কবিতা জগতে মানুষ তাকেই স্থান দিয়েছে— যার আছে নিজের কিছু রসদ, আছে কিছু চাল-চুলা যা দিয়ে সাবলীলভাবে তার আতিথেয়তা কবুল করা যায়। এইগুলা কখনো ভঙ্গির মধ্যে থাকে, কখনো থাকে বিষয়ে। দুইটাকে যিনি মেলাতে পারেন, তিনি হয়ে ওঠেন মহত্তর থেকে মহত্তম।
কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে যখন কবিতা-টবিতা পেয়ে বসলো, খুব খোঁজখবর রাখি ছাপা কবিতার ও কবিতা নিয়ে নানা কাজকামের। ঐ সময়ই কার যেন একটা লেখায় তখনকার কবিতার সমালোচনা করে বলা হইল, কবির নাম মুছে দিলে নাকি কোনটা কার কবিতা বোঝা যায় না। আমি অবাক হইলাম! কবির নাম মুছে দিয়ে কবিতা পড়া, এইটা আবার ক্যামন ব্যাপার! সবাই কত যত্নআত্তি করে কবিতা লেখতেছে, ছাপাইতেছে— সেই কবিতায় তার নাম লুকিয়ে ফেললে আর তার থাকে না! এইটার কারণ কী? কেন ঘটে এইসব? ভাবনা পেয়ে বসে। তখন বলা হতো কবিতায় নাকি চিন্তা না থাকলে এমন হয়। আবার কেউ কেউ বলতো একই সময়ের তো, আলাদা হওয়া অনেক টাফ। বিষযের অভাবরেই কেউ কেউ কবিতা ভিন্ন না হওয়ার জন্য দুষতেছেন। এই সমস্ত কথাবার্তা টিপে টিপে দেখে রাস্তা বার করন যায় কিনা ভাবি।
প্রথম কথা হইল একই সময়ে ভিন্ন রকমের কবিতা লেখা যাইতে পারে। এইটা আমাদের ইতিহাসের মধ্যেই আছে। যদিও অনেক অনেক দিন পর যখন যুগের শিকল টানা হয়, কষ্ট কমানোর জন্য একই কালের লোকরে একটা ঘরের মধ্যে আমরা ঢুকিয়ে রাখি। এই কারণেই আমরা নাম দেই—‘রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান’, ‘বৈষ্ণব কবিতা’ , ‘মঙ্গলকাব্য’, ‘আধুনিক কবিতা’ আরও কত কী!। একই নামের মধ্যে যে কত অজস্র নাম প্রবল প্রতাপে বিরাজ করতেছে, তা এর অন্দরে ঢুকলেই টের পাওয়া যায়। প্রায় একই বিষয় নিয়ে লিখেও বহু কবির আয়ু শতাব্দ—সহস্রাব্দ ছাড়িয়েছে। ফলে বিষয়ও তেমন শক্ত পক্ষ হইতে পারলো না। পুরা ‘মধ্যযুগজুড়ে’ বাংলা কবিতায় ছন্দ ও ফর্মের কিছু সাধারণ চেহারা আছে, তারপরও কবিরা স্বনামে টিকে আছেন। কেউ কেউ বলে থাকেন, একটা লাইন বা একটা কবিতাই কবির জন্য যথেষ্ট। পাঠক সাধারণকে সতর্ক করে দিতেছি, অদ্য আমার আলোচনার বিষয় কবির টিকে থাকার প্রশ্নের চেয়ে, নাম মুছে দিয়ে কবিতা পড়লে কবিকে চেনা যায় কিনা এই প্রশ্নটা।
