সিনেমার মতো এক পর্বতাভিযানের গল্প ।। ইলিয়াস কমল

পৃথিবীতে ৮ হাজার মিটার উঁচু পর্বত আছে মাত্র ১৪টা। এর মধ্যে নেপালের এভারেস্ট পৃথিবীর সবচে উঁচু, যার উচ্চতা ৮ হাজার ৮শ ৪৮মিটার। এর মধ্যে সবার আগে (১৯৫০) মানুষ জয় করছে নেপালের অন্নপূর্ণা। সর্বোচ্চ চূড়া এভারেস্ট জয় করতে আরও তিন বছর সময় লাগছে। তেনজিং নোরগে আর এডমুন্ড হিলারি ওই কাজ করছে ১৯৫৩ সালে। আর চীনের শিশাপাঙ্গমা চূড়া জয় করছে মানুষ সবচে পরে। ১৯৬৪ সালে। কিন্তু পর্বতারোহনের ইতিহাসে এই ষোলটি চূড়ায় ওঠা মানুষের সংখ্যা খুবই কম। তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ান ইউএম হঙ গিল একজন। ২০০১ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম ও পৃথিবীর চৌদ্দতম ব্যক্তি হিসেবে এই রেকর্ড করেছিলেন তিনি। এই রেকর্ড করার পেছনে সবচে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করছে পার্ক মোতায়েক নামের আরেক কোরিয়ান পর্বতারোহী। হঙ গিল তার সঙ্গে এভারেস্ট ও কাঞ্চনজঙ্ঘা অভিযানসহ বেশ কয়েকটি অভিযানে ছিলো।

পরে হঙ গিলকে ছাড়া এভারেস্ট অভিযানে গিয়ে আরও দুই পর্বতারোহীসহ মারা যায় পার্ক মোতায়েক। তার মৃত্যু খুব নাড়া দেয় হঙ গিলের মনে। সে সিদ্ধান্ত নেয় এভারেস্টের ৮ হাজার ২শ মিটার বা তার আশপাশে যেখানে মোতায়েক মারা গেছেন বলে জানা গেছে, সেখান থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করবেন। তারপর দল গঠন করেন। আর দলে যোগ দেয়াদের মধ্যে হঙ গিল নিজে ছাড়া আর কেউ কাঞ্চনজঙ্ঘার চেয়ে বেশি উপরে উঠে নাই কখনো। এমন একটা দল নিয়ে ৫৬ দিন খুঁজে পার্ক মোতায়েক এর মরদেহ খুঁজে বের করেন। যদিও শেষ পর্যন্ত নিচে নামানো যায় নি তাকে।

এভারেস্টে হঙ গিল
এভারেস্টে হঙ গিল

গল্পটা এখানেই শেষ না। এর আগে ও পরে আরও অনেক গল্প আছে। প্রথমে আগের গল্পটাই বলি। পার্ক মোতায়েক যখন তার সমসাময়িক বন্ধুদের নিয়া এভারেস্ট বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, তখন তার সাথে ছিলো পুরনো বন্ধু পার্ক জেয়ঙ বুক। সে আবার হঙ গিলের নেতৃত্বে কাঞ্চনজঙ্ঘা মিশন দিয়ে দুই বন্ধুর পর্বতারোহন অভিযান শুরু করছিলো। মোতায়েক যখন এভারেস্টের ৫ হাজার ৪শ মিটার উপরে বরফ ঝড়ে ও দুর্ঘটনার কারণে আর এগুতে ও পিছাতে কোনটাই পারছে না, তখন কোনও উদ্ধারকারী দলও যায় নাই তাকে আনতে। তার কারণ বাজে আবহাওয়ায় ওখানে যাওয়া মানে অনেকটা মৃত্যুকে ডেকে আনা। এই অবস্থায় তিন নম্বর ক্যাম্প- বেস ক্যাম্প থেকে অনেক ওপরে ও এভারেস্টের চূড়া থেকে ১ হাজার মিটার নিচে (মনে হয়, ভুলে গেছি) থেকে নিজেদের ক্যাম্প করছিলো ওরা। সেখানে জেয়ঙ বুক পার্ক মোতায়েকের জন্য অপেক্ষা করছিলো। আর বারবার বেস ক্যাম্পে বলছিলো উদ্ধারকারী দল পাঠাতে। যেহেতু তাদের উদ্ধার করতে কেউ যায় নি, মাইনাস ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে সে বন্ধু পার্ক মোতায়েককে খুঁজতে বের হয়ে যায়। যা পৃথিবীর কোনও পর্বতারোহীই করবে না।

22810436_10214449755097063_900387767_o

 

সারারাত সার্ভাইভ করে ভোরবেলা মোতায়েককে সে আবিষ্কার করে। তখনো মরে নি সে। কিন্তু নিজের অবস্থা এত খারাপ হয়, আর ফিরে আসেনি জেয়ঙ বুক! পরে যখন হঙ গিল মোতায়েককে খুঁজে বের করে, তখনও জেয়ঙ বুককে খুঁজেছিলো দলের অন্যরা। কিন্তু পায় নি। হঙ গিল, মোতায়েককে কথা দিছিলো, একসাথে ১৪টা চূড়ায় উঠবে দুই বন্ধু। কিন্তু মোতায়েক মারা যাওয়ায় তার এই স্বপ্ন বাধা পড়ে যায়। কিন্তু মোতায়েককে দেয়া কথা রাখে হঙ গিল। ২০০১ এ সে পূরণ করে বন্ধুকে দেয়া কথা। এবং তা উৎসর্গ করে বন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। পার্ক  মোতায়েক বাস্তব চরিত্র, হঙ গিল তো কোরিয়ান পর্বতারোহীদের কাছে এখনো জীবন্ত কিংবদন্তী। তাদের দুজনের বাস্তব ঘটনাকে অবলম্বন করে নির্মিত ছবি ‘দ্যা হিমালয়াস’। ছবিতে হঙ গিল, পার্ক মোতায়েক চরিত্রে অভিনয় করা দুজনেই বেশ উপভোগ্য ছিলো। সাধারণত ছবির গল্প নিয়ে আমার কম লিখা হয়, রুচি হয় না। কারণ ছবির গল্প আসলে বলে দেয়ার মাঝে কোনও কৃতিত্ব নাই। তবে এই ছবিতে গল্পই সবচে বড় নায়ক। তাই ছবিটা নিয়ে গল্পের মতোই বলতে চেষ্টা করা। আর সবচে বড় কথা হলো, ছবি শুরু হলে আর শেষ না করে উঠা যাবে না।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading