The spuds are black
The turnips are black
Every last leaf of cabbage in the pot is black.
(Excerpted from the poem Dubh by Nuala N’ Dhomhnaill)
আইরিশ গ্যালিক ভাষায় Dubh অর্থ ঘোর-কৃষ্ণ। স্রেব্রেনিৎসা ধ্বংসযজ্ঞের স্মরণে আয়ারল্যান্ডের কবি নুয়ালার কবিতায় পূর্ণগ্রহণের কালো চাদরে ঢেকে যায় গোটা বসনিয়ার আকাশ। দক্ষিণ ইউরোপের পার্বত্য অঞ্চলটির প্রেতপুরীতে রূপান্তরিত হওয়া, সেখানটায় অপছায়া নেমে আসা আর বীভৎস রক্তপিপাসায় মুসলিম, ক্রোয়াট এবং সার্ব অধ্যুষিত বসনিয়ার ক্ষত বিক্ষত হবার আভাস আছে যে কবিতায়।
দ্রিনা নদী থেকে অল্প দূরে অবস্থিত স্রেব্রেনিৎসা শহরের গণহত্যা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচাইতে অন্ধকারাচ্ছন্ন বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড হিসেবে ইতিহাস-স্বীকৃত। মাত্র পাঁচ দিনে বসনিয়ান সার্ব মিলিটারি হাজার হাজার নিরস্ত্র মুসলিমকে হত্যা করে। ধর্ষিত হয় অজস্র নারী। যুগোস্লাভিয়ার ভাঙনের পর স্লোভেনিয়া তারপর ক্রোয়েশিয়া থেকে শুরু করে শেষতক বসনিয়ায় এসে সামরিক সংঘাত দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বসনিয়ান মুসলিমদের সবচাইতে বেশী মূল্য দিতে হয়েছিল সেই অগ্নিযজ্ঞে। পুরো সংঘাতটি বোঝার জন্য; কবিতাগুলোও; যুগোস্লাভিয়ার ভাঙ্গন কিংবা মিলোশেভিচের উত্থানটুকু বোঝা জরুরী।
ঐক্যে ভাঙ্গনে লড়াইয়ে যুগোস্লাভিয়া
কিংডম অব সার্বস ক্রোয়াটস এন্ড স্লোভেনস। ১৯১৮ সালে গঠিত হয়েছিল সার্বিয়া, মন্টেনিগ্রো, স্লোভেনিয়া, মেসেডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়া আর বসনিয়া হার্জেগোভিনা মিলে; পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে সার্ব ক্রোয়াট স্লোভেনদের ভূমিটি যুগোস্লাভিয়া নামে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। মার্ক্সিস্ট রাষ্ট্রনায়ক জোসিপ ব্রজ টিটোর নেতৃত্বে ঐক্যে- সংহতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল যুগোস্লাভিয়া। যদিও অভিযোগ আছে সংবিধান প্রণয়ন করে নিজেকে আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখার কালাকানুন কিংবা জিডিপির ফুলে-ফেঁপে ওঠা আলাপ, একচ্ছত্র ক্ষমতা করায়ত্ত করে ফেলা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, বিরোধী মতকে বরদাশত না করতে পারাসহ স্বৈরতন্ত্রের এটা-সেটা মোটামুটি জারী রাখার পরেও মার্শাল টিটো অখণ্ড যুগোস্লাভিয়ার এক মহানায়ক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন পাকাপোক্তভাবেই। সমাজতন্ত্রে দেশ গড়লেও সোভিয়েত আদর্শ থেকে যুগোস্লাভিয়াকে যিনি আলাদা রাখতে পেরেছিলেন। অখণ্ড যুগোস্লাভিয়া রক্ষার্থে যিনি ভাতৃত্বের মন্ত্র জপতে উদ্বুদ্ধ করতে চাইতেন শেষ নিঃশ্বাস-তক। যেহেতু যুগোস্লাভিয়া ছয়টি প্রজাতন্ত্র, পাঁচ জাতি, চার চারটে ধর্ম, তিনটি ভাষা, দুই রকমের বর্ণমালা এবং আটটি জাতিগত সংখ্যালঘুর সমন্বয়ে গঠিত একটি দেশ, সে কারণে স্বয়ং টিটো তার শাসনভারকে সংজ্ঞায়িত করতেন বেশ জটিল বাক্যেই। বলা হয়ে থাকে মার্শাল টিটোর শাসনামলে অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা ছিল, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিও আপাতদৃষ্টিতে বিরাজমান ছিল।
