আমি সবসময় লেখক হতে চেয়েছি, এখনও চাই। তবে এই দুনিয়াতে আমার প্রিয়তম বিষয় সাহিত্য নয়, সঙ্গীত। আর আমার এক জীবনে যতো সুরেলা কণ্ঠ শুনেছি, মহান রুনা লায়লার চাইতে উদার কাউকে কখনো মনে হয়নি। ‘গডেস অভ অ্যামনেশিয়া’ (২০২২)র মতো সাংস্কৃতিক আলেখ্য লেখার পেছনেও অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর কালজয়ী গানগুলো।
‘মায়া’ মূলত মিথ্যা। জাদু হয়ে ওঠা বিস্ময় আর রূপকথার মতো অবাস্তব। আবার মায়ায় ডুবে যাওয়ার চেয়ে সত্যিকারের অনুভূতিও জগতে খুব কম আছে। এই যে প্রেম, সংসার, সন্তান, স্বদেশ, সম্পর্ক, রাজনীতি নিয়ে আমাদের এতো এতো আলাপ, সংগ্রাম, অভিমান, অভিযোগ— সমস্ত কিছুর মূলে আছে প্রধানত মায়ার কারসাজি। ইংরেজিতে একে ‘ইলিউশন’ বললে আমার ধারণা খুব সরলীকরণ হয়ে যায়। আবার মায়া কেবল ভারতীয় দর্শনের ‘জাদুকরী বিভ্রম’ও না। বরং এতো অনিবার্যভাবে জৈবিক যে এর অস্তিত্ব এড়ানো একেবারেই অসম্ভব!
কিন্তু ‘মায়া কাটানো’ বলতে একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যাই, যেতে হয়। মানুষের সাথে মায়ার সম্পর্ক তাই বিচিত্রতম। একভাবে বলতে গেলে মানুষ (এবং অন্য আরও প্রাণি) বেঁচেই থাকে মায়ার মোহে। আনন্দ, সুখ, উদযাপনের প্রধানতম উৎস হলো উপভোগের মায়া। আবার বিপদ, শোক, এমনকি বহু মৃত্যুর জন্যেও দায়ী আসলে মায়ার ফাঁদ। আমাদের ধর্ম, পুরাণ, সাই-ফাই, দর্শন, থিওরি যেমন ‘স্পিরিচুয়াল ইলিউশন’ বা অন্য দুনিয়ার অনুভূতি এনে দেয়। তেমনি প্রেম, সঙ্গীত, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, বিরহ, বিজ্ঞান ইত্যাদি নিয়ে আসে শরীর মন, মহাকাশ বা সমুদ্রের ‘অতল গভীর’ থেকে মায়াময় জীবনযাপনের ছোট-বড় গল্প।
এদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী গল্পের নাম ‘মাটির মায়া’। মাটির প্রথম অর্থ এখানে বাতাস, জল, জন্মভূমি। তবে সবচেয়ে জরুরি অর্থে এই ‘মাটি’ আমাদের শরীরগুলো। ‘জীবন’ হলো আমাদের জটিল, রহস্যময়, অনিশ্চিত ভ্রমণকাহিনী। দিনশেষে প্রত্যেকেই আমরা মহাবিশ্বের মরণশীল ক্ষুদ্র তুচ্ছ কণা। আমাদের গুরুত্ব কেবল অমর অবিনশ্বর শক্তির নদী হয়ে বয়ে চলায়। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত একইসাথে যাপন করতে পারি, তাই আমরা স্মৃতিকাতর, দুঃসাহসী। এমনকি আছে ‘অমরত্বের প্রত্যাশা’। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মায়ার খেলা’য় মায়াপরীদের জন্যে প্রাণবন্ত এক গান লিখেছিলেন।
মায়া করে ছায়া ফেলি মিলনের মাঝে,
আনি মান-অভিমান।
বিরহী স্বপনে পায় মিলনের সাথী।