বাচ্চা হইলে, আমরা পহেলা পহেলা জিজ্ঞাস করি, কার মতো হইলো? মার মতো, না বাবার মতো? দাদা, না দাদির মতো? কিন্তু বাচ্চার বড় হইতে থাকার সাথে এই প্রশ্নটাও লোপ পাইতে থাকে, এমনকী অমুকের ছেলে তমুকের ছেলের জায়গায় শেষে ঐ একই ব্যক্তির পরিচয় দাঁড়ায় পুত্র বা কন্যার নামে, অমুকের বাপ তমুকের বাপ। সমাজ এইভাবে পরম্পরা নির্ধারণ করে দিছে। কবিতাও এই ভাষা বা ভাবনা বলয়ের বাইরে নয়। যেটারে আমরা ‘বাপ’ বলতেছি, আলোকায়নের গুরুরা সুইট করে ওরে ‘স্কুল’ বলে। বাচ্চা যেমন মায়ের পেট থেকে ভাষা নিয়ে দুনিয়াতে আসে না, কবিরাও কবিতা লিখতে বসেই নিজের কবিতা লিখে ফেলতে পারে না। প্রথম বয়সে তিনি লিখেন পূর্বপ্রজন্মের ভাষায়। আবার আধা-শিক্ষিত সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে স্টেরিওটাইপ নানা ভাবনা থাকে। বেশিরভাগ মানুষ ঐগুলি দ্বারা চালিত হন, সমাজের সাধারণ সদস্য হিসাবে কবিও। ফলে প্রথমকালে তিনি মানুষের মনে গেঁড়ে থাকা ফর্মে আকৃষ্ট হন এবং স্বতঃস্ফূর্ততাতাড়িত হয়ে ঐভাবে লিখতে থাকেন। কিন্তু ঐ পানিতে নামার মতো এক সিঁড়ি দুই সিঁড়ি বেয়ে যখন মূল প্রবাহে পা দেন, টের পান—জলের কী অথৈ তল! এই হাবুডুবু খাবারকালে জান বাঁচানোর ত্বরিকা হিসাবে তিনি কোনো একটা ডিঙ্গায় নিজেরে সমর্পণ করেন। এই সময় বহু দল-উপদল তৈয়ার হয়। একটা নালায়েক দল থাকে যারা সকালে এই নৌকায় তো বিকালে ঐ ডিঙ্গায় তো রাত্রে আরেক ভেলায়। এই সর্বত্র বিচরণকারীরা খুব হৈচৈ ও ব্যাভিচারপ্রবণ হয়। আর দ্রুতই ক্লান্ত হয়ে সমুদ্রযাত্রার আশা ত্যাগ করে। পরে দল-উপদলে ভাগ হইতে থাকাদের মধ্য থেকেই আসল রেসটা শুরু হয়। যতদূর আগাইতে থাকেন উপদলগুলি দলে লীন হইতে থাকে, কিংবা ছোট ছোট টেমি বাতির মতো টিমটিম করে তারা জ্বলে আর নিভে। এই কারণে পঁচিশ বছর বয়সী কবিদের পাল পঁয়ত্রিশে গিয়ে হাতে গোনার অবস্থা হয়। এইটাই নিয়তি, এইটাই বাস্তবতা। আমার হিসাব হইতেছে এই হাতে গোনাদের নিয়ে। তারা কীভাবে হয়ে ওঠেন ও বিরাজ করেন। নাম মুছে দিলেও তাদের কেন চেনা যায়?
