এখন পর্যন্ত কামুর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৯টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি মুখপত্রহীন, মামুজির নৌকায়, নিগার সুলতানা, আমি রোহিঙ্গা এবং আমাকে এবার পিছমোড়া করো। ৩১ জানুয়ারি ছিলো এই কবির পঞ্চাশতম জন্মদিন। এদিন মাঝ দুপুরে কবির সাথে মিতুল আহমেদের কথা হয়। সেই আলাপ…
১৫ দিন পরে আমি হিসাব করে দেখলাম ৬০টা গান লিখে ফেলছি।
মিতুল আহমেদ
টোটাল লেখালেখির মধ্যে থিকা ২৫টা কবিতা যদি বেছে নিতে বলা হয়, নাম বলা যাবে এই মুহূর্তে?
কামরুজ্জামান কামু
এতগুলার নাম বলতে তো পারব না এই মুহূর্তে।
মিতুল
যে কয়টা হয়
কামু
অই যে… মাতৃভূমি, আমাকে এবার পিছমোড়া করো, এ কার হৃদয়ের কাজল গলে যায়, রণরক্তমাতম, আসাদ, নিখিলসুন্দরী, শল্যরোগীর মেটাফিজিক্স …
আর তো নাম মনেই পড়তেছে না।
মিতুল
ধান বেচা লোক মজার আছে
কামু
ধান বেচা লোক, হ্যাঁ এরকম অনেক পুরানা কবিতা আমার মনেই পড়বে না, বুঝছ? এরকম হবে। মফস্বলে রচিত কবিতা… এরকম একটা কবিতা আছে আমার দ্বিতীয় বইয়ে।
মিতুল
লাস্ট আপনার গত বছর যে বইটা বের হইলো, আমাকে এবার পিছমোড়া করো। এর আগে নব্বই দশকে বা তারো আগে থেকে তো লিখতেছেন। একটা বড়ো জার্নি হইছে। মফস্বল থেকে নগরে আসছেন। লেখাতেও তো বদল হইছে। ভাষা, কন্টেন্টের নানা বিষয়ে চেইঞ্জ আসছে। অনেকে শুরুর দিকের লেখাগুলিকে স্বীকারই করতে চায় না। এখন এসে আপনি আগের লেখাগুলিকে নিয়ে কী ভাবেন?
কামু
সেটা মোটের ওপর প্রত্যেকটা বই বের হবার পরেই আমার একটা ধরো যে অই লেখাগুলোকে আমি বাদ দিয়ে দেই। এরপর নতুন কিছু লেখার, নতুন কোনো ভঙ্গি আনার চেষ্টা করি। সাধারণত এটাই করে আসছি। যেরকম লেখা হয়ে গেল অনেক, আমার আর অইখানে থাকতে ভালো লাগে না।
মিতুল
আপনার লেখার বড়ো একটা ধরন হলো যে গ্রামবাংলার নিবিড় একটা ব্যাপার, এক প্রকারের স্মৃতিকাতরতা থাকে অইগুলো নিয়ে। এটা কেন ঘটে, যাপনের জন্যে?
কামু
এটা ঘটে কারণ আমি তো জায়গাগুলির ভিতর দিয়ে আসছি। নগরের বিষয়-আশয় হয়তো আমি এখনো বুঝতে পারি না। ধরতে পারি না। যে কারণে লোকজন আমারে বলে, সে সরল। যেহেতু জটিলতা আমি বুঝি না। আমি অই গ্রাম থেকে আসার কারণে, গ্রামে বড়ো হবার কারণে সেই দৃশ্যগুলা, সেই বিষয়গুলা আমার মধ্যে আছে। সেগুলাই বের হয় লিখতে গেলে। এবং আমার হয়ত সেই জিনিসগুলা ভালো করে আসে। নাগরিক জটিলতার মধ্যে বেড়ে উঠলে তখন হয়ত আমার কলম থেকে অন্য জিনিস বের হতো। বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপার-স্যাপার আসতো। এই আর কি।
মিতুল
আমাদের বেশিরভাগ কবিই গ্রাম থেকে শহরমুখি হইছেন। সেকারণে হয়ত কিছু হীনমন্যতাও থাকে। আমাদের বয়সী বা বয়সে বড়ো, ছোটো যারা মফস্বলে থাকেন, তাদেরও এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে আসলে। আপনি যখন আপনার শহরে বাইড়া উঠতেছিলেন, এই ব্যাপারগুলা ছিলো কিনা?