মোরা মায়াজাল গাঁথি।
হুমায়ূন আহমেদ ‘নক্ষত্রের রাত’ শিরোনামে অতিরিক্ত সুন্দর একটা নাটক লিখেছিলেন টিভির জন্যে। মণীষার মতো ‘মায়াবতী’ চরিত্রে শমী কায়সারের হাসি-কান্না হয়ে উঠেছিল কোটি মানুষের প্রিয়তম কাহিনী। এই নাটকে হাসান নামের এক রহস্যময় দার্শনিক চরিত্রের জবানে শুনতে পাওয়া গেল জীবনের ঘোরলাগা এক আপাত সরল ব্যাখ্যা।
মানুষের প্রধান কাজ মায়া তৈরি করা এবং মায়া কাটানো
আমার দৃঢ় বিশ্বাস মানুষের তৈরি সুমহান সঙ্গীত কর্মগুলোর আসল সৌন্দর্য টের পাওয়া যায় কেবল কখনো কোনভাবে এইসব মায়াজাল সমস্ত মন দিয়ে অনুভব করতে পারল। আমার সারাজীবনের স্বল্প জ্ঞান বলে, সুরে বসানো গীতিকবিতাই মানুষের নানান রকম মায়াময় অনুভূতি প্রকাশের জনপ্রিয়তম উপায়।
⧫⧫⧫
আবার বেশিরভাগ মানুষেরই জীবনের প্রথম দিককার স্মৃতির একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে রূপকথা। বাস্তব-অবাস্তবের ভেদ নিয়ে তখন খুব একটা ভাবে না কেউ। রাজা, রানি, রাজপুত্র, রাজকণ্যা, দৈত্য-দানব, পরী, সিংহাসন – ইত্যাদি বিমূর্ত অথচ উজ্জ্বল ছবিতে ডুবে থাকার যে অতুলনীয় একটা আনন্দ আছে তা অস্বীকার করা অসম্ভব।
কিন্তু আমাদের বড় হতে হয়। বড় হওয়া মানেই ধীরে ধীরে এই রূপকাহিনীর ঘোর থেকে বেরিয়ে আসা। আমাদের নতুন নেশা হয়ে যায় বাস্তবকে জানা। মূর্ত এবং বৈষয়িক গুরুত্ব আছে এমন সব বিষয় নিয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি। না হয়ে উপায় থাকে না আসলে। জীবন মানে তো আসলে টিকে থাকা। আর এর জন্যে আমাদের নানা ভাবে যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত।
তবে এই বাস্তবের ঘোর কি সবার জন্যেই সমান অমোঘ, অপরিহার্য? দরকারি কাজের স্রোত কি সবার জীবনকে সমান তোড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়? নাকি কেউ কেউ ছিটকে পড়ে? কারও কারও অবসর মেলে প্রয়োজনীয়তার বাইরে গিয়ে প্রাণভরে দম নেয়ার? কেউ কেউ নিশ্চয়ই আরও একবার ঢুকে পড়ে অবাস্তবের ছায়ায়?
আমরা আসলে কল্পলোকের বাইরে একটানা বেশিদিন থাকতে পারি না। বাস্তবতা আর প্রয়োজন আমাদের খুব দ্রুত ক্লান্ত করে। নানা উসিলায়, অজুহাতে আমরা তাই বারবার ফিরে যেতে চাই কল্পনার অলীক জগতে। মানুষ যুগেে যুগে এই ফিরে যাওয়ার নানা উপায়ও সৃষ্টি করেছে। যেমন শিল্পকলার প্রায় সমস্ত রকম আবিষ্কার। খেলা নিয়ে প্রতিযোগিতা। প্রেম, বিরহ। মদ বা নেশা জাগে এমন সব কিছু। এমনকি অনেক আপাত দৃষ্টিতে দরকারি কাজও কখনও কখনও কোন না কোন মাত্রায় কল্পনার আশ্রয় নেয়। যেমন রাজনীতি। বলাবাহুল্য, এই উপায়গুলো থেকে একেক সময় একেকজন একেকটা বেছে নেয়, চেতনে হোক বা অবচেতনে।
