রশীদ করীম পড়ছিলাম— বাঙালি মুসলিমের অন্দরমহল, তার ব্যবহৃত তশতরী-দস্তরখান-সরবোশ কিংবা ইজারবন, তার ভুক্ত ‘পাপিতা’ কিংবা ‘আম্রুদ’, তার বাঙালি হিন্দুর প্রতি তুলে চাওয়া অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ চাহনী, তার প্রায় অনাবিষ্কৃত এবং নিরালোচ্য দৈনন্দিন জীবন, তার মধ্যবিত্তসুলভ (গ্রামীণ মুসলমান সমাজ অনুপস্থিত এবং অদৃশ্য) অবদমিত কাম— পরস্ত্রী এবং পরিচারিকাপ্রীতি। আমাদেরকে রশীদ করীম স্মরণ করিয়ে দেন যুগান্তরের গলার আওয়াজ, সেই ‘আনোয়ারা’ / ‘জোহরা’ থেকে কুণ্ঠিত-অপ্রাপ্তবয়স্ক কণ্ঠস্বরের শুরু। শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানের নিজের দিকে তাকাবার চেষ্টা তাঁর উপন্যাসগুলিতে প্রখর, এই দৃকপাত কখনো রোমান্টিক, কখনো আত্মসচেতন, কখনো অনুসন্ধানী।
যেখানে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক তোয়ের হয়, সেটাও যেন ইতিহাসের আদলে, তাতে তার মুসলমান সমাজের লোকে কি খায়-কী পরে-কী ভাবে-কী করে দিনাতিপাত করে সেই সার্বিক চিত্র অনুপস্থিত।
যদিও ভারতবর্ষ বিষয়ে বলতে গিয়ে ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলেশ স্বীকার করেছিল— এতে মুসলমান আছে, মুসলমানদের চালচিত্র তৈরিতে এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ব্যবহার করেছিলেন “শ্বেতপ্রস্তর-রচিত বড়ো বড়ো অভ্রভেদী সৌধশ্রেণী, পথে লম্বপুচ্ছ অশ্বপৃষ্ঠে মছলন্দের সাজ, হস্তীপৃষ্ঠে স্বর্ণঝালরখচিত হাওদা” (‘দুরাশা’), কিংবা “বৃহৎ তাম্রঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতিদূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝড়ের স্ফটিক দোলকগুলির ঠুন্ ঠুন্ ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান , বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক” (ক্ষুধিত পাষাণ)। এই অনুষঙ্গগুলি আরেক দেশের, আর জনমের। মুসলমানদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে জানা যায় এই যে তাদের আশপাশে ‘কিংখাবের সাজ পরা ভীষণদর্শন কাফ্রি’, তাদের সামনে ‘নীলাভ স্ফটিকপাত্রের নাশপাতি-নারঙ্গী আর আঙুর’, তাদের নারীদের “জাফরান রঙের পায়জামা এবং দুটি শুভ্র রক্তিম কোমল পায়ে বক্রশীর্ষ জরির চটি পরা, বক্ষে অতিপিনদ্ধ ফুলকাটা কাঁচুলি আবদ্ধ, মাথায় একটি লাল ট্যুপি এবং তাহা হইতে সোনার ঝালর ঝুলিয়া তাহার শুভ্র ললাট এবং কপোল বেষ্টন করিয়াছে” (‘ক্ষুধিত পাষাণ’।
