মজনু শাহের কবিতাঃ শব্দের অনেক আয়নায়… | খান রুহুল রুবেল

প্রস্তাবনা

 

“বিজেত্রীর ঘরে আমি যাই নি সেদিন,লোকে তবু
আমাকেই বেরুতে দেখেছে। ভ্রষ্ট সেই সন্ধেবেলা
গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞাময় সংলাপের দিকে
হেঁটে গেছি এক স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো… “

এইরকম পঙক্তি মাথার ভেতরে অথবা পকেটে নিয়ে এককালে আমরা হাঁটাহাঁটি করেছি। সময়টা বোধহয় প্রথমবর্ষ। জেনেছিলাম কবির নাম মজনু শাহ, কবিতার বইয়ের নাম লীলাচূর্ণ। কবির নাম আমার কাছে ছদ্মনাম মনে হতো। প্রকৃতপক্ষে সময়টাই ছিল এমন, যেকোন আসলকেই ছদ্ম বলে মনে হয়। যদিও তখন লীলাচূর্ণের কাল নয়, কেননা তার কিছুকাল পরেই জেব্রামাস্টার এসে গেছে আনকা মেঘের পৃথিবীতে।


শব্দই কবিতা, এ বাক্য মজনু শাহের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর পূর্বসুরী মালার্মে নন, সুধীন্দ্রনাথও নন। কেবল শব্দসংস্থাপন, কিংবা বাক্যের জ্যামিতিক পরিমিতি আবিষ্কার তাঁর কবিতার কাজ নয়।


তারপর থেকে মজনু ভাইয়ের সাথে ফেসবুকে সংযোগ। কথা হয়না কখনোই, অথবা কখনো কখনো হয়।আমাদের মনে থাকে না। আরো জানা গেল মজনু ভাই থাকেন গ্লাডিয়েটরদের দেশে, সেখানে জেব্রা চরিয়ে থাকেন, সন্ধ্যায় কোন এক ভূগোলের শিক্ষিকার কাছে জেব্রাদের জমা রাখেন। আমাদের সন্দেহ হয়। জেব্রা তো আফ্রিকায়, কোন রহস্যময় বাণিজ্যে সে গ্লাডিয়েটরদের কাছে পোষ মানে? আমরা এখন এমন এক ভূগোলে দাঁড়িয়ে আছি, যেকোন ভূগোলকেই সন্দেহের চোখে দেখা ভালো।

পুনরায় লীলাচূর্ণ কেন লেখেন না তিনি? কিংবা আনকা মেঘের জীবনী? কিংবা মধু ও মশলার বনে? এই প্রশ্ন যে হাস্যকর তা জানতে আরো কিছু বয়স ও অভিজ্ঞতা লেগে গেছে। এ পৃথিবীতে পুনরায় বলে কিছু হয় না। কবিতার অসুখ কর্কটরাশির মতো ছড়িয়ে যায়, কিন্তু একই অসুখে সে কখনো দুবার মরেনি।

তারপর কেটে গেছে বহুদিন, মূলত বহুবছর। প্রচুর কবিতা লিখেছি আমরা, মজনু ভাইও লিখেছেন। বহুকিছু বদলেছে এতদিনে। কবিতার গঠন, কবিতার কাঠামো সম্পর্কে আমার বা অনেকের ধারণা বদলেছে, আগ্রহ বদলেছে। যেরকম লেখা একসময় লিখতে ভালো লেগেছে তা আর এখন লাগে না, যেরকম লেখা একসময় পড়তে ইচ্ছে করেছে, এখন মনে হয় তার চেয়ে কিছুটা অন্য কুসুম পেলে ভালো হতো, অন্য কোন পাখিমাতায়।মজনুর ভাইয়ের ভাষার চাইতে সেটা হয়তো কিছুটা দূরেরই। মজনু ভাই আগের মতোই রয়ে গেছেন। জেব্রাদের দেখভাল করেন, কিছুকাল ফেসবুকে থাকেন কিছুকাল থাকেন না।

সংঘমিত্রার বনে উটপাখির আড়ালে তিনি নিঃশব্দ ঐরাবত, যে ভাষা জল খেতে আসে তাকে তিনি তুলে নেন কোমল থাবায়, তারপর ছুঁড়ে দেন দূরে, তার কিছুটা চিরনক্ষত্রের পাশে সমাহিত হয়, কিছু এসে জমা হয় বাল্মীকির কুটিরে।  শব্দের অশরীরী ও ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবিম্বকে নিয়ে মজনু ভাইয়ের এক কবিজন্ম কেটে গেল। এও তবে এক বিস্ময়কর সন্দেহ? শুধু শব্দ নিয়ে এই এতদূর হেঁটে যাওয়া?

