দেশ স্বাধীনের আগে আগে যখন আতরজানের বয়স ষোলর মতো আর ফুলজান মোটে সাত, আতরজানের বিয়ে ঠিক হলো চুকনগরে। কিন্তু চুকনগরে যুদ্ধের বছরে দশ হাজার মানুষ মরলো এক দিনেই তাদের চোখের সামনে। আতরজানরা কিনা মুসলমান বলে বেঁচে গেছিল প্রাণে।
১.
আতরজানেরা ছিল পাঁচ ভাই-বোন। আতরজানই সবার বড়। তার পরে তিন ভাই হয়ে সবার ছোট ফুলজান। এক কার্তিকের ভোরে জন্মালো সে হলদে ফর্সা রঙ আর মাথা ভর্তি কোঁকড়া কোঁকড়া চুল নিয়ে। হাঁটতে শিখলো মাত্র দশ মাস বয়সেই। হাঁটতে শিখলো কিন্তু কথা বলতে শিখলো না। সে নিয়ে আম্মার কি পেরেশানি, ‘আমার ফুলজান কতা কতি শিকবিনা নাকি? ও আতর- দুটো ছড়া শোনা ওকে- ঢঙ্গের মেইয়ি আমার! স্কুলে যাও মণি অতচ ছোট বুনটারে দু’টো ছড়া শোনাতি পারো না?’
মায়ের বকা শুনে ভীত আতরজান তার নয় বছরের ছোট বোন ফুলজানের উদ্দেশে স্কুলে শেখা সব ছড়া বা কবিতা বলা শুরু করত, ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে/ঝাঁঝর কাঁসর মৃদঙ্গ বাজে’ কিম্বা ‘হাট্টিমা টিম টিম/তাদের খাড়া দু’টো শিং’ অথবা ‘ছেলে ঘুমালো/পাড়া জুড়ালো/বর্গী এলো দেশে’ এইসব। সে সব ছড়া শুনে ফুলজান তার লালচে আর অতটুকু বয়সেই টোল পড়া দুই গালে অবাক চোখে যদি বা চায়, মুখ থেকে আনন্দে-রাগে-কান্নায় এক ধরণের গোঁ গোঁ শব্দ ছাড়া তার কিছুই বের হয় না। তখন খালিশপুরে মাত্রই নতুন নতুন জুট মিল। ক্রিসেন্ট, প্লাটিনাম, ইস্টার্ন। জুট মিলের লেবারদের জন্য পাকা দালানের এক রুমের কোয়ার্টার যেমন আছে, তেমন বস্তিও আছে। যতদিন ‘পারমানেন’ লেবার না হয়, ততদিন বস্তিতে থাকা হয়। তারপর ‘পারমানেন’ হলেই পাকা দালানের এক রুমের কোয়ার্টারে ওঠা। চাকরি আরো পাকা হলে দুই রুমের কোয়ার্টারও পায় কেউ কেউ। যেমন, আতরজানরাই প্রথম খালিশপুরে এসে চার বছর রেললাইনের পাশে বস্তিতে থাকার পর পিপলসে আব্বা যেদিন প্রথম ‘পারমানেন’ হলো, পাকা দালানের একটি এক রুমের কোয়ার্টারে জায়গা হলো তাদের। সে বছরই ফুলজান হওয়ায় আম্মা ধরেই নিল যে এই মেয়েটি তার ঘরের লক্ষী। অথচ, তিন/চার বছরেও সেই যখন ফুলজানের মুখে আর বোল ফোটে না, আম্মার সে কি দুশ্চিন্তা, সে কি দুশ্চিন্তা!
আতরজান তখন স্কুলে যেত। খালিশপুরে লেবারদের ছেলে-মেয়েদের জন্য বানানো স্কুলে। তাদের দেশের বাড়ি এমনিতে মংলাতে। কিন্তু আব্বা সেই দেশ স্বাধীনেরও কত আগে খালিশপুরে যখন মাত্রই বড় বড় জুট মিল তার বিশাল সব লাল টকটকে গেট আর জুট মিলের সাথে লাগোয়া সব লম্বা, টানা রেল লাইনসহ মাথা তুলে খাড়া হচ্ছে আসমান ছোঁবে বলে, তখন আতরজানের বয়স পাঁচের মত হবে আর পরের ভাইটার তিন, সেজ ভাইটা মায়ের পেটে, তেমন এক সকালে আব্বা এসে আম্মা, আতরজান, মেজ ভাই আর মায়ের পেটের অদেখা ভাইটিসহ তাদের সবাইকে এনে তুললো রেল লাইনের পাশে পিপলস জুট মিলের বস্তিতে। আব্বা আসলে আরো বছর খানেক আগে থেকেই জুট মিলে কাজ শুরু করেছিল। তারপর না আতরদের সবাইকে শহরে নিয়ে আসা। ফুলজানই সবার ছোট। অথচ তার মুখেই বোল ফুটলো না। দেশ স্বাধীনের আগে আগে যখন আতরজানের বয়স ষোলর মতো আর ফুলজান মোটে সাত, আতরজানের বিয়ে ঠিক হলো চুকনগরে। কিন্তু চুকনগরে যুদ্ধের বছরে দশ হাজার মানুষ মরলো এক দিনেই তাদের চোখের সামনে। আতরজানরা কিনা মুসলমান বলে বেঁচে গেছিল প্রাণে। পরে কোনমতে যুদ্ধ শেষ হতে না হতে আতরজানের স্বামী গোলাম রসুল কি মনে করে গ্রাম পাল্টালো। ভারি নরম স্বভাবের মানুষ ছিল গোলাম রসুল। ভদ্রা আজ চুকনগরের সামনে মরে গেলেও সেই একাত্তর সালে ছিল প্রমত্তা। সেই নদীতে মানুষের লাশে স্রোতের জল সামনে সরতে পারেনি একটা মাস। কাক, শকুন আর চিলে এসে ঠুকরে ঠুকরে খেয়েছে সেই যত লাশ। গোলাম রসুলেরই পরিচিত অনেকে মারা গেছিল চৈত্র মাসের সেই অলক্ষুণে দিনে। কাজেই যুদ্ধ শেষ না হতেই কি মনে করে গোলাম রসুল নতুন বউ নিয়ে, গ্রাম পাল্টে উঠে এলো আর এই ভদ্রা নদীর পশ্চিম কিনারে এই গাঁয়ে…এখন লোকে যে গ্রামকে ২২ নম্বর পোল্ডার বলে ডাকে। কুড়ি/ত্রিশ বছর ধরে এই নামই চলছে। যখন থেকে কিনা ওয়াপদার লোকেরা এসে ভদ্রা নদীর শ্রাবণ মাসের ভাঙন ঠেকাতে, বন্যা-বৃষ্টি ঠেকাতে পাথরের পর পাথর ফেলে এই বড় বাঁধটা দিলো আর গোটা গ্রামের মানুষ বাঁধের উপরেই উঠে এসে নতুন বসতি বাঁধলো, তখন থেকে এই গ্রামের নাম ২২ নম্বর পোল্ডার। সে নোনা পানির আবাদের আগের কথা। তখনো দশ গাঁয়ের মানুষকে চিংড়ি চাষের লোভ পেয়ে বসেনি। হেলে চাষা তার চাষের জমি আর বছরের ফল-ফসলটুকু নিয়েই সুখে থাকে। আতরজানের স্বামীর ছিল ক্ষেতি-গেরস্থির কাজ। তারা বংশানুক্রমিক চাষা। তিন ভাই মিলে বারো বিঘা জমির চাষ ছিল তার বর আর ভাশুর-দেবরদের। আব্বা তাই এখানেই বিয়ে দিলেন। যদিও আতর কিনা রেললাইনের পাশে বস্তিতে হোক আর এক রুমের কোয়ার্টারে হোক, শহরে থেকেই মানুষ। পড়েওছে পাঁচ-ছয় ক্লাস পর্যন্ত। মাথা খারাপ ছিল না পড়া-শোনায় একেবারে। তবু তখন কিনা লেবারের ঘরের মেয়ে, তাতে নিচে তিন/চারটা ভাই-বোন, মা-কে সাহায্য করতে পাঁচ-ছয় ক্লাসের পরই পড়া বন্ধ আর পাত্র খোঁজা! ষোলতেই মা-বাবা-তিন ভাই আর সবার ছোট বোন ফুলজানকে ছেড়ে এই ২২ নম্বর পোল্ডারে আসা।
‘দাদী- দাদী!’
মেজ ছেলের ঘরের নাতি এসে ডাকে।
‘ক রে দাদা- কী কবি?’
‘দাদী- তোমাকে সবিতি মিলি কানী কয় ক্যানো?’
মেজ ছেলের ঘরের বড় নাতি সোহেলের হাতে একটা চিপসের প্যাকেট। তিন ছেলে মিলে পোল্ডারের উপর একদম হাইওয়ের পাশে নতুন ঘর তুলেছে। বড় রাস্তা ধরে সমানে বাস-ট্রাক যায় তিন বেলা। এ কথায় একটু যেন থমকে যায় আতরজান। বয়স কত হলো তার আজ? সেই যে কিশোরী বয়সে আম্মা একবার খুলনা কালীবাড়ির কাছে হিন্দুদের দোকান থেকে দেখে দেখে, পরখ-বাছাই করে পেতলের কাজললতা কিনে এনে দিয়েছিল বড় মেয়েকে আর তখন বাংলা সিনেমার নায়িকারা সবাই চোখে কানী টেনে কাজল পরে…সুচন্দা বলো, শবনম বলো কি কবরী বলো…তাদের উঁচু উঁচু খোঁপার সাথে চোখে টানা কাজল দেখে আতরজানেরও মন চাইতো অমনটা সাজতে! বিয়ের পর নতুন বর তার চোখের কাজলেই মুগ্ধ হয়ে থেকেছে কত কত দিন যত দিন না আর একটির পর এক নতুন শিশু এসে ভরিয়ে তুলেছে তার কোল। আর নববধূর ব্রীড়া ছেড়ে ক্রমেই মা আর বাড়ির সর্বময় গৃহিনী ও কর্ত্রী হয়ে উঠেছে সে।
‘ও দাদী- তোমাকে সবিতি মিলি কানী কয় ক্যানো?‘
‘কে কানী কয় রে, দাদা?’ আতরজান তার একটি ক্ষত চক্ষুর কোণা থেকে চুঁয়ে পড়া জল ময়লাটে শাড়ির খুঁটে একটু মুছে নাতিকে স্নেহে হাতের বেড়ে কাছে টানে। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবার পথে। মাঘের শেষ দুপুরের রোদে টিন আর বেতের বেড়ার এই ঘরের সামনেই রাস্তার পাশে সামান্য উঠোনে আতরজানের তিন ছেলের বউই বোধ করি এখন ধান শুকোচ্ছে। সারা সকাল তারা ধান সেদ্ধ করে উঠোনে শুকোতে দিয়েছে। এখন শুকিয়ে আসা ধান নেড়ে-চেড়ে, ঘরে তোলার পালা। সন্ধ্যা হবার আগে আগে ঢেঁকিতে ধান কুটে তা’ দিয়ে পিঠে ভাজা হবে। এমনিতে আতরজান আজ বিধবা বলে বা এক চোখ হারিয়ে সে ‘কানী’ হয়ে গেছে বলে ছেলের বউরা খুব যে তাকে অসম্মান বা হেনস্থা করে পদে পদে তা’ নয়। তিন ছেলেই তার আজো মাতৃভক্ত। কিন্ত সেই কত বছর আগে শান্তিময়ীর পিছু পিছু নোনা পানির চিংড়ি চাষের বদলে ধান্য জমি ফেরতের মিছিলে গিয়ে শান্তিময়ী গুলি খেয়ে মরলো আর আতরজানের একটি চোখ গেল, তারপর থেকে আতরজান টের পায় যে তল্লাটে কারো বিয়ে, আকিকা কি মুসলমানী, অন্নপ্রাশন বা পৈতে পরা, ঈদে-পূজায় সে কোথাও গেলেই মানুষ যেন কেমন তাকে ‘অশুভ’ বা ‘অশৈল’ ধরে নেয়! তারা মুখে সরাসরি কিছু না বললেও আতরজান কি বোঝে না? অথচ এই আতরজানের চোখে পেতলের কাজললতায় পাড়ানো কাজল দেখেই সপ্তম শ্রেণির আতরজানকে প্রথম প্রেমপত্র লিখেছিল খালিশপুর লেবার কোয়ার্টারের দুই তলা উপরে হান্নান চাচার নবম শ্রেণি পড়া ছেলে। সেই চিঠি আম্মার হাতে পড়ার পরই আতরজানের স্কুল যাওয়া বন্ধ। নাহলে আরো কিছু দিন পড়া হতো হয়তো। সেসব কত আগের কথা! সেই ছেলে নাকি পরে ঢাকায় গিয়ে আরো পড়েছে, কোট-প্যান্ট পরা সাহেব হয়েছে। নাহ্, সেসব ভাবাও অন্যায়। পর পুরুষের কথা ভাবাও অন্যায়।
‘দাদী- কলা না সবেতে মিলি তোমাকে কানী কয় ক্যান?’ মেজ ছেলের ঘরের বড় নাতি তিনবারের মত প্রশ্ন করে।
‘কবো রে, দাদা!’ বলেই একটি উদাস শ্বাস ছেড়ে নাতিকে আবার হাতের বেড়ে কাছে টেনে চুপ করে যায় আতরজান।
এখন যখন শীতের বেলা প্রায় পড়ে এসেছে আর আতরজানের বেটার বউরা হাইওয়ের ঠিক নিচেই আতরজানদের টিনের ছোট্ট, এক রত্তি ঘরের সাথে লাগোয়া উঠানে সেদ্ধ ধান শুকিয়ে উঠে, রান্নাঘরে নৈশ আহারের আয়োজন করছে, তখন আতরজান ঘর থেকে বের হয়ে এসে উঠান লাগোয়া হাইওয়ের সামনে দাঁড়ায়। হুশ করে কত দূর থেকে এসে ছুটে যায় দূরপাল্লার বাস বা ট্রাক। ভ্যানে চড়ে কত মানুষ যায় আসে! আশপাশে বেদেদের তাঁবুও আছে কয়েকটা।
২.
