কখনো খুব সরল করে লিখে ফেলা কবিতাও অনেক জটিল বিষয়ভিত্তিক হতে পারে। এটা নির্ভর করে কবির প্রকাশভঙ্গীর উপর এবং পাঠকের চিন্তার ক্ষমতার উপর। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা আপাত দৃষ্টিতে সরল কিন্তু আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে একটি পেন্টাকল।
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ, যাকে নিয়ে লিখতে বসার আগে প্রথমেই যে বিশেষণ মাথায় আসে তা হল “জনপ্রিয় এবং আলোচিত কবি”। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার কিছু কিছু লাইন মানুষের মগজ থেকে হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। প্রশ্ন আসে, কেন তিনি জনপ্রিয়?
সাধারণভাবে এর উত্তর, যা তার পাঠকেরা বলে থাকেন তা হলো তিনি খুব সহজ করে মানুষের কথা বলেন। তার লেখায় বাস্তবতা মেলে। যে চিন্তা মাথায় ধোঁয়ার মতো পাক খাচ্ছে তা দিয়ে তিনি অনায়াসে মেঘ বানিয়ে ফেলেন। অর্থাৎ পাঠক যা ভাবে কিন্তু বলতে পারে না কবি ইমতিয়াজ মাহমুদ সেই কথাটি বলে দেন। যেমন :
“প্রতিটি থাকার পাশে না থাকা অধিক
গাছে-থাকা ফুলটিরও শূন্য চারদিক!” (পেন্টাকল)
খুব সহজ করে বলা জগতের শূন্যতার রূপ যা সুন্দরের পাশে আরেকটি সুন্দরের উপমায় থেকে যায়। তার এই ব্যক্তিক অনুভূতির কাব্যিক প্রকাশ মানুষের ভালো লাগে।
“সহজ কথা যায় না বলা সহজে” এই কথা যেমন সত্য আবার সত্য না। অন্তত শব্দ নিয়ে যারা খেলেন, তাদের কাছে। এখানে সহজ কী অথবা কঠিনই বা কী? এ নিয়ে ভাবতে গেলে দেখা যায় সহজে বলে ফেলা কঠিন বিষয় কিন্তু সহজ হয়ে যায় না। আর সহজ বিষয় কঠিন করে বললেও তা কঠিন হয়ে যায় না। যা আসলে যেমন তা তেমনিই থেকে যায়। পার্থক্য কেবল প্রকাশে। প্রকাশের ভঙ্গিমায় মূর্ত বিমূর্ত হয় আবার বিমূর্ত মূর্ত হয়ে ওঠে। কাগজ দিয়ে তৈরি করা চমৎকার কিছু প্রতিকৃতি যা অরিগ্যামি নামে পরিচিত, ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা কখনো কখনো শব্দের অরিগ্যামি।
কিন্তু আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা কেন পাঠকপ্রিয় তা নিয়ে নয়। তাকে বিশেষণে বিশেষায়িত করাও না। এক ধরনের অনুসন্ধান। অবশ্যই বিশেষ কিছু যা প্রতিটি কবি অনুসন্ধান করে তার শিল্পবোধ থেকে এবং পৌঁছাতে চায় দারুণ কোন অনুসিন্ধান্তের দিকে।
“জলের উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকা বক
তোমায় দেখে বাড়ে আমার নদী হবার শখ” (শখ, কালো কৌতুক)
শব্দের অরিগ্যামিতে তৈরি হওয়া দুই লাইনের কবিতা। কিন্তু মুহূর্তে মূর্ত হয় নদী, বক, নদীর ভেতর বৃত্তাকার পানির ঢেউ। তারপর, মানুষের ইচ্ছা। যা সে দেখে তাই সে হতে চায়। আরও একটু ভাবতে গেলে মনে হয় প্রেম। যা মানুষকে কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের দিকে নিবিষ্ট করে রাখছে, পেতে চাইছে কিন্তু পারছে না। এই না পারাও সুন্দর। পেয়ে যাওয়া তো স্থির হয়ে যাওয়া। যেমন সমস্ত কজমিক বস্তু একটি আরেকটিকে ঘিরে ঘুরছে। মিলতে চাইছে মিলতে চাওয়ার বাসনায় যা ফুরিয়ে যাবে মিলনে। একটি নদী আর বক নিয়ে ভাবতে গিয়ে পাঠক হিসেবে আমার ভাবনা ইউনিভার্স অবধি ছড়িয়ে গেল। এটাই শব্দের খেলা ।