কামু
না। আমার এরকম কখনো মনে হয় নাই। আমার লেখা যখন বেশি ছাপা হইছে, যখন আমার নামধাম বেশি হইছিল, সেটা আমি মফস্বলে থাকার সময়েই। ঢাকায় আসার পর বরং জীবিকার কাজকর্মের দিকে বেশি মনযোগী থাকতে হইছে। ফলে যেটা হইছে যে… কোন বিষয়টা নিয়ে যেন কথা হচ্ছে?
মিতুল
অই যে গ্রামে থাকার সময়টা
কামু
অহ, হীনমন্যতা। আমি যখন রংপুরে থাকতাম অইখান থেকেই লেখা পাঠাইতাম। লেখা ছাপা হতো। কে ঢাকায় বড়ো কবি, এসব নিয়ে ভাবতাম না। বড়ো বড়ো কবিদের সঙ্গে দেখা করে মানুষ, আমার কিন্তু অইরকমের অভিজ্ঞতা নাই। আমি শখ করে কারো সঙ্গে দেখা করতে যাব, ধরো সৈয়দ হক। তিনি তো উত্তরাঞ্চলের কবি। কাছাকাছি এলাকার মানুষ। ফলে দেখা করে আসি। আমার কিন্তু কখনো এরকম মনে হয় নাই। আমি আসলে নিজের ভিতরে নিজে থাকার একটা প্র্যাকটিস করছি। পরে এসে তরুণ মানে তোমাদের বয়সীদের সঙ্গে বেশ মেলামেশা করছি। দেখবা যে সিনিয়রদের সঙ্গে আমার বেশি ওঠাবসা নাই। এমনকি সমবয়সীদের সঙ্গেও কম। খেয়াল করছ হয়তবা। কমবয়সীর সঙ্গে মিশতে আমি একটু বেশি আনন্দ পাই। ভারী সেজে থাকা আমার ভালো লাগে না। একটু হালকা, হালকা মেজাজে থাকা এগুলোই আমি পছন্দ করি। যখন তরুণরাও ভারিভারি কথা বলতে চায়, আমি অই জায়গাটায় থাকি না। এগুলারে আমার পার্ট মনে হয় না। খুব একটা যে জ্ঞানচর্চা আমি করি, তা না।
মিতুল
আপনি তো কবিতা লিখেন। শিল্প-সাহিত্যের যে শাখাতেই কেউ কাজ করুক, তার তো ইন্সপিরেশন লাগে। আপনার পেছনেও কোনো ইন্সপিরেশন ছিলো নাকি?
কামু
ব্যক্তি?
মিতুল
ব্যক্তি হতে পারে, ঘটনা হতে পারে। কারো দ্বারা প্রভাবিতও তো হতে পারেন।
কামু
ও। সেটা তো হইছিই। পূর্ববতী যারা লিখেছেন, তাদের প্রায় সবার দ্বারা প্রভাবিত হইছি। আমি তো লিখি সেই স্কুলজীবন থেকেই। ক্লাসের বাংলা বইয়ে যে কবিতা পড়তাম, অইগুলা পড়তে পড়তেই মনে হইছিলো আমিও এইরকম কবি হবো। এরকম করেই আমি কবিতা লেখা শুরু করছিলাম। জীবনানন্দ বলো, মাইকেল বলো… মাইকেলের কবিতায় এত কঠিন কঠিন শব্দের ব্যবহার। মানুষ পড়তেই পারে না। মাইকেলের কবিতা আমার সেই সময়ে একদম মুখস্থ থাকতো। কঠিন বলেই ওটার প্রতি আমার আকর্ষণ বাড়তো এবং মুখস্থ থাকতো।
মিতুল
বাহ্। আপনি পড়ছেনও তো মেবি বাংলা সাহিত্য। নাকি?
