লুকোচুরি — ফিওদর সলোগাব ।। ভাষান্তর : হুজাইফা মাহমুদ

ফিউদর সলোগাব ( fyodor sologub) ১৮৬৩ সালে সেন্টপিটার্সবার্গের এক দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন দর্জি। সলোগাবের শৈশবেই তিনি মারা যান। পরবর্তীতে তাঁর নিরক্ষর মা বাধ্য হয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন, এবং সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নেন। যাবতীয় প্রতিকূলতাসহ সলোগাব পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। ছাত্রজীবনেই লেখালেখির শুরু। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক এবং নাট্যকার তিনি। রাশিয়ার প্রতিকবাদি কবিতার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠেন তিনি। তাঁর গল্প-উপন্যাসও বেশ জনপ্রিয়। তাঁর উপন্যাস Petty Demon বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করে। ১৯২৭ সালের ৫ ডিসেম্বর লেলিনগ্রাদে মৃত্যুবরণ করেন এবং স্ত্রীর পাশে সমাহিত হন। অনূদিত গল্পটি Best Russian Short Stories নামক একটি ইংরেজি সংকলন থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।



                      লুকোচুরি

                        ফিউদর সলোগাব

১.
লেলেস্কার খেলাঘরের সবকিছুই ছিল উজ্জ্বল, সুন্দর, এবং আনন্দদায়ক। লেলেস্কার কচি কণ্ঠস্বর তার মাকে আনন্দিত করতো। অনিন্দ্য সুন্দর এক শিশু লেলেস্কা। অত্র এলাকায় তার মতো সুন্দর আর কেউ কখনোই ছিল না, এবং ভবিষ্যতেও যে হবে না, এ ব্যাপারে অন্তত লেলেস্কার মা সেরাফিমা আলেক্সান্দ্রোভনা নিশ্চিত ছিলেন! লেলেস্কার আঁখিযুগল ছিল ঘন কালো আর বড়। তার গণ্ডদেশ ছিল রক্তাভ গোলাপি! আর ওষ্ঠযুগল যেনো তৈরিই হয়েছে চুমু আর হাসির জন্য! কিন্তু লেলেস্কার মাকে কেবল এসব জিনিসই আনন্দিত করে ব্যাপারটা এমন না। লেলেস্কা ছিল তার মায়ের একমাত্র সন্তান, এজন্য লোলেস্কার প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনও তাকে মুগ্ধ করে রাখে! লেলেস্কাকে হাঁটুতে বসিয়ে গভীর মনযোগে আদর করতে তিনি পরম সুখ অনুভব করতেন। তাকে বাহুতে জড়িয়ে ধরে ভাবতেন, বাহ্ কি সুন্দর, জীবন্ত একটা জিনিস, অথচ ছোট্ট একটা পাখির মতো পলকা!

সত্য বলতে কি, আলেক্সান্দ্রোভনা একমাত্র এই খেলাঘরেই সবচে বেশি সুখ পেতেন! তার স্বামীর কাছে গেলে তিনি শীতল হয়ে যান। এর কারণ হয়তো তার স্বামীর স্বয়ং শীতলতা! তিনি এক অদ্ভুত ঠাণ্ডাপ্রিয় লোক। তিনি ঠাণ্ডা পানি খেতে ও ঠাণ্ডা হাওয়ায় শ্বাস নিতে ভালবাসেন। তার মুখে ঝুলে থাকে এক শীতল হাসি। তিনি সবসময়ই তকতকে পরিষ্কার ও শীতল থাকেন। এমনকি যখন হাঁটেন তখন চারপাশে শীতল হাওয়ার একটি স্রোত বইয়ে দেন! 
নেসলেটিভ সার্গেই মোদেস্তোভিক এবং সেরাফিমা আলেক্সান্দ্রোভনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন কোন পূর্বপ্রেম, পরিচয় ও হিসাব-নিকাশ ছাড়াই। কেননা সমাজে কেবল এটাই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ছিল।
মোদেস্তভিকের ছিলেন তখন পঁয়ত্রিশ বছরের একজন ভদ্র যুবক, আর সেরাফিমা ছিলেন পঁচিশ বছরের। তাদের উভয়ের বেড়ে ওঠা একই সামাজিক বৃত্তের ভেতর! একটা সময়ে এসে মোদেস্তভিকের ব্যাপারে সবাই আশা করছিলেন, এখন তিনি একজন স্ত্রী গ্রহণ করবেন। অপরদিকে সেরাফিমারও স্বামী-সন্তান নিয়ে চিন্তা-ভাবনার বয়স হয়ে গেছে। বরং সেরাফিমার বিষয়টা তো এমন ছিল, তিনি রীতিমতো তার কল্পিত ভবিষ্যত স্বামীর প্রেমেই পড়ে গিয়েছিলেন । তার কাল্পনিক স্বামীর ভাবনা তাকে যারপরনাই আনন্দিত করতো। তিনি মনের আয়নায় দেখতে পেতেন, খুব সুদর্শন, হৃষ্টপুষ্ট একজন সুপুরুষ, যার ধূসর চোখজুড়ে সর্বদাই সম্ভ্রান্তি ও মর্যাদার ভাব ফুটে থাকবে। যে তার পত্নীর সকল আদেশ ও আবদার নিখুঁত ভদ্রতার সাথে পালন করবে!

