভাষাভাষী নরগোষ্ঠী। এরা ইউরোপের আলপাইন নরগোষ্ঠীর সমতুল্য। এদের অস্তিত্ব পশ্চিম বারানসী থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত। সমুদ্রপথে বাংলাদেশে এসেছিলো এবং উত্তর প্রদেশের পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েছিলো। পরবর্তীকালে ভারতে এসেছিলো আরেক শ্রেণির আর্যভাষী। তাদের বসবাস উত্তর-পশ্চিমের সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে পঞ্চনদের উপত্যকায় আশ্রয় নিয়েছিলো। এরা রচনা করেছিলো ‘ঋগবেদ’। বিস্তৃত হয়েছিলো মিথিলা পর্যন্ত। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ নামক একখানি প্রাচীন বৌদ্ধগ্রন্থে বলা হয় বাংলাদেশে আর্যভাষাভাষী লোকরা অসুর জাতিভুক্ত। ‘আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প’ অষ্টম শতাব্দীতে লেখা হয়। লক্ষণীয়, বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে অসুর শব্দটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় দেবগণের বিরোধী হিসেবে। অসুর মানে এই না-আর্যপূর্ব যুগের কোনো দেশজ অধিবাসী। বিচার্য সাহিত্য তো অনেক পরে, নৃতাত্ত্বিক নরগোষ্ঠীর বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যে জনগোষ্ঠী সামনে এসে দাঁড়ায় সেই জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিকতার সঙ্গে ভাষার উৎপত্তি বিকাশ, মনন আর সেইসঙ্গে সাহিত্যের প্রশ্নটা আসে বলে জানা বা অস্পষ্ট বিষয়গুলোকে ঝালাই করে নেয়ার এই ইচ্ছাটা। আর্য-প্রাক্ বাসকালে অসুরদের ভেতর একটা বিশিষ্ট জীবনচর্চার ধর্ম গড়ে উঠেছিলো। এই নতুন ধর্মকে তারা ‘দেইবো’ বা (প্রাচীন ইন্দো-ইউরোপীয়) বা ‘দইব’ (ইন্দো-ইরানীয়) ‘দেব’ (সংস্কৃত) নামে অভিহিত করতো। আর আর্য ভাষাভাষী অপর গোষ্ঠী তাদের আরাধ্যমণ্ডলীকে অসুর নামে অভিহিত করতো। বৈদিক সাহিত্যে অসুরদের যেমন নিন্দা এবং কটাক্ষ করা হয়েছে আবার প্রধান আরাধ্য-দেবতা ‘ইন্দ্র’ ও অন্যান্য দেবতাগণকে অসুর বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রমাণিত দেব- উপাসকগণ এবং অসুর-উপাসকগণ উভয়ই সাধারণ অঞ্চলে বাস করতো। আর্যরা যখন দেব-উপাসক ও অসুর-উপাসক দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়লো, তখন অসুর উপাসকমণ্ডলীর প্রধান আরাধ্য হলো বরুণ। আর দেব-উপাসকদের ইন্দ্র। যারা মার্জিত রুচিসম্মত চিন্তাশীল ছিলো এবং যাদের জীবিকা ছিলো মুখ্যত কৃষি ও গো-পালন তারাই অসুরপন্থী। আর যারা সভ্যতার মানদণ্ডে অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধার দল ছিলো তারা হয়েছিলো দেবপন্থী। উত্তরকালে এই অসুরপন্থীরা এশিয়া মাইনর, ইরান ও ভারতে বসতি স্থাপন করে। আর দেবপন্থীরা উত্তর-পশ্চিম গিরিপথ দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। দুর্গা যে অসুরকে বধ করছে, যে দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করা হোক না, দুর্গাকে একপেশেভাবে গুরুত্ব দিয়ে এই পুজো উৎসবটি তেমন সমীচীন না।

 


রিজলী-র মতে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে। একাধিক শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিকদের মতে আধুনিক বঙ্গজাতির এই পর্যন্ত উৎপত্তি এবং বিকাশ আদি-অন্তাল এবং দ্রাবিড়দের দ্বারা। প্রমাণিত ধারাটা এই। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় অবশেষে, দূর থেকে ছুটে আসা আগত এক তাজা ঘোড়া আর লাফ দিতে দিতে এগিয়ে আসা এক কোমল গাধা-এই দুয়ের সংমিশ্রণে দুর্দান্ত গতিশীল এবং কঠোর আত্মত্মত্যাগ নিয়ে এই ‘অমায়িক … খ’… বা হাজার বছরের বাঙালি এবং তার সত্তা।

 

     তবে উৎপত্তির দিকে গেলে বিশটি আদি নৃগোষ্ঠীর ভাষানুসারে ১৯৪১ সালের সেন্সাস রিপোর্টে বাংলাদেশের সমাজগুলোর নাম বলা হয়েছে। ভেটিয়া, চাকমা, দামাই, গুরং, হাদি, কামি, খাসি, কুকি, লেপচা, লিসব, মাগর, মেচ, মুণ্ডা, নেওয়ার, ওরাঁও, সাওয়াল, সারকি, টিপর, কোল, খন্দ, ধনুরাই, সনুয়ার, টিপবা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় লুসাই ভাষাকে ছাত্র-পরীক্ষার্থীদের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকার করেছে। আদিবাসীদের পৃথক ভাষা রয়েছে। হিন্দুধর্ম তা ধারণ করেছে। এই প্রসঙ্গে এলুইনের মন্তব্য অবাক করে। তিনি (ডিস্টিঙ্কট অ্যাপার্ট) দেখেছেন হিন্দু সমাজের মধ্যে শত শত শ্রেণি, আশ্রম ও জাত রয়েছে। এত বিভিন্ন ও বিচিত্র-শাক্ত, সৌর, গাণপত্য, বৈষ্ণব, বৈদান্তিক ও তান্ত্রিক রয়েছে-২যারা পরস্পর বিশিষ্ট এবং পৃথক। কেমন হিন্দু তারা? অধিবাসীদের এতো ঘনিষ্ঠ রূপে বুঝতে পেরেও মি. এলুইন কেন ওদের পার্থক্যগুলোর ওপর এতো জোর দিয়েছিলেন?

     হিন্দু সমাজের কুপ্রথাগুলো যেন না গ্রহণ করে তার জন্য কি এতো সাবধানতা? বহুকাল থেকে আদিবাসীরা আপনাআপনি হিন্দু ধর্মে চলে এসেছিলো। আবার খ্রিস্টান মিশনারির উদ্যোগে কিছু কিছু আদিবাসী খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম আদি অধিবাসীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। লক্ষ লক্ষ হিন্দুর ওপর ইসলামের প্রতিক্রিয়া সফল হলেও আদি অধিবাসীদের ওপরে হয়নি। পর্যবেক্ষণের জন্যে লেখক সুবোধ ঘোষের ওপর ছেড়ে দেয়া যায়। তার চিন্তাধারা খুব শাণিত। বঙ্গদেশের বিষয়ে আসতে হলে প্রথমে দেখা যাক ‘বঙ্গ’ নামটি ‘বঙ্গ’ নামটি কার্পাস তুলো জাতীয় শিল্পের সঙ্গে তুলনীয়। ‘বঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ কার্পাস তুলো। ‘পুণ্ড্র’ শব্দের অর্থ ‘আখ’, একইসাথে বলা যায় ‘গুড়’ শব্দ থেকে ‘গৌড়’ এসেছে।

     অষ্টম-নবম শতাব্দীতে পালসিংহাসন উত্তর গাঙ্গীয় ভূমিতে গঙ্গার তীরভূমি সম্পদপ্রাচুর্যে বরেন্দ্রভূমি বা বরেন্দ্রী হয়ে ওঠে। যার অর্থ শ্রেষ্ঠ সরসভূমি-উৎকৃষ্ট ইন্দ্রপুরী। বাম তীরভূমির সঙ্গে বৈপরীত্য স্থাপন করে দক্ষিণ তীরভূমির নাম ‘রাঢ়ভূমি’ বা ‘রাঢ়া’। মহাবীরের পরিভ্রমণ ঘটে এখানে। ‘রাঢ়া শব্দের অর্থ সৌন্দর্য অর্থ বৈভব। লিখতে গিয়ে বুঝছি, পড়তে গিয়ে ভাবছি, কী অসম্ভব সম্পদশালী দেশ ছিলো এই বঙ্গভূমি এতো লাবণ্য, এতো বৈচিত্র্য আর এতো সূত্রমুখ আপাতত খাপছাড়া মনে হয়, কিন্তু এর পরম্পরা খুব অন্তর্গত। ইতিহাসের ফিতে ধরে গজ মেপে সম্ভব না। আহমদ শরীফও দেখি একই-বাঙালি-বাঙালি বাংলাদেশী- বাংলাদেশী করে চিৎকার করলেই আমাদের আত্মপরিচয় মিলবে না। বুঝতে হবে বাংলাদেশের বিশাল ভূ-খণ্ডে সেকালে আঞ্চলিকভাবে জীবন গড়ে উঠেছে, সমাজ গড়ে উঠেছে, অর্থনীতি গড়ে উঠেছে, ধর্ম গড়ে উঠেছে, সাম্য গড়ে উঠেছে, রাজ্য ও রাজত্ব গড়ে উঠেছে, শাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সামন্ত যুগে সর্ববঙ্গীয় বলে কোনো কিছু ছিলো না, সমাজ ছিলো না, রাজ্য ছিলো না, ধর্ম ছিলো নাড়কোনো সংহতিবোধ ছিলো না। ধর্মের ক্ষেত্রেও হিন্দু আমলের সময় একক দেবতার পুজো হয়নি। মনসার পূজা হয়েছে এক জায়গাতে, বিষ্ণুর পূজা হয়েছে আরেক জায়গাতে। এক ধর্মাবলম্বী হিন্দু সমাজ ব্রিটিশ-পূর্বকালে সামন্ত যুগে-বাংলাদেশে ছিলো না।

