১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেও ২৯টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। ভাবা যায়! দেশটা স্বাধীন হয়েছে তখনও এক বছরও হয়নি, এরই মধ্যে এতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তেপ্পান্ন বছর প্রায়। এর মধ্যে কোনও কোনও শাখায় বিশ্ব দরবারে নিজেদের পরিচয় এতটাই দাপটের সাথে করেছে এই দেশটি, যা দেখে বিশ্ব রীতিমত অভিভূত। কিন্তু স্বাধীন দেশের শিল্পের দুনিয়ায় বিশেষ করে সিনেমায় আমরা কি আমাদের সেই স্বকীয় রূপটা প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি? সে আলোচনাই করতে চাই এখানে। না পারলে কেন পারিনি তাও আলোচনা করা যেতে পারে। একই সঙ্গে আলোচিত হবে দেশের সাম্প্রতিক সিনেমার যাত্রা ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতার পরিস্থিতি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালেও ২৯টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। ভাবা যায়! দেশটা স্বাধীন হয়েছে তখনও এক বছরও হয়নি, এরই মধ্যে এতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। যদিও এই সময়ের মুক্তি পাওয়া সিনেমাগুলোর বেশিরভাগই ৭১’র সময় মুক্তির জন্য প্রস্তুত ছিলো বা হচ্ছিলো। যুদ্ধের জন্য মুক্তি দেওয়া সম্ভব হয়নি। সে বছরের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রশংসিত সিনেমা হচ্ছে ওরা এগারো জন। বাংলাদেশের সিনেমার উন্নয়নের একটা তুলনামূলক উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, গত পঞ্চাশ বছরে ‘ওরা এগারো জন’ সিনেমার কাছাকাছি মানেরও কোনও মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মিত হয়নি। কেন হয়নি এ নিয়েও বিস্তর আলোচনা করা যেতে পারে। রীতিমত গবেষণাও সম্ভব। কিন্তু গবেষণা করার সুযোগ যেহেতু আমাদের নেই, তাই আমরা কেবল আমাদের ধারাবাহিকতাটাই দেখে পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করবো। আর খুঁজে বের করতে চেষ্টা করবো বর্তমান বাংলাদেশের সিনেমা আদতে সেইসব অতীতের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে আগাচ্ছে, নাকি কোনও পথই তৈরি করতে পারছে না?
বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে একটা বিষয় আমরা দেখতে পারি, প্রতিটি দশকে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের নানা জনরার (জঁরা) সিনেমা নির্মিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সিনেমার প্রধান উপাদান ছিলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের স্বপ্নবাজ ও তরুণ নির্মাতাদের কাছে তখন স্বাধীনতাই ছিলো সিনেমা নির্মাণের সবচেয়ে সেরা উপাদান। তবে তাও কমে আসতে থাকে। সিনেমা তার স্বাভাবিক চেহারায় সামাজিক অ্যাকশন ও রোমান্টিক ধারায় ফেরে মুক্তিযুদ্ধের দুই তিন বছরের মধ্যেই। তবে সবচেয়ে বেশি যে ধারার সিনেমা নির্মিত হয়েছিলো তা হলো রোমান্টিক ধারা। একই সময়ে একটা ট্রেন্ড শুরু হয় দেশের সিনেমায়, তা হলো বিদেশী সিনেমার অনুকরণে বাংলা সিনেমা