তবে ১৯৮০ সালে মার্শাল টিটোর মৃত্যুর পর অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা পরবর্তী তীব্র জাতিগত সংঘাত দেখা দিলে যুগোস্লাভিয়ায় ভাঙনের মরণ খেলা শুরু হয়। মরণ খেলা এই জন্য যে সমঝোতায় সমাধান চেষ্টা সম্ভব হয়নি সেখানে, বরং রক্তক্ষয়ে অঙ্গচ্ছেদ হয়েছিল যুগোস্লাভিয়ার।
ভয়াবহ বলকান সংঘাত- গণহত্যার রক্তনদী পেরিয়ে, উত্তর মেসেডোনিয়া, বসনিয়া- হার্জেগোভিনা আর স্লোভেনিয়া স্বাধীন হয়ে যায়। ‘ফেডারেল রিপাবলিক অব যুগোস্লাভিয়া’ হিসেবে সার্বিয়া আর মন্টেনিগ্রো একসাথে কিছুকাল টিকে থাকলেও মন্টেনিগ্রো ২০০৬ সালে আলাদা হয়ে যায়। সার্বিয়ার স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল কসোভো স্বাধীন হবার মধ্য দিয়ে একীভূত যুগোস্লাভিয়ার অস্তিত্ব ইতিহাসে বিলীন হয়ে যায়।
মিলোশেভিচ উপাখ্যান
বেলগ্রেড লীগ অব কমিউনিস্টস সিটি কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১৯৮৪ সালে মনোনীত হবার পর স্লোবোদান মিলোশেভিচ অল্প কয়েক বছরের ভেতরই প্রেসিডেন্সি অব দ্য সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অব সার্বিয়া এবং লীগ অব কম্যুনিস্টস অব সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
মিলোশেভিচের উত্থান যখন হচ্ছিল সার্বিয়ায় সে সময় ছিল দুটি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল; কসোভো এবং ভ্যোভোদিনা। কসোভোতে শতকরা পচানব্বই ভাগ আলবেনিয়ান মুসলিম বসবাস করত- সার্বরা সেখানে ছিল সংখ্যালঘু। মন্টেনিগ্রো কিংবা পুরো সার্বিয়াতে অর্থোডক্স খ্রিষ্টান সার্বরা যেমন দাপুটে, কসোভোতে আবার স্বাভাবিকভাবেই তেমনটা না। সার্ব প্রেসিডেন্ট ইভান স্তাম্বোলিচ তার অতি নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক অনুচর স্লোবোদান মিলোশেভিচকে ১৯৮৭ সালে কসোভো পরিদর্শনে পাঠান। সংখ্যালঘু সার্বরা তাদের নেতার সাথে ব্যানার প্ল্যাকার্ড সাথে নিয়ে সাক্ষাতে জমায়েত হলে এবং আলবেনীয় মুসলিম কর্তৃক বঞ্চনার কথা বলতে গেলে তাদেরকে বাধা দেয়া হয়। স্বায়ত্তশাসিত কসোভো পুলিশ এক পর্যায়ে তাদের ওপর লাঠিচার্জ করলে মিলোশেভিচ সমাবেশ ডেকে এক ঐতিহাসিক বক্তব্য প্রদান করেন। যার একটি বাক্য ছিল “আজ থেকে কারো অধিকার নেই তোমাদের আঘাত করবার”। বাক্যটি রাতারাতি তাকে সার্বদের মহানায়কে পরিণত করে ফেলে। সার্ব অধিকার আদায়ের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে সার্ব জনগণের মানসপটে মিলোশেভিচের নামখানা একেবারে খোদাই হয়ে গিয়েছিল সে সময়। যার কারণে পরবর্তীতে বহুদলীয় নির্বাচন সংঘটিত হলে মিলোশেভিচ সার্বিয়া মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
