তারাদের ঘরবাড়ি ।। প্রথম পর্ব ।। অলোকপর্ণা

১.
এরকম পুরোনো বাড়িতে আগে আসেনি ইন্দিরা। ভিতরে অন্ধকার পুষে চুপ করে বসে থাকা বাড়ি, দেওয়ালে আদর করে জমিয়ে রাখা শ্যাওলা। যেন কিছু দেখতে পাচ্ছে না এমনভাবে দেওয়ালে হাত রেখে রেখে এগোয় সে, একটু বাদে আলো আসে। ইন্দিরা বাড়িটার ছাদে এসে পৌঁছোয়। নীচু পাঁচিলের ছাদ, শিশুর মাথায় হাত রাখার মত পাঁচিলে হাত রেখে ঝুঁকে দেখে ইন্দিরা। পাশে কে যেন এসে দাঁড়াল,- মা কি? ইন্দিরা বুঝতে পারে না, কিন্তু দেখে কার্নিশ ধরে ঝুলে রয়েছে একটা দশ বারো বছরের ছেলে, বার বার ছাদে উঠে আসার চেষ্টা করছে।
মা বললেন, “তোল ওকে!”
ইন্দিরা পাঁচিল থেকে ঝুঁকে এক হাত বাড়িয়ে দিল। বাড়িয়ে দেওয়া হাত ধরতে যাওয়ার আগেই ছেলেটার হাত ফসকে গেল। ছাদ থেকে অনেক নীচে পড়ে গেল ছেলেটা।
মা বলে উঠলেন, “ধরতে পারলিনা তো!…”
মায়ের গলার হতাশা অথবা বাসের ঝাঁকুনিতে জেগে উঠল ইন্দিরা। বাস এসে দাঁড়িয়েছে বাড়ির স্টপেজে।
বাস থেকে নেমে ইন্দিরা ছাতা খোলে। রোদ খুব উজ্জ্বল হয়ে যায় যখন, চলতে চলতে ইন্দিরার মনে হয় না যে সে হাঁটছে। তার মনে হয় যেন সে বয়ে যাচ্ছে তাপের মত, মাটি থেকে এক দুই ইঞ্চি উপরে। মাটি থেকে দু- এক ইঞ্চি উপরে ভাসতে ভাসতে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছোয় ইন্দিরা। ছাতাটা আলগা সরিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনের বড় সাদা বাড়িটার দিকে। এর সাথে স্বপ্নে দেখা বাড়িটার কোনো মিল নেই।
 
উপরে উঠে আসতে ইন্দিরা দেখে পিকলুর ঘরের দরজা খোলা। ঘরের বাইরে থেকে পর্দা আলতো করে সরিয়ে সে দেখে নেয় পিকলু জানালায় দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে পুকুর ঘাট দেখছে। ইন্দিরা জানে এখন রত্না মাসির স্নানের সময়। পিকলু রত্না মাসিকে স্নান করতে দেখতে পছন্দ করে। গলায় অল্প আওয়াজ করে ঘরে ঢুকে আসে ইন্দিরা। পিকলু চমকে ইন্দিরার দিকে তাকায়।
কাঁধের ব্যাগ, ছাতা বিছানায় রেখে বসে পড়ে ইন্দিরা বলে, “খেয়েছিস?”
মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় পিকলু। আর কিছু না বলে জানালার পাশের চেয়ারে বসে পড়ে। তার চোখ তখনও পুকুর পারের দিকেই। ইন্দিরা ভাবে একটু আগে যে দশ বারো বছরের ছেলেটাকে সে স্বপ্নে দেখেছে সেটা কি দাদা ছিল?
ইন্দিরার চোখে পড়ে টেবিলের ওপর রক্তকরবী খুলে রাখা।
“তোর মনে আছে দাদা, সেবার ক্লাবে তুই রাজা হলি?”
পিকলু জানালা থেকে চোখ সরায় না।
“তোর মত রাজা হতে আমি আর কাউকে দেখিনি”, ইন্দিরা বোঝে পিকলু তার কোনো কথাই শুনছে না।
বাইরে কিছুর আওয়াজ পেয়ে পিকলু জানালায় আরো ঝুঁকে পড়ে।
“এইসব পাড়ার ফাংশনে রবীন্দ্রনাথ আর চলে না বুঝলি…” ক্লান্ত শোনায় ইন্দিরার গলা, “গতকাল আমি মায়ের সাথে দেখা করেছি”, সে দেখে পিকলুর দৃষ্টি স্থির হয়ে গিয়েছে জানালার উপর।
“মা ভালোই আছে, যেমন তুই বলতিস”
পিকলু ইন্দিরার দিকে ফিরে তাকায়, ইন্দিরা বলে, “মা তোর কথাও জিজ্ঞেস করল”
পিকলু আবার জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
“আমি কিছু বলিনি, এড়িয়ে গেছি”
পিকলু বাইরের দিকেই তাকিয়ে থাকে।
ইন্দিরা পিকলুকে দেখে। কাঁচাপাকা দাঁড়িতে ভরে আছে তার গাল। জ্যেঠুকে বলে সাধনদাকে আনাতে হবে, অনেকদিন হয়ে গেল পিকলুর চুলও কাটানো হয়নি।
“পরশুদিন আমি চলে যাচ্ছি দাদা”
“কোথায় যাচ্ছিস?” জানালা থেকে চোখ না সরিয়েই ঘড়ঘড়ে গলায় জিজ্ঞেস করে পিকলু।
“চাকরি পেয়েছি একটা, কোলকাতার বাইরে জয়নিং”
“আচ্ছা”
ইন্দিরা ছাতাটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলে, “আমি ঘরে যাচ্ছি, তোর কিছু লাগলে আমায় বলিস”
সে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে পিকলু জিজ্ঞেস করে, “আর তার কি হবে?”
ইন্দিরা পিছু ফিরে দাঁড়ায়, “কার?”
“যার সন্ধ্যেতারাটা তোর কাছে ছিল?”
 
কার সন্ধ্যেতারা কার কাছে ছিল মনে নেই আর। তাদের বাড়ির ছাদে এখন সন্ধ্যা নামছে, দূরের ওই তারাটাই কি সেই শুক্রগ্রহ? ছোটোবেলায় বাবা তারা চিনিয়ে দিয়েছিলেন, বিশেষ করে ধ্রুবতারা। ইন্দিরা মাঝে মাঝে ভাবে, অত আগ্রহ নিয়ে বাবা তাকে ধ্রুবতারা চিনিয়েছিলেন কেন? যাতে সে কখনও রাস্তা না হারায়?! একা ছাদে বসে থাকতে থাকতে সন্ধ্যা নেমে আসে। নিজের কাছে পড়ে থাকা সন্ধ্যেতারাটা আকাশে তুলে দিয়ে নীচে ফিরে আসে সে, তারাটার প্রয়োজন অজান্তেই ফুরিয়ে গিয়েছে।
নীচে নেমে ইন্দিরা দেখে ধীরেশ বারান্দায় বসে আছেন। ঘর থেকে জয়তীর হারমোনিয়ামের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
“জ্যেঠু, সাধনদাকে আজকালের মধ্যে আসতে বোলো, দাদার চুল দাঁড়ি অনেকদিন কাটানো হয় না”
ধীরেশ মাথা তুলে ইন্দিরাকে দেখলেন, পাশের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, “বস”
চেয়ারে এসে বসতে ধীরেশ বললেন, “সব গুছিয়ে ফেলেছিস?”
“না, কাল গোছাবো”
“কটায় ট্রেন?”
“বিকেল চারটেয়”
“ঘর ঠিক করা হয়েছে না ওখানে গিয়ে দেখে নিবি?”
“কয়েক জনের ফোন নম্বর আছে, সেগুলোয় ফোন করে ঘরের খোঁজ করতে হবে”
“আচ্ছা”
বারান্দায় চুপ করে বসে থাকে দুজনে।
কিছুক্ষণ পর ধীরেশ বলে ওঠেন, “ফিরিস না বুঝলি তো, যদি সুযোগ পাস, আর কখনও ফিরে আসিস না এখানে”
ইন্দিরা কিছু বলে না।
“আমি, পিকলু, তোর বাবা, বা জয়তী সবাই যেমন আছি তেমনই থেকে যাবো”
ইন্দিরা মাথা নিচু করে মেঝের মোজাইকগুলো দেখে। এত চেনা মোজাইক, আর তার প্যাটার্ন, ইন্দিরা না দেখেও এঁকে ফেলতে পারবে। গত তেইশ বছর ধরে যে ছকের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে সে, কোনোদিন তা ভোলা সম্ভব নয়।
“জানিস তো, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের সবার যেন কোনো অতীত নেই। যেন আমরা কোনোদিন জন্মাইনি, শুরু থেকেই যেন এই বারান্দা, শুরু থেকেই যেন এই চেয়ার, এই ঘর, চৌকাঠ, সিঁড়ি। বর্তমান, আমাদের শুধুমাত্র বর্তমান আছে। তুই যদি ফিরেও আসিস, দেখবি আমি তখনও এই চেয়ারেই বসা। পিকলু পিকলুর ঘরে। জয়তী একা একা ওর হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসে আছে তখনও। কিচ্ছু বদলায়নি।” কিছুটা বিরতি নিয়ে ধীরেশ আবার বললেন, “তুই ফিরিস না আর। বুঝলি?”
ইন্দিরা কোনো উত্তর দেয় না। কিছুক্ষণ পর জয়তীর হারমোনিয়াম থেমে যায়। ইন্দিরা উঠে আসে জয়তীর ঘরের সামনে। জানালা দিয়ে দেখে ঘরের ভিতর হারমোনিয়ামের সামনে বসে আছে জয়তী। পিসি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যত্ন করে বেঁধে রাখা মাথার কাঁচাপাকা চুলগুলো এখন এলিয়ে পড়ে আছে হারমোনিয়ামের রিডের ওপর। জয়তী কিছুই করছে না।
জানালায় চোখ রেখে ধীরেশের উদ্দেশ্যে ইন্দিরা বলে, “সাধনদাকে বোলো এবার জয়তীর চুলগুলোও যেন কেটে দিয়ে যায়, এইভাবে কতদিন তোমরা…”, মুখ ফেরাতে সে চুপ হয়ে যায়, ধীরেশের চোখ জানালা দিয়ে গিয়ে পড়েছে জয়তীর গায়ে, পরম মমতায়। ইন্দিরা কিছু বলতে পারে না আর।
 
ভোরের দিকে কেউ কেউ আরো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। আবার একটা শুরুয়াৎ তাকে হন্যে করে দিয়ে যায়। আরো একটা নতুন দিনের জন্য তৈরি না থেকেও সে জেগে ওঠে। ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় ইন্দিরার। চোখ বুজে বিছানায় পড়ে থাকে সে কিছুক্ষণ। তারপর চোখ খোলার চেষ্টা করে। মনে হয় কেউ যেন আঠা দিয়ে তার চোখের পাতাদুটো আটকে দিয়ে গেছে। যেন সেই মানুষটা চাইছে না এই দিনটা আসুক। ইন্দিরা হাত নাড়ানোর চেষ্টা করে। অনেক চেষ্টা করেও একটাও আঙুল নাড়াতে পারে না। অসহায় ভাবে গলা তুলে জ্যেঠু বা বাবাকে ডাকার চেষ্টা করে সে কিছুক্ষণ, গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না, নিজের ঠোঁট পর্যন্ত নাড়াতে পারেনা ইন্দিরা। সে টের পায় কেউ একজন ঘরে এসেছে। চিৎকার করে ওঠার চেষ্টা করে ইন্দিরা, আর তখনই সে জয়তীর গলা শুনতে পায়, “তুই না কি চলে যাবি?”
ইন্দিরা প্রাণপণে কিছু বলার চেষ্টা করে।
“তুই যেখানে যাবি, সেখানে কাক আছে?”
নিজের ভিতর নিজে ছটফট করে ওঠে ইন্দিরা।
জয়তী বলে, “আমার কথা ভুলে যাবি না তো? আমার আর তোর কথা?”
ইন্দিরা স্থির হয়ে যায়। সে টের পায় জয়তীর এক হাত তার মাথার চুল ছুঁয়ে যাচ্ছে।
একটু পরে জয়তী উঠে পড়ে ইন্দিরার পাশ থেকে। ইন্দিরার বিছানা থেকে একটু দূরে গিয়ে ফিরে দাঁড়ায়, ইন্দিরা শুনতে পায় জয়তী ফিসফিস করে বলছে, “ভালো থাকিস বুঝলি… একা থাকিস।”
তখনই এক ঝটকায় নিজেকে জাগিয়ে তোলে ইন্দিরা। ঘামতে ঘামতে বিছানায় উঠে বসে দেখে ঘরে কেউ নেই।
 
সকালে ঘুম থেকে উঠে জামাকাপড় আর দরকারি কিছু জিনিস গুছিয়ে নিতে শুরু করে ইন্দিরা। গোছাতে গোছাতে জামাকাপড়ের থেকে বইয়ের সংখ্যা বেশি হয়ে যেতে যায়। পড়ে থাকা ম্যাগাজিনগুলোর প্রতি এতই মায়া হয় যে, ইন্দিরা ঝুঁকে পড়ে তাদের গায়ে হাত রেখে বলে, “পরের বার এসে তোদেরও নিয়ে যাবো।”
দরজায় আওয়াজ হয়, বাবার গলা শোনা যায়, “আসবো?”
“হ্যাঁ,”
ঘরে ঢুকে অপরেশ কিছুক্ষণ ব্যাগ তিনটের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর বলেন, “কি বলতে যেন এসেছিলাম… হ্যাঁ, বাপিকে বলে দিয়েছি, কাল দুটোর সময় ট্যাক্সি নিয়ে আসবে, তুমি যেতে পারবে তো একা?”
ইন্দিরা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।
“সেরকম হলে বোলো, দাদা যাবে তোমার সাথে”
“না, জ্যেঠুর যাওয়ার দরকার নেই, আমি পারব একা যেতে”
অপরেশ মাথা ঝাঁকান আলতো করে। “সব গোছানো শেষ?”
“হ্যাঁ”
“টাকা লাগবে কিছু?”
“না”
“যাওয়ার সময় একবার দিদির ছবিতে প্রণাম করে যেও”
“আচ্ছা”
“আর কিছু লাগলে দাদাকে জানিও”, বলতে বলতে অপরেশ বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থেকে ইন্দিরা অস্ফুটে বলে ওঠে, “ধ্রুবতারাটা…”
 
বিকেলের দিকে ইন্দিরা একা একা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অনেকটা দূর অবধি গিয়ে কাঠের ব্রীজে এসে থামে। ব্রীজের সাথে সমান্তরালে চলে গিয়েছে রেল লাইন, মধ্যমগ্রামের দিকে। ব্রীজ শেষে বেশ কিছু চালাঘর। সেই সব ঘরের মাথা থেকে উনুনের ধোঁয়া উঠে আসছে। শীতের বিকেলের শ্বাসরোধ করে দিতেই যেন ওই ধোঁয়া থেকে কুয়াশা তৈরি হয়ে কাঠের ব্রীজটাকে আষ্টেপিষ্টে আগলে নিচ্ছে। সাইকেল হাটিয়ে নিয়ে ব্রীজের মাঝ পর্যন্ত এসে দাঁড়িয়ে পড়ে ইন্দিরা। সামনের অন্ধকারে খালের পুরো শরীরটা ডুবে রয়েছে, অল্প কিছুদূর গিয়েই ইন্দিরার দৃষ্টি হারিয়ে গেল তাতে। আন্দাজে ইন্দিরা জানে কিছুদূরে কচুরিপানার রাজ্যে জেগে আছে সরস্বতীর বরাভয় মূদ্রা, বা কার্তিকের ময়ূরের পালক। মজে যাওয়া খালে কাছেদূরে এভাবেই দেব দেবীরা বাসা বেঁধে আছেন। তারও খানিক নীচে হয়তো অন্ধকার জলে কিছু অন্ধ মাছ বয়ে যাচ্ছে। কুয়াশার মত জলে পাক খেতে খেতে মাছগুলো মধ্যমগ্রাম পেরিয়ে বারাসতের দিকে চলে যাচ্ছে। যেমন ইন্দিরাও চলে যাবে কাল, অন্য কোনোখানে। চলে যেতে ঠিক কেমন লাগে? তা সে এখনও জানেনা। এযাবৎ অন্যদের প্রস্থানই দেখে এসেছে সে।
পিছনে হঠাৎ খুব আওয়াজ করে একটা লোকাল ট্রেন বনগাঁর দিকে চলে যায়। কচুরিপানা ঢাকা জলে তার কোনো ছায়া পড়ে না।
 
বাড়ি ফিরতে একটু রাতই হয় ইন্দিরার। জয়তী ততক্ষণে হারমোনিয়াম ছেড়ে আয়নার সামনে গিয়ে বসেছে। ইন্দিরার ছায়া সেই আয়নায় পড়তে জয়তীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
“আজ ভোরে আমার ঘরে গিয়েছিলে?”
যেন ধরা পড়ে যাবে এমন ভয়ে ভয়ে জয়তী ধীরে ধীরে মাথা নাড়ায়।
“আমায় ডাকলে না কেন?”
“তুই তো ঘুমোচ্ছিলি!”
ইন্দিরা জয়তীর পিছনে বিছানায় বসে পড়ে। জয়তী অনেকক্ষণ ধরে কপালে একটা গোল সিঁদুরের টিপ এঁকে চলেছে। টিপে আঙুল বোলাতে বোলাতে সে বলে, “তুই যেইখানে যাচ্ছিস সেই খানে গোলাপি ফুল আছে?”
ইন্দিরা মাথা নাড়িয়ে বলে, “হয়তো আছে…”
“আমায় এনে দিবি? মাথায় পরবো… তোর জ্যেঠু খুব ভালোবাসে বুঝলি, আমার চুল”
ইন্দিরা চুপ করে বসে থাকে, তারপর বলে, “এনে দেবো”
টিপটা বড় হয়ে জয়তীর পুরো কপাল ছেয়ে ফেলেছে প্রায়। জয়তী বলে, “শুনছিলাম তুই সাধনকে এনে আমার চুলগুলো কাটিয়ে দিতে বলেছিস, সাধনকে বারন করিস কাটতে বুঝলি তো, তোর জ্যেঠু কষ্ট পাবে খুব আমার চুলগুলো না থাকলে”
ইন্দিরা মাথা নাড়ায়। জয়তীর সামনে ড্রেসিং টেবিলে এখনো ধীরেশ আর জয়তীর বিয়ের একটা ফটো ফ্রেমবন্দী করে রাখা আছে। সেই ফটো থেকে জয়তী ভাসা ভাসা চোখে ইন্দিরার দিকে তাকিয়ে আছে, যার সাথে আয়নায় ছায়া পড়া জয়তীর কোনো মিল জ্ঞানত ইন্দিরা খুঁজে পায়নি। জ্যেঠুদের বিয়ের পর কি যে হয়েছিল, সে জানে না। কেন ইন্দিরা জয়তীকে তার নাম ধরে ডাকে তাও জানা নেই তার। তার জ্ঞানত জয়তী এই রকমই,- এক আয়নাময় মানুষ। হারমোনিয়াম না থাকলে আর ঘুমের সময় ছাড়া দিনের পুরোটাই জয়তী আয়নার সামনে কাটায়। এত কি দেখার আছে আয়নায়? ইন্দিরা ভেবে পায়নি। তাই বাকিদের মত সেও তাকে লুনাটিকই মনে করে।
চলে আসার জন্য উঠে দাঁড়ায় ইন্দিরা, জয়তী তার হাত চেপে ধরে।
“কি?”
“দাঁড়া একটু”
উঠে গিয়ে দেরাজ থেকে খবরের কাগজে মোড়া কি যেন একটা বের করে সে ইন্দিরার হাতে দেয়।
“এইটা সব সময় কাছে রাখবি, কখন কাজে লাগবে তুই নিজেও জানিস না”
খবরের কাগজের মোড়ক খুলতে একটা ছোট ছোপ পড়া গোল আয়না দেখতে পায় ইন্দিরা। মুখের সামনে তুলে ধরতে তার নিজের মুখ তাতে আবছা ভাবে জেগে ওঠে। অনেক দাগ, অনেক ছাপ পেরিয়ে ইন্দিরা নিজেকে দেখতে পায়।
 
মাঝের ঘরের ছাপ পড়া দেওয়ালটার উপরের দিকের একটা হুক থেকে ঝুলে আছেন পিসি। ইন্দিরা মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকাল। পিসি সোজা তাকিয়ে থাকলেও তাঁর চোখ যেন অনেক দূরে কোথাও গিয়ে পড়েছে। এদিক ওদিক তাকিয়েও ইন্দিরা ঠাহর করতে পারে না, পিসি ঠিক কি দেখছেন। মাথা নীচু করে চোখ বুজে পিসির কথা ভাবতে থাকে সে। আজ তিনি বেঁচে থাকলে অন্তত সাত আটটা ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ছাড়তে হত তাকে। ইন্দিরা পিসির গায়ের গন্ধটা মনে করার চেষ্টা করে, মনে পড়ে না, শীতের দুপুরের গন্ধ ঢুকে আসে তার নাকে।
বারান্দা থেকে ধীরেশ বলে ওঠেন, “এই, বাপি এসে গিয়েছে কিন্তু, আর দেরী করিস না।”
চোখ বুজেই ইন্দিরা আস্তে আস্তে বলে, “যাই বলতে নেই। আসি।” ঠিক যেভাবে পিসি বলতেন।
বারান্দায় এসে জ্যেঠুকে প্রণাম করে উঠতে ইন্দিরা দেখে পাশের ঘর থেকে জয়তীও বেরিয়ে এসেছে। জয়তীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ায় ইন্দিরা।
“মনে আছে তো কি বলেছিলাম?”, অনেক আগ্রহসহ জয়তী ইন্দিরার চোখে চোখ রাখে।
“ফুল তো?”
“না, না। আয়না! মনে রাখিস কিন্তু!”
ইন্দিরা মাথা নাড়িয়ে এক এক করে ব্যাগ তুলে নেয়। দাদার ঘরের সামনে এসে পৌঁছোতে দেখে, দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। এক হাত তুলে দরজায় নক করতে গিয়েও পিছিয়ে আসে ইন্দিরা, দরজার পাশে ঝুলতে থাকা রবীন্দ্রনাথের ছবিটা নামিয়ে নেয়, জ্যেঠুকে বলে, “ফোন কোরো আমায়।”
সিঁড়ি দিয়ে অর্ধেক পথ নেমে আসার পরে একবার পিছু ফিরে তাকায় ইন্দিরা। জয়তী ফিরে গিয়েছে, জ্যেঠু একা দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির মুখে। তাঁর মুখে কোনো আলো এসে পড়ছে না বলে তিনি ইন্দিরাকে দেখছেন কি না বোঝা যায় না। কিছু না বলে ইন্দিরা বাকিটা নেমে আসে।
বাপিকাকু নিজের মত ব্যাগ ভরে ফেলেছেন গাড়িতে।
রবীন্দ্রনাথের ছবি হাতে ইন্দিরা ট্যাক্সিতে উঠে বসে একবার উপরের বারান্দার দিকে তাকায়। উঁকি দিয়ে ফাঁকা বারান্দা দেখে বাপিকাকু বলে, “একটু দাঁড়াবো নাকি…”
“নাহ্‌ চলো।”
শহরের বুক চিড়ে হলুদ ট্যাক্সি হাওড়া স্টেশানের দিকে এগিয়ে যায়। জানালা দিয়ে ইন্দিরার ভিতরে যেন অগুনতি হাওয়া ঢুকে আসে, ভিতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা হয়ে যায়। ইন্দিরা ভাবে, চলে যেতে হয়তো এমনই লাগে,- হাওয়ার মত।
 
খড়গপুর পার হতে ইন্দিরা বইয়ের ব্যাগ খুলে বসে। সাইড লোয়ার বার্থে তার উল্টোদিকে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ, তাঁর চোখ জানালা দিয়ে বাইরে দূরে কোথাও চলে গিয়েছে। একটু পরে একটা পাতলা মতো বই ইন্দিরার হাতে উঠে আসে। বইটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে সে, তারপর মুখ তুলে রবীন্দ্রনাথকে দেখে, ফটোফ্রেমের কাঁচের উপরে তখন দ্রুত বেগে গাছগাছালি ছায়া ফেলে ফেলে সরে যাচ্ছে, তাই চোখাচুখি হয় না। ইন্দিরা বইটা মুখের সামনে তুলে ধরে, তার প্রথম পাতায় লেখা,
 
                         “অমিত আর লাবণ্যর মাঝে যতখানি রাস্তা পড়ে আছে…”
                                                                                  – রঞ্জনা।
 
শেষের কবিতা পড়তে পড়তে কখন সন্ধ্যেতারাটা জানালার কাঁচ বেয়ে ইন্দিরার কপাল পর্যন্ত উঠে এসেছে, ইন্দিরা নিজেও জানতে পারে না। এক অন্ধকারের মধ্য দিয়ে শেষের কবিতা হাতে ইন্দিরা এগিয়ে যাচ্ছে, কোলকাতা থেকে অনেক অনেক দূরে। দ্রুতবেগে।

(চলবে)
শেয়ার