তাঁর মতন দ্রষ্টাকেও শেষ অব্দি আলিফ লায়লা ওয়া লায়লার দৃশ্য যা পুরানো মুঘল মিনিয়েচার ছবিকে ভরসা করে আঁকতে হয় মুসলমানের ছবি। ঐতিহ্যে-সংস্কারে-নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে মূল ভূখণ্ড থেকে আলাদা হয়ে থাকার একরকম আন্তর প্রয়াস বাঙালি মুসলিমকে তথা তার সাহিত্যকে স্বতন্ত্র করে রেখেছে। তার কাছে আদরণীয় হয়েছে পুঁথিসাহিত্য। তার পদ্যসাহিত্যের মন পড়ে রয়েছে বিশ্বমুসলিমের দিগ্বিজয়ের গাঁথায়— কবে কোন ক্রুসেডে জয়ী হয়েছিল সেই রোমাঞ্চে। তার গদ্য প্রাথমিকভাবে ছিল বঙ্কিমী আবহ এবং ঘটনাচিত্রের মাঝে কেবল মুসলিম নাম এবং আরবি-ফার্সি শব্দ ইনফিউজ করে দেওয়া, যেখানে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক তোয়ের হয়, সেটাও যেন ইতিহাসের আদলে, তাতে তার মুসলমান সমাজের লোকে কি খায়-কী পরে-কী ভাবে-কী করে দিনাতিপাত করে সেই সার্বিক চিত্র অনুপস্থিত।
বাঙালি মুসলিমের জীবনের গদ্যচিত্রের চিত্রকর জুটেছে হাতে গোনা, সৈয়দ মুজতবা আলী, বেগম রোকেয়া, মোহাম্মদ নজিবর রহমান , কাজী ইমদাদুল হক, মাঝে মাঝে সুফিয়া কামাল, আবু রুশদ, শওকত ওসমান, আবু ইসহাক, শহীদুল্লাহ কায়সার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, গৌরকিশোর ঘোষ, আবুল বাশার। সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছ থেকে মিলেছে শেফালীবোঁটায় রাঙানো ঈদের জর্দা বানানো সকাল। বেগম রোকেয়ার উদ্বিগ্ন সিনিকাল কলম থেকেও জুটেছে সর্ষের তেলের প্রদীপ জ্বালানোর অন্দরমহলের ছবি, যেখানে দুটি শিশুকে ঘুম পাড়াতে অভ্যস্ত হাতে দেওয়া চলে আফিম। সুফিয়া কামালের স্মৃতিচারণে এসেছে জল ভেজানো খস্-এর টানাপাখায় বাতাস দেবার ছবি— সারারাত পেতলের হাণ্ডিতে সেদ্ধ দেওয়া শবদেগ (মোরগা-শালগম-আলুর ঘৃতপক্ক পদ— ইহুদিরা যেমন সমস্ত রাত রাঁধে cholent), পাঠ্যপুস্তকের সুবাদে আমরা ‘আব্দুল্লাহ’র সদর ও অন্দর দেখেছিলাম। নজরুলের গদ্যের চম্পা-চামেলিবিলাসী নারী এবং রাজশক্তির সাথে যুযুধান পুরুষকে এখানে আনতে চাই না আর। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কিংবা আবুল মনসুর আহমদ জানিয়েছেন বাঙালি মুসলিমের মাজারপ্রীতি-ফকির-পীরপ্রীতির অন্ধকার।
এইসব ছোটবড় খণ্ডচিত্রকে জুড়ে এবং খামতি পুড়িয়ে একটা কালের বৃত্তচাপ রচনা করা সহজ কাজ নয়, সহজ নয় একটি গোষ্ঠীর নিজেকে পর্যালোচনা করবার বুভুক্ষা মেটানো। রশীদ করীম সেই অসহজ কাজটির একাংশ করেছেন, নেহাত অবলীলায়। তাঁর গল্প বলবার ধরনে যদিও কথার মারপ্যাঁচ নেই তবু একরকমের স্বাদু ‘আনপ্রেডিক্ট্যাবিলিটি’ আছে, ‘ডিটেইল’গুলি (কে কি পরছে, কি রাঁধছে, কি দেখছে, কি শুনছে) মূল নকশাকে অতিক্রম করে যায়নি বরং ভাবনার চিত্র বিনির্মাণে দারুণ লাগসই হয়েছে। পটভূমি-দৃশ্যায়ন-উপমান সবই তাঁর দক্ষ হাতের লোফালুফিতে হয়ে উঠেছে চলচ্চিত্র।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মজিদের সামনে যেমন ক্লাইম্যাক্সে এসে রক্তাক্ত চোখের মতন হিলহিলে কুপির আগুন জ্বলে (লালসালু), যেমন করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটবকুলপুরের যাত্রীরা পিছ ফিরে দেখে টঙ-এ ঝুলন্ত কারখানার টিমটিমে আলো, সেইরকম ছোট ছোট চকচকে স্প্যাচুলার ধার দিয়ে রশীদ করীমও বাড়তি রঙ ফেলে দিয়েছেন, পাশের বাড়ির ছেলেপুলেদের ক্যারম খেলার শব্দ দিয়ে তিনি অলস সকাল-দশটা তৈরি করেছেন। আবার অনেক স্থানে কলম খুলে দৃশ্যনির্মাণ করেছেন, তার উদ্দেশ্য শুধু স্বভাবলিপ্সু পাঠকের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি নয়, পরিতৃপ্তি। উদরপূর্তি। এইখানে একটি উদ্ধৃদি দেবার লোভ করি—