বাকি রিপাবলিকগুলো ১৯৯২ সালে আলাদা হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে শুরু করে দিলে সে সমস্ত এলাকা সংখ্যালঘু সার্বরা নিজেদের অনিরাপদ ভাবা শুরু করল। যেমন কসোভোর সার্বরা চাইলো আলবেনিয় মুসলিমরা কসোভো ছেড়ে সমভাষা- সমধর্ম- সমসংস্কৃতির দেশ সীমান্তবর্তী আলবেনিয়াতে পাড়ি জমাক। সার্বরা আরও অভিযোগ করছিল আলবেনিয় বংশোদ্ভুত কসোভো জনগণ তাদের ওপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ নিচ্ছে। ক্রোয়েশিয়ার সার্বরা আশংকা প্রকাশ করছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ক্রোয়েশিয়ান ন্যাশনালিস্টরা যে দমন-পীড়ন চালিয়েছিল সার্বদের ওপর তার পুনরাবৃত্তি আবার শুরু হবে কি না। বহুজাতিক বসনিয়ায় বছরের পর বছর বসবাস করার পরও জাতিগত এবং ধর্মগত বিভেদ, পারস্পরিক অবিশ্বাস কিংবা ঘৃণা বেড়েই চলছিল। পরিণতিতে আন্তঃজাতিগত এবং ধর্মীয় সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
বসনিয়ান কবি আসমির কুজোভিচ হয়ত জাতিতে-জাতিতে বিরোধে বিক্ষুব্ধ হয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন যুদ্ধের সময়, যার কোন শিরোনাম খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রচুর হতাহতের পরপর সেই দিনটিতে
আমরা মূত্রে ডোবানো পাহাড়টায় নিজেদের আবিষ্কার করলাম।
আমরা যখন নেচে যাচ্ছিলাম আর অ্যাকর্ডিয়ান বাজাচ্ছিলাম
মেষশাবকের মাংশ ঝলসানো হচ্ছিল, পানীয়ের প্রবাহও ছিল অবাধ
চেৎনিকরা তাদের হারানো অবস্থান যেন ফিরে পাচ্ছিল
এবং পার্টি চালিয়ে যাচ্ছিল,
আমাদেরই চুকানো মুল্যে।
(*সার্বদের তুচ্ছার্থে চেৎনিক পরিভাষাটি ব্যবহৃত হয়।)
পপুলিস্ট মিলোশেভিচ ক্ষমতা পাবার পর মাত্র পাঁচ মাসের ভেতর তার ঘনিষ্ট সহচর এবং পরামর্শদাতা ইভান স্তাম্বোলিচকে হত্যা করে ফেলল। বৃহত্তর সার্বিয়া গঠনের নিমিত্তে ক্ষমতায় আসীন হবার সাথে সাথে উন্মত্ত হয়ে পড়েছিল সে। বাকি দেশগুলো স্বাধীনভাবে নিজেদের পরিচালনা করতে পারবে কি পারবে না তাই নিয়ে সাবেক যুগোস্লাভিয়ার প্রধান দেশ হিসেবে সার্বিয়া হস্তক্ষেপ চালানো শুরু করল। জাতিসত্ত্বার পাশাপাশি ধর্ম বিবেচিত হল মোটাদাগে। ক্যাথলিক এবং অর্থোডক্স ক্রিশ্চিয়ান অধ্যুষিত স্লোভেনিয়া, মন্টেনিগ্রো কিংবা মেসেডোনিয়ার ব্যপারে ঐ সময় মিলোশেভিচ নজরদারি না করলেও প্রতিবেশী বসনিয়া-হার্জেগোভিনা কিংবা অন্তঃর্গত রাজ্য কসোভো নিয়ে ভিন্ন পরিকল্পনা আটছিল। আবার অন্যদিকে ক্রোয়েশিয়ার সংখ্যাগরিষ্টদের ধর্ম ক্যাথলিক হলেও সেখানকার সংখ্যালঘু সার্বরা নতুন ক্রোয়েশিয়ার নীতির প্রতি আস্থাহীনতা প্রকাশ করে।
এছাড়াও মিলোশেভিচের পরম লক্ষ্য এবং রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি ছিল বৃহত্তর সার্বিয়া, শুধুমাত্র সার্বরাই বসবাস করবে তার স্বপ্নের সেই সার্বিয়ায়। সব মিলিয়ে মিলোশেভিচ প্রথমেই ক্রোয়েশিয়ায় দাঙ্গা বাঁধিয়ে দেয়। সেখানকার শহর ভুকোভারকে টার্গেট করে সার্ব আর্মি, রক্ষীবাহিনী- মিলিশিয়া ব্যবহার করে ঐ দাঙ্গায় উল্ল্যেখযোগ্য সংখ্যক ক্রোট নাগরিক, যুদ্ধবন্দী, মুসলিম এবং হাঙ্গেরিয়ানদের হত্যা করা হয়। ভুকোভারে এরপর সার্ব আধিপত্য জারী হয়।