     থার্ড মিলিনিয়াম কমিটি ফর স্যোসাল ট্রানজিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণ যা পাচ্ছি প্রায় সব সেখান থেকে। বাঙালির ইতিহাস এক হাজার বছরের ইতিহাস। পশ্চিমের সময়ের হিসাব অনুসারে আমরা তৃতীয় সহস্রাব্দে পৌছে গেছি। বাঙালির মধ্যে অর্থাৎ বঙ্গভাষী জনগণের মধ্যে বামুন, কায়েত, বদ্যি আছে, রাজপুত ছত্রী বৈশ্য আছে, যারা নিজেদের খাঁটি বা মিশ্র আর্য বলে মনে করে থাকে; আছে নানাজাতীয় ব্যক্তি যাদের উৎপত্তি হয়েছে দ্রাবিড় বা কোল অর্থাৎ নিষাদ থেকে, মোঙ্গল অর্থাৎ কিরাত থেকে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যেটা বলছেন, পূর্বাপর বাঙালি জাতি বা জনের গঠনের ইতিহাসের ধারাটা এরকম: ভারতে তথা বাংলায় মানুষের বাস ছিলো না। বাইরে থেকে ভারতের অধিবাসীদের পূর্বপুরুষরা বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশ থেকে আসতে আরম্ভ করে স্মরণাতীত কাল থেকে-প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে। প্রথম আসে আফ্রিকা থেকে নিগ্রোজাতীয় মানুষ। আফ্রিকার পরে আরব দেশে আরব সাগরকূল ধরে এরা দক্ষিণ বেলুচিস্তান হয়ে ভারতে আসে। বাংলাদেশেও এদের আগমন হয়, কিন্তু পরবর্তীকালের মানুষ, যারা আসে তাদের হাতে এরা বিধ্বস্ত হয়। বাঙালা হয়ে আসাম, তারপরে বর্মা, বর্মা থেকে ডোঙার রাস্তায় মালয়দেশ, আর ডোঙা করে সাগর পেরিয়ে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ-এইসব দেশে নিগ্রোজাতীয় মানুষের প্রসার হয়, কিন্তু বাঙলায় এদের আর অস্তিত্ব নেই। তারপর নিষাদজাতীয় মানুষ, যাদের ইউরোপীয় পণ্ডিতদের পরিভাষায় অস্ট্রিক বা অস্ট্রো-এশিয়াটিক বলে। এদের ভাষা এখন পরিবর্তিত আকারে কোল, খাসিয়া আর নিকোবরিদের ভাষা বলে বিদ্যমান-মুণ্ডারি, সাঁওতাল, হো, কুরকুঁ, গদব প্রভৃতি ভাষা যারা বলে তারা এদের সাক্ষাৎ বংশধর। সারা বাংলা জুড়ে এদের বাস ছিলো। এখন যারা তাদের মধ্যে বনে-পাহাড়ে গিয়ে আছে তারাই নিজেদের পৃথক সত্তা বজায় রেখেছে, আর বাকি সব বাংলাদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে মিলে গিয়েছে, ভাষা নিজেদের যা ছিলো তা ত্যাগ করে বাংলা নিয়ে ক্রমে বাঙালি হয়ে গিয়েছে। এরা চাষাবাদ করতো, কাপড় বুনতো, ভারতের সভ্যতার বুনিয়াদ হয় এদের হাতে। তারপর আসে দ্রাবিড়ভাষী জাতি। এরা নিষাদদের চেয়ে বেশি উন্নত ছিলো, নাগরিক সভ্যতার পত্তন এরাই করে। এরাও নিষাদদের পাশে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। তারপর নাম করতে হয়, পূর্বদেশ থেকে আগত কিরাতদের। নাক চ্যাপ্টা হলদে রঙ, বেঁটে-খাটো মানুষ ছিলো এরা। এদের বসবাস হয় হিমালয়ের দক্ষিণ অঞ্চলে, উত্তর-বিহার আর উত্তর-বাংলায়, পূর্ব-বাংলায় আর সারা আসাম জুড়ে। সভ্যতায় এরা তেমন অগ্রসর ছিলো না। বাঙালির জনগণের গঠনে উপাদানস্বরূপ এরাও এসেছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব আর পূর্ববঙ্গে। শেষে আসে আর্য ভাষাভাষী জাতি। পাঞ্জাব, উত্তর-প্রদেশ, বিহার, সর্বত্র এই আর্যভাষী জাতি স্থানীয় নিষাদ, কিরাত, দ্রাবিড়দের সাথে অনুলোম আর প্রতিলোমে বিবাহবদ্ধ হতে থাকে।

     এদিকে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তির নিরূপণ করতে গিয়ে স্যার হার্বার্ট রিজলি বাংলার অধিবাসীবৃন্দকে মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড় জাতিদের সংমিশ্রণে উদ্ভূত বলে মত প্রকাশ করেছেন। অতুল সুর তার দীর্ঘ নিবন্ধে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ দিয়ে তা নাকচ করেছেন। নীহাররঞ্জন রায় উদাহরণ দিয়ে নাকচ করেছেন মোঙ্গলিয়ানদের এভাবে, মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর সঙ্গে ভারতবর্ষের ঘনিষ্ঠতর পরিচয় হয়েছে, পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে এইসব মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশে ছড়িয়েছে সন্দেহ নেই, কিন্তু ভারতবর্ষ জনপ্রবাহে এদের স্পর্শ গভীরভাবে কোথাও লাগেনি। আর ফন আইকস্টেইড এদের নাম দিয়েছেন উত্তর ইন্ডিড বলে। ডেনিকার এদের নামকরণ করেছেন ইন্দো-আফগানীয়। আবার খর্বদেহ একটা জাতির অনুমান করেছেন নৃতত্ত্ববিদ ফিসার, যাদের তিনি ওরিয়েন্টাল বলে মনে করেন। ইন্ডিডের তিন শাখা, ইন্ডিড আদি-নর্ডিক, উত্তর ইন্ডিড আর গোলমুণ্ড নরগোষ্ঠীদের বলা হচ্ছে আলপাইন। এরা র‍্যাকিড, এদের তিন ধারা, পূর্ব-র‍্যাকিড, গাঙ্গেয় উপধারা দীর্ঘদেহ র‍্যাকিড, মহারাষ্ট্র দেশের পশ্চিম র‍্যাকিড। প্রাগৈতিহাসিক যুগে পামির তাকলামাকান মরুভূমি অঞ্চলে বিস্তৃত শিরস্ক এক জাতি বাস করতো। এরা পাশ্চাত্য ইউরোপ প্রচলিত ইটালো- সেলেটিক ভাষার অনুরূপ এক আর্যভাষাভাষী ছিলো এবং পশ্চিম ইউরোপের অধিবাসীগণ ওই একই বিস্তৃত শিরস্ক পর্যায় বলে এদের নামকরণ করা হয়েছে আলপাইন পর্যায়ে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে এবং বালুচিস্তানে এই পর্যায়ে বৈদিক আর্য ও দ্রাবিড় জাতির সঙ্গে সংমিশ্রিত হয়ে তারা নাতিদীর্ঘ শিরস্ক ইন্দো-আফগান পর্যায়ের সৃষ্টি করেছে। এই পর্যায়ে ভারতের অন্যত্র আদিম অধিবাসীগণ (প্রো-অস্টালাইট) বৈদিক আর্য এবং দ্রাবিড় জাতির সাথে সংমিশ্রিত হয়। নিম্ন বর্গের বাঙালির এবং বাংলার আদিম অধিবাসীদের ভেতর যে জনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি, নৃতত্ত্ববিদরা তাদের নামকরণ করেছে আদি-অন্তালীয়। বস্তুত বাংলাদেশে যে জনসংস্কৃতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে, তার প্রায় সমগ্র মূল রূপায়ণই প্রধানত আলপাইন ও আদি-অন্তালীয়, এই দুই জনলোকদের কীর্তি। পরবর্তীকালে আর্য ভাষাভাষী আদি-নর্ডিক নরগোষ্ঠীর রক্তপ্রবাহ সংস্কৃতি স্তরের একটি ক্ষীণ প্রবাহ মাত্র এবং এই প্রবাহ বাঙালির জীবন এবং সমাজ-বিন্যাসের উচ্চতর স্তরে আবদ্ধ। যাই হোক, রিজলী-র মতে বাঙালির নৃতাত্ত্বিক উৎপত্তি মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড় জাতির সংমিশ্রণে। একাধিক শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিকদের মতে আধুনিক বঙ্গজাতির এই পর্যন্ত উৎপত্তি এবং বিকাশ আদি-অন্তাল এবং দ্রাবিড়দের দ্বারা। প্রমাণিত ধারাটা এই। সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় অবশেষে, দূর থেকে ছুটে আসা আগত এক তাজা ঘোড়া আর লাফ দিতে দিতে এগিয়ে আসা এক কোমল গাধা-এই দুয়ের সংমিশ্রণে দুর্দান্ত গতিশীল এবং কঠোর আত্মত্মত্যাগ নিয়ে এই ‘অমায়িক … খ’… বা হাজার বছরের বাঙালি এবং তার সত্তা।

     ধান ভানতে গিয়ে শিবের গীত, এতো টার্ন করি, এতো টুইস্ট হয়, ট্রাভেলগ বা মনোলগ কই? একটা বুক-লগে যেন চলেছি-বরং লেখালেখির শুরুর দিকটা দেখি। আমার স্বক্ষেত্র গদ্য-সেদিকে…।