সেরাফিমা ছিলেন বেশ সুন্দরী। দীর্ঘাঙ্গিনী, কৃষ্ণনয়না, দীর্ঘকেশিনী! কিছুটা ভীতু বটে, কিন্তু খুব চালাক চতুরও! মোদেস্তভিক তাকে যৌতুকের বিনিময়ে বিয়ে করেননি। তবে তিনি এটা জেনে খুশি হয়েছিলেন যে, কন্যার সহায়-সম্পত্তি ভালই আছে। বড় বড় লোকদের সাথে তার খাতির ছিল, এবং তার স্ত্রীরও গণ্যমান্য প্রভাবশালীদের সাথে চেনা-জানা ছিল। পরবর্তীতে এগুলোই উপযুক্ত সময় ও সুযোগ অনুযায়ী বেশ কার্যকর বলে প্রমাণ হলো। কর্মক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সুকৌশলে তার পছন্দানুযায়ী পদগুলো পেয়ে যাচ্ছিলেন! এতোটা দ্রুত নয় যে, লোকজন তাকে হিংসা করবে। আবার এতো ধীরেও না যে, তার অন্যদেরকে হিংসা করা লাগবে! বরং সবকিছুই সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাপে আসছিল। তাদের বিয়ের পরে সার্গেই মোদেস্তভিকের আচার-আচরণে এমন কিছুই পাওয়া যায়নি যেটা তার স্ত্রীর কাছে বেঠিক বা ভুল বলে মনে হয়।
যাই হোক, পরবর্তীতে তার স্ত্রী যখন সন্তান সম্ভবা হলেন, তখন সহসা সার্গেই মোদেস্তভিক অন্য কোথাও খণ্ডকালীন সম্পর্ক স্থাপন করে বসলেন। সেরেফিমা সেটা টের পেয়ে গেলেন। এবং তিনি এতে কেবল ক্ষুব্ধ  ও আহতই হলেন না, বরং তার অনাগত সন্তানের জন্য এতটাই ব্যাকুলতা ও আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন যে তার অন্যান্য বোধশক্তিকেও এটা গ্রাস করে ফেললো।

একটা ছোট্ট কন্যাসন্তান জন্ম নিলো তাদের।
তার জন্মের পর সেরেফিমা আলেক্সান্দ্রোভনা নিজের সম্পূর্ণটুকুই তার জন্য উজাড় করে দিলেন! শুরুর দিকে তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে তার স্বামীর কাছে তার কন্যার প্রতিটা অঙ্গভঙ্গি, নড়াচড়া ও অস্তিত্বের বিস্তারিত বর্ণনা দিতেন, অত্যন্ত উচ্ছ্বাস ও আনন্দ নিয়ে। কিন্তু শীঘ্রই তিনি আবিস্কার করলেন, তার স্বামী এসব কথা শোনেন ঠিকই, তবে তাতে একফোঁটাও আগ্রহ নাই। কেবল তার স্বভাবসুলভ ভদ্রতার খাতিরে শোনেন। এরপর থেকে সেরেফিমা তার স্বামী থেকে দিনে দিনে দূর থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন! তিনি তার ছোট্ট কন্যাটিকে ভালবাসলেন, এক অতৃপ্ত আবেগ আর আকুলতা দিয়ে। সে ভালবাসা এতটাই তীব্র যে, তার পড়শী মহিলারা তাদের স্বামীদেরকে খোঁটা দিত, দেখো তারা তাদের বাচ্চাটাকে কত্ত ভালবাসে!

মামোস্কা, চলো আমরা প্রিয়াতকি ( লুকোচুরি) খেলি! লেলেস্কা তার মাকে ডাক দিয়ে বলে। র শব্দটা তার কচি উচ্চারণে ল হয়ে যায়। ফলে সে যখন প্রিয়াতকি বলে, তখন সেটা শুনায় প্লিয়াতকি।
লেলেস্কার শব্দোচ্চারণের এই অক্ষমতায় সেরেফিমার সবসময়ই হাসি পায় এবং এতে তিনি খুব মজা পান! 
অতঃপর লেলেস্কা তার হৃষ্টপুষ্ট ছোট্ট পা দুটো দিয়ে কার্পেটের উপর দৌঁড়ায় এবং তার একমাত্র লুকানোর জায়গা তার বিছানার কাছে গিয়ে লুকায়।
: কুউউ..কুউউ মামোস্কা! 
সে তার হাসি হাসি মিষ্টি কণ্ঠে ডাক দেয়! আর দুষ্টোমিপূর্ণ একটি চোখ খোলা রেখে সতর্কতার সাথে তাকিয়ে থাকে!
: কোথায় আমার ছোট্ট সোনামনি!!
যেন মা তার মেয়েকে খুঁজে খুঁজে হয়রান! এভাবে তাকে বিশ্বাস করালেন যে তিনি তাকে কোথাও দেখেননি! লেলেস্কা তার লুকানোর জায়গায় হাসির তরঙ্গ ঢেলে দিলো যেন। অত:পর সে তার জায়গা ছেড়ে আরেকটু কাছে আসলো, এবং তার মা, যদিও তিনি ইতোমধ্যেই চোখের কোনা দিয়ে দেখে ফেলেছেন তাকে, সহসা একজোড়া উচ্ছ্বসিত কচি বাহুর বন্ধনে আবদ্ধ হলেন! তিনি আনন্দ প্রকাশ করে বললেন, আরেহ, এই তো আমার লেলেস্কা! কোথায় ছিলে তুমি, আমি খুঁজেই পাইনি!
খুশি আর আহ্লাদে লেলেস্কা দীর্ঘসময় পর্যন্ত হাসতেই থাকে। তার মাথা নুয়ে আছে মায়ের হাঁটুর কাছে। শ্বেত-শুভ্র দুইটা হাত দিয়ে তিনি তাকে গভীর স্নেহে আদর করে চলেছেন। চোখে জ্বলজ্বল করছে এক গভীর আবেগমথিত স্নেহ! 
: মামোস্কা, এবার তুমি লুকাও।
লেলেস্কা কোনরকম হাসি থামিয়ে বললো।
তার মা লুকানোর জন্য গেলেন। লেলেস্কা ঘুরে দাঁড়ায়, যেন তার লুকানোর জায়গাটা দেখে না ফেলে। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে সে ঠিকই দেখেছে তার মা সবসময়ই ওই কাবার্ডের পেছনেই লুকায়!
: কুউউ.. কুউউ আমার ছোট্ট সোনা!
লেলেস্কা পুরো ঘরজুড়ে দৌড়ে দৌড়ে সব কোনায় কোনায় খুজতে লাগলো! যদিও সে জানে তার মা কোথায় লুকিয়ে আছেন, তবুও না জানার ভান করে তার মাকে বোঝাতে চায় সে আসলে জানে না!
: মামোস্কা, কোথায় তুমি! আমি খুঁজে পাচ্ছি না!
আহা, এখানেও নাই!
এভাবেই ঘরের এক কোনা থেকে আরেক কোনায় দৌড়াতে থাকে আর বারবার এসব বলতে থাকে!
তার মা শ্বাসরুদ্ধ করে দেয়ালে মাথা চেপে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথার চুল কিছুটা এলোমেলো, এবং লাল ঠোঁটে ঝুলে আছে সেই অপত্য স্নেহের হাসি।

নার্স ফিডোসিয়া, ভাল স্বভাবের সুদর্শনা মহিলা, যদিও কিছুটা বোকাটে- তার দিকে তাকিয়ে হাসলো, যেমনটা সে সবসময়ই তার মালকিনের দিকে তাকিয়ে হেসে থাকে- তার স্বভাবগত মুখের ভঙ্গিমা দিয়ে। যে ভঙ্গিমার দ্বারা সে যেন এটা বোঝাতে চায় যে, তার মালকিনের মতো একজন ভদ্রমহিলা এভাবে শিশুতোষ খেয়াল-খুশিতে মেতে থাকাটা ঠিক না। সে মনে মনে ভাবে, এই মা নিজেই যেন এক বাচ্চা শিশু! দেখো, কি আমুদে-উত্তেজনাতে সে মেতে আছে!

লেলেস্কা ধীরে ধীরে তার মায়ের লুকানো কোনার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তার মা প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়ছেন খেলাতে তার এই অতি আগ্রহের কারণে, তার হৃৎকম্পন দ্রুত বাড়তে লাগলো, এবং তিনি নিজেকে আরও বেশি করে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলেন, চুলগুলো আরও অবিন্যস্ত করে। লেলেস্কা সহসা তার মায়ের লুকানো কোনার দিকে তাকালো এবং সোল্লাসে চিৎকার দিয়ে বললো, পেয়ে গেছি.. পেয়ে গেছি।
স্ফূর্তি ও উল্লাস প্রকাশ করে জোরে চিৎকার করতে লাগলো এবং শব্দগুলির উচ্চারণে এমন অদ্ভুত ভুল করতে লাগলো যা তার মাকে আরও বেশি আনন্দিত করছিল।
লেলেস্কা তার মাকে টেনে টেনে রুমের মাঝখানে নিয়ে আসে। উভয়ে আমোদিত ও হাস্যরত। লেলেস্কা পুনরায় তার মাথা লুকায় মায়ের দুই হাঁটুর মাঝে এবং গোঙাতে থাকে।অনবরত গোঙাতে থাকে। তার ছোট্ট মধুর এই ধ্বনি খুবই মনোহরি, তবু কিছুটা বেখাপ্পাও লাগে তার মায়ের কাছে।

সার্গেই মোদেভস্কি এসময় আসছিলেন তাদের খেলাঘরের দিকে। আধখোলা দরজা দিয়ে আসা তাদের কলহাস্য, উচ্ছ্বাসধ্বনি ও দৌড়-ঝাঁপের শব্দ তিনি শুনেছেন। রুমে প্রবেশ করলেন, মুখে লেগে আছে তার শীতল অমায়িক হাসি। নিখুঁত টিপটাপ পরিচ্ছদ গায়ে। তাকে খুব তরতাজা ও ঋজু দেখাচ্ছে। তার চারপাশে পরিচ্ছন্নতা ও শীতল সুঘ্রাণময় একটি বলয় তৈরী করলেন। তিনি তাদের চলমান খেলার মাঝখানে প্রবেশ করলেন এবং তার প্রভাববিস্তারি শীতলতা দিয়ে তাদের সবাইকে অনেকটা হতচকিত করে ফেললেন। এমনকি নার্স ফিডোসিয়াও কুণ্ঠা অনুভব করতে লাগলো। কিছুটা তার মালকিনের জন্য, কিছুটা তার নিজের জন্য।
সেরাফিনা আলেকজান্দ্রোভনা মুহূর্তেই একেবারে শান্ত ও শীতল হয়ে গেলেন। এই পরিবেশ ছোট শিশুটিকেও প্রভাবিত করলো, তার হাসি থেমে গেলো এবং নিশ্চুপ হয়ে গভীরভাবে তার বাবার দিকে তাকালো।

সার্গেই মোদেভস্কি চকিত একনজর চোখ ঘোরালেন পুরো রুমে। তিনি সবসময়ই এখানে আসতে পছন্দ করেন। কারণ এখানের সবকিছুই সুন্দর পরিপাটি করে করে সাজানো। সাজসজ্জার এই কাজ আলেকজান্দ্রোভনা নিজে করেছেন। তার একান্ত আকাঙ্ক্ষা হলো, তার মেয়েটির চারপাশ যেন সুন্দর থাকে, এবং একেবারে শৈশব থেকেই যেন চারপাশে কেবল সুন্দরতম জিনিসগুলো নিয়ে বেড়ে উঠে।
এমনকি আলেকজান্দ্রোভনা যে অত্যন্ত উন্নত ও রুচিসম্পন্ন সুন্দর জামাকাপড় পরিধান করেন, সেটাও কেবল তার মেয়েটির জন্যই, এবং সেটাও তার পূর্বোক্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের ইচ্ছায়।
সার্গেই মোদেস্তভিক একটি জিনিসের সাথে নিজেকে এখনও খাপ খাওয়াতে পারেননি, সেটা হলো বাচ্চাদের খেলাঘরে তার স্ত্রীর এই ধারাবাহিক উপস্থিতি।

:ঠিক তাই, যেমনটা আমি ভেবেছিলাম। আমি জানতাম এখানেই তোমাকে পাবো আমি।
মোদেস্তভিক কিছুটা উপহাস আর অনুকম্পার সুরে বললেন।
একত্রে সকলেই খেলাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। মোদেস্তভিক দরজা দিয়ে তার স্ত্রীর পেছন পেছন আসতে আসতে কথায় পূর্বের সুর বজায়ে রেখে, কিছুটা নির্লিপ্তি ও শব্দে চাপ প্রয়োগ না করে বললেন, তোমার কি মনে হয় না এই বাচ্চা মেয়েটা যদি কিছুটা সময় তোমার সঙ্গ ছাড়া থাকে, তাহলে সেটা তার জন্য ভাল হবে? 
দেখো, কিছুটা হলেও তার নিজস্বতা তাকে অনুভব করতে দেওয়া উচিৎ তোমার।
তিনি নিজেই ব্যাখ্যা করলেন, আলেকজান্দ্রোভনার সপ্রশ্ন অদ্ভুত দৃষ্টির জবাবে।
:সে এখনও অনেক ছোট।এসব বুঝবে না।
আলেকজান্দ্রোভনা বললেন।
: যাই হোক, এটা নিছক আমার মতামত ছিল। জোর করছি না তোমাকে। যেহেতু এটা একান্তই তোমার জগৎ।
:আমি ব্যাপারটা আরও ভেবে দেখবো।
তার স্ত্রী জবাব দিলেন, সবসময়ের মতো মুখে শীতল আর সদয় হাসি মাখিয়ে।
তারপর তারা অন্য বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করলেন।

২.

