আন্দামান সাগরের একলা দ্বীপে পাখির কিচির মিচিরে অতিষ্ঠ এক সাধু আর জাকার্তার জনাকীর্ণ সড়কে হাজার মানুষের ভীড় ঠেলে হেঁটে যাওয়া জনৈক পথিকের একা হওয়ার তীব্র বাসনায় আক্রান্ত হয়ে যখন পাঠ শুরু করি ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতা, ক্রমে আলগা হতে থাকি পরিপার্শ্ব থেকে। এমনকি পূর্বতন কাব্যবোধ থেকেও। যে তরিকায় কবিতা পাঠ করে অভ্যস্ত, সেটা অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়ছে এখানে যেন। ফলে নতুন রাস্তা সন্ধান করতে হয়। সত্তাকে প্রশ্ন করি, আনন্দ পাচ্ছি তো? হ্যাঁ বোধক উত্তর আসে মনের গহীন থেকে। ফলে ঢুকে পড়তে সহজ হয় কবিতার শরীর বেয়ে আত্মায়। এবং এখানেই পেয়ে যাই কবির স্বকীয় সত্তার বিবরণ। সচরাচর যারা বাহ্যিক আবরণে কবিতা খুঁজে মরেন, তাদের জন্য বড় দুঃসংবাদই এটা। কেননা শব্দ দাঁত কেলিয়ে হাসে না তাঁর কাব্যে। বাক্য কেটে কেটে তাতে অলংকার ছন্দ মেখে কাব্য বিচারের ভার বয়ে বেড়ানো লোকদের জিভ তিতা হতে বাধ্য এখানে। এভাবে কাব্য ইতিহাসের গাঁ বেয়ে গলগলিয়ে ঝরে পড়া কাব্যিকতা মুক্ত কবিতার জগৎ সৃজন করে চলেছেন ইমতিয়াজ মাহমুদ। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করি, বিবিধ ধারার কবি ও কবিতার প্রবল শাসন ও প্রোপাগান্ডার মধ্যেও তিনি নিজস্ব নন্দন দৃষ্টির উপর আস্থাশীল থেকেছেন। কবিতায় অনুরণিত করতে চেয়েছেন একান্ত অভিব্যক্তি ও দর্শন। বিচিত্র বাসনায় সক্রিয় কবিমন সরব হয়েছে তাঁর কবিতায়। এই বাসনাকে নিয়ন্ত্রণ করে এক ধরনের ম্যাডনেস, যা ভাষ্যিক জগতের প্রচল সূত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়ে পাঠককে আমন্ত্রণ জানায়। তিনি তখন বলতে পারেন এমন করে—
আমার তখন সাত বছর। মেঘলা আকাশ। বর্ষাকাল। আমার
ভূতের মাংস খাবার ইচ্ছে হলো। বাবা গরীব কৃষক। বললেন,
বর্ষাকালে ভূতের মাংস পাওয়া যায় না। আমি বললাম, কোন
কালে পাওয়া যায়? বাবা ভালো মানুষ, বললেন— মরনকালে!
