মুজিবুর রহমান-এর গল্প — মায়া ভুজঙ্গিনী

বানেছা বানুর সিথানে-পৈথানে দুঃখ।

একমাত্র পুত্র আর পুত্রবধূ নিয়ে বিড়ম্বনার শেষ নেই তার। তার হাতে গড়া সংসার যেনো বানের তোড়ে ঠুনকো শন, এই ডুবে এই ভাসে অবস্থা। যেমন তার পুত্র তেমন তার বউ, হায়া-শরমের ধার ধারে না। শ্বশুর -শ্বাশুড়ির সামনে জামাই-বউ একসাথে কিভাবে খায়! খায় তো খায়-ই, আবার বউটা পাহাড়ি ঢলের মতো খলখল করে হেসে ওঠে।

আসলে দোচালা এই ছোট্ট ঘরে একপাশে বানেছা বানু ও তার স্বামী, অন্যপাশে হোগলা পাতার বেড়া দিয়ে আড়াল থাকে পুত্র আর পুত্রবধূ। ঘরে একে অন্যের নিঃশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পায়। বউটার আদিখ্যেতা দিনকে দিন বেড়েই চলছে, সহ্য হয় না বানেছা বানুর। উপুর নাই দুপুর নাই, চার ঠোঁটের আওয়াজ পায় সে। পাশাপাশি মোবাইলে সিনেমা দেখে। এসব তবুও মেনে নিয়েছে বানেছা বানু। তার চিন্তা সংসারের হাল আনাড়ি হাতে চলে যাচ্ছে দিনকে দিন। জান-জীবন মাটি করে এই সংসার টিকিয়ে রেখেছে সে। অন্য কোনো নারী এই সংসার করতো না।

গতকাল এক বিহানের জন্য শুধু গঞ্জে গিয়েছিল বানেছা বানু, ফিরে এসে দুয়ারে পা রাখতেই তিলপিঠার গন্ধ তার নাকে উষ্ঠা মারলো। এই ঘরে তারে জিজ্ঞেস না করে তিলপিঠা হয়, এত বড় সাহস হয় কীভাবে। ঘনঘন খরচের হাত লম্বা হওয়া ভাল লক্ষ্মণ নয়। ভেজা বালিশের মতো রাগে ফুলে উঠলো বানেছা বানু। বউ এসে হাতেপায়ে ধরে সাধলো, পিঠা মুখে নেয়নি সে। এক পর্যায়ে পুত্রবধূর বংশলতিকার বিভিন্ন দূষণ নিয়ে গালাগাল শুরু করলো। আহা, বানেছা বানুর গালি, শুনলে কানের পোকা মরে যায়।

– এইডা কোন জুইতের কথা কথা কস মা, তোর একটা মোটে পুতের বউ, তুই কেমনে পারোস তার মা-বাপ চোদ্দগুষ্ঠি তুইলা গালি দিতে? দিন-দুপুইরা ডাকাইতের মতোন মিছা কথা কইবি না, আল্লার কিরা কইরা ক, পিঠা বানায়া তোরে সাধে নাই?

– আরে গোলামের পুত, আমি তো তোরে পেটে লই নাই, পেটে লইছে তোর বউ। বউ তো না তোর নয়া মা হইছে। আমার কথা তো কানে তুলবি না। তোর বউ একটা কালনাগিনী, হাছা মিছা যা কয় তুই মাইগ্যা পোলা হেডাই একিন করছ?

ইসাক মিয়ার বাপ হুকা সাজতে সাজতে মা-ছেলের ঝগড়া শুনে। মাঝে মাঝে বিরক্তি নিয়ে বলে – ধুরু বাল! এই শব্দ দুটো সে হুকায় ধোঁয়া না ওঠায় বলে নাকি ঝগড়ায় বিরক্ত হয়ে বলে ঠাহর করা যায় না। বানেছা বানুর গায়ে  তখন যেনো বিছুটি বিষ ফোটায়। গালাগালি নতুন মোড় নেয়।