সেই সন্ধ্যায় নার্স ফিডোসিয়া রান্নাঘরে বসেছিল।
বসে বসে নিশ্চুপ গৃহপরিচারিকা দারিয়া ও বাচাল বাবুর্চি আগাথিয়াকে বলছিল আলেকজান্দ্রোভনার কাহিনী। কিভাবে তারা মা-মেয়ে সারাটা দিন লুকোচুরি খেলে কাটায়, আর কতটা মগ্ন হয়ে থাকে এই খেলায়।
:সে তার ছোট্ট মুখখানা লুকায়, আর ডাকে.. কুউউ।
আর আমাদের মালকিনও যেন এক ছোট্ট শিশু। হাসতে হাসতে বলে ফিডোসিয়া।
আগাথিয়া শুনলো সবকিছু। শুনে মাথা নাড়াতে লাগলো ভয়ানকভাবে। চেহারায় ফুটে উঠেছে গাম্ভীর্য ও অসন্তোষের ভাব।
: আমাদের মালকিন এমনটা করেন, আচ্ছা সেটা আরেক বিষয়। কিন্তু বাচ্চা মেয়েটা যে এমন করে, এটা তো খারাপ!
: কেন, খারাপ কেন? 
ফিডোসিয়া সাগ্রহে জানতে চাইলো। তার চেহারায় ফুটে ওঠা এই অতি আগ্রহের ভাব যেন তার চেহারাকে একটা এবড়ো-খেবড়ো রং করা কাঠের পুতুলের মতো করে তুলেছে।
: হ্যাঁ, এটা খারাপ। ভয়ঙ্কর খারাপ!
আগাথিয়া কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে কয়েকবার বললো এ কথা।
:আচ্ছাহ!
ফিডোসিয়া বললো। তার চেহারায় ফুটে ওঠা হাস্যকর আগ্রহের ভাবটি আরও জোরালো হয়ে উঠছে।
: সে লুকাবে, লুকাবে এবং চিরতরে লুকিয়ে যাবে!
আগাথিয়া রহস্যময়ভাবে ফিসফিস করে বললো, দরোজার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে।
: কিসব কথা বলছো?
ভয়ে চিৎকার করে উঠলো যেন ফিডোসিয়া।
:এই সত্য। আমি বলছি। আমার কথাগুলো মনে রেখো। এটাই নিশ্চিত লক্ষণ।
আগাথিয়া একইভাবে, ফিসফিস করে ও সতর্কতার সাথে বললো।
বৃদ্ধ মহিলা এই লক্ষণটি নিজে আবিষ্কার করেছে এবং তা একেবারেই সহসা। এবং স্পষ্টতই এর জন্য সে গর্বিত।

৩.

লেলেস্কা ঘুমিয়ে ছিল, আর আলেকজান্দ্রোভনা তার নিজের রুমে বসেছিলেন, মূলত কল্পনার রাজ্যে সাঁতার কাটছিলেন। মনের সকল মাধুরি আর আনন্দ মিশিয়ে লেলেস্কার কথা ভাবছিলেন। কল্পনায় প্রথমে দেখছিলেন তার আদরের লেলেস্কা একটি ছোট্ট-মিষ্টি আর আদরণীয় মেয়ে, তারপর লেলেস্কা একটি মায়াবী পরীর মতো তরুণী, পুনরায় ছোট্ট উচ্ছল আনন্দিত একটি মেয়ে। এভাবেই লেলেস্কা তার কল্পনার চক্রে ঘুরে-ফিরে আসছিল বারবার। ছোট থেকে বড়, বড় থেকে আবার ছোট।
আলেকজান্দ্রোভনা একদমই লক্ষ্য করেননি ফিডোসিয়া তার কাছে এসেছে এবং সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে খুবই উদ্বিগ্ন ও ভয়বিহ্বল দেখাচ্ছে।
: ম্যাডাম, ম্যাডাম
সে শান্ত ও কম্পিত স্বরে ডাকলো। আলেকজান্দ্রোভনা তাকালেন। ফিডোসিয়ার সন্ত্রস্ত অবয়ব তাকেও উদ্বিগ্ন করে তুললো। 
:কী ব্যাপার, ফিডোসিয়া? লেলেস্কার কিছু হলো নাকি?
দ্বিগুণ উদ্বেগে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
: না ম্যাডাম, ওর কিছু হয়নি।
ফিডোসিয়া বললো এবং হাতের ভঙ্গিতে তার মালকিনকে শান্ত করতে ও দাঁড়ানো থেকে বসাতে চাইলো।
:লেলেস্কার কিছু হয়নি, সে ঘুমোচ্ছে, খোদা তার সঙ্গি হোন। আমি স্রেফ একটা কথা বলতে এসেছিলাম। আপনি দেখছেন, লেলেস্কা সবসময় নিজেকে লুকোতে পছন্দ করে, কিন্তু এই ব্যাপারটা মোটেও ভাল না।
কথাটা বলে ফিডোসিয়া স্থির দৃষ্টিতে তার মালকিনের দিকে তাকালো, তার দৃষ্টিতে এখনও ভয়ের ছাপ বিদ্যমান।
: কেন ভাল না? 
আলেকজান্দ্রোভনা নিস্তেজ অনিচ্ছুক আর বিরক্তিমাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ভয়টা দূর করার জন্য।
: কিভাবে খারাপ, কেন খারাপ সেটা আমি বলতে পারবো না।
ফিডোসিয়ার চেহারায় ফুটে উঠেছে সুনিশ্চিত প্রত্যয়।
: দয়া করে বুদ্ধি খাটিয়ে যৌক্তিক কথা বলো। তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।
: দেখুন ম্যাডাম, এটা একধরনের অশুভ পূর্বলক্ষণ।
কিছুটা লজ্জাবনত হয়ে ফিডোসিয়া বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে চাইলো।
: আস্ত একটা নির্বোধ তুমি।
আলেকজান্দ্রোভনা বললেন।