কামু
হ্যাঁ। আমি বাংলা সাহিত্যে পড়ছি। পড়লেও অত মনযোগী ছাত্র ছিলাম না। হা হা হা হা অই পাশ করা-টরা লাগে। এই আরকি।
মিতুল
সেক্ষেত্রে আরো একটা কমন প্রশ্ন করি। প্রথম কবিতা কবে ছাপাইছিলেন?
কামু
প্রথম কবিতা ছাপা হইছিল যখন, তখন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে থাকতাম। অইখানে হাইস্কুলে পড়ছি। কলেজেও পড়ছি অইখানে। যা করে তরুণ লেখক-কবিরা, অই সময়টাতে বিভিন্ন রকমের সাময়িকী বের করে। একুশে ফেব্রুয়ারিতে বা বিভিন্ন দিবসে দেয়ালিকা করতে হবে এরকম ব্যাপার থাকে। সেগুলা করতাম। অইখানে তো প্রকাশ হইতোই। আর ঢাকায় আমার প্রথম কবিতা ছাপা হইছিলো কিছুধ্বনি নামে একটা পত্রিকায়। আনোয়ার আহমদ নাকি আহমেদ, ভুলে গেছি এখন—আহমেদই বোধ’য়। আনোয়ার আহমেদ ছিলেন সেই পত্রিকার সম্পাদক। সেই সংখ্যাটার অতিথিসম্পাদক ছিলেন ব্রাত্য রাইসু। আর জাতীয় পত্রিকা যেগুলো, প্রথম ছাপা হয় ভোরের কাগজে। সেটার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন সাজ্জাদ ভাই (কবি সাজ্জাদ শরিফ)। এরপর সাজ্জাদ ভাই আমার বহু কবিতা ছাপছেন।
মিতুল
সেই সময়টায় তো লিটলম্যাগ চর্চাও ছিলো। আবার লিটলম্যাগের সাথে দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলির এক ধরনের বিরোধ ছিলো। একরকম মুভমেন্টের মতো করেই।
কামু
এগুলো নিয়ে আমি অতটা ভাবতাম না। আমি কবিতা লিখতাম। দৈনিকেই বেশি কবিতা ছাপছি। এমনে নিজেরাও একটা লিটলম্যাগ করতাম। লিটলম্যাগ হইলো কি, নতুন কবি-লেখকদের যাদের এখনো দৈনিক পত্রিকাওয়ালারা দেখেনি, যারা নতুন নতুন ভঙ্গিতে লিখবে, বোঝাপড়ার ভঙ্গির কারণে প্রতিষ্ঠান সেগুলা ছাপতেও পারবে না, সেগুলা ছাপার একটা জায়গা হিসাবে লিটলম্যাগ তৈরি হয়। আমরাও করছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে যেভাবে বলা হয়, আমি সেভাবে বুঝি নাই কখনো। প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা বলতে বুঝছি কবিতায় আমার কাছে আমার ঠিক আগের কালে কবিতার সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জীবনানন্দ। জীবনানন্দই হচ্ছে প্রতিষ্ঠান। তো সেইটাকে ভাঙতে হবে। বিরোধিতা না ঠিক, সেটাকে ভেঙে নতুন একটা রাস্তা বের করতে হবে। সেটা আমি পেরে উঠি নাই আসলে। আমি বুঝতাম যে এটা করতে হবে। কিন্তু আমি ঢাকায় এসে জীবন-জীবিকার দৌড় এবং তা পারা না পারার কারণে আমার নিরবচ্ছিন্ন সাধনা বা গবেষণাগুলা আর করা হয়ে ওঠে নাই অইভাবে। ফলে আমি যেটা করতে চাইছি, জীবনানন্দের কবিতা থেকে বের হয়ে আসলে কি করা যায়? গদ্যময় অক্ষরবৃত্তটা উনি তৈরি করছিলেন। সেখান থেকে বেরোতে হবে। এই চাওয়া থেকে আমি ধরো যে অনেক বেশি মাত্রাবৃত্তের কবিতা লিখছি। আগে বেশি চর্চা হতো, এরকম ছন্দে ঘুরে বেড়াইছি। অ্যাইইই।
মিতুল
তো আমি যতদূর জানি, লেখালেখি করতেই আপনি ঢাকা শহরে আসছিলেন।
কামু
না। এটা কিন্তু ঠিক না। অনেকের ক্ষেত্রে এটা ঠিক। আমার ক্ষেত্রে না। তোমাকে আমি কিছুক্ষণ আগে বলছি, আমি রংপুরে থাকতেই বিখ্যাত কবি হইছি। সমসময়ের অন্য অনেকের চেয়ে আমি বেশি বিখ্যাত হইছিলাম রংপুরে থাকতেই। আমি কিন্তু কবিতা লেখার জন্যে ঢাকায় আসি নাই। আমি পরে ঢাকায় আসছি জীবিকার সন্ধানে।
মিতুল
আচ্ছা। আসলেন। কবিতা লেখালেখির সাথে সাংবাদিক, গীতিকার হিসাবেও আপনার নাম যুক্ত হলো। গান লেখার রাস্তায় কীভাবে এলেন?