– ইয়া মাবুদ, আমারে তুমি কবুল করো মাবুদ। এই ব্যাডার সংসার করা আর তালগাছের লগে সংসার করা একই কথা। এই পাঠার ঘরের পাঠার মুখ -পুটকি সমান কথা। বাতাস আইলে তালগাছ একটু লড়েচড়ে, কিন্তু সংসারে আগুন লাগলেও এই পাঠা কিছু কইবো না। তার পুতেরে যে ছিনাল বউ বাণ মাইরা আন্ধা কইরা রাখছে, হেইডাও বুঝে না।

গাজিকালুর দরগায় সিন্নি, মাগরিব আজানের সময় শাড়ির আঁচল পেতে দোয়া, ডাক্তার-কবিরাজ ফিকির করে খোদার দরবার থেকে পুত্র সন্তান মঞ্জুর করে বানেছা বানু। পুত্রের নাকের গোড়ায় বয়ঃসন্ধির  কালো চাঁদ উঁকি দিতে না দিতেই, জৈষ্ঠ মাসের হাওর পাথারি ষাঁড়ের মতো ক্ষেপে উঠল বিয়ের জন্য। গামছা কাঁধে ফেলে লুঙ্গির এক কোণা হাতে তুলে দপদপ করে হেঁটে যায়, পাড়ার মস্করা সম্পর্কের দাদা-নানা ঠিসারা দেয় :

 – কিরে ইসাক মিয়া, যেই লীলার হাঁটা দেস, নিজের ধোনের ওজন মনে হয় বইতে পারতাছস না, ভাবডা কি তোর?

এই ধরণের মস্করার অপেক্ষাতেই ছিল যেন ইসাক মিয়া। অহেতুক গামছায় কয়েকটা ঝাড়া দিয়ে বলে

 – বিয়া করায়ে দেও, নাইলে ঘরের মাগি লইয়া শান্তিতে ঘুমাইবার পারবা না, ধোন কান্ধে লইয়া চলমু কিন্তু!

বানেছা বানুর কানে যায় কথা। নয়া বাড়ির কলা গাছের মতো তরতর করে লম্বা হয়েছে পুত্র, আক্কেলে তো বাড়ে নাই। তবুও কলিকালের দোষ, কিয়ামতের আলামত, সিনেমা দেখে দেখে ছেলেদের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে এবং পুরুষজাতির মাথায় যে বীর্য উঠে যায়, – ইত্যকার নানা কথা বলে তিনি রাজি হলেন পুত্রের বিয়ে দিতে। যদিও পাড়াপড়শি ফোড়ন কাটে যে পুত্রের চেয়ে মায়ের আগ্রহটাই বেশি ছিল। কেননা নিত্যি নিত্যি বানেছা বানু খোয়াব দেখতো – সাদা কাপড়, সাদা সাদা বাড়ি, সাদা নৌকার পাল তুলে বানেছা বানুকে নাইওর নিতে আসছে কোন এক অনচিনা মাঝি। বানেছা বানু বলছে,

– আর কয়ডা দিন সবুর কর মাঝি, সংসারটা সমঝায়ে দিয়া লই কারো কাছে।

আষাঢ়ের বিল ঝিলমিল জ্যোছনার রাতে ঘরে পুত্রবধূ আনে বানেছা বানু। জোয়ারের রাঙ্গা পুটির মতো ফরফর করে ইসাক মিয়ার মন। শোলাপাতলা এতোটুকুন বউ, বাতাসের আগে আগে উড়ে উড়ে ঘর-দুয়ারের গৃহস্থালি গুছিয়ে রাখে।

পড়শিরা বলে,

 -কিগো বানেছা, তোমার খোয়াবের মাঝিরে কও এখন আইতে, সাদা কাপড় পড়াইয়া তোমারে বউ সাজাইয়া নায়ে তুইলা দেই।