‘স্নেহের আতরজান,
পরম করুণাময় আল্লাহ তা‘য়ালা ও তোমার আম্মা-আব্বার কাছ হইতে অনেক ভালবাসা জানিবে। আশা করি, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্বামী ও দুই শিশু পুত্র লইয়া ভাল আছো।
প্রথম কন্যা বা সন্তান হিসাবে তোমার সাথে একটি বিষয় আলোচনা করা দরকার। তোমার ছোট বোন ফুলজান সোমত্থ হইয়া উঠিতেছে। তাহার বয়স এই কার্তিকে তেরো হইবে। গত মাসে তাহার হায়েস (মাসিক) হইয়াছে। তবে তুমি জানো যে খোদার কি মর্জি কে জানে, সে কথা কহিতে পারে না! খোদা যদি তাহাকে এত রূপ দিবেন, তবে তাহার মুখে বোল দিলেন না কেন? ইহাকে কে বিবাহ করিবে? আবার বোল না থাকিলেও এত রূপ, তাহাতে মাথায় বিশেষ বুদ্ধি নাই…তোমার আব্বা ও ভাইরা কাজে যায়, আমি ঘর-সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকি…সে কলোনির ভেতর বাহির হয়। কবে কি অঘটন ঘটে! কিন্তু এই বোবা কন্যাকে কে বিবাহ করিবে? পারিলে দু/এক দিনের জন্য স্বামী-পুত্রসহ আমাদের বাড়ি একটু ঘুরিয়া যাও আর একটু বুদ্ধি দাও।’
আম্মা নিজে তো আর অত লিখতে পারতেন না। আব্বাই বা কয় ক্লাস পড়েছে? হাতের লেখা দেখেই চিনেছিল। পাড়ার নাম করা চিঠি লিখিয়ে জয়নবের হাতের লেখা। দশ ক্লাস পড়ে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মী হবার আগ পর্যন্ত পিপলস জুট মিলের লেবার কোয়ার্টার থেকে রেল লাইনের সামনের বস্তি অবধি সমবয়সী মেয়েদের প্রেমপত্র থেকে চাচী-খালা-ফুপু-নানী-দাদীদের নানা পারিবারিক সমস্যার চিঠি জয়নবই লিখতো। অগত্যা দেশ স্বাধীনের কয়েক বছরের মাথায় বরকে নিয়ে কিন্তু ছোট তিন ছেলেকেই শাশুড়ির কাছে রেখে আতরজান গেছিল খালিশপুর। গিয়ে চমকাতেই হয়! মাত্র বছর দেড়েক বাপের বাড়ি নানা ঝামেলায় আসা হয়নি আর এর ভেতর ফুলজান মাথায় কত লম্বা হয়েছে। তাতে গরীবের ঘরে এমন টসটসে ডালিমদানার মত রঙ! মাথা ভর্তি কোঁকড়া চুল। অথচ বোবা মেয়ে। আম্মা কাঁদে, বকাবকি করে।
‘কি করি? এই মিয়্যেকে না স্কুলে দিতি পারি, না বিয়ি দিতি পারছি!’
‘আজকাল ত’ ফ্যাক্টরিতে মেয়েরাও কাজে ঢুকতিচে। আব্বা এত বছর কাজ করতিচেন ফ্যাক্টরিতে- ফুলজানকে কাজে দিয়ি দেন, ‘বলেছিল আতরজানের বরাবরের ঠান্ডা মাথার স্বামী, ‘আব্বার সাতেই কাজে যাবি। আব্বার চোখের সামনি থাকবি। মাস শেষে ওর হাত খরচের টাকা হলিও হাতে আসবি। ওকে পাহারা দেবারও টেনশন নাই। আর কপাল থাকলে কখুনো যদি বিয়ি হয়, কেউ যদি সব জানিই ওকে ঘরে নেয়…।’
সেটাই হলো। আব্বা পিপলসে প্রায় কুড়ি বছর কাজ করছে। সেই সুবাদে তেরো বছরের ফুলজানের প্রিপেয়ারিং সেকশনে কাজ হলো। তখনো এখন কথায় কথায় বয়স আঠারো না হলে লেবার হওয়া যাবে না এসব ছিল না। তাতে ফুলজান বয়সের তুলনায় মাথায় লম্বা আর স্বাস্থ্যবতী। তাকে অনায়াসে চোদ্দ বছর দেখিয়ে প্রিপেয়ারিং সেকশনে রাজযোগালীর কাজে নেয়া গেল। তারপর এত এত বছর খোদ আপন গর্ভধারিণী মায়ের কথায় কথায় ‘বোবা মেইয়ে- অলক্ষী মেইয়ে- হাতি পালা পালতিচি মেইয়ে’ কারখানায় যোগ দিয়ে কী যে যাদু লাগলো যেন তার কাজের সুনামে সবাই অস্থির। একটা সকাল এক মিনিট দেরি নেই। কাজ করতে পারে যেন অসুরের জোরে। দেখতে দেখতে বয়স উনিশ-কুড়ি হতে না হতে দুই নম্বর ফিটারে ব্রেকার ফিটারের কাজ মিললো তার। সারা মিলে সে একমাত্র মেয়ে মানুষ যে এমন কঠিন কাজ পেয়েছে। প্রায় পুরুষ মানুষের সমান আয়। আর তখনি পাশের সেকশনের আলমগীর যে গত প্রায় ছ/সাত বছর টানা ফুলজানকে দূর থেকে দেখেই এসেছে আর দেখেই এসেছে, এক বিকেলে ফুলজানের দুই বড় ভাইকে লাল হয়ে জানালো তাদের বোবা বোনকে বিয়ের বাসনা।
‘সব চিন্তা-ভাবনা করি বলচো তো? বোবা-কালা বুন আমাদের!’
‘ঘটনা না। ও কত সুন্দর আর কাজে-কর্মে কত লক্ষী!’
শুরুতে ফুলজানের হবু শ্বশুর-শাশুড়ি মানতে চায় না। পরে আলমগীর যখন দু’রাত ভাত না খেয়ে থাকলো, বাসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলো, তখন তার বাড়ির সবাই মেনে নিলো। বিয়ের সাজে কি সুন্দরই না দেখিয়েছিল আতরজানের ছোট বোনটাকে। বোবা মেয়েটি প্রকৃতির নিয়ম মেনে তিন/তিন বার সন্তানের মা-ও হলো। আহা, তিনবারই প্রসবের সময় বোবা মেয়েটার কি কষ্ট! কথা বলা মেয়ে হলে ও সময়টা তবু ‘আম্মা গো- আল্লা গো’ বলে কষ্ট একটু হালকা লাগে। ফুলজান শুধু গর্ভবতী গরুর মত ধড়ফর করলো। সেই মেয়ের কোলের দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে বড় মেয়েটা মাস ছয়েক হয় তালাক পেয়ে, দুই নাতি নিয়ে আবার ফুলজানের ঘাড়েই নাকি এসে চেপে বসেছে। ছোট মেয়েটার বিয়েতে এখনো পর্যন্ত অবশ্য কোন সমস্যা নেই। আর তিন ছেলে-মেয়ের ভেতর সবার ছোট ছেলেটাও মা’র ফ্যাক্টরিতেই একটি অস্থায়ী কাজ নাকি পেয়েছে। অনেক দিন দ্যাখে না ছোট বোনটাকে! একবার দেখতে যেতে হয়!
ধানের থোড়ে দুধ আসা মানেই মা লক্ষীর পায়ের ছাপ ধান ক্ষেতে পড়েছে। হোক আতরজানরা আজ তিন পুরুষ কলেমা পড়ে মুসলমান, তবু প্রতি ছড়া ধানে যে মা লক্ষী থাকে, তা’ কি সে কারো চেয়ে কম জানে? শান্তিময়ীদের বাড়িতে প্রতি বছর কোজাগরী লক্ষী পূজায় কি যায়নি আতরজান? ঐ তো শান্তিময়ী উঠোনে ঝাড়– দিয়ে, গোবর দিয়ে লেপা-পোছা করে, চালের পিঁটুলী গোলায় মা লক্ষীর পায়ের ছাপ এঁকেছে।
৩.
