‘তমোহা পাথর’ বইয়ের কবিতা | ফারুক ওয়াসিফ

মোনাজাত

 

অন্ধকারে মিলছে দুটি হাতে এক মোনাজাত,

বিজোড়ে বিজোড়ে মিলেছে একই আয়াত।

তোমার আঙুল ইঙ্গলা, পিঙ্গলা,

অরূন্ধতী, স্বাতী আর তমা;

আমার আঙুল মাটি হয়ে ঝরে,

পুড়ে শুধু ঝামা।

 

আঁজলা তুলে দেখি,

হৃদয়রেখায় তোমার ক্ষত, আমার আয়ুতে কাঁটা;

আমি তো ভিখারি নই, তোমারও সম্রাজ্ঞীর মতো শ্লাঘা

আমাদের চাওয়ার দীনতা একই মোনাজাতে বাঁধা।

 

 

 

আয়না ও ডুমুর

 

চিরনদী পাড়ে ফের ওঠে কালা ঢেউ

আঁজলা ভরা জল আজও কি জমাও,

গলে চোখের পারদ, আয়না ভাসে স্রোতে।

আবছায়া জাহাজের ডাক শোনা যায়—

ডানার বিস্তারে সন্ধ্যা লেপে দিচ্ছে ছাই,

ভিড়ে আছি ভবতীরে উবুদেহ ভাসমান

ব্যর্থ সব তীর হতে চায় বায়ুর চিক্কুর,

কতদূর নিয়তির টান কতদূর ইকারুস?

 

কুয়ার দু-মুখে দুটি ভয় পাওয়া মুখ,

আয়ুর আঁটন-ছেঁড়া উড়াল কর্পূর।

চিতল পেটের মতো বিলের কিনারে

জন্মান্ধ পাখির গান শোনা যায় দূর।

 

নিরলের ফুল ঘিরে বিধি পাতে জাল

বুনে যাব তার রাহে নাভিমূলে নূর

ঐশী নীল থেকে এক বানাচ্ছি ময়ূর।

গোধূলি দুর্গের ভাঙ্গা জানালার ধারে

দাঁড়িয়ে ছিল সে একা যোনীতে ডুমুর।

 

ডুমুরের খোলে ফোটে ব্রহ্মাণ্ডের ফুল

ফুরায় উড়নপাক, সাত আকাশ আকুল,

আমারই প্রেত আজ আমাকেই খাক

আয়নার ধ্বংসফেনায় আয়না ভেসে যাক!

 

 

 

মরিয়ম পাথর

 

দূর এক সন্ধ্যাদেশ থেকে আমি আসি,

সেখানে বরষা আসে—কুয়াশাও হয় খুব,

বাতাসের স্ক্রলে জমা কথিত ভাষার গান

দাহকালে ফাটে গাছ, কান্নাবমি করে মাটি।

                

শাড়ি ফেঁসে গেছে যোগিনীর,

সময়ের তাঁতী ভেঙ্গে ফেলছে তার তাঁত।

নিজেরই পায়ের পথে করেছি কাঁটার চাষ

আর,

মরিয়ম পাথরের আংটিতে তোমার—

মরিয়ম পাথরের ওই আংটিতে এখন

রহস্যরেখায় ফুটছে কোন ছবি?

সে পাথর কত আর দেবে অভিশাপ,

ক্রুশ পিঠে কত আর ঝুলে থাকে লাশ?

 

সড়কের ধর্মে আমরাও চলেছি কত

পাশাপাশি লেনে—প্রতিজ্ঞার বিপরীতে।

বিপরীত লক্ষ্য সব সড়কেই জোড়া-লাগা থাকে,

ট্রেনেরাও রুদ্ধশ্বাস কাছাকাছি যায় বুক ঘেঁষে—

তোমাকে তেমনি দেখে ফেলিব চকিতে,

                        বিপরীত জানালায়!

যেমন স্বেচ্ছায় চাহনি ফিরিয়ে আনা যায়

তেমন কি ফেরে গিরিবাজ কবুতর?

ঘৃণার মতোন জেনো প্রেম সতত অক্ষম

বোবাধরা স্বপ্ন্ একধরনের জাগরণ

                       —ভয়ের অরণ্যে।

হন্যমান এ জীবন—দহন সচলা রাতে,

তার কাছ থেকে দূরত্ব কীভাবে পাবে—

এমন কিছুই তুমি জানতে চিরদিন।

তোমার আড়াল ছিঁড়ল বলো কোন ভয়,

কেন তুমি ছড়াতেছ বিদায় লোবান?

 

পাঁজরের থেকে খুলে শুদ্ধতম হাড়
আমি বলছি ইতিহাস—
আমি লিখে যাচ্ছি দেয়ালে দেয়ালে;

লিখতে হয় গাথা যে মতোন নির্বাসনে

চিত্রে দিতে প্রাণ ক্ষয় হয় চক ও পেন্সিল,

সেমতো আমার ক্ষয় থেকে সৃজন তোমার।

সাগরে ডোবার আগে, বুকভরা জল নিয়ে

কত কী যে আকুলতা করে নদী—

তেমন অস্থির আমি ডেকে যাচ্ছি কিছুকে,

ভুলে গেছি সব বিষ্মরণের চাবুকে চাবুকে।

 

২.

উজিয়ে আশার সমতুল পথ

ফিরছি আমি চিরনদী পাড়ে।

জলে নাই আর জলের সিনান,

হাতে নিবু নিবু কুয়াশার কুপি;

আঁধারে দাঁড়িয়ে যেন কারা

দিচ্ছে নিজেদের নিজেই পাহারা?

 

রক্তনেকড়ে মন

চাঁদ উঠবে যে কখন,

পেছনে ফেলেছে শ্বাস

আধেক জাগর বাদাবন,

হয়তো তা অচেতন মন।

হিম থেকে ওঠে জলমাখা রোঁয়া

কাঁপে তরি কাঁপে ভবিতব্য ছায়া।

 

বিশ্বাসে নিকটে আসি

হাসি সেই চেনা হাসি,

অচেনার পাশে যে বিশ্বাসে বসি;

হাসি দেয় সেই পরিচয়।

যে স্মৃতিরা আজ কবরের মাঠ,

হাসি যেন তার সমাধিফলক!

 

কাছে এসে তাই হাত ধরে হাসি

সে-ও হাসে চন্দ্রতোয়া আলো পেয়ে,

কপালের কাছে গতজনমের সেই ক্ষত।

বলে, ‘আমাকে চিনেছ, আমি মরিয়ম।’

 

একে একে তারা আমাকে জড়ায়:

‘চিনেছ আমায়, চিনেছ আমায়?’

বাতাসে বাতাসে দুলে ওঠে ঘাট

আমি তার কাঁধ ধরে কাঁদি,

একে একে সবাকে জড়াই,

‘তোমাদের মতো আমিও কি মৃত?’

 

সে তখনও পাশে ছিল,

রেখামোছা হাত। বলি, ‘আমাকে চেননি?

তোমার স্বপ্নে যে মেলে চোখ,

আমি সে-ই, তুমি যার প্রেত!’

 

 

৩.

ভোরের আগেই শেষ হলো গান,

অন্য কোনো জীব, অন্য কোনো স্মৃতিধর

না জেনেই শুধে যাবে আমাদের ঋণ—

তমোহা পাথর ঘেঁষে ঘুমাবে তারাও,

মরিয়ম পুঁতে নেবে ধুতরাবীজ গায়;

এ কালো পাথর তার শোকগর্ভে

তমোহর এক যিশু পেতে চায়।

 

 

 

বদনাম

 

ইবাদত নাই গো আমার,       প্রাণভরা শুধু বন্দেগি

দুষ্কালে ফুটেছি হেন চোখ      আসমানে খুঁড়ছি খরা নদী।

      মোরগ-মাথায় চড়া,      লাল নিধি এক আউলিয়া

   রাতের রূপকাঠে লিখি      বিধি বহে অপার দরিয়া।    

  এ ধানের দরগা তলায়       আমি করি যা চিৎকার

   বদনাম হে বদনাম হে       কুমকুম হই রাধিকার!


ব্লার্ব

ফারুক ওয়াসিফের কবিতার কবিতা টোকা দিলেই বাজে। এ জগৎ তাঁরই দেখা। রক্তের শিরার মতো দপদপে এর ভাষা। চমক নেই, আছে গুঞ্জন ফিসফাস আর চিৎকার। আছে ঘনিয়ে আসা এক প্রেম ও বিচ্ছেদের কাহিনী। এই কবিতা  লিখতে চায় আমাদের বিধ্বস্ত সময়ের মর্সিয়া।

জল জবা জয়তুন ও বিষ্মরণের চাবুকের পর তমোহা পাথর যেন এক ‘কালো গীতা’। গল্পের মতো চলন এ কবিতার, জাগায় মহাকাব্যিক বিষাদ। কখনো তা ‘বদনাম হে বদনাম হে, কুমকুম হই রাধিকার’।   

অন্ধকার দূর করার তমোহর পাথর খুঁজতে খুঁজতে এই কবি চলে যান সময়ের শেষ সীমান্তে, যেখানে নদীতে বয়ে যায় লাশ আর মোহনায় ডুকরে ওঠে নদী।

তমোহা পাথররে কল্পনা মনে লেগে থাকে।



ফারুক ওয়াসিফের বই

কবিতা

বিস্মরণের চাবুক (আগামী প্রকাশনী, ২০১৭)

জল জবা জয়তুন (আগামী প্রকাশনী, ২০১৫)

 

প্রবন্ধ

জীবনানন্দের মায়াবাস্তব (আগামী প্রকাশন, ২০১৭)

বাসনার রাজনীতি, কল্পনার সীমা (আগামী প্রকাশন, ২০১৬)

ইতিহাসের করুণ কঠিন ছায়াপাতের দিনে (শুদ্ধস্বর, ২০১১)

জরুরি অবস্থার আমলনামা (শুদ্ধস্বর, ২০০৯)

 

অনুবাদ

সাদ্দামের শেষ জবানবন্দি (প্রথমা, ২০১২)

 

পরিচিতি

ফারুক ওয়াসিফের জন্ম ১৯৭৫ সালে, বগুড়ায়। প্রথম পাঠ বগুড়া মিশন স্কুলে, স্নাতকোত্তর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা ও গল্প লেখা দিয়ে শুরু হলেও প্রতিরোধী রাজনীতিতে জড়িয়ে যান ছাত্রকালেই। পেশাগতভাবে প্রথম আলোর সহকারি সম্পাদক। একই পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক। আগ্রহের বিষয় সাহিত্য, ইতিহাস, জাতীয়তাবাদ ও সমকালীন জীবনধারা। প্রিয় স্থান বহমান নদী, প্রিয় শুশ্রুষা জলসাঁতার, প্রিয় ভয় বিস্মরণ, প্রিয় ক্রীড়া বাংলা ভাষা, প্রিয় ভ্রান্তি মানুষ।

শেয়ার