কথা শুনে বানেছা বানু মিশ্রিচোরা মিষ্টিমিহি শরমের হাসি টেনে বলে

–  মাঝিরে তুমরার বাড়ি চিনাইয়া দিমুনে, নাতি নাতকর না দেইখা যামু না।

নাতি নাতকর হোক বা না হোক, বানেছা বানু চায় সংসারের পয়মন্ত অগ্রগতি। কিন্তু পুত্র আর পুত্রবধূর সাব-মেম চলাফেরা তার পছন্দ না। হাওর-কান্দা ঘুরে খড়কলমি, লাকড়ি, শুকনো গোবর পর্যন্ত কুড়িয়ে আনে বানেছা বানু। আর মেমসাব বউ তিনবেলার লাকড়ি একবেলায় শেষ করে ফেলে! চুলার পেট কি রাক্ষস হয়ে গেল? এই চুলায় রান্না করে নি বানেছা বানু? এই সংসারের ভালমন্দটা যদি তারা না বুঝে তাতে বানেছা বানুর কি করার আছে? বেশি বেশি করলে আলাদা করে দিবে সে। নিজে কামাই করে সংসার কাকে বলে শিখুক। দুনিয়া বড় কঠিন। বানেছা বানু জানে তা। এখনো মনে পড়ে সেইসব উপোস করা দিনের কথা। ইসাক মিয়ার বাপের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। বানেছা বানুর বিয়ে হয়, এক বছরেই আলাদা করে দেয় তাদের। পিঁড়িতে বসে খেতে দিতো না বানেছা বানুকে, বেশি খেয়ে ফেলবে। বেশি খেতে নেই নতুন বউয়ের। বেশি খেলে শরীর ভারি হয়ে যাবে, কাজ করা যাবে না।

বর্ষার এক মেঘগোমরা দিনে বানেছা বানুকে আলাদা করে দেওয়া হয়। বানেছা বানুর পেটে তখন বড় মেয়ে মেঘের মতো ঘনায়ে এসেছে। কয়েক কেজি সিমের বিচি, দুটো পাতিল, একটা চাঁদর ও বন্ধুর দেওয়া এক প্যাকেট বিড়ির প্যাকেট সাথে করে বানেছা বানুকে নিয়ে ঢাকার ট্রেন ধরে ইসাক মিয়ার বাপ।

ঢাকায় নেমেই বানেছা বানুর গা গুলিয়ে ওঠে। ইসাকের বাপকে বলে

 – কিয়ো, সারা পথে গু ক্যান?

– আরে এগুলা গু না, ঢাকার মাটিই এমন, হলদি হলদি। বিষ্টি অইলে গুয়ের মতোন লাগে।

ঢাকার ভাষানটেক এলাকায় গাঁয়ের লোক থাকে। অনেক খোঁজাখুজির পর পরিচিত একজনের দেখা মিললো।

ঘর ভাড়া নিতে হবে। বাড়িওয়ালিরা নতুন মানুষ নিতে চায় না অগ্রিম বায়না ছাড়া। বানেছা বানু বলে

– খালা গো, আমার পেটের বাচ্চার কসম, আফনের ভাড়া মাইর দিমু না। বান্দি খাইট্টা শোধ দিমু, আমারে জায়গা দেন।

বানেছা বানুর গলগলে পেট দেখে দয়া আর চোখেমুখে সীসাভারি আত্মবিশ্বাস দেখে ভরশা পেলো বাড়িওয়ালি। ছোট একটা খোপের মতো ঘর, কাদাজলে জবজব করে।

স্বামীর সাথে সমানে মাটি কেটেছে, রাজমিস্ত্রির জুগালি ছিল, বালু টেনেছে, ইট টেনেছে। মাসিকের লজ্জাজলে সায়া ভিজে উঠেছে, তবু ঠায় বসে ইট ভেঙেছে বানেছা বানু। রক্ত পানি করা শ্রমে-গ্রামে বাড়ি কিনেছে, বড় মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, দুই কানি জমি রেখে ঢাকা ছেড়ে গাঁয়ে থিতু হয়েছে। এখনো থেমে নেই বানেছা বানু, বাড়ির সামনের মরিচ ক্ষেতের পুরোটা তদারকি সে একাই করে। মরিচ ক্ষেত নিড়ানি, বসে আগাছার সাথে বাহাস করে – পেটলাগাইন্যা ঘাস, সার পাইয়া রং রং করো, এই বানেছারে চিনো না, একবারে গোরা থিকা মুসলমানি করায়া দিমু।

ইসাক মিয়ার চলাচলতি ভাল লাগছে না বানেছার। কতই বা রুজি করে পুত্র, কিন্তু বউয়ের তো স্নো পাউডারের কমতি নাই। উপরি উপরি গন্ধ সাবান, সুবাস তেল, নতুন নতুন বক্ষ-বন্ধনি। আদিখ্যেতা দেখলে গা রিরি করে বানেছা বানুর। বাজার থেকে পোটলা এনে বউয়ের হাতে দেয় ইসাক মিয়া। এটা কীভাবে মেনে নেবে বানেছা? তার কি ঘর সামাল দেওয়ার দিন শেষ? এখনি বউয়ের হাতের দিকে চেয়ে থাকবে সে? এই বানেছা!

– কিরে জাউরার পুত, বেটির মুরিদ, ঘরে মা থুইয়া তুই এখনি মাতাব্বরি করাস বউ দিয়া? কয় টেকা কামাস তুই?

– দেখ মা, টেকা তোর বাপের বাড়ি থিকা আসে? তোর বাপ দেয় টেকা? আছে তোর বাপের কিছু? সারাদিন পুটকি মারলে তোর বাপের এক ছটাক গু বাইর হইবো না। আমি আমার বাপেরটা খাই।

– আহা গো তোর বাপের টেকা। হাগে না কাউয়ার আসমান ভরা ডাক। আমার ঠ্যাং লাড়া না দিলে তোর বাপের মুরোদ ছিল না দুই আনা জামানোর। পাডার পুত আবার আমার বাপ লইয়া খুটা দেস।

–   মা, তুই চাস কি? খুদার ত্রিশটা দিন কাইজ্জা করোস। এমন করলে তো থাকা যায় না, থাকিস তুই তোর সংসার লইয়া।

– আল্লা গো, এই কানপড়া নি দিছে তোর বউ? বুঝি, বুঝি, সব বুঝি। বউটা কথা-বার্তা কম কইলে কি হইবো, পেট লাগাইবার যম। শেষ কইরা দিছে আমার পুতেরে। যাও, তোমরার যদি আমার কথা মজা না লাগে, যাও কোন বাপের বাড়ি যাইবা।

প্রতিদিন আযানভোর আর কুপিজ্বলা সন্ধ্যায় বানেছা বানুর ঘরে ঝগড়া লাগে। একপর্যায়ে ইসাক মিয়ার আলাদা হতেই হলো।

পড়শিরা বানেছা বানুকে বললো

 – এইডা কি করলা বানেছা, তোমার স্বভাব এমন বনাতি কচুর মতোন ক্যান? একটা পুতের বউরে লইয়া সংসার করতে পারলা না? মাইনষে পাঁচ পুতের বউ লইয়া কেমনে চলে? তোমার মাংগের পানির গাঙ্গেও জায়গা হইবো না, পুত আর পুতের বউ ছাড়া দেখমু আর কোন সুজন আসে। এই রংয়ে এই জীবন যাইবো তোমার?

পানে জাবর কেটে নির্ভার, নির্বিকারভাবে বানেছা বলে

– ও গো ছিনালরা, দুনিয়াডা দেইখ্যা আসুক, আমারে মন্দ কইয়ো না। আমার জানে-জীবনে পুতের সুদিন কইরা দিমু। একলগে থাকলে এখন পুতে খালি লুটাইবো, কান্ধে জোয়াল দিছি টাইন্যা আসুক।

ইসাকের বাপ কাশতে কাশতে বলল -ধুরু বাল’। এবারো ঝগড়ায় নাকি হুকায় বিরক্ত সে ঠাহর করা গেল না।

ভরা বর্ষা মাথায়, ইসাক মিয়া পোয়াতি বউ নিয়ে ঢাকার ট্রেন ধরলো। ঢাকার ভাষানটেকে গাঁয়ের মানুষ থাকে।

ট্রেন থেকে নেমে ফুটপাতে বনরুটি খেয়ে নিলো। পানি মুখে নিতেই বউ বললো

– কিয়ো, পানিতে তো গুয়ের গন্ধ করে।

ইসাক মিয়া মৃদু হেসে বলে

– ঢাকার পানি এমনি, আমার আম্মা যখন ঢাকায় আইছিল, তখন ঢাকার মাটি গুয়ের মতো ছিল।

শেয়ার