     অবনি ধরের কথাবিশ্বে মলয় রায়চৌধুরী যেটা বলতে চান: ভারতবর্ষে ‘পঞ্চতন্ত্র’, ‘হিতোপদেশ’, ‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’, ‘কথা সরিৎসাগর’, ‘বৃহৎকথা’, ‘কথামঞ্জুষা’, ‘দশকুমার চরিত্র’, ‘বাসবদত্তা’ ইত্যাদি গদ্যে লেখা কথাবস্তুর অতি প্রাচীন ঐতিহ্য আছে। ইংরেজ আসার পর এবং ফলে বাংলা গদ্যসাহিত্যে ও গদ্যে নানাবিধ সংরূপের উদ্ভবজনিত অভিবিভাজকটির দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, সাহিত্যে নন্দনতত্ত্বের ক্ষেত্রটি বিশেষভাবে প্রতিস্বরের লে কজনের ওপর। ইংরেজ আসামাত্র এবং বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত প্রতিস্বর নিয়ে লেখন পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেখন পরিসরের ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তির মৌলিকতা, ব্যক্তির সৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো বাঙালি জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিলো। ১৮১৭ সনে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা এবং ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহনরূপে ইংরেজি এবং ১৮৫৭ সনে বঙ্গসমাজে প্রবেশ করতে পেরেছিলো মনন বিশ্বটি। বাংলাভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হলো ১৮৬৫-তে, একই সঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিস্বরটি এই মনন বিশ্বের আদরায় নির্মিত হবার পর, এবং এই একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্রের দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সনে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতি’। তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ফিকশন, ‘নববাবু বিলাস’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে। আর প্যারীচাঁদ মিত্রর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৫৮-এ। পূর্ণচন্দ্র তাঁর রচনায় নাম স্বাক্ষর করেননি। ‘নববাবু বিলাস’ এবং আলালের ঘরের দুলাল ছদ্মনামে রচিত। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে (১২৮০-১৩০৩ বঙ্গাব্দ) বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় একশত ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিলো। যেগুলোয় লেখকরা নাম স্বাক্ষর করেননি, এমনকি ছদ্মনামেও নয়। উনসত্তর জন লেখক কেবল নাম স্বাক্ষর করেছিলো। অবাক হতে হয়, কতো নির্মোহ আর আপনা-আপনি ভাবে মানুষ কীভাবে অপ্রাতিষ্ঠানিক হয়। নাম স্বাক্ষর না করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট, কথাবস্তুর রচয়িতারা যারা জানতেন না লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, লেখকের নামটি কোনো মর্যাদা বহন করে-না জেনে না বুঝে ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে, নিজের মেধাস্বত্বের প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে থেকে মানুষ সৃজনশীলও হতে পারে। উনিশ শতকের রেনেসাঁ ব্যক্তির কর্মকাণ্ডের প্রভাব এবং কর্মের স্বীকৃতি শিখিয়ে দিয়ে গেলো। কিছু ব্যক্তিমানুষের যৌথ জোট ফলের জন্য এটা একটা প্রগতি, কিন্তু এর ভেতর থেকে বেরিয়ে এলে আরেকটি গণ্ডারের মতো নির্লজ্জ জন্তু, তার নাম প্রতিষ্ঠান। তার ইউরোপ থেকে ধার করা ব্যাখ্যা তত্ত্ব বিশ্লেষণে বিচার শুরু হলো বাঙালি লেখকদের সৃজনশীলতা। আমার একান্ত নিজের বিচারে ভারতবর্ষের প্রথম প্রতিষ্ঠান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। নিঃসন্দেহে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত মুন্সিরা ১৮৪৩-পরবর্তী বাংলা গদ্যের জড়তা কাটাতে থাকেন। ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকাটিতে যে লেখাগুলো হয়েছিলো এদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ের গদ্যভাষা অনবদ্য; অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় নিজের মতো করে দেখলে বলতে হয় যে ক’জন গদ্য নিয়ে ১৮২০-এর ভিতর পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছিলেন তিনি তার মধ্যে অসাধারণ কীর্তি রেখেছিলেন তার গদ্যগ্রন্থ ‘প্রবোধচন্দ্রিকা’য় (১৮৩৩)। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক বর্বরতা যার ওপরে বর্তায় তিনি মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার। অসাধারণ ভাষা তার হাতে থাকলেও তার ‘রাজাবলী’-তে মুসলমানদের ইতিহাস বর্ণনা করায় এবং জিছাছ-এর বদলে খোদার প্রসঙ্গ বলায় কেরী ও হালহেড তার লেখকসত্তার ওপর প্রচুর আঘাত করে। প্রতিষ্ঠানের আরেকটি বর্বরতা পূর্ণচন্দ্রের ওপর পড়লো। ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু দি স্টাডি অফ লিটারেচার’-এ, ডব্লিউ এইচ হার্ডসন ছোটোগল্পের শিল্পকলার মূল্যে ভাব ও ঐক্যের বজায় রাখার নামে (কোন ভাব আর কোন উদ্দেশ্য বজায় রাখা, কিসের ঐক্য, বলা নেই) পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘মধুমতি’ রচনাটিকে আমল না দিয়ে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সার্থক গল্পের নামে তকমা এঁটে দিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনা পাওনা’য় (‘পোস্টমাস্টার’ হলেও মানা যেত, ‘রোববার’ বা ‘একরাত্রি’ হলেও, ‘ল্যাবরেটরি’-‘কাবুলিওয়ালা’-‘এরাত্রি’ হলেও এমনকি ‘হৈমন্তী’ এবং ‘বলাই’ হলেও) অন্তত বাঙালির ভাবাবেগটাকে হার্ডসন-এর শিল্পবিচারে পাওয়া যেত। দেড়শ বছর ধরে ওই সেইদিন থেকে রেনেসাঁ-পরবর্তী বাঙালি জাতির একমাত্র ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান হয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আরেকটু আগে গেলে দেখা যায় ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ রচনা হলো ১৮৭৮-এ। বিদ্যাসাগরের প্রথম রচনা হলো ১৮৫৯-এ। রাজা রামমোহন রায় বাংলা গদ্যের একজন প্রধান লেখক। বলতে গেলে তিনি বাঙালিকে হাতে ধরে বাংলা গদ্য পড়তে শিখিয়েছেন (১৭৪৪- ১৮৩৩), তারপরে ‘বিষবৃক্ষ’ রচনা হলো ১৮৭৩ সালে। বঙ্কিমের সময়কাল ছিলো ১৮৩৮-৯৪। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনার সময় ছিলো ১৮৭১ থেকে। সমসাময়িক লেখক তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম সামাজিক উপন্যাস ‘স্বর্ণলতা’ লিখলেন। এরপর ‘পথের পাঁচালী’ ১৯২৯ সালে লেখা হয়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছয়টি উপন্যাস লিখলেন ১৯৩১-৪১ এর মধ্যে। তারাশঙ্করের সময়কাল ১৯৩০ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ‘হাঁসুলিবাকের উপকথা’ বের হয় ১৯৪৭ সালে।

     ১৮-র শেষ থেকে ১৯-এর মধ্য সময় পর্যন্ত বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠ ভিত্তির স্থাপন ঘটে। এরপরে কতো পথ পার হলো। কতো লেখক তৈরি হলেন। প্রতিষ্ঠান আরো সক্রিয় হয়ে উঠলো। এই সময় তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে বাংলা গদ্য রূপায়ণ নিয়ে দু’ভাগ হয়। পূর্বপাকিস্তানে আধুনিক চিন্তার বাহক এবং সমকালীন জীবনের রূপকার হিশেবে বেশ ক’জন বলিষ্ঠ প্রবন্ধকার, কথাসাহিত্যিক এবং নাট্যকারের আবির্ভাব হয়। সংস্কৃত বা আরবি-ফারসি বা উপভাষা কোনোকিছুই তারা প্রাধান্য দেননি। প্রগতি সংঘ এবং কলকণ্ঠ ঘিরেই এই আন্দোলন শুরু হয়। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (নোয়াখালী) ‘চাঁদের অমাবস্যা’, শামসুদ্দীন আবুল কালাম (বরিশাল) ‘কাঞ্চনগ্রাম, আবু ইসহাক (ঢাকার বিক্রমপুর) ‘সূর্য দীঘল বাড়ি, আলাউদ্দীন আল আজাদ (চট্টগ্রাম) ‘কর্ণফুলী’ এবং হাসান আজিজুল হক (কুষ্টিয়ার রাঢ় বঙ্গের বুলি নিয়ে লেখেন) ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’। আর দ্বিতীয় দলে যারা ছিলেন অর্থাৎ আরবি-ফারসিকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন তারা হলেন: আবুল মনসুর আহমেদ, হাবিবুল্লাহ বাহার, শওকত ওসমান।

 


আশির দশক থেকে বাংলাদেশে শক্তিশালী অর্থে লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট শুরু হয়, যার পেছনে ছিলো রাজনীতিক বিশৃঙ্খলা, সামরিক শাসন, ধর্মীয় উন্মাদনা, ভৌগোলিক বিবর্তন, দুর্বৃত্ত পুঁজির ভারসাম্যহীনতা এবং মাতৃভাষা কেন্দ্রিক স্মরণীয় কিছু ঘটনাপ্রবাহ। ঐতিহাসিক এই বিবর্তনগুলোর কারণে বাংলাদেশের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট এতো সক্রিয় আর শুদ্ধ হয়ে হলো রূঢ় আর বিশ্লেষণাত্মক। আর সেই লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট অসংখ্য বিষয় ধারণ করে এগিয়েছে, শুধু নান্দনিক দিকটাও দেখেনি রাজনৈতিকমনস্ক লেখাও প্রচুর প্রকাশিত হয়েছে।

 

     ‘শিখা’ গোষ্ঠীর যশোরের ঝিকরগাছার আবুল হুসেন (১৯১৯- ১৯৩৮-তৎপরতার সময়কাল) সেই সময়কার প্রেক্ষিত অনুসারে থার্ড লিটারেচারের প্রবর্তক। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি এবং কথাসাহিত্যের বিষয়বস্তু নিয়ে প্রকৃত অর্থে বাস্তব উপযোগী খুব মৌলিক চিন্তার লিটলম্যাগাজিন শুধু বের করেননি, নিঃসন্দেহে বলা যায় বাঙালি মুসলমানদের ভেতর প্রকৃতঅর্থে তিনিই প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক। হিন্দু মুসলমান এই দুই পক্ষের সাথে এমনকি তার গোষ্ঠীর সাথে তার যে যুদ্ধ করা এবং একজন শিল্পী, চিন্তক, সম্পাদক, সংগঠক, আইনজীবী এবং প্রাক্তন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েও যাকে নাকেখত্ দিতে হয়েছিলো একজন প্রভাবশালী মুসলিম নেতার কাছে। বিস্তারিত বলা প্রয়োজন: ১৯২৮-এর ২০ আগস্ট আবুল হোসেনের ‘নিষেধের বিড়ম্বনা’ এই প্রবন্ধটি লেখার অপরাধে ঢাকার রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের বলিয়াদির নবাব খানবাহাদুর কাজেম উদ্দিন তাকে বিচার করার নামে প্রবল অপমান করে আনুগত্যের মুচলেকায় স্বাক্ষর করান।

     ১৯২৯-এ তার পরবর্তী প্রবন্ধ ‘আদেশের নিগ্রহ’ রচনার দায়ে তাকে আহসান মঞ্জিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে বিচারে নাকে খত্ দেওয়ানো হয় (কোনো কোনো বইয়ের মতে চল্লিশ হাত)। তারপরেও তিনি ‘শিখা’ পত্রিকাটি সুদীর্ঘ সময় ধরে বের করে গেছেন। শিখা পত্রিকার পাশাপাশি ‘জাগরণ’, ‘অভিযান’ এই দুটি পত্রিকাও দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ করেছেন। এই দ্রোহচৈতন্যের শিখা, অভিযান, জাগরণ আর

     আবুল হুসেনের ব্যক্তিগত লেখা আর তার গ্রন্থগুলো লিটলম্যাগাজিনের ওই সময়ের প্রেক্ষিত অনুসারে অনিবার্য পরম্পরার সৎসাক্ষ্য বহন করে। উল্লেখ্য, আবুল হুসেন তাঁর শক্তিশালী লেখনীশক্তিকে বিসর্জন দিয়েছিলেন সাংগঠনিক কাজগুলোকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। এটা আরেকটি বড় আত্মত্যাগ। প্রবল লেখকসত্তা নিয়ে সে-সময় মুসলিম সমাজ থেকে উঠে আসা বাঙালিদের ভেতর বুদ্ধিবৃত্তিক তীক্ষ্ণতা ও প্রতিভাদীপ্ত লেখার ব্যাপক সাক্ষ্য রেখেছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী, আবুল ফজল প্রমুখ।