“সাঁঝরাতে ঝুম বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখন শীত বড় দুরন্ত। গোটা কুষ্টিয়া শহরটাই ঘুমে মগ্ন। কেবল থেকে থেকে ট্রেজারি থেকে হুংকার ওঠেঃ হু কাম দার? জবাবও আসেঃ ফ্রেন্ড।
এবং কোথায় জানি না একটা ডাইনামো বাজতেই থাকে ঢিপ ঢিপ ঢিপ। আকাশের সারা গায়ে তারা ফুটেছে। চাঁদ হাসছে বড় মধুর হাসি। তারই নিচে পড়ে থেকে লোহার রেললাইন চিকচিক করছে। সামনের তালগাছটি ক্লান্ত পানখা পুলারের মতো মাঝে মাঝে নাড়ছে পাতা। তারই ঠিক নিচে জ্যোৎস্নার অস্পষ্ট আলোকে সম্মুখের কুঁড়েঘরটি ঘোমটা পরা গ্রাম্যবধূর মতোই দাঁড়িয়ে আছে। দেখলাম, একটি খরগোশ লাফিয়ে রেললাইন পেরিয়ে চলে গেল। ডানদিকের ডোবাটির ময়লা পানির ওপর জ্যোৎস্নার আলো সরের মতো ভাসছে…” (প্রসন্ন পাষাণ)
অইসব চাটুর শব্দ-কোর্মার খুশবু টেবিলক্লথের কসিদার সুচিকর্ম-খাঞ্চার নাস্তা-হাতে বোনা লেসের আড়ালে কতদিনের কত অন্যায় আলস্য কত অমানবিকতা পরিপাটি করে ঢেকে রাখা, কত তিশনার ছোট ফুপুর অমূল্য মানবজীবন অপ্রেমে বয়ে যাওয়া…
পাড়াগাঁয়ের শীতের রাত্রি তার মৃতমাধুরীর কণাসমেত এমন করে সরেজমিনে পরিবেশিত হয়েছে, কারণ নায়িকা ‘তিশনা ইয়াসমীন’-এর অঘোর সাক্ষাত ঘটেছে তার বিপত্নীক পিতার নতুন স্ত্রীর সাথে। গৃহহীনতার অস্থির বেদনা, নগরজীবনের অপরিসর অন্দরে প্রিয় পরিজনকে প্রেমের জন্যে কলঙ্কিত হতে দেখে পেষণরত বিবেক এইসব মিলে তার যে মনোবৈকল্য এবং সে মন্থনের প্ররোচনায় পরদিন শরতকালের সকালে চলন্ত ট্রেনে উঠে যাওয়া— এইসব কিছুর জন্য অই ক্লান্ত তালগাছ-পচা ডোবার স্থির জল-মৌনমুখী কুঁড়ে-মরা জোছনা এমনকি অই রেললাইন ডিঙানো চকিত খরগোশ জরুরি ছিল বৈকি।
‘উত্তম পুরুষ’, ‘প্রসন্ন পাষাণ’, ‘প্রেম একটি লাল গোলাপ’-এর নারী-পুরুষের সম্পর্ক-জটিলতা-বেদনা-সূক্ষ্ম টানাপড়েন এইগুলিই মূলত রশীদ করীমের এলাকা। রক্তমাংসপিত্তশ্লেষ্মার নরনারী তাঁর বিষয়, নাগরিক সাহিত্যের যা গন্তব্য। ‘প্রসন্ন পাষাণ’-এ বিধবার পুনর্বিবাহ আর বিপত্নীকের পুনর্বিবাহে কি বেদনাদায়ক পার্থক্য! একটিতে ঝড়বৃষ্টির রাতের অনুষঙ্গ অন্যটি ঝঞ্ঝাবিহীন শরতের বেলা। একটি পাপের মতো গোপন, অন্যটি প্রাত্যহিকতার মতো অনায়াস। আমার আবার মনে পড়ে যায় ‘গন উইদ দ্য উইন্ড’-এর আমেরিকা, ‘এ বিস্তীর্ণ ভূমিতে নারীর কাছ থেকে চাওয়া হয় সে যেন প্রসববেদনায়ও টুঁ শব্দ না করে, এদিকে ব্যাটাছেলের হাতে তারকাঁটা ফুটলে সে চেঁচিয়ে আকাশ চৌচির করে দিতে পারে!’
