বাংলা কবিতার ভাষা-কবির লড়াই ।। মোস্তফা হামেদী

কবিতা কি কেবল কবির গহন মনের আকুতি? দেশ-কাল ও শ্রেণি নিরপেক্ষ কোনো ক্রিয়াকাণ্ড? নাকি বিশেষ মুহূর্তে কবির যা ইচ্ছা তাই বলার বা লেখার অগাধ স্বাধীনতা? নাকি কোনো মুক্ত জমিন যেখানে কবি স্বয়ম্ভূ? হয়তো শৈশবে শোনা ছেলে-ভোলানো গল্পের মতো কবিতাকে আমরা ভেবে বসেছি রূপকথার কোনো রঙিন রাজ্য, যেখানে রাজকুমারীর ঘুম ভাঙে জাদুর কাঠির ছোঁয়ায়। সম্ভবত ভাষার বিশাল ডানার নিচে আমরা ওমপ্রিয় ছানা। আরামে বুঁদ হয়ে ঐ ডানাটির বায়ুমণ্ডলব্যাপী তড়পানো টের-ই পাই না। আজ আমরা জেনেছি মহাকাশেও ‘স্পেস’ কিনতে হয়। সুতরাং বলতে বাঁধে না বলেই আমার ভাষাটি সর্বত বিস্তৃত, বোকারাই কেবল ভাবতে পারে এইভাবে।

পৃথিবীর বয়স বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভাষা সংঘাত। ফলে কবির আপাত নিরীহ প্রকল্প স্রেফ গভীর এক লড়াই। নিজের ভাষার পক্ষ হয়ে তিনি শব্দাস্ত্র চালনা করেন ভাষাবিশ্বযুদ্ধের ময়দানে। কে না জানে ভাষার সাথে রাজ্যবিস্তারের বা সিংহাসনাধিকারীর দারুণ আত্মীয়তা। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদ শুধু রাজনীতির দুনিয়ার-ই নয়, ভাষিক পরিমণ্ডলেরও জরুরি প্রপঞ্চ। ক্ষমতা ও শক্তির হাত ধরাধরি করে এক ভাষা দখলে নেয় অপর ভাষার জগত। মানুষ তখন ঐ পরিস্থিতির দাসবৃত্তিই করে কেবল। একমাত্র প্রতিরোধ-ই সেখানে প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করতে পারে। অপরাপর সকল যুক্তি ও তর্ক সান্ত্বনা বা আপোষ বৈ অন্য কিছু নয়। আজ পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় পরাশক্তির আলখাল্লার নিচে আবির্ভূত হয়েছে ভাষা দানো। লায়েক লোকমাত্র জানে, এটা শিশুর মতো ভাষার সহজ মেশামেশি নয়। এর পিছনে ক্রিয়াশীল দুর্বল ও ছোটকে গিলে ফেলার আগ্রাসী রাজনীতি। কিন্তু কবেই বা এ থেকে মুক্ত ছিল পৃথিবী? এইসব কূট-ক্যাচালের মধ্যে কেমন আছে প্রাণের বাংলাভাষা?

বাংলাভাষা নিয়ে বাঙালির আদিখ্যেতার শেষ নেই—এভাবে টিপ্পনি কাটেন কেউ কেউ। কিন্তু আমি ভালোবাসি এই আদিখ্যেতা। এ কারণেই বোকাদের দলে ভিড়ে গ্রাম্য হওয়ার সাধনায় মশগুল। তোমরা হয়ে উঠছো বিশ্বজনীন। অথচ আজও চর্যাপদের ভুসুকুর মতো সাহস করে বলতে পারছি না- আজি হামেদী বাঙালি ভইলি। জন্মমাত্র-ই যদিও বাঙালি জাতিভুক্ত হলাম, কিন্তু রূপান্তরের খেলায় সত্তা বিকাতে যে দ্বিধা করিনি- তা নাকচ করি কী করে! তবে কি ভাষার রূপান্তর অবৈধ? ভাষা কি কোনো সতী-সাধ্বী, যাকে প্রতিনিয়ত অগ্নিপরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়ে সতীত্ব প্রমাণ করতে হয়?