[ গরীব : মানুষ দেখতে কেমন ]
কিন্তু তাঁর এই অদ্ভূতুড়ে বাসনা ম্যাডনেসে ফুরিয়ে যায় না, চূড়ান্তে প্রবল দার্শনিক জিজ্ঞাসায় সমাচ্ছন্ন করে আমাদের।
আমি হতে চেয়েছিলাম বই।
…. …. …. …. …. ……
মোমের আলোয় বালকেরা—
আমাকে গলা ছেড়ে পাঠ করতো।
…. …. …. …. …. ……
খোদা আমাকে মানুষ বানালো
কেউ পড়তে পারে না।
[বই : মানুষ দেখতে কেমন]
আত্মদর্শনের উপর থিতু হয়েছে কবির নিজস্ব স্বরভঙ্গি। বলতে পারি, কবিতার অন্তঃতল থেকে বোধের গা জড়াজড়ি করে উর্ধ্বতলে উচ্চারিত হয় তাঁর স্বর। উপর থেকে আরোপন দুর্লক্ষ্য এক্ষেত্রে।
দই থেকে যেমন দুধ আলাদা করা দুষ্কর, ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার আধার ও আধেয় তেমনি অচ্ছেদ্য সংশ্লেষে কেলাসিত। বাচনভঙ্গির বিশিষ্টতা তথা বলার নির্মোহ এক ঢং পাঠককে ক্রমাগত টেনে নিয়ে যায় বোধের কেন্দ্রে। কী যেন এক অশ্রুত কথনের টানে পাঠক আগাতে থাকে শব্দের পিছু পিছু। একেবারে শেষ বাক্যটি না পড়া পর্যন্ত কৌতূহল নিবারণ হয় না। এমনকি বলা যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাঠককে তিনি ছেড়ে দেন কৌতূহলের অসীমতার মধ্যে। যাকে আমরা বলতে পারি, রহস্যময় গোলকধাঁধা। ফলে সম্পূর্ণতা জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর নির্মিত শিল্পবস্তুতে। কল-কব্জা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই বললেই চলে। প্রতিটি পঙক্তিই সম গুরুত্বের দাবিদার এবং ভরকেন্দ্রের সাথে আবশ্যকভাবে সংযুক্ত।
সুপরিচিত শব্দের অভূতপূর্ব কম্বিনেশন-পারমুটেশনের ভিতর দিয়ে ইমতিয়াজ মাহমুদ পাঠককে মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারেন। ‘চিঠি’ কবিতার প্রারম্ভে দেখি,
প্রিয়,
আমি এখানে খুব শোচনীয় হয়ে আছি।
তারা আমার হাড়গুলো খুলে নিয়ে গেছে।
আর বলেছে— ‘জীবন এভাবে ভালো।’
[ চিঠি : অন্ধকারের রোদ্দুরে ]
মৃত সত্তার ভিতর কবি অনুভূতি চাড়িয়ে দেন যখন, তখন আমাদের হৃদয় ধক্ করে না উঠে পারেনা। আর বলেছে— ‘জীবন এভাবে ভালো’ — বলা মাত্রই আমাদের সংবেদনশীল স্নায়ুগুলো মোচড় মেরে উঠে।
গূঢ় কোনো সত্য আবিষ্কারের ঝোঁক লক্ষ্য করি ইমতিয়াজ মাহমুদের অনেক কবিতায়-ই। পাঠক সে সত্যের দেখা পান বা না পান, বক্তব্যের উপরিতলে কবি যে প্রেক্ষিত রচনা করেন, তাতেই ঘটে তার রসনিবৃত্তি। ‘আত্মহত্যা’ কবিতায় পাথরে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে তিনি পাথর খেয়ে ফেলেন। এরপর ক্রমান্বয়ে হলুদ পাখি ও সবুজ পাতাসহ নদীতীরের গাছপালা, খেলোয়াড় ও দর্শকভর্তি স্টেডিয়াম, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, মার্কস, ডারউইনসহ গ্রন্থাগার, বিমান বন্দর, জাতিসংঘ কার্যালয়, এমনকি গোটা মহাশূন্য তিনি খেয়ে ফেলেন। এইরকম অদ্ভূত এক জার্নির সফরসঙ্গী হয়ে পাঠক মুগ্ধ হতে বাধ্য। এই কবিতার ‘আমি’-কে পুঁজিতন্ত্রের প্রতিরূপ হিসেবে কল্পনা করা যেতে পারে, যে সাবাড় করে ফেলতে চায় সবকিছু। কিংবা যদি শেষ পঙক্তি — ‘পৃথিবী একটা শুয়োরের বাচ্চা’ — এইটাকে ভাবনার কেন্দ্রে আনি, তাহলে ‘আমি’ হয়ে উঠে বিদ্রোহীসত্তার সমার্থক। এইভাবে ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতার কোন্দরে লুকিয়ে থাকে দ্ব্যর্থ বা বহুর্থবোধকতা।
