বৈচিত্রকে বাদ দিয়ে নয়, বহুর সমন্বয়ের ধারায় চলমান পথ তৈরিই তার লক্ষ্য। তাই মানবতাই তার মূলমন্ত্র। মানুষকে বাদ দিয়ে এমনকি কোনো ঈশ্বরও আসেননি, মানুষের কাছেই তার গৌরবের বয়ান।
১.
এশিয়ার ভূপ্রকৃতির মতো এখানকার মানুষের ভাবজগত ও আধ্যাত্মিকতার ভাবনাও বৈচিত্রময়। বহুরূপে বহুভাবে মানুষ তার স্বরূপ সন্ধান করেছে। আকাশভরা সূর্য-তারা, বিশ্বভরা প্রাণের দিকে তাকিয়ে সে নিজের স্থান খুঁজে নিতে চেয়েছে। কেউ কেউ লৌকিক হাতে অলীককে তুলে নিয়েছে বিস্ময়ে। তাদের সেই বিস্ময়জাত গানের কথায় আন্দোলিত হয়েছে ভূ-ভারত! আধ্যাত্মিকতার ইতিহাস সংযোগের ইতিহাস, মানুষে মানুষে ঐক্যের আহ্বানের ইতিহাস। তবে বৈচিত্রকে বাদ দিয়ে নয়, বহুর সমন্বয়ের ধারায় চলমান পথ তৈরিই তার লক্ষ্য। তাই মানবতাই তার মূলমন্ত্র। মানুষকে বাদ দিয়ে এমনকি কোনো ঈশ্বরও আসেননি, মানুষের কাছেই তার গৌরবের বয়ান।
আধ্যাত্মিকতায় নারী-পুরুষ সবারই যেমন অংশগ্রহণ আছে, সহস্র বছরের এই সাধনার ধারায় ও বিস্তারে তেমনি নারীর অবদানও কম নয়। যদিও শাস্ত্রীয় ধর্মগুলো নারীর অংশকে সমান মর্যাদা দেয়নি, বরং উপেক্ষা করেছে। তাদের নাম চাপা দিতে পারলেই যেন বিধিবিধানের সমাজ খুশি। তবে স্বাভাবিকভাবেই নারীর অভিজ্ঞতা যেমন সমগ্র মানবজাতির আধ্যাত্মচর্চার ইতিহাসেরই অংশ তেমনি সময়, সমাজ, সংস্কৃতিভেদে আধ্যাত্মচর্চার প্র্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক দুই ক্ষেত্রেই নারীর ভূমিকা পুরুষের চেয়ে আলাদা। এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলে জন্ম নেয়া নারীসাধকদের জীবনের দিকে তাকালেও আমরা সেই সত্যটি পাই। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত পছন্দ আলাদা, জীবনের লড়াই, সাধনমার্গে আসবার ও সাধক হয়ে উঠবার গল্পও স্বতন্ত্র। তবু তারা প্রত্যেকে নারী হয়ে উঠবার গল্পকে ছাপিয়ে মননের স্বাধীনতাকেই বেছে নিয়েছিলেন, সবার উপরে তুলে ধরেছিলেন এক পরম ভালোবাসার মশাল।
বহুমাত্রিকভাবে তাদের জীবন ও রচনা পর্যালোচনা করা ও বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ রয়ে যায়। এখানে সংক্ষেপে প্রাচীন ও মধ্যযুগের এশিয়ার মাত্র কয়েকজন নারীসাধকের কথা বলছি, যারা একাধারে সাধক ও কবি। প্রথমেই আমাদের সামনে দাঁড়ালেন থেরীগাথা থেকে উঠে আসা চরিত্র সুমানগালমাতা, যিনি ছিলেন গৌতম বুদ্ধের সরাসরি শিষ্য, আধ্যাত্মিকতার পথ বেছে নিয়েছিলেন সংসারজীবনে ক্রমাগত বঞ্চনায় বিক্ষুব্ধ হয়ে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতকে ভারতের উত্তর প্রদেশের এই ভিক্ষুণীর নামটিও তার নিজের নয়। সুমানগালমাতা বা সুমঙ্গলের মা হিসেবেই তাকে ডাকা হয়েছে। গৃহস্থ ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে পুরুষই যেখানে কর্তৃত্বকারী, নারীর নাম হারানোর এমন উদাহরণ সেখানে অহরহ। তবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সুমানগালমাতা নিজের মুক্তি অর্জন করে নিয়েছিলেন। এই মুক্তি একজন সাধক হিসেবে তো বটেই, নারীজীবনের চাপানো ভার থেকেও। বুদ্ধের অনুসারী আদিপর্বের নারী ভিক্ষুণীগোষ্ঠীর অন্যতম এই নারীসাধক থেরীগাথায় বলেছেন,
অবশেষে মুক্তি
আহা, আমি মুক্ত নারী।
রান্নাঘরের ঘেরাটোপ থেকে এই মুক্তি
কী যে চমৎকার!