ভাষা আসলে আলমারির তাকে শোভিত ও সুরক্ষিত খেলনা নয়, যখন খুশি খেলেটেলে তুলে রাখলাম। এ এক ঘন জংলার বায়ু—যেখানে আম পাতার হাওয়া গিয়ে লাগে জামপাতার গায়ে, আমলকির বায়ু দোলে আতামগডালে। দুরন্ত শিশুর মতো ভাষা পাড়ার অপরাপর শিশুর স্বভাবদোষে ও গুণে পরিপক্ক হয়ে ওঠে। আবার ভাষা জারজ নয়। মানুষের ঠোঁটে এর জন্মও লয়। ফলে মানুষ কথা কওয়া ছেড়ে দিলে কেবল কবি নয়, কবির বাপও ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না। এই কারণে ভরসা মানুষের গালি ও বুলি । কিন্তু মানুষ তো গাছ নয়, যে স্বভাব নিয়ে সে বেড়ে উঠবে-সে রূপেই মরে যাবে। মানুষ সঞ্চরণশীল প্রাণি। এখানেই সম্ভাবনা ও ভয়। মাথা গোনা দিলে বাঙালি আজ একাই আয়তনে তার চেয়ে বড় কয়েকটা দেশের লোকের সমান। রবীন্দ্রনাথ তার সময়ে গৌরব করে বলেছিলেন,
“বাঙালিভাষীর জনসংখ্যা ভারতবর্ষে অপরভাষীর তুলনায় অধিক। প্রায় পাঁচ কোটি লোক বাংলা বলে।” [ভাষা বিচ্ছেদ: শব্দতত্ত্ব]।
পাকিস্তানে ভাষার প্রশ্নে আমরা বলেছিলাম, ছাপ্পান্ন ভাগ লোকের ভাষা বাংলা। ফলে মাথা ও মুখ আমাদের বড় শক্তি। কিন্তু সে মানুষ-ই যদি বদলে যায়, কবির কাজ তখন কী দাঁড়ায়? কবি ঘরের কোণে গোপন খাতায় কেবল লিখে যাবেন তার রক্তক্ষরণগুলি? নাকি ভাষার চেহারাকে বদলে দিতে পারেন তিনি? কবির কাজটা আসলে কী? কবিতাপূর্বযুগে ভাষা টিকিয়ে রাখতো কারা, হয়তো সেখান থেকে কিঞ্চিত ইশারা পেতে পারি।

যখন কলম ও কাগজ ছিল না, এমনকি তালপাতা কিংবা মাটিতেও লেখার কৌশল জানতো না মানুষ, তখন ভাষা নিয়ে কী কারবার ছিল? ভাষাতাত্ত্বিকগণ বলেন, তখন ছিল স্মৃতি ও শ্রুতির যুগ। মানুষের মনে রাখার পরম্পরায় ভাষা টিকে থাকতো। ফলে বলে বলে শুনে শুনে মনে রেখে রেখে এগিয়েছে সে সময়কার ভাষাবিশ্ব। লেখন পদ্ধতি ও উপকরণ আবিষ্কারের পর থেকে কবিতা হয়ে উঠেছে ভাষার অমোঘ আশ্রয়। কিংবা ভাষা জন্ম দিয়েছে এমন এক সন্তান, যা তার রক্তকে বহন করে চলেছে। আদতে কবিতা ভাষার-ই দেহজাত এক কোমল সত্তা। সন্তান যেমন পিতামাতা তথা পূর্বপুরুষের বৈশিষ্ট্যকে জীনের মাধ্যমে ধারণ ও বহন করে, কবিতাও জনক-জনয়িতা ভাষার বৈশিষ্ট্যকে অতিক্রম করতে পারে না। কবি সেই ভাষাপিতার দাস যে হুকুম তালিম করে সমীহ ও দরদের দর্শনে। ফলে নিজ ভাষার জগতকে বোঝা ছাড়া কবির গত্যন্তর নেই। কবি নিদিষ্ট সময়ে এক ক্রমবিবর্তমান ভাষার জগতে বাস করেন। বুদ্ধিদীপ্তির গুণে তিনি কেবল ভাষার বিশেষ সংকেতকে বাছাই করেন। শ্রেণিকরণ করেন। তার যে কল্পনাপ্রতিভাকে আমরা অভিনন্দিত করি, ঐটা আদতে ভাষার-ই গোপন কোনো শক্তি, সময় ও সংস্কৃতির গেরোতে বাঁধা। এ কারণে দেখব ভাষাবিশ্ব বদলে গেলে কবিতাও বদলে যায়। আর ভাষাবিশ্ব বদলায় উৎপাদন কাঠামো ও শাসনক্ষমতার পালাবদল ঘটলে।