আমি শৈশবে কিছুদিন ভেবেছি ছবি আঁকা শিখবো। কৈশোরে মন মজলো সাহিত্যে। বড় হয়েও লিখেছি, লিখছি। কিন্তু না চিত্রকলা না সাহিত্য, কারণ না জেনেও খুব সহজেই বলতে পারি, বাস্তব থেকে পালিয়ে আমি সবার আগে আশ্রয় নেই সঙ্গীতে। অথচ সুর, সারগাম, তাল, লয় আমার আয়ত্তের বহু বাইরে। বিন্দুমাত্র গান গাইতে পারি না, কোন বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে শিখি নাই। সুরের সাথে আমার যোগাযোগ কেবলই একজন নির্বিবাদ শ্রোতা হিসেবে যে বিশ্বাস করতে ভালোবাসে এই মহাবিশ্বে মানবজাতির সবচেয়ে সুন্দর অবদান হলো- বিচিত্র সব কথায় বসানো বিচিত্রতর সুর। আরও অজস্র মানুষের মতো, সঙ্গীত আমার প্রিয়তম রূপকথা।
⧫⧫⧫
আমি তাই খুব দ্রুতই সুরেলা একটা রূপকাহিনী লিখতে চাই। প্রেক্ষাপট একটা ছোট রাজ্যকে ঘিরে। এখানকার জানা-অজানা সব নদীতে সুরের সহস্র কোটি ঢেউ। অযূত নিযূত কণ্ঠ এখানে প্রতিনিয়ত গান গেয়ে চলে। দক্ষিন দিকে উত্তাল নীল গহীন সমুদ্র। এখানকার পাহাড় থেকে পাহাড়েও মেঘ হয়ে সারাদিন বয়ে চলে সুরের বাতাস। ফসলের মাঠ, বাজার, জনপদ সবখানে কান পাতলে শুনতে পাই উচ্চারিত অনুচ্চারিত অজস্র গান। আর সেই সব গান থেকে আমি অনায়াসে পান করি মায়ার মদিরা।
তোমার সুরের নেশায় যখন
ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন
কিংবা
তার ভাবে বিভোল রাঙা পায়ের তলে
পর্বত জঙ্গম টলমল টলে
নজরুলকে বলতে পারি আমার টলমল নেশালু পথের অন্যতম প্রধান দিশারী। তাঁকে অনুসরণ করেই হয়তো সুর সরোবরে দিশাহীন মিলিয়ে যাওয়ার আশায় বারবার আচ্ছন্ন হতে চেয়েছি। যেন আর কোন দরকারি কাজ এ জীবনে বাকি নাই, এমন আয়েশি ভঙ্গিতে আমি এই রাজ্যের সব জানলা, গলি, রাজপথ, খোলা মাঠ খুঁজে মধুর কিছু কণ্ঠ অনুধাবনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছি।
সাধনা শব্দের মানে তখনও কী জানি না। সুরে কোন রাগ, সঙ্গীতায়োজনে কত রকম বাদ্যযন্ত্র — কিছুই খেয়াল করার বয়স হয় নাই। কিন্তু অনবদ্য কণ্ঠটার সুন্দর কোমল মায়ায় মগ্ন হতে কোন কষ্ট হয় নাই। সাবিনা ইয়াসমীন থেকে শুরু হয়েছিল এই মুগ্ধতার যাত্রা। এখনও প্রতিনিয়ত সন্ধান পেয়ে যাচ্ছি জাদুকরি নতুন নতুন কণ্ঠের।
সময় এতো কম! এতো দ্রুত বয়ে যায় রাত থেকে দিন! এক জীবনে আমরা মধুময় কয়জনকেই বা আর পূর্ণ মনোযোগে শুনতে পারি? যাঁদের কণ্ঠের শ্রুতিমধুর গানগুলো আমাদের আদৌ কোনদিন শুনবার সৌভাগ্য হয় না, আফসোস, তাঁদের সংখ্যা অপরিসীম বেশি, দিন দিন পর্বত সমান বাড়তে থাকে দৃষ্টিসীমানায়!