কামু
সাংবাদিকতা পেশাটা তো ঠিকই আছে। আমি লেখালেখির লোক। আমি কি করবো? তো সাংবাদিকতাই বেছে নিলাম। সাংবাদিকতা করতে গিয়েই সঞ্জীবদাকে (গায়ক সঞ্জীব চৌধুরী) পাইছিলাম। আমি আসলে সঞ্জীবদার পাল্লায় পড়ে কিছু গান লিখছি। কখনো ভাবিও নাই যে আমি গান লিখবো। সঞ্জীবদার সাথে মেশার ফলে, সঞ্জীবদার সাথে আড্ডার ফলে উনি আমাকে উদ্বুদ্ধ করছেন, গান লিখলে টাকা পাওয়া যাবে। যেহেতু তখন আমার খুব টাকাপয়সার সংকট ছিলো, আমি ভাবছি যে আচ্ছা, তো গান লেখা যায়। (হেসে) সেইজন্য আমি গান লেখা শুরু করছিলাম। মার্কেটিং-টার্কেটিংয়ের ব্যাপার আছে, সেগুলা আমার করা হয়ে ওঠেনি। মার্কেটিংটা আমার খারাপ।
ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস তো বদলে যাবার ইতিহাস।
মিতুল
আপনি যে গানগুলা লিখছেন এবং সঞ্জীবদা গাইছেন, প্রত্যেকটা গানই এখনো মানুষ শোনে। এবং নস্টালজিক হয়। পরবর্তীতে আর গান পেলাম না। সঞ্জীবদার অনুপস্থিতিই কী আপনার আর গান না থাকার কারণ?
কামু
এইটার গল্পটা আমি যেভাবে বলি বা যেটা সত্য, সেটা হচ্ছে উনি যেদিন গানের কথা বললেন, আমি ১৫ দিনের জন্যে মামার বাসায় চলে গেলাম যাত্রাবাড়িতে। অই সময়ে আমি আর আসি নাই এদিকে। অইখানে ১৫ দিন পরে আমি হিসাব করে দেখলাম ৬০টা গান লিখে ফেলছি। লিরিকগুলা আমি যখন সঞ্জীবদার কাছে নিয়া আসলাম, অই দুই-তিন বছর পরপর অ্যালবাম বের করে। সেখানে দুই-একটা করে গায়। ফলে আগ্রহটা হারায়ে ফেলছি। আমি যেভাবে ভাবছিলাম, এভাবে গান লিখতে থাকব, সব বিক্রি হয়ে যাবে আর আমার অনেক টাকা হয়ে যাবে। (হেসে) তা যখন ঘটলো না, তখন আমি হতাশ হয়ে আর অইপথে পা বাড়াইনি। ধ্যুৎ, কি আর হবে।
মিতুল
তো ৬০টা গানও তো সংখ্যায় অনেক আসলে। ১২/১৩টার মতো মনে হয় আমরা জানি।
কামু
১২/১৩টা হবে কিনা, আরো কম বা অই টাইপেরই হবে আর কি।
মিতুল
বাকী গানগুলির কী হইলো পরে?