এখন যখন শীতের বেলা প্রায় পড়ে এসেছে আর আতরজানের বেটার বউরা হাইওয়ের ঠিক নিচেই আতরজানদের টিনের ছোট্ট, এক রত্তি ঘরের সাথে লাগোয়া উঠানে সেদ্ধ ধান শুকিয়ে উঠে, রান্নাঘরে নৈশ আহারের আয়োজন করছে, তখন আতরজান ঘর থেকে বের হয়ে এসে উঠান লাগোয়া হাইওয়ের সামনে দাঁড়ায়। হুশ করে কত দূর থেকে এসে ছুটে যায় দূরপাল্লার বাস বা ট্রাক। ভ্যানে চড়ে কত মানুষ যায় আসে! আশপাশে বেদেদের তাঁবুও আছে কয়েকটা। সেই পদ্মার পাড়ে বিক্রমপুর থেকেও ওরা আসে শীতের মৌসুমে এই এত দূরে। এই ত’ গত শনিবার তিন/চারটা সাপুড়ে মেয়ে এসেছিল আতরজানদের বাড়ির উঠোনে। গলায় হরেক পুঁতির মালা আর কেমন বিচিত্র ঢঙে শাড়ি পরা মেয়েগুলো গাছের শেকড় বিক্রি করছিল। বলছিল যে ওদের ঝাঁপিতে নাকি প্লাস্টিক আর জ্যান্ত—দু‘রকমই সাপ আছে। আল্লাহর দুনিয়া সত্যিই ভারি অবাক করা। কত রকম মানুষ আর তাদের কত রকম নক্সাদারী! এই ত’ সেদিন আতরজান- ষোল বছরের মেয়েটি- না, ষোল পার হয়ে সতেরোতে পা দেবে…শান্তিময়ী আর তার তার স্বামী হরেন গোলদারদের সাথেই কিনা চুকনগর থেকে নৌকায় করে তারা এসেছিল এই ভদ্রার একদম পশ্চিম কোণে- এখন যে গ্রামের নাম ২২ নং পোল্ডার।
‘শান্তিরা না হয় হিন্দু। অগো অনেক মানুষ মারি ফেলচে যুদ্দের ভিতর- আমরা কেন পালাতিচি?’
অবাক হয়ে বলেছিল আতরজান।
‘ভালো লাগে নারে, বউ! যুদ্দির ভিতর কত লাশ যে আমিই নিজিই উজানে কি ভাটায় ঐ বাজারের পাশে মন্দিরের লাগোয়া নদীতে যখনি পাড়ের কাছে ভাসি আসিছে…আমরা কিছু জোয়ান মিলি ফির সেই লাশের পায়ে দড়ি বেঁধে ফিরতি স্রোতে ঠেলি দিইচি। নদীর মাছ খাতি ভয় করে বউ। সেদিন হাটবারের দিন ছেলো না? আমি নিজিই তো ছিলাম হাটের ভিতর। নৌকায় করি আশপাশের দশ গ্রাম থেকে হিন্দুরা আসতিচে। সব বর্ডার ক্রস করবে খানেদের আর বিহারীদের ভয়ে। অনেকে নৌকা থামায়ি বাজারে নামলো চিড়া-মুড়ি কিনবি বলি। এই সময় না শুরু অলো গুলি। আমার চোখের সামনে কত জন মন্দিরির ভিতর পলায়ি বট গাছের শিকড়ের কাছে কি কেউ গাছের ডালে উঠি বসলো। সেই গাছের ডালেও গুলি করি পাঞ্জাবি মেলেটারি মানুষ মারলো। এই গেরামটা আমার কেমন খাঁ খাঁ লাগি আজকাল। আশিভাগ মানুষই তো ছিল হিন্দু। ছোটকালের থেকে বন্ধু চেলো কত! সবই মরিচে। সন্ধ্যার পর একা বাইরে হাঁটতি ভয় লাগে। মরি গিয়ি কে ভুত হয়িচে আর কে জ্বিন হয়িচে-।’
‘সে কতা ঠিকই। শান্তিময়ী আর তার জামাই এ গিরাম ছাড়তি চায় ক্যানো?’
‘হরেণ গোলদার যাতি চায়…বলে যে এই গিরামে তারই আপন তিন ভাই তার সামনি খুন হয়িচে…যখন তারা নৌকা করি পালাতি নিয়িছিলো…নেহাত সে আর শান্তিময়ী বুদ্ধি করি নৌকা থিকি নদীতে ঝাঁপ দিয়ি পানির ভিতর ডুবি ছিল অনেকক্ষণ- এখন এই গিরামে তার দম আটকি আসতি চায়।’
‘আপনার মনটা ভারি নরম। তা’ ঠিকই। আমারও কেমন তরাস লাগে, আতঙ্ক লাগে সবটা সময়। বুকির ভিতর ধড়ফর ধড়ফর করে। যে গিরামে যাব, সিখানে খুন-খারাপি হয়নি?’
‘সেখানে এখনো এত মনুষ্যি বসতি নেই। তাই আমরা কয়েক ঘর মানুষ সিখানে যাব। সরকার থেকে কয়েক বিঘা খাস জমিও পাওয়া যাতি পারে। এ গাঁয়ে জমি চষতি গেলে লাঙ্গলে কঙ্কাল ওঠে- মানুষির মাথার খুলি, হাড়। ভাল লাগে নারে, বউ। এছাড়া বাপের সামান্য কয় বিঘা জমি নিয়ি আমাদের চার ভায়ির ভিতর সারাক্ষণ ঝগড়া!’
‘ঠিকই কয়িচো, চলো তৈলে।’
এভাবেই যুদ্ধ যদি শেষ হয়েছিল পৌষ মাসে, মাঘেই তারা কয়েক ঘর নর-নারী অনেকটা আশা নিয়ে ভদ্রার পশ্চিমে এই জলা-জঙ্গলে চলে এসেছিল; সরকার থেকে নদীর শিকস্তির পর জেগে ওঠা চরের কিছু জমি খাস জমি দেওয়া হবে এই আশায়। সেই সাথে মৃত্যুকূপের মতো গ্রামটিও তারা পরিত্যাগ করে এসেছিল। এখানে আলাদাভাবে নিকিরি পাড়া, তাঁতী পাড়া, মুসলমান পাড়া এসব ছিল না। মাত্র কয়েক ঘর নর-নারী। পাশাপাশি সবার ঘর ওঠানো হলো দ্রুতই। তারপর দশ কি কুড়ি বছরে সেই গ্রামের পাশের সব বন-জঙ্গল সাফ হয়ে ক্ষেতি, আবাদী জমি হলো। আর নারীকে নাকি স্বয়ং আল্লাহই পুরুষের ক্ষেতি-জমি করে পাঠিয়েছেন বলে খোদ ইমাম সাহেবই শুক্রবারের মসজিদে মাইকে বলেন যা আতরজান এই বুড়ো বয়সেই ঘরে বসেও শুনতে পায়। কথা সত্যি। মাত্র কয়েক ঘর মহিলা-পুরুষ তারা এসেছিল যুদ্ধের পর মাঘ মাসে। আজ কত মানুষ! সেই নৌকা করে প্রথম শ্বশুরবাড়ির ভিটা ছাড়ার সময় থেকে যেদিন শেষ মিছিলে গুলি খেয়ে মারা যায় শান্তিময়ী আর আতরজানের ডান চোখটা গুলিতে যায়, গোটাজীবন তারা ছিল সই। কত কত দিন এ ওকে চুলে নারকোলের তেল মেখে দিয়েছে- শীতের দিনে শিশির ভেতর জমে থাকা নারকোলের তেল রোদে দিয়ে তেল যখন গলে ওঠে- সেই তেল এ ওর মাথায় মাখানো- এই গ্রামে প্রথম আসার পর একজনের ঘরে নুন-তরকারী-বেনুনের একটি পদ ফুরিয়ে গেলে ওর ঘর থেকে ধারে আনা- কত কী স্মৃতি!
অনেক বছর ভালোই কাটছিলো। আতরজানের তিন ছেলে আর দুই মেয়ে এই গ্রামেই তো সব জন্ম নিলো। সবার শেষে ছোট মেয়েটা যে বছর হলো- যুদ্ধের তেরো/চোদ্দ বছরের মাথায়- সে বছর থেকেই এই গাঁয়ে কি আশপাশের গাঁয়ে- বলতে গেলে গোটা তল্লাট জুড়ে শুরু হলো নোনাপানির চাষ। কেউ কেউ বলে ‘সাদা সোনা।’ চিংড়ি। একে কিনা খুলনা হলো সুন্দরবনের কাছ ঘেঁষে থাকা জায়গা, তাতে সমুদ্র আছে চারপাশে…এখানের জমি কি পানি মিঠাপানির দেশের চেয়ে খানিকটা নোনা এমনিতেই বেশি। আর সেই সবার ছোট মেয়েটাকে যে ভোর রাতে আঁতুড় ঘরের চালা থেকে দেখা যায় এমন শুকতারার আলোয় দু‘পায়ের ফাঁকে পুনর্বার পৃথিবীতে আনলো আতরজান…যথারীতি রক্তাক্ত, ক্লান্ত শরীরে হাঁপাতে হাঁপাতে…সেই সবার ছোট মেয়েটি হবার সময় থেকেই দেখা গেল চারপাশের গ্রামগুলোয় সাতক্ষীরা-বাগেরহাট-খুলনা-ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে আসছে সব সাহেব-সুবো, সাফ-সুতরো লোক। হেলে চাষীদের নগদে ক’টা কাগজের টাকা ধরিয়ে দিয়ে কি না দিয়ে গ্রামকে গ্রাম চিংড়ির খামারে গলদা আর বাগদার চাষ। এই চিংড়ি পরে সব বরফ দিয়ে কার্টনে বোঝাই করে চলে যায় ঢাকা আর চট্টগ্রাম। জাহাজে আর উড়োজাহাজে করে যায় সাহেব-মেমদের দেশে। আর চিংড়িঘেরের মালিকেরা হয়ে ওঠে এ্যাতো এ্যাতো টাকার মালিক। আর চিংড়ি ঘেরে যারা কাজ করে? যে মেয়ে-বউরা সকাল থেকে সন্ধ্যা নোনা পানিতে দাঁড়িয়ে চিংড়ি ধরে বা চিংড়ি বাছে, তারা কয় পয়সা পায়? হাত ভরে যায় দাদ-চুলকুনিতে। শুধু কি নোনা পানি? বাতাসও যেন নোনা হয়ে যেতে চায়। বাতাসেও নোনা ঘ্রাণ।
‘জীবনটা দোজখ হয়ি গেল, বউ!’
‘ক্যানো গো?’
‘ক্ষেতি এখন ধান হয় না, শাক-সব্জি কিছু হয় না। সব জমি নোনা হয়ি গেছে। যেখানে যাবি, শুধু বালু। পানি মুখিত দেওয়া যায় না। পুকুরিত মাছ নাই। হাঁস-মুরগী তাও সব মরি যাতি নাগিচে।’
‘আমাদের জমি কি ঘেরে দিলি ভাল হতো?’
‘কতটুক জমিই বা আচে আমাদের? ও জমি ঘের মালিকরা নিয়ি আমাদের ঠিকঠাক দামটাও দিত না। এই জমি ফসলের জমিই রাখপ।’
‘কিন্তু ঘের মালিকরা তো আরো জমি চাচ্ছে। সবাইকে মাইকিং করি বলতিছে জমি ভালয় ভালয় ছেড়ে দিয়ি টাকা বুঝি নিতি।’
‘ইসশ- ওসব কতা বলে। আসলে দেবে না। মদ্যিখান থিকি শুদু শুদু আমদের চাষের জমি ছিনিয়ি নেবে। তা’ এত সোজা নাকি? আমরাও পাল্টা মার দিতি জানি না নাকি?’
‘পাল্টা মার? ওদের সাথে?’
‘দেওয়া যাবে। শুদু একটু সাহস রাখতি হবে।’
‘কিন্ত তাগের বন্দুক আছে, হোন্ডা আছে, গুণ্ডা-মস্তান আছে।’
‘অত ভয় করিস নাতো!’
সেজ ছেলের বউ কখন আতরজানের পেছন এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।
‘আম্মা- সন্ধ্যা হয়ি গেছে। মাগরিবের নামাজ পড়লেন না। কতক্ষণ রাস্তার পাশে দাঁড়োয়ি থাকবেন?’
‘মাগরিবের আজান কি হয়ি গেচে?’
‘কখন?’
ওহো- দেখেছো? নামাজ পড়া দূরে থাক। আজ এই সন্ধ্যায় আতরজান কখন আজান হয়েছে টেরও পায় নি। সে হাইওয়ের ঠিক নিচে তাদের এই এক চিলতে জমির ঘর থেকে বের হয়ে আরো ছোট উঠোনে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে এক মনে কত কি ভাবছিল। আকাশে বেশুমার তারা উঠেছে। সেইসব তারায় কি ওরা আছে? নামগুলো আজ এত দিন পরও ঠিক মুখস্থ আছে। ডহুরি ভাইনার গোবিন্দ দত্ত, কোরের দনের জাবের শেখ, মঠবাটির মাওলা বক্স, বাবুরাবাদের জাহেদা বেগম, খোরিয়ার কিনু গাজি আর…আর…আতরজানের কত দিনের চেনা শান্তিময়ী! ওরা সবাই কি মিঠা পানির জন্য জান লড়িয়ে মরে গিয়ে আসমানের তারা হয়েছে? য্যানো আবার ক্ষেতে ধানের থোড়ে দুধ আসে? ধানের থোড়ে দুধ আসা মানেই মা লক্ষীর পায়ের ছাপ ধানক্ষেতে পড়েছে। হোক আতরজানরা আজ তিনপুরুষ কলেমা পড়ে মুসলমান, তবু প্রতি ছড়া ধানে যে মা লক্ষী থাকে, তা’ কি সে কারো চেয়ে কম জানে? শান্তিময়ীদের বাড়িতে প্রতি বছর কোজাগরী লক্ষী পূজায় কি যায় নি আতরজান? ঐ তো শান্তিময়ী উঠোনে ঝাড় দিয়ে, গোবর দিয়ে লেপা-পোঁছা করে, চালের পিঁটুলী গোলায় মা লক্ষীর পায়ের ছাপ এঁকেছে। এঁকেছে ধানের ছড়া, পেঁচা আর পদ্মফুলের ছবি। সেই আল্পনার উপর একটি ছোট টুলের উপর কাপড় বিছিয়ে মা লক্ষীর ছবি, তার সামনে দূর্বাঘাস আর ফুল, বেলপাতা দিয়ে সাজানো। কাঁসার ঘটে আমের পল্লব। ফল কেটে, লুচি আর তালের বড়া, দুধের পায়েস সব সাজানো মা লক্ষীর আসনের সামনে। খানিকটা দূরেই বেঞ্চির উপর বসতো আতরজান। দুলে দুলে পাঁচালী পড়তো শান্তিময়ী আর মনে মনে সেই প্রার্থনাগুলো আতরজানও মনে মনে বলতো। মা লক্ষী মানে টাকা-পয়সা যেন চঞ্চলা না হয়, ক্ষেতে যেন ধান-পাট, শাক-সব্জি ঠিক থাকে, গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগী যেন ঠিক থাকে। স্বামী-সন্তান যেন ঠিক থাকে। পাঁচালী পড়া শুনতে শুনতে সেই প্রার্থনাগুলো নিজেও মনে মনে বলতে বলতে চোখে পানি চলে আসতো। তারপর শান্তিময়ী উলু ধ্বনি দিয়ে সব শেষ। তখন শান্তিময়ীর ছোট মেয়ে এসে থালায় প্রসাদ সাজিয়ে সবার সামনে এসে হাতে হাতে করে, ছোট ছোট বাটিতে প্রসাদ তুলে দিত। সেই শান্তিময়ী আজ কোথায়? তার ছোট মেয়েটাও বিয়ে হয়ে গেছে দূরের গ্রামে। কত দিন চেনা-পরিচিত কতজনকে দেখতে পায় না আতরজান!