 

দৈবাৎ এসে পড়েছি শব্দের রাস্তায়

উপর্যুক্ত কথাগুলো লিখেছিলাম মজনু শাহের কবিতাসংকলন বাল্মীকির কুটির প্রকাশিত হবার পর। সেখানে যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে সেটা আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে মজনু শাহকে পড়ার অভিজ্ঞতা। আজ পুনরায় মজনু শাহকে নিয়ে লিখতে গিয়ে বাল্মীকির কুটিরে এসে পৌঁছলাম। তমসা-তীর্থ পেরিয়ে দেখলাম উঁইঢিবি নয়, রয়েছে পাতার কুটির, যার দুয়ারে লেখা— ‘দৈবাৎ এসে পড়েছি শব্দের রাস্তায়…’।

মজনু শাহের প্রথম কবিতার বই আনকা মেঘের জীবনীর ভূমিকার প্রথম বাক্য এটি। মজনু শাহের ভুবনে প্রবেশের দরজায়, আপনাকে স্বাগত জানাবে এই বাক্য, কিংবা জানাবে একটি সতর্ককতা সংকেত। কারণ বহু অরণ্যের পথ ও সলিল সন্তরণ শেষে, দৈবাৎ, যেন অজানিতেই আপনি ঢুকে পড়ছেন শব্দের রাস্তায়।

শব্দের রাস্তায় আমরা কেন যাব? কোথায় পৌঁছে দেবে এইসব শব্দেরা? আমাদের ভারতবর্ষের বিশ্বাসে শব্দই ব্রহ্ম। মহাজন ও আদিপিতা মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেন, শব্দে শব্দে যে বিয়ে দেয় যেই জন সেই জন কবি’। মাইকেল যে দেশে অঙ্কুরিত ও বিনষ্ট হচ্ছিলেন সেই ফরাসীদেশের কবি মালার্মে এ সম্বন্ধে চূড়ান্ত কথাটি দুই শব্দে আমাদের জানান—  শব্দই কবিতা।

তবে শব্দই কবিতা, এ বাক্য মজনু শাহের জন্য প্রযোজ্য নয়। তাঁর পূর্বসুরী মালার্মে নন, সুধীন্দ্রনাথও নন। কেবল শব্দসংস্থাপন, কিংবা বাক্যের জ্যামিতিক পরিমিতি আবিষ্কার তাঁর কবিতার কাজ নয়। বরং তাঁর পূর্বপুরুষ হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ, অরুণ মিত্র, উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, আবদুল মান্নান সৈয়দ, সিকদার আমিনুল হক, জহরসেন মজুমদার কিংবা আরো অনেকে। যাদের নাম নেয়া হলো তাঁদের অনেকের সকল কবিতায়, কারো অধিকাংশ কবিতায়, কারো কিছু কিছু কবিতায় আমরা এমন এক জগতের সন্ধান পাব যা শব্দ, ধ্বনি, ইঙ্গিত ও দৃশ্যের।

“মেলে ধরো, স্বপ্নরাক্ষস, এই আনকা মেঘের জীবনী,
একদিন তুমি ছিলে ডালিমকুমার,
এখন আগন্তুক মাত্র, কোনো গুপ্ত পরিখার ভিতর
বনভূমির স্মৃতিবাহী একটি পাতা মাত্র”

……….

“একটানা দুলে চলেছে কায়াপিঁড়ি, বসব কোথায়?”

……….