যুক্তরাজ্যের লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক মাইকেল স্পিটজারের একটা আলাপ শুনছিলাম একবার ইউটিউবে। উনি বিশ্বাস করেন সঙ্গীতের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের অবশ্যই প্রাগৈতিহাসিক কাল পর্যন্ত যেতে হবে। কেবল সুরকার, গীতিকার, গায়ক গায়িকার জীবন এবং কাজ নিয়ে কথা বলা আদতে খুবই অপর্যাপ্ত। আমিও বিশ্বাস করি, সঙ্গীত এতো সর্বব্যাপী এবং বিস্তৃত যে এর কোন শুরু বা শেষ নাই। এই গ্রহে যখন মানুষ ছিল না, তখনও অনেক অনেক সুরের অস্তিত্ব ছিল। মানুষ এসে এই ভাণ্ডার ক্রমশ সমৃদ্ধ করেছে বিচিত্র উপায়ে। এই বুদ্ধিদীপ্ত প্রজাতির প্রায় সকলেই কোন কোনভাবে সঙ্গীত অনুধাবন এবং যাপন করে। এমনকি যারা নানা সংস্কারের কারণে গানকে পরিত্যাজ্য মনে করে, তারাও জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত কাটায় সুরের সাথে। এবং গান, মানুষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে, শিল্প-কলার অন্য যেকোনো শাখার চেয়ে প্রায় সদা-সর্বদা সহজলভ্য, অনেক বেশি গণতান্ত্রিক।
আমার জীবনের শুরু এবং গানের সাথে পরিচয় হয়েছে খুবই আশাবাদী এক সময়ে। গনতন্ত্রের পথে বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়েছে। হতাশা, অভাব, অভিযোগ, অপরাধ, শোষণ, নির্যাতন এইসব নিশ্চয়ই ছিল। কেবল ভাত, বাসস্থান, কাপড়ের ন্যূনতম ব্যবস্থা করতেই জীবনের সকল শক্তি ক্ষয় করা মানুষের কালেভদ্রে অবসর মিলত। তবু এই ক্লান্ত মানুষদের অনেকেই বাংলা গানের অপরিসীম ভাণ্ডারে ঢুঁ মারতো বিন্দুমাত্র ফুরসত পেলেই।
আমার শৈশব, প্রায় সকলের মতোই, রঙিন কেটেছে। বাবা-মাকে চোখের সামনে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করতে দেখতাম যেন অভাবের কোন কড়া ধাক্কা আমার গায়ে না লাগে। আসলেই আমাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতির তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলো থেকে। অভাব আর অন্যায় আমি দেখেছি বরং জানলা দিয়ে। যতো মলিন, যতো জীর্ণই হোক বাবা মা ঠিকই এক নিরাপত্তার দেয়াল তুলে রেখেছিলেন আমার পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের চারপাশে। কিন্তু আমার স্মৃতি পরোক্ষ কষ্টের অভিজ্ঞতাগুলোকেও অতি যত্নে সাজিয়ে রেখেছে। পরিবার, প্রতিবেশি, বন্ধু, সহপাঠীদের জীবনের সংগ্রাম নিয়ে প্রচুর কাতর হয়ে ভাবতাম। এই ভাবনাগুলো প্রায় অক্ষত অবস্থায় মনের ভেতর রয়ে গেছে। আনন্দ বিষাদ মাখা শৈশবের দারিদ্র্য-প্রধান স্মৃতিগুলোর মধ্যে কিছু আবার অবিশ্বাস্য রকমের উজ্জ্বল! নব্বই দশকের মাঝামাঝি উপহার পাওয়া লাল রঙের পকেট রেডিওতে যেমন একটা ঠিকানা শুনেছিলাম।
১২১, কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ, শাহবাগ, ঢাকা।
বাংলাদেশ বেতার এর তৎকালীন ঠিকানা। এখান থেকে বানিজ্যিক অনুষ্ঠাণে সকাল-সন্ধ্যা গান বাজানো হতো। প্রধানত সিনেমার গান। গরমকালের বিকেল গুলোতে গাছের গালে বসে আয়েশে পা দুলিয়ে দুলিয়ে শুনতাম। নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমার লাল রিসিভারে একটা মধুমাখা কণ্ঠ শুনে জীবনে প্রথম উদাস হয়েছিলাম।
শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে
কত সাধনায় এমন ভাগ্য মেলে
সাধনা শব্দের মানে তখনও কী জানি না। সুরে কোন রাগ, সঙ্গীতায়োজনে কত রকম বাদ্যযন্ত্র — কিছুই খেয়াল করার বয়স হয় নাই। কিন্তু অনবদ্য কণ্ঠটার সুন্দর কোমল মায়ায় মগ্ন হতে কোন কষ্ট হয় নাই।
সাবিনা ইয়াসমীন থেকে শুরু হয়েছিল এই মুগ্ধতার যাত্রা। এখনও প্রতিনিয়ত সন্ধান পেয়ে যাচ্ছি জাদুকরি নতুন নতুন কণ্ঠের। সারা দুনিয়ায় কতো রকমের গান হয় তার কোন সীমা পরিসীমা নাই। কতো কতো মনমাতানো কণ্ঠশিল্পী তাঁদের প্রাণ উজার করে গেয়ে যাচ্ছেন! কতো অজস্র মহান গীতিকার সুরকার সৃষ্টি করে চলেছেন মানুষকে তন্ময় করে রাখার মতো কালজয়ী সব কাজ। খুব সম্প্রতি যেমন একটানা শুনে যাচ্ছি অনুভ জেইন নামের একটা খুব তরুণ আবেগি কণ্ঠস্বর।
মেরি ইয়ে আঁখোমে আঁখোমে তো দেখো
স্কুল জীবনে মাতাল করে রেখেছিলেন জেমস। তিনি প্রতিটা শব্দ উচ্চারণ করেন একেবারেই নিজের মতো। বজ্রের মতো বলিষ্ঠ কোন কণ্ঠ থেকেও যে এতো মায়া নিয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে জমাট বুকের আবেগ, প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম।
কবিতা, তুমি স্বপ্নচারিণী হয়ে খবর নিও না
কবিতা, এই নিশাচর আমায় ভেবোনা সুখের মোহনা
দেখবে আমাদের ভালবাসা হয়ে গেছে কখন যেন পদ্ম পাতার জল
আরেকজনকে ভালো করে জানলাম কলেজে পড়ার সময়। যেন চির কিশোর তিনি। মোহাম্মদ রাফির গান কোনটা রেখে কোনটা বেশি প্রিয় ঠিক করে বলতে পারি না। তবে সবচেয়ে প্রিয় মানুষের সাথে বসে শুনেছিলাম তাঁর অবিস্মরণীয় ‘বাহারো ফুল বারসাও মেরা মেহবুব আয়া হ্যায়’। আমার জীবনের সুন্দরতম স্মৃতির আরেকটা হলো কুয়াশা-নিবিড় শীতের রাতে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে শোনা লতা মঙ্গেশকর আর মোহাম্মদ রাফির একটা গল্প-বলা ডুয়েট।
হাম হি মিলেথে কাভি যামুনা কিনারে
রাধা কিষাণ থে কাভি নাম হামারে
ফির য়ো পায়েলিয়া ফির য়ো মুরালিয়া
ফির য়োহি সাঙ্গীত রে
গানকে প্রেম বিরহের উর্ধ্বে অন্য কিছু ভাবতে শিখিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমার কাছে নুসরাত ফাতেহ আলী খান। ‘তুমহে দিল্লাগি ভুল জানি পাড়েগি/ মুহাব্বাত কি রাহো মে আ কার তো দেখো’ – তিনি যেন পরিচিত মানব অভিজ্ঞতার বাইরে অন্য আরেক জগতের সন্ধান দিলেন। আরেকজন মহান শিল্পীর গজল আমাকে আসমান জমিন যোগাযোগের মতো আধ্ম্যাতিক সুখ-দুঃখের সন্ধান দিয়েছে। নূর জাহানের কণ্ঠের ঢেউগুলো সুরেলা সূক্ষ্মতায় এখনও আমার ভেজা সৈকতের আছড়ে পড়ে।
অউর ভি দুখ হ্যায় জামানে মে মুহাব্বাত কে সিবা
রাহাতে অউর ভি বাসল কি রাহাত কে সিবা
পশ্চিমের গান শোনার অভিজ্ঞতা অনেকের তুলনায় আমার অনেক বেশি কম। যতোটুকু শুনেছি ম্যাডোনা আর অ্যারিথা ফ্র্যাঙ্কলিনকে মনে হয়েছে নিজ নিজ জেনারেশনের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ। অ্যাডেলের ‘আই উইল সেট ফায়ার টু দ্য রেইন’ এর একটা লাইভ পারফরমেন্স আমি সময় পেলেই দেখি। ইংল্যান্ডের রয়াল অ্যালবার্ট হল তাঁর কণ্ঠের আগুন-বৃষ্টিতে ঝলমল করে উঠেছিল সেই সন্ধ্যায়, আমি মোটামুটি নিশ্চিত।