ঝুপড়ি বস্তি হলেও রেল লাইনের পাশের এই বস্তিতে অনেক ছাঁটাই হয়ে যাওয়া লেবার পরিবারই কবুতর পালে। সারাটা সময়ই কবুতরের বাক বাকুম শুনতে পাওয়া যায়। ছাঁটাই হয়ে যাওয়া লেবারদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হবার পর, জলকামানের তোড়ে ভেজা শার্ট আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া চোখে নিয়ে ঝুপড়ি বস্তিতে এক হাজার টাকা ভাড়ার এক কামরার খোপে যখন ঢুকলো অলিয়ার…
৪.
রোজার মাস আসার আগে থেকেই গোটা খালিশপুরে ফিসফিস গুজব চলছিল যে ফ্যাক্টরি সব বন্ধ হয়ে যাবে। বছর বছর পাটকলের এত লোকসান আর সরকার গুনতে পারছে না। তাই নিয়ে ক্রিসেন্ট-প্লাটিনাম-পিপলস কি ইস্টার্নের বিশাল সব লাল গেটের ভেতর লেবারদের কত কত মিটিং আর মিছিল!
‘মালিকপক্ষ শুধু কয় যে আমরা, লেবাররা, ট্রেড ইউনিয়ন কইরা ইন্ডাস্ট্রি পথে বসাইছি। কথাটা ঠিক না। বিজেএমসি কেন পাট ফলনের মৌসুমে পাট কেনে না? তখন সস্তা দামে প্রাইভেট পাটব্যবসায়ীরা পাট কেনে। আর সরকারি মালিকানার ২২টা পাটকল পাট কেনে পাটের মৌসুম শেষ হবার পর অনেক চড়া দামে। ম্যানেজমেন্ট ক্যানো সব থার্ড ক্লাসের মেশিনারিজ কেনে? যন্ত্রের পার্টস সব থার্ড ক্লাস কোয়ালিটি হলে প্রডাকশন ক্যামনে ভাল হবে? অথচ ম্যানেজমেন্টের এক-এক জনের বেতন লাখ টাকার উপর!’
সেই পাকিস্তান আমলের শ্রমিক নেতা তোফাজ্জল চাচা বক্তৃতা করছে। উনি অবশ্য খুলনার মানুষ না। তবে এই জুটমিলের শুরু থেকেই এখানেই আছেন। ওনাদের দেশ এমনিতে বরিশাল। তোফাজ্জল চাচার বক্তৃতা শুনলেই গায়ের রক্ত গরম হয়ে যায়। অলিয়ার জোরে হাততালি দেয়। গত রাতে কর্তৃপক্ষ না বলে কয়ে ফ্যাক্টরি বন্ধ করেছে। প্রথম রোজার দিন অনেক লেবারই ভোর রাত পর্যন্ত নাইট শিফটে কাজ করে বাসায় গেছে সেহেরি খাবে বলে। মর্নিং শিফটের শ্রমিকেরা কারখানার সামনে এসে দ্যাখে তালা লাগানো আর লক-আউটের নোটিশ ঝুলছে। এদিকে অধিকাংশ লেবার লিডার এর ভেতরেই মালিকপক্ষের সাথে টাকা খেয়ে আপোষ করে ফেলেছে। ঐ এক বুড়ো তোফাজ্জল চাচাই এখনো মাঠ ছাড়েনি। মাথার ভেতর হাতুড়ির বাড়ি পড়ে অলিয়ারের। আব্বা মারা গেছে আজ পাঁচ বছর হলো। তার বোবা মা’র রিটায়ারমেন্টের বয়স হতে আরো এক বছর। আম্মার সুবাদে বা পিপলসে চাকরি করা মৃত আব্বার সুবাদেই হোক, অলিয়ারও পিপলসে একটি অস্থায়ী চাকরি মাত্রই পেয়েছিল। এর ভেতরেই কিনা লকডাউন! প্যান্টের পকেটে মোবাইলে বিপ বিপ আওয়াজ। বড় আপার ফোন। কারখানা লকআউট হতে না হতে একদিনের ভেতর তাদের ফ্যাক্টরি গেটের ভেতর এক রুমের হলেও পাকা দালানের ঘর ছেড়ে রেল লাইনের পাশের ঝুপড়িতে এসে উঠতে হয়েছে। ছোট বোনটার বিয়ে হয়ে সুখীই হয়েছে। অলিয়ার আর তার মা ফুলজানের এক রুমের ঘরেই চলে যেত। কিন্তু এরই ভেতর তালাক খেয়ে বড় আপা এসে জুটেছে সাথে ফুটফুটে দু’টো ভাগ্নে-ভাগ্নি নিয়ে।
‘আপা- এখন মিটিংয়ে আছি।’
‘শোন্, তোর ভাইগ্নার ডায়রিয়া হয়িচে। আসার সময় কয়েক প্যাকেট ওর স্যালাইন আনিস।’ কি ঝামেলা! না- মিটিংয়ের মাঠ ছেড়ে না হয় সামনেই নিরঞ্জন কাকার ডিসপেন্সারি থেকে স্যালাইন আনা যাক!
‘কাকা-কয় প্যাকেট স্যালাইন দিন তো?’
‘সে নয় দিলাম। তুমি এত ব্যস্ত হয়ে যাবে কই?’
‘তোফাজ্জল চাচার মিটিংয়ে, কাকা!’
‘তয় এক মিনিট থামো। আমিও যাব। শাটারটা ফেলি আগে।’
নিরঞ্জন কাকু বারো ক্লাস পাশ করে বহু বছর পিপলসে মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে শ্রমিকদের ফার্স্ট এইড দিতেন। মাত্রই হাই কোর্টে দশ বছর মামলা লড়ার পর তাঁর চাকরিটা আগামী মাস থেকে স্থায়ী হবার কথা ছিল। আর তখনি কিনা এলো ছাটাইয়ের খবর!
‘একটা সময় এই কারখানা কত গমগম করছে! তিনটা শিফটে মানে ২৪ ঘণ্টাই মিল চালু থাকছে। আর আজ কী অবস্থা!’