“ক্যসিনো টেবিলে হয়তো কারো জন্য অপেক্ষা করছে
একটি কাকতাড়ুয়া। এখানে আমি
প্রহরীর অধিক কিছু নই। দমকা হাওয়ায়
তাসের রানির পিছে উড়ে গেল তাসের জোকার।
জোকারের পিছে রাজা উড়তে গিয়ে পড়ে রইল মেঝেয়।
চোঙা লাগানো গ্রামোফোনে কে বেজে উঠবে এখন,
আঙুরবালা না গহরজান?

……….

“লৌহজং। লৌহজং। পৃথিবীতে স্টেশন লুপ্ত হয়, কেউ কেউ পায় তবু আঁধারের রঙ। লৌহজং। রাত রাত লৌহ চুরি যায়, আকাশে ছায়া ফেলে ঘুমায় নীল সঙ। লৌহজং।”

 

শব্দই অস্তিত্ব তার

আনকা মেঘের জীবনীর পর মজনু শাহের দ্বিতীয় কবিতার বই লীলাচূর্ণ। সেটার উপক্রমনিকায় তিনি জানাচ্ছেন শব্দই অস্তিত্ব । আনকা মেঘের জীবনী পেরিয়ে তিনি এবার অনেক বেশি বৃষ্টিসম্ভব। এই প্রথম কবিতাগুলি আকার পাচ্ছে বাষ্প থেকে জলকণায়। আরো ঘনীভূত, আরো বেশি বর্ষণমুখর। এর কাঠামো, দৃশ্যময়তা, আকার, আকৃতি আমাদের কখনো কখনো মনে করিয়ে দেবে বিনয় মজুমদারের ফিরে এসো চাকা’র সেই লীলাময়ী করপুট। তবে এটা, ফিরে এসো চাকা নয়, এটা লীলাচূর্ণ। শব্দ, বাক্য, দৃশ্য ও ইঙ্গিতের জগত মিশ্রিত করে যে কবিতাগুলি তৈরি হলো এখানে, তার জৈবদেহ অনেক বেশি সংহত। ৩৬টি ভুক্তিতে বিন্যস্ত এই বইতে আমরা যেসব কবিতা পেলাম, সেসবের অধিকাংশতেই রয়েছে একেকটি সম্পূর্ণ শরীর। শব্দের রাস্তায় দৈবাৎ আসার ঘোষণা থেকে শব্দকেই অস্তিত্ব বলে প্রতিষ্ঠা করার এই বিপজ্জনক পথ মজনু শাহ কখনো পরিত্যাগ করেননি। সে পথের সবথেকে বড় সরাইখানার নাম লীলাচূর্ণ। সমস্ত বাংলা ভাষার রাস্তাতেই লীলাচূর্ণ এক স্টেশন, যেখানে প্রায়ই আমাদের রাত্রিকালীন ট্রেন এসে নামিয়ে দেয়।

“আমাকে নিক্ষেপ করো পৌরাণিক গল্পের অরণ্যে
একটি বিন্দুর মতো, শোনো, আর কিছু চাইব না।
কোথাও রয়েছে প্রশ্ন প্রহরীর স্খলিত নিদ্রায়,
সেইসব দেখি আর থমকে থাকি ঘাসের পাখায়
তারার ধুলোর মতো, তারারশ্মি, তুমিও নশ্বর!
আমি কি পেখম এত বয়ে নিতে পারি মহাকাল
যেখানে করুণ ছায়া ছায়াজাল আহা জালখানি
ক্রমশ জড়ায় অঙ্গে! যতিচিহ্ন ছড়ানো জঙ্গলে
আজ কোথা থেকে এত তুলো উড়ে আসে ওগো হেম
ওগো রক্তমাখা বীর, কোনো যোনিপুষ্প ঢেকে দিতে
আমাকে বলো না আর, শাদা স্তব্ধ পিয়ানোর কাছে
আমার কবিতা তবু মূর্চ্ছা যেতে যেতে জেগে ওঠে,
তখনও দূরের গদ্য থেকে অপরূপ ফুল্কি উঠছে
ধসে পড়ছে দেখো ধুলো হচ্ছে ক্রমে লেখার টেবিল।”

…….