নির্মাণ। বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার রিমেক। বাংলাদেশের সিনেমায় ভারতের অলটাইম হিট শোলে’র রিমেক ‘দোস্ত দুশমন’ দিয়েই বোধকরি এই ধারার শুরু। পরবর্তীতে ভারতীয় বহু হিট-সুপারহিট সিনেমা বাংলাদেশ পুনঃনির্মাণ বা কপি করেছে। কাছাকাছি সময়ে সাহিত্যভিত্তিক সিনেমা নির্মাণও শুরু হয় দেশে। যেসব সিনেমা মূলতঃ ইন্ডাস্ট্রি সিনেমার সমান্তরালে নির্মিত হতো— কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই এফডিসি থেকেই পাওয়া যান্ত্রিক সুবিধা বা অনুষঙ্গ ব্যবহার করে। ফলে সাহিত্য নির্ভর বা চলচ্চিত্র উৎসবগুলোর জন্য নির্মিত সিনেমাগুলোও বিএফডিসির ওপরই নির্ভরশীল ছিলো বলা যায়।
এই সিনেমার স্বাধীনতাটাই তো আমাদের দেশে নেই। সেন্সরবোর্ড বলে যে বিষয় রয়েছে, তা দিয়ে আদতে সেন্সর করা হয় না, করা হয় নিয়ন্ত্রণ। দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও এই সেন্সরবোর্ড আধুনিকায়ন হচ্ছে না। নতুন চিন্তার প্রভাব সেখানে নেই।
আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশে পৌরাণিক গল্পের ওপর নির্ভর করে সিনেমা নির্মিত হতে শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের সিনেমা পায় দেশের ইতিহাসের এ যাবৎকালের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। একটার পর একটা পৌরাণিক ও মধ্যযুগীয় গল্প হয়ে ওঠে সিনেমার প্রধান ধরণ। অবশ্য বেশিরভাগ সময়ই বাণিজ্যিক সিনেমার ইন্ডাস্ট্রি পরিচালিত হয় সর্বাধিক হিট ছবির ধরন দিয়ে। কোনও সময়ে যদি একটা সিনেমা মুক্তি পেয়ে বাম্পার হিট হয়, তখনই একই ধরণের সিনেমা নির্মাণের হিড়িক পড়ে বাণিজ্যিক সিনেমার নির্মাতাদের মাধ্যমে। আশির দশকে এই ট্রেন্ডকে উস্কে দিয়েছিলো সেই ’বেদের মেয়ে জোসনা’ সিনেমা। যাকে একদিক থেকে সিনে ইন্ডাস্ট্রির স্ট্রেংথ হিসেবেও উল্লেখ করতে পারি আমরা। কারণ, পুরো দশক জুড়েই এ ধরণের সিনেমাই নির্মিত হয়ে আসে তখন। একই ধরণের গল্পের মধ্যে রোমান্টিক, সামাজিক গল্প ও অন্যান্য ধারার প্র্যাক্টিসও করা হয়ে যায় তখন।
নব্বই দশকে বাংলা সিনেমার ট্রেন্ডে থাকে মার্শাল আর্ট বা পুরোপুরি অ্যাকশন নির্ভর সিনেমা। যেখানে গল্প বা নির্মাণশৈলীর চেয়ে ‘অ্যাকশন’ই গুরুত্বপূর্ণ বিনোদন হিসেবে ধরা হতো। আর তাই নব্বই দশকের শুরুর দিকে ছিলো সেই ধারাই। নব্বইয়ের শুরুতে নতুন ধারার প্রেমের গল্পের প্রবণতা শুরু হয়। সেই সময়ই সিনেমায় আসে বেশ কিছু নতুন নায়ক। তাদের সর্বাগ্রে ছিলেন সালমান শাহ। বাণিজ্যিক সিনেমায় তার হাত ধরে প্রেমের গল্প নতুন করে রূপান্তরিত হয়। সালমানের মৃত্যুর পর অন্য নায়কদের মাধ্যমে রোমান্টিক ধারা স্বতন্ত্র ধারা হিসেবে চলচ্চিত্রে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। যদিও রোমান্টিক সিনেমা আগে থেকেই নিয়মিত ছিলো, কিন্তু নব্বই দশকে এসে এইটা নতুন মাত্রা পায়। কিন্তু একই সময়ে নব্বইয়ের শেষ দিক থেকে বিশ শতকের (কবিতায় তো শূন্য বলা হয়) শুরুতে সিনেমায় আসে এক ধরনের প্রাপ্ত বয়সীদের জন্য যৌন সুরসুরিমূলক সিনেমা নির্মাণের হিড়িক। তখন থেকেই কমতে শুরু করে সিনেমা হল। পাশাপাশি বাড়তে থাকে এফডিসির বাইরে সিনেমা নির্মাণ সুবিধা ও সিনেমা নির্মাণও। ডিজিটালের সহজলভ্যতায় সিনেমায় দারুণ সুযোগ তৈরি হয়। আর ট্রেন্ড হিসেবে বিশ শতক পর্যন্ত নির্দিষ্ট কোনও ধরণই ছিলো না। তবে গেলো বিশ বছরে বেদের মেয়ে জোছনা’কে অতিক্রম করার মতো সুপারহিট সিনেমাও নির্মিত হয়নি। একই সাথে সিনেমা হলের পরিবেশ সকলের জন্য স্বাভাবিক না থাকায় ও ব্যক্তিগত বিনোদন মাধ্যমের প্রভাব বেড়ে যাওয়ায় সিনেমা ধীরে ধীরে লার্জার স্ক্রিনের প্যারালালে হোমস্ক্রিনের দিকে ঝুঁকতে শুরু করে। বর্তমানে আমরা এই প্রেক্ষাপটেই রয়েছি। এই সময়টায় বড় ক্যানভাসের সিনেমার জন্য বড় বাজেট প্রয়োজন হওয়ায় সব সিনেমার গন্তব্য আদতে সিনেমা হলই রয়ে গেছে। সাম্প্রতিক সময়েও বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমায় দেখা যায় পাশ্ববর্তী দেশের মূল ধারার সিনেমার প্রভাব। কিন্তু দর্শকের মনে সেইসব সিনেমা প্রভাব বিস্তার করতে পারছে তুলনামূলক কম। কিন্তু বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সিনেমা যেইটা সেইটার আদতে কি অবস্থা? কোনও নির্দিষ্ট ধারা কি ধারণ করতে পেরেছে?
দুই হাজার সালের পর হিট সিনেমা বললে বলতে হয় মনের মাঝে তুমি, মনপুরা, হাওয়া, দেবী, প্রিয়তমা, সুড়ঙ্গ ছাড়া তেমন নাই। এর মধ্যে বেশিরভাগই এফডিসির বাইরের নির্মাতাদের হাত ধরেই সিনেমার এই যাত্রা। তবে কোনও সিনেমাই বাণিজ্যিক সিনেমার ধারায় প্রভাব ফেলতে পারেনি। ফলে সিনেমা হলে বাড়েনি বাজারও। একই সাথে কথা ওঠে শুধু সিনেমার ধারার জন্যই কি দেশের সিনেমার কোনও নির্দিষ্ট চারিত্র দাঁড়ায়নি? এক কথায় বলা চলে, না! বাংলাদেশের সিনেমার চারিত্র শক্ত করতে বাণিজ্যিক সিনেমা ততটা ভূমিকা রাখে না। যতটা রাখে অবাণিজ্যিক সিনেমা। আবারও সেই চলচ্চিত্র উৎসবকেন্দ্রিক সিনেমার জয়জয়কারই এখানে করতে হয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে যেসব সিনেমা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সফলতা বা সুনাম অর্জন করছে সেইসব সিনেমা তৈরি করে চারিত্র। কিন্তু দেশে তো এমন সিনেমা খুব কম হয়। তাহলে সিনেমার চারিত্র কীভাবে দাঁড়াবে? ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প ঘোষণা করলেই এখানে রাতারাতি এই চারিত্র দাঁড় হয়ে যাবে না। তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সিনেমা নির্মাতাদের নিশ্চয়তা। তাদের চিন্তা ও কথা বলার স্বাধীনতা। সিনেমার স্বাধীনতা। কিন্তু এই সিনেমার স্বাধীনতাটাই তো আমাদের দেশে নেই। সেন্সরবোর্ড বলে যে বিষয় রয়েছে, তা দিয়ে আদতে সেন্সর করা হয় না, করা হয় নিয়ন্ত্রণ। দীর্ঘদিন ধরে বলা হলেও এই সেন্সরবোর্ড আধুনিকায়ন হচ্ছে না। নতুন চিন্তার প্রভাব সেখানে নেই। উল্টো সেন্সরশিপ আবির্ভুত হতে যাচ্ছে ব্যক্তিগত বিনোদনের কাঠামো মানে ওটিটিতেও। যেখানে দরকার সহযোগিতা সেখানে যেন প্রতিবন্ধকতার মহড়া দিতে বসে থাকে একদল লোক। আদতে তারাই কি ঠিক করে থাকেন সিনেমার গন্তব্য? যে বা যারা সিনেমার গন্তব্য কী হওয়া উচিত তাই জানেন না!