মাইক হাতে তোফাজ্জল চাচার কথা মুখেই থাকে। ছোট-খাটো তবে বেশ সুন্দরী এক মহিলা পুলিশ অফিসার যিনি নীল শাড়ির ইউনিফর্ম পরে রাস্তার ওধারে ডানে-বামে অসংখ্য পুুলিশ নিয়ে আর হাতে একটা হ্যান্ড মাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন- তিনি হাত তুলে তাঁর সাথের পুলিশদের কি একটা নির্দেশ করতেই হুট করে জলকামান ছোঁড়া শুরু হয়। পানির তোড়ে ছিটকে পড়ছে সবাই এদিক ওদিক। যেন তিন মাস আগের আম্পান ঝড় শুরু হয়েছে। জলকামানের পরই শুরু হলো টিয়ার গ্যাস। মহিলা লেবার সব এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। ভাগ্য ভালো তা-ও আজ আম্মা আসেনি। তার বোবা মা ফুলজান আজ ঘরেই আছে!
‘আপনি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যবাদী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন…’ নিয়ম মাফিক যা যা বলার বলা শেষ করে ওরা অলিয়ারের হাতে হাতকড়া পরায়।
৫.
ঝুপড়ি বস্তি হলেও রেল লাইনের পাশের এই বস্তিতে অনেক ছাটাই হয়ে যাওয়া লেবার পরিবারই কবুতর পালে। সারাটা সময়ই কবুতরের বাকবাকুম শুনতে পাওয়া যায়। ছাটাই হয়ে যাওয়া লেবারদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হবার পর, জলকামানের তোড়ে ভেজা শার্ট আর কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া চোখে নিয়ে ঝুপড়ি বস্তিতে এক হাজার টাকা ভাড়ার এক কামরার খোপে যখন ঢুকলো অলিয়ার, বড় আপা তখন কোলের ছেলেটাকে বাড়িতেই প্লাস্টিকের জগে চিনি আর পানি গুলিয়ে স্যালাইন বানিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। তাতে মাত্র একদিনের নোটিশে পাকা দালানের এক রুমের সংসার থেকে ঝুপড়ি বস্তিতে এসে ওঠায় ঘরের সব জিনিষ এখনো গোছানো হয়নি। ষাট ওয়াটের একটা বাল্ব ঝুলছে অবশ্য। কেরোসিনের একটি স্টোভ আর ইলেকট্রিকের একটি হিটার- দুটোই আছে। একটি কাঠের আলনায় কিছু কাপড়-চোপর আর একটি আলমিরায় সংসারের যাবতীয় জিনিষ।
‘দেরি হলো- আপা!’
‘ওর স্যালাইন ছিল দোকানে?’
‘হ্যাঁ- এই ধরো!’
বোবা ফুলজান লাউ কুটে আর রেল লাইন বাজার থেকেই কেনা কুড়ি টাকার কুচো চিংড়ি এক পাত্রে বসিয়ে মাত্রই রাতের রান্না চাপিয়েছিল। ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। এই হাসিটা দেখলেই অলিয়ারের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায়। না বলতে পারুক তার মা কথা, এমন হাসি ক’জনের মায়ের আছে?
‘টিউবওয়েলে হাত-মুখ ধুয়ি আয়! ভাত হয়ে যাবে এখনি,’ বড় আপা তাড়া দেয়। ছোট ভাইয়ের দিকে একটা শুকনো গামছা আর ৫৭০ সাবান এগিয়ে দেয়। ফুলজান ছেলের দিকে তাকিয়ে গোঁ গোঁ করে ছেলে ঘরে ফেরার নিশ্চয়তায় ও আনন্দে। মেলামাইনের গামলায় ভাতের হাঁড়ি থেকে সদ্য ফোটা, ধোঁয়া ওঠা সাদা ভাত বেড়ে দিতে থাকে সে। কবে যে তার হলদে, ফুলো ফুলো আর যুবতী হাতগুলো চল্লিশ বছরের কঠোর শ্রমে এমন দড়া পাকা প্রৌঢ়া হাত হয়ে গেলো, কবে তার ভরা শরীর শুকিয়ে শীর্ণ হয়ে এলো আর চুলে এলো গলিত সাদা রং কে জানে!
‘এটা কি ফুলজান বিবির ঘর?’
‘জ্বি-‘
মা’র হয়ে বড় আপা সাড়া নেয়।
‘দরজা খোলেন।’
‘আপনারা কারা?’
‘আমরা র্যাবের লোক!’
‘আল্লা গো-‘
‘দরজা খোলেন। আমাদের কাছে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।’
‘ও ভাইরে- তোরেই নিতি আসছে মনি হয়। এত কলাম মিটিংয়ে যাস না- মিটিংয়ে যাস না! এখন কি হবে?’
‘তুমি থামো তো আপা- দেখি কি হয়!’
অলিয়ার দরজা খোলে। এত নড়বড়ে ঘরের দরজা অবশ্য খোলার কি আর না খোলারই বা কী? না খুললে ওরা বরং এক লাথিতে বা এক ধাক্কাতেই খুলে ফেলতে পারত।
‘আপনি অলিয়ার হোসেন?’
‘জ্বি।’
‘আমাদের কাছে আপনার বিরুদ্ধে সার্চ ওয়ারেন্ট আছে।’
‘আমার অপরাধ?’
‘আপনি প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যবাদী কার্যক্রমে যুক্ত ছিলেন…’ নিয়ম মাফিক যা যা বলার বলা শেষ করে ওরা অলিয়ারের হাতে হাতকড়া পরায়। তারপর বস্তির সামনে রেল লাইনের উল্টো দিকে থাকা জিপে নিয়ে তোলে।
সেকথায় আতরজানও পথে নামলো। তবে আতর আর শান্তি দু’জনেই তখনো যুবতী। দু’জনেই তখনো নবোঢ়া। তখনো তারা মা হয়নি। তাদের পায়ে আলতা আর মাথায় লাল ফিতের বিনুনী। তাদের দু’জনেরই গায়ে ডুরে শাড়ি। শান্তির মাথা ভর্তি সিঁদুর। কিন্ত খানিকটা পথ না যেতেই বৃষ্টির মত গুলি ছুটি আসছে তাদের দিকে…
৬.
প্রচণ্ড জোরে ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। এই অসময়ে আবার ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো নাকি? দু’টো কাঁথা গায়ে চাপিয়ে তিন নাতি/নাতনীকে লেবুসুন্দরীর গল্প বলতে থাকে আতরজান।
‘এক দেশে ছিল একটি মেয়ে। তার গায়ে ছিল লেবুর গন্ধ আর তাই তাকে সবাই ডাকত লেবুসুন্দরী। লেবুসুন্দরীর তিন ভাই। বড় ভাই আর মেজ ভাই বিয়ে করলেও ছোট ভাই বিয়ে করেনি। সে লেবুসুন্দরীর চেয়ে মাত্র তিন বছরের বড়। একদিন এক ঘটক যখন লেবুসুন্দরীর জন্য বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে, তখন ছোট ভাই বললো যে সে নিজেই লেবুসুন্দরীকে বিয়ে করবে। একথা শুনে মা-বাবা, বড় আর মেজ ভাই ও তাদের বউরা যখন অবাক, লেবুসুন্দরী এক দৌড়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেল নদীতে আর নদীতে ডুবে মরতে চাইলো। তখন লেবুসুন্দরীর মা আর বাবা এসে ডাকলো তাকে। লেবুসুন্দরী উত্তরে বললো, ‘বাবা হয়ে হবে শ্বশুর/তা’ না সবে পরাণে/বাবা তুমি দূরে যাও/ আমি যেন মরে যাই।’ মা-কে বললো, ‘মা হয়ে হবে শাশুড়ি/তা’ না সবে পরাণে/মা তুমি দূরে যাও/আমি যেন মরে যাই।’ এরপর এলো বড় ভাই ডাকতে। তাকেও একই কথা, ‘ভাই হয়ে হবে ভাসুর/তা’ না সবে পরাণে/ভাই, তুমি দূরে যাও/আমি যেন মরে যাই।’ মেজ ভাই ডাকতে এলেও একই কথা বললো।’
‘তারপর দাদী?’
‘তারপর দিন গড়িয়ে রাত হলো। তখন লেবুসুন্দরী ভাবছে মা‘র তো বয়স হয়েছে আর দুই ভাইয়ের বউয়েরই সামনে বাচ্চা হবে। ঘরের সব কাজ তো লেবুসুন্দরীই করতো। এখন কে করবে? এই কথা ভেবে অনেক রাতে লেবুসুন্দরী নদীর ডুব থেকে উঠে ভেজা কাপড়েই চুপি চুপি তাদের বাসায় এসে, নিজের ঘরে ঢুকে প্রথমে একটি শুকনো শাড়ি পরে নিল। তারপর রান্নাঘরে ঢুকে পরের দিনের সব রান্না করে, শেষ রাতের আলোয় উঠান লেপা-পোছা করে উঠতে উঠতে ভোরের আলো ফুটি ফুটি করছে যখন, ঠিক তখন লেবুসুন্দরীকে বিয়ে করতে চাওয়া ভাইটি তার সামনে এসে দাঁড়ালো।’
‘তখন? তখন কী হলো, দাদী?’
‘তখন লেবুসুন্দরী পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে বিয়ে করতে চাওয়া আপন ভাই যেই না তার চুল ধরেছে, অমনি সে একটা পাখি হয়ে উড়ে গেল হাওয়ায় আর কোনদিনই সেই গ্রামে ফিরল না। তাকে আর কেউ কখনো দেখতে পায়নি। শুধু তার এক গোছা চুল রয়ে গেল সেই স্বামী হতে চাওয়া ভাইয়ের হাতে।’
গল্প শুনতে শুনতে নাতি-নাতনীরা কখন ঘুমিয়ে গেছে! আতরজানেরও চোখ ঘুমে ঢুলে আসে। মনে এসময় হেঁয়ালি জাগে। কত ছোটবেলা থেকে লেবুসুন্দরীর গল্প শুনেছে সে। এই গল্প নিয়ে তার মনে তেমন কোনো প্রশ্ন জাগত না ছোটবেলায়। কিন্তু আজকাল ভাবতে অবাক লাগে তার। আপন ভাই কেন বিয়ে করতে চেয়েছিল লেবুসুন্দরীকে? এর মানে কী? বেচারা মেয়েটা শেষে পাখি হয়ে উড়ে পালালো চিরদিনের মতো। কিন্তু ওকে কি থামানো যায় না? আতরজান তাই থামাতে চাইলো লেবুসুন্দরীকে। এই বুড়ি আতর না- সেই ষোড়শী আতর।
‘ও লেবুসুন্দরী- তুমি চলি যেও নাকোা! কই যাচ্ছ? শোন?’
তখন বাতাস ধ্বনিত হয় ভদ্রার পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ দিকে আর লেবুসুন্দরী আতরের দিকে মুখ ফেরালে আতর দ্যাখে যে সে আসলে লেবুসুন্দরী নয়। সে তো শান্তিময়ী। শান্তিময়ী তাকে ডাকছে।
‘ঘরে বসি থাকপি, আতর? আজ না আমাদের মিঠা পানির জন্যি, ধান আর মাছের জন্যি লড়াইয়ের দিন?’
সেকথায় আতরজানও পথে নামলো। তবে আতর আর শান্তি দু’জনেই তখনো যুবতী। দু’জনেই তখনো নবোঢ়া। তখনো তারা মা হয়নি। তাদের পায়ে আলতা আর মাথায় লাল ফিতের বিনুনী। তাদের দু’জনেরই গায়ে ডুরে শাড়ি। শান্তির মাথা ভর্তি সিঁদুর। কিন্ত খানিকটা পথ না যেতেই বৃষ্টির মতো গুলি ছুটি আসছে তাদের দিকে আর একটা গুলি একদম শান্তির দুই উঁচু, ভরাট বুকের মাঝে বিঁধে শান্তি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। ‘হায় ভগবান!’ বলে একটা শব্দ বের হয়ে এলো তার গলা থেকে। আর ঠিক তখনি আতরের সামনে একটা বোমা ফাটলো আর অমনি আতর গড়াতে গড়াতে পথের ধূলোয় লুটোপুটি খেতে লাগলো। কারা যেন তাকে নৌকায় তুলে নৃপেণ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে চললো। কিন্তু এ তো নৃপেন ডাক্তারের চেম্বারের রাস্তা না? এ তো খালিশপুরের সেই যত জুট মিল, জুট মিলের স্কুল আর ঐ যে বোবা ফুলজান হাসিমুখে এক পাল কবুতরের দিকে তাকিয়ে দুই হাতে তালি বাজাচ্ছে! সে কোথা থেকে কোথায় এলো?
‘আম্মা- ও আম্মা-‘
ভোর হয়েছে নাকি? সারা রাত লণ্ডভণ্ড ঝড়ের পর আকাশ ফেটে রোদ উঠেছে।
‘খবর জানেন?’
‘কী?’
‘ফুলজান খালার ছোট ছেলেরে কাল রাতির বেলা র্যাবে ধরি নিইছে! ওনার বড় মেয়ে মোবাইলে ফোন দিয়িচে আপনাকে। নেন, কতা বলেন।’
বড় ছেলের বউ তার বরের মোবাইলটা এগিয়ে দেয়। এই নম্বরেই আতরজানের কাছেও মাঝে মাঝে ফোন-টোন আসে।
‘বড় খালা?’ ওপাশে রাবেয়া কাঁদছে, ‘আমাদের অলিয়ারকে কাল র্যাবে ধরিচে। আর গত পরশুই ফ্যাক্টরি বন্ধ করিচে। আম্মা আর ভাইয়ের- দু‘জনার কারোরই চাকরি নেই। কোয়ার্টার থেকে দিনি দিনি বের করি দিয়িছে। তাতে আমি এসে জুটিচি ঘাড়ে। তুমি একবার এসো!’
থম মেরে যায় আতরজান। এই জন্যই কি রাতে এত উল্টো-পাল্টা দুঃস্বপ্ন দেখছিল আতরজান? ঠিক মনের ভেতর কু-ডাক দিচ্ছিল হয়তো। যাবে। অবশ্যই যাবে আতরজান। আজই আর এখনি রওনা হবে। খানিকটা পথ ভ্যানগাড়ি, খানিকটা পথ শেয়ারের সিএনজি, তারপর লোকাল বাস আবার রিক্সা করে পৌঁছে যাবে তার ছেলেবেলার খালিশপুরে। কতদিন পর দুই বোনের- তারা আতরজান ও ফুলজান- অথবা বোবা ও কানী- তাদের পরস্পর দেখা হবে, মিলন হবে! আপাতত, ওদের জন্য তিন/চার মাসের খোরাকি ধান গাঁটরিতে বাঁধা যাক। আতরজানের ছেলেরা বুঝদার। তারা কোন বাঁধা যে দেবে না, সেটা আতর জানে।
অদিতি ফাল্গুনী
কবি, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক। জন্মঃ ১৯৭৪ সালে, যশোরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনশাস্ত্রে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর। একাধিক সংবাদপত্রে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কিছু উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেছেন। বর্তমান কর্মক্ষেত্রঃ বিফরআরএল-সিএনআরএস। প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪৫।
‘প্রথম আলো বর্ষসেরা গ্রন্থ-২০১১’-সহ পেয়েছেন একাধিক সাহিত্য পুরস্কার।