…..
শান্ত এখন, নির্মল এখন আমি
নিজ বৃক্ষের ছায়ার নিচে বসে
স্থির-সমাহিত, সুখী।
তবে, খ্রিস্টের জন্মের আরও আগের সময়কালে যদি যাই, আজ থেকে প্রায় চার হাজার তিনশ’ বছর আগে ইরাকে জন্ম নিয়েছিলেন এনহেদুয়ান্না। সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা কোনো ভিক্ষুণী নয়, তিনি বরং ছিলেন আক্কাদিয়ান সম্রাট সারগন ও রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়ায় তিনি সেসময় রাজ্যের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। পৃথিবীর এত সভ্যতা পাড়ি দিয়ে এসেও এক নারীর এই প্রজ্ঞা, দক্ষতার গল্প বিস্ময়কর ঠেকে। শিহরণ জাগায় প্রস্তরখণ্ড থেকে পাওয়া এনহেদুয়ান্নার গাওয়া স্তবগান:
সবচেয়ে প্রাচীন ও করাল মন্দির-
পর্বতের গহিনে
মায়ের জঠরের মতো অন্ধকার
অন্ধকার মন্দির সেই
মায়ের বিক্ষত বুকের মতো
লাল, রক্তাক্ত আর ভয়াবহ।
যদিও এখানেই নিরাপত্তার সেই ভূমি
যেখানে চুলের দূরত্বসমান কাছে তুমি
এদিকে, প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগের অর্থাৎ পনেরশ থেকে পাঁচশ খ্রিস্টপূর্ব কালের নারী ঋষি গার্গী বাচক্নবী, তাঁকে বলা হতো প্রাকৃতিক দার্শনিক বা ন্যাচারাল ফিলোসফার। আজ থেকে প্রায় তিন হাজার বছর আগে, ব্রহ্মবাদী গার্গী জ্ঞানসাধনায় তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সেসময়ের বিদ্যজনসভার তিনি ছিলেন অন্যতম। বৃহদারণ্যকোপনিষদে ব্রহ্মা ও আত্মা নিয়ে গার্গীর তত্ত্বানুসন্ধান ও দার্শনিক তর্ক স্থান পেয়েছে। মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যর সাথে তার ব্রহ্মা নিয়ে তর্ক কাল ছাপিয়ে আজও বিখ্যাত। ভাগ্যিস মেয়েদের তর্ক করা মানা বলে-কয়ে সেসময় কেউ তাকে থামায়নি। তর্কসভায় থামিয়ে তাকে দিয়েছিলেন বটে যাজ্ঞবল্ক্য, তবে তা গার্গীর প্রশ্নের উত্তর ‘জ্ঞানের অগম্য’ এমন কারণদর্শিয়ে। তবে সত্যসন্ধানী গার্গী তাতেও দমেননি। ব্রহ্মার অস্তিত্ব বিষয়ক শেষ প্রশ্নটি তিনি করেই ছেড়েছিলেন।
বৈদিক যুগ পার হয়ে চলে আসি অষ্টম শতকে। এশিয়ার আরেক আরেক পূণ্যভূমি, গোলাপের জন্য বিখ্যাত ইরাকের বসরা নগরীতে। অষ্টম শতকের বসরায় আধ্যাত্মিকতার সবচেয়ে সুগন্ধি গোলাপ হয়ে জন্মেছিলেন সাধক ও কবি রাবি ‘আ আল আদাবিয়্যা, যিনি রাবেয়া বসরি নামেই অধিক পরিচিত। তাজকেরাতুল আউলিয়া জানাচ্ছে, জীবিকার জন্য একবার সুতা কেটে রাবেয়া দুটি মুদ্রা পেলেন। দুই হাতে দুটি মুদ্রা নিয়ে তিনি ভাবলেন, দুই থেকে চার হবে, চার থেকে আট, এভাবে বহু। অথচ তিনি তো শুধু একের উপাসনা করেন। এক আল্লাহ ছাড়া তো তাঁর অন্য চাওয়া নাই। এই ভেবে মুদ্রা দুটি তিনি পানিতে