কামু
পরে হারায়ে-টারায়ে গেছে। পরে আরো নুরুল আলম আতিকের প্ররোচনায় লিখছিলাম ১২টা গান। ১২টা সে নাটক বানাইতো, ১২টা কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলো মেয়ে। এবং এই ১২টা চরিত্র নিয়ে ১২টা গান লিখছিলাম আমি, প্রত্যেকটা নাটকের জন্যে একটা একটা করে। পরে ওর কাছ থেকেও হারায়ে গেছে, আমার কাছ থেকেও হারায়ে গেছে। আমার যেমন কোনো বইয়ের সংগ্রহ নাই অই অর্থে। সব হারায়ে গেছে।
মিতুল
অই ১২টা গান নাটকে ব্যবহার হয় নাই? নাকি শুধু লেখা পর্যন্তই।
কামু
অই লেখা পর্যন্তই। পরে আর অই প্রজেক্টটাই ওর করা হয়ে ওঠে নাই। দুজনেই হারায়ে ফেলছি। কম্পিউটার নষ্টটষ্ট হইলে উদ্ধার করা যায় না। এরকম কিছু একটা ঘটছে।
মিতুল
এরপরেও তো একটা সিনেমার জন্য লিখছিলেন মেবি
কামু
হ্যাঁ। অই যে অই ছেলেটা, অন্তু আজাদ, ওর সিনেমায় আছে। ও বোধ’য় যেটা ট্রাই করছিলো, সেটা বের করতে পারে নাই। অইদিকে ও আবার শুটিং করে ফেলছে। তো আমি বললাম, অই ফুটেজগুলা আমাকে মেইলে দেন। ফুটেজ দেখে দেখে আমি গান লেখি। আমি তোমায় চাই রে বন্ধু … এই গানটা ফুটেজ দেখে দেখে লেখা।
মিতুল
আহ হা হা এইটা জানতাম না তো। ফুটেজ দেখে দেখে গান লিখছেন। বাহ। সঞ্জীবদার সাথে কাজ করতেছিলেন, গান লিখতেছিলেন, এরপর নির্মাণের প্রতি কীভাবে আকৃষ্ট হইলেন? এর পিছনের ঘটনা কী?
কামু
অই যে আমি সাংবাদিকতা করে আসতেছিলাম, তো আমি ছিলাম যায়যায়দিনে। যায়যায়দিন যখন দৈনিক পত্রিকা হলো, সঞ্জীবদাদের সঙ্গে গিয়ে আমিও জয়েন করছিলাম। বিনোদন বিভাগে। ফিচার এডিটর ছিলেন সঞ্জীবদা, আমি ছিলাম বিনোদন সম্পাদক। সেখান থেকে হঠাৎ আমাদের চাকরি চলে গ্যালো। অনেকের। সেখানে যখন অনেকের চাকরি চলে গ্যালো, আমি সাংবাদিকতা পেশাটার প্রতি আগ্রহ হারায়ে ফেললাম। আমার তো বউ-বাচ্চা আছে, আমি নিরাপত্তার সন্ধান করতেছিলাম সবসময়। নিরাপদে কাজ করে খাওয়া যাবে, এরকম। তো দেখলাম এই চাকরির তো কোনো ভরসা নাই, যখন-তখন বিনা নোটিশে এই চাকরি চলে যায়। যখন-তখন বিপদে পইড়া যাব। তখন অই পেশার প্রতি আগ্রহ হারাইলাম। আর ঢাকায় আসার পর কি করব কি করব ভাবনায় এক সময় সিনেমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি। সে সময় সরয়ার (নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী) কাজ করতেছিল, ওর দেখাদেখি আমারো মনে হইল, আচ্ছা আমিও তো এগুলা পারব। এবং তারো আগে ফিল্ম এপ্রিসিয়েশন কোর্স করছিলাম। ব্যাপারটা কি, একটু বোঝার চেষ্টা। এটা করে খাওয়া যায় কিনা এবং অই কারণেই আমি ছবি-টবির প্রতি আগ্রহী হইছিলাম। ২০০৫ বা ছয়ে আমি ‘স্ক্রিপ্ট রাইটার’ বানাইছিলাম। মনে হইলো, অইদিকেই ড্রাইভটা দেই এখন। দিতে গিয়ে তো স্ক্রিপ্ট রাইটার বানাইলাম। আবার ‘ডিরেক্টর’ বানাতে গেলাম। ডিরেক্টর বানাতে গিয়ে কি কাহিনী হইলো সেইটা তোমরা জানোই। প্রতিভার কামড় খাইলাম। প্রতিভার কামড় খাইয়া আমি পাগলামির চরম সীমায় পৌঁছে গেলাম। আমার কাছে ছবিটার এখনো মূল্য আছে অনেক। শিল্পমূল্য আর বাজারমূল্য তো এক জিনিস নয়। সৌন্দর্য অর্থে শিল্পমূল্য বলে অনেক সময়। মানুষ বলে জিনিসটা সুন্দর। এই সুন্দরটারে ভেঙে দেওয়াও যে আর্টের একটা কাজ হইতে পারে, সেটা আবার ধরতে পারে না। ফলে এই-সেই কারণে ছবিটা এলোমেলো, কোথাও বেচতেই পারলাম না। তাদেরও লিমিটেশন আছে। আমি তো এখন বুঝতে পারি বিষয়টা। আচ্ছা আমি নিজে একটা টিভি চ্যানেলের সাথে থাকলে এরকম একটা উল্টাপাল্টা জিনিস চালামু কিনা। তো সেই বুদ্ধিটা আমার তখনো হয় নাই।
মিতুল
নির্মাণে আপনি ডিরেক্টরও করছেন আবার স্ক্রিপ্ট রাইটারও করছেন। স্ক্রিপ্ট রাইটারটা লোকজন প্রশংসা করে, যারা সিনেমা-টিনেমা বুঝে তারাও ইনভলভ থাকে আলোচনায়। ডিরেক্টরের কথা বললেই লোকে আলোচনা থেকে সরে যেতে চায়। এটা আসলে কেন?
কামু
এইটা আসলে ওখানে (স্ক্রিপ্ট রাইটারে) পাগলামি ছিলো না। এইখানে (ডিরেক্টরে) পাগলামিটা যে লেভেলে লোকজন নিতে পারে, তারচেয়ে বেশি ছিলো। রুচির জায়গাটায় কিছুটা ধাক্কা ছিলো। ছবিতে একজন কবিকে এফডিসিতে নিয়ে গিয়ে নাচানো হচ্ছে, এই জিনিসটা মূল্যবোধে আঘাত হানে। মূল্যবোধে আঘাত করার কারণে এই ছবিটা নিয়ে কথা বলতে চায় নাই কেউ। মানুষের রুচিতে লাগছে যে, এটা কি করলো! এই জাতীয় জিনিস। কবি তো, মানুষ আশা করে যে তার একটা ঝোলা থাকবে, পাঞ্জাবি পরবেন। তার বদলে আমি এফডিসির নায়িকা নিয়া নাচানাচি করতেছি। মূল্যবোধে, রুচিতে আঘাত লাগার কারণে নেয়নি এটা বা নিতে পারেনি।
মিতুল
তো আপনি বলতে চাইছেন যে, সচেতনভাবেই আপনি একটা ধাক্কা দিতে চাইছিলেন
কামু
হ্যাঁ, আমি সচেতনভাবেই করছি এটা। নাহলে এরকম কেন করতে যাবো। আমি জানতাম রুচিতে একটা বাড়ি মারব। কারণ এই রুচিবানরা জীবিকার জায়গায় আমাকে অসহযোগিতা করছে। মানে অই মূল্যবোধটাকেই নেগেটিভলি দেখছি আরকি। ধাক্কা দিতে হবে, বাড়ি দিতে হবে এবং এই রুচির সামনেই আমার এফডিসির নায়িকার কাপড় খুলতে হবে। এই জিনিস আমি করতে চাইছি।
মিতুল
হ্যাঁ, সেইটা হইছে।
কামু
ফলে তারাও ধাক্কা দিছে আমাকে। ছবি তো বাইরই করতে পারতাম না। শেষে, যাই হোক, কীভাবে হলো দেখলাই তো।
পলিটিক্সের বাইরে তো কিছুই নাই। ওটাও পলিটিক্স যে তুমি জীবনানন্দের ভাষাকে ভেঙে অন্য একটা ভাষা নির্মাণ করতে চাও।
মিতুল
সেটা বটে। এখন হচ্ছে কামু ভাই, এইবার কোনো বই আসতেছে?