নব্বই দশকে কবিতারা নিষ্প্রভ পাহাড়ের দেশে
ইজেত সারাজলিচ (১৯৩০- ২০০২) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সবচাইতে পরিচিত কবি। এই বসনিয়ান কবি তার জীবনের সাতান্নটি বছর সারায়েভোতে অতিবাহিত করেন। সার্বো- ক্রোশিয়ান ভাষায় লেখা কবিতাগুলোর ইংরেজী তরজমা করেছেন সি পলোনি। ১৯৯৩ সালের সারায়েভো ওয়ার জার্নালে কবি ইজেত সারাজলিচের To my Former Yugoslav Friends এবং A Theory of Maintaining Distance শিরোনামে কবিতা দুটো প্রকাশিত হয়। দুটো কবিতাতেই দূরত্ব বিষয়ক দুঃখবোধটুকু স্পর্শ করা যায় অন্তত।
রাতারাতি আমাদের কী হয়ে গেল বন্ধু
আমি জানি না তোমরা কী করছো
কী লিখছো
কার সাথে বসে পান করছো
ঠিক কোন বইগুলোতে নিজেদের প্রোথিত করছো?
আমি কিছুই জানি না
বন্ধু আছি তবু আজও।
(আমার প্রাক্তন যুগোস্লাভ বন্ধুদের সমীপে)
সার্বদের অযৌক্তিক কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি পেতে বসনিয়া বারবারই দাবী জানিয়ে আসছিল। আবার বসনিয়াকদের সাথে ক্রোয়াটদেরও সংঘাত বেঁধে গেল এরই ভেতর। ক্রোয়েশিয়াও চাইলো আলাদা হতে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মোড়ল দেশগুলো তাদের সে দাবীর পক্ষে তখন না দাঁড়ালেও পরবর্তীতে গণভোটের শর্ত দেয়। সার্বরা স্বভাবতই সে গণভোট ইস্যুকে গ্রাহ্য করতে চাইলো না। বসনিয়ান সরকার গণভোটে অংশ নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বসনিয়ার পক্ষে ৬৪ শতাংশ ভোট পায়।
১৯৯২ সালে বসনিয়া ইউরোপিয়ান কমিটির স্বীকৃতি পেল। তাদের স্বাধিকারের ঘোষণার পরপরই সার্বিয়াভিত্তিক এক সামরিক দল বসনিয়া-হার্জেগোভিনার শহর বিজেলিনা আক্রমণ করে মাত্র একদিনে প্রায় ৭৮ জনকে হত্যা করে। ক্রমাগত খুন, দণ্ড আর ধর্ষণের শেকড়টা প্রথিত হয়ে যায় তখনই। সার্বিয়ার সীমান্তবর্তী শহরগুলোকে বিজেলিনার ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়েছিল পরবর্তী চার-চারটি বছর ধরে। জীবন জীবিকার ক্ষয় ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলছিল। প্রিয়েডর, ভিজেগার্ড, যভরনিক, ভ্লাসেনিৎসা, টুযলা, ফোসা নগরে বিপুল পরিমাণে রক্তপাত হল; স্রেব্রেনিৎসাতেও। ১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে ম্লাদিচ বাহিনী জাতিসঙ্ঘ ঘোষিত নিরাপদ নগরী স্রেব্রেনিৎসা অবরোধ করে ফেলেছিল। কবি সারাজলিচের কবিতায় মাটির নীচে ঢুকে পড়া শহরগুলো আর মানুষের পারা না পারা সংক্রান্ত হৃদয়ের আকুতি যেন কিছুটা হলেও বিহ্বল করে দিতে পারে।
লেখকদের ভেতর দূরত্ব বজায় রেখে চলার তত্ত্বকথা তো আবিষ্কার করে ফেলেছে
ক্রোড়পত্রের সেই লেখকসমাজ
যারা ঝুঁকি এড়ানোতে সদা তৎপর বিপদে পড়তে চায় না কোন
আমি কিন্তু তাদেরই একজন,
যারা বিশ্বাস করে
সোমবারেই সোমবারের কথাগুলো বলা উচিৎ
কেননা মঙ্গলবারে হতে পারে খুব বেশি দেরি হয়ে যাবে।
মাটির নীচের ভাঁড়ারে বসে কবিতা লেখা দূরহ তো বটেই,
কিন্তু মাথার ওপর ফাটছে যখন মর্টারের শেল
একটি মাত্র কবিতা লিখে ফেলতে না পারাটা যে আরও বেশী কঠিন!
