নির্বাচিত ২৫ কবিতা ।। সব্যসাচী সান্যাল

প্রিয় পিয়ক্কড় কাব্যগ্রন্থ থেকে

১.

প্রিয় সম্পাদক,

“আমাকে বুঝতে গেলে জটিলতা অর্জন কর। সারল্য তোমাকে সারাতে পারত, সেই সব দিন চলে গেছে”—এ’ভাবে বলতে পারতাম, গানের লাইন হিসেবেও মন্দ নয়—তবে বিনয়ে বাধে। বরং এ’ভাবে বলি, আমার কবিতার একমাত্র কাজ আমার একাকীত্বকে সন্দেহ করা। আত্মপক্ষের বাঁট ঘুরিয়ে দিয়ে অন্ত্রে ঢুকিয়ে দেওয়া ফলা। রেটরিক বলতে প্লেটোর কথা মনে পড়ার ছিল অথচ আমি ট্রটস্কির কথা ভাবছিলাম এমন কী বুড়ো শরীরে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা অটোইমিউনিটির কথা। আসলে ইতিহাস থেকে, প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়ার কথা মগ্নতার কথা ভাবতে পারি না। প্রদাহ ও শীতলতার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রেখা আমাকে আশ্চর্য্য করে— আমি হতবাক দেখি তার আপাত সারল্য অথচ তার কোষ ও কণার কী চূড়ান্ত জটিল ভারসাম্য…

 

২.

প্রিয় সম্পাদক,

আমি বেড়াতে এসেছি, আপনার ও আমার অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে এসেছি—এখানে কুড়িয়ে পাচ্ছি রজঃস্বলা ঝিনুকের সারি, মুক্তোর ক্রিস্টালিনিটি থেকে দূরে, আরো দূরে। প্রিয় সম্পাদক, মানুষের ইতিহাস বলে সভ্যতার পূর্বে সে তার গুহাবাসি আঙুল তুলে এনেছিল একাধিক ঊরুসন্ধি থেকে আর গুহার দেয়ালে নানা রসের স্থিরচিত্র এঁকেছিল যা ব্ল্যাকলাইটেই কেবল দৃশ্যমানতা পায়—সে শবর ছিল, জুগাড়ু ছিল—এক চড়ুইভাতির দিনে বন্ধ হল্ট স্টেশানে এসে সে মদের হাঁড়ির খোঁজ পেল—আর নেশার জোগাড়ের জন্য কৃষিকাজের কথা ভেবে উঠল। এর পর সম্পত্তির কথা আসে, উত্তরাধিকারের কথা—এই সূত্রে তার বৃন্দযৌনতার থেকে সরে আসা। আমি যে আমার উত্তরাধিকারের জন্যে মানুষের মন থেকে সমাজ থেকে সরে আসব—এও তো স্বাভাবিক, আর যা স্বাভাবিক তাকে নিয়ে আর যাই হোক যুক্তিগ্রাহ্যতার কথা বলবেন না, প্লীজ।  প্রিয় সম্পাদক, আমাদের অবস্থানগত পার্থক্যের মধ্যে বেড়াতে বেড়াতে আমি কাচের ওপারে দেখতে পাচ্ছি মানুষের স্বভাব কাঁচা পেঁপের মত সবুজ—নক্ষত্রের জন্য উদ্দিষ্ট তাদের গানগুলি একের ওপর এক জমে উঠছে—গণনার জন্য অপেক্ষা করা টাকার বান্ডিলের মত…

 

৩.

প্রিয় সম্পাদক,

আচমকা শেষ হয়ে যাওয়া রেখা, তট এই সব আমার প্রক্রিয়া—জানেনই তো আয়ু থেকে সময় বার করে লিখতে হয়—প্রজ্ঞা মাত্রেই কাউন্টার-প্রোডাক্টিভ এটা বোঝার জন্য প্রজ্ঞা অর্জন করার প্রয়োজন হয় না—যখন সর্বনাম সমেত পিঠ ঠেকে যায় দেয়ালে—তখন মেঘ কাটে, মানুষ দেখতে পায় রেসভেরাট্রল নিয়ে ৯০% গবেষণা স্পন্সর করছে ক্যালিফোর্ণিয়ার ওয়াইন ইন্ডাস্ট্রি। বাই দ্য ওয়ে দেশী সূলা যথেষ্ঠ ভাল কাবার্নে বানায়—তথাপি আমি কারাকাসের মত খোয়া ওঠা রাস্তার গন্ধ, বৃষ্টিতে পীচফল মেশানো গন্ধের ওয়াইন অন্যত্র খাইনি কখনো—অবশ্য পাসপোর্ট খুলে ভেনিজুয়েলা’র অভিজ্ঞান দেখাতে পারব না—বলে রাখা ভাল ক্যালিফোর্ণিয়ার কার্লো রোসি ওয়াইনে আমি কেবল কেরুয়াক,ভ্যাগাবন্ড আর অড্রি হেপবার্নের ফ্লেবার পেয়েছি—থাক সে প্রসঙ্গ, বরং সর্বনামের কথা কেন এল সে নিয়ে বলি— বলি, আমার প্রতিফলন ওয়াইন খেতে ভালোবাসে, আর আমি ওয়াইন খাই না— অ্যাসিডিটি হয়। আয়নায়, বিছানায়, বাথরুমে, রান্নাঘরে নৈমিত্তিক অম্লস্বাদের মধ্যে হাটুরে ক্লান্তি নিয়ে জেগে ওঠা–দৃশ্য থেকে বাইশগজ দূরে হেলমেট ছাড়া, অ্যাবডোমেন গার্ড ছাড়া… এই আমার কবিতার ইম্পেটাসটুকু —আর এও যে কাউন্টার-প্রোডাকটিভ সে নিয়ে আপনার অ্যাটলিস্ট সন্দেহ থাকার কথা নয়…

 

৪.

প্রিয় সম্পাদক,

ফ্ল্যাটবাড়ির জানলা থেকে দেখতে পাচ্ছি—কালো পাতার ফাঁক দিয়ে মূর্ত হয়েছে রাস্তা, ট্রাফিক, বৃষ্টি। ব্যালকনিতে দুজন অ্যাডাল্ট কথা বলছে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে, যোগাযোগের ফাঁকফোকর নিয়ে—কেতাবি সিন্ট্যাক্স ক্রমশ ডিসজয়েন্টেড হয়ে উঠছে—ঘোরাফেরা করছে আশার মধ্যে হিস্টিরিয়ার মধ্যে—এই সান্দ্রতার ভেতরে কখন যে একটা দরদালান আকাশে চারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করবেন এইখানে ফায়ারপ্লেসের পাশে যদি ভঙ্গুরতার কথা, আবছা হয়ে ওঠার কথা মনে পড়ে… জানি আপনি বলবেন মীথের ভিতরে ঢুকে গল্প আর ক্লিশে হয়ে উঠে কবিতা পরিণতি পায়। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, নিষ্পত্তি কাম্য নয়– কবিতা তো সন্তানের দিকে স্নেহে মুচড়ে ওঠা পুরুষস্তন। ফলে যোগাযোগের কথা, চক্র সম্পূর্ণ হয়ে ওঠার কথা এই সব নিয়ে ভাবি না সম্প্রতি—বরং বিষয় থেকে বিষয়ে ছুঁয়ে যাই আঙুল– যেটুকু চামড়ার গন্ধ উঠে আসে, যেটুকু অসুস্থতা তার্পিনদাহ্যতা নিয়ে ফিল্মরোলের মধ্যে, ধ্বনির মধ্যে, মধু ও ক্ষারের ভেতর ঢুকে যায়…

 

৫.

প্রিয় সম্পাদক,

আলো তো সঙ্ঘাত
প্রিজমের ক্ষত থেকে
অনিচ্ছা থেকে ঠিকরে ওঠা
ব্যথা ও উন্মেষ

আলো বলতে আমি দোনোমনার কথা বুঝি, কখনো এক হলুদ প্রতিধ্বনির কথাও ভাবি যে ভেড়াদের নৃশংস চৌকো দাঁতের দিকে এগিয়ে দেয় রেটিসেন্ট নেকড়ের দাবনা। প্রিয় সম্পাদক আলো বলতে আমি দেখতে পাই, পার্কে, বুলেভারে, ফাঁসে, বুঁদির রায়তায়, রক্তের মধ্যে গজিয়ে ওঠা অসংখ্য কনফেশান বুথ— অভ্যাস মত আস্তিন খুলে উন্মুক্ত করি তাস আর জন্মান্তরের উল্কি—আলো বলতে আমি পাশের গলির থেকে শুনতে পাই অবিশ্বাস্য জড়তা নিয়ে কে যেন বলছে—হাম কা ছোড় দে গোরি, হামার ধরম লেই যা…

 

৬.

প্রিয় সম্পাদক,

“বাস্পের খাঁচার ভিতর তুমি এক বাইশে শ্রাবণ”, অথবা “তোমাকে করি না, তাই তুমি কি করিনা?”—এরকম লিখতে পারতাম কিন্তু লিখতে পারছি না। আমাদের নরম সরম মাটি, মনোবেদনায় টইটই করে—বেদনার থেকে গড়িয়ে পড়ে স্নেহ—আর স্নেহের নীচে সব থাকে—শ্যাওলা, পাথর, পোকা মাকড়, মানুষের বিকার—এই চিরন্তনের মধ্যে থ্যাঁতলানো টিকটিকির মত আমায় থেকে যেতে বলবেন না প্লীজ। আমি তো ভাত খাচ্ছি, ডাল খাচ্ছি, মাঝে সাঝে চুমুটা আঁশটা যে খাচ্ছি না তাও নয়—তবে নবনীতে নেই—বরং ভুট্টা ক্ষেতে কশ ছড়ে গেলে বুঝি জিভ এখনো হারায়নি স্পৃহা। ফলে জিভের কথাই লিখি, দাঁতের কথাই লিখি নরম সরম করে মিডলাইফ ক্রাইসিসের কথা লিখি—যা একমাত্র কবিতা লিখতে বসলে টের পাই। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প কেবল অভ্যাসের বাইরেই গড়ে ওঠে—প্রাকৃতিক উপাদান নিয়েও সে প্রকৃতির থেকে বিচ্যুত হয়ে বেড়ে ওঠে—ফলে আমি নিজেকে লিখি না, নিজের স্বভাব থেকে দূরে এক অপরিচিতের কথা লিখি…উদ্ধৃতিচিহ্নের থেকে ছাড়িয়ে আনি বস্তুর চিৎকারটুকু—তাকে লিখি…

 

৭.

প্রিয় সম্পাদক,

কখন যে ধাতু হয়ে উঠলো বাতাস, জ্যোৎস্নায় ঢুকে গেল পাথরের স্পেসে—সেইখান থেকেই এ’লেখার শুরু—এ’লেখার শেষটুকু সেখানেই যাবে। এর চেয়ে অলংকার সোজা,এমনকী যাদু-বাস্তব নিয়ে, রূপক নিয়ে আমাদের নড়াচড়াও কখন প্রাঞ্জল হয়ে আসে—পংক্তির ছিলা কাঁপে, ভাব কাঁপে—কাঁপুনি সাঙ্গ হলে রিসাইক্লিং-এর দিন ফেরে। প্রিয় সম্পাদক,আমি দেখতে পাচ্ছি শেষ বলে কিছু নেই,ঘন্টা রিপিট করছে ঘন্টাকে,কুন্ঠা রিপিট করছে কুন্ঠাকে—রেললাইনের পাশে প্রশ্নচিহ্নের ফিরে ফিরে আসা…এ’টুকুই যৌনতা,এ’টুকুই জাউভাত আমার…

 

৮.

প্রিয় সম্পাদক,

বিষন্নতা এক জরুরি অবস্থা। বিষন্নতার দিনে নিখুঁত করে দাড়ি কাটা যায়। সমস্ত আয়নাই সেদিন উত্তল, জলও উত্তল। আমি জল ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নজরুলগীতির ও’পারে চলে যাই। যারা বলে বিষন্নতা এক জরুরি অবস্থা—ভালো লোক তারা। আমাকে পাটপাট টেবিলে বসায়, চীজ ওমলেট খেতে দেয়। মাখন আর মাশরুমের গন্ধ হেঁটে বেড়ায় রুমালে, বাথরুমে, ওডিকোলোনে। যারা বলে বিপন্নতা এক জরুরি অবস্থা—ভালো লোক তারা। গরম জলে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে যত্ন করে হাত-পা মুছিয়ে দেয় আমার ক্ষয়াটে জিন্স টি শার্ট খুলে পরিয়ে দেয় পরিপাটি শাদা রাতপোষাক। বেডসাইড টেবিলে বেল-ফুল রেখে আলো নিভিয়ে দেয়। ভালো লোকেরা এরপর দেয়াল থেকে একটা একটা করে আমার সমস্ত ছবি নামিয়ে ফেলে, বাথরুমের দেয়াল থেকে, টিস্যু পেপার থেকে ঘষে ঘষে আমার সমস্ত কবিতা মুছে ফেলে।

 

৯.

প্রিয় সম্পাদক,

অমন করে কে আসে এক লাইন ভ্রমণে তো এক পংক্তি ঘরফেরা? মানুষ হাসে, আর দূরত্বের সূচনা তাকে আলগোছে ছোঁয়—চিবুকে কপালে। বিন্দু থেকে একচিলতে তার মনোনিবেশ নথে—ঝিকিয়ে ওঠে জল আর বিকার কাঁপিয়ে দিয়ে স্টীমার চলে যায়। উপলক্ষ্যের কাছে। এই আমাদের বিনত ছাউনি যাকে তুমি দুচোখে হারালে, কিছুটাক লাঞ্ছনাও দিলে… অথচ দেখনি তুমি ধীর ও অনড় জলের ওপরে শুধু ভারী কালো মেঘ দীপ্যমান হয়। আমাদের আমতলা জামতলা সমস্ত ছোট হয়ে আসে, বেড়ে ওঠে দরজার খিল। দূরের জানলা দিয়ে দেখি কে যেন সম্পর্কের মত ধীরে চলে যাচ্ছে…

 

           বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

                                         স্বদেশ সেন

 

স্বদেশ থেকে—

১.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

রাত্রি নামছে

কুকুরের ডাক এসে

গেঁথে যাচ্ছে বন্ধ জানলায়

ছবি হয়ে উঠছে

দৃশ্য বলতে এটুকুই ছিল

 

ছায়া বাদ দিলে ছবিকেও শূন্যতায় পায়

–একথা জেনেও তুমি

ছায়ার শরীর থেকে সরিয়ে রাখলে

ধার ও কাঁপন

 

একমাস নদীতে ড্রেজিং চলেছিল

গতকাল উপচানো পাড়ে  পলি ও বালির স্তুপে

আমাকে দেখিয়েছিলে

 

তামার আঙ্গুলে ধিকিধিকি হাড়ের আংটি

 

২.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

দীর্ঘ ও কঠিন  প্রাক্কালে

ইউরিনাল থেকে মোরগ ডাকছে—অভিলাষ অভিলাষ

 

এত বৃষ্টি হয় আর এত সমস্যা জীতে জাগতে ভেলোরের

টিকিট কাটে     রঞ্জন কাটে   রশ্মিও কাটে

মশারি খুলে চুপিসাড়ে পর্দার  ফাঁক দিয়ে

চারিয়ে নেয় ভাষা

সে তো বোবা ও বধির–

কাঠের ঈঙ্গিতে

কশাইকে বলে—চর্বির লেয়ারটা থাক বুঝলে

মধু মাখানো হলে জোর তাপে ওটাই ক্যারামেল

ভেতরে টসটসে বাইরে কড়ুয়া ক্রাস্ট

 

আমাকে করলে না ভালো

ভালো করলে নারে ভাই এই বাঞ্চোত বসন্তে

ফ্রীজার খুলতেই বেরিয়ে পড়লো একটা তুন্দ্রাবন

 

তন্দুর থেকে মোরগ ডাকছে—অভিলাষ অভিলাষ

 

৩.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

শীতের প্রাক্কালে ঘুঘু ডাকছিল –টারটল ডাভ

ওদিকে কিছুটা তো

ফাঁদ ও ডেকেছিল

 

মাতমে কাতানে বেনারস থেকে আলগা ডেকেছিল

ঘুণ ও চলন আর মলিন মলম

আমি তো ইমোশানে  গুটিয়ে গেলাম

এমনকি শিশ্নসমেত         বাতাবরণে

 

ঘামে    মোটা হাওয়া বসল অকস্মাৎ

রূহ আর রূহ

আর মানে ঘিয়ের চাপাটি

কাঁচা অরহড় দাল – রসুনে রসুনে

খিদে পায়  বাঞ্চোত  বসন্তবনে

 

ডাগর বসন্ত         আমি

শীর্ণতার ভেতর নামিয়ে দেখছি পা

গভীরতা কতটা ডিসেপ্টিভ

ভাবনার ইকোগুলি

ফিরে আসছে

 

দুপুর গড়িয়ে ক্ষীণ     বসন্তপর্যায়

সেও স্নান ফান সেরে  উঠে আসছে

ফাঁদ থেকে

 

৪.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

অথচ বাগানের কান ঘেষে  উড়ে গেল বেলুন

মেডিক্লেম ছুঁড়ে দিয়ে গেল

কিছুটা হেলান ছুঁড়ে দিল

সটান চেয়ারে

 

মোমের মানুষ আর তার

মোমের আঙুল  ঘষা কাচ আর

এক অস্পষ্ট চন্দ্রোদয় ৭টা ২২শে

তরঙ্গ এল       কিছুটাতো ধরা পড়ে

 

মেলাতে মেলানোতে    রেডিও স্টেশন

থেকে কুকুর ডাকছে, হাড্ডি ডাকছে

এমন কী কামড় থেকেও

 

একটা প্রভূত ডাক ওঁত পেতে ছিল

আউটডেটেড স্তনে  আর একটা

অথচ  নিয়ে  আশা ছিল  সংবেদ ছিল

তবু করলে না ভালো

 

৫.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

ওদিকে তো ক্রিস্টাল হিম সেটল করছে কাশগড়ে

চিনিবাগে   উইঘুর বাজার থেকে থৈ থৈ করছে   আহত

খচ্চর সামোভার  হান কেরানীর বুটে

                                       অভ্যস্ত ফাটল

 

যেমন হত্যার কাছে এসে নিসংশয় হয় শিল্প

তেমনই নিভৃতি ঘাড়ে  ফুলে ফলে অন্তরীন হলে

একটা বিকেল গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে

রেশম রূটের ওপর উড়ছে তোমার সুতির শার্ট

 

যেন গাজন থেকে কার্তিকের মিথগুলো গুজ্জর

অধ্যুষিত পাহাড়ে নামল

 

শেষবার গ্রীকসেনা এখানেই দেখেছিল আগুনের

ছায়া আর রেশম ঘাঘরায়  দৃঢ় ও সংবদ্ধ  নিতম্বশ্রেণী

 

৬.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

রাঢ়ের আঁচল থেকে বিহারের দিকে

ফিরে এলে

কার্পণ্য নিয়ে কিছু নিপুণ ব্যবহারে

স্মিতকথনের মত এলে

 

বাবলা-কাঁটায় বিদ্ধ হচ্ছে রোদ

জলার ওপরে চুঁইয়ে পড়ছে

অবরোধ

 

পুটপুট করে ধুলো ফেড়ে গেল

মিলমালিকের  স্কুটারের স্মৃতি

একটু জালিম চলে গেল-

খড় কাটার শব্দ উঠছে- নাসরীন নাসরীন

 

আর তুমি

পাথরের ভেতর  পরব হয়েই

থেকে গেলে

 

৭.

বসন্তপর্যায় গেলো, আমাকে করলে না তুমি ভালো

হুড়মুড় করে ঢুকে গেলে অহেতুচেতনে

দরজার ধারণাকে আধখানা  করে

ঢুকে গেলে সামাজিক তোয়াক্কা ছাড়াই

 

আমার ভেতরে ছিল স্থানুজল

জলের ভেতরে ছিল

শূন্যতাসমেত

একটা নিমজ্জন

–আমারই তীর্যক অবয়ব

আর তার অবস্থানটুকু

 

তাকেও তো প্ররোচনা দিলে

কানকোয় ফুসফুসে ঢুকে গিয়ে

আমাকে বোঝালে তুমি–

মাছকেও মন্ত্রণা দিলে–

 

জালই জীবন

 

মন্ডি

ট্রেন থামে। সূর্যোদয়ের কাছে
চাষাভুষো স্টেশনে। জলের শব্দ হয়
ধীরে পাতা আশ্লেষে খুলে আসে বেগুন ঢ্যাঁড়শ
কলাইয়ের ক্ষেতে
আঙ্গুর বাগান থেকে কানাকানি শুরু হয়েছিল
অবভাস লেগেছিল
রিঠা শিকাকাই চুলে দূরত্বে
খল ভরসায়

বেড়াতে বেড়াতে এলে
তুষার থেকেই এলে স্বপ্নের ভেতর
জামা খুলে দেখালে জরুল
বৃন্তের কাছে শেষ টেস্টামেন্ট হয়ে
মলিন ম্যাপের দিক-নির্দেশ হয়ে
তলিয়ে যাচ্ছে রাত পার করে, সূর্য পার করে

কোঠা বাড়ির দিকে ঘন হয়ে উঠছে
প্রচ্ছদ, ফিকে হয়ে উঠছে অক্ষর

আমি তো ততটা স্থিতধী নই যে কিছু কিনতে চাইবো না
তেমন নিরীহ নই যে পকেটে একশো টাকার একটা নোটও থাকবে না।

 

গোয়েন্দা গল্প কাব্যগ্রন্থ থেকে

১.

লাউমাচার পেছনে সূর্য ডোবে। গোয়েন্দা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন তার আভা। মাটি ফুঁড়তে ফুঁড়তে ঢুকে যায় তামাশারঙ্গা কেঁচো। গোয়েন্দা দেখেন। নীহারিকা অব্দি তাঁর দৃষ্টি তদারক করে ছায়ার। নোনা হাওয়ায় আচমকা দৌড়ে যাওয়া মানুষ বিস্মিত করে তাঁকে। হাতে চায়ের মগ তুলে নিতে নিতে তিনি তারও তদারকি করেন। দূরে বন্দরের আলো। মুখে বসন্তের দাগওলা মানুষেরা তাস পেটায়। এনামেল একটা প্রতিধ্বনি জলের ভেতরে ডোবে। গোয়েন্দা মানুষের ধর্মের কথা ভাবেন। গোয়েন্দা বোঝেন—ঠিক যেখানটায় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যায় মানুষ, সেখানটাই মানুষের অবস্থান—যা ক্রমে স্বপ্নে চেতনে প্রবঞ্চনায় পরিকল্পনাজাত হয়ে ওঠে।

২.

কামিনরা চুন গুলছে ক্যানেস্ত্রায়। ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে। গোয়েন্দার চায়ের লিকারে ফোঁটা ফোঁটা শাদা সময়… এবড়োখেবড়ো দাঁতের ওপর হলদে হয়ে আসা সময়…।শীতের ভোরে হাইড্রেন্ট দিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া সময় বেরিয়ে আসছে মিশতে চাইছে আস্তে সুস্তে বড় হয়ে ওঠা আবহাওয়ায়। গোয়েন্দা জানেন, এক সময় আর অপর সময়ের জোড়ের চিহ্নটুকুই বিপন্নতা। গোয়েন্দা এই চিহ্নের তদারকি করছেন। মাঝে মাঝে চায়ের কাপে চোখ রেখে দূরত্বের কথাও ভাবছেন।

 

১০.

পাথরের ফাটল থেকে উঠেছে, চারা, সাদা গোলাপের বুনো ফল। মুয়াজ্জিন আসছেন ত্রস্ত পায়ে, ফজর ডাকছে। গোয়েন্দা ঘাসের ভেতর থেকে এ’সমস্ত দেখেন, গোলাপ ফলের ভেতর থেকে… গোয়েন্দা দেখেন, অবসাদ ঘুরে বেড়াচ্ছে বাতাসে, অক্ষর হয়ে, বাক্য হয়ে, জমাট বাঁধছে ভেঙ্গে উঠছে, গাছ ছেঁকে নিচ্ছে সেই সব অবসাদ, তাকে উপযুক্ত কার্বন করে নিচ্ছে। গোয়েন্দা জানেন মানষের স্বভাব, তার আত্মপ্রবঞ্চন– সময়ে সময়ে কব্জির শিরা অব্দি কাঙ্খায় দপদপ করা কাঁচের টুকরোকে নিয়েও সে রিফাইনমেন্টের কথা ভাবে, হীরের কথা ভাবে, দু’টো-একটা কবিতা লিখে উঠতে পারে। গোয়েন্দা জানেন মুহূর্তই সব– মুহূর্তই জানে খুনীর চেহারা জলরঙ্গের মধ্যে দিয়ে কীভাবে আচমকা স্বচ্ছ হয়ে যায়…শ্যাওলার নীচে পাথরের খাদ্য হয়ে থেকে যায়।

 

১২.

পর ও অপর, এরই মাঝে সূত্রগুলো রাখা—আপন বলে কিছু নেই। প্রমাণের কুচি উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘটনাস্থলে, মানুষের নৈতিক ও কানুনী প্রক্রিয়াগুলোর ফাঁকে ফাঁকে। মৃত্যু কে মেনে নেওয়া মানে জীবনকে মেনে নেওয়া—এ’রকমই গোয়েন্দা ভাবেন। বাইরে থেকে ভাবেন। ঘটনা মানুষকে ফেলে চলে যায় অন্য একটা পরিণতির দিকে—অথচ মানুষ তাকে আজীবন করে রাখে, ইচ্ছে বা অনিচ্ছেয় প্রাণ করে রাখে। তার গলায় ওয়াটার বটল বেঁধে দিতে ভুলে যায় না কখনো।

 

২৯.

ছ্যাঁকার মুহূর্তটুকুই আগুন, বাকীটুকু সম্বিত ও ধারণা। যদিও মানুষ প্রমাণের কথা, তার লুপ্তির কথা বলতেও আগুনের কথা ভেবে ওঠে– গোয়েন্দা জানেন, যা স্পষ্ট যা শিখা, উৎস থেকে রং বদলাতে বদলাতে যা অবলোহিতের দিকে চলে যায়—সে শুধু ধারণার ভিনিয়েট—বস্তু ও তার দাহ্যতা সংজ্ঞার বাইরেই থেকে যায়, এমনকী ক্রিয়ার বাড়বাড়ন্তও তাকে আর ফাঁদে পা দিতে প্রলুব্ধ করে না। 

সাদা ঘাসের মধ্যে দিয়ে ঢালু একটা পথ নেমে গেছে আলোর ভেতরে। সাদা নুড়ি কুড়াতে কুড়াতে খুনী সেই পথে নেমে যান। তার চামড়া স্বচ্ছ হয়ে ওঠে পোষাক পার করে। প্রমাণের ছায়াও তার পদক্ষেপের পাশে জেগে উঠতে ভুলে যায়।

 

৩৫.

নিজেকে এড়িয়ে যাওয়া—এতটুকুই বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন। মানুষ মানুষকে শুইয়ে রাখে ফুলকপির ক্ষেতে। মানুষের পিত্তথলির রঞ্জকে হলুদ হয়ে ওঠে অসময়ের শীত। কাগজের শহরে দীর্ঘশ্বাসের মত গোয়েন্দা ঘুরে বেড়ান। তাঁর কমলা জামার কলারে থক থক করছে দু’চারশো বছরের মাছি ও প্রেরণা। এই আয়না-শহরে খুনীও জেগে থাকেন। পত্রপ্রেরকের মত। নীরব। অধীর।

 

৩৬.

শ্রমের বিপরীত একটা আকার মানুষকে টানে, পীচরাস্তার থেকে জঙ্গলের দিকে নিয়ে যায়। ইতিহাসের ভেতর মানুষ চুঁইয়ে পড়ে তার ভুল ভ্রান্তি চুঁইয়ে পড়ে। তবু মানুষ ফিরে তাকাতে চায় আর স্বপ্নের মধ্যে পাশ ফিরে বুঝতে চায়–যেন সে কোথাকার, যেন তার কোথায় কমলা বাগানের শীত পচনের থেকে দূরে  আলগোছে গ্রন্থির ওপর ক্ষুর চালিয়ে দিচ্ছে।

গোয়েন্দা দেখেন, নীবার ধানের মরাই থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে পোড়ো বিকেলের ময়ূর, তার পেখমের ভেতর খুনীর চোখ ঝলসে উঠছে।

 

৩৭.

আলোগুলো নিভিয়ে দেয়া হয়, স্মৃতিগুলো। পরিবর্তনের সময়ে মানুষ শুধু সামনের দিকে তাকায়, তালার ফুটোর ভেতরে তাকায়। গোয়েন্দা লক্ষ করেন, অস্থির মানুষের খোলসের ভেতর রঙের প্রকোপে সাদা হয়ে উঠছে ক্যানভাস। গর্ভ থেকে পাতাগুলি ঝরে যাচ্ছে। পুবের পাহাড় কেঁপে উঠছে অসঙ্গতিতে। গোয়েন্দা দেখতে পান, ধ্বসের ভেতর স্থির বসে আছেন খুনী। তাঁর চোখের কোণায় নির্বিকার হয়ে আছে আলো।


সব্যসাচী সান্যাল

কবি পরিচিতি

সব্যসাচী স্যানালের জন্মঃ ১৯৭৩, আগরতলা, ত্রিপুরা। বেড়ে ওঠা, ইটানগর (অরুণাচল প্রদেশ), হাজারিবাগ, পুরুলিয়া ও বোলপুরে। ১৯৯৭-২০০২ দক্ষিণ কোরিয়ায় সপ্তাহে ১০ মিনিট বাংলা ভাষায় কথা বলে বেঁচে থাকা। ২০০২-২০০৭, স্টকহোম, সুইডেন। ২০০৭ থেকে লখনৌ-এর বাসিন্দা। পেশায় মলিকিউলার বায়োলজিস্ট। কৌরব পত্রিকার সাথে যুক্ত গত এক যুগ। প্রকাশিত বইঃ নীল গ্রামাফোন, হরিপদগিরি, এপ্রিলতা/পানুর ইচ্ছে, ব্র্যাকেটশহর, প্রিয় পিয়ক্কড় (কৌরব), ডুবোপাহাড়ের লগবুক (সৃষ্টিসুখ), গোয়েন্দা গল্প (পাঠক), তদোগেন গিরতের কবিতা (বেহুলাবাংলা)।

শেয়ার