“স্বৈরতন্ত্র এবং সাহিত্য কেবল একটি উপায়েই সহাবস্থান করতে পারে, দিন-রাত একে অপরকে গ্রাস করার মধ্য দিয়ে। দুটো হিংস্র জন্তু যেমন নখরে, দন্তের আঘাতে পরস্পরকে ক্ষত-বিক্ষত করে একই বনে টিকে থাকে, ঠিক সেভাবে। কেননা একজন লেখক প্রাকৃতিকভাবেই স্বৈরতন্ত্রের শত্রু।”
—ইসমাইল কাদারে
সৃষ্টিশীল মানুষমাত্রই হতে হয় স্বাধীনচেতা, নিজ ও সামগ্রিক অস্তিত্বের প্রতি সৎ ও সাহসী। এ কারণেই, প্রতিনিয়তই এক দ্বন্দ্ব পোড়ায় তাঁকে। তিনি জানেন অস্তিত্বের মুক্তির স্বাদ, অথচ সম্মুখে দেখতে পান অন্য প্রাণের বেদনা, আরো অন্য কারো রক্তচোষা নিয়ন্ত্রণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের নির্মম অব্যবস্থাপনা ও সভ্যতার অগভীরতা, অসভ্যতা। এসবের প্রতিবাদে একজন কবি, লেখক বা যে কোনো শিল্পী—আওয়াজ তোলামাত্রই একপক্ষ ক্ষমতাবান তাঁর টুটি চেপে ধরতে উদ্যত হয়। এ যেন কাছে ও দূরে, পুরোবিশ্বের চিরন্তন চিত্র। তদুপরি, ক্ষমতাবানেরা যদি হয় অসহিষ্ণু, ফ্যাসিবাদী, তবে রাজনীতি ও সাহিত্যের লড়াই অন্য মাত্রা পায়। যেমন আমরা পাই, ফ্যাসিবাদ বনাম একজন ইসমাইল কাদারেকে। শেষমেশ সত্যের জয় হয়, তবে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে।
ইসমাইল কাদারে; যাকে ধরা হয় বর্তমান বিশ্বে জীবিত সাহিত্যিকদের মাঝে শ্রেষ্ঠতমদের একজন। তুলনা হয় গোগোল, অরওয়েল, কাফকা, মার্কেজ, কুন্ডেরা, দস্তয়েভস্কির সঙ্গে; এমনকি ‘আধুনিক হোমার’ বা ‘আলবেনিয়ার একিলিস’ বলেও আখ্যা দেয়া হয়। তাঁর অন্তত এককপি বই নেই এমন বাড়ি আলবেনিয়াতে খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। কেননা, গত শতকের অর্ধেককাল জুড়ে স্বৈরশাসনাধীন আলবেনিয়ায় মানুষ যেমন জীবনের নামে পরাধীনতা, দুঃস্বপ্ন, ভয় ও ভোগান্তি, বাঁধা ও বিস্বাদের ভেতর দিয়ে এসেছে তা আজকের প্রজাতান্ত্রিক আলবেনিয়ায় দাঁড়িয়ে সুদূর অতীত বলে মনে হলেও—ইসমাইল কাদারে তার কিছুই ভুলতে দেননি। আলবেনিয়াতে কাদারে এতই জনপ্রিয় ও প্রভাববিস্তারী, তারা চাইলেও সেই দিনগুলোর কথা ভুলতে পারবে না—অন্তত কাদারে ভুলতে দেবেন না।
বিভিন্ন লেখকের সঙ্গে তুলনা করা হলেও, কাদারে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন নিজস্ব স্বর ও লেখনি-শক্তিমত্তা দিয়ে। নিজ ভূমি, ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন সার্বজনীন পরিসরে, আলবেনিয়ার রাজনৈতিক ও জাতিগত অস্তিত্বের সংঘাত, অটোমান সাম্রাজ্যের সময়কাল হতে তাঁর সময় পর্যন্ত শোষিত মানুষের মনস্তত্বিক চিত্র, নিপীড়ক শ্রেণির স্বরূপ এঁকে—বৃহৎ পরিসরে ও বৈচিত্রময়তা দিয়ে। এবং কাদারের মধ্য দিয়েই আলবেনিয়ার সাহিত্য হয়ে ওঠে বৈশ্বিক, বহুল পঠিত ও স্বীকৃত। পরিচিতি পায় মূলধারার ইউরোপীয় সাহিত্যের অংশ হিসেবে।
ইসমাইল কাদারের এই সাহিত্যযাত্রা কখনোই মসৃণ ছিল না। স্বেচ্ছাচারী শাসকের অধীনে লেখালেখি করতে কাদারেকে পেরোতে হয়েছে বাঁধার পাহাড়, চড়াই-উতরাই। হতে হয়েছে নিষিদ্ধ, নির্বাসিত, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ও কুচক্রের চক্রান্তের শিকার; পেতে হয়েছে প্রাণনাশের হুমকি। নিজ বাসভবনও অনিরাপদ হয়ে উঠলে ছাড়তে হয় মাতৃভূমিকে। বলা হয়, কেবল সাহিত্য রচনার জন্য এতটা চরম মূল্য আর কোনো লেখককে পরিশোধ করতে হয়নি। কথাটা যে অত্যুক্তি নয়, তা বোঝার জন্য তৎকালীন একনায়কতন্ত্রের অধীনস্ত আলবেনিয়ার পরিবেশ বিশেষভাবে মনে রাখা জরুরি।
দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপে অবস্থিত ছোট একটি দেশ আলবেনিয়া। দেশটিতে—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৪ সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসে স্টালিনবাদ নাম্নী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক সরকার, আনোয়ার হোজ্জা। যার শাসনামলজুড়ে আলবেনিয়ায় লেখকদেরকে নিয়মিত হয়রানি করা হয়। যদিও সিনেমা বা সঙ্গীতের মানুষদের তুলনায় কম। ক্ষমতায় এসেই হোজ্জা তার রাজনীতি-বিরোধী ব্যক্তিদের চুপ করিয়ে দেয় ছোট থেকে বড় ও নির্মম শাস্তি দিয়ে। স্টালিনের রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার মডেলে আলবেনিয়াকে নতুন রূপে সাজাতে গিয়ে যাকেই হুমকি বলে মনে হয়েছে তাকেই নিপীড়ন, নির্যাতন, নির্বাসন, কারাদণ্ড, গুম ও হত্যার মাধ্যমে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। হোজ্জার শাসনকালে, কম করেও এক লাখ মানুষকে কারাবন্দি করা হয় রাজনৈতিক কারণে, প্রতিবাদ করায়, সরকারের সমালোচনা করে লেখালেখি করায়, গান রচনার জন্য। প্রায় পাঁচ হাজার মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, এর মাঝে কবি ও লেখকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এ প্রসঙ্গে কাদারে নিজেই বলেছেন, “একটি শব্দ! স্রেফ একটি শব্দও যদি সরকারের বিপক্ষে যায়, তবে নিন্দা করে না তারা, সরাসরি গুলি করে।” ফলে পরবর্তী পঁয়তাল্লিশ বছর, আনোয়ার হোজ্জা এবং তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলের অধীনে আলবেনিয়ার ইতিহাস হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারের ইতিহাস।
অর্থাৎ আলবেনিয়ার সমাজতন্ত্র কখনোই অন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর মতো উদার ছিল না। অন্য দেশে যেভাবে মানুষের বাক-স্বাধীনতা রয়েছে, নিজস্ব মতামত ও মতাদর্শ প্রকাশের সুযোগ আছে, গুরুত্বও রয়েছে—আলবেনিয়াতে ঠিক তার উলটো চিত্র ছিল। এখানে সিনেমা, সঙ্গীত বা সাহিত্য—যে কোনো প্রকাশমাধ্যমকেই রাখা হতো কড়া নজরদারিতে। তাই তৎকালীন আলবেনিয়াকে তুলনা করা যেতে পারে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে, অথবা ১৯৩০ এর দশকে স্টালিনের সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে। ইসমাইল কাদারে এমন পরিবেশেই লেখালেখি করে গেছেন—তিন দশক ধরে শাসনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন, সরকার ও আমলাদের অন্ধকার দিক তুলে ধরেছেন, বিদ্রূপ করেছেন সাহিত্যের মাধ্যমে; এক সময় রাষ্ট্রের বিপরীতে নিজের সাহিত্য ও নিরাপত্তা পর্যদুস্থ হলে, টিকে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন। কাজটা সহজ ছিল না।
টোটালিটারিয়ান একনায়কতন্ত্রের অধীনে বেড়ে ওঠা, লেখকসত্তার বিকাশ ও ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সাহিত্যকে বেছে নেয়া, অতঃপর কালক্রমে নিপীড়িত সাধারণের কণ্ঠ হয়ে ওঠার যাত্রাটি ছিল দুঃসাহসী, বুদ্ধিদীপ্ত ও চমকপ্রদ। যদিও কাদারে কখনো সরাসরি সরকার বিরোধী কার্যক্রমে অংশ নেননি। এবং তা সম্ভবও ছিল না। যে দেশে সরকারি আদেশ বিনা গাছের পাতাও নড়ে না, সে দেশে সরকারের বিপক্ষে সরাসরি কলম ধরা মানে—স্রেফ আত্মহত্যা। কাদারে এখানেই দিয়েছেন বুদ্ধিমত্তার পরিচয়। নিজেকে ভিন্নমতাবলম্বী বা বিপ্লবী বলে দাবি করে নয়, শুধু অসুস্থ এক রাষ্ট্রে সুস্থ সাহিত্য রচনা করতে চেয়েছেন। তাঁর প্রতিবাদের জায়গা ছিল গভীরে—ভাষা, সংস্কৃতি, জাতিগত পরিচয় ও ইতিহাসের ভিত্তিমূলে—যার উপর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বিশ্বাস ও আদর্শকে স্থাপন করে গেছেন অভিনব স্বরে এবং কোনো ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণ না করে।
