।১।
*
এক প্রাচীন পথ বেয়ে হেঁটে চলেছে আজান। এক প্রাচীন পথ বেয়ে উড়ে চলেছে আজান। আজানের সুর। আজানের শব্দসমূহ। এক অতিবৃদ্ধের ঘড়ঘড়ে গলা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে বোধ কিংবা বোধের অতীত ব্রহ্মটুকু। তুমি ভাবছ এ সংস্কারমাত্র। নিছক বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠা। আর তৎক্ষণাৎ তোমাকে চমকে দিয়ে আকাশে উড়ে যাচ্ছে সাদা বকের পাল। তোমাকে চমকে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক অতিবৃদ্ধের নিছক শব্দের প্রতি প্রেম। ব্রহ্মের প্রতি একনিষ্ঠ অবিনাশ আহুতি।
*
শব্দ এবং সুরের মধ্যে যে সম্পর্কের হাওয়া, তুমি তাতে ফুঁ দিচ্ছ ছোটবেলা থেকেই। তোমার হারমোনিয়াম থেকে উদ্গত হয়েছে সাতটি সুরের সমাহার। আর তোমার গলা চিরে বেরিয়ে এসেছে শব্দের শিরা-উপশিরা। সুরের হাত ধরবার অনবদ্য আশায় তারা তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এযাবৎ। আজীবন তোমাকে ভাসিয়েই নিয়ে যাবে। অথচ শব্দ এবং সুরের মধ্যে যে সম্পর্কের হাওয়া, তুমি তাতে ফুঁ দিতে দিতে দেখতে পাচ্ছ, তুমি নও, এক ঝাঁক উড়ন্ত পাখি, কিংবা একমাথা ঝাঁকড়া পাতাওলা গাছ কিংবা এক আকাশ বৈশাখী মেঘের সঙ্গে বসত করছে সুর। বসত করছে শব্দ। আর তৎক্ষণাৎ তুমি হাতজোড় করছ। তুমি বুঝতে পারছ প্রকৃতির থেকে বড়ো গায়ক জন্মায়নি আজও।
*
শব্দ, সুর এবং আজানের সম্পর্কটি তৈরি করেন যে গোষ্ঠীপ্রধান, তার বাড়িতে দশটি মুরগি, কুড়িটি হাঁস কিংবা পাঁচটি বেড়াল আছে ধরে নেওয়া যেতেই পারে। তাই মিঠে রোদে মোড়ায় বসে মিহি সুতোর জাল বোনার সময় তিনি দেখতে পান শব্দ, সুর এবং আজানের সম্পর্কটি তৈরি হচ্ছে তারই জাল থেকে। তারই আঙুল থেকে। তারই শরীর থেকে। তার পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকা মনুষ্যেতর প্রাণীগুলির নিঃস্বার্থ প্রেমগন্ধ থেকে জন্ম নিচ্ছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ আজান। নিরন্তর।
।২।
*
একটি মানুষ কিংবা একটি যন্ত্রণার পাশাপাশি একটি গাছের অবস্থান হতে পারে। অথবা একটি কাগজের নৌকার। অনস্তিত্বকে পরিণতি হিসাবে মেনে নেওয়াই যাদের একমাত্র পরিণতি। এরূপ একেকটি পরিণতির পায়ে বাঁধা থাকছে তোমার হাসির খলখল, চুরির কলকল কিংবা চোখের ঝিলমিল। এরূপ একেকটি পরিণতির চামড়ায় ফুল হয়ে ফুটে উঠছে পৃথিবীর সমস্ত মায়ার বীণ, স্বয়ং তুমি কিংবা তোমাদের শতসহস্র অবিরল কলকলানি আয়ু।
*
একেকটি আয়ুর দরবারে নিজেকে বন্ধক রেখেছে এ জগতের সমস্ত তানসেনের দল। তাদের গলা। কিংবা হারমোনিয়ামের কাঠ। আমরা বুঝি। অথবা বুঝি না। দেখি। অথবা দেখি না। এ পৃথিবীর প্রতিটি জীবের আয়ু এভাবেই দরবার সাজিয়ে বসে থাকে। বসে থাকে নিজস্ব দেখানেপনার প্রতিযোগিতা নিয়ে। তাদের অগণিত ঝিলমিলে ক্রমাগত জ্বলে ওঠে, নিভে যায়, জ্বলে ওঠে, নিভে যায় এ মহাজগতের সত্যসন্ধানী জোনাকির দল।
*
তোমার সঙ্গে আমার যতখানি বসত ছিল, তা পৃথিবীর প্রতিটি সংগীতকে অতিক্রম করেছে। এ মহাজগতের প্রতিটি সংগীতকে অতিক্রম করার সময় দেখেছে আমাদের সংগীতের গীত কতখানি ঠুনকো, কতখানি অসহায়। মাটির জরায়ু ফুঁড়ে যে সংগীত এসে পৌঁছায় গাছেদের কানে কানে, আকাশের যোনি চিরে যে সংগীত এসে পৌঁছায় পাখিদের চঞ্চুতে, সেইসব অকৃত্রিম সংগীতের কাছে পরাজিত হয়েছে আমাদের সংগীত। দেখেছে একটি পাখি কিংবা একটি গাছ, একটি গাছ কিংবা একটি পাখি কেমন ধীরে ধীরে সম্ ও গীতের ধারক হয়ে ওঠে। ধারক হয়ে ওঠে একটি মহাপৃথিবীর। মানুষ যার কাছে যৎসামান্য বাসি হয়ে যাওয়া ফুল।
শীর্ষা মণ্ডলের জন্ম বীরভূমে (১৯৯২, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণীবিদ্যায় স্নাতকোত্তর এবং গবেষণা। বর্তমানে মধ্যপ্রদেশে একটি সরকারি কলেজে প্রাণীবিদ্যা বিষয়ের সহায়ক অধ্যাপিকা। পাশাপাশি বিশ্বভারতীর তামিল বিভাগ থেকে সার্টিফিকেট এবং ডিপ্লোমা কোর্স সম্পূর্ণ করেছেন তামিল সাহিত্যে। মুক্তি দেয় লেখালিখি। লেখালিখির সূচনা স্কুলজীবনের সাহিত্যসভা থেকে। কবিতা ও গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘কবিসম্মেলন’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘কবিতাপাক্ষিক’, ‘আদম’, ‘গুহালিপি’, ‘কবিতা আশ্রম’ সহ বেশ কিছু পত্রিকায়। প্রকাশিত বই ‘তারাফুলের শবযাত্রা’ (তবুও প্রয়াস প্রকাশনী, ২০২০) এবং ‘একটি কালো কিংবা সাদা বেড়ালের কবিতাগুচ্ছ’ (প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন, ২০২৩)। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘পৌলোমী সেনগুপ্ত মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন পুরস্কার’ (২০২১)। লেখার পাশাপাশি তামিল সাহিত্যের (মূল ভাষা) বাংলা ভাষান্তর বেশ কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত বই ‘কাশী আনন্দনের নড়ুক্কু কবিতা’ (তবুও প্রয়াস প্রকাশনী, ২০২৩)। অনুবাদের জন্য পেয়েছেন ভাষা সংসদ প্রদত্ত ‘সোনালী ঘোষাল স্মারক পুরস্কার’ (২০২২)।