কামু
এইবার বইটা করতে চাই না। গতবারো বের হইছে (আমাকে এবার পিছমোড়া করো)। এইবার আমি একটু গ্যাপ দিতে চাইতেছি। এমনিই। নতুন চাকরি, নতুন লাইফস্টাইল, এইটাতে একটু সেট হওয়া দরকার। সব মিলিয়ে এবার আমার বই করার স্পৃহা নাই আরকি। এই কবিতা-টবিতা গোছাবো, এই কাজগুলা এইবার করতে ইচ্ছা করতেছে না। আগামীবার হয়তো করব।
মিতুল
কামু ভাই, আরেকটা ব্যাপার। এই যে ধরেন আপনার গত তিরিশ বছরের জার্নিটা করে আইসা এখন একটা কর্পোরেট জব করতেছেন। একজন কবির যাপনের সাথে এগুলি সাংঘর্ষিক কিনা?
কামু
এইটা তো আগেও ছিলো। মাইকেল তো একজন বড়ো কবি আমাদের। তাই না? মাইকেল অই ধরনের পাঞ্জাবি পরা কবি ছিলো না তো। আমার কাছে এরকম মনে হয় না। যাপন মানে একটু ময়লা থাকা, একটু ইয়ে থাকলে…এইভাবে আমি কখনো বুঝি নাই জিনিসটা। যেই জীবনে থাকবো, সেই জীবনের প্রভাব নিশ্চয়ই কবিতায় কিছুটা পড়বে। ভাষার বিবর্তনের ইতিহাস তো বদলে যাবার ইতিহাস। অন্যান্য আর্টগুলাও যা, এইটা ইতিহাস ধরে হয়। অই যে বললাম না যে, জীবনানন্দ আমার আগের সবচেয়ে বড়ো প্রতিষ্ঠান কবিতায়। তারপর এই প্রতিষ্ঠানের কোন কোন জায়গায় ভাঙতে হবে, এই রূপটাকে ভেঙে নতুন রূপটাকে কীভাবে তৈরি করা যায়, এইগুলাই তো খেলা। তুমি ব্যক্তি কি ধরনের, কোন জায়গায় আছো সেটা তো প্রভাব রাখেই। তুমি কি ইন্টারন্যাশনাল ক্যারেক্টার? যেমন আমাদের মাশরুর আরেফিন দেখো, উনি কিন্তু চরিত্র হিসেবে একটু আন্তর্জাতিক। ওনার পড়াশোনাও অই ধরনের, ঘোরাফেরাও অই ধরনের, ওনার কবিতায় আসবে কি? অই জিনিসগুলাই তো আসে। উনি গ্রামও জানেন। ফলে উপাদানগুলা নানাদিক থেকে আসতেছে। আবার সুব্রত অগাস্টিন গোমেজও দেখো যে, তার পড়াশোনার কারণে নানা ধরনের জিনিসপত্র আসে। এখন যে যে-ই রেখা ধরে আগায়ে আসছে, সে সে-ই জীবনের সে-ই পরিবেশ-প্রতিবেশের থেকেই তো তার ইমেজগুলি আসবে।
মিতুল
সেটা ঠিক। তারপরো কোট-টাই পরার পর আপনার কাছেও নিশ্চয়ই এসব প্রশ্ন আসে। তখন কেমন লাগে আসলে?
কামু
আমার কাছে তো বিষয়টা কোট-টাই পরা দিয়ে না, আমার কাছে বিষয়টা জীবিকা দিয়ে। আমি জীবিকার সন্ধানে নানাকিছু করতেছিলাম, এখানে এসে একটু স্থির মনে হচ্ছে। ফ্রেশ থাকতে পারতেছি। এবং এই ফ্রেশ থাকতে ভালো লাগে তো। আগের জীবনযাত্রার কারণে, পেশাগত কারণে থাকাটা হতো না। ভাল্লাগে তো। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকি। কোট-টাই পরতে আমার ভালোই লাগে। হা হা হা হা…
মিতুল
ঠিক আছে।
কামু
কবিদের জন্য আদর্শ যেসব পোশাক-আশাক ভাবা হয়, অগুলো পরতেই আমার শরম লাগে। কবি আমি, আমি এরকম করবো। এসব ভাবলেও শরম লাগে। একজন মানুষ কিরকম ড্রেস পরবে, দেইখো লক্ষ্য করে, সেটা কিন্তু তার পেশার ওপরে নির্ভর করে।
মিতুল
একটা কর্পোরেট যাপন তো আছে।
কামু
কর্পোরেট যাপন আবার কি। এখন সবই তো কর্পোরেট। তোমরাও তো কর্পোরেট।
মিতুল
অবশ্যই
কামু
এখন তো সব প্রতিষ্ঠানই কর্পোরেট হয়ে গেছে। কর্পোরেটযাপনের কিছু না। আমি তো কাজ শেষে সেই বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি, সেই বউ-বাচ্চার কাছে ফিরে যাচ্ছি। একইরকম। সেই অভিজ্ঞতাগুলো তো পাল্টে যায় নাই। আমার কর্পোরেট লোকজনের সাথে ওঠাবসার কাহিনী খুব একটা নাই। কারণ আমি যে কাজটা করি, সেই কাজটার ধরন এমন যে তা অফিসেই হয়ে যায়। বাইরে কিছু মেইনটেইন করতে হয় না। বাসায় গেলে আমি আমার মানুষ হয়ে যাই।
মিতুল
আচ্ছা। কামু ভাই, আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ প্রশ্ন। একজন কবিকে কতটা পলিটিক্যাল হওয়া উচিত বা কতটা স্বাধীন হলে কবির জন্যে ঠিক আছে এতটুকু?
কামু
সব মানুষই তো পলিটিক্যাল। পলিটিক্সের বাইরে তো কিছুই নাই। ওটাও পলিটিক্স যে তুমি জীবনানন্দের ভাষাকে ভেঙে অন্য একটা ভাষা নির্মাণ করতে চাও। আর তুমি কি পলিটিক্স বলতে দলাদলি এসব বলতেছ? এগুলো যদি বলে থাকো, এই যে, সাহিত্যের বাজারে যে পলিটিক্স হয়, কে কার দলে, কে কার বন্ধু, এসব ধরো সাহিত্যপাঠের রুচি বা সাহিত্যপাঠের অভিজ্ঞতা বা কে কোন অরিয়েন্টেশনের ভিতর দিয়ে আসছে, সেসবের ওপরেই নির্ভর করে কে কার বন্ধু।
মিতুল
সে-ই
কামু
দেখা গেলো যে, আমি যে অরিয়েন্টেশনের ভিতর দিয়ে আসছি, সেই অরিয়েন্টেশনের সাথে যাদের ম্যাচ করে, বন্ধুত্বটাও তো তাদের সাথেই হবে। তারপর কাজ করতে গিয়ে সমমনা, সমরুচির লোকেদের সাথে কিছুটা ইয়ে হয়। সেইটা আমার মধ্যেও কিছুটা আছে। সেই অর্থে আমি কোনো দলাদলির ভিতরে নাই। আমার বন্ধু আছে, সে দেশে থাকুক আর বিদেশে থাকুক, এরকম কিছু বন্ধু আছে যাদের লেখা পড়তে আমার ভালো লাগে। যাদের সাথে কথা বললে, সে আমাকে সহজে বুঝতে পারে। আমিও তার কথা বুঝতে পারি সহজে।
মিতুল
বোঝাপড়ার সিংকটা ভালো হয়
কামু
হ্যাঁ হ্যাঁ। আর পলিটিক্স, পলিটিক্সের বাইরে তো কিছুই নাই। সেই অর্থে পলিটিক্স তো জরুরি জিনিস।
মিতুল
ভাসা-ভাসা কথা হইলেও অনেক কথাই হইলো, কামু ভাই। আপনাকে ধন্যবাদ।
কামু
তোমাকেও।