কাদারের বেড়ে ওঠা ও সাহিত্যে হাতেখড়ি
ইসমাইল কাদারের জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৩৬ সালে, গ্রিস সীমান্তবর্তী আলবেনিয়ার জিরোকাস্তারে। কাদারের মা ছিলেন জিরোকাস্তারের অন্যতম ধনী পরিবারের মেয়ে। বাবা সাধারণ পরিবারের, পেশাগতভাবে ছিলেন বিচারসভার চিঠিপত্র বহনকারী পিয়ন। বাবার প্রতি কাদারের ভক্তি ও ভালোবাসা ছিল অসীম। বালক বয়সে কাদারেকে তাঁর এক চাচা (চাচাজান কানে কম শুনতেন) উপদেশ দেন, এ সমাজে টিকতে হলে রাজনীতির কথা এককানে ঢুকলে অন্য কান দিয়ে বের করে দিতে হবে।
কাকতালীয়ভাবে, জিরোকাস্তার ছিল আনোয়ার হোজ্জারও জন্মস্থান। ১৯০৮ সালে হোজ্জার জন্ম। এবং তার বাড়ি হতে দুইশ কদম দূরেই বাস করতো কাদারের পরিবার। পরিবারদ্বয় এভাবেই পূর্ব-পরিচিত ও শেকড়ে সম্পর্কিত।
হোজ্জা যখন ক্ষমতায় এলো, কাদারের বয়স তখন ৯ বছর। যুদ্ধ-পরবর্তী নতুন আলবেনিয়ায় প্রথম জেনারেশন হিসেবে কাদারে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে, যা তাঁকে স্বপ্নপূরণে অনেক সাহায্য করেছে। হোজ্জা যেসব সংস্কারের দিকে মনোযোগ দেয় তার মাঝে অন্যতম ছিল সাহিত্য। প্রবীণ লেখকদের অনেকেই স্টালিনিয় সমাজতন্ত্রের কঠোর সমালোচনা ও বিরোধভাব পোষণ করতেন। তাঁদেরকে হোজ্জা চাতুর্যের সঙ্গে সরিয়ে দিতে থাকে রাষ্ট্রবিরোধিতার বিভিন্ন মাত্রার অভিযোগ এনে—হাজতে পাঠিয়ে, লেবার ক্যাম্পে বা নির্বাসনে পাঠিয়ে, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এবং তরুণ লেখকদেরকে প্রাধান্য দিয়ে। স্বাধীনচেতা প্রবীণ লেখকদেরকে হোজ্জা কখনোই পছন্দ করতো না। তাঁদেরকে সরিয়ে নতুনদেরকে বুদ্ধিজীবী সমাজে স্থান দেয়, ক্ষমতার স্বাদ চাখায়। হোজ্জার চিরকালীন স্বপ্ন ছিল সমাজতান্ত্রিক লেখকগোষ্ঠী গড়ে তোলার, যারা আলবেনিয়ার সংস্কৃতিকে নতুন করে লিখবে, সমাজতন্ত্র ও শাসকের গান গাইবে, সাজাবে হোজ্জার মনমতো—এবং এর পূর্ণাঙ্গ প্রভাব আমরা দেখতে পাই হোজ্জা-শাসনামলের পরবর্তী সময়গুলোতে।
ইসমাইল কাদারে সে সময় মাসিক ‘ন্যিন্তরি’ ও সাপ্তাহিক ‘দ্রিতা’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। ১৯৫৩ সালে, সতেরো বছর বয়সে প্রকাশ করলেন প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘ইয়থফুল ইন্সপিরেশন’। প্রথম বইটি দিয়েই সাহিত্য সমাজের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে সমর্থ হলেন। তিরানা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও ভাষাতত্ত্ব অনুষদে, ভাষা ও সাহিত্যে পড়াশোনাকালে প্রকাশ হয় দ্বিতীয় কবিতাগ্রন্থ ‘ড্রিমস’ (১৯৫৭)। ১৯৫৮ সালে যখন তিনি মস্কোতে, ম্যাক্সিম গোর্কি ইন্সটিটিউটে উচ্চশিক্ষার জন্য মনোনীত হলেন, তখন, জিরোকাস্তারের উৎস ও ইতিহাসকেন্দ্রিক ‘দ্য প্রিন্সেস আরিরো’ কবিতায় ঐতিহাসিক ও আদর্শগত ভুল আছে—এমন অভিযোগে একটি সাহিত্যমহলের কাছে সমালোচিত হন। কবিতাটির বিরুদ্ধে সরকারিভাবেও রিপোর্ট হয়। রিপোর্টটি পেশ হয় লিরি বেলিশোভার কাছে, পলিটব্যুরোর উচ্চপদস্থ সদস্য তিনি, কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি, রাষ্ট্রের মতাদর্শগত দিক দেখভাল করতেন। বেলিশোভা ইতোমধ্যে কাদারের কাব্যশক্তি ও সম্ভাবনার সঙ্গে পরিচিত। তিনি বিষয়টি তুলে ধরেন হোজ্জার স্ত্রী—নজমিয়ে হোজ্জার কাছে। এবং কাদারে সেই প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রের মুখোমুখি হলেন তাঁর লেখালেখির কারণে। যদিও বেলিশোভার সুপারিশে নজমিয়ে হোজ্জা বিষয়টি নিয়ে আর আপত্তি তোলেনি। বেলিশোভা অভিযোগটির মীমাংসা করে মতামত দেন যে, ইসমাইল কাদারে এখনো তরুণ এবং প্রতিভাবান কবি, তাঁর লেখার সমালোচনা হওয়া উচিত আরো কোমলভাবে। সুতরাং সে যাত্রায় কাদারের উপর থেকে আরোপ সরে যায় এবং স্কলারশিপে সোভিয়েত ইউনিয়নে যেতেও আর বাঁধা থাকে না।
ইসমাইল কাদারের তখনো অনেককিছু বোঝা ও শেখার বাকি—সাহিত্য সম্পর্কে, বিশেষত রাজনীতি সম্পর্কে। নিজের লেখালেখির বিষয়, ভঙ্গি, উদ্দেশ্য নির্মাণ ও নির্ধারণে কাজে আসে এই মস্কোযাত্রা। সেখানে পরিচিত হন বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে, ইউরোপীয় আধুনিকতার সঙ্গে, দেখতে পান একনায়কতন্ত্রের পূর্ণচিত্ররূপ, কীভাবে ‘ডক্টর জিভাগো’ রচনার ফলে বরিস পাস্তেরনাক রুশ সরকার কর্তৃক হেনস্থার শিকার হলেন; স্টালিনের স্বৈরাচার কী ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে সমাজে, কাদারেকে এসব স্পষ্টতই নাড়া দেয়। ১৯৬০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে আলবেনিয়ার রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হলে মস্কোতে থাকা আলবেনীয় শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়। হোজ্জা তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনে সে বছরই। আর যুদ্ধ-পরবর্তী সাহিত্য চিন্তাধারা, আইডিয়া ও মতাদর্শ মনে ও মগজে বয়ে দেশে ফিরতে ফিরতেই সিদ্ধান্ত নেন কাদারে, গোঁড়া একনায়কতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে তিনি কখনোই কলম ধরবেন না।
একনায়কতন্ত্রের অধীনে সাহিত্যযাত্রা
১৯৬০ এর দশকের শুরুতেই ইসমাইল কাদারের নাম কবি হিসেবে বহুল পরিচিত হয়ে ওঠে। ইয়থফুল ইন্সপিরেশন (১৯৫৩), ড্রিমস (১৯৫৭) ও মাই এইজ (১৯৬১)—তিনটি কবিতার বই দেশের সাহিত্যজগতে ও পাঠকসমাজে প্রশংসিত হয়। বিশেষত তরুণসমাজে ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়। হেলেনা গুশি নাম্বী স্কুলছাত্রী চিঠি লিখলেন কবিকে, একজন ভক্ত হিসেবে। ১৯৬৩ সালে যিনি কাদারের জীবনসঙ্গী হলেন ‘হেলেনা কাদারে’ নামে।
একজন লেখক যতটা না বিষয়কে বেছে নেয়, তার অধিক, বিষয়ই লেখককে গড়ে তোলে। বিশেষত, সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিবেশ-পরিস্থিতি কোনো সচেতন লেখক এড়াতে পারেন না। কাদারের ব্যক্তিত্বেও এসময় রাজনৈতিক প্রভাব লক্ষ করা যায়। ১৯৬১ সালে তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বার প্রকাশ দেখতে পাই। মস্কো-ফেরত কাদারে এবং আরো কয়েকজন কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে তাদের আচরণ জাতীয়তাবাদ ও সম্প্রদায় বিরোধী, পশ্চিমঘেঁষা ও অধঃপতিত। এ অভিযোগ উপর মহল পর্যন্ত পৌঁছালে সভা ডাকা হলো। সমালোচকদের অভিযোগ শুনে এক পর্যায়ে কাদারে ক্রুদ্ধ হয়ে সভা ত্যাগ করলে, আনোয়ার হোজ্জা সবাইকে অবাক করে দিয়ে অভিযুক্ত লেখকদের পক্ষ নেয় ও এই বিষয়ে তরুণ লেখকদের মতামত চায়। বিশেষত কাদারের কাছে। দুপুরের পর কাদারেকে সভায় ফিরিয়ে আনা হলে, তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন এবং সমালোচকদের অসারত্ব তুলে ধরেন। হোজ্জা ততদিনে হয়তো কাদারের নাম শুনে থাকবে, হয়তো এও বুঝে থাকবে যে এরকম লেখক ভবিষ্যতে তার কাজে আসতে পারে। যে দেশে লেখকদের পান থেকে চুন খসলেই শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, সে দেশে কাদারে বা অন্য কেউ আশা করেনি যে হোজ্জা তাদের পক্ষ নেবে। সভায় ঘোষিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইসমাইল কাদারেকে হিংসুকদের ধরাছোঁয়ার বাইরের একজন করে সমাজতান্ত্রিক লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজে (intelligentsia) তাঁকে স্থান দেয়া হলো। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আপার-ক্লাস নাগরিক/ কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজীবীরা যেসব সুযোগ সুবিধা ও ক্ষমতার স্বাদ পায়—সেসব পেলেন তিনি। সেই সঙ্গে, তাঁকে জাতীয় লেখকদের (nomenclatura) একজন করা হবে এমন কানাঘুষাও শোনা গেল। এ প্রসঙ্গে কাদারে লেখেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম, আমার দিকে অচেনা ও ভয়ঙ্কর কিছু ঘনিয়ে আসছে। জাতীয় লেখক হিসেবে নাম তোলা, সেও একনায়কতন্ত্রের অধীনে…”
এতে লেখকসমাজে ও সরকারের কট্টর স্টালিনিস্ট বামপন্থীদের ভেতরে শত্রুও গজিয়ে উঠল। বিশেষ করে, রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি—কাদারের লেখকজীবনকে দুর্বিষহ করতে ভবিষ্যতে যার অবদানের কথা বারবার আসবে। কাদারে পেশা হিসেবে কাজ শুরু করলেন লেখক, সাংবাদিক এবং সাপ্তাহিক ‘দৃতা’ পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে।
নিষেধাজ্ঞার সূচনা
১৯৬২ সালে, কাদারের ‘কফিহাউজ ডেইজ’ নামক গল্পটি প্রকাশের পরপরই নিষিদ্ধ হলো। অভিযোগ উঠল, কাদারে স্রেফ সরকারের ভাবমূর্তি অবক্ষয়ের উদ্দেশ্যে সাহিত্য করছে। অভিযোগকে নস্যাৎ করতে তিনি এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত প্রকাশ করলেন, ‘হোয়াট আর দ্য মাউন্টেইনস থিংকিং এবাউট?’ শিরোনামে কবিতার সিরিজ। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে রোমান্টিসাইজ করা কবিতাটি হোজ্জার সমাজতান্ত্রিক নতুন আলবেনিয়ার স্বপ্নকে যেন পূর্ণতা দিলো। যদিও কবিতায় সমাজতন্ত্রের উপস্থিতি বা সরকারের স্তুতি সযত্নেই এড়িয়ে গেছেন। প্রকাশ করেছেন নিজস্ব জাতীয়তাবাদের ধারণা, আবেগ ও আদর্শকে। সমাজতন্ত্রের তোষামোদ না থাকায় রাইটার্স ইউনিয়ন থেকে অভিযোগ ওঠে, কবিতায় ‘উদ্যমের যথেষ্ট অভাব আছে।’
৬০-এর দশকের দ্বিতীয় ভাগে কাদারের লেখায় রাজনীতি সচেতনতা প্রকাশ পায়। আমলাতন্ত্রকে আঘাত করে লেখা ‘ইন দ্য সিটি উইদাউট সাইনস’ কবিতায় রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আমলাদের স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে বিপদজনক ছিল না। এছাড়া ‘হোয়াট আর দ্য মাউন্টেইনস থিংকিং এবাউট?’ কবিতা ইতোমধ্যে আলবেনিয়ায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছে, সরকারের সুনজরেও এসেছে; যে কবিতার জন্য আনোয়ার হোজ্জা একদিন ফোনই করে বসলো কাদারেকে, অভিনন্দন জানালো। সেই প্রথম নেতার সঙ্গে তাঁর সরাসরি কথা।
ওই ফোনকলের গুরুত্ব অনেকদিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে, কাদারের লেখকসত্ত্বা নতুন মাইলফলক স্পর্শ করল এবং উপর মহলে তাঁর খ্যাতি বেড়ে গেল। অন্যদিকে, নেতার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া গেল এই, এখন থেকে তাঁর প্রতিটি শব্দই সরকারের মনোযোগের বিষয়। সুতরাং কদম সাবধানে ফেলতে হবে।
উক্ত ফোনকলের পর কাদারের জীবন উভয়দিক থেকে বদলে যেতে দেখা যায়। সময়টা তাঁর জন্য ছিল দ্বিধাদ্বন্দ্বময়। কারণ, রাজনীতির সঙ্গে সাহিত্যের স্পষ্ট দ্বৈরথ দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি। টের পাচ্ছিলেন, নিজের দেশাত্মবোধ ও বিশ্বাসের সঙ্গে সরকারের দেশাত্মবোধের সংজ্ঞার বিশাল পার্থক্য ও সংঘর্ষ রয়েছে। কাদারের পরবর্তী প্রকাশগুলোতে একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে আপোষ না করার সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ঘটতে দেখা যায়। খ্যাতি তাঁর সাহসের জায়গা হয়ে ওঠে।
দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি ও সমালোচনা
গল্পের ছলে নিজের চিন্তা ও মতামতকে বড় পরিসরে, অধিক মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ বিধায় তিনি উপন্যাস রচনায় আগ্রহী হলেন। ১৯৬৩ সালে প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ প্রকাশের পর দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপকভাবে পরিচিতি ও প্রশংসা পান কাদারে। ১৯৭৭ সালের মধ্যে বইটি বিশের অধিক ভাষায় অনূদিত হয়। সত্তরের দশকে অনূদিত সবচেয়ে সফল বই হিসেবে সংবাদমাধ্যম জয়ধ্বনি করে।
কিন্তু বইটি রাজনৈতিক শত্রু বুলগেরিয়া ও যুগোশ্লাভিয়াতে অনুবাদ হলে, ক্ষমতাশীলেরা তা ভালো চোখে দেখল না। রাইটার্স ইউনিয়ন, গোয়েন্দা-পুলিশ সংস্থা ‘সিগিরিমি’, সেনাবাহিনী ‘ওল্ড গার্ড’ এবং পলিটব্যুরো/ কেবিনেটের ভেতর যারা কাদারেকে অপছন্দ করতো, তারা এ সুযোগ হাতছাড়া করলো না। সমালোচনার ঝড় ওঠে : ‘এই বই অগ্রহণযোগ্য, বুর্জোয়ারা প্রকাশ করেছে’, ‘বইটি আলবেনিয়ার সমাজতন্ত্রকে অপমান করেছে’, ‘এই লেখক পশ্চিমের গুপ্তচর’; শেষোক্ত অপবাদটি ছিল অত্যন্ত বিপদজনক। দেশের মানুষের কাছে বা সরকারের কাছে আস্থা ও অবস্থান হারানোর জন্য এটুকু অভিযোগই যথেষ্ট ছিল। হোজ্জার কাছে কাদারের অবস্থান কোথাও সামান্য অবনত হলো, যার প্রভাব দেখতে পাই পরবর্তীতে।
অনেককাল পরে, কাদারের এক সাক্ষাৎকারে আমরা এও জানতে পারি যে, অন্য রাজনৈতিক দল সমর্থনের অভিযোগে “দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি”-র ফরাসি অনুবাদককে তেরো বছর জেল খাটতে হয়েছিল।
১৯৬২-৬৪ সময়কালে আলবেনিয়ার রাজনীতিতে নির্মম দিকগুলো প্রকট হতে শুরু করে। সংস্কার ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নামে একনায়কতন্ত্রের প্রভাব কঠোরভাবে জেঁকে বসতে শুরু করে প্রতিটি সেক্টরে। শিল্পী ও সাহিত্যিকদের জন্য পরিবেশ আরো প্রতিকূল হয়ে উঠল। এই কঠোরপন্থা হোজ্জার মৃত্যু অবধি অব্যহত থাকে। এ সময় দেখতে পাই, শিল্পী ও লেখকদের চুলের স্টাইলও সরকারের নাক গলানোর বিষয় হয়ে উঠেছিল। শিল্প সাহিত্য নিয়ন্ত্রণ করা হতো উপরমহলের তৈরি এক অদৃশ্য সেন্সর গ্রুপ দ্বারা; যে গ্রুপটি আদতে সরকারিভাবে গঠিত কোনো পরিষদ নয়, এরা ছিল ছায়াদানব; সাহিত্য, প্রকাশমাধ্যম ও গোয়েন্দাসংস্থার ব্যক্তিবর্গ এই কাজে তটস্থ থাকতো। মুদ্রণ ও প্রকাশনা-মাধ্যমগুলো সরকারিকরণ হওয়ায় এই সেন্সর গ্রুপের ছায়া এড়ানো অসম্ভব ছিল।
ফলত, একজন লেখককে স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে সরল বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে লিখতে হতো। কোনো বাক্য সমালোচক বা সেন্সর গ্রুপের চোখে বিন্দুমাত্র আপত্তিকর হতে পারে কিনা সেদিকে খেয়াল রাখতে হতো। প্রকাশনার আগে সম্পাদিত হতো আরো সাবধানে। সরকারিভাবে রিপোর্ট বা বাজেয়াপ্ত করা হতো সাহিত্যপাতায় বা বই আকারে প্রকাশের পর।
দানবের দিন, দানবের রাত : দ্য মনস্টার
হোজ্জার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে তখন নিয়মিতই বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী সাহিত্যিকদেরকে দলে দলে লেবার ক্যাম্পে ও হাজতে যেতে দেখা যায়। তখন, ১৯৬৫ সালে, কাদারের ‘দ্য মনস্টার’ উপন্যাস প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হলো। কাদারের মানসিকতার আন্দাজ করতে ঐ সময়ের স্মৃতিচারণ করে সাক্ষাৎকারে বলা কথাটি উল্লেখ করা যেতে পারে, “ঐ সময় আমি কাউকেই ভয় পেতাম না। সরকার বা তাদের নেতা, বক্তব্য, এমনকি হুমকিকেও সিরিয়াসলি নিতাম না। আবার এমন নয় যে সেসবকে ‘ফালতু কথাবার্তা’ হিসেবে উড়িয়ে দিতাম। সে সুযোগ ছিল না।”
‘দ্য মনস্টার’ নিষিদ্ধ হলো, শাস্তি হিসেবে কাদারেকে পাঠানো হলো দুই বছরের সশ্রম নির্বাসনে—দেশের দক্ষিণ প্রান্তে, ‘বেরাত’ নামক গাঁয়ে। চাষা ও খেটে খাওয়া মানুষের সাথে বাস করে ও কাজ করে বাস্তবতা শেখানোর হোজ্জা-পদ্ধতি। তুলনামূলকভাবে, শাস্তি হিসেবে এটা নিতান্তই মামুলি, তবে ধমকটা পরিষ্কার, ‘সরকারের দোষ-ত্রুটি ভাবা বাদ দাও!’
কাদারে ও রাজনীতি
১৯৬৭ সালে ইসমাইল কাদারে রাইটার্স ইউনিয়নের সদস্য হলেন। ১৯৬৯ সালে নাম উঠল নোমেনক্লেচার-এ (nomenclatura)। অর্থাৎ তখন থেকে তিনি একজন সরকারি বেতনভুক্ত পূর্ণকালীন লেখক। ১৯৭০ সালে পিপল’স এসেম্বলির ডেপুটি পদ পেলেন। ১৯৭২ সালে হলেন আলবেনিয়ার লেবার পার্টির রাজনৈতিক সদস্য। হোজ্জার রাজনৈতিক দলে কাদারের যোগ দিতে দেখে আমাদের ভ্রূ কুঁচকে যেতে পারে। ফলে, আলবেনিয়ার সার্বিক পরিবেশ বিবেচনায় রাখা-পূর্বক একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। কাদারে কখনোই পার্টির “রাজনৈতিক সদস্য ছিলেন না”, সরকারের রাজনৈতিক বিষয়াদিতে সংযুক্ত বা সক্রিয় ছিলেন না। মূলত তিনি ছিলেন সরকারের অধীনস্ত সাংস্কৃতিক অনুষদের চেয়ারম্যান। এই অনুষদটি পরিচালনা করতো হোজ্জাপত্নী নজমিয়ে হোজ্জা।
পার্টিতে তথাকথিত ‘যোগ দেয়া’ প্রসঙ্গে কাদারে ব্যাখ্যা করেন যে, দলের সদস্য বা সংসদে যাওয়া-আসার কোনো ইচ্ছেই ছিল না তাঁর। বরং এসব থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছেন সব সময়, সাহিত্যে মনোযোগ দিতে চেয়েছেন। রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম, ফাঁপা ও অসার কথাবার্তা তাঁকে চিরকালই বিরক্ত করেছে। কিন্তু দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাঁকে রাজনীতিতে টেনে নেয়। প্রথমত, দেশ ও বিশ্বকে জানানো যে, তিনি বুর্জোয়া নন, কম্যুনিস্ট এবং দেশের প্রতি তাঁর প্রেম কারো চেয়ে কম নয়। পাশাপাশি, এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ইউরোপে তাঁর অবস্থান শক্ত করা। ইউরোপের চোখে কাদারে সবসময়ই ছিলেন সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। নিজের দেশে টিকে থাকতে ইউরোপের সাপোর্ট তাঁর প্রয়োজন ছিল, এবং সে সুযোগও তাঁর বাড়ছিল। এতে তিনি যেন দেশের অভ্যন্তরীণ বিপদ থেকে নিরাপদ থাকতে পারেন, নিজেকে শত্রুদের নাগালের ঊর্ধ্বে তুলতে পারেন, কোনো অভিযোগ ও হুমকি তাঁর সাহিত্যের পরিবেশকে নষ্ট করতে না পারে।
দ্বিতীয়ত, হোজ্জার একান্ত ইচ্ছে। ইসমাইল কাদারের মতো বিখ্যাত ব্যক্তিকে নিজের কাছাকাছি রাখার সুবিধা কতখানি তা সে অনেক আগে থেকেই জানত। দেশে ও দেশের বাইরে নিজেকে ও দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার সহজ পদ্ধতি ছিল ‘ইসমাইল কাদারে’। অসংখ্য ব্যক্তি পার্টি সদস্য হবার আবেদন করেও যখন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিল তখন আনোয়ার হোজ্জা ব্যক্তিগতভাবে কাদারেকে আহ্বান জানায় পার্টিতে যোগ দেয়ার জন্য। কাদারে খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব হলেও হোজ্জার দাওয়াত নাকচ করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না। এরকম কথার প্রচলন ছিল, “আলবেনিয়ার সবাইকেই ঊর্ধ্বতনের কাছে রিপোর্ট করতে হয়, কেবল হোজ্জার উপরে কেউ নেই!” সুতরাং হোজ্জাকে প্রত্যাখ্যান করা মানে সাক্ষাৎ যমদূত ডেকে আনা। এ ব্যাপারে কাদারে বলেন, “কী করার ছিলো? না করব? নিজের উপর বিপদ ডেকে আনব? ‘না’ বললে আমার বিরুদ্ধে ‘ফ্রান্সের চর’ প্রমাণে তাদের সুবিধা। স্টালিনিয় শাসনাধীন একজন লেখককে কেন পশ্চিমা বুর্জোয়ারা এত সম্মান করে? এই প্রশ্নের জবাব পেতে গোয়েন্দা পুলিশ সব সময়ই আমার পেছনে লেগে ছিল। দলে যোগ দেয়ায় নিজের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হয়।”
উল্লেখ্য, এর কিছুকাল আগেই—১৯৬৯ সালে কাদারে আলবেনিয়ার বাইরে, বৈশ্বিকভাবে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন। ১৯৭০ এ ‘জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়, বইটি ইউরোপে বহুল পঠিত, আলোচিত ও প্রশংসিত হয়। এক ফরাসি ম্যাগাজিনে ইসমাইল কাদারে ও আনোয়ার হোজ্জাকে কভার করে ‘আলবেনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত দুই মুখ’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এতে তিনি অন্য লেখকদের গাত্রদাহের কারণ হন, রাইটার্স ইউনিয়নে ও সিগিরিমি ও ওল্ড গার্ডের কুতুবদের মাঝে, এমনকি পলিটব্যুরোর ভেতরেও কাদারে-বিদ্বেষীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। যারা কাদারেকে “পশ্চিমের দালাল” বলে গুজব ছড়াচ্ছিল, “পশ্চিম তাঁকে এত ভালোবাসে কেন?”, “কাদারে কি পশ্চিমের পোষাপ্রাণি?” বলে আরো রঙ চড়াতে শুরু করে। একজন লেখকের জন্য এমন পরিস্থিতি স্বভাবতই বিরক্তিকর ও চাপের। এ সময় কাদারেকে নিজের সাহিত্যের ভাষা কৌশল বদলাতে দেখা যায়। হোজ্জার আচরণ বিশ্লেষণ ও বোঝার তাগিদে তাঁকে পড়াশোনাও করতে দেখা যায় মনোঃসমীক্ষণ বিষয়ক সাহিত্য। অতঃপর হোজ্জার দলে যোগদান।
আজ পাশা খেলব রে শ্যাম : দ্য রেড পাশাজ, ১৯৭৪
১৯৭৪ এর জানুয়ারিতে, কেন্দ্রীয় কমিটির চতুর্থ প্ল্যানারি সেশন এর ছয় মাস পরের ঘটনা। কাদারের একটি কবিতা প্রকাশ হয় দৃতা পত্রিকায়, ‘এট মিডনাইট দ্য পলিটব্যুরো মেট/ মধ্যরাতের পলিটব্যুরো সভা’—কবিতার সিরিজটি পরবর্তীতে ‘দ্য রেড পাশাজ (the red pashas’) নামে পরিচিত হয়। যেখানে কাব্যিক ঢঙে আরো তীব্রভাবে বিদ্রূপ করা হয় আমলাদেরকে, দায়ী করা হয় দেশের বিশৃঙ্খলতা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির জন্য। এই ফর্মে ইউরোপীয় রাজনৈতিক কবিতা লেখার চল বহুদিনের, যেখানে রাজা, সরকার-প্রধান বা দলের নেতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নয়, তার চারপাশের নীতিহীন সভাসদদের কার্যকলাপকে দেশের অরাজকতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ কবিতাও ছিল কাদারের আরেকটি “কারেক্টিভ মাস্ক”। হোজ্জাকে সরাসরি আঘাত করে নয়, বরং সরকারের ভিত্তি ও ভাবমূর্তি নড়বড়ে ও দূষিত করা সরকারি আমলা ও পার্টির—কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর অসাধুদেরকে একহাত নেয়া হয় কবিতাটিতে। কবিতাটি প্রকাশের পর সারাদেশে তুমুল বিতর্ক জন্ম নেয়।
১.
পলিটব্যুরো ডাকা হলো মধ্যরাতে :
উত্তর সীমান্তে কোনো নতুন খবর?
দক্ষিণ সীমান্তের কী খবরাখবর?
আকাশও মেঘাবৃত, তুষারিত শীত।
পুরনো শাসকেরা কী করছে এখন?
নতুন দুর্যোগ কোনো ঘনাতে কি পারে?
কোনো সতর্কবার্তা কি পাঠিয়েছে দূতাবাসগুলো?
না, হুজুর, সীমান্ত শান্ত আছে আর
দূতাবাসও দেয়নি সতর্কবার্তা
আর সর্বহারাদের এই একনায়কাধীনেই
কাটাতে হবে শীত, আমাদের, মহান জাতিকে।
ফসল হচ্ছে ঠিকঠাক, ফলনও স্বাভাবিক
ডিসেম্বরের দিন, রুটিনমাফিক যাচ্ছে…
…তাহলে হঠাৎ কেন খামোখা কৌতুকে
পলিটব্যুরো ডাকা হলো মধ্যরাতে?
২.
রাষ্ট্র ধ্বসে না কখনো—ভাঙা এই ছাদের কারণে
চু’য়ে চু’য়ে যতই গড়াক জল,
রাষ্ট্র ধ্বসে যেতে পারে স্রেফ ভিত্তিমূলের পচনে
আমার সমাজতন্ত্র—স্বদেশ, একই সমীকরণে।
মনে হবে ঠিকঠাক, সমস্তকিছু, উপর থেকে :
বাণী ও বক্তব্য, আর—টেন্ডার, গণসঙ্গীতে এবং
পহেলা মে’র ব্যানারে, বিলবোর্ডে ও সান্ধ্য খবরে
নেতাদের প্রিয় মুখ ও মুখরিত সাক্ষাৎকারে;
আস্থা জাগানো ভাষণে, ওই রৌদ্রোজ্জ্বল স্মিত হাস্যে
নির্বাচনে এবং কবিতায়, তরুণের তীব্র ছন্দে যেন
মনে হবে ছন্দময়; শুধু এর খানিক গভীরে—
রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে যে—গজিয়েছে কালো ক্যান্সার
পড়ছে ছড়িয়ে দ্রুত
শত্রুর বিপক্ষে আছে বন্দুক, কামান গোলা যত
আছে স্তব সঙ্গীত ও দূতাবাসও প্রচারে রত
কিন্তু কী অস্ত্র রয়েছে এ আমলাতন্ত্রের বিপরীতে?
বন্দুক বেকার বড়, দূতাবাসও চুপচাপ, খুব!
কবিতাটি প্রকাশের আগেই নিষিদ্ধ হয়। রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি চিঠি লিখে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের জানিয়ে দেন, কাদারের কবিতাটি সরকার বিরোধী, বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি নষ্ট করার চক্রান্ত, বিদেশি মহলের জন্য রচিত, এমনকি এই সরকার দেশ পরিচালনার অযোগ্য—এমন ইঙ্গিত রয়েছে কবিতায়। সুতরাং তাঁকে মূলধারার লেখকদের তালিকা (nomenclatura) থেকে বরখাস্ত করা হোক।
প্রকাশনা থেকে বাজেয়াপ্ত হয় কবিতাটি, চলে যায় পার্টি অফিসে। বৈঠক ডাকা হয়। বৈঠকে কবিতাটি হয়ে ওঠে সমাজতন্ত্রবিরোধী, বিপ্লববাদী, পশ্চিমের চিন্তাধারায় দূষিত। সমস্ত তীর যখন কাদারের দিকে, তখনো তিনি একজন বড় কবি, যার মাঝে ১৯৬১ সালেই সম্ভাবনা দেখেছিল আনোয়ার হোজ্জা, যার কাছে কাদারের গুরুত্ব তখনো কমেনি।
সুতরাং এবার ‘উপর মহল’ থেকে রায় দেয়া তুলনামূলক লঘু সাজা মেনে নিতে হলো কাদারেকে। প্রথম শাস্তি : কবিতাটি সরকার, রাষ্ট্র ও সমাজতন্ত্র বিরোধী, সাধারণ মানুষকে মিসলিড করা—তা সভায় বিবৃতি দিয়ে স্বীকার করতে হলো। আগে লেখকসমাজে তাঁর নিরীহ শত্রু ছিল, এখন—এই কবিতার পর উচ্চপদস্থ আমলাগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিটব্যুরোর ভেতরে ভয়ঙ্কর কিছু শত্রু গজিয়ে উঠল। “পশ্চিমের গুপ্তচর” অপবাদটি তীব্র রূপ নিলো। দ্বিতীয় শাস্তি : তিরানা ও লেখালেখি ছাড়তে হবে। অর্থাৎ বড় কোনো লেখা, পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস প্রকাশ করতে পারবেন না তিন বছরের জন্য। সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এবং আবার নির্বাসন, এবার মিজেকাতে।
কাদারের শুভাকাঙ্ক্ষী ও সাহিত্যিক বন্ধুদের সুপারিশে দু’মাস পরই নির্বাসন প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। কাদারে টের পান, এই শাস্তি—গতানুগতিক শাস্তির তুলনায় কিছুই না। কেননা নির্বাসিত মানুষের সংখ্যা তখন এত বেশি ছিল যে, এর কোনো পরবর্তী প্রভাব ছিল না। কে কোথায় কবে নির্বাসিত হলো—এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাতো না কেউ। নির্বাসন থেকে ফেরার অর্থ, সে এখন নিষ্পাপ; তাঁর নিজ আসনে বহাল তবিয়তে বসতে আর কোনো বাঁধা নেই।
নিষেধাজ্ঞাকাল ও পরবর্তী
একটি দেশ—যেখানে সমস্ত প্রকাশমাধ্যম, মুদ্রণব্যবস্থাকে রাখা হয় কড়া নজরে। এমনকি ফটোকপিও সন্দেহের চোখ এড়িয়ে করা সম্ভব না। যেখানে লেখক, শিল্পী বা রাজনৈতিক কর্মীর লিখিত বা মৌখিক—একটা ভুল কথার জন্য গুনতে হতো চরম মাশুল। পরবর্তীতে, কেউ কেউ এসব সাজাপ্রাপ্ত সাহিত্যিক ও শিল্পীদের তালিকা করেন, যেখানে লেখালেখি ও অন্য শিল্পমাধ্যমে সরকারের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে কঠিন শাস্তি পেতে হয়েছে। সে সময় সরকারবিরোধী কবিতার দায়ে তিনজন কবিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কাদারেও জানতেন বিপদ যে কোনোদিক থেকে আসতে পারে। সেই সময় কবিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রের বাস্তব চালচিত্র তুলে ধরাটা ছিল দুঃসাহসেরও অধিক। সারাদেশে ইসমাইল কাদারের নাম ছড়িয়ে পড়ল একজন সাহসী লেখক হিসেবে, সরকারের সমালোচনা করার সাহস রাখেন যে লেখক—ইসমাইল কাদারে।
“দ্য রেড পাশাজ” বিতর্কের পর, ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে কবিতাটি পুনরায় সম্পাদনা করে পাঠান দৃতা পত্রিকায়। সেখান থেকে পাণ্ডুলিপিটি গায়েব/ চুরি হয়ে যায়। কাদারে যখন চুরির বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করছিলেন তখন তাঁর নিন্দুকেরা বাঁকা হাসছিল। বলছিল, পাণ্ডুলিপি কি আদৌ ছিল, নাকি এ কাদারের নতুন নাটক? পাণ্ডুলিপিটি আলবেনিয়ার জাতীয় ভল্ট থেকে ২০০২ সালে পুনরুদ্ধার করা হয় ও পুনঃপ্রকাশ করা হয়।
স্বৈরাচারী শাসকের বিপক্ষে কাদারের দাঁড়িয়ে যাওয়া এই অঘোষিত যুদ্ধে আহত হয়েও লেখক নিজের উপর আস্থা হারাননি। নিজ ভূমি, ভাষা ও আদর্শকে তিনি রক্ষা করে গেছেন শেষ পর্যন্ত, নিজের সাহিত্যকে বাঁচিয়েছেন। হোজ্জা জানতো, মৃত কাদারের চেয়ে জীবিত কাদারে তার জন্য লাভজনক। এমন তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব মারা গেলে দেশের মানুষের কাছে সে নবী হয়ে উঠবে। কাদারে বলেন, ‘এ সময় আমার ঔদ্ধত্যই আমাকে রক্ষা করেছে, আরো সাহসী করেছে, ক্ষমতাবানরাও আমার ঔদ্ধত্যকে সমীহ করে চলেছে।’ এছাড়াও দেশের বাইরে, বিশেষত ফ্রান্সে, ইসমাইল কাদারের পক্ষে ছিল অনেকেই।
সে সময় দেখতে পাই, কাদারে—নির্বাসন, কারাভোগ বা প্রাণনাশের হুমকিতে ভীত ছিলেন না। তিনি ভাবছিলেন তাঁর সাহিত্যের অস্তিত্ব রক্ষার কথা, এবং ভবিষ্যতে সুস্থভাবে লেখালেখি চালিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কিনা সেই ভাবনা তাঁকে আচ্ছন্ন করেছিল। কাদারের কিছু হলে, তাঁকে নিয়ে রাজনীতি হবে, হয়তো তাঁর বইপত্রের অস্তিত্বও বাতাসে মিলিয়ে দেয়া হবে। একজন লেখকের জন্য এ এক অশুভ পরিবেশ এবং এর মাঝেই তাঁকে লিখে যেতে হবে। সুতরাং সকল ভয়ভীতি ও ক্ষমতাধরদের চোখ রাঙানো বা হুমকির সঙ্গে টেক্কা দিতে এ সময়কালে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করে তুলতে শুরু করেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে হয়ে ওঠেন আরো সতর্ক। লিখতে হয় রূপক ও উপমার আড়ালে; পৌরাণিক কাহিনী, লোক কাহিনী, উপকথা, রূপকথা ও চিরায়ত গল্পের রূপকে বর্তমান রাষ্ট্রের পরিস্থিতি—ইঙ্গিতপূর্ণতায়, কৌতুকছলে, প্রচ্ছন্ন ভঙ্গিতে, এমনকি সাংকেতিক ভাষায় ও ডাবল মিনিং-এ।
এ সময়টা ছিল কাদারের সাহিত্য-জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। বৈরী পরিস্থিতিকে একপাশে সরিয়ে তিনি দুইহাতে লিখে চললেন। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাসগুলোর অধিকাংশই এ সময়ের রচনা। যেমন- ব্রোকেন এপ্রিল, দ্য থ্রি আর্কড ব্রিজ, দ্যা ক্যাসল, দ্য নিশে অব শেইম। ঐতিহাসিক উপন্যাস ছিল তাঁর শক্তি প্রকাশের জায়গা। তিনি জানতেন, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সাহিত্যের দৃষ্টিভঙ্গির সংঘর্ষের কথা। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী নয়, মানুষের সভ্যতা ও মননের আশ্রয় হবে সাহিত্যের বাস্তবতায়। সুতরাং তিনি লিখলেন মানুষের কথা, জীবনের কথা, একনায়কতন্ত্রের স্বেচ্ছাচারীতায় সাধারণ মানুষের প্রাত্যাহিক জীবন কেমন—সেসব তুলে আনলেন। নিজভূমি, ঐতিহ্য, যুদ্ধপূর্ব ও পরবর্তী আলবেনিয়ার ইতিহাসকেই যেন নতুন করে লিখলেন তিনি। তাঁর সৃষ্টির উল্লাস হয়ে উঠল রাষ্ট্রের সমস্ত নোংরামির জবাব।
আনোয়ার হোজ্জার মুখোমুখি
ইসমাইল কাদারে সব সময়ই ছিলেন ইউরোপীয় ঘরানার আধুনিক। নারীবাদ ও ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন ও নেতিবাচক, নিজস্ব চিন্তাধারা ও আদর্শ টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে ছিলেন বুদ্ধিমান। সরকার ও শত্রুদের কু-নজর এড়াতে কিছুকাল অরাজনৈতিক বিষয়বস্তু কেন্দ্রিক বই লেখেন। সেখানে নিজের রাজনৈতিক মতামত এলেও সতর্কতার সঙ্গে উপস্থাপন করেন। এছাড়া কিছু লেখা লিখতে হয়েছে স্রেফ টিকে থাকার স্বার্থে, অপবাদ মুছতে। এসময় একটি উপন্যাস লেখায় হাত দেন তিনি, যেখানে হোজ্জাকে জাতির নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করে, সমাজতন্ত্রের ইতিবাচক কাজগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। উপন্যাসটি লেখার সময় কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করতে নজমিয়ে হোজ্জা দাওয়াত করে কাদারেকে। সেই প্রথম ও শেষবারের মতো একান্তে মুখোমুখি হয় দুজন—আনোয়ার হোজ্জা ও ইসমাইল কাদারে। বইটি নিয়ে কাদারে নিজেই বলেন, ‘this is the price I had to pay for freedom.”
কাদারে আরো ব্যাখ্যা করে বলেন যে, এই বইটি যখন তিনি লিখতে বাধ্য তখন তাঁর ইচ্ছে ছিল বইটি যেন কিছুটা হলেও হোজ্জাকে শুধরে দেয়। হোজ্জাকে জাতির নায়ক হিসেবে দেখিয়ে, ভালো কাজ সামনে নিয়ে এলে অন্তত সরকারের পরবর্তী কাজকর্মে যেন ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। কাদারে এর নাম দেন, ‘কারেক্টিভ মাস্ক’। কিন্তু তাঁর বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না হোজ্জা কোন জলের মাছ! কাদারের মনোঃসমীক্ষণ বিষয়ক জ্ঞানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হোজ্জা যেন নিজের অহমকে আরো এককাঠি সরস করে ফেলল। একবার কাদারের নানী তাঁকে বলেছিলেন, ‘জানিস, হোজ্জাদের সঙ্গে আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে!’ কাদারের বাবা হোজ্জাদের পছন্দ করতেন না, কথাটি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোর নানী একটা মিথ্যুক!’