ছুঁড়ে ফেললেন। তাঁর জীবন ছিল এরকমই কঠোর তপস্যার ও পরজগতমুখী। অতীন্দ্রিয়বাদী ও ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে একসময় তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দূর-দূরান্তে। তিনি খ্যাত হন তাপসী রাবেয়া নামে। স্রষ্টাকে পেতে, ভয় বা লোভ নয়, ভালোবাসাই একমাত্র শর্ত হওয়া উচিত। এই মতবাদ প্রচার করে গেছেন রাবেয়া। ফার্সিতে রচিত তাঁর কবিতার প্রতি বাক্যে সেই ভালোবাসা উজ্জ্বল।
যদি দোজখের ভয়ে নেই নাম তোমার
জাহান্নামের আগুন তবে আমাকে পোড়াক।
যদি বেহেশতের লোভে গাই নাম তোমার
জান্নাতের দরজা তবে বন্ধ হয়ে যাক।
যদি ডাকি তোমায় তোমারই প্রেমে
তবে নিও না মুখ সরিয়ে আড়ালে!
এদিকে প্রায় একই সময়ে আরেক দৃঢ়চেতা, অকুতোভয় নারী লড়ছিলেন নিজের সাধনায় অটল থাকার পথে। তিনি মহাসিদ্ধা লক্ষ্মীঙ্করা। নাথ ঐতিহ্য ও তিব্বতি বিভিন্ন সূত্রে প্রথাগতভাবে যে ৮৪ জন মহাসিদ্ধার উল্লেখ আছে, তিনি তাদেরই একজন। অষ্টম বা নবম শতকে কিছু নারী-সিদ্ধাচার্যের দেখা মেলে যারা যোগ ও তন্ত্রসাধনা করতেন, তারাই ছিলেন সেসময়ের অনেক প্রখ্যাত তন্ত্র সাধকের গুরু, লক্ষ্মীঙ্করার প্রধান শিষ্য ছিলেন তন্ত্রসাধক বিরূপা। ভারতের ওড়িয়ানা বা ওড়িশার সমবোলের রাজা ইন্দ্রভূতির বোন ছিলেন তিনি। লঙ্কাপুরীর রাজার ছেলে জলান্ধরের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব আসে, পাঠিয়ে দেওয়া হয় লঙ্কায়। কিন্তু নিজ সাধনায় মগ্ন থাকার জন্য অলঙ্কার সব বিলিয়ে শরীরে ছাই মেখে, চুল খুলে নগ্ন বেরিয়ে পড়েন তিনি। তখন থেকে পাগলের রূপেই থাকলেন তিনি, হলেন শ্মশানবাসী। এভাবেই একদিন কঠোর সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। ৮৪ মহাসিদ্ধার কাহিনিতে তাকে ‘দুর্নিবার জ্ঞানের যুবরাজ্ঞী’ হিসেবে স্মরণ করা হয়েছে। দেখে নেই লক্ষ্মীঙ্করার পদটি :
সংসারের সর্বপ্রাণ দুঃখী
শুদ্ধ সুখের সন্ধান কেউ পায়নি।
জন্ম-মৃত্যু-জরা আর রোগভোগ থেকে
নিস্তার দেয়া হয়নি এমনকি দেবতাদেরকে।
এই তিন দুর্গতি, দুঃখের হবে না অবসান
যত খুশি খাও, আর যতো করো পান।
আগুন আর তুষার দেবে যন্ত্রণা অসহ্য
তাই হে রাজা,
পরিত্রাণে মহাসুখ, তার সন্ধান করো।
এদিকে তখন তিব্বতে বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে চলেছেন ইয়েশে সোগ্যাল ৭৭৭-৮৩৭ সাল (সম্ভবত)। যাকে শ্রদ্ধাভরে ডাকা হতো ‘জ্ঞানের সমুদ্র’। তন্ত্রসাধনা ও যোগ বিদ্যায় অনন্য স্তর আয়ত্ত করায় তাকে ডাকিনী ধারার অবতার গণ্য করা হয়। তিব্বতে তিনি ‘নারীবুদ্ধ’ হিসেবে সন্মানিত এবং তাকে ‘তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের জননী’ আখ্যা দেয়া হয়। পদ্মসম্ভবের শিষ্য হয়ে ৭৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নেপালে পৌঁছান তিনি। সেখানে বহু বছর নির্জনে কঠিন তান্ত্রিক সাধনা করেন। একসময় তাঁর লক্ষ্য সাধন হয়, তিনি সিদ্ধিলাভ করে হয়ে ওঠেন বজ্রযোগিনী ইয়েশে। সিদ্ধি লাভের পর তিব্বতে বজ্রযান শাখার র্ন্যিং-মা ধারার২ স্কুল চালনায় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্র হয়ে ওঠেন তিনি। ইয়েশের কবিতাতেও তাঁর ধ্যান-সাধনার অভিজ্ঞতাগুলোই উঠে এসেছে :
চৈতন্যের সরোবরের ডাকিনী রানিই পরম-সত্তা!
পদ্মজ্যোতির মধ্যে আমি উধাও হয়ে যাই, জন্ম নিতে
চির গতিশীল পূর্ণ, নির্মল পদ্মের পবিত্র গর্ভে।
বিশ্বাস রাখো, হারিয়ে যেয়ো না।
পুরুষরা গার্হস্থ্য বজায় রেখে আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে সক্ষম হলেও নারীদের গার্হস্থ্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, বৈবাহিক সম্পর্ক ত্যাগ করেই এ পথে আসতে হয়েছে।
২.
এশিয়ার আধ্যাত্মবাদ নিয়ে কথা উঠলে একটি বড় জায়গা দখল করে নেবে ভক্তিবাদ। মধ্যযুগে ভারত জুড়ে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন জাগিয়ে তুলেছিল ভক্তিবাদ থেকে উৎসারিত ভক্তি আন্দোলন । ভক্তি আন্দোলনের মূল কথা হলো, ভগবানের সাথে ভক্তের মিলনের পথ ভক্তি। ঈশ্বর তাঁর উঁচু আসন ছেড়ে তখনই কাছে আসেন যখন ভক্তির পথ বেয়ে ভক্ত তাঁর শরণাগত হয়। ভক্তিবাদে ঈশ্বরের সঙ্গে ব্যক্তির মিলন হয় প্রেমের দোহাইয়ে। কী সামাজিকভাবে, কী ধর্মীয়ভাবে এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন নারীরাও। ভক্তি আন্দোলনে নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ শুধু সমাজ-বর্ণ-সম্প্রদায়ের বেড়াজাল ভাঙার ক্ষেত্রেই নয়, নারী-পুরুষের সামাজিক- লৈঙ্গিক বৈষম্য ভাঙতেও ভূমিকা রেখেছে। উপরন্তু সেই আন্দোলনে বেশকিছু দিক বদলকারী প্রভাব রেখেছিলেন নারীরাই।
তবে পুরুষ সাধকদের তুলনায় নারী সাধকদের সামাজিক লড়াই ছিল আলাদা। পুরুষরা গার্হস্থ্য বজায় রেখে আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করতে সক্ষম হলেও নারীদের গার্হস্থ্য জীবন বিসর্জন দিয়ে, বৈবাহিক সম্পর্ক ত্যাগ করেই এ পথে আসতে হয়েছে। স্বামীদের কাছ থেকে প্রভুত্বের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সংসার ছেড়ে তবেই ঈশ্বরের পথে যাত্রা করতে হয়েছে তাদের। সবকিছু ছেড়ে তবেই সাধনা, তাদের জন্য এটা ছিল এক কঠিন ত্যাগ। কিন্তু নিজ চিন্তা ও ব্যক্তিত্ববিভায় উজ্জ্বল নারী সাধকরা নারী-পুরুষের অসমতার সেই বাধাকেও ভেঙে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন এক অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত।