রক মিউজিক আমার আরেকটা পছন্দের জনরা। গত শতাব্দীর রক ব্যান্ডগুলো থেকে অন্তত দশ বারোটার কম বেছে নেওয়া আমার মতে মহা অন্যায়। তারপরও যদি এক দুইজনের কথা নাম ধরে বলতেই হয় আমি বলবো কার্ট কোবেন আর জিম মরিসনের নাম। মরিসন আবার আমার অন্যতম প্রিয় কবিও। তাঁর কণ্ঠ একই সাথে নিয়ম ভাঙার তুরীয় আনন্দ আর বিদায়ের প্রায় মরণ-গন্ধা অনুভূতি দেয় ।
আই টেল ইউ উই মাস্ট ডাই
ও, মুন অভ আলাবামা
উই নাউ মাস্ট সে গুড বাই
⧫⧫⧫
২০০৬ সালে আমার জীবন যাপনের ধরণ আমূল বদলে গেল। যমুনার পাড়ের ছোট্ট গ্রাম থেকে আমি এসে পড়লাম বিশাল এক মহানগরে। রাজশাহী শহরের সবচেয়ে নামকড়া কলেজে আমাকে ভর্তি করে দেয়া হলো। কলেজ থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ, জিপিওর উল্টাদিকে একটা হোস্টেলে থাকি। কলেজের তিনটা দালানকে এক করে দেয়া করিডোর দিয়ে হাঁটতে অসম্ভব ভালো লাগে। তার চেয়েও সুন্দর হোস্টেলের পাশের পাবলিক লাইব্র্রেরি। ঢুকতেই কালাইয়ের রুটির দোকান। বাগানের মধ্যে দিয়ে এর পর একতলা দালান পর্যন্ত ইট বিছানো পরিষ্কার রাস্তা। বিকেলগুলো আমার এই দালানে বসে বই আর প্রত্রিকা পড়ে কাটে। সন্ধ্যায় বের হয়ে যাই নিউ মার্কেটের দিকে। পুবদিকের গেটের মুখে সিনেমা হল। তার সামনে সারি সারি চা, পুরি-সিঙ্গারার দোকান। ছোটবেলায় আমার অন্যতম প্রধান স্বপ্ন ছিল রাতের বেলা টং দোকানে বসে চা খাওয়া। গ্রামে থাকতাম, তাই কোনদিন সম্ভব ছিল না। শহরের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দিক এটাই। সন্ধ্যা হলেই ঘরে ঢুকে যেতে হয় না। বরং বাইরের জীবন এরপর আরও জমে ওঠে।
একদিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। তখন উপন্যাসটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল একটা অনলাইন ম্যাগাজিনে। দুই হাজার আঠারো সালের জুন/জুলাই হবে। একটানা তিন/চারদিন বসেও তেমন কিছু লিখতে পারছিলাম না। এদিকে সম্পাদক সাহেব নিয়ম করে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। অস্থির লাগছিল খুব। লিখব একটা অবুঝ শিশু আর তার পিতামাতার মধ্যেকার আবেগি যোগাযোগ নিয়ে। তাই মাথা ঠান্ডা রাখাও জরুরি। ভাবলাম যে সময়কাল নিয়ে লিখব, তখনকার কিছু গান শুনে দেখি।
পর পর অন্তত দুইকাপ চা শেষ করে তারপর তিনতলা নিউ মার্কেট ঘুরে ঘুরে দেখি। নিচতলায় সবচেয়ে পুরোনো দোকানগুলো। একটা দোকান আছে কেবল চুড়ি বিক্রি করে, আর কিছু না। এতো চুড়ি কবে কখন কে কেনে? এর তিনটা দোকান পরেই ‘মুন রেকর্ডিং’ নামে একটা ক্যাসেট সিডির দোকান। ওই দোকান থেকে একটা খুব পরিচিত গলার গান ভেসে আসছে। গানটা অচেনা, বিদেশি ভাষায়। গানটা মোটেও বাংলাদেশি না। কিন্তু বাংলাদেশ বেতারে অসংখ্যবার শুনেছি এমন কণ্ঠ গাইছে। কৌতুহলে টিকতে না পেরে দোকানদারের ডেস্কের দিকে এগিয়ে গেলাম। পিছনে অনেকগুলো এল পি রেকর্ডের কাভার সাজানো। আমি সামনা সামনি এইসব প্রথম দেখছি। গানটাও ক্যাসেট বা সিডি প্লেয়ারে বাজছে না, বাজছে গ্রামোফোনে।
ক্যাহদো ইস রাতসে কে রুখ যায়ে
দার্দে দিল মিন্নাতোসে সোয়া হ্যায়
ইয়ে য়োহি দার্দ হ্যায় জিসে লেকার
ল্যায়লা তাড়পিথি মাজনু রোয়া হ্যায়