“বিজেত্রীর ঘরে আমি যাইনি সেদিন, লোকে তবু
আমাকেই বেরুতে দেখেছে। ভ্রষ্ট সেই সন্ধেবেলা
গোলাপ ও আফিমের প্রজ্ঞাময় সংলাপের দিকে
হেঁটে গেছি এক স্বপ্নরিক্ত নটরাজনের মতো।
সেই হাড়-কঙ্কনের পথে, প্রভু, ভেবেছি বিস্ময়ে:
রঘু ডাকাতের মতো হয়ে যাই কেন যে আমরা
ওষ্ঠ চুম্বনের লগ্নে! মাটিতে অর্ধেক ডুবে থাকা
রথের চাকার গোঁয়ার্তুমি কীভাবে শরীরে জাগে!
নায়িকা-চূর্ণের রাতে, মৃত বেলফুলের ভিতর
তার গাঢ় কেশগন্ধ আমি পাই। বিজেত্রী বলেছে:
কাছে না এসেও এইভাবে নিকটে থাকার পথ
উন্মুক্ত রয়েছে, এইভাবে, বাক-বিভূতির দেশে
পৌঁছে গিয়ে দেখা যায় ঘুম-হারা কত মীনশব্দ,
কার স্পর্শ লেগে ওঠে ধীরে শিখীবর্ণ যবনিকা…”


জনু শাহের কবিতায় তাহলে কী সেই গূঢ়-সংকেত? যা গোলকাধাঁধাঁকে পরিণত করে চলাচলে? সংগীতময়তা। মজনু শাহের কোনো কবিতাই সংগীত নয়, কিন্তু তা সাংগীতিক, কখনো কখনো আনমনা স্বরলিপির মতো সজল।


আলী এক আশ্চর্য তোরণ

লীলাচূর্ণে প্রতি কবিতায় যে শরীর তৈরি হলো, এবার মজনু শাহ একটি একক ভাস্কর্য নির্মাণে প্রস্তুত হলেন।  সেই প্রস্তুতি বা সিদ্ধি আমরা দেখতে পাই মধু ও মশলার বনে নামক কবিতাপুস্তকে। মধু ও মশলার বনে মূলত এক ডানাওয়ালা কফিন যা ধাওয়া করে চলেছে মৃত সহোদর ভাইয়ের স্মৃতিময় বনভূমি। সহোদরের বিষণ্ণ স্মৃতিতে ভরা মেঘ, মিস্ট্রি, মর্মলোকের এমন কবিতা বাংলা ভাষায় রয়েছে এমন নজির আমরা পাই না। কেবল, শহীদ কাদরীর ‘অগ্রজের উত্তর’ নামক কিংবদন্তি হয়ে ওঠা উদাসী মর্মরে ভরা কবিতাটি ছাড়া আর কোনো দৃষ্টান্তও মনে পড়ছে না। কাদরীর কবিতাটি অগ্রজের বয়ানে নিজের প্রতিকৃতি বর্ণনা। আর এখানে অনুজের নির্মিত স্মৃতিতে অগ্রজের মশলাময় শরীর, মধুময় হলাহল।

“আমার সমুখে এক অন্ধ
অতি ধীরে খুলে দেয় আশ্চর্য তোরণ—
আনে পদ্মের সহায়,
আনে পানপাত্রখানি, হাসির ফোয়ারা;
পোড়া এই জীবনের বাঁকে ভাই ছাড়া
তেমন কে আর করে গূঢ় আপ্যায়ন?

এই স্যানাটেরিয়ামে বসে
তারা গুনে গুনে কারা হলো আত্মহারা?
কারা বলেছিল, নলখাগড়ার বন খুব বেশি দূরে নয়,
দূরে নয় চিরন্তন সুধা— ”

অনেক রথের চলাচল

শব্দের রাস্তায় দৈবাৎ আসার ঘোষণা থেকে শব্দকেই অস্তিত্ব বলে প্রতিষ্ঠা করার এই বিপজ্জনক পথ মজনু শাহ কখনো পরিত্যাগ করেননি। কেন এই রাস্তা বিপজ্জনক? বহু ব্যবহার ও অতি উৎপাদন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কবিতায় তালিকা প্রবণতা (একইরকম বাক্যের বারবার ব্যবহার, উদাহরণ শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি’) যেমন বহু বছর ভূতগ্রস্ত করে রেখেছিল কবিতাযশপ্রত্যাশী বহু কিশোর ও বালিকাদের। যে-কোনো স্কুল ম্যাগাজিনের কবিতায় এখনো আমরা দেখা পাই সেই ভাষা ও বর্ণনার ভঙ্গী। তেমনি, এখনকার তরুণেরা কবিতা লেখার প্রথম প্রহরে সহজেই আক্রান্ত হন শব্দ ও বাক্যের এই বিমূর্ত প্রকাশময়তার দিকে। আশির দশক হতে শুরু হয়ে পরবর্তী চল্লিশ বছরে এই জ্বর ও ঘোর উপশম হয়নি। যেহেতু বিমূর্ত বাক্য ও শব্দ তৈরি আপাতদৃষ্টিতে সহজ বলে মনে হয়, ফলে আমরা অজস্র কবিযশপ্রার্থীকে দেখি পরপর কতগুলো বিমূর্ত বাক্য থালায় সাজিয়ে মনে করছেন সেটুকুই কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে যা সহজ বলে মনে হয়, ভবিষ্যত বিচারে আসলে সেটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল এক প্রহেলিকা। যিনি সংকেত সমাধানে সক্ষম, তিনি ঠিক পাঠককে সেই দৃশ্য ও ধ্বনি ও ইঙ্গিতের ভুলভুলাইয়াতে ঢুকিয়ে আবার বের করে আনতে পারেন। যিনি সেই সংকেতের গূঢ় অভিসন্ধি সমাধানে সক্ষম নন, তিনি কেবলই কতগুলো আত্মরচিত গোলকধাঁধায় ঘোরাফেরা করেন। কবিতাকে সকলভাবে অগম্য করে তোলাই তাঁদের লক্ষ্য।

মজনু শাহ তাঁর কবিতায় এই গূঢ় সংকেত সমাধানে সক্ষম, কারুকার্যগুলো করায়ত্ত, ফলে একের পর এক বইতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন বাকবিভূতি নিয়ে হাজির হয়েছেন। তবু, এটুকু দেখি যে জেব্রামাস্টার, ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না, আমি এক ড্রপাউট ঘোড়া এই বইগুলোতে পাঠক কখনো কখনো ভাবতে পারেন, এই পান্থশালায় যেন আর জায়গা নেই। অথবা, যে তাস বেটে চলেছে সরাইটেবিলে, সেখানে সে দর্শকমাত্র, ইসকাপনের টেক্কায় যেন তাঁর অধিকার নেই। এই বইগুলোতে মজনু শাহকে আশ্রয় করতে হয়েছে এমন কিছু কৌশল, যাতে পাঠকের হাতে তাস না থাকলেও, চাল দেয়ার উত্তেজনা তাঁকে টেবিল-সংলগ্ন করে  রাখে। জেব্রামাস্টারের ধ্বনিমাধুর্ধ, ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না বইয়ের দৃশ্য নির্মাণের ফাঁকে ফাঁকে আচমকা প্রশ্নের কৌশল, এর উদাহরণ। এই পুলসিরাতটুকু পার হয়ে গেলে, ফের আবার ‘বাল্মীকির কুটির’ কিংবা ‘ধীরে রজনী ধীরে’ বই দুটিতে পাঠক তাসের আসরে নিজেই বসার সুযোগ পান। যেন যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটি স্পর্শ করেছে। মজনু শাহের কবিতায় তাহলে কী সেই গূঢ়-সংকেত? যা গোলকাধাঁধাঁকে পরিণত করে চলাচলে? সংগীতময়তা। মজনু শাহের কোনো কবিতাই সংগীত নয়, কিন্তু তা সাংগীতিক, কখনো কখনো আনমনা স্বরলিপির মতো সজল। একটি একটি করে পুষ্পচয়নমাত্রই যেমন মালা নয়, তার চাই সুতোর শশীকুসুম সমন্বয়, যা আনন্ধ করে ও নিজে গোপনীয় থাকে, বিমূর্ত কবিতার জগতে ওটুকুই আমাদের পথখরচ ও মানচিত্র।

“আজ আমার সকল সৃষ্টিছাড়া পঙক্তির গায়ে বিকেলের স্নান স্বর্ণচ্ছায়া এসে পড়ুক, কিম্বা তার পাশে জ্বলে উঠুক শুকনো পাতার স্তূপ। ব্যাধ ফিরে এসে দেখবে, ছাই উড়ছে শুধু।
কতটুকু সত্য কাছাকাছি আসে আনন্দের? তীর্থ-বিতাড়িতদের বলি, ভাঙা বেহালার মধ্যে আমার সমস্ত পাপ ঠেসে ভরাতে চেয়েছি।
এখন ফিরে আসুক সেইসব পাখিরাও, মৌরিজঙ্গল ছেড়ে , একদিন যারা উড়েছিল সাগরের পথে।”

 

এবার ফিরাও মোরে

আশির দশকে বাংলাদেশের কবিতায় যে বিমূর্ত ভাষ্যের সূচনা হয়েছিল ও পরবর্তীকালে লাভ করেছিল সর্বব্যাপী জয়জয়কার, সে পথ বোধ হয় বড়সড় বাঁক নিতে শুরু করেছে একবিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে। কবিতা বিষয়ে গত চল্লিশ বছরের ধারণা ও ধরন পালটে যাচ্ছে অতি দ্রুত, যেমন পালটায় কয়েক দশক দশক পরপর। বাংলাদেশের কবিতায় অন্তত কয়েকজন কবি মনে করছেন, বাংলা কবিতাকে জ্যামিতি থেকে জমায়েতে বসাবার। বাংলা কবিতা তাঁদের হাতে হয়ে উঠছে অনেক বেশি রক্তমাংসময়। গত চল্লিশ বছরের ধ্বনিভাণ্ডার ও ধ্বংসাবশেষ ছেড়ে তারা তাকাচ্ছেন আরো অতীতে, সুদূরের সুতোয়। আমি নিজেও, বাংলা কবিতার একজন সহযাত্রী হিসেবে, সেই অতীতময় ভবিষ্যতেই আমার আস্থা ও প্রত্যয় প্রকাশ করি।

কিন্তু, এই এতকাল পরেও মজনু শাহের কবিতা একের পর এক পড়তে গিয়ে দেখি এ এমন এক ধ্বনিজগত যা ধানের মতো চিরকালীন। মজনু শাহের ভাষা এমনই যে পাঠমাত্র বলে দেওয়া যায় এ কালি কোন কলঙ্কের। যেন আমি গিয়ে বসেছি এক উড়ন্ত সেলুনে, চারপাশে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অজস্র অপেক্ষা ও অক্ষর। অনেক গল্প, অনেকের। আর সামনে পেছনের বহুপ্রতিবিম্বী আয়নামহলে একের পর এক দৃশ্য জন্ম নিচ্ছে।

“আমার ইশতেহার নাই, বহু শব পেরিয়ে একটা শিউলিগাছের কাছে পৌঁছতে চাইছ”

 

যবনিকা

মজনু ভাই, তাহলে আমাদের কথা হবে ফের। মথ যেখানে মন্বন্তরের মানে জানে না। সমুদ্র যেখানে ক্লাসপালানো নদীদের সমাবেশ। আর আমাদের পশমিটুপি, সুনির্মম…

“রাত্রিবেলা, একেকটা মৌরিফুল, একজনের স্বপ্ন আরেকজনের কাছে
নিঃশব্দে বিক্রি করে দেয়।
উল্কাঝড় শুরু হলে এই কাণ্ড আমি স্বচক্ষে দেখেছি।”

 



খান রুহুল রুবেল

কবি ও গদ্যকার। জন্মঃ ১৯৮৭। জন্ম ও বেড়ে ওঠা গোপালগঞ্জে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন।  প্রায় এক যুগ ধরে বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য, বিজ্ঞান, সভ্যতার ইতিহাস এবং অর্থনীতি তাঁর পাঠ ও চর্চার বিষয়।

আসক্তি : ভাষাচর্চা, সঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত শোনা, নানা রকম বইয়ের অনুসন্ধান ও সংগ্রহ।

প্রকাশিত বই : ‘ডুবোপাহাড়’ (২০১৭, কবিতা), ‘প্রাচীন বিজ্ঞান’ (২০১৭, বিজ্ঞান/ ইতিহাস)।

শেয়ার