ভক্তি আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাসে কানহোপাত্র, আন্ডাল, মুক্তা বাঈ, জনা বাঈ, মহাদেবী আক্কা, লাল্লা, আম্মাইয়ার, মীরা বাঈ, রূপা বাওয়ানি প্রমুখ নারী সাধকরা ভক্তিবাদ বা ভক্তি ধর্ম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। ভক্তিবাদের পরম্পরায় অনন্য তিন নারী সাধক অষ্টম শতকের আণ্ডাল, দ্বাদশ শতকের আক্কা মহাদেবী ও ষোড়শ শতকের মীরা বাঈয়ের জীবনকথায় আমরা সেই সূত্রের অতল সন্ধান করতে পারি।
মধ্যযুগের সপ্তম-অষ্টম শতকে দক্ষিণ ভারতের নারী সাধক ও কবি আন্ডাল তার ভক্তি ও প্রেমে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছিলেন। আন্ডাল একমাত্র কৃষ্ণকেই স্বামীরূপে মানার পণ করেছিলেন। আজ থেকে আটশ বছর আগের সমাজে নিজ পছন্দকে অনুসরণ করতে শক্তি ও দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। দিয়েছিলেন কৃষ্ণের গলাতেই বরমাল্য। ঐতিহাসিকভাবে যে বারো জন আলবারের কথা আমরা জানতে পারি তাদের মধ্যে আন্ডাল একমাত্র নারীসাধক ও কবি। আলবাররা ছিলেন মূলত ভ্রমণকারী। তীর্থ থেকে তীর্থে ঘুরে তারা গাইতেন বিষ্ণু ভক্তির কাব্য- তিরু বায়মোলি বা মুখের বাণী। সহজবোধ্যতাসহ নানা কারণে এই গান সেসময়ে বেশ জনপ্রিয়তা আদায় করতে পেরেছিল। এ গানের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ক্ষিতিমোহন সেন তার ‘ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা’ গ্রন্থে বলছেন, ‘তিরু বায়মোলি’ বা মুখের বাণী বেদের অপেক্ষা বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে অধিক সমাদৃত।’ আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় পূর্বে নারী সাধক আন্ডাল সেই ঐতিহ্য নিমার্ণের অন্যতম কারিগর হিসেবে আজও সমাদৃত। আন্ডালের রচনায় উঠে এসেছে প্রেমভক্তির অসাধারণ এক অনুভব। তার রচনায় খুঁজে পাওয়া যায় অলৌকিক এক আকুলতা।
তিনি মমতামাখা ভাষায় লিখছেন,
আমার দূত হও, হে কালো মেঘ
ঘন মেঘ ভাঙে মাথায়
অন্ধকার পৃথিবীতে
বৃষ্টি ঝরে মুক্তার মতো।
সহৃদয় আমার!
কেঁপে কেঁপে উঠছে বৃক্ষের শাখা
আকাশের কোলে,
কী সংবাদ এনেছো বয়ে সেখান থেকে
রুদ্র দেবতার আমার?
তোমার ছায়া নেমে এলো,
গভীরতর হলো রাত্রির কালো
আমি জ্বলি
পুড়ি ভালোবাসায়, ঘুমহীন।
তোমার দখিনা বাতাস জমালো ঘোর,
বাঁচাও আমায় –
আমি পুড়ে মরি
তুমি রাত্রির রঙ, যেন বৃষ্টি অঝোর
শব্দ তার আমাকে করছে আদর,
অলৌকিক সঙ্গীতে আনে খবর বয়ে
আমার প্রিয়তমের
নিকষ আঁধারে,
আকাঙ্ক্ষার প্রহর যায়, আর আমি তার মাঝে
এ দেহ পুড়িয়ে জ্বলি!