এর পর থেকে আমার নতুন নেশা হয়ে গেলো গান সংগ্রহ করা। একটা ওয়াকম্যান কিনলাম। এরপর শহরের সব দোকান তন্ন তন্ন করে গানের ক্যাসেট খুঁজে বেড়াই। গ্রামোফোন নাই কিন্তু সেই চেনা কন্ঠের অচেনা বিদেশি গানের রেকর্ড কিনে পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখলাম। কাভারটা একেবারেই আলাদা। একবার তাকালে চেয়ে থাকতে হয় অনেকক্ষণ। নীল জমিনের উপর সাদা ইংরেজি অক্ষরে লেখা নাম। নিচে একটা রেকর্ড ভেঙে দুই টুকরা হয়ে গেছে বজ্রপাতে। মাঝখানে ফুটে আছে গায়িকার মুখ। তাঁর তাকিয়ে থাকার ভাষা সেই গানটার মতোই ভিনদেশি কিন্তু প্রচণ্ড মায়াময়।
আমি সবসময় লেখক হতে চেয়েছি, এখনও চাই। তবে এই দুনিয়াতে আমার প্রিয়তম বিষয় সাহিত্য নয়, সঙ্গীত। আর আমার এক জীবনে যতো সুরেলা কণ্ঠ শুনেছি, মহান রুনা লায়লার চাইতে উদার কাউকে কখনো মনে হয়নি। ‘গডেস অভ অ্যামনেশিয়া’ (২০২২)র মতো সাংস্কৃতিক আলেখ্য লেখার পেছনেও অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল তাঁর কালজয়ী গানগুলো।
একদিনের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। তখন উপন্যাসটা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল একটা অনলাইন ম্যাগাজিনে। দুই হাজার আঠারো সালের জুন/জুলাই হবে। একটানা তিন/চারদিন বসেও তেমন কিছু লিখতে পারছিলাম না। এদিকে সম্পাদক সাহেব নিয়ম করে তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। অস্থির লাগছিল খুব। লিখব একটা অবুঝ শিশু আর তার পিতামাতার মধ্যেকার আবেগি যোগাযোগ নিয়ে। তাই মাথা ঠান্ডা রাখাও জরুরি। ভাবলাম যে সময়কাল নিয়ে লিখব, তখনকার কিছু গান শুনে দেখি। ইউটিউবে খুঁজতে খুঁজতে চোখ আটকে গেল কম পরিচিত একটা ছবির গানের উপর। গানটা জীবনে বোধহয় প্রথমবার পূর্ণ মনোযোগে শুনলাম।
আহা! একটা এপিফ্যানি ঘটে গেল। মনে হলো এই জাদুকরী সুরেলা কণ্ঠ আসলে আমাকে অচেনা এক মায়ার সন্ধান দিয়ে গেল। কয়েক দিনের কড়া জড়তা কেটে গেল সুরের রানির এক মিনিটের উচ্চারণে। এই গানে তিনি চিরায়ত মা। সন্তানের সাথে তার রাজকীয় উপমায় আলাপ চলছে। আনন্দ আর বিষাদ মিশে অনায়াসে একাকার!
এই বুকেই পাতা আছে মায়ার সিংহাসন
স্নেহের ছায়ায় বসেরে তুই করে যা শাসন
আব্দুল্লাহ আল মুক্তাদির
জন্ম সিরাজগঞ্জে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা শেষ করে এখন শিক্ষকতা করছেন ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে। দৈনিক ‘সংবাদে’র সাহিত্য পাতায় ছোটগল্প ও কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ২০১০ সালে।
প্রকাশিত বই:
দুনিয়া ( গল্প। চন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম। ফেব্রুয়ারি ২০২৩)
গডেস অভ অ্যামনেশিয়া ( উপন্যাস। চন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম। ফেব্রুয়ারি ২০২২)
যুদ্ধ যুদ্ধ রুদ্ধ দিন ( কবিতা । চন্দ্রবিন্দু। চট্টগ্রাম। ফেব্রুয়ারি ২০২০)
বছরের দীর্ঘতম রাত ( গল্প। ঐতিহ্য। ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৯)
অন্য গাঙের গান, সমুদ্রসমান ( কবিতা। প্লাটফর্ম। ঢাকা। ফেব্রুয়ারি ২০১৬)