এই প্রশ্ন করতে করতেই মনে পড়লো মানুষের চেহারার লগে কবিতার কোনো সম্পর্ক আছে কিনা? তর্কবাজরা এইখানে বলবে জমজ হইলে দুইজনে একজন হয়ে যাইতে পারে। অর্থাৎ চেহারা থিউরিরে তারা নাকচ করতেছেন এইভাবে। কিন্তু না, চেহারা প্রায় একই হইলেও জমজ আলাদাই। আর তাদের এই আলাদাত্ব তৈয়ার করে ব্যক্তিত্ব। ঠিক এইরকভাবে একজন কবি থেকে আরেকজন কবি আলাদা হয়ে ওঠেন ব্যক্তিত্বের গুণে। ফলে প্রথমত এইটার সাথে তার স্বভাবের যোগ আছে। তার পছন্দ—অপছন্দ নির্বাচনের যোগ আছে। এই কারণেই এই ‘স্কুলের’ ছাত্র হইলে কবিতে কবিতে আলাদাত্ব ফুটে ওঠে। তবে এইটাই শেষ না। বরং এইটা শুরূ।
ঐসব পাতায় রয়ে আছে কত না গুপ্ত সংকেত, কত না নতুন সুড়ঙ্গ। পথভ্রষ্টরা সে সংকেত বুঝতে ব্যর্থ হন, অথবা সংকেতকেই ভেবে বসেন সমগ্র। কারণ ভাষা কোনো স্থির ব্যাপার নয়। আবার ইতিহাসচ্ছিন্নও নয়।
এখন প্রশ্ন হইল, সামাজিক অর্থে যারে আমরা ‘ব্যক্তিত্ব’ বলি, কবিতায় সে সংজ্ঞাটা খাটে কীনা? আমার ধারণা দুইটা পুরাপুরি একই ‘বস্তু’ না হইলেও দুইটার মধ্যে বেশ সহজ যোগাযোগ আছে। আমার এই আন্দাজের সমর্থনে ছোটবেলায় সমাজ বইয়ে পড়া ‘সামাজিকীকরণ’ অধ্যায়ের কথা মনে করাইতে পারি। শিশুতোষ মনে হইলেও এইগুলি জরুরি ব্যাপার। যদিও কবিরে যারা আসমান থেকে পড়া ‘নিহারীকামণ্ডলের মণ্ডল’ মনে করেন, তাদের ব্যাপারে আমার আপাতত কথা নাই। শিশু হিসাবে-কিশোর হিসাবে কবির এই যে বেড়ে ওঠা, সেইগুলি ফেলনা তো নয়-ই বরং খুবই গুরুত্বপূর্ণ নিক্তি ‘কবিব্যক্তিত্ব’ মাপার। এর সাথে যোগ হয় ‘কবি’ হয়ে ওঠার সংগ্রাম। ‘কবিতা’ পদবাচ্যের প্রেমে ধরাশায়ী ব্যক্তি কোনো না কোনোভাবেই কবিত্রা ইতিহাসের সাথে যুক্ত হন। এমনকী ভাষার ইতিহাসের সাথেও। আর যে সময়টায় তার চর্চা শরীর পেতে শুরু করে, সেই সমযের কাব্যের চল ও চিন্তা-চেতনা বহু পথেই তাকে আলিঙ্গণ করতে চায়। সেই পরিস্থিতির সাথে কে কীভাবে অভিযোজিত হচ্ছেন, সেই প্রক্রিয়া বোঝাটাও কবিকে চেনার ক্ষেত্রে জরুরি। ‘স্কুলিং’-এর ব্যাপারটা সরল বয়ানে এই। কিন্তু স্কুলিং ভালো হইলেই কেউ কবি হয়ে উঠবেন, এমন নাও হতে পারে। কবিতা প্রসঙ্গে এবং লেখালেখি প্রসঙ্গে প্রচলিত মত হলো, প্রচুর লিখতে থাকার মধ্য দিয়ে কবি তার নিজের ভঙ্গি খুঁজে পান। অবশ্য যে কোনো দক্ষতার ক্ষেত্রেই অবিরাম লেগে থাকার কথাটা আমরা তুলতে পারি। পরিশ্রম, অভিজ্ঞতা, নানা বিষযের সাথে যুক্ততা, পঠনপাঠনের বৈচিত্র্যও কাজের হতে পারে। মুশকিল হইলো, আয়োজনেই মেলা লোকের দম ফুরায়। ফলে সৃষ্টির পিছনের কার্যকারণ, উপকরণ যাই হোক— সৃষ্টিকর্মই কবির সার। সৃষ্টিকর্মের হয়ে ওঠার কিছু শর্ত থাকে। এই শর্ত তৈয়ার হয় আবার নানা মানুষের বিবিধ ক্রিয়াকাণ্ডের ফলে। কবিতার বা শিল্পের এইগুলি পূরণের দায় আছে। কারণ শিল্পেরও এক ধরনের শাসনতন্ত্র আছে। এর পরেই হইলো আসল খেল দেখাইবার পালা।