     বিদ্যাসাগরের সংযুক্তির ‘তত্ত্ববোধিনী’ থেকে বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকাটির পর্যন্ত বহু অমিল থাকা সত্ত্বেও একটা মিল ছিলো, সুদৃশ্য টেবিল-চেয়ার ভিত্তিক সাহিত্য পত্রিকা বের করা। ‘কবিতা’ প্রতিবাদ ছিলো রবিঠাকুরের নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। তিরিশের কবিরা রবিঠাকুরের বিরোধিতা করলেন ইউরোপের তাজা চোখ থেকে। এরপর হাংরি জেনারেশন। সারা পৃথিবীর প্রেক্ষিত তখন ভিন্ন। বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ববাংলা থেকে আশ্রয় নেয়া একটা মিষ্টির দোকানের কর্মচারীও যে কবিতা লিখে ছাপতে পারে এর প্রমাণ দিলেন মলয় রায়চৌধুরীসহ অনেক প্রতিভাদীপ্ত তেজি লেখকদের সংস্পর্শের কিছু পত্রিকা। ‘ক্ষুধার্ত’ ও ‘ফু’ হাংরিদের অন্যতম পত্রিকা। কবিতাপত্রের এলিটিজম ভাঙতে লাগলো। হাংরি জেনারেশনের গুটিকয়েক জন ছাড়া তারা তেমন চিন্তাশীল এবং সৃজনশীল ছিলেন না। ওই মুভমেন্টে যারা ছিলেন প্রত্যেকেই পরবর্তীকালে নিজস্ব অবদানের গ্রন্থ রচনা করে আইকন হবার চেষ্টা করেছেন। শুধু তাই নয় অধিকাংশই আনন্দবাজার এবং কলকাতার সংস্কৃতির অঙ্গনে নিজেদের ইমেজ অবলীলায় বিক্রি করে চলেছেন। হাংরির মুভমেন্টের প্রাথমিক দিক পার করার পর অনেকে প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। আর যারা ছিলেন তারা মধ্যপন্থী। হাংরি জেনারেশনের মুভমেন্ট যদি সৃজনশীলতায় প্রকৃত অর্থে গৌরবময় ইতিহাস হয়ে থাকে, তাহলো মাত্র তিনজনের জন্যে। তাদের মর্মান্তিক যাপন এবং সৃজনশীলতা কেবলমাত্র কথিত প্রথাবিরোধিতার নামের জায়গা থেকে বেরিয়ে গিয়ে অর্থাৎ ‘ধরি মাছ না-ছুঁই পানি’র মনন থেকে ব্যাপকভাবে সরে এসে সুতীব্র প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার বীজ পুঁতেছিলো। তাঁরা হলেন, ফাল্গুনী রায়-যার কাব্যগ্রন্থ ‘নষ্ট আত্মার টেলিভিশন’ সময়-কালকে অতিক্রম করেছে। ব্যক্তিগতভাবে আমার চিন্তায় যাকে আমি এই প্রেক্ষিতে সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ‘বিকল্পঅহম’ মনে করি। দ্বিতীয়ত, বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যগ্রন্থ ‘রন্ধনশালা’ যুগজয়ী বই। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিককালে প্রয়াত সুভাষ ঘোষের উপন্যাস ‘সাবিত্রীবালা’। জীবিতদের ভেতরে সেই পরম্পরায় যে কজন আজও দীপ্তিময় এবং আস্থাশীল হয়ে আছেন তার ভেতর শৈলেশ্বর ঘোষ যেন-বা নিভৃতে এক ক্রন্দনরত সাক্ষ্য। এছাড়া হাংরির পরম্পরা ছিলো শূন্যতায় ভরা। ঠিক সেই সময়, ষাটের শুরুতে কুস্তীপুত্র কর্ণের মতো এলেন সুবিমল মিশ্র। একটাই প্রশ্ন? হাংরি জেনারেশন-কিন্তু হাঙ্গার কই, কোথায়?

     আশির দশক থেকে বাংলাদেশে শক্তিশালী অর্থে লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট শুরু হয়, যার পেছনে ছিলো রাজনীতিক বিশৃঙ্খলা, সামরিক শাসন, ধর্মীয় উন্মাদনা, ভৌগোলিক বিবর্তন, দুর্বৃত্ত পুঁজির ভারসাম্যহীনতা এবং মাতৃভাষা কেন্দ্রিক স্মরণীয় কিছু ঘটনাপ্রবাহ। ঐতিহাসিক এই বিবর্তনগুলোর কারণে বাংলাদেশের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট এতো সক্রিয় আর শুদ্ধ হয়ে হলো রূঢ় আর বিশ্লেষণাত্মক। আর সেই লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট অসংখ্য বিষয় ধারণ করে এগিয়েছে, শুধু নান্দনিক দিকটাও দেখেনি রাজনৈতিকমনস্ক লেখাও প্রচুর প্রকাশিত হয়েছে। এই টোটালিটি এবং পূর্বের সকল কাগজের তুলনায় এর স্বাতন্ত্র্য বেসিক দুটি নীতির ওপর থাকে। ১. অন্যায্য মুনাফায় প্রতিষ্ঠিত ব্যাপক প্রচারিত ছাপা কাগজে না লেখা এবং প্রচার অর্থেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়াকে বর্জন করা (প্রচার অর্থে, তথ্য জানানো অর্থে নয়)। ২. নিজের চিন্তায় আত্মত্মস্থ হয়ে লেখায় পরীক্ষা- নিরীক্ষা করা। আশির শুরুতে এই মুভমেন্টের যে ক’টি লিটলম্যাগাজিন ব্যাপক ভূমিকা রাখে এবং আজও তার ভেতর যে ক’টি রেখে চলেছে, সেগুলো: ‘গাণ্ডীব’, ‘অনিন্দ্য’, ‘দ্রষ্টব্য’, ‘চোখ’, ‘প্রতিশিল্প’, ‘দুয়েন্দে’, ‘চালচিত্র’, ‘কফিনটেক্সট’, ‘শিরদাঁড়া’, ‘সূর্যঘড়ি’, ‘জংশন’, ‘সংবেদ’, ‘প্যাঁচা’, ‘প্রসূন’, ‘খুন’, ‘ঘণ্টা’, ‘ড্যাফোডিল’, ‘চারবাক’, ‘ওপেনটেক্সট’। অন্যভাবে ভূমিকা রেখে চলেছে ‘নিসর্গ’, ‘একবিংশ’, ‘কথা’, ‘লিরিক’, ‘লোক’, ‘শব্দপাঠ’, ‘মঙ্গলসন্ধ্যা’, ‘বৈশম্পায়ন’, ‘শুদ্ধস্বর’, ‘সুনৃৎ’, ‘খেয়া’, ‘উলুখাগড়া’, ‘ঠিকানা’, ‘কুঁড়েঘর’, ‘অক্ষর’, ‘অভীপ্সা’, ‘ফ্রি স্কুল স্ট্রিট’, ‘ছাঁটকাগজের মলাট’, ‘সুদর্শন চক্র’, ‘সমুজ্জল সুবাতাস’, ‘দ’, ‘আবহমান’, ‘হালখাতা’, ‘কর্ষণ’। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য আরো কাগজ রয়েছে। আশিতে আমূল পরিবর্তিত রূপ দেখিয়েছিলো দুটি কাগজ ‘রূপম’ ও ‘বিপ্রতীপ’। সাম্প্রতিক প্রকাশিত নতুন কাগজগুলো দুর্দান্ত সক্রিয়তায় তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে পথ অনুসন্ধান করে চলেছে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কাগজ ‘লাস্টবেঞ্চ’, ‘কালনেত্র’, ‘মাতাল পুনরুত্থান’। বিগত পঁচিশ বছরে বাংলাদেশের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্ট-এ যতোটা ভাঙন এসেছে তার চেয়ে গতিশীল হয়েছে দ্বিগুণ। উল্লেখ্য, পশ্চিম বাংলার লিটলম্যাগাজিন-এর একটা পরোক্ষ প্রভাব নিঃসন্দেহে প্রাথমিকপর্যায়ে বাংলাদেশের লিটলম্যাগাজিন মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাজনীতির ও অর্থনীতির নব প্রেক্ষিতে ৮০-র শেষ দিক থেকে বাংলাদেশের ছোটকাগজগুলোর ভেতর স্ব-চরিত্র অন্বেষণ প্রবণতা তৈরি হতে থাকে। পরবর্তীকালে অধিকাংশ ছোটকাগজ নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে এগিয়েছে।

     থার্ড মিলিনিয়াম কমিটি ফর সোশ্যাল ট্রাঞ্জিশন বা সমাজ রূপান্তর সন্ধানী তৃতীয় সহস্রাব্দ সমিতি গবেষণা চালিয়ে ‘বঙ্গদর্পণ’ নামে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই প্রকাশ করেছে। এই লেখার অনেক উপাত্ত সেখান থেকে পাচ্ছি। সমিতির অফিস সেক্রেটারি মানসী কীর্তনীয়া। স্বামী হিমাংশু কীর্তনীয়া লেখক, তার কয়েকটা গল্প পড়া ছিলো। পছন্দ করার মতো মানুষ। কথা বলার সময় ঘাড়টা অল্প নড়ে। অন্তর্গত আবেগেই হয়তো-বা বামহাতের আঙুলগুলো মাঝে মাঝে কাঁপে। হিমাংশু জিজ্ঞাসা করেন, আমার লেখা কোথায় পড়েছেন? বললাম, আপনার বই থেকে, যশোর পাবলিক লাইব্রেরি বাংলাদেশের পুরনো বই পাওয়ার দুর্লভ জায়গা, আপনার লেখাগুলো নতুন। আমি তার ‘দুধ’ গল্পটি সম্পর্কে বললাম। তিনি বললেন, বাংলাদেশে আমি ছিলাম, হাসান আজিজুল হক এই লেখাটাকে ভালো বলেননি। বললাম, কাছের এবং দূরের কিছু নিয়তি থাকে। হাসান আজিজুল হক আমার কাছে একজন বিস্ময়কর শিল্পী আর একইসঙ্গে আমার জন্যে তিনি দূরের নিয়তি। লেখা-সংক্রান্ত তাঁর যেসব আলোচনা পড়েছি এবং বিবিধ লেখা নিয়ে তাঁর যেসব মন্তব্য শুনেছি এই দৃষ্টিভঙ্গি আমার পছন্দের না। তিনি যাদের পছন্দ করেন বা যাদের লেখা তিনি পড়েন তারা কখনোই আমাকে বিস্মিত করেনি। যেসব লেখা নিয়ে তিনি নীরব, লক্ষ করেছি সেগুলো আমার প্রিয় লেখা। রুচিটা উল্টো হয়ে গেছে। ‘দুধ’ বিষয় নিয়ে তাঁর লেখাটি কতো গুরুত্বপূর্ণ সে বিষয়টি নিয়ে আমার সৎ এবং সামর্থ্যযোগ্য মন্তব্য জানালাম। ভদ্রলোক বললেন, হাসান আজিজুল হক আমাকে স্নেহ করতেন। আমার ভালোর জন্য হয়তো বলেছিলেন। আমি বললাম, আমিও আপনাকে পছন্দ করেছি। আপনার প্রতি এই মন্তব্য অধিক ভালোর জন্যে। তিনি হাসলেন। দিনকয়েকের বন্ধুত্ব হলো।

 


বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান মহাযান রয়েছে। যারা এর ভেতর নিজেরা নাক উঁচু করে থাকে তারা লক্ষ করেনি মূলত তাদের নাক চ্যাপ্টা। মুসলমানদের ভেতর আশরাফ যারা হতে চান, আহসান মঞ্জিল তো সেই আদর্শ।

 

     ‘জারি বোবাযুদ্ধ’-র টেবিলে সুবিমল মিশ্র এবং প্রচেতা ঘোষ বসে। আমি দূরে দাঁড়িয়ে। বাংলাদেশের কাওরান বাজারের আশীর্বাদপুষ্ট এক খ্যাতিমান যুবক লেখক ভক্তিসহকারে সুবিমল মিশ্রের টেবিলের দিকে যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগোচ্ছিলেন, হঠাৎ আমাকে দেখে বিব্রত হয়ে তাড়াতাড়ি সুবিমল দা’র সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে গেলেন। আমরা যারা লিটলম্যাগাজিন করি তাদের এই উন্নত মানসিকতাটুকু আছে, দুইকূল ঠিক রাখছে এইভাবে সবসময় মানুষকে মনে করি না। একজন লেখক শিল্পীর কাছে যাবে, দলাদলিটা পরে। আমাদের পুরনো বন্ধু কীর্তিময়ী নাসরীন জাহান বরং স্মার্ট-‘বুঝলেন সুবিমল দা, ও যতো দূরে দূরে থাকতে চায়, দেখা হয় ঠিক মোক্ষম জায়গায়-‘বলে নাইটিংগেলের মতো বকবক করতে করতে অপসৃয়মান। বেনজিন খান সম্পাদিত এডওয়ার্ড সাঈদের বইটা প্রচেতার কাছে কম দামে বিক্রি করলাম। দেশের বড়ো লেখক মামুন হুসাইনের ‘সর্পরাজ’ নামক একটি লেখা নিয়ে সুদেষ্ণা চক্রবর্তী কলকাতার এক পত্রিকার পক্ষ থেকে আমাকে অনেক প্রশ্ন করছিলো। ভেবেছিলাম সর্প বিষয়টা পৈতৃক হয়ে গেছে, না। সুদীর্ঘ সেই লেখাটা আমার পড়া ছিলো, প্রশংসা করতে হলো। ভাবলাম স্থানীয় পড়াশোনা কমিয়ে দেবো। কয়েকজন লেখকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো শুভঙ্কর। প্রায় একই প্রশ্ন সবাই আমাকে করলেন, বাংলাদেশের মৌলবাদ নিয়ে। দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নিয়ে যা করা হয় তা কতোটা সত্য? বললাম, অংশত। সুবিমল দা বললেন, তসলিমা সাপ-ব্যাং যাই লিখুক, লেখে এটাই বড়ো কথা। তসলিমাকে ভারত সরকার প্রতিরক্ষা দিচ্ছে না বলে তিনি ‘কবিতীর্থ’-র জাঁ পল সাত্র সংখ্যায় বুদ্ধদেব দাসের উদ্দেশ্যে লিখেছেন, ‘মাথাটা দুই উরুর ভেতরে ঢুকিয়ে বসে আছেন কিনা?’ আবারও সাপ-ব্যাং, সাপ নিয়ে কথা এলেই এক দূরান্বয়ী উপমার জিভ আমাকে যেন ছোবল দেয়। গলার স্বরটা কাঁপলো, বললাম, সাপ-ব্যাং নিয়ে লেখা আর ফ্রয়েডের সাপ নিয়ে স্বপ্নব্যাখ্যার সূত্র নিয়ে লেখা, দুটো দু’রকমের। সুবিমল দা বললেন, ‘অন্নজল’ লেখাটা পড়ে আমাকে চিঠি দিয়ো। শর্মী পান্ডে একটা চকবার এনে হাতে দিলো। এগিয়ে গেলাম সামনে, একা একা হাঁটতে চাচ্ছি। ভাবতে চাচ্ছি, হুড়মুড় করে কিছু ভাবনা আসছে। প্রকাশ করার উপযুক্ত না এমনসব সস্তা ভাবনা।

     আচ্ছা, মহল্লার বাইরে থেকে মোটরসাইকেল চালিয়ে একটা ছেলে এলাকার কোনো বিল্ডিঙের রেলিঙে দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মেয়ের জন্য চার-পাঁচবার আসা-যাওয়া করলে এলাকার অধিবাসীরা বিশেষত যুবকরা ভালো চোখে দেখে না। মেয়েটা কিংবা তাদের পরিবারের সঙ্গে গভীর পরিচয় থাক বা না-থাক তাদের সম্ভ্রমে লাগে। এমনকি পাড়ার ভেতরের কোনো ছেলে বাড়াবাড়ি করলে বন্ধুদের ভেতরে ছুরি খোলাখুলি হয়। এলাকার প্রত্যেকটা ঘরের সম্ভ্রম তাদের সম্ভ্রম। জেলা শহর থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত একই, গাঢ়, গভীর শ্রদ্ধা করার মতো মূল্যবোধ। নারীসঙ্গ লিপ্সায় ভরা ছেলেটিকেও সংগত কারণে তার এলাকায় সতর্ক থাকতে হয়। সেখানে এই বাঙালি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীদের হাতে পাশের ঘরের এবং নিজের ঘরের মেয়ে, বোন, বউ তুলে দিয়েছে। একটি পর্যায় পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় এবং ধার্মিক, ব্যক্তিজীবনে গুণবান এমন বহু মানুষ একাত্তরের যুদ্ধের বিপরীতে থেকে ধর্মের এবং প্রগতির দুটি দৃষ্টিতে যা বর্বর এমন কাজে পুরো সাতমাসে যুক্ত ছিলেন। কদর্য এই কর্মটির ভেতর দিয়ে কোনো মানবতা-নৈতিকতা, ধর্ম তো দূরে থাক, প্রগতি তো দূরে থাক তারা ধর্ষকদের প্রত্যক্ষ সহযোগী হলেন। এতোটা অসুস্থ হয়ে ইসলামি দলগুলো একাত্তরে ২০০৯-এর ‘রসু’ হয়ে গেলো। যুদ্ধ মানে বহু নৃশংসতা, কিন্তু ধর্ষকের প্রবণতা নিয়ে (আক্ষরিক এবং প্রতীকী) আক্রমণ করা আর যাই হোক দেশপ্রেমের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আর তা-ও যদি হয় সর্বশ্রেষ্ঠ মানবের ওপর স্রষ্টার প্রেরিত বাণীগুলো আত্মস্থ করার নামে কোনো দেশে যদি ঘটে। সম্মানিত মুহম্মদ নিজে উপস্থিত হয়ে যুদ্ধ করেছেন বেশ কয়েকটি। সেই যুদ্ধে একটিও ধর্ষণের ঘটনা নেই।

     একটা নাটকের সংলাপ বোধহয় এরকম, মেয়ে বাবাকে বলছে, একটিমাত্র শব্দের নামে নিজের মেয়েকে তুলে দিলে? তুলে দিয়েছিলো কোন শব্দের নামে? আল্লার-ধর্মের না ইসলামের? নাকি এই নামগুলোর নেপথ্যে ছিলো বংশপরম্পরায় প্রাক্-দেশভাগের দুটি কারণ? এক. অতীতের হিন্দুদের দ্বারা কথিত শিক্ষা-সংস্কৃতিতে পরাভূত হবার আক্রোশ, দুই. মুসলিম বাঙালি জাতির নিজস্ব ভূ-খণ্ডটি যদি হারিয়ে যায়। যদি দেশটা হিন্দুদের হয়ে যায়। এই মুসলমানরা তখন নিজস্বতায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে কি? আশঙ্কা, ভয়, ইংরেজদের সঙ্গে হিন্দুদের সহযোগীমূলক সম্পর্কের কারণে দ্বন্দ্বমূলক ঘৃণিত বাস্তবতায় নির্যাতিত হওয়ায় কী আত্মঘাতী প্রতিশোধপরায়ণতা। ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানরা নিজের বাস্তবতা কখনো দেখতে পারেনি। নিজেকে উত্তরণের জন্যে সমান্তরাল প্রগতির পথ বের করেনি বা সে অবকাশ তারা পায়নি। অন্ধবিশ্বাসের পথ ধরে বড়জোর নিজেকে শুদ্ধ রাখা যেতে পারে কিন্তু ব্যাপ্তির সঙ্গে যুক্ত থাকা যায় না। ঐতিহ্য কখনো একক বিষয় না। পারস্পরিক বিনিময় ছাড়া পৃথিবীর আদি সেরা পাঁচটি সভ্যতারও একক ঐতিহ্য নেই। ব্যাপ্তিময় ঐতিহ্য মানে চারপাশকে আত্মস্থ করা। ইতিহাসে কী দেখি? এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে যতোটা ক্ষতি করেছে, স্বধর্মের নিপীড়ন তার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। ইসলামে আছে হাজারটা বাহাস। একমাত্র আবু বক্কর সিদ্দিকী (রা.) ছাড়া খোলাফায়ে রাশেদীনের বাকি তিনজন খলিফাকেই খুন করা হয়েছিলো। নিজেদের ভেতরের অভ্যন্তরীণ কোন্দল সম্মানিত মোহাম্মদের মানবিক মূল্যবোধকে তছনছ করেছে। একইসঙ্গে ওসমান (রা.) এবং আবুজর আল গিফারি, ইসলামের ছায়াতলে থাকলেও চরম অর্থেই পরস্পর বিপরীতে। মুতাজ্জিলারা ইসলামের বিকাশউন্মুখ সময় থেকে এখনও নিয়ত যে প্রশ্ন রাখে আজ অবধি সে প্রতর্কের নিষ্পত্তি হয়নি। বাক্যের আক্ষরিক একরৈখিক অর্থ-মানা শুচিবায়ুগ্রস্ত ইসলামিপন্থীরা এর সদুত্তর দিতে পারেননি। ইরান-ইরাকের যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের যেমন ভূমিকা ছিলো না, তেমন আবার ভারতে সাম্প্রতিক কালের প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিংকে পদত্যাগ করতে হলো হরিজনদের সম্মান বৃদ্ধির অপরাধে। খ্রিস্টানদের ভেতর রোমান ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্টদের সংঘর্ষের সমাধান কোন ধর্মীয় উপায়ে ঘটেছে-আজও কি তার সমাধান হয়েছে? আমেরিকান সংবিধানে প্রেসিডেন্ট হবার একটা নিয়ম বিশেষভাবে উল্লেখ্য, প্রেসিডেন্টকে ইভাঞ্জেলিক প্রটেস্ট্যান্ট হতে হবে। স্বধর্মের ভেতর এতো অমিল, একত্রিত হতে পারে না, সেখানে অন্য ধর্মের ওপর বিদ্বেষ করা, আধিপত্য করতে চাওয়া কতোটা যৌক্তিক? স্ব-অশিক্ষা থেকে অহম আর আপন সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পুরুষতান্ত্রিক দাপট ছাড়া আর কোন দর্শন কাজ করে? ধর্ম অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চেয়েছে কিন্তু দাপটকে অভিশপ্ত করেছে পদে পদে। ইহুদি সম্প্রদায়ের স্বধর্মের ভেতর দীর্ঘকাল পর্যন্ত যেসব বিষয় নিয়ে যে রক্তাক্ত মনোবৃত্তি আছে তা উল্লেখ করার মতো। ১৯২০ ও ১৯৩০ সনে বিপুল সংখ্যক ইহুদি পণ্ডিত জীয়নবাদ আন্দোলন সমর্থন করেনি। জীয়নবাদ আন্দোলন ছিলো সম্মানিত মুসার দৃষ্টিভঙ্গিকে নতুনভাবে দেখার প্রশ্ন। জীয়নবাদ আন্দোলন করেছিলো যারা, ইতিহাসে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রজ্ঞাসম্পন্ন, জ্ঞানগত দিক দিয়ে যথেষ্ট বিচক্ষণ কিন্তু রক্ষণশীল ইহুদি মোল্লারা এই জীয়নবাদকে প্রবলভাবে বাধা দেয়। একজন ইহুদি অন্য ইহুদিকে হত্যা করলে তার ফাঁসি হবে কিন্তু একজন অ-ইহুদিকে কোনো ইহুদি হত্যা করলে তার ফাঁসি হবে না। এসবের ভিত্তিতে তারা মনে করে প্যালেস্টাইনের প্রতি তাদের মনোভাব ঈশ্বরের মনোভাব। দাউদ (আ.)-এর ওপর ‘যবুর’ নাজেল হয়। আপন সম্প্রদায় কর্তৃক দুষ্কর্মে তা ভেঙে পৃথিবীতে দাউদের সম্প্রদায় নামে (ডি-স্ক্রোল) একটি বিন্দু হয়ে রয়েছে। কথাগুলো আমার আত্মোপলব্ধি আর ভাসা ভাসা খুব খাপছাড়া হয়তো, কিন্তু বিতর্কিত কিছু লেখা কাম্য না। বেদনাদগ্ধ মন থেকে কথাগুলো উঠে আসছে বলেই লিখছি। প্রাসঙ্গিক অর্থে বলছি, শৈশব-কৈশোরে দেখেছি আমাদের পরিবারটি সংস্কৃতিমনা ছিলো। ধর্মীয় বিষয়ে প্রচুর আলোচনা হতো পাশাপাশি। সেখান থেকে জানতে পারি, ভাই গিরীশচন্দ্র সেন প্রথম পবিত্র কোরান শরীফ বাংলায় অনুবাদ করেন। আমাদের পরিবারে এর দ্বিতীয় মুদ্রণ গ্রন্থটি সযত্নে রাখা থাকে। গ্রন্থটির দ্বিতীয় মুদ্রণে লেখা আছে পঁচাশি বছর পর আবার মুদ্রিত হয়েছে। কবে এটি প্রথম অনূদিত, প্রকাশকাল খুঁজে পাইনি। এ অনুবাদটির পাশাপাশি সূত্র ধরে পরবর্তীকালে অন্যান্য অনুবাদও পড়তে হয়েছে। পাঠের এই ধারাবাহিকতার পেছনে একটা সূক্ষ্ম উৎসাহ কাজ করেছিলো। দ্বিতীয় মুদ্রণ গ্রন্থটি পহেলা বৈশাখ ১৩৮৬ সনে। হরফ প্রকাশনীর প্রকাশক কলেজ স্ট্রিটের আব্দুল আজিজ আল-আমান দেশ-বিদেশ মিলিয়ে সেই সময়কার সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুসলমান, আরবি ভাষার পণ্ডিত, বাংলাভাষার ওপর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষিত এরকম পাঁচজনের মূল্যায়ন গ্রন্থটির পেছনে ছেপেছিলেন। বাঙালি মুসলমানদের কাছে যাতে গ্রন্থটি বিশ্বস্ত হয়। মূল্যায়ন পাতাটির শিরোনাম ছিলো প্রতিষ্ঠাপত্র। সেই পাঁচজন হলেন, জনাব আমান উল্লাহ (তিনি ইংরেজিতে লিখেছেন, কলকাতার মাদ্রাসার আরবি ভাষার সিনিয়র স্কলার হিশেবে তার পদবির উল্লেখ) প্রত্যেকেরই সেইরকম যাইহোক, দ্বিতীয় জনাব আবদুল আলা এবং আবদুল আজিজ। তৃতীয় জনাব আলিম উদ্দিন আহমেদ। চতুর্থ আবুয়াল মফজর আবদুল্লাহ (ফুটনোটে লেখা, ইহা পারস্য পত্রের অনুবাদ)। পঞ্চম ব্যক্তি জনার মৌলোভী আফতারোদ্দীন সাহেব (যশোর কাজীপুর)। এই পঞ্চম ব্যক্তিটি আমার দাদার বাবা। তাঁর পত্রাংশে এক জায়গায় তিনি লিখছেন, ‘এই পুস্তকের বাংলা অনুবাদ অতি উৎকৃষ্ট প্রাঞ্জল এবং ইহা যে একটি উপাদেয় পদার্থ হইয়াছে তাহা বলাই বাহুল্য। পুস্তকখানি সম্পন্ন হইয়া প্রকাশিত হইলে শুধু অনুবাদকের নয় বিশেষত বাঙালি জাতির গৌরব বাড়িবে এবং তার জন্য আপনি সম্মানার্হ। ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ নিয়ে বিশেষ সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে হৃদয় উৎসারিত মন্তব্যে শব্দ প্রয়োগের রসসিক্ততা (উপাদেয় পদার্থ) এবং মুক্তমনন (বাঙালি জাতির কাছে) বলতে এরকম, শুচিবায়ুগ্রস্ত পন্থীদের জন্যে উদ্ধৃতিটা বিব্রত হয়েও দিতে হলো।

     বৌদ্ধ ধর্মে হীনযান মহাযান রয়েছে। যারা এর ভেতর নিজেরা নাক উঁচু করে থাকে তারা লক্ষ করেনি মূলত তাদের নাক চ্যাপ্টা। মুসলমানদের ভেতর আশরাফ যারা হতে চান, আহসান মঞ্জিল তো সেই আদর্শ। যারা একজন আবুল হোসেনকে ক্ষত-বিক্ষত করে ইতিহাসের একটি গতিশীল বাক্যের ব্যঞ্জনার ক্ষেত্রে বদ্ধসমাপ্তির কাঠামো। আবুল হোসেন সেই কাঠামোকে উপহাস করে অমর হয়েছেন। অনেকে মনে করেন ধর্ম সবার জন্যে। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি ধর্ম, ধর্মতত্ত্ব, ধর্মবিধান কোনোকিছুই কমবুদ্ধির মানুষের জন্য প্রযোজ্য না। যেহেতু ধর্মের সঙ্গে তীক্ষ্ণপ্রবণ মনন ও সুগভীর ভাব আছে। ধর্মবিধান, ন্যায়-অন্যায়ের প্রাথমিক স্বচ্ছতাটা একজন নির্মীয়মানের জন্যে হয়তো-বা জরুরি। কিন্তু তার গোটা জীবনের ক্ষেত্রে এটা টোটাল পলিসি হবার অবকাশ যদি থাকে-কী ভয়ঙ্কর তা আমরা লক্ষ করেছি।

     যাই হোক।

     আমি আর শ্রীলতা। শ্রীলতাকে আমি ভালোবাসি। শ্রীলতা সাড়া দেয়।

     পলকাহাওয়ামুক্ত সুনিবিড় সিক্ত আচ্ছন্নতায়; সংশয়ের সূক্ষ্ম বিষয়টি কাঁপে।

     কোথায় তা বুঝি না। উৎকণ্ঠিত হই বারবার, মৃদু অসহিষ্ণু হলে শ্রীলতা তৃপ্তির ভেতর দাঁড় করিয়ে দেয়।

     শ্রীলতা ধোঁয়াভরা আকাশের ভেতর জ্যোৎস্নার রূপকল্প।

     কুয়াশায় চলা পাখির প্রত্যক্ষ ডানা।

     নিঃশ্বাসের নির্বাচিত গন্ধ।

     শ্রীলতা একটা ঘোর।

     আমি চল্লিশোর্ধ্ব বিত্তহীন, গন্তব্যরুদ্ধ অখ্যাত একজন, একটা ছাদ আছে, তলে আছে শতছিন্ন মলিন একটা চাদর, আমার সঙ্গে যিনি থাকেন চাদরটার কোণ ধরে আমার মতোন তিনিও আঙুলে রেখেছেন। আর শ্রীলতা, স্থির-ধী-শক্তিসম্পন্ন, গন্তব্যমুখী। আমি বিস্মিত হই, শ্রীলতা আমার সঙ্গে দেখা করে, আসে, হাসে, মমতা নিয়ে কথা বলে, ভাবি শ্রীলতা কী নিঃসঙ্গ?-ততোটা না। একসময় মনে হয় ভাঙতে শুরু করেছে; এক অভ্যস্ততা শর্তহীনভাবে একাত্ম করেছে আমার সঙ্গে; জীবন নিয়ে সাময়িক নিরীক্ষার কাঙ্ক্ষায় যেন-বা এই অসম সম্পর্ক, জানি না!

     ডিপার্টমেন্ট থেকে ও দুদিনের ছুটি পেলো। শ্রীলতা বললো, ঢাকার বাইরে যাবে। আমাদের হাতে একদিন একরাত। ঢাকা থেকে রাতের ট্রেনে চট্টগ্রামে গিয়ে সারাদিন ঘুরে রাতে ফিরে আসতে হবে। আমার কথায় শ্রীলতা সম্মতি দিলো। প্রস্তুতি নিলাম। পরদিন রাস্তা থেকে টিকিট কাউন্টারের বিল্ডিঙের দিকে এগোচ্ছি হঠাৎ একটা মটরসাইকেল কাছে এসে ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষে দাঁড়ালো। একটু চমকে উঠে চেয়ে দেখি-দু’জন প্রসন্ন মুখের যুবক। পুলিশ অফিসারের পোশাক পরা। আমার তাকানো দেখেই বললো, কোথায় যাবেন? বললাম। কেবিনে যাবেন? না-বলে জানতে চাইলাম, কেন? ভালো দুটো সিট পাবেন। টিকিট কিনতে হবে না। বুঝে ফেলেছি, বললাম, টাকাটা কাকে দিতে হবে। উপবিষ্ট দ্বিতীয়জন হাত বাড়ালো। বললাম, চেকার যদি টিকিট চায়? বললো, গাড়িতে আমাদের দু’জন পুলিশ থাকবে। দূরবর্তী দাঁড়িয়ে থাকা দু’জনকে দেখালো। ওরা সিট ঠিক করে দেবে। কাছাকাছি থাকবে। আরামে যেতে পারবেন। শুনলাম। কিছুটা ইচ্ছের বিরুদ্ধে যেন মেনে নেয়া হলো।

     মুখোমুখি হাতলওয়ালা দুটো সিট। শ্রীলতার পরনে গাঢ় সবুজের চেক শাড়ি। কপালে ফেব্রিকের টিপ। ডানহাতে সোনার সরু একটা বালা। পাশের সিট থেকে একজন বললো, আগেও দেখেছি এই ট্রেনটা বিশ- তিরিশ মিনিট লেট করে। প্লাটফর্মে ব্যস্ততা কম। বাটিহাতে-‘খাবো’ ‘খাবো’ বলে এক পাগলা ফকির জানালা-জানালায় ঘুরছে। একটা দৃষ্টিনন্দন ডাব নিয়ে শ্রীলতার জানালার কাছে এসে সৌম্যমুখের একজন বললো, আমার বাড়ির গাছের ডাব। ঠান্ডা পানি আর মিষ্টি। শ্রীলতা মৃদু না বললো। লোকটা আন্তরিক হাসি দিয়ে বললো, সবগুলো বিক্রি হয়েছে এই শেষ ডাবটার দাম যা দেবেন তাই নিয়ে চলে যাবো। লম্বা পথ, একটা ডাব খেয়ে যান। নিকটবর্তী কেউ যেন এমনভাবে লোকটা কথা বলছিলো। গায়ে হাফ জামা আর ময়লা পাজামা পরা লোকটার দিকে তাকিয়ে শ্রীলতা কী যেন ভাবলো। বোধহয় ট্রেনে ওয়াশরুম থাকায় শেষে রাজি হলো। ‘দেন’-শ্রীলতা বলতেই কয়েক মুহূর্তের ভেতর ধারালো দা দিয়ে লোকটা ডাবে ছিদ্র তৈরি করলো অভ্যস্ত হাতে।

     শ্রীলতা পার্সটা পাশে রেখে জানালার ভেতর দিয়ে একটু মাথা বাড়িয়ে হাতদুটো এগিয়ে দিতেই তড়িৎ গতিতে লোকটা দা-টা শূন্যে উঠালো। পরক্ষণেই শ্রীলতার চিৎকার মৃত্যুদূতকেও ভয় পাইয়ে দেয়। রক্ত ভেসে যাচ্ছে সিটের চারপাশে, জানালার কাচে, আমার জামা-কাপড়ে আর মুখে ছিটকে আসছে। যাত্রীদের প্রচণ্ড চিৎকার, দলে দলে ছুটে যাওয়া ‘ধর, ধর, খুন’ বলে উচ্চকিত হওয়া অনুরণন। লোকটা ঊর্ধ্বশ্বাসে লাফ দিয়ে দৌড়াচ্ছে দেখা গেলো। কয়েকজনের সহযোগিতায় আমি শ্রীলতাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। সেই সময়টুকুর ভেতর কী কী ঘটেছে আমার স্মৃতি তা ধারণ করতে পারে না। শ্রীলতা তৎক্ষণাৎ অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো। গায়ের জামা খুলে কর্তিত অংশ থেকে ছুটে আসা রক্তের স্রোত চেপে ধরার চেষ্টা করছিলাম। প্রবল ভয় পেয়ে ভীষণ কাঁপছিলাম। কান্নার মতো করে চিৎকার করছিলাম অসংলগ্ন কথাবার্তায়। কখন হাসপাতালে গিয়েছি জানি না, শ্রীলতার জ্ঞান ফিরেছে কিনা তা-ও জানি না। পুলিশের লোকজন শ্রীলতার ঠিকানা নিয়ে আমাকে প্রিজন-ভ্যানে তুলে নিলো।

     কয়েক মাস পরে জেল থেকে বের হলাম। অবৈধ সম্পর্ক হিশেবে কত কদর্যভাবে লেখা যায় পুলিশ আর সাংবাদিকরা তা নিয়ে ইতিমধ্যে জনমত তৈরি করেছে। অপরাধী লোকটার সাথে আমার যোগসাজশ আছে কিনা বহুভাবে তদন্ত হয়েছে। অপরাধী লোকটাকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ইন্টারোগেশন সেলে আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে আমি তাকে চিনি কিনা? আমার ইন্ধন আছে কিনা?

     বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাই। কপর্দকশূন্য আমি। প্লাটফর্মের প্লাস্টিক চেয়ারটায় বসি। সেই দিনের রাত থেকে আজ এখন পর্যন্ত স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে সব, সেই রাত থেকে জীবন নিয়ে যে নির্মমতা দেখেছি যা যাবতীয়, কয়েকমাস ধরে তা আমার কাছে ছবির মতো উজ্জ্বল। ভাবতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে যায়, হঠাৎ মনে হয়, আশ্চর্য, কেন মনে হয় জানি না। যা আমি দেখিনি এমন কি কিছু আছে? যা দেখিনি সেটা কি শুধু কল্পনা? না দেখার কল্পনা চেনা বাস্তবতার চেয়েও তো বেশি হতে পারে। মনে হয় ডাববিক্রেতা লোকটা এখন কোথায়? ওই রাতে সে লাফিয়ে প্লাটফর্ম ধরে দৌড়াচ্ছিলো। রেলের পাটি ধরে আঁকাবাঁকা ছুটেছে। পেছনে সে একবারও তাকায়নি। চারপাশে তার গতির সঙ্গে প্রতিপক্ষ কতোটা সমান্তরাল, প্রতিমুহূর্তে এক অজ্ঞানতায় সে গতি বাড়াচ্ছে। সিগনাল বাতির যে পোস্টে মৃদু আলো, তার পাশ দিয়ে জনবসতির রাস্তা, সেখানে কেমন লোকজন আছে তাকে ঠাহর করতে হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেও সে রেলের পাটি ধরে যখন দৌড়াচ্ছিলো ‘ওই তো ওই তো ধর’-এই শোরগোলের ভেতর সে ছুটছিলো জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে। কর্তিত অংশ থেকে সোনার বালাটা বের করে শক্ত করে অজান্তে ধরেই দৌড়চ্ছে। সিগনাল পোস্টের আগে তিন-চারটে বস্তির ভেতর দিয়ে একটা পথে গতিটা কিছু কমালো সে। তারপর ঘরের পাশ থেকে এঁকেবেঁকে হেঁটে একটা সরু রাস্তায় গিয়ে পড়লো। তার আতঙ্ক জমাট বরফের মতো ভাঙছে। তার জামায় তাজা রক্তের দাগ, পাজামাটা ছিড়ে গেছে-দূরে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছে। জামাটা খুলে ফেললো সে। ডাইনে বড়ো বড়ো কিছু বিল্ডিং, বাঁয়ে শহরতলীতে পৌঁছানোর পথটা বের হতে পারে অনুমান করলো। এই গভীররাতে ঘুমনিস্তব্ধতায় তার পালানোর শব্দ তারই কাছে এতটাই প্রকট, সেই প্রতিধ্বনি মনে হলো প্রতি ঘরে ঘরে জানিয়ে দিচ্ছে মুহূর্তে। কিছুটা হাঁফ ছাড়লো। এতদূর ব্রত নিয়ে কে-বা এই রাতে পেছনে ছুটে আসছে। সংশয়টুকু তবুও থেকে যায়। দু’ঘণ্টা পর জিব বের করা কুকুরের মতো সে তার নিবাসের কাছাকাছি পৌঁছে গেদের পুকুরে খুব দ্রুত হাতমুখ থেকে রক্তের দাগ মুছলো। সে এক প্রকার স্নানই করলো। ঘাটে বসলো কিছুক্ষণ। ধড়ফড় করা বুক তখনো নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে। ঘুম আসছে তার। ঘাট থেকে উঠতে হলো তাকে। ভোর হয়ে গেছে। চারুকাকার বাড়িতে সে কাঁপতে কাঁপতে গেলো। গ্রামের চারুকাকা প্রস্রাব করতে বের হয়েছিলো এই সময়। সে তাকে ডাকলো। চারুকাকা এগিয়ে এলে সে থেমে থেমে বললো, শ্বশুরবাড়ি থেকে আসলাম। শাশুড়ি এই বালাটা দিয়েছে, এটা বন্ধক রাখবো। চারুকাকা খুবই বিশ্বস্ত। প্রশ্ন করার অভ্যাস কম। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বালার ডিজাইন, ওজন দেখলো সময় নিয়ে। সে তাড়াতাড়ি বললো, সরু হলেও ভারি আছে। খাঁটি সোনা দেখেন। কী সুন্দর কাজ করা! চারুকাকা বললো, হ্যাঁ, এক হাজার টাকা দেবো। হা হয়ে গেলো লোকটা। এক-হাজার টাকা!

 


পৃথিবীর বহু প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করতে নেই, যতো নিকটবর্তী লোকই হোক না কেন বুঝে নেয়াটাই কর্তব্য। স্টলে ফিরে যাওয়ার সময় বিষয়টা নিয়ে শুভঙ্কর কিছু বললো না। আবার ভাবতে থাকি। আমার চিন্তা এতো টুইস্ট করে, টার্ন করে, এতো এলোমেলো ভাবনাটা যে ইনিয়ে- বিনিয়ে গুছিয়ে আচ্ছন্ন করবে এরকম হয় না। হঠাৎ এর ভেতর থেকে উত্তর পেলাম-ফ্যান্টাসি! একটা ইতিবাচক ফ্যান্টাসি।

 

     ছোটো বাচ্চাটা ক্ষুধায় শীতল। গলা দিয়ে স্বর বের হয় না। বড় ছেলের বয়স বারো, বেশ কয়েকদিন একবেলা আধপেটা খেয়ে মেজাজটা রুক্ষ, ঘুম থেকে উঠে মা’র দিকে তাকিয়ে খিস্তি-খেউড় দিচ্ছে। গাঢ়রোদে লোকটা ঘরে ঢুকলো।

     দুধের প্যাকেট-আটা-চাল-ডাল-আলু-তেল-পিঁয়াজ-লবণ, ভোরের মাছ আর তাজা সবজি নিয়ে।

     ন্যায় এবং দয়া দুটি শব্দ পাশাপাশি থাকে না। দুটি পরস্পর বিপরীত মত যুক্তিশাস্ত্র স্বীকার করে না (প্রিন্সিপ্যাল অব ননকন্ট্রাডিকশন)। আবার দুটি বিষয়ের ওপর একটা প্রাধান্য দেয়া ন্যায়শাস্ত্র অনুমোদন করে না (প্রিন্সিপ্যাল অব সাফিসিয়েন্ট রিজন)। আমজনতা বসে থাকে না। সে তার প্রেক্ষিত অনুসারে কাজ করে। কিন্তু যে বিচক্ষণ হতে চায়, শিল্পী হতে চায়, মানবিক মানুষ হতে চায় তার জন্যে কী? কলমটা ছুঁড়ে ফেলে ঘাতককে খুঁজে বেড়াবে সেই একই দা নিয়ে, নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে আইন নামক বড়ো একটা ফাঁকে আশ্রয়ের নামে ঢুকে যাওয়ার জন্যে? এই আইনকে যারা শ্রদ্ধা করে তারা সুনাগরিক। এই আইনকে শ্রদ্ধা করার আরেক নাম কাপুরুষতা। পৌরুষের অর্থ থেকে না, চেতন-সত্তার প্রায়োগিক জায়গা থেকে বলা।

     লেখক কী করবে? সে কি নির্বাক? নাকি ডুবে যাবে গোটা সমাজের ভেতর। একবার ঢুকে গেলে বিষয়টা টোটাল, এই সমগ্রতা বিন্দু থেকে বিন্দুতে যুক্ত করে সে যাই লিখুক প্রশ্নগুলো এসে দাঁড়াবে সামনে। কী করবে? ঘাতক খুঁজতে বের হবে এক প্রয়োজনীয় অমানবিকতার ব্রত নিয়ে, কেননা শ্রীলতা হাত হারিয়েছে। শ্রীলতা লিখতে পারবে না। কী করবে লেখক? এক হাতে দা, একহাতে কলম? নাকি দা’কে কলম বানাবে? নিষ্ঠুর পাথরের খণ্ডিত অংশের মতো, নাকি কলমকে দা বানাবে? এইগুলো নিরন্তর কোশ্চেন, এই টোটাল সবকিছু নিয়ে ভাবনা, যাপন, লেখা আর এই এলোমেলো তৎপরতার শেষমেষ যে যোগফল তা হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা।

     শুভঙ্কর বইমেলায় গ্রাফিত্তি স্টল থেকে বের হয় না। মেলার ভাঙার আগে হঠাৎ স্টল থেকে বেরিয়ে লিটলম্যাগাজিনের দক্ষিণ দিকের টেবিলগুলোর দিকে শুভঙ্কর আমাকে নিয়ে হাঁটতে লাগলো। একটা টেবিলে একজন পঞ্চাশোর্ধ্ব লোক বসে। টেবিলে ওপর স্বরচিত দু-তিনটে বই। সামনে ঘুরিয়ে রাখা পেপার ওয়েট দিয়ে চাপা একটা কাগজ, ‘আজকাল’ থেকে লেখা চেয়ে উপর্যুপরি অনুরোধ করা একটা পত্র। বুঝলাম তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেননি। চিঠিটা উন্মুক্ত এভাবে রাখায় কেন জানি ভালো লাগেনি। যে দু-তিনটা বই তাঁর খুব যে বিক্রি করার আগ্রহ, বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করে দেখলাম, তেমন না। এগিয়ে গেলাম আরো কিছু দূরে। পঞ্চাশোর্ধ্ব আট-দশজন লোক একটা টেবিল ঘিরে চারপাশে দাঁড়িয়ে। তাঁরা যে প্রভাবশালী সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক কিংবা কথাসাহিত্যিক কিংবা বুদ্ধিজীবী বোঝা যায়। খুব সম্ভ্রমে ভরা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চেহারায় দামি পাঞ্জাবি-পরা বিদগ্ধজনই। চুলগুলো নমনীয় ব্যাকব্রাশে নির্মলভাবে আঁচড়ানো। চওড়া কপালে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার কিছু ছাপ রেখায় এবং কোনো কোনো অংশের ত্বকে। আমি আর শুভঙ্কর তাঁদের পাশে এসে দাঁড়ালাম। স্বাভাবিক মুখে শুভঙ্কর কিছুটা একা একা থাকে। মৃদুস্বরে কুশলবিনিময় ছাড়া যেচে কথা বলা তো দূরে থাক, বন্ধুদের ভেতর ছাড়া কানেকটেড হওয়ার টেন্ডেনসি চোখেমুখে একেবারেই নেই। একজন শুভঙ্করের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, শুভঙ্কর, স্টল কেমন চলছে, শুভঙ্কর দ্রুত বললো, চলছেআরকী। এ সময় আমাদের বয়সী প্রায় যুবকোত্তীর্ণ একজন শক্ত চেহারার, কাপড় চোপড় কিছুটা ময়লা, কোথা থেকে এসে জোরে জোরে বললো, শুভঙ্কর শোন, একটা কবিতা শোন। সে কবিতা পড়লো। বাংলাদেশের যে কোনো জায়গার অজপাড়াগাঁয়ে সনাতন কবিতাও পড়েনি বা প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কেউই নিশ্চিতভাবে বলা যায় এমন কবিতা কোনোদিন লেখেনি বা লিখবেও না। মানটা পরের কথা, আমি শুধু ধারণা নিয়েই বলছি। আট লাইন বাক্যের ভেতর আমি আর তুমি দিয়ে ভরা আর বকুল ফুল। সচেতন প্রয়াস যে না সেটা যে কেউ বুঝবে। বারবার পড়তে লাগলো। সবাই চুপ, অবাক হলাম যারপরনাই ওর পরের কথা শুনে। সুললিত, সুগঠিত বাক্যে বললো, সাগরময় ঘোষ তিনবার এই লেখাটি পাবার জন্য তার বাসায় গিয়েছিলো। সে বেশ কয়েকবার তাঁকে না বলে দিয়েছে। সে কখনো দেশ-এ লিখবে না জানিয়ে দিয়েছে। সাগরময় ঘোষ মর্মাহত হয়ে চলে গিয়েছেন। বিশ্বাসযোগ্য সেই বিবরণ, সেই অভিব্যক্তি অবাক এবং নির্বাক করে। আত্মবিশ্বাস আর প্রত্যয়ী হবার মতো এক দৃঢ়চিত্তের অবিরাম প্রকাশ। টেবিলের গোড়ায় যারা দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা গম্ভীরমুখে মাথা নিচু করে আছেন। এতো নীরবতার ভেতর শুভঙ্কর আমার দিকে শুষ্কভাবে তাকালো। আমি শুভঙ্করের দিকে তাকালে শুভঙ্করের ঠোঁটে সামান্য স্নেহের একটা হাসি আসার আগেই যেন মিলিয়ে গেলো। পৃথিবীর বহু প্রশ্নের উত্তর জিজ্ঞাসা করতে নেই, যতো নিকটবর্তী লোকই হোক না কেন বুঝে নেয়াটাই কর্তব্য। স্টলে ফিরে যাওয়ার সময় বিষয়টা নিয়ে শুভঙ্কর কিছু বললো না। আবার ভাবতে থাকি। আমার চিন্তা এতো টুইস্ট করে, টার্ন করে, এতো এলোমেলো ভাবনাটা যে ইনিয়ে- বিনিয়ে গুছিয়ে আচ্ছন্ন করবে এরকম হয় না। হঠাৎ এর ভেতর থেকে উত্তর পেলাম-ফ্যান্টাসি! একটা ইতিবাচক ফ্যান্টাসি। ‘আজকাল’-এর চিঠি টেবিলে চাপা দেয়া থেকে সাগরময় ঘোষের বারবার বাসায় যাওয়ার ভাবনা এবং প্রত্যাখ্যান করার ভাবনা বাস্তবে চিত্রায়ণ করে নিজেকে বিশ্বাস করিয়ে অভিব্যক্তি তৈরি করা। শিল্পের ন্যূনতম সৌন্দর্য লক্ষ্য না করে এই কল্পনা এ কথামালা কেন? ভাবতে গিয়ে যখন উত্তর পেলাম, ভালো লেগেছে। মিথ্যা এ চর্চাটার প্রতি কিঞ্চিৎ শ্রদ্ধাও এসেছে এই জন্যে, এর নেপথ্যে রয়েছে একটাই কথা-বিশ্বাস করো আমি তোমাদেরই লোক। আমি কবি হতে আসিনি।

     সকালে ফিরে আসবো বলে, রাতে আমার সেল থেকে ইন্ডিয়ান সিমে সুবিমল দাকে ফোন করলাম। বললেন, কিছুই ভাবতে পারছি না। তোমার একটা কথা ডায়েরিতে লিখেছি। বাবরি মসজিদে বোম পড়ে, আজমীর শরীফে পড়ে না। ভালো বলেছিলে। আজমীর শরীফ ঘুরে এসো। ভাবলাম, দাদাদের সাথে মন খুলে কথা বলা যায়, বাবাদের সাথে যায় না। আরো কিছু কথা হলো, শেষে বললেন, যেদিন আট ঘণ্টা লিখতে পারবো না সেদিন সুইসাইড করবো। এছাড়া কিছু ভাবছি না, কোথাও লেখা দিচ্ছিও না। স্বাস্থ্যটা ভালো রেখো।

     আর একটা কথা, মিডিয়া এবং কিছু লোকজন আমাকেও করেছে, তোমাকেও স্যাবোটাজ করবে। কান দিয়ো না। আমাকে বিজেপির লোকও বলে; বললাম, আপনার পাশাপাশি আমার নামটা বলবেন না। আমি কোনো দিক থেকে আপনার সমান না। ধুর! কী বলো? তোমার গদ্য, ‘বাঘের ঘরে ঘোগ’-এ তোমার শব্দ প্রয়োগ, আমার ডায়েরিতে… সুবিমল দা প্লিজ… একটু থেমে সুবিমল দা বললেন ধীরে ধীরে, সত্যি খুব খারাপ লাগলে আজমীর ঘুরে এসো। বললাম, পরেরবার এসে আগ্রার তাজমহলে এবং আজমীর শরীফে যাবো।

     অনেক মানুষের শ্রম রয়েছে।

 

[উৎসর্গ: কবি শান্তনু চৌধুরী প্রিয়বরেষু— করকমলে]



সেলিম মোরশেদ

২২ মার্চ ১৯৬২-তে যশোর শহরে জন্ম নিয়েছেন সেলিম মোরশেদ। তিনি গল্প লিখতে আরম্ভ করেছিলেন আশির দশকের একেবারে গোড়া থেকে। গাণ্ডীব, অনিন্দ্য, সংবেদ, চর্যাপদ, দ্রষ্টব্য, প্রতিশিল্প, শিরদাঁড়া, জঙশন, সূর্যঘড়ি ইত্যাদি ছোটকাগজের মাধ্যমে কথাসাহিত্যের চর্চা করে আসছেন। তাঁর প্রথম গল্প গ্রন্থ ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ এবং উপন্যাস ‘সাপলুডু খেলা’ দুই বাংলায় ব্যাপক আলোচিতই শুধু নয় গ্রন্থ দুটি স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। ‘কাটা সাপের মুণ্ডু’ ও ‘সুব্রত সেনগুপ্ত’ গল্প দুটো দীর্ঘদিন ধরে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত। 

প্রকাশিত গ্রন্থ

গল্পগ্রন্থ:
কাটা সাপের মুণ্ডু (প্রথম প্রকাশ: আশ্বিন ১৪০০ প্রকাশক: শব্দশিল্প)
রাতে অপরাজিতা গাছে ফুল (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৫, প্রকাশক: যুবকাল)
বাঘের ঘরে ঘোগ (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০৮, প্রকাশক: উলুখড়)
কান্নাঘর (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২০, প্রকাশক: পরানকথা)
নীল চুলের মেয়েটি যেভাবে তার চোখ দুটি বাঁচিয়েছিল (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৪, প্রকাশক: উলুখড়)

উপন্যাস
সাপলুডু খেলা (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১, প্রকাশক: প্রতিশিল্প, পুনঃপ্রকাশ: উড়কি, ২০১৯)

নাট্যগ্রন্থ
মানুষ উত্তম (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১, প্রকাশক: শিরদাঁড়া)

কবিতাগ্রন্থ
দাঁড়িয়ে অতৃপ্ত রোদ  (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৩, প্রকাশক: উলুখড়)

গদ্য
পাল্টা কথার সূত্রমুখ অথবা বুনো শুয়োরের গো (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০২, প্রকাশক: প্রতিশিল্প)

ট্রাভেলগ/প্রবন্ধ
অমায়িক খচ্চর (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১, প্রকাশক: প্রতিশিল্প)

সমগ্র
সেলিম মোরশেদের নির্বাচিত গল্প (প্রথম প্রকাশ: ডিসেম্বর ২০০৪, প্রকাশক: প্রতিশিল্প)
রচনাসংগ্রহ-১ (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১১, প্রকাশক: উলুখড়)
শ্রেষ্ঠ গল্প (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১৬, প্রকাশক: উলুখড়)
Short Stories of Selim Morshed (edited by: Sofiul Azam, 1st Published: 26th March 2009, Publisher: Ulukhar)

সম্পাদনা
স্বপ্নের সারসেরা—(যৌথ) (প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০১০, প্রকাশক: উলুখড়)।

পুরস্কার ও সম্মাননা

  1. ‘স্বগতকণ্ঠ’ আয়োজিত ‘রচনাসংগ্রহ-১’-এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান ও সম্মাননা’ ২০১১, যশোর।
  2. ‘লোক সাহিত্য পুরস্কার’ ২০১৯।
  3. ‘মেঘচিল’ ওয়েবম্যাগ আয়োজিত সেলিম মোরশেদের সাহিত্যকর্মের ক্রোড়পত্র—মূল্যায়নী।
শেয়ার