নারীকে দেখবার জন্যে অপর নারীর সামাজিক চক্ষুও অবশ্যম্ভাবীভাবে জাজমেন্টাল, কে দুশ্চরিত্রা, কোন ব্যবহারের মাপ নিন্দনীয় বা নীতিহীন এইগুলি নিয়ে উপন্যাসগুলির আধুনিক নারীপুরুষ পদে পদে এত মাথা ঘামায় যে মনে হতে পারে, এ ঔপন্যাসিকের নিজের মত নয় তো? প্রাচীনপন্থী হিসাবে যেভাবে চিহ্নিত হয়ে গেছিলেন তারাশঙ্কর, যেভাবে চিহ্নিত হতে পারেন একালের শীর্ষেন্দুও (তাঁর গল্পে আধুনিক-শিক্ষিত-সুস্থদেহী নারী হেরে যায় বারবার উপবাসে বিশ্বাসী-সংস্কারাচ্ছন্ন-ক্ষীণস্বাস্থ্য নারীর কাছে)। তার পরপরই আশা জাগানিয়া মন বলে— এ তো পুরনো দিনের গল্প, পুরনো মূল্যবোধের গল্প-পুরাতন দীর্ঘশ্বাস তো থাকবেই। যেমন আছে চরিত্রগুলির নিজেদের মধ্যে কথা বলবার অতিপুষ্পিত ভাষার ভনিতা, পুরনো সংস্কারের ভারেই যে তার এ দশা তা বোঝা যায়। যথার্থও মনে হয়। অতএব যখনই ‘জননীর চোখে জটিল সড়ক’ উঁকি দেয়, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে ‘কবরে নড়েন ক্ষুব্ধ জনক’। অইসব চাটুর শব্দ-কোর্মার খুশবু টেবিলক্লথের কসিদার সুচিকর্ম-খাঞ্চার নাস্তা-হাতে বোনা লেসের আড়ালে কতদিনের কত অন্যায় আলস্য কত অমানবিকতা পরিপাটি করে ঢেকে রাখা, কত তিশনার ছোট ফুপুর অমূল্য মানবজীবন অপ্রেমে বয়ে যাওয়া…
পার্ক-শো হাউজে দেবিকারানীর ‘অচ্ছ্যুৎ কন্যা’, পিচগলা পথে ব্যাঙের মতো থপথপিয়ে লাফিয়ে যাওয়া ভিস্তি, পার্ল হারবারে বোমা নিক্ষেপ, কে সি দে বা দ্বারিকের দোকান, ফ্লুরিসের পেস্ট্রি. মোহামেডান বনাম মোহনবাগান, লালা আর মুশতাক, গ্যাসপোস্টের আলো, ফিটন. করপোরেশনের রাস্তায় সকালে হোসপাইপ দিয়ে জলসেচন— এইসব মিলে যে আলেখ্য তা কেবল সেই জমানার মানুষদেরকেই স্মৃতির আলোছায়ায় আনাগোনা করায় না, পরবর্তীকালের পাঠকের ব্যক্তিগত স্মৃতিকেও উসকে দেয়। পড়া শেষ হওয়ামাত্র মন বলে— ‘বাহ’, আর মন বলে— ‘ভাগ্যিস’! ভাগ্যিস অই কাল-অই বধির যবনিকা স্থায়ী হয়নি, ভাগ্যিস যা গেছে তা একেবারেই গেছে (আসলেই?)। যেটুকু কালের চিহ্ন অমোচনীয় কালির মতো এই লেখাগুলিতে রয়ে গেছে, পাঠকজীবনের সদবৃত্তকে সম্পূর্ণ করতে তার প্রয়োজন ছিল।
সাগুফতা শারমীন তানিয়া
ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক। বর্তমানে প্রবাসী এই লেখকের বইয়ের সংখ্যা এগারো। লিখেছেন ‘ওয়াসফিরি’, ‘এশিয়া লিটেরারি রিভিউ’ এবং ‘সিটি প্রেস’-এর মতো সাহিত্য-জার্নালে। ২০১৯ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমির সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কার।