(দূরত্ব বজায়ের তত্ত্বকথা)
বসনিয়ান সার্ব নেতা রাদোভান কারাদজিচ। যিনি নিজেও একজন কবি। উগ্রতা এবং চরমপন্থা যার কবিতার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। স্লোভেনিয়ান দার্শনিক স্ল্যাভো জিজেক কারাদজিচের কবিতাকে গুরুত্বহীন কিংবা তামাশার বস্তু হিসেবে বাতিল করে দেবার বদলে নিবিড়ভাবে পড়তে বলেন, কারণ জিজেকের মতানুসারে এইসব কবিতার মধ্য দিয়ে জাতিগত নির্মূল সংঘটিত হবার বিবিধ সূত্রের দেখা মেলে। কারাদজিচ তার এক নামবিহীন কবিতার উৎসর্গপত্রে জনৈক ইযলেত সারাজলিচকে উদ্দেশ্য করে লিখলেন,
আমার নতুন ধর্মদলে যোগ দাও
আমি এমন কিছু প্রস্তাব করছি যা আগে কেউ কখনো করেনি
আমি তোমার জন্য উগ্রতা এবং মদ প্রস্তাব করছি
যার কোন রুটির বন্দোবস্ত থাকবে না তাকে আমার একান্ত সূর্যালোক থেকে প্রতিপালিত করা হবে
আমার এই ধর্মে কোন কিছুই নিষিদ্ধ নয় হে জনতা
দেখা মিলবে সস্নেহ কিংবা প্রেমাতালের
যতক্ষণ তোমার মন চাইবে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারবে
এই মহান দেবতা তোমায় কিছুই নিষেধ করবে না
ভিড় ফুঁড়ে আমার ডাকে সাড়া দাও ওহে সমধর্মী!
সার্বিয়ার স্বার্থে তৎকালীন এই রাষ্ট্রপ্রধান নির্বিচারে মানুষ হত্যাকে নীতিসিদ্ধ বলে মানতেন। বসনিয়ান গৃহযুদ্ধে অগণিত নারী শিশু তরুণ যুবা বৃদ্ধ হত্যার নেপথ্যের কারিগর তিনি। রাদোভান কারাদজিচকে বলকানের কসাই উপনামে ডাকা হত আড়ালে, যেমন ডাকা হত মিলোশেভিচ অথবা রাতকো ম্লাদিচকেও। এক আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে তিনি বললেন, যদি যুদ্ধ বেঁধে যায় তবে মুসলিমরা সার্বদের হারাতে পারবে না।
কারাদজিচের নির্দেশে তার সামরিক অধিনায়ক রাতকো ম্লাদিচের পরিচালনায় এক স্রেব্রেনিৎসাতেই মুসলিম পরিচয়ের কারণে প্রায় সাড়ে আট হাজার মানুষ মারা হল। বসনিয়ার সাথে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলে সামরিক বাহিনী নিয়ে হামলা চালানো হল স্রেব্রেনিৎসায়। ত্রিশ হাজারেরও বেশী শিশু ও নারীকে বিতাড়িত করা হয় নিজ ভূমি থেকে। পতিতালয় আখ্যা দিয়ে (আট মাস ধরে কারে কারো ক্ষেত্রে) নির্মম এক যুদ্ধাস্ত্রে লাগাতার আহত করা হত- মেরেও ফেলা হত নন-সার্ব নারী ও শিশুদের, সে যুদ্ধাস্ত্রের নাম ধর্ষণ। বন্দিত্ব বরণ করতে লাগলো বেশুমার মানুষ। ওমার্স্কা মানয়াসার মত বিভিন্ন জায়গায় দেখা দিতে লাগলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প। সে যেন আরেক হলোকাস্ট শুরু হল বিশ্বে। বহুজাতিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের শহর রাজধানী সারায়েভোও কারাদজিচ- ম্লাদিচের মরণছোবল থেকে নিষ্কৃতি পেলনা। সারায়েভোর মুসলিম জনগোষ্ঠীও অবরুদ্ধ হল। দেড় মাসের মত অবরুদ্ধকালীন সময়ে বলকানের কসাইটির নির্দেশে আবারো হাজার মুসলিমের প্রাণ ঝরে পড়ল।