বলতে গেলে ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা পানিতে নিক্ষেপ করা পাথরের মতো যা তলিয়ে যায় পানির উপর পানির নকশা তৈরি করে। তবে এই তৈরি হয়ে যাওয়া কোন দিব্যতা নয়, চর্চার সাথে দেখার যোগ। এই যোগ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতায় আমি যোগ দেখতে পাই। ভাবের সাথে বাস্তবতার, শব্দের সাথে দৃশ্যের , কল্পনার সাথে লৌকিকতার এবং সর্বশেষ রিয়ালিটির সাথে মেটা-রিয়ালিটির।
প্রাসঙ্গিকভাবেই একটি শব্দ চলে আসে “বাস্তবতা”। প্রাথমিকভাবে দেখলে তার কবিতা বাস্তবধর্মী তথা রিয়ালিস্টিক। ইমতিয়াজ মাহমুদ জীবনে যা দেখছেন তাই তিনি লিখছেন। তার লেখায় মধ্যবিত্ত মানুষের গল্প পাওয়া যায়। একজন মধ্যবিত্ত মানুষ বর্তমানে আমাদের দেশে অনেকটা বার্গারের দুই পাশের রুটির ভেতর মাংশের টুকরা, তাকে তার ইচ্ছা এবং সামর্থ্যের মাঝে মধ্যপথ অনুসরণ করে চলতে হয়। এই টানাপোড়েন তাকে যেমন একদিকে ভাবুক করে রাখে আরেক দিকে তাকে হতে হয় সামাজিক মানুষ। তাকে চলতে হয় সমঝোতায়। এই দুই শক্তির লব্ধিরুপ ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতায় দৃশ্যনীয়। তার “কালো কৌতুক” কবিতায় একজন শিল্পী চরিত্র আছে যে ভাবছিল তার মাত্র দুই হাত আর দশ আঙ্গুল নিয়ে কিভাবে জীবন সামলাবে আর কিভাবেই বা একজন শিল্পী হয়ে উঠবে। এরুপ টানাপোড়েন থেকে যে দীর্ঘশ্বাস , তা থেকেই ঐ শিল্পীর শরীরময় আঙ্গুল তৈরি হয়ে যায়।
রামায়ণ কাহিনীতে দেখা যায় ঋষি গৌতমের অভিশাপে অহল্যা যেমন পাথর হয়েছিল, তেমনি ইন্দ্রও ছিল না অভিশাপমুক্ত। গৌতমের অভিশাপে তার শরীরে এক হাজার যোনি তৈরি হয়েছিল যা তার অনুশোচনার কারণে পরবর্তীতে এক হাজার চোখে রুপ নেয়। এক কথায় বলা যায় “ শাপে বর”। ইমতিয়াজ মাহমুদের “কালো কৌতুক” কবিতার শিল্পী চরিত্রটির দীর্ঘশ্বাস থেকে গজানো আঙ্গুলগুলো একসময় তার শরীরের সবখানে ছড়িয়ে যায়। এই আঙ্গুলগুলো প্রতীকী অর্থে ঐ শিল্পীর সামর্থ্য ও সক্ষমতা। এবং একসময় সে আর নিজেকেও দেখতে পায় না কারণ ততক্ষণে তার চোখও আঙ্গুল হয়ে যায়। ঠিক এই জায়গায় এসে যে উপলব্ধি, যখন একজন মানুষ নিজেকে ছাড়িয়ে যায়, তাকে সবাই দেখতে পায় কেবল ঐ ব্যক্তি ছাড়া। নিজেকে দেখার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে একজন শিল্পী, একজন মানুষ যখন ঐ স্বয়ংকে নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই উপলব্ধিই মুলত ব্ল্যাক হিউমার বা কালো কৌতুক।
এই আলোচনার শুরুতেই বলেছিলাম বিশেষণে বিশেষায়িত করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, একটি অনুসন্ধান আছে। খেয়াল করলে দেখা যায় বাস্তবতার ভেতরে যে অনুবাস্তবতা আছে তা জাদুবাস্তবতা ছাড়া প্রকাশ করা অসম্ভব। আর এই অনুবাস্তবতা মূলত বাস্তবের ভেতরেই থাকে।
ইমতিয়াজ মাহমুদের আরও একটি বহুল পঠিত কবিতা “ হারুন”। এই কবিতায় হারুন একটা চক্রে আটকে গেছে। ঐ সেই মধ্যবিত্তের বার্গারের মাংসের টুকরার মতো। এখান থেকে হারুনের মুক্তি নাই। সে দোষ না করেও দোষী, দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়েও তার মুক্তি নেই। সে পৃথিবী সংক্রান্ত জটিলতার নিস্পত্তি ঘটালেও মহাজাগতিক জটিলতায় ফেঁসে আছে। আসলে এই হারুন আমরা কমবেশি সবাই। এই কবিতার শেষ লাইন “ হারুন, পড়ে যাবার আগে ধরুন”
এখানে হারুন তথা আমরা শেষ পর্যন্ত কী কিছু ধরতে পারি, আটকাতে পারি! আসলে পারি না, কারণ সময়ের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে নেই। এই যে নিয়ন্ত্রণ নেই এতেই সিসিফাসের মতো আটকে আছি নিয়তির বিরতিহীন শাস্তির চক্রে। মুক্তি এক ধরনের ইউটোপিয়ান সুড়সুড়ি।
তার আরও একটি সমাদৃত কবিতা “ঈদ”। এই “ঈদ” আসলে আনন্দ, যা কার থেকে কখন কথায় হারিয়ে যায় জানা যায় না। কিন্তু আমরা আমাদের প্রিয় মানুষের থেকে আনন্দ নিয়ে বাঁচি। যদি বেঁচে থাকার দারুণ কোন পরম্পরা থাকে তাহলে সেটা অন্য কারো আনন্দ হয়ে বা নিয়ে বেঁচে থাকা। এই কবিতা খুব সহজ, ছোট্ট একটা আয়নার মতো যাতে নিজের মুখ খুঁজে পাওয়া যায় সহজে।
এবার আসা যাক “চোখ” কবিতা নিয়ে। এই কবিতা পড়তে গিয়ে আমি অনুভব করছিলাম জড় আর জীবের কোন ব্যবধান নেই। মানুষ ভাবছে সে একজন সাবজেক্ট। এবং নিজেকে কেন্দ্র মনে করে সে যখন জগতকে অবজেক্ট করে ফেলে, ভ্রমটা সেখানেই হয়। সে বুঝতে পারে তার দেখার আড়ালেই থেকে যায় পরিবর্তনশীল জগত।
“খেলনা” কবিতায় কোথাও কারো নাম থাকে না, বয়স তথা সংখ্যাই দিয়ে এখানে চরিত্রকে প্রকাশ করা হয়েছে। এই কবিতায় নারী পুরুষের সম্পর্কের জটিলতা , সময়ের সাথে ক্ষয়ে যাওয়া সম্পর্কের অভ্যস্ততা এবং এর থেকে মুক্তি না পাওয়া মানুষের একমাত্র মহান অবিস্কার সৃষ্টিকর্তা, নিয়তি এবং পরিণতি। এখানে যা হচ্ছে এবং যা হবে তা মেনে নেওয়াই মানুষ তথা পুতুলের ভাগ্য। এই প্লটমেকিং যেন মানুষের না, অন্য কারো। এই ভাবনা মানুষের জন্য একটা সান্ত্বনা। সান্ত্বনাতে মুক্তি খোঁজা শিশুর মতো মানুষের যেন আর কিছু করার নেই। এবং মানুষকে ফিরতে হয়। মানুষকে ফিরতে হয় তার প্রতিদিনের যাপনের কাছে।
তার “ খোঁজ” কবিতায় দেখা যায় তিনি পৃথিবীর হৃদয় খুঁজে বেড়াচ্ছেন । এবং পরিশেষে তাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে সন্দেহের সাথে অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছালেন “এরকম তো হবার কথা নয় যে, পৃথিবী হৃদয়হীন!”
“আইডেন্টিটি” বর্তমান সময়ের খুব আলোচিত একটি শব্দ। আমাদের অস্তিত্বের ধারণা এখন আর জাঁ পল সার্ত্রের বিইং এন্ড নাথিংনেসে আটকে নেই। সময়ের পরিবর্তনে এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কারণে আইডেন্টিটি এখন আর কোন একমাত্রিক বিষয় না। এই মেটা-রিয়ালিস্টিক জগতে আমিত্বের বহু রুপ এবং যা ব্যক্তি স্বতন্ত্রের ধারণাকে পাল্টে নিজেকে বিভিন্ন মানুষের ভেতরে দেখার ও খুঁজে পাওয়ার যোগ তৈরি করে দেয়। এখানে মানুষ সবখানেই নিজেকে দেখতে পায়। দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষ, দরজার ভেতরের মানুষ, টিভির পর্দায় দেখা মানুষ এবং যে দেখছে সেই মানুষ, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনাকারী মূলত একই মানুষ । একজন ব্যক্তি এই মেটা-রিয়ালিস্টিক জগতে মূলত যা কিছুর সংস্পর্শে আসে তার সবকিছুই সে। এই উপলব্ধিকে জানা যায় ইমতিয়াজ মাহমুদের “আমিত্ব” (কাব্যঃ পেন্টাকল) কবিতায়।
“আমার বউও কি আমি? এমন তো হতেই পারে
যে , আমিই আমার স্ত্রী আবার আমিই আমার স্বামী!”
এক থেকে সৃষ্টি হওয়া সবকিছু ছড়িয়ে যায়, আবার একীভূত হয় । এটাই দারুণ খেলা, কজমিক গেইম। ঠিক এইখানে আমাদের মনে হবে তাহলে এত বিরোধ, দ্বন্দ্ব কার সাথে কার।
“পৃথিবীর সব গল্প বিচ্ছেদের নয়,
নদী মরে গেলে দুই তীর এক হয়ে যায়” (গল্প, পেন্টাকল)
মূলত কবিতা নিজেই একটি মেটা-রিয়ালিস্টিক বিষয়। কবিতার যেমন খুব সরল পাঠ আছে, তেমনি আছে নিরীক্ষাধর্মী পাঠও। পাঠক তার মত, চিন্তা আর বোধ অনুযায়ী কবিতা পড়েন। একটি কবিতা তাই ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের কাছে বিবিধ রুপের প্রকাশ। কখনো খুব সরল করে লিখে ফেলা কবিতাও অনেক জটিল বিষয়ভিত্তিক হতে পারে। এটা নির্ভর করে কবির প্রকাশভঙ্গীর উপর এবং পাঠকের চিন্তার ক্ষমতার উপর। কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা আপাত দৃষ্টিতে সরল কিন্তু আণুবীক্ষণিক দৃষ্টিতে একটি পেন্টাকল।
তাসনুভা অরিন
জন্মঃ ২ অক্টোবর ১৯৯০, রাজশাহী
স্থায়ী ঠিকানাঃ মিরপুর ঢাকা
ইমেইলঃ orin.tasnuva@yahoo.com
পড়াশোনাঃ ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর
(জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় )
পেশাঃ শিক্ষকতা ( ঢাকা কমার্স কলেজ )
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ও প্রকাশকালঃ
ত্রিকালদর্শী বেলপাতা, প্রথমা প্রকাশন – ২০১৯
জলপাই বিষাদ পায়রা, বৈভব প্রকাশনী – ২০২১
নূহের নৌকায় জোড়া খরগোশ, চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী- ২০২৩
পুরস্কার – প্রথম কবিতা বই “ত্রিকালদর্শী বেলপাতা” এর পাণ্ডুলিপির জন্য প্রথমা প্রবর্তিত “জীবনানন্দ দাশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার ২০১৮”