কবিতার ইতিহাসে শিল্পগুণসম্পন্ন কবিতা লিখতে পারা কবির সংখ্যা কম নয়। কিন্তু সম্ভবত মানুষ কবিকে দেখতে চায় আরও উঁচু কোনো প্রতিকৃতি হিসাবে। গড়পড়তার চেয়েও বড় রকম করে মানুষ তার কবিকে ধারণ করে। ফলে কবিতাগ্রন্থ বা কবিতাভাষা বা কাব্যভঙ্গি বা কাব্যচিন্তা স্রেফ কথার কথা বা একাডেমিয়ার কচকচি নয়। এগুলোর বহু কেরামতি আছে, যা কবির বড়ত্বকে তৈয়ার করে বা ধারণ করে। নিরেট মৌলিক বলে জগতে যেমন কিছু নাই, আবার ভিন্ন-ভিন্ন সত্তার উপস্থিতিও প্রকৃতিতে দুর্লভ নয়। ফলে অনেক মুখের ভিড়ে যে মুখ চেনা যায় না, যার মধ্যে এর কান, তার চোখ, ওর ঠোঁট, হের হাসি লেপ্টে থাকে তাকে হয়তো সার্কাসের সংয়ের মতো নগদ বাহবা দিতে পারবো। মনে জায়গা দিতে পারবো না। কবিতা জগতে মানুষ তাকেই স্থান দিয়েছে— যার আছে নিজের কিছু রসদ, আছে কিছু চাল-চুলা যা দিয়ে সাবলীলভাবে তার আতিথেয়তা কবুল করা যায়। এইগুলা কখনো ভঙ্গির মধ্যে থাকে, কখনো থাকে বিষয়ে। দুইটাকে যিনি মেলাতে পারেন, তিনি হয়ে ওঠেন মহত্তর থেকে মহত্তম। আমরা তখন আদর করে তাদের ‘মহান কবি’ শব্দজোড়া উপহার দেই। এইসব কবিদের আছে নিজের জগত, নিজের ব্যক্তিত্বকে কবিতা করে তুলতে পারেন তারা, শব্দ তাদের পোষ মানে। কল্পনা চায় তাদের সাহচর্য। কবিতার ‘চিরপদার্থ’কে কবিতার শরীরে পুরেই তারা ক্ষান্ত হন না, নতুন সময়ের সত্যকে, নিযুত মানুষের শ্রম ও ধ্যানে লোকেসমাজে ঘনিয়ে ওঠা সুর তাদের বীণায় ভর করে। ফলে তিনি একক হলেও বহুর প্রতিভূ হয়ে ওঠেন। তখন তাদের নাম মুছে দিয়েও চেনা যায়, পাঠ করা যায়। কীভাবে হয় এইসব? কোথায় পাব তারে?
মহৎ কবিতা চেনার জন্য আসলে দুনিয়া হাতড়ানোর দরকার নাই। প্রত্যেক কবির নিজের সেল্ফেই তারা বহাল তবিয়তে আছেন। কোনো নবিশ যখন উপমা খুঁজে মরেন, বইয়ের পাতায় শুয়ে শুয়ে তারা মুচকি হাসেন। আর বেকুবিপনা দেখে আফসোস করেন। অথচ ঐসব পাতায় রয়ে আছে কত না গুপ্ত সংকেত, কত না নতুন সুড়ঙ্গ। পথভ্রষ্টরা সে সংকেত বুঝতে ব্যর্থ হন, অথবা সংকেতকেই ভেবে বসেন সমগ্র। কারণ ভাষা কোনো স্থির ব্যাপার নয়। আবার ইতিহাসচ্ছিন্নও নয়। পাঠ এবং পাঠান্তরের দ্বৈরথ কবিকে যুঝতে হয়। ফলে বইয়ের বাইরে বইয়ে চলা যে জীবন ও প্রকৃতি তার গুঞ্জরন কবির অবশ্য পাঠ্য হয়ে পড়ে। এইসব অলিখিত ‘টেক্সট’ লিখতে পারার ভিতর দিয়ে কবির কবিতা তার নামপদকে ছাপিয়ে ওঠে। তখন তাকে আর মুছে ফেললেই মোছা যায় না।