A Massage of Thanks; Good- Luck Sarajevo Style; The beginning, after everything কবিতাগুলোর লেখক গোরান সিমিচ। সাহিত্যকর্মে সদা সক্রিয় এই কবি ১৯৫২ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। প্রাচ্য পাশ্চাত্যের সন্ধিস্থল সারায়েভোতে গোরান সিমিচের বইয়ের দোকান ছিল। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত অবরুদ্ধ শহরটিতে তিনি বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে ছিলেন। ১৯৯৫ সালের পর থেকে তিনি কানাডায় বসবাস করছেন।
এখনো তবু বেঁচে আছি
সারায়েভোতে,
এই মুহূর্তে এই বেঁচে থাকার মানে গিয়ে দাঁড়ায়
আমরা অনেক কাল আগে বেঁচে ছিলাম।
আর আগামীর দিনযাপন নিয়ে আলাপচারিতার মানে
স্বপ্ন দেখা।
আমার চূড়ান্ত আশ্রয় যেন এক সাদা কাগজ
আর আমার ধর্মটা
সে কাগজে লিখতে পারা পেন্সিল।
(কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের বার্তা)
সারায়েভোতে,
বিরানব্বই-এর বিরাগ বসন্তে সবকিছু সম্ভব, সব কিছু।
ধরুন একটি লাইনে দাঁড়ালেন আপনি
চেয়েছিলেন রুটি কিনতে
কিন্তু কেমন করে যেন কোন ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে গিয়ে নিজেকে গোটালেন
কাটা-ছেঁড়া পা চারপাশে
অথচ তারপরেও নির্দ্বিধায় বলতে পারছেন
আপনি ভাগ্যবান
(সৌভাগ্য, সারায়েভো ঢঙে)
সারায়েভো তো বটেই গোটা বসনিয়ায় তখন ভয়াবহ এক পাথর সময়। ধোঁয়ার কুণ্ডলী কিংবা মর্মপীড়ার পতঙ্গের ওড়াওড়িতেও আকাশটা ঢেকে গিয়েছিল সেখানে। ৬৪,০০০ জীবন শেষ হয়ে গেল চিরতরে, অর্ধলক্ষ ধর্ষণের হিসেব পাওয়া গেল। অগণিত মানুষ বাড়ি ছাড়া হল- উদ্বাস্তু হল। ২০১৩ সালের সেন্সাসের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বসনিয়ার উত্তর- দক্ষিনাংশের শতকরা পঞ্চাশ থেকে একশত ভাগ বসনিয় মুসলিমকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছিল সার্ব ফোর্সের সেই এথনিক ক্লিনজিং মিশনে।
মাকে তার কবরটায় রেখে আসতে না আসতেই
গোরস্তানময় বারুদের বর্ষণ থেকে পালাবার পর,
বয়ে নিয়ে আসা সৈনিকদের কাছেই জীর্ণ ক্যানভাসের খাটিয়ায় শায়িত আমার মৃত ভাইয়ের রাইফেলটি ফিরিয়ে দেবার পর,
আমার সন্তানদের চোখে ঠিকরে পড়ে অগ্নিশিখা
তাড়া খেয়ে পালানো ভয়ানক ইঁদুরদের সাথে পাতালপুরীর ভাঁড়ারে ঠাঁই নিয়েছিল তারা
সে জ্বলন্ত দৃষ্টিগুলোর আঁচ পাবার পর,
খসখসে ন্যাকড়ায় জনৈক বৃদ্ধার মুখটা মুছিয়ে দেবার সময় তাকে চিনে ফেলবার দুঃশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন হবার পর,
ক্ষুধার্ত কুকুরটাকে পথের কোণায় দাঁড়িয়ে নিজের রক্তাক্ত ক্ষত চেটে খেতে দেখবার পর,