আশির দশক : রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দ্য প্যালেস অব দ্য ড্রিমস
১৯৮০-র দশক আলবেনিয়ায় রাজনৈতিকভাবে ঘটনাবহুল, বিস্তৃত ও অস্থির। কাদারের জন্যও সব বড় বাঁধা এলো এই সময়কালে। দশকটির শুরু হয় হবু প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা ও এ নিয়ে শুরু হওয়া নোংরা রাজনীতির মধ্য দিয়ে।
কাদারে জানতেন, হোজ্জার কাছে তাঁর প্রাণের মূল্য আছে। তবে হোজ্জার তখন শেষ বয়স, দুর্বল, নানান রোগে কাতর। হোজ্জার মৃত্যুর পর কাদারের শত্রুরা সবদিক থেকে প্রকাশ্যে ঝাঁপিয়ে পড়বে, এই পূর্বানুমানও করেছিলেন। কেননা কাদারের শত্রুর অভাব ছিল না বহুদিন ধরেই। তিন বছর নিষেধাজ্ঞার পর ততদিনে আবার উপন্যাস প্রকাশ করতে শুরু করেছেন তিনি। প্রার্থনা একটাই, বইগুলো যেন সরকারের কুনজরে না পড়ে, সেন্সরের হাতে না পড়ে। সব প্রার্থনা যেহেতু পূরণ হয় না—সেই সূত্রমতে, ১৯৮১-৮২ সালে ‘দ্য প্যালেস অব ড্রিমস’—কাদারের সবচেয়ে আলোচিত ও বিতর্কিত উপন্যাস—প্রকাশের পর তাঁর জন্য পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হয়ে উঠল।
হেরাক্লিটাসের ‘those who sleep are alone, those awake are with others’ কোট করে বিদ্রুপাত্মক উপমায় উপস্থাপন করেন স্বৈরতন্ত্রের অধীনস্ত মানুষের সামগ্রিক অচৈতন্যকে (collective sleep/unconciousness); রূপক-আশ্রয়ী ঐতিহাসিক উপন্যাসটি আদতে ছিল পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। প্রকাশের পর তিরানাজুড়ে ব্যাপক হৈচৈ শুরু হলো। স্বাভাবিকভাবেই, বইটি সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিপক্ষে যাওয়ায় নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত হলো। এ সময় কারাবন্দি এক রাজনৈতিক ব্যক্তির মন্তব্য ছিল এরকম, ‘এই বই যে লিখেছে, তাঁর এতক্ষণে হয় আমাদের সঙ্গে জেলে থাকার কথা, অথবা সরকারের পতন হবার কথা।’
দলের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড রমিজ আলিয়ার উপস্থিতিতে পার্টির সদস্যদের সঙ্গে দুদিনব্যাপী মিটিং হলো। সেখানে উপস্থিত ছিল নজমিয়ে হোজ্জা—ভদ্রমহিলা বরাবরই কাদারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশে অকৃপণ। উপস্থিত ছিল রাইটার্স ইউনিয়নের সভাপতি—বন্ধুরূপে কাদারের লেখকজীবনকে শুরু থেকেই যিনি অতিষ্ঠ করে এসেছেন—উপন্যাসটির বিরুদ্ধে রিপোর্টটি সভায় পড়ে শোনালেন। ইসমাইল কাদারেকে অপমান ও অপদস্থ করার সবরকম ব্যবস্থাই সেদিন নেয়া হয়েছিল। সভার নির্দেশক্রমে, চারশ মানুষের উপস্থিতিতে কাদারেকে স্বীকার করতে হলো যে, বইটি ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক মতাদর্শ বিরোধী।
‘কাদারে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী’, ‘পার্টির জন্য বিপদজনক’, ‘পশ্চিমের দালাল’, ‘ফ্রান্সের চর’—অভিযোগের পর প্রস্তাব উঠল, ‘তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হোক।’ কাদারের রাজনৈতিক জীবনে শেষ পেরেক ঠুকলো শত্রুরা। দল থেকে বহিষ্কারের পর প্রকাশ্যেই এই পতন উদযাপন করছিল তারা। নজমিয়ে হোজ্জা বলল, ‘কাদারেকে বদলাতে হবে, নয়ত মুছে যেতে হবে’, ‘…এই বইটিকে ইতিহাস থেকে সরিয়ে দিতে হবে…’
কাদারেকে সতর্কবার্তা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হলো। এতে শত্রুরা পুরোপুরি তৃপ্তি পেল না, তাই চক্রান্ত অব্যহত রইলো।
মূলত কাদারের কঠিন ব্যক্তিত্ব ও ব্যাপক খ্যাতি এবং ফ্রান্সের সাপোর্ট তাঁকে সরকারের কাছেও অস্পৃশ্য করে তুলেছিল। তবে কাদারে বুঝলেন, আলবেনিয়া তাঁর জন্য এখন খুব বিপদজনক। যে কোনোভাবেই তাঁকে মেরে ফেলা হতে পারে। যে কোনোদিক থেকে গুলি আসতে পারে, সড়ক দুর্ঘটনার নাটকে তাঁকে খুন করা হতে পারে। এসময় ফ্রান্সের সাপোর্ট তাঁর জন্য জরুরি হয়ে উঠেছিল।
অন্যদিকে, আনোয়ার হোজ্জা তখন শেষ বয়সে অমরত্বের নেশায় মগ্ন। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে সরে এলেও দলের কলকাঠি তার হাতেই। কাদারের মতো লেখকের নাম ইতিহাস থেকে সরাতে হলে হোজ্জাকে নিয়ে কাদারের সুড়সুড়ি-মূলক বইও হারিয়ে যাবে! যেখানে তাকে আলবেনিয়ার নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইতিহাস থেকে কাদারের সঙ্গে যে তাকেও তো মুছে যেতে হবে! হোজ্জা হাড়ে হাড়ে জানত, সাহিত্যের দলিল ব্যতীত আলবেনিয়ার মতো দেশে মৃত্যু-পরবর্তী অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা অসম্ভব। নিজের অহমের জন্য হোজ্জা সব করতে পারে। সুতরাং কাদারের বেঁচে থাকা জরুরি।
দেশত্যাগের প্রথম অধ্যায় ও পাণ্ডুলিপি পাচার
১৯৮২ ও ১৯৮৩ সালের দিকে আলবেনিয়ার স্বৈরাচারী রাজনীতির সবচেয়ে অন্ধকার দিকগুলোর সঙ্গে মানুষ পরিচিত হয়। সেসব যদিও অন্য প্রসঙ্গ, তবে নগর পুড়লে দেবালয় যেহেতু এড়ায় না—তাই কাদারেও এসবের ভুক্তভোগী হলেন—চরমভাবে। দেশের অন্যান্য পরিস্থিতির একপাশে, কাদারের উপর নানান মাত্রায় ত্রাস ও হুমকি দিন-দিন বেড়ে চলল। তিরানার বাসভবনের সামনে রাতের বেলা গোয়েন্দা পুলিশের আনাগোনা, দিনের বেলা ভাড়াটে গুণ্ডাদের উৎপাত শুরু হলো। রাস্তায় বের হওয়া মুশকিল হলো। পরিবারসহ বিভিন্নরকম পরিস্থিতি ও হেনস্থার শিকার হচ্ছিলেন। নানান অজুহাতে থানায় ডেকে বারবার গোয়েন্দা- পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ ও হয়রানি চলল। তিরানার বাসভবনে একদিন দুর্বৃত্তদের হামলা হলো। আইনের শরণাপন্ন হতে গিয়ে কাদারে দেখেন, প্রশাসন নিশ্চুপ। পুলিশ পরামর্শ দিলো, নিজের নিরাপত্তার দিকটা দেখুন, মামলা করলে হিতে বিপরীত হবে।
কেননা, এসবের পেছনে ছিল সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের হাত ও ইঙ্গিত।
কাদারের কাছে দেশ ছাড়া ব্যতীত আর কোনো উপায় রইলো না। কিন্তু তাঁকে দেশের বাইরে যেতে বারবার বাঁধা দেয়া হলো। শেষে, ১৯৮৩ সালে ‘দ্য জেনারেল অব দ্য ডেড আর্মি’ সিনেমার প্রিমিয়ারে যোগ দিতে যাবেন—কারণ দর্শিয়ে দেশ ছাড়ার অনুমতি পেলেন। ফ্রান্সে গেলেন বটে, কিন্তু শত্রুরা থামল না। তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হলো। দেশে ফিরলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে রটানো হলো। এ সবই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ। কাদারে নিরাপত্তার তাগিদে ফ্রান্সে থেকে যাওয়ায় কাদারেকে দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ও ফ্রান্সের চর—বলে প্রচারে সুবিধা হলো। তাঁকে ‘খলনায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চলে জোর প্রচেষ্টা। তিনি প্যারিসে থেকে গেলেও, লেখকের পরিবার নিরাপদ ছিল না তিরানায়। চিঠি ও ফোনে প্রাণনাশ ও ক্ষতির হুমকি নিয়মিতই এলো। এ সময়টাতে কাদারে কেবল নিজের প্রতি প্রবল আস্থা ও বিচক্ষণতার জোরেই সবকিছুর মোকাবিলা করতে পারছিলেন। বিভিন্নজনের পরামর্শে তিনি দেশেও ফিরে এলেন।
এসময় রাজনৈতিক আশ্রয়ের নেয়ার ব্যাপারে কাদারেকে বিভিন্নজনের সঙ্গে পরামর্শ করতে দেখা যায়। আলবেনিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের গুঞ্জনও তিনি ভাবনার বাইরে রাখেননি। প্রাণ-সংশয় ভাবছিলেন, ভাবছিলেন নিজের সাহিত্যের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কথা। কাদারের বুদ্ধিমত্তার গভীরতা দেখতে পাই এই সময়কালে।