ফলে গ্রামকেন্দ্রিক কৃষিজীবী অস্ট্রিক ভাষাভাষীর জগত দখল হয়ে যায় দ্রাবিড়দের করস্পর্শে। জীবন-যাপনের সূত্র বদলে তারা যে নগরসভ্যতার প্রচলন করেন, তাতে ভুক্ত হয়ে গেলে বদলে যায় ভাষা। আবার আর্য আগমন, অপভ্রংশ, সাধারণের প্রাকৃত কথনের প্রভাবে ভাষা তার রূপ বদল করে। এক ভাষা-সংস্কৃতির সাথে আরেক ভাষা-সংস্কৃতির সংঘাতে নতুন রূপ পায় ভাষাকাঠামো। এইভাবে কালান্তরে পাই বাংলা ভাষার আদি নমুনা ‘চর্যাপদ’, যেটা ধরে আছে বহু অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় চিহ্ন। বৌদ্ধচিন্তার বিকাশের নানান মাত্রাকেও চর্যার পদগুলি ধারণ করেছে।

“উঞ্চা উঞ্চা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।
মোরঙ্গ পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত শবরো পাগল শবরো মা কর গুহাডা তোহৌরী।
নিঅ ঘরিণী ণামে সহজ সুন্দারী।।
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিগুই কণ্নরকুণ্ডলবজ্রধারী।।”

[পদকর্তা শবরপা: চর্যাপদ]

সময়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের বাইরে নয় এটা মোটে-ই। সময়ের রশিতে বাঁধা বলেই আজ আর কেও লিখছে না চর্যার মতন করে এইসব গুঢ় তত্ত্বকথা। কিংবা প্রথম শতাব্দী পরেই যখন বৌদ্ধদের হটিয়ে ব্রাহ্মণ্য প্রভাব বিস্তারিত হল, চর্যার ভাষা অকেজো হয়ে উঠলো সেই লোকমানসের অভিব্যক্তি প্রকাশে। শাসকের বিবিধ কাণ্ডের তালে বদলে গেল মানুষ ও তার ভাষাবিশ্ব। শূন্যপুরাণ আর চর্যার ভাষা সে কারণেই এক থাকল না। এর পরে মুসলমানরা এলো। সমাজদেহে আবার ভাঙাগড়া শুরু হলো। থিতু হতে হতে দেখা গেল বাংলাভাষায় ঠাঁই গেঁড়েছে প্রায় ২৫শ ফারসি ও ফারসি উচ্চারণে আরবি শব্দ। [সূত্র: বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত—ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ] এই ভাষা-ই জন্ম দিল ‘ইউসুফ জোলেখা’, ‘লায়লী মজনু’, ‘পদ্মাবতী’সহ বহু অমূল্য গ্রন্থ। গীত হতো বলে ঐ সকল পুস্তকে রাগের উল্লেখ আমরা পাব।

“কুচযুগ মনোরম                                         নবীন শ্রীফল সম
                          কিবা নব নারাঙ্গ যুগল।।
মধ্যদেশ ক্ষীণ অতি                                       জিনিয়া মৃগের পতি
                         কনক কিঙ্গিণী শোভাকর
নাভি পদ্ম বিকশিত                                       অতিশয় উজ্জ্বলিত
                          লোমলতা অধিক সুন্দর।।”

[লায়লীর রূপ (রাগ: সুহি): লায়লী মজনু—দৌলত উজির বাহ্রাম খাঁ]

আবার কৃষিনির্ভর সমাজে পাব তাদের জীবন-কল্পনাভাষা ও বিশ্বাসাশ্রয়ী গীতিকা। গ্রামীণ চল অনুযায়ী এগুলো পালাকারে গীত হতো। হয়তো অক্ষরবিদ্যাচর্চা না থাকার দরুণ মানুষের স্মৃতি ও শ্রুতি কৌশলে এইসব কবিতা প্রজন্মান্তরে বাহিত হতো। উৎপাদন কাঠামো, জীবনের চালচিত্র-ই এর সুর-স্বর তথা ভাষাকাঠামো ও শিল্পকৌশল নির্ধারণ করে দিয়েছিল।