ইমতিয়াজের ‘আমি’-কে কোথাও কোথাও মানবসত্তার সাধারণীকরণের আকারে হাজির হতে দেখি। যে সত্তায় লীন হয়ে আছে মানবের বহুরূপতা ধর্ম। ‘আমি’ কবিতায় বর্ণনার অভিনবত্বের মধ্য দিয়ে কবি দেখান, মানুষের ভিতরে কত মানুষ করিতেছে বিরাজন।
আমার ভেতরের আমিবৃন্দ কোন আমন্ত্রণ ছাড়াই রোজ রোজ চলে আসে আমার কাছে। আমি তাদেরকে বসতে দেই।
তারা গল্পগুজব করে। চা খায়। চা খেতে খেতে ১৭ বছরের আমিকে ধমক দেয় ৪৩ বছরের আমি। অরণ্য আমিকে
রক্তচোখ দেখায় দাবানল আমি। শেয়াল আমি চেঁচিয়ে ওঠে। প্রবীণ আমি সবাইকে শান্ত হতে বললে আমার মেজাজ হঠাৎ
খারাপ হয়ে যায়। আমি ৭৭ বছরের আমির দাড়ি ধরে টান দিতেই আমার দিকে ছলছল চোখে তাকায় ৭ বছরের আমি।
[ আমি : সার্কাসের সঙ ]
কবি একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়-আশয়কে কবিতা করে তুলতে চেয়েছেন কখনো কখনো। কিন্তু পাঠ শেষে আমরা মিলিয়ে নিতে পারি আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির সঙ্গে। মধ্যবিত্তীয় হাহাকারে পুষ্ট কবিতাগুলি তখন সময়েরই একপ্রস্থ সংস্করণ হয়ে ওঠে, যে সময়ের গর্ভে চলতি প্রজন্ম কাতরাচ্ছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় এবং স্বীয় বাসনাকে সংকুচিত করতে করতে নুব্জ হয়ে পড়ছে ক্রমাগত। ‘নেতা’ কবিতায় এমন একজন বাবাকে দেখি যার অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা পুত্রের হৃদয়কে ক্ষতাক্ত করছে চরমভাবে।
……আমরা জানতে পারলাম ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মারা গেছেন।
পর্দায় আমরা প্রয়াত নেতার মুখ দেখলাম। শোনা গেলো তাঁর শেষকৃত্যে যোগ দেবেন পৃথিবীর বহু গণ্যমান্য মানুষ।
টেলিভিশনে প্রথম ছবি দেখার পর উত্তেজনার চেয়েও আমার মনে তৎক্ষনাৎ যে কৌতুহল, যে উৎকন্ঠা তৈরি হলো
তা হচ্ছে— বাবাকে এখন দু-চার দিনের জন্য ইরান যেতে হবে কি না। আমি তখনো জানতাম না
বাবার নেতৃত্বের ভৌগোলিক সীমা কতটুকু?”
[ নেতা : সার্কাসের সঙ ]
এরপরই আমরা দেখি, পুত্রের মানস রাজ্যে স্থাপিত শৈশবের নায়ক বাবার মসনদ কীভাবে টলে উঠে। পুত্র বেদনায় ও ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে যায়। যখন সে প্রত্যক্ষ করে ঘর ভাড়ার জন্য অথর্ব এক বুড়ো বাবাকে রক্তচোখ দেখায়। তাকে গলার রগ দেখান মোড়ের হাবা দোকানদার, যখন তখন তাকে পুলিশ আর গুণ্ডার ভয় দেখান জনৈক ওয়ার্ড কমিশনার।
কাব্যের অন্তরে সংগুপ্ত হৃদয়স্পর্শী গল্পের সংস্থাপন ইমতিয়াজ মাহমুদের কবিতায় দারুণ এক বৈশিষ্ট্য। বুননের ক্ষেত্রে পরম্পরা অক্ষুণœ রেখে তিনি গল্পটাকে ভাসিয়ে তোলেন মহাসমুদ্রে ভাসমান বরফের মতো। যার একটামাত্র তল দেখা যায়, অপরাপর তলগুলি রয়ে যায় দৃশ্যের অতীত। যে অদৃশ্যকে খুঁজবার প্রয়াসেই পাঠক লিপ্ত হন কবির কবিতায়। এক ঘনায়মান রহস্য তখন বাঙময় হয়ে উঠে পাঠকের অন্তর্পটে।
সূক্ষ্ম সংবেদনা ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা ইমতিয়াজ মাহমুদের মোক্ষম এক অস্ত্র। বর্ণনায় স্বল্পভাষ, প্রসঙ্গ— অনুষঙ্গের নিখুঁত নির্বাচন, পরিমিত কখন তাঁর কাব্যভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি।
আমি পরকালে চোখ রাঙা
রোগা
এক
মহিলাকে
মা মা বলে ডেকে উঠবো।
[ পাঠ করো হে পুরোহিত : সার্কাসের সঙ ]
কিংবা,
ভুল তার কবেকার অন্ধকার নেশা
মরণের গান গাওয়া শিশুটির পেশা,
…. …. …. …. ….. …..
যে কাঁদে কাঁদুক তবু লিখি ফুটনোট
ফুল তুই তেলাবিবে বোমা হয়ে ফোট।
[ ফুটনোট : মৃত্যুর জন্মদাতা ]
কবি কোথাও দ্রষ্টা, কোথাও বা জীবনরূপের ধারা ভাষ্যকার। তবে সানুপুঙ্খ বিবরণী তাঁর লক্ষ্য নয়। বরং জীবনের মর্মশ্বাসের সন্ধানলাভ তাঁর অন্বিষ্ট।
জীবিকার উৎকণ্ঠার কাছে
সবচেয়ে বড় মাছটাও ফালতু হয়ে যায়
এক জেলে আমাকে বলে— এমন কথা।
তার কথা অনুযায়ী মাছ ধরার চেয়ে মাছ
বিক্রি করে টাকা গোনার আনন্দই অধিক।
সে বলে জালপাতা খুব বিরহের কাজ।
[ জীবিকা : পেন্টাকল ]
জীবনের মর্মভাষ্য প্রদান করতে করতে কবি কখনো হাজির হন ক্রিটিক রূপে। তখন সমাজ ও মানুষের নানা ভান-ভনিতা, প্রবণতার উপরিত্বক খসে প্রকাশ হয়ে পড়ে দগদগে মাংসল ঘা। ইমতিয়াজ মাহমুদ তা খুবলে খুবলে দেখান নির্মোহ ভঙ্গিতে।
রাতের সংবাদের সময় এক মন্ত্রীকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করছিলাম।
তখন আপন মাহমুদ বললো, ইমতিয়াজ, আমি মারা গেছি আর আপনি হাসতেছেন!
…… ……. …….. ……. …….. ……. ………
পরদিন ভোরে তাকে নিয়ে একটা গদ্য লিখতে বসলাম।
‘আমি মারা গেছি আর আপনি আমার মৃত্যু নিয়াও ব্যবসা শুরু করছেন!’
[ আপন মাহমুদের মৃত্যু : নদীর চোখে পানি ও অন্যান্য কোয়াটরেন। ]
অন্যত্র,
খুন বন্দুক বোঝে না
বন্দুক খুন বোঝে না
মানুষ দুটোই বোঝে
ফলে বন্দুক খোঁজে।
[ অবুঝ : কয়েকটি কোয়াটরেন ]
কিছুক্ষেত্রে প্রচলিত ছন্দের নিরীক্ষা লক্ষণীয় হলেও, মূলত মুক্ত গদ্যের প্রতি পক্ষপাত ইমতিয়াজ মাহমুদের। তাঁর অধিকাংশ কবিতা সে সাক্ষ্যই দেয়। পূর্বেই বলেছি, বলবার বিষয় ও ভঙ্গিই তাঁর ভাষা গড়ে দিয়েছে। আর ভাষাই নিজ প্রয়োজনে অঙ্গীভূত করেছে জুতসই ছন্দকে। ফলে সিদ্ধান্ত টানতে পারি, ছন্দ ও ভাষাকে শাসনে রেখে নিরাভরণ গদ্যে পরিপাট্য রক্ষা করে ভাব এখানে পসরা সাজিয়েছে স্বয়ম্ভূ সত্তারূপে। ইমতিয়াজ মাহমুদ উসিলা হয়ে রইলেন কেবল।