জানি,
অন্ধকারেই তো পরম ঢালেন সুধা।
তবু আমি বঞ্চিত, হায়, আসেনি সে আজও!
আমার অঙ্গারে আমি তড়পাই
ধরা না ধরায়, ডুবি-ভাসি
হারাই …
এদিকে, ভারতের উত্তর-পশ্চিমের রাজ্য কর্নাটকে দ্বাদশ শতকে সাধক আক্কা মহাদেবী বা মহাদেবী আক্কার অবস্থান বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। মহাদেবী আক্কাও ছিলেন রাজবধূ, কিন্তু ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিলেন তিনি। শিবের সাধনায় বাধা পেয়ে সবকিছু ছেড়ে, এমনকি বস্ত্র বিসর্জন দিয়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে কল্যানা শহরে যান আক্কা। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সেখানে আধ্য্যাত্মিকতায় নিজের শক্ত অবস্থান তুলে ধরতে সমর্থ হন তিনি।
কন্নড় সাহিত্যের প্রথম দিককার নারী কবি হিসেবেও আমরা তাকে পাই। আমরা তার কবিতায় সন্ধান করি পারলৌকিক এই জগত থেকে অন্য এক জগতের, যেখানে নির্বাণ লাভের মধ্যে দিয়ে ঘটে নিজ আত্মার মুক্তি।
কে খোঁজে ফুল
বুকে সুগন্ধি টেনে নিতে?
শান্তি, দয়া কিংবা নিজেকে নিয়ন্ত্রণে
প্রয়োজন কি তার কঠোর যোগের!
সারাবিশ্বই যখন একটি মাত্র মুখ
নির্জনতায় তার কীইবা আর সুখ?
ও শংকর, সে যে সাদা জুঁই ফুল!
তবে ১৬ শ শতকের মীরা বাঈকে পুরো ভারত জুড়ে ভক্তি আন্দোলনকে প্রভাবিত করা সবচেয়ে খ্যাতিমানদের অন্যতম হিসেবে ধরা হয়। রাজপুত রাজকন্যা থেকে সাধকে পরিণত হয়েছিলেন মীরা বাঈ। চিতোরের প্রাসাদ ছেড়ে পথে নেমেছিলেন কৃষ্ণের টানে। স্বামী ও পরিবারের নির্যাতন, চাপের কারণে কাশ্মীরের সাধক লাল্লা এবং রূপা বাওয়ানি ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রথাগত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ওপর চাপানো বিধিনিষেধ ও নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে তাদের এই পদক্ষেপ ছিল তাৎপর্যপূর্ণ।
পাঁচশ বছর পার হলেও আজও সমান জনপ্রিয় বৈষ্ণব-সাধক মীরা বাঈর ভজন। মীরা নিজ জীবন উৎসর্গ করেছিলেন কৃষ্ণপ্রেমে। প্রাসাদ, গার্হস্থ্য জীবন, লোকলজ্জা ছেড়ে একাই পথে নেমেছিলেন তিনি। যে কৃষ্ণ দেবতা হলেও চিরপ্রেমিক, সে কৃষ্ণকে ফুলমালা দিয়ে সাজাতে চায় মীরা, তার অঙ্গে মিলাতে চায় অঙ্গ। রাধার মূর্তি ছাপিয়ে কৃষ্ণের সাথে যুগল মিলনে এখানে জীবন্ত মীরা, যেখানে দেবতা ও মানুষে ভেদ থাকে না।
মীরার ভজন-সাধনের টানে তাকে ঘিরে চিতোরে গড়ে উঠেছিল এক ভক্তগোষ্ঠী। তাঁর ভজন রাজস্থানের উচ্চবর্ণের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে ওঠে। মধ্যযুগের এক রাজপুত রাজবধূ থেকে আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ওঠেন মীরা।
মীরার পদ কৃষ্ণের প্রতি সম্পূর্ণ আত্ম নিবেদনের একইসঙ্গে তার পদগুলো তীব্র প্রেমময় আকাঙ্ক্ষার দ্রবণে নিমজ্জিত। মীরার ভজনের সংখ্যা হাজার পাঁচেক বলা হলেও বাস্তবিক চার-পাঁচ শ’র মতো ভজন পাওয়া যায়।
নন্দদুলাল, ঘনশ্যাম ঘিরে ধরেছে আমায়,
জমছে কালো মেঘ, গর্জায় কী ভীষণ
পূব থেকে ছোটে হাওয়া, বিজুলি চমকায়!
ঠান্ডা বৃষ্টিতে ময়ূর পেখম মেলে
কোকিল ডাকছে কুহু হায়
মীরার প্রভু যে গিরিধর নাগর
পদ্মচরণে তার মন আটকায়।
৩.
এশিয়ার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে নানা কাল জুড়ে, সমাজ-সংস্কৃতি ভেদে যে অসংখ্য নারীসাধক ও কবি এসেছেন, তাদের সাধনার ধরন, উপাস্য এক নয়। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার যাত্রা তো নিজের দিকেই। আত্ম অনুসন্ধানই এর পথ। বিশ্ব-জগতের সাথে নিজেকে এক সুতায় গাথার এই গল্প সমস্ত বিভেদ মুছে দিয়ে ভালোবাসার বার্তাই দেয়। অবহেলার ধুলোর আস্তরে বহুকাল ঢাকা পড়ে থাকার পর আজ সময় এসেছে নতুন আলোয় তাদের খুঁজে নেবার। নারীসাধকদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই, জনমানসে তাদের সাধকজীবনের প্রভাব নিয়ে আরও অনুসন্ধান, গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।
এই মধ্যযুগেই এশিয়ার জাপানে ইজুমি শিকিবু, জুসামি চিকাকো, চীনে কাও ওয়েনি, সান বুয়ার, ঝাও জুয়ানজিং, ভিয়েতনামে লি নক কিউ, আজারবাইজানে মাহসাতি গানজাভি, সিরিয়ায় আয়েশা আল বাউনিয়া, তুরস্কে জয়নেপ হাতুনসহ অসংখ্য নারীসাধক ও কবি তাদের আধ্যাত্মিক সাধনার আলো ছড়িয়েছেন। এই নামগুলোই যেন একেকটি উঠে দাঁড়াবার ইতিহাস, অন্ধকার দিগন্তে জ্বলে ওঠা মশাল। আজ এত বছর পার হয়ে এসেও পৃথিবীতে সেই আলোর প্রয়োজনীয়তা কমেনি। বিশেষত হিংসা, বিদ্বেষ, যুদ্ধের এই বিশ্বে আজ অত্যন্ত জরুরি আত্ম অনুসন্ধান ও শান্তির অন্বেষণ। সভ্যতার অন্ধকার দিকটি পার হয়ে আমরা সবাই আজ সেই আলোর কণ্ঠের অপেক্ষায়। যেমনটা দেখানো হয়েছে ১৪ শ শতকের জাপানের দর্শনের কবি জুসামি চিকাকোর কবিতায়— পূর্ণিমার চাঁদ, যা কিনা আলোকপ্রাপ্তির প্রতীক, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেছে। কিন্তু বাসিন্দারা কেউ সচেতন বা সতর্ক নয় এই আলোর স্ফূরণে। বলা হচ্ছে, আলোকপ্রাপ্তরি জন্য দরজাটা খোলা রাখাই মুখ্য। তবেই অনায়াসে আলো আসবে।
এই গ্রীষ্মের রাতে
সব বাড়ি ঘুমন্ত,
আর দরজায়
অন্ধকার পেরিয়ে একসময়
দাঁড়ায় চাঁদ
উজ্জ্বল, মেঘহীন।
হাসিবা আলী বর্ণা
জন্ম ১৯ মে ১৯৮১, ঢাকায়। কবি, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। পেশায় সাংবাদিক। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শব্দকে বলি, না’ (২০১৬)। তার সম্পাদনা ও ভাষান্তরে ইউপিএল থেকে এবছর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘গহিনের স্রোতধারা: এশিয়ার নারীসাধকদের জীবন ও কবিতা (খ্রিস্টপূর্ব ২৩০০ অব্দ-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)’। তার কবিতা ও প্রবন্ধ বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে।