নবীন কবিদের কবিতা পড়ে
১.
এমন একটি কথা আমি সবসময়ই বলবার চেষ্টা করেছি যে— ভালো কবিতা বহু লিখিত হয়েছে, বরং ‘ভিন্ন কবিতা’ লেখবার একটা চেষ্টা কবিদের থাকা উচিত। একটা দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা-চর্চা করলে যেকোন কবির ‘ভালো কবিতা’ থাকাই স্বাভাবিক। এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ‘ভালো কবিতা’ লিখে-লিখে ভালো কবির তকমা পাওয়া যাবে নিশ্চয়ই; কিন্তু এতে যেটা হয় যে, ওই কবির মধ্যে তথাকথিত ‘ভালো’ লেখার একটা ছক তৈরী হয়ে যায়। ফলে ‘ভালো কবিতা’ যতোই ভালো হোক না কেন; এক সময় তা হয়ে ওঠে একঘেয়ে, পুনরাবৃত্তিমূলক। যে কারণে কবিকে হতে হয় নিরীক্ষাপ্রবণ। সহজে কবিতা করে ফেলার ছক কবিকে তার কমফর্ট জোন থেকে বেরোতে দেয় না। নিরীক্ষাপ্রবণতার ভেতর দিয়ে না গিয়ে নিজস্ব ছাঁচ ও প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে কবিতা লিখে যাওয়াটাই সহজ কাজ হয়ে ওঠে তার কাছে। নিরীক্ষাপ্রবণতা কম থাকার ফলে অনেকানেক ‘ভালো কবিতা’র দেখা মিললেও ‘ভিন্ন কবিতা’ আমরা পাই-ই না বলা চলে।
২.
যাবার জন্য একজন নবীন কবির সহজ জায়গা হলো প্রকৃতি। যদিও এক অর্থে জগতের সকল কিছু প্রকৃতিরই অংশ। তবে এখানে ঠিক সেই অর্থে না; বলা হচ্ছে কবিতায় ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাকৃতিক অনুষঙ্গ বা ন্যাচারাল অবজেক্ট; কিংবা প্রকৃতি-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ঘটনা বা ফেনোমেনার কথা। একজন কবি যখন এগুলোকে তার কবিতার অংশ করে ফেলেন, তখন কবিতাটিতে তার যতোটা সেরেব্রাল ইনপুট দেয়ার সম্ভাবনা থাকে, সেটি কার্যত আর হয় না। ফলে ‘মাথা খাটিয়ে লেখা’ কবিতার দেখা আমরা তেমন একটা পাই না। লেখায় বুদ্ধিদীপ্ততা ও আবিস্ক্রিয়ার এমন ঘাটতির ফলে কবিতা তখন এর ভেতরকার প্রকৃতি-সংশ্লিষ্ট উপাদান বা অনুষঙ্গগুলোকে আশ্রয় করে দেহ নেয় ও বিকশিত হতে থাকে। কবিতায় এত-এত প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের ব্যবহার নবীন কবির প্রাথমিক কাজকে কমিয়ে দেয় বা সহজ করে দেয়। কেননা এই প্রাকৃতিক অনুষঙ্গগুলো প্রতিটিই তার নিজস্ব সৌন্দর্যে ভাস্বর। লেখায় প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের এমন পৌনঃপুনিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে একজন নবীন কবি প্রকৃতপক্ষে তার নিজস্ব শৈলী ও বাকভঙ্গি গড়ে তোলার সুযোগকে সংকুচিত করে ফেলেন। এক অর্থে এটি কবিসৃষ্ট এক ধরনের স্বরচিত ফাঁদ বৈ আর কিছু নয়। এ’ কথার মধ্য দিয়ে কোন ট্যাবু আরোপ করা হচ্ছে না। চাঁদ, ফুল, জোছনা, নদী, লতা-পাতা— কবিতায় এগুলো ব্যবহার করা যেতেই পারে। কেননা এসব উপাদান/ অনুষঙ্গ ব্যবহার করেও যে কেউ ‘ভিন্ন কবিতা’ নির্মাণে সক্ষম হতে পারেন। তবে সেইসব পন্থা-প্রকরণ ও মার্গ আবিষ্কারের জন্য নবীন কবির দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। আর তাতে খানিকটা সময় তো লেগেই যায়।
৩.
সাম্প্রতিক সময়ে নতুন লিখতে আসা বেশ ক’জন কবির গুচ্ছকবিতা পড়বার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। তাদের ৪-৫টি করে কবিতা পড়ার ভিত্তিতে ভালো-মন্দ লাগা কিংবা ব্যক্তিগত মতামত জানানোই আমার উদ্দেশ্য। অচিরেই এই কবিদের পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ আমরা আশা করতে পারি। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, কোন কবির কয়েকটি মাত্র কবিতা পাঠ করে তার সমগ্র কবিতা-জার্নি বিষয়ে মন্তব্য করা এক অর্থে অবিমৃষ্যকারীতাই। ফলে এখানে কারও কবিতার বিষয়ে জানানো মতামত আসলে সুনির্দিষ্টভাবে তার যেই কবিতাগুলো আমি এখানে পড়েছি, সেই বিষয়ে আমার মন্তব্য। কারোকে উৎসাহ দেয়া বা অনুৎসাহিত করাও আমার উদ্দেশ্য নয়। উৎসাহে কারও কবিতার উন্নতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। কেননা কবিতা উঠে আসে তার যাপন প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা, সামাজিকীকরণ, পঠন-পাঠন ও কাব্যরুচি থেকে। এখানে পঠিত সব কবির কবিতাই যে ভালো লেগেছে, এমন নয়। তবে সেসব ইতি-নেতির ফিল্টার দিয়ে না দেখে সরলভাবে তাদের কবিতা বিষয়ে যৎসামান্য আলোকপাত করা যাক বরং—
আবির আবরাজ
আবির আবরাজের ‘সমুদ্রের কাছে’ কবিতাটির প্রতিটি পংক্তির পূর্বাপর সংযোগ দারুণ। একটির সূত্র বা হেতুকে তিনি বয়ে নিয়ে গেছেন পরের প্রসঙ্গে। একটি মহাজাগতিক পরিস্থিতির অবতারণার মধ্যে শেষ হয় কবিতাটি। শেষটুকু পড়ে আবার কবিতার শুরুটিতে খেয়াল করার প্রয়োজন হলো। গ্লাস হাতে চাপকলের কাছে যাবার মত আপাততুচ্ছ একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে ব্যাপারটির শুরু হলেও চুড়ান্ত অর্থে এটি আসলে জীবনবোধ বা উপলব্ধিজাত কবিতাই। আমি নিজেও দেখেছি, আমার ব্যক্তিগত সকল মহাজাগতিক চিন্তাই এমন ধরণের আপাত-সরল ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়েই শুরু হয়। তার অন্যান্য কবিতাগুলো আমাকে টানেনি তেমন।
দেওয়ান তাহমিদ
দেওয়ান তাহমিদের কবিতার ভাষা নির্মেদ, ছিপছিপে। লেখায় চিন্তাশীলতার ছাপ পাওয়া যায়। এই গদ্যের শুরুতে যেই ‘মাথা খাটিয়ে লেখা’র কথা বলেছিলাম, সেরকম একটা বিষয় যেন অন্তশীলভাবে এই কবির ভাষার ব্যবহারে আছে। তার কবিতার দিকে নজর থাকবে সামনে।
হিম ঋতব্রত
আকারে ছোট-ছোট কবিতা হিম ঋতব্রতর। যদিও কবিতার আকৃতি কোন বিবেচনার বিষয় নয়। তবে এ’ থেকে ভাষার ব্যবহারে কবির নানাবিধ প্রবণতা সনাক্ত করা যায়। তার ‘বকের মাংস’ ও ‘ভূত’ কবিতা দু’টি ভালো লেগেছে পড়তে। অহেতুক বয়ান প্রবণতা এই কবির নেই বলেই মনে হয়েছে আমার। তবে তার আরও কিছু কবিতা পড়া গেলে বিষয়টি আরও ভালভাবে ধরা যেতো।
জাকারিয়া প্রীণন
জাকারিয়া প্রীণনের কবিতা মুগ্ধতা-জাগানিয়া। এখানে যত কবির লেখা পাঠ করলাম, তার মধ্যে কাব্যময়তার জায়গা থেকে তার কবিতার ভাষাই আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে ভালো লেগেছে। এই কবির কবিতার ভাষা বুদ্ধিদীপ্ত, সংবেদী, স্মার্ট। তার ছোট-ছোট বাক্যগুলো লক্ষ্যভেদী, অব্যর্থপ্রায়। তার ৫টি কবিতা পড়েই আনন্দ পেয়েছি, যার প্রতিটিই স্বতন্ত্র সৌন্দর্যে ভাস্বর। যদিও ‘উপক্রমণিকা অথবা প্রতিবিম্ব’ নামে কবিতাটির ভাষাগত শ্লথতা ও শৈথিল্য দৃষ্টি এড়ায় না। তার কবিতার জন্য অপেক্ষা করা যায়।
কাজী ওয়ালী উল্লাহ
কাজী ওয়ালী উল্লাহ’র কবিতাগুলো পড়ে প্রকৃতই আনন্দ পেয়েছি। বিশেষত সাফা প্রামাণিককে নিয়ে লেখা তার কবিতাগুলো চমৎকার। কবিতায় ওয়ালী উল্লাহ’র আবেগের প্রকাশ পরিমিত, লক্ষ্যনীয়।
দিপংকর মারডুক
‘তারাচৈত্র দিন’ কবিতাটি দীপঙ্কর মারডুককে শক্তিমান কবি হিসেবে তুলে ধরলো। পাশাপাশি অন্যান্য কবিতাগুলোতেও পাঠের আনন্দ অনেকটাই অটুট থাকে। কিছু শব্দজোড় খুঁজে পেলাম তার কবিতায়; যেমন— বিলম্বফুলের ডালপালা, ঋতুমতী ফুল, তমসা পাহাড়, অন্ধকারহীন রাত ইত্যাদি; যেগুলো এক ধরনের অনুরণন তৈরী করে ভাবনায়। পাঠের পরও আপনি তার কবিতার কথা ভাবতে চাইবেন; কবিতাগুলোর আবেশ এমন।
মাসিয়াত জাহিন
মাসিয়াত জাহিনের কবিতাগুলো পাঠে আমি ঋদ্ধ হয়েছি; সেই সাথে কবিতাগুলো আমার পাঠের জায়গাকে প্রসারিত করেছে নিঃসন্দেহে। তবে আমার কাব্যরুচি অনুযায়ী কবিতাগুলো আমাকে আলোড়িত করেছে কম।
মিসবাহ জামিল
মিসবাহ জামিলের কবিতায় ভাষা ও রূপকের ব্যবহার সংযত, পরিমিত। ভাষার গমক দিয়ে পাঠককে চমক দেয়া তার উদ্দেশ্য নয়। এই পরিমিতিকেই তার কবিতার ভেতরকার সৌন্দর্য বলে মনে হয়েছে। ভাষাগত সরলতাই তার ক্র্যাফটসম্যানশিপ এক প্রকার। তার পড়েছি একটা সিরিজ-কবিতা; শ্রেণিসংগ্রাম, অসাম্য, আমাদের এই বিষম সমাজ-কাঠামো নিয়ে লিখিত। মানুষে-মানুষে সমতা বিধানের অভীপ্সা তার প্রতিটি ছত্রে। নিচুগ্রামের স্বর, বাক্য বিন্যাস, শব্দ চয়ন ও অলংকারহীনতা তার লেখনীকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে মনে হলো। আমি তার কবিতার বন্দনা করি।
মুহিন তপু
বেশ প্রাঞ্জল লেগেছে মুহিন তপুর ‘কল্পনা করো, আমি তোমারে কল্পনা করতেছি’ ও ‘জ্বর’ নামের কবিতা দুটি। তার অন্য কবিতাগুলোর বিভিন্ন অংশ বা ওই কবিতাগুলোর বেশ কিছু কয়েনেজও ভাল লাগলো পড়তে। ভবিষ্যতেও তার কবিতা পড়তে আনন্দ হবে নিশ্চয়ই।
নাদিয়া জান্নাত
নাদিয়া জান্নাতের ‘চিলমারী’ নামে মিনি-সিরিজ-কবিতা দুটি বেশ মনোমুগ্ধকর। এই দুটি কবিতার চিত্রকল্পগুলো প্রাঞ্জল, ভিভিড। দৃশ্য ও ঘটনাগুলো যেন কবির অভিজ্ঞতাসঞ্জাত! তার ‘বেনামী মাস্তুল‘ কবিতাটিও ভালো লেগেছে। ভালো লাগেনি ‘শ তে শব’ কবিতাটি।
অনুভব আহমেদ
অনুভব আহমেদের ‘খাদ্যকণা’ নামের কবিতাটি ভালো লেগেছে বেশ। তবে তার দ্বিতীয় কবিতা; ‘অক্ষর’ — আমার কাছে খানিকটা ক্লিশেই লাগলো। কেবল ভাষার ক্লিশেমি নয়, চিন্তার দিক থেকেও নতুন কিছু যেন হাজির করতে পারেনি কবিতাটি। তার বাকী কবিতাগুলো অবশ্য মন্দ লাগেনি পড়তে।
রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা
‘কখন কোন কবিতা যে লেগে যায় মনে’ কী দারুণ স্বগতোক্তি! আমার নয়, কবি রাবিয়া সাহিন ফুল্লরার। এভাবে তার প্রথম কবিতা ‘শীতের বরই’ শুরু হচ্ছে, শুরু থেকেই চমৎকার গতি পেয়েছে কবিতাটি। বারবার প্রসঙ্গান্তর ঘটছে যদিও কবিতাটিতে। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ বদল বা উল্লম্ফনকে আমার অকারণ মনে হয়নি। বরং বায়োস্কোপের মতো এখানে একটার পর একটা দৃশ্য যেভাবে বদলাচ্ছে এবং পাঠকের জন্য ভাবনার অবকাশ রেখে যাচ্ছে, তা অন্যান্য পাঠকেরও ভালো লাগতে পারে বলে আমার মনে হয়েছে। তার নয়টি কবিতা হাতে পেলেও সংগত কারণে প্রথম পাঁচটি লেখাই পাঠের জন্য বেছে নেয়া হয়েছে। ‘নীল নীল ফুল’ কবিতাটিও বেশ ভাল লেগেছে আমার। রাবিয়া সাহিন ফুল্লরার সবগুলো কবিতাই কমবেশি স্মৃতিচারণমূলক। এ ধরণের কবিতায় অন্তশীলভাবে কিছু স্নিগ্ধ সৌন্দর্য থাকে।
রেদওয়ান আহমদ
কবি রেদওয়ান আহমদের কবিতায় তার নিজস্ব ভাষাভঙ্গির প্রকাশ ঘটানোর সচেতন চেষ্টা আছে। একে আমার ইতিবাচক বলেই মনে হয়েছে। তার কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ ও পরিভাষা মূলত মুসলিম-মিথ ও সংস্কৃতিবাহিত। ইদানীন্তন বাংলাদেশের কবিতায় মুসলিম ধর্মাচার ও পরিভাষার এক বাকভঙ্গিকে আমরা জনপ্রিয় হতে দেখছি। বাংলাদেশের অনেক কবি-লেখকই সচেতনভাবে পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতা থেকে বাংলাদেশের কবিতাকে ভাষা ও ভঙ্গির দিক থেকে পৃথক করতে গিয়ে বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত হিন্দু-পুরাণাশ্রয়ী চরিত্র ও মিথগুলোর কাউন্টার-এলিমেন্ট হিসেবে কবিতায় নিয়ে আসছেন নানান ইসলামী উপাদান, গাঁথা, মিথ ও ধর্মীয় চরিত্রগুলোকে। রেদওয়ান আহমদের কবিতাকে এই ট্রেন্ডের ধারাবাহিকতা বলেই আমার মনে হয়েছে। তিনি নিজেও সম্ভবত এভাবেই তার কবিতার ভাষা ও গতিপথ নির্ধারণ করতে চাইছেন। অবশ্য এগুলো তার কবিতার উপরিকাঠামোই। তার কবিতা পাঠ করতে যেয়ে দেখেছি তার কবিতার অন্দরমহলও সুন্দর; আর সুরম্য যথেষ্ট।
রুম্মানা জান্নাত
রুম্মানা জান্নাতের ‘মিস করি সিনট্যাক্সের বাইরে, তোমাকে’ সিরিজের পাঁচটি কবিতা বিচ্ছিন্নভাবে পাঠ করা হলো। রুম্মানা জান্নাতের কবিতার ভাষা উপদ্রবহীন, স্বস্তিদায়ক যথেষ্ট। তিনি লিখেছেন— আঙুলের ডগায় বসে কাঁপতেছে হৃদয়। স্পর্শাকাঙক্ষার মনোদৈহিক প্রকাশের একটি চমৎকার নমুনা হিসেবে নেয়া যায় বাক্যটিকে। ছোট্ট একটি বাক্য বিশেষ হয়ে উঠেছে কেবল চিন্তাশীল প্রকাশের জন্যই। তার অন্যান্য কবিতাগুলোতেও এরকম বেশ কিছু চিন্তাশীল প্রকাশের নমুনা ছড়ানো-ছিটানো রয়েছে। আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে বেশি ভালো লেগেছে ৪৭ নম্বর কবিতাটি। রিফ্রেশিং।
সাফা প্রামাণিক
সাফা প্রামাণিকের কবিতাগুলো কমবেশি ভালোই লেগেছে পড়ে। তার কবিতায় বিলাপ, জরা, মৃত্যু, অপ্রাপ্তি, আক্ষেপ, বন্ধ্যাত্ব বা এমন সব ডার্ক এলিমেন্ট হাজির আছে। তবে সেই সাপেক্ষে যেন তার কবিতাগুলো যথেষ্ট ‘ডার্ক’ হয়ে ওঠেনি! ভিন্ন ও প্রতিশ্রুতিশীল কিছুর ইঙ্গিত দিয়েও তার কবিতাগুলো শেষমেষ হয়ে উঠেছে ব্যক্তিগত রোদনমুখর।
সাফওয়ান আমিন
শেষের জন্য পাঞ্চ-লাইন জমিয়ে রাখা— এই ধাঁচে কবিতা রচনা করে অনেকেই আনন্দ পান। নবীন কবিদের অনেকেই পাঠককে পাঞ্চ-লাইন ব্যবহার করে চমকে দিতে চান। সাফওয়ান আমিনের যেই কবিতাগুলো পাঠ করলাম, তার প্রতিটি কবিতার শেষেই এরকম পাঞ্চ-লাইন রাখা আছে। পাঞ্চ-লাইন মূলত পাঠকের সকল মনোযোগ টেনে নেয় বলে এটি কবিতার অন্যান্য সম্ভাবনা ও যোগ্যতাকে অনেক সময় ঢেকে ফেলে। তার ‘ডিভোর্স’ ও ‘কলেজ লেক’ কবিতা দুটো আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে।
তানিম আমিন
তানিম আমিনের যেই কবিতাগুলো পাঠ করেছি, তা স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক। জোর করে চাপিয়ে দেয়া উপমা/ রূপকের ঝনঝনানি নেই সেখানে। কবিতায় তার প্রকাশ একেবারেই স্ট্রেটকাট, ভনিতাহীন। স্ট্রেটকাট হবার ফলে নানান স্ল্যাং ও ট্যাবু-শব্দকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করেছেন সহজেই। তার কবিতার এই আপাত-আগ্রাসী ভাষা কখনো ভালো লেগেছে, কখনো বা অনাকর্ষক, কাঠখোট্টা। তবে কর্কশ হলেও যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এতে কবির নিজস্বতা ফুটে আছে।
ইশতিয়াক আহমেদ
ইশতিয়াক আহমদের কবিতায় মরমীয়া বা মিস্টিক-ধাঁচের কিছু এক্সপ্রেশন চোখে পড়লো। এই মরমীয়া আবহ, গ্রামীণ প্রতিবেশ ও তার কবিতার নানান অনুষঙ্গ আমাকে চকিতে আল-মাহমুদের কথাও মনে করায়নি, এমন নয়। তবে সেইসব অনুকারিতা নয় নিশ্চয়ই। আমি মনে করি, কবিতায় একজন কবি কী লিখবেন— সেই বিষয়ে তার যেমন সুস্পষ্ট পরিকল্পনা থাকতে হয়, তেমনই কী লিখবেন না— সেই বিষয়েও পরিষ্কার ধারণা থাকা উচিৎ। ইশতিয়াক আহমদের পরবর্তী কবিতাগুলো আমাকে হয়তো আনন্দ দেবে।
— আন্দালীব
কবি
কবিতা মানেই ভাষার বড়াই। আর ভাষার বড়াই মানে একুশ। নতুন কবিতা মানে নতুন ভাষা। নতুন কবিতা আর নতুন ভাষার সন্ধানে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শিরিষের ডালপালায় প্রকাশ হলো বাংলাদেশের ১৮ জন তরুণ কবির কবিতা সংকলন ‘নতুন কবিতার সন্ধানে’। সবার কবিতাতেই যে নতুন ভাষা, আঙ্গিক পেয়েছি, তা না। তবে অনেকের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। বারবারই তাদের কবিতা পড়তে চাইবো। যাদের লেখা অতটা মুগ্ধ করতে পারেনি, আশা করি তারা ভবিষ্যতে দারুণ সব কবিতা লিখবেন। সংকলনের এই ১৮ জনের বাইরে আমি নিশ্চিত আরও মারাত্মক কবিতা লিখিয়ে আমাদের নজরের বাইরে রয়ে গেছে। তা নিতান্তই সম্পাদক হিসাবে আমার ব্যর্থতা। এই ব্যর্থতা মাথা পেতে নিয়েই কবিতা পড়ার আমন্ত্রণ জানাই।
— রুহুল মাহফুজ জয়
১৮ কবির কবিতা
জাকারিয়া প্রীণন, রুম্মানা জান্নাত, কাজী ওয়ালী উল্লাহ, দেওয়ান তাহমিদ, রাবিয়া সাহিন ফুল্লরা, আবির আবরাজ, রেদওয়ান আহমদ, দিপঙ্কর মারডুক, মিসবাহ জামিল, তানিম আমিন, মাসিয়াত জাহিন, হিম ঋতব্রত, সাফা প্রামাণিক, সাফওয়ান আমিন, নাদিয়া জান্নাত, অনুভব আহমেদ, মুহিন তপু, ইশতিয়াক আহমেদ