আলবেনীয় ভাষার কোনো নথি বা পাণ্ডুলিপি দেশের বাইরে নেয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। নথি বা পাণ্ডুলিপির গুরুত্বের উপর শিথিলতা নির্ভর করতো। কাদারে জানতেন, দেশে থাকলে পাণ্ডুলিপিগুলো কোনো-না-কোনোভাবে উধাও হবে। ফলে পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য ফ্রান্সে পাচার করতে লাগলেন (‘পাচার’ শব্দটাই এখানে যথাযথ।) পাণ্ডুলিপিগুলো পাচার করতে হতো সতর্কতার সঙ্গে। খণ্ডাকারে, ভেতরের টেক্সট এলোমেলো রেখে—যেন ইসমাইল কাদারের রচনা বলে কেউ বুঝতে না পারে। কখনো সাঙ্কেতিক ভাষায়—যাতে লেখাগুলো সরকারবিরোধী কিনা তা বোঝা আপাতত অসম্ভব হলেও প্রকাশক ও সম্পাদক এর পাঠোদ্ধার করতে পারে। পাণ্ডুলিপির কভারে বিদেশি লেখকদের নাম বসিয়ে—যেন মনে হয় পাণ্ডুলিপিটা কোনো বিদেশি বইয়ের আলবেনীয় অনুবাদ। এই পাণ্ডুলিপিগুলোর মধ্যে ছিল কতগুলো উপন্যাস, কিছু ছোটগল্প ও গুটি কয়েক কবিতা। ফ্রান্সের একটি ব্যাংকের ভল্টে রাখা হতো সেসব। ফরাসি প্রকাশকের প্রতি নির্দেশ ছিল, তাঁর কিছু হয়ে গেলে দ্রুতই যেন সেগুলো বই আকারে প্রকাশ করা হয়—যাতে আলবেনিয়ার সরকার তাঁকে নিয়ে রাজনীতি না করতে পারে।
১০ এপ্রিল, ১৯৮৫—আনোয়ার হোজ্জার মৃত্যু হয়। সেদিনই সন্ধ্যাবেলা কেন্দ্রীয় কমিটি, পলিটব্যুরো ও রাইটার্স ইউনিয়নের কর্তারা একত্র হয় কাদারের উপন্যাসিকা ‘A Moonlit Night’ এর বিপক্ষে হওয়া রিপোর্টসমেত। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বইটি নিষিদ্ধ করা হয় ও বাজার থেকে তুলে নেয়া হয়। যদিও ততদিনে বিশ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে।
হোজ্জার মৃত্যুর পর কাদারের উপর গোয়েন্দা-পুলিশের নজরদারি বেড়ে যাওয়ায়, কাদারেকে এ সময় খুব সতর্কতার সঙ্গে কদম ফেলতে হয়েছে।
১৯৮৭ সালে আলবেনিয়ায় রাজনৈতিক পরিবর্তনগুলো স্পষ্ট হতে থাকে। ১৯৮৮ সালে কাদারে ‘ইন্সটিটিউট দে ফ্রান্স’ এর সদস্য হন। এই পদটিই ছিল দেশে ক্ষমতাশীলদের আক্রোশ থেকে বাঁচার বর্ম। কাদারে নিজেকে দেখতে পেলেন অভ্যন্তরীণ যে কোনো কুচক্রের নাগালের অনেক বাইরে। ফলস্বরূপ, তার পরের বছর নজমিয়ে হোজ্জা—যে কিনা কাদারেকে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলতে তৎপর ছিল, গত সাত বছর গোয়েন্দা পুলিশ লেলিয়ে কাদারের শান্তি কেড়ে নেয়ায় যার ভূমিকা ও ইশারা ছিল মূখ্য, সে-ই কাদারেকে আলবেনিয়ার ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের ভাইস প্রেসিডেন্টের নমিনেশন দিলো। দেশে নিজের অবস্থান ফিরিয়ে আনতে কাদারে এই নমিনেশন গ্রহণ করেন। এখানেই একটা ভুল করে ফেললেন তিনি। এত জল গড়ানোর পর আবার সেই রাজনৈতিক দলে ফেরায় সমালোচনার মুখোমুখি হলেন। আলবেনিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যতও ততদিনে অন্য পথে হাঁটতে শুরু করেছে। কাদারে নিজের ভুল শোধরাতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের পক্ষ নিলেন ১৯৮৯ ও ১৯৯০ এ। স্বৈরচারী সরকারের সমালোচনা করে দেশকে গণতান্ত্রিক করার পক্ষে আহ্বান জানালেন। তখন দেশে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবার মতো পরিস্থিতি, শুরু হয় সরকার-পতন আন্দোলন।
দেশত্যাগ : রাজনৈতিক আশ্রয় ও সমাজতন্ত্র পরবর্তী ইসমাইল কাদারে
১৯৯০ এর অক্টোবরে দেশের পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে ওঠে। ক্ষমতার লড়াইয়ে কতগুলো পক্ষ নিজেদের ভেতর লড়ছিল। এর প্রভাব পড়ছিল জনজীবনে। নিরাপত্তাহীনতা, হামলা, হত্যা, গুম নৈমত্তিক ঘটনা। এই বিশৃঙ্খল পরিবেশ কাদারের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠল। বিশেষত একনায়কতন্ত্রের সমালোচনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলায় গোয়েন্দা পুলিশ ও মিলিটারি, নজমিয়ে হোজ্জা ও পার্টির নেতাদের কালো তালিকায় সবার উপর উঠল ইসমাইল কাদারের নাম।
কাদারেকে আবার উড়াল দিতে হলো ফ্রান্সের দিকে। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন মঞ্জুর হলো। থেকে গেলেন ফ্রান্সে। এবং শেষমেশ—নিজেকে স্বাধীন একজন লেখক বলতে সমর্থ হলেন ইসমাইল কাদারে। ১৯৯৩ সালে শেষ করলেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য পিরামিড’। লিখে চললেন তাঁর পরবর্তী বইগুলো। এখন আর রাখঢাক করে নয়, একনায়কতন্ত্রের কালো ইতিহাসকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন পুরো বিশ্বকে। রাজনৈতিকভাবেও ছিলেন সোচ্চার, বুদ্ধিজীবির ভূমিকা পালন করেন। কসোভোর স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে বারবার মানুষের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন। পরবর্তীতে কসোভো তাঁকে সম্মানস্বরূপ নাগরিকত্ত্ব প্রদান করে। অন্যদিকে সাহিত্যে অবদানের জন্য এরমাঝে পেলেন অনেক পুরষ্কার।
কাদারে দেশে ফেরেন ১২ বছর পর, ২০০২ সালে। ১৯৯০ ও ২০০০ এর দশকে আলবেনিয়ার দুটো প্রধান রাজনৈতিক দল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী হতে আহ্বান করলেও তিনি রাজি হননি। তাঁর চিরকালীন সংগ্রাম, সাহিত্যচর্চার স্বাধীনতার প্রতি অসীম ভালোবাসার কারণে কেবল সাহিত্যেই ব্যস্ত রাখলেন নিজেকে, আজ অবধি।
পরিশেষ
“Ismail Kadare chose to compromise in order to continue living and writing in Albania, without adopting the suicidal role of the heroic outsider on the one hand, and without supporting the dictatorship on the other.”
—Peter Morgan
স্বৈরচারের বিপক্ষে ইসমাইল কাদারের অবস্থান ও প্রতিবাদের বুদ্ধিদীপ্ততা তাঁকে যে অবস্থানে উন্নীত করেছে তা যে কোনো দেশে, পরবর্তী যে কোনো লেখকের জন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে। তাঁর এই লেখক জীবনের যাত্রা একদিকে যেমন অতুলনীয় ও অকল্পনীয়, অন্যদিকে তাঁর সৃষ্ট সাহিত্য আলবেনিয়াকে নতুন পরিচয়ে পরিচিত করিয়েছে সারাবিশ্বে। ইসমাইল কাদারেকে ‘আলবেনীয় জাতির অস্তিত্বের অভিভাবক’ হিসেবে আখায়িত করে ২০০৫ সালের ম্যান বুকার পুরষ্কার প্রদান মঞ্চে প্রফেসর জন ক্যারি বলেন, ‘ইসমাইল কাদারে হচ্ছেন সেই লেখক, যিনি সাহিত্যে নিজের জাতির ইতিহাস ও সংস্কৃতির পুরো মানচিত্র এঁকে ফেলেছেন।’
৯০-এর দশক থেকেই নোবেল পুরষ্কার জয়ীদের সম্ভাব্য তালিকায় তাঁর নাম উপরেই স্থান পেয়ে আসছে। বেঁচে থাকলে হয়তো পেয়েও যাবেন। না পেলেও ইসমাইল কাদারের এখন আর কিছু যায় আসে কিনা—আলোচনার বিষয়।
তথ্যসূত্র:
Wikipedia : Ismail Kadare, Enver Hoxha, Party of Labour of Albania
Ismail Kadare: The Writer and the Dictatorship 1957–1990 by Peter Morgan
The Guardian, Friday, 3 June 2005; Carey’s speech
The Gurdian : ‘I am not a political writer’ says Ismail Kadare
A Dictator Calls by Ismail Kadare
The Disappearance of Kadare’s The Red Pashas: Inquiry into a Literary Crime, Tirana 2002, by Maks Velo
রনক জামান
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১; মানিকগঞ্জ, ঢাকা, বাংলাদেশ। পড়াশোনা : জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (রসায়ন শাস্ত্র)। কবিতার অবসরে অনুবাদও করেছেন কিছু।
ranakzaman1991@gmail.com
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা
শামুকচর্য (২০২৪)
অগ্রন্থিত ওহী (২০১৯)
ঘামগুলো সব শিশিরফোঁটা (২০১৬)
অনুবাদ
ললিতা – ভ্লাদিমির নবোকভ (২০১৬, ২০২২)
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে – সেরা ২০ ছোটগল্প (২০১৮)
আমক – স্তেফান সোয়াইগ (২০১৮)
দক্ষিণে – সালমান রুশদি (২০১৮)
ইসমাইল কাদারের কবিতা (২০১৭)