“ভিনদেশী পুরুষে দেখি চান্দের মতন।
লাজ-রক্ত হইল কন্যার পর্থম যইবন।।
পঞ্চ ভাইয়ের বউয়ে ডাইক্যা কয় ‘ননদিনী।
সইন্ধ্যাকালে জলের ঘাটে একলা কেন তুমি।।”

[সুন্দরী মলুয়া: চন্দ্রাবতী দেবী]

নাথ সাহিত্য ও মঙ্গলকাব্যও সমকালের রীতি দ্বারা প্রভাবিত। বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের সাথে শৈব ধর্মের সংযোগে যে নানা কাহিনী লোকমুখে তৈরি হয়েছে, তারই আখ্যান নাথ সাহিত্য। ফলে বয়ানকৌশলের সাহিত্যগুণ এবং সমাজ-সময় ও ধর্ম এতে মিলেমিশে রয়ে গেছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী ধ্যান-ধারণার প্রভাবে লোকসমাজের সঙ্গে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে সেনযুগে, তা গোছানোর সাহিত্যপ্রচেষ্টা মঙ্গলকাব্য। এই সমাজসত্য চেপে রেখে মঙ্গলকাব্য পাঠ করার সুযোগ নাই।
শ্রী চৈতন্যের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রভাবে বৈষ্ণবীয় ধারার সাহিত্য গড়ে উঠছিলো। তাতে কি নেই সমাজের সংশ্লেষ? বৈষ্ণবীয় চিন্তার পুনর্গঠন যে ইসলাম প্রসারের প্রতিক্রিয়া, তা গোপন করি কী করে? ফলে গভীরভাবে রাজনৈতিক বৈষ্ণবীয় ধারার কবিতা। সেই তুমুল তোলপাড় তোলা পদাবলী ফের লিখতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ বহুবছর পরে। কিন্তু ভাষাবিশ্ব ও লোকমানস বদলে যাওয়ায় হয়তো পাঠক আর এ কালের কবির কাছে পদাবলি আশা করেনি। ফলে তিনি থিতু হলেন গীতিকবিতায়। যেমন করে ঔপনিবেশিকতাকে আলোকায়ন ভেবে মধুসূদনের নেতৃত্বে পশ্চিমা ভাবাপন্ন কবিতার আমদানি ঘটলো বাংলা কবিতায়। এবং তাকে ত্রাতা ভেবে যে ব্যাপক পঠিত ও কথিত আধুনিক বাংলা কবিতার সৌধ গড়ে উঠলো, সেসব সৃষ্টির অন্তরালেও ফণা তুলে আছে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ার বাতাবরণে লতিয়ে ওঠা আলোকায়নের রূপকথা। তাহলে এই যে বাংলা ভাষা ও কবিতার ইতিহাস, তা রাজনীতি-সমাজ ও সংস্কৃতির সংঘাতের কবলে পড়েনি কবে?

বাংলা কবিতাভাষার প্রতিটা বাঁক বদলেই আছে সমাজ ও মানুষের অন্তর্জগতের লীলানৃত্যের ছাপ। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ইউরোপীয়ত্বের চেয়ে ভারতীয়ত্ব এবং বাঙালিয়ানার ছাপ-ই তো বেশি। আধুনিক নাগরিকতার পরিমণ্ডলে থেকে যেমন ইউরোপীয় সাহিত্যচিন্তাকে উপেক্ষা করতে পারেননি, তেমনি বিপুল অনাধুনিক ভারতীয়ত্বও তার মননকে পোক্ত করেছে। ফলে তার যে অধ্যাত্ম জগত, যে প্রকৃতি তা ভারতের কিংবা বাঙালির-ই থেকেছে। নজরুল আগা-গোড়াই ঔপনিবেশিক শাসক শক্তির মদমত্ততার জন্য হুমকি ছিলেন। তাঁর কবিতার ভাষা বিশ শতকে বাঙালি সমাজ এবং ভারতবর্ষে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার চিন্তা বিকাশের অনুগামী হয়েছে। জসীমউদ্দীনের কবিতা যেন কেমন কেমন গ্রাম-বাংলায় ঠাঁসা, যেন পূর্ববঙ্গ গীতিকার নগরভাষ্য। এটা কি কেবল কবির নিজস্ব নির্বাচন? সময় কি নিয়ামক নয়? বিশ শতকের শুরুর দিকে দীনেশচন্দ্র সেন, আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কর্মকাণ্ড খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় আধুনিক সাহিত্যের আওয়াজের মধ্যেও তারা বাঙালির পুরাতন দিনের সাহিত্যচর্চার নমুনা ও ঠিকুজি সন্ধানে কী উদ্যমী ছিলেন। তার প্রভাব যে জসীমউদ্দীনের কবিমানস তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। কবি জীবনানন্দের বড়ত্বে আধুনিক ইউরোপীয় ভাবধারার চেয়ে বাংলার প্রকৃতিকে নিবিড়ভাবে চিনতে ও বুঝতে পারার অবদানই অধিক।

“এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে—সবচেয়ে সুন্দর করুণ:
সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;”

[২৭-সংখ্যক সনেট (এই পৃথিবীতে এক): রূপসী বাংলা]

অন্যত্র,
“… যখন তুলিতে যাই ঢেঁকিশাক—দুপুরের রোদে”
“পৃথিবীর রাঙা রোদ চড়িতেছে আকাঙ্ক্ষায় চিনিচাঁপা গাছে—”

[২৬-সংখ্যক সনেট( কখন সোনার রোদে): রূপসী বাংলা]

কিংবা,

“সেই সব নোনা গাছ, করমচা, শামুক, গুগলি কচি তালশাঁস
সেই সব ভিজে ধুলো বেলকুঁড়ি ছাওয়া পথ, ধোঁয়াওঠা ভাত”

[২৪-সংখ্যক সনেট (খুঁজে তারে মরো মিছে): রূপসী বাংলা]

জীবনানন্দে এইরকম অজস্র মাল-মশলা পাওয়া যাবে যা প্রবলভাবে রাজনৈতিক। তিনি যে প্রতিবেশ নির্মাণ করেছেন এই জায়গাগুলোতে, তা কবির খামখেয়াল নয়। কবি যে জংলার বিবরণ দিয়েছেন, আমাজান-আন্দালুসিয়া তো বটেই, পার্বত্য হিমালয়ের লোকেরাও ভিন্নতা টের পাবে। অবশ্য বুড়িগঙ্গার তীরে বসে ইউক্যালিপটাস-আপেলবাগানবিহারী ও আঙুরলতায় দোল খাওয়া ঢাকাই কবিকূলের কাছে এ নিছকই প্রকৃতিমুগ্ধতা ও নিসর্গপ্রেম।

তবু যে তিরিশ নিয়ে এত কথা হয়, তার পরে কেন চল্লিশ এল? কেনইবা আড়মোড়া না ভাঙতেই এলো স্বাতন্ত্র্যবাদীদের যুগ। তারপর একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে শুরু হলো ‘নতুন কবিতা’র চল? উনিশশো বিশ সাল থেকে পঞ্চাশের দশক অবধি রাজনীতির মুহর্মুহু ভোল পাল্টানোর দিকে নজর শানালেই আমরা দেখতে পাব কীভাবে মানুষের চিন্তা ও তৎপরতা কাব্যভাষায় ধৃত হয়েছিল। অসহযোগ আন্দোলনের বাতাবরণের ফাঁকে যে সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্নও বেশ লকলকিয়ে উঠেছিল সেকালের ভারতবর্ষে, চল্লিশের কবিতা যেন তার-ই ভাষাচিত্র।

“বাঁকানো চাঁদের সাদা ফালিটি
তুমি বুঝি খুব ভালোবাসতে?
চাঁদের শতক আজ নহে তো,
এ-যুগের চাঁদ হ’ল কাস্তে!”

[কাস্তে: দিনেশ দাশ]

“কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?
কুয়াশাকঠিন বাসর যে সম্মুখে।
লাল উল্কিতে পরস্পরকে চেনা—
দলে টানো হতবুদ্ধি ত্রিশঙ্কুকে,
কমরেড, আজ নবযুগ আনবে না?