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বাণিজ্যিক ধারায় বেশ কিছু পরিবর্তন আসছে। যার অধিকাংশই ইতিবাচক। যদিও শিল্পমান সম্পন্ন সিনেমার ক্ষেত্রে সেসব ততটা গুরুত্বপূর্ণ না হলেও গণমানুষের সিনেমায় তা গুরুত্বপূর্ণ। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে রয়েছে কারিগরি কিছু বিষয়। যেমন, সিনেমাটোগ্রাফিতে আসছে ডিজিটালাইজেশন বা আধুনিকতার ছোঁয়া। শিল্প নির্দেশনায়ও বেশ উন্নতির লক্ষণ দেখা গেছে। বাণিজ্যিক সিনেমার সম্পাদনায়ও এসেছে যুগোপযুগি আধুনিক সম্পাদনার ছোঁয়াও। এসব কারণে সবচেয়ে বড় যে উপকারটা হয়েছে তা হলো স্ক্রিন বা পর্দাটা হয়েছে ঝকঝকে। গল্প বলায়ও গতি আসছে বেশ। এর ফলে বাংলাদেশের সিনেমা উত্তর আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়ার সিনেমা হলে মুক্তি দিয়ে বাঙালি দর্শকদের আকর্ষণ করা যাচ্ছে। দেশেও সিনেপ্লেক্স আর মাল্টি স্ক্রিনের সংখ্যা বাড়ছে। বড়ো বড়ো চলচ্চিত্র উৎসবগুলিতেও বাংলাদেশের সিনেমা আগের চেয়ে বেশি যাচ্ছে। একদল মেধাবি তরুণ নির্মাতার আবির্ভাব হয়েছে। নিঃসন্দেহে এসব উদাহরণ বাংলাদেশের সিনেমার জন্যে দারুণ খবর। কিন্তু এখনও নির্মাতারা স্বাধীনভাবে পর্দায় তাদের গল্প বলতে পারছেন না। ক্যামেরার লেন্সে নানারকম অদৃশ্য শেকল পরিয়ে রাখা হয়েছে, মেধাবি নির্মাতারা তাই শুরুতেই হতোদ্যম হয়ে যাচ্ছেন। সেন্সর বোর্ড তো আছেই, রাজনৈতিক ও পুলিশি কর্তৃত্ববাদ তো আছেই। যে কারণে দেশের সিনেমা নিয়ে যতটা আশাবাদী আপনি আমি হতে চাই, ততটা পারি না। এইসব প্রতিবন্ধকতা বারবারই পেছনে টেনে ধরে।
ইলিয়াস কমল
কবি, সাংবাদিক। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে।
প্রকাশিত বই:
অতিরিক্ত বাগান বাড়ি (২০১৭, কবিতা)
প্রিয় মেঘমঞ্জরি (২০২০, কবিতা)