তারপর—
তারও সব কিছুর পর,
খবরের কাগজের প্রতিবেদন যেভাবে লেখা হয়ে থাকে
ঠিক তেমন করেই কবিতা লিখতে চাইলাম আমি।
নির্লিপ্ত নিরুত্তাপ, একেবারেই অনুভূতিহীন, উদ্দীপনা হয় না— যেন ভুলে যেতে পারা যায় সহজেই
আর সে সময়েই কোন আগন্তুক যেন রাস্তায় দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করে বসলেন,
খবরওয়ালাদের মত এমন রসকষহীন কবিতাটা কেন লিখতে গিয়েছি?
(সমস্ত কিছুর পরের শুরু)
কুখ্যাত সে রক্তবন্যার অবসান হল অবশেষে। শোকার্ত নদী পার করে- কিংবা পাথরকুচির লাল ধুলো। বিকৃত দগ্ধ মৃতদেহ আর কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত দালানের চিহ্ন বুকে নিয়ে। ছোট ছোট প্রস্তরফলক বা কড়িকাঠে আলাদা করে রাখা হাজারো গজিয়ে ওঠা কবরের মধ্য দিয়ে। ডেটন শান্তিচুক্তিতে তবু আনুষ্ঠানিক ইতি টানা হল ধ্বংসের। গোড়াপত্তন হল রিপাবলিকা স্রাপ্সস্কা নামের নতুন এক প্রজাতন্ত্রের। ২০১০ সালে সার্বিয়া স্রেব্রেনিৎসার জলাভূমি, রক্ত মেশা কাদা কিংবা অজস্র পুরনো হাড়গোড়ের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করলো।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসও ওই নির্মমতাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বলকানের তিন কসাইকে বিচারের জন্য কাঠগড়ায় হাজির করানো হয় নেদারল্যান্ডসে জাতিসঙ্ঘ নিয়ন্ত্রিত সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে। বিচারকার্য চলাকালীন অবস্থাতেই ভুকোভারের ক্রোয়াট, বসনিয়া-হার্জেগোভিনার অ-সার্ব মুসলিম হত্যাকারী স্লোবোদান মিলোশেভিচের হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়। রাদোভান কারাদজিচের হল চল্লিশ বছরের জেল। অন্যদিকে রাদোভান কারাদজিচের অধীনে কাজ করা সামরিক অধিনায়ক এবং স্রেব্রেনিৎসা গণহত্যার মাস্টারমাইন্ড রাতকো ম্লাদিচের বিচারকার্য আজও স্থগিত আছে।
তথ্যসূত্র
- Endgame: The Betrayal and Fall of Srebrenica, Europe’s Worst Massacre Since World War II;David Rohde
- 1995: Das Massaker von Srebrenica
- What was the Srebrenica massacre?; DW
- The poets of Sebrenica ; Janaki Challa
- How poetry relates to ethnic cleansing SLAVOJ ŽIŽEK
- The Siege of Sarajevo: Sarajlić and Simić; Zócalo Poets
- Srebrenica – Wunden, die niemals verheilen (Bosnien Doku)
- বসনীয় গণহত্যা: নব্বইয়ের দশকে এক বর্বরতার ইতিহাস; ইরফানুর রহমান রাফিন
- বলকান কসাই: বসনিয়া যুদ্ধে গণহত্যার নেতৃত্ব দেয়া তিন খলনায়ক; মোহাম্মদ ফাহিম খান
- The Bosnian War And The Dayton; Radio Free Europe
- Poetry and War; Angus Calder