[সকলের গান: সুভাষ মুখোপাধ্যায়]

কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, প্রজাসত্তার বিকাশসহ রাজনীতির নানা কূটচাল ও বাস্তবতায় যখন বাঙালি- মুসলমান স্বাতন্ত্র্য খুঁজতে লাগলো, কবিতাও তখন সেই আকাঙ্ক্ষার দোসর হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অবিশ্বাস ও শাসকের নৃশংসতায় যখন মানুষের চিত্ত নড়ে উঠলো, মুক্তির সুর বেসুরো হয়ে বাজলো, কবিতার ভাষাও চট করে খুঁজে নিল নতুন গন্তব্য। যে শামসুর রাহমান এত নন্দিত- সেই রাহমান তো আদতে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের-ই দান।

“গাছের কোটর থেকে লাফাতে লাফাতে নেমে
আসো,

আসো কাঠবিড়ালির রূপে,

ফুল্ল মেঘমালা থেকে চকিতে ঝাঁপিয়ে পড়ো
ঐরাবত সেজে,

সুদূর পাঠশালার একান্নটি সতত সবুজ

মুখের মতোই দুলে দুলে ওঠো তুমি
বার বার কিম্বা টুকটুকে লঙ্কা ঠোঁট টিয়ে হ’য়ে

কেমন দুলিয়ে দাও স্বপ্নময়তায় চৈতন্যের দাঁড়।”

[বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা: শামসুর রাহমান]

আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ও তো নতুন চরের মতো জেগে ওঠা বাঙালির স্বপ্নের জমিনকে স্পর্শ করতে চেয়েছিল। মানুষের মনের গুঞ্জরন এভাবে কবিতাভাষায় দেহরূপ পায়।

“আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষম বণ্টন,
পরম স্বস্তির মন্ত্রে গেয়ে ওঠো শ্রেণীর উচ্ছেদ,
এমন প্রেমের বাক্য সাহসিনী করো উচ্চারণ
যেন না ঢুকতে পারে লোকধর্মে আর ভেদাভেদ।

[ ১০ সংখ্যক সনেট: সোনালি কাবিন]

নতুন রাজধানী ঢাকার লোকমানস শহীদ কাদরীর কবিতায় উজ্জ্বল বলেই হয়তো পড়ার টেবিলে আজও তাকে টেনে আনি। ষাট-সত্তর-আশির প্রথম অর্ধ পর্যন্ত কবিতা মোটাদাগে মানুষ-ঘনিষ্ঠ থেকেছে। পরে যে কবিতার অন্তর্মুখী যাত্রা, তাতে সময় কি ক্রিয়া করেনি? পুরা পৃথিবী জুড়েই সমষ্টির শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তার ছোঁয়াচ এসে লাগছে বাংলার তরুণদের মনেও। আবার নিজ দেশে উপর্যুপুরি সামরিকায়ন আর স্বাধীনতার স্বপ্নের রং চটে গিয়ে যখন ফ্যাকাশে হয়ে পড়লো, তখন যেন ক্রমে একা ও অর্ন্তমুখী হয়ে যাওয়াই নিয়তি। যদিও সেই ঘোর কলিকালেও কবিরা কবিতা চর্চা করেছিলেন এবং বাংলা ভাষার ছন্দলালিত্যে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। আজ যে আশির উজ্জ্বল কবিদের আমরা পড়ি, তাতে এভাবে ভাবতে পারা যায়। নব্বইয়ের দশকের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-শ্লেষ ও লোকায়ত জীবনের ভাষ্যরূপ এমনি এমনি-ই আসেনি কবিতার শরীরে। অর্থনীতিতে উদার নীতিবাদের আড়ালে সাধারণের গোলাঘর উদাম করে দেয়ার নীতি ও নগরায়নের ভেল্কি যে প্রজন্মমানস তৈরি করেছে তার ভিতর থেকেই উঠে আসে নব্বইয়ের কবি ও কবিতা। শূন্য হয়তো বিরাজনীতিকরণের ফল। সে কারণেই বিমূর্ততা, ব্যক্তিগততা, নাগরিক জীবনের কোলাজ ও ক্যাওয়াজের শিল্পরূপ নির্মাণে তাদের ঝুঁকে পড়া বিস্ময়ের নয়। যদিও স্বল্পকাল পরেই আমরা দেখতে পাব, কবিতার ভাষা সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির সংঘাতের দিকে মনোযোগ ফেরাতে চাইছে। দ্বিতীয় দশকে এসেই বাংলা কবিতা ফিরতে চাইছে চিরায়ত কক্ষপথে। শুধু ফেরা নয়, যেন প্রসারিত হয়ে পড়ছে ভাষা, কল্পনা ও বাসনার জগত। এ সময়ের কবিরা বাংলা কবিতার ইতিহাসের নানা অধঃক্ষেপকে চারিয়ে দিতে আকুল নিজেদের সৃষ্টিতে। কোথা থেকে আসছে এ প্রেষণা?

সম্ভবত ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে ঝুলে আসে সময়। ইতোমধ্যে নয় এগারোর অভিঘাত বিশ্বরাজনীতির হিসাব-নিকাশ যেমন পাল্টে দিয়েছে, বাংলাদেশের মানুষের ভাবজগতও বলকাচ্ছে নতুন চিন্তায়। ইউরোপীয় আলোকায়নের ভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে দ্রুত। বিশ্ব চষে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তির পথ প্রসারিত করে নিজেকে চেনার সাহস সঞ্চারিত হচ্ছে তারুণ্যের মনে। যদিও জগদ্দলের মতো তাদের উপর চেপে আছে আলোকায়নের সুবিধাভোগী এলিট শ্রেণি, পাশ্চাত্য-উচ্ছিষ্টভোগী উন্মূল চিন্তক, পরিত্যক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদের পূজক। অর্থনীতির হাতিয়ার ও নগরের সুবিধাকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে তারা চাপা দিয়ে চলেছে জনতার সংস্কৃতি ও ভাষা। নিজেদের নোংরা বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য বাংলাভাষার প্রতিপক্ষরূপে দাঁড় করিয়েছে ইংরেজি ভাষাকে, এক মুসলমানের শত্রু বানিয়েছে অপর মুসলমানকে, ধর্মবিদ্বেষ ছড়িয়ে মানুষের মনকে করছে বিক্ষিপ্ত ও অশান্ত। নিজ শ্রেণির বেলেল্লাপনাকে জায়েজ করার জন্য সাধারণের সংস্কৃতিকে অবজ্ঞা করেই কেবল ক্ষান্ত হয়নি, বিদ্রুপের বিষয়ে পরিণত করেছে। নিশ্চিতভাবেই সংবেদনশীল কবিমন এই দ্বন্দ্বকে টের পাচ্ছেন তুমুলভাবে। সমাজকে বিভাজিত করার এলিটীয় রাজনীতির নষ্ট চক্র থেকে বেরিয়ে এসে কবিতায় তুলে ধরতে সচেষ্ট হচ্ছেন সাধারণের আকুতি, অনুভব ও রক্তক্ষরণ। কিন্তু মানুষ-ই ভয় ও ভরসা, শুরুতেই এই নোক্তাটা দিয়ে এসেছি। মানুষ কোন দিকে ঝোঁক নেয় তার উপর নির্ভর করে কবি ও কবিতার ভবিষ্যৎ। মানুষ কি তথাকথিত এলিটীয় সংস্কৃতিতে কাবু হয়ে বিভাষার কাছে সঁপে দিবে বাংলা ভাষার জগত? নাকি ঔপনিবেশিকতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন কোনো ভাষাবাস্তবতার মুখোমুখি হবে বাঙ্গালি ও বাংলা ভাষা? এই দ্বিধা ও সংকটে কবির লড়াই হচ্ছে মানুষের স্বর বুঝতে পারা, যাবতীয় ছুঁৎমার্গ প্রত্যাখ্যান করে শব্দব্যবহারের সীমা ভেঙ্গে দেওয়া, বাংলা ভাষার কবি হিসাবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির পক্ষভুক্ত হয়ে ময়দানে হাজির থাকা, এলিটের সংস্কৃতির অসারতা তুলে ধরা, বিদ্বেষমুক্ত জনসংস্কৃতির পরিপোষক হয়ে ওঠা, গ্রামের বিপুল নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মনকে বোঝা, শহরের গলিতে গলিতে হাপিত্যেশ হয়ে ঘোরা-লোকাল বাসে ঝুলতে থাকা ঊননাগরিক শ্রেণির বেদনা ও প্রেম অনুভব, ঘরের পাশের ভিন্ন জাতি ও ধর্মের ভাইটিকে আপন ভাবতে পারার মতো জ্ঞানকাণ্ড ও কাব্যচিন্তা বিকশিত করা।

সম্ভবত বাঙালিকে রাষ্ট্রচিন্তার দৈন্য ও ভাষাবৈকল্য থেকে রক্ষা করতে কবিতার ভাষা আগামীদিনে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক হয়ে উঠবে।


মোস্তফা হামেদী

কবি

শেয়ার