এই পূর্বলক্ষণ বিষয়ে আলেকজান্দ্রোভনার আর একটা শব্দও শোনার ইচ্ছা নাই, এমনকি এটা কিসের পূর্বলক্ষণ সেটাও শুনতে চান না। কিন্তু কোন না কোনভাবে এক অজানা ভয়ের অনুভূতি ও দুঃখবোধ তার মন মেজাজকে গ্রাস করে নিলো। এই অনুভূতি তার জন্য লজ্জাজনকও। কোথাকার কোন এক অদ্ভূত হাস্যকর কাহিনী তার প্রিয় কল্পনারাজ্যে এসে উপদ্রব শুরু করেছে। এবং তাকে এতোটা গভীরভাবে আন্দোলিত করে যাচ্ছে!

: আমি জানি, ভদ্রলোকেরা এসব লক্ষণ কুলক্ষণে বিশ্বাস করে না। কিন্তু ম্যাডাম এটা আসলেই একটা কুলক্ষণ।
দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে ফিডোসিয়া বলে যেতে থাকে।
:ছোট্ট মেয়েটি লুকোবে, লুকোবে…
সহসা কান্নায় ভেঙে পড়ে ফিডোসিয়া, সশব্দে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে যায়, আমাদের ছোট্ট পরীর মতো মেয়েটি লুকোতে লুকোতে শেষমেশ স্যাঁতসেঁতে কবরের পেটে গিয়ে লুকোবে।
বলতে বলতে ফিডোসিয়া তার অ্যাপ্রোন দিয়ে চোখের পানি মোছে এবং নাক ঝাড়ে।
: তোমাকে কে বলেছে এসব কথা?
নিচু কণ্ঠে কঠোর স্বরে আলেকজান্দ্রোভনা জিজ্ঞেস করেন।
: আগাথিয়া বলেছে, ম্যাডাম! সে এসব জানে।
: জানে?
আলেকজান্দ্রোভনা চিৎকার করে উঠলেন। এই অকস্মাৎ আশঙ্কার হাত থেকে নিজেকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে চাইছেন।
: কিসব পাগলের মতো কথা-বার্তা বলছো! দয়া করে ভবিষ্যতে কখনো এ ধরনের আজগুবি কথা নিয়ে আমার সামনে আসবে না। এখন ভাগো এখান থেকে।

ফিডোসিয়া আহত ও মনমরা হয়ে চলে গেলো।
আলেকজান্দ্রোনভনা ভাবছেন, কিসব আজে-বাজে চিন্তা এদের, হ্যাঁ, লেলেস্কার মৃত্যু আসতে পারে, কারণ মৃত্যু একটি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এসব কথা তো নিতান্তই অযৌক্তিক আর ভিত্তিহীন।
লেলেস্কার সম্ভাব্য মৃত্যুর যে শীতল অনুভূতি ও ভয় তার মনোজগৎ দখল করে বসেছিল সেটাকে দূর করতে চাইছেন।
আলেকজান্দ্রোভনা জোর করে ভাবলেন, কুলক্ষণের উপর এইসব মহিলাদের বিশ্বাস স্রেফ তাদের অজ্ঞতা। তিনি স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছেন, একটা শিশুর নিতান্ত স্বাভাবিক খেলাধুলা বিনোদন আর জীবনের চলমানতার মাঝে সম্ভাব্য কোন সংযোগ বা বিরোধ কোনটাই নেই। সেই সন্ধ্যায় তিনি তার মনকে অন্যান্য বিষয়ে ব্যস্ত রাখার জন্য বিশেষ প্রচেষ্টা ব্যায় করতে লাগলেন। কিন্তু তার মন বেখেয়ালে বারবার এই একটা ভাবনায়ই ডুবে যায়, লেলেস্কা নিজেকে লুকোতে খুবই পছন্দ করে!
যখন লেলেস্কা একেবারেই ছোট ছিল, কেবল তার মা ও নার্স ফিডোসিয়ার মাঝে পার্থক করা শিখেছে, তখন সে মাঝেমাঝে নার্সের বাহুতে মাথা রেখে সহসা দুষ্টুমিপূর্ণ ভেঙচি কাটতো এবং তার সহাস্য মুখটি নার্সের কাঁধে লুকিয়ে ফেলতো। তারপর সেখান থেকে চোরা দৃষ্টিতে তাকাতো।
পরবর্তীতে, খেলাঘরে আলেকজান্দ্রোভনার বিরল অনুপস্থিতির মুহূর্তগুলোতে ফিডোসিয়া তাকে লুকানো শিখিয়েছে। এবং আলেকজান্দ্রোভনা যখন এসে তার এই মুখ লুকানোর দৃশ্য দেখতেন তখন ভাবতেন, বাহ্ সে যখন মুখ লুকায় তখন কি চমৎকার লাগে দেখতে!
ধীরে ধীরে আলেকজান্দ্রোভনা নিজেই তার ছোট্ট মেয়েটির সাথে লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠলেন।

৪.
পরের দিন, আলেকজান্দ্রোভনা যথারীতি লেলেস্কাকে নিয়ে তার আনন্দময় খেলায় মগ্ন হয়ে গেলেন। এবং আগের দিন ফিডোসিয়ার বলা কথাগুলো একদমই ভুলে গেলেন।
কিন্তু খাবার প্রস্তুতের আদেশ দিয়ে পুনরায় যখন খেলাঘরে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন আচমকা শুনলেন, কুউউ.. কুউউ আওয়াজ।
ভয় ও আশঙ্কার একটি শিহরণ জেগে উঠলো তারা সারা গায়ে। যদিও তৎক্ষনাতই নিজেকে ভৎর্সনা করতে লাগলেন, ভিত্তিহীন ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন একটি কথার কারণে এতোটা ভয় পাওয়ায়। তথাপি, এরপর আর মনে-প্রাণে লেলেস্কার প্রিয় খেলায় প্রবেশ করতে পারেননি। তিনি চেষ্টা করতে লাগলেন লেলেস্কার মনযোগকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দিতে।
লেলেস্কা অত্যন্ত চমৎকার আর বাধ্য শিশু। সে সাগ্রহে তার মায়ের নতুন ইচ্ছার প্রতি সাড়া দিতে লাগলো। কিন্তু সে নিজেকে তার মা থেকে ঘরের কোনে এক কোনায় লুকানোর দীর্ঘ একটি অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে এসেছে এতদিন। সে কারণেই দিনে বেশ কয়েকবার মনের বেখেয়ালে আগের খেলায় ফিরে গেছে।
আলেকজান্দ্রোভনা লেলেস্কাকে অন্যভাবে আমুদিত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিষয়টা এতো সহজ না। কারণ বিরামহীনভাবে একটি আশঙ্কাজনক ভাবনা বারবার আঘাত হেনে যাচ্ছে তার মস্তিস্কে।

:লেলেস্কা কেন এই কুউউ ডাক ডেকেই যাচ্ছে? কেন সে একই জিনিস এতোবার করেও ক্লান্ত হয় না? চিরকাল এই চোখ বন্ধ করা আর কোথাও মুখ লুকানো, এটা আর কতকাল করবে সে!
আলেকজান্দ্রোভনা ভাবেন, হয়তো সে পৃথিবীর অন্যকিছুর প্রতি এতোটা শক্তিশালী আকর্ষণ অনুভব করে না, অন্যান্য বাচ্চারা যেমন বিভিন্ন জিনিসের প্রতি আকৃষ্ট থাকে। যদি ব্যাপারটা তাই হয়, তাহলে এটা কী তার আঙ্গিক ও গঠণগত দুর্বলতা নয়? এটা কী তার অবচেতনে বেঁচে থাকার প্রতি অনাকাঙ্ক্ষার জীবানু নয়?
আলেকজান্দ্রোভনা এই ভবিষ্যতাশঙ্কার কথা ভেবে খুবই কষ্ট পাচ্ছেন। ফিডোসিয়ার সামনে লেলেস্কার সাথে লুকোচুরি খেলা থামিয়ে দিয়ে বেশ লজ্জাও অনুভব করছেন। কিন্তু এই খেলা তার জন্য বেশ মর্মপীড়ার কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচে বেশি কষ্টে ভুগছেন এজন্য যে, তিনি নিজেও খুব করে চাইছেন এ খেলাটি খেলতে এবং এজন্যও যে, কোন এক অজ্ঞাতবোধ তাকে জোর করে টেনে নিতে চাইছে লেলেস্কা থেকে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার জন্য, এবং লুকানো লেলেস্কাকে খুঁজে বের করার জন্য! আলেকজান্দ্রোভনা নিজে এক-দুইবার খেলে খেলাটির শুরু করেছিলেন, যদিও তিনি শুরু করেছিলেন কোনকিছু না ভেবেই। কিন্তু এখন যে যাতনা সইছেন, মনে হয় যেন জেনে-শুনে ভয়াবহ কোন মন্দ কর্মে জড়ানোর শাস্তি পাচ্ছেন।

তার জন্য এটা এক দুঃখভারাক্রান্ত দিন ছিল।

৫.
লেলেস্কা তার ছোট্ট বিছানায় উঠে প্রায় যেন ঘুমিয়েই গেছে! তার বিছানার চারপাশ জাল দিয়ে ঘেরা। ক্লান্তি আর অবসাদে লেলেস্কার চোখ আপনাতেই বুঁজে আসছিল। তার মা তাকে নীল কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলেন। লেলেস্কা তার মিষ্টি কচি হাত দুটো কম্বল থেকে ধীরে ধীরে টেনে বের করে আনে মাকে জড়িয়ে ধরার জন্য।
মা তার উপর নুয়ে পড়েন। লেলেস্কা, তার তন্দ্রালু চেহারায় কোমল আদুরে অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে মাকে চুমু খায়, তারপর মাথাটিকে বালিশের গায়ে ঢলে পড়তে দেয়। হাতগুলো পুনরায় কম্বলের নিচে নিয়ে যায়। কম্বলের নিচে হাত দুটো নাড়িয়ে আদুরে গলায় বলে, মামোস্কা, হাতের কুউউ… 
আলেকজান্দ্রোভনার হৃৎকম্পন যেন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়! লেলেস্কা এখানে শুয়ে আছে, এতোটা ক্ষুদ্র নিস্তেজ আর শান্ত হয়ে, তা দেখে!
লেলেস্কার মুখে একচিলতে হাসি ফোটে। চোখ দুটো সামান্য খুলে আবার বন্ধ করে। অনুচ্চস্বরে বলে, মামোস্কা, চোখের কুউউ…
তারপর আরও অনুচ্চ আওয়াজে বলে, লেলেস্কা কুউউ..
এসব বলার মাঝেই সে ঘুমেরর কোলে ঢলে পড়ে। তার মুখের চাপ পড়ে বালিশের উপর। তার মা বেদনাক্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন, কম্বলের নিচে লেলেস্কাকে কি ক্ষুদ্র নিস্তেজ আর ক্লান্ত দেখাচ্ছে!
আলেকজান্দ্রোভনা দীর্ঘসময় বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন, লেলেস্কার দিকে শঙ্কা ও স্নেহের দৃষ্টি ফেলে।
: আমি তো একজন মা, আমার পক্ষে এটা কি সম্ভব তাকে এই কাজ থেকে বিরত রাখা?
লেলেস্কার উপর আপতিত সম্ভাব্য নানান রোগের কথা ভাবতে ভাবতে আলেকজান্দ্রোভনার এটা মনে হলো।
সে রাতে তিনি দীর্ঘসময় প্রার্থনা করলেন। কিন্তু এই প্রার্থনা তার দুঃখবোধকে দূর করতে পারলো না।

৬.

বেশ কয়েকদিন কেটে গেলো। ঠাণ্ডায় আক্রান্ত হলো লেলেস্কা। রাতে জ্বর উঠলো।
আলেকজান্দ্রোভনাকে যখন নার্স ফিডোসিয়া ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল, তিনি তড়িঘরি করে লেলেস্কার কাছে আসলেন। তার শরীর প্রচণ্ড জ্বরে উত্তপ্ত হয়ে আছে। খুবই ক্লান্ত অবসন্ন আর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনে হচ্ছে তাকে। তৎক্ষনাৎ তার অশুভ লক্ষণগুলোর কথা মনে পড়লো এবং একেবারে প্রথম মুহূর্ত থেকেই এক অপার নৈরাশ্য তার মনে জায়গা করে নিলো।
একজন ডাক্তারকে খবর দেয়া হলো। এবং এসব ক্ষেত্রে করণীয় যা যা থাকে সবই করা হলো, কিন্তু যা অনিবার্য তাই ঘটলো। আলেকজান্দ্রোভনা নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করলেন, হৃদয়ে আশার জাল বুনছেন, লেলেস্কা খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে, আবারও মন খুলে হাসবে, খেলবে- যদিও এটাকে এখন তার কাছে অকল্পপনীয় সুখ মনে হচ্ছে! আর, লেলেস্কা প্রতি ঘণ্টায়ই যেন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ছে।
এসব কৃত্রিম আশ্বাস ও সান্ত্বনা তাকে যতটা না ভীত করে তুললো, তারচে বেশি দুঃখিত করে তুললো এদের মুখোশাবৃত মুখগুলো।

ফিডোসিয়া বিড়বিড় করে বারবার একই কথা বলছে, সে নিজেকে লুকায়, নিজেকে লুকায় আমাদের লেলেস্কা!!
আলেকজান্দ্রোভনার কাছে এটা আরও বেশি অসহ্য লাগছে। কিন্তু তার চিন্তা-ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে গেছে। তিনি বুঝতে পারছেন না কী ঘটতে চলেছে!
জ্বর লেলেস্কাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। এবং বেশ কয়েকবার সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছে, কখনো প্রলাপ বকেছে। যখনই আবার জ্ঞান ফিরে পায়, এই অবসাদ ক্লান্তি আর যন্ত্রণা সে খুব সুন্দর করে সয়ে নেয়। দূর্বলভাবে হাসে মায়ের দিকে তাকিয়ে। যেন তার “মামোস্কা” বুঝতে না পারে কতটুকু যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সে!
এভাবে তিনটা দিন কেটে গেলো, দুঃস্বপ্নের মতো যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। লেলেস্কা আরও দুর্বল হয়ে পড়লো। সে জানতো না যে সে আসলে মারা যাচ্ছে!
লেলেস্কা তার অর্ধনিমিলত চোখ মেলে মায়ের দিকে তাকায়, হালকা অনুচ্চ ও ফ্যাঁশফ্যাশে গলায় বলে, কুউউ…মামোস্কা, তুমিও কুউউ দাও!
আলেকজান্দ্রোভনা লেলেস্কার বিছানার পাশেই পর্দার পেছনে মুখ লুকান! কি নির্মম বিষাদময়তা!

:মামোস্কা!
প্রায় শোনাই যায় না এমন আওয়াজে ডাক দিলো লেলেস্কা!
আলেকজান্দ্রোভনা নুয়ে পড়লেন তার দিকে। আর লেলেস্কা, তার চোখ বুঁজে আসছে, ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকা দৃষ্টি দিয়ে তার মায়ের ধূসর, ক্রমশ অদৃশ্যমান মুখটি শেষবারের মতো দেখলো।
: আমার শুভ্র সুন্দর মামোস্কা….
ফিসফিসিয়ে বললো লেলেস্কা। তার শুভ্র মুখটি নিষ্প্রভ হয়ে পড়লো এবং তার সামনে সবকিছু এক গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যেতে লাগলো। সে তার দুর্বল হাত দুটো দিয়ে বিছানার চাদরের একপ্রান্ত খামচে ধরলো এবং আবারও ফিসফিস করে বললো, কুউউ..
তার গলায় কিছু একটা ঘরঘর শব্দ করছে। লেলেস্কা তার দ্রুত বিবর্ণ হতে থাকা ওষ্ঠদ্বয় একবার খুলে আবার বন্ধ করে ফেললো এবং মারা গেলো।

আলেকজান্দ্রোভনা এক মূক বোবা নৈরাশ্য নিয়ে দেখলেন সবকিছু। তারপর রুম ছেড়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে স্বামীর কাছে গেলেন।
: লেলেস্কা মারা গেছে।
শান্ত আর নিস্তেজ কণ্ঠে কথাটি বললেন আলেকজান্দ্রোভনা।
সার্গেই মোদেস্তভিক উদ্বিগ্ন হয়ে তার ধূসর নিস্প্রভ মুখের দিকে তাকালেন। আলেকজান্দ্রোভনার প্রাণবন্ত সজীব সুন্দর চেহারায় এই অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ও নিশ্চলতা দেখে তিনি শিউরে উঠেন।

৭.
লেলেস্কার গায়ে শেষকৃত্যের পোষাক জড়িয়ে ছোট্ট একটি কফিনের ভেতর রাখা হলো। তাকে নিয়ে আসা হলো বড় হলরুমটায়। আলেকজান্দ্রোভনা কফিনের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন, আলোহীন, দুর্বল, নিস্তেজ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছেন তার মৃত লেলেস্কাকে।
সার্গেই মোদেস্তভিক তার স্ত্রীর কাছে গেলেন। রিক্ত-শূন্য আর শীতল শব্দাবলী দিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইলেন। চেষ্টা করলেন তাকে টেনে কফিনের কাছ থেকে সরিয়ে নেয়ার। আলেকজান্দ্রোভনা হাসলেন কেবল।
:দূরে সরে যাও! লেলেস্কা খেলছে। এক মিনিটের ভেতরই সে আবার উঠে দাঁড়াবে, দেখো!
শান্তভাবে কথাগুলো বললেন।
: সিমা, দয়া করে নিজেকে এতোটা বিক্ষুব্ধ করো না!
‎ফিসফিসিয়ে বললেন মোদেস্তভিক।
‎:স্বাভাবিক হও সিমা! নিজেকে ছেড়ে দাও নির্ধারিত ভাগ্যের উপর।
: সে এক্ষুনি জেগে উঠবে।
আলেকজান্দ্রোভনার কন্ঠে জেদ ফুটে উঠলো। চোখ গেঁথে আছে তার ছোট্ট মৃত মেয়েটির গায়ে!
মোদেস্তভিক তার চারপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি আশঙ্কা করছেন আলেকজান্দ্রোভনা আবার না কোন লজ্জাজনক ও হাস্যকর কাণ্ড ঘটিয়ে বসেন।
: সিমা, নিজেকে এতো বিক্ষুব্ধ আর অসহনশীল করো না।
কথাটা পুনরায় বললেন।
:যদি এমনটা ঘটেও তাহলে সেটা হবে এক অলৌকিক ঘটনা। আর এই উনবিংশ শতকে কোন অলৌকিক ঘটনা ঘটে না।
কথাগুলো বলার পরপরই মোদেস্তভিক বর্তমান ঘটনার সাথে তার কথাগুলোর অপ্রাসঙ্গিকতা বুঝতে পারলেন। তিনি বেশ দ্বিধাগ্রস্থ ও বিরক্তি বোধ করছেন।
বাহুতে জড়িয়ে সাবধানে আলেকজান্দ্রোভনাকে কফিনের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিলেন। আলেকজান্দ্রোভনাও এর কোন বিরোধিতা করলেন না।
তার মুখ নিথর, আর চোখ শুষ্ক হয়ে আছে। ধীর পায়ে হেঁটে খেলাঘরের দিকে গেলেন এবং রুমের চারপাশে ঘুরতে লাগলেন। যেসব জায়গায় লেলেস্কা নিজেকে লুকিয়ে রাখতো সেসব জায়গা দেখছেন। প্রায় পুরো কামরা জুড়েই ঘুরতে লাগলেন। কখনো মাথা নুয়ে টেবিলের নীচে, খাটের নীচে দেখছেন, বারবার স্ফূর্তিমাখা কণ্ঠে ডাকছেন, কোথায় আমার ছোট্ট সোনা! কোথায় লুকিয়েছো লেলেস্কা…
একবার পুরো কামরায় চক্কর কাটার পর যেন নতুন উৎসাহ ফিরে পান। আবার একই কাজ করেন। নার্স ফিডোসিয়া নিশ্চল, হতাশ মুখে বসে আছে এক কোনায়, ভীত চোখে তাকিয়ে দেখছে তার মালকিনকে! সহসা প্রচণ্ড কান্নায় ফোঁপাতে লাগলো। ক্রমেই তা জোর বিলাপে রূপান্তরিত হলো-
: নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সে, নিজেকে লুকিয়ে ফেললো আমাদের ছোট্ট পরীর মতো লেলেস্কা!!
আলেকজান্দ্রোভনা কেঁপে উঠলেন তার বিলাপ শুনে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছু সময় ফিডেসিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে খেলাঘর ছেড়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলেন।

৮.

সার্গেই মোদেস্তভিক শেষকৃত্যের কার্যাবলি দ্রুত সমাধা করে ফেলতে চাইছেন। তিনি দেখলেন, আলেকজান্দ্রোভনা এই আকস্মিক দুর্বিপাকে যে মারাত্মক আঘাত পেয়েছেন, সেটা খুবই ভয়াবহ। যদি দ্রুত লেলেস্কাকে সমাধিস্ত করে আসতে পারেন তাহলে হয়তো তাকে এ অবস্থা থেকে কিছুটা সরিয়ে আনা যাবে এবং ভালভাবে সান্ত্বনা দেয়া যাবে।

পরদিন সকালে আলেকজান্দ্রোভনা বিশেষ মনযোগ দিয়ে জামা-কাপড় পরিধান করলেন- তার লেলেস্কার জন্য। তারপর ধীর পায়ে বড় হলরুমটায় প্রবেশ করলেন। লেলেস্কা ও তার মাঝে আরও বেশ কয়েকজন মানুষ আছে। যাজক আর পুরোহিতেরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে একপাশে। পুরো কামরায় নীল ধোঁয়ার মেঘ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। ধূপগন্ধে ভরে আছে পরিবেশ। মাথার ভেতর তীব্র চাপের অনুভূতি নিয়ে আলেকজান্দ্রোভনা এগিয়ে গেলেন ছোট্ট কফিনের দিকে। লেলেস্কা এখনো শুয়ে আছে, ম্লান, বিবর্ণ আর ওষ্ঠে লেগে আছে এক করুণ মায়াবি হাসি। কফিনের একপাশে আলতো করে গাল ছোঁয়ালেন আলেকজান্দ্রোভনা। ফিসফিস করে বললেন, কুউউ আমার ছোট্ট মামণি!
ছোট্ট মামণির কাছ থেকে কোন জবাব আসেনি। তার চারপাশের লোকজনের মাঝে বেশ অস্বস্তি, আলোড়ন আর দ্বিধাগ্রস্ততা দেখা গেলো। কয়েকটি মুখ তার দিকে ঝুঁকে পড়লো অপ্রয়োজনীয়ভাবে। কেউ একজন তাকে ধরে একটু সরিয়ে আনলো। আর লেলেস্কাকে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হলো।

আলেকজান্দ্রোভনা সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। দীর্ঘ দীর্ঘঃশ্বাস ফেললেন। তারপর হেসে দিয়ে জোরে ডাক দিলেন, লেলেস্কা!!
লেলেস্কাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার মা এক নিরাশ চিৎকার দিয়ে কফিনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন। কেউ পেছন থেকে আটকে রাখলো।
যে দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে, সে দরজার দিকে ঝাঁপ দিলেন। তারপর মেঝেতে বসে দরজার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলেন। জোরে চিৎকার দিয়ে বললেন, লেলেস্কা, কুউউ.. কুউউ লেলেস্কা!!
আলেকজান্দ্রোভনা তার মাথাটি বের করলেন দরজা দিয়ে, এবং জোরে জোরে হাসতে লাগলেন।

লেলেস্কাকে খুব দ্রুততার সাথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার মায়ের দৃষ্টিসীমা থেকে। জোর কদমে হাঁটছে শববাহকেরা! হাঁটার পরিবর্তে যেন দৌড়ে যাচ্ছে।

শেয়ার
সর্বশেষ সংখ্যা