পিক্সো: প্রতিবাদি দেয়ালের অন্য চিত্র | ইলিয়াস কমল

পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রথার মতো সমাজের বিভিন্ন শৃঙ্খল ভাঙার ইতিহাসও লেখা হয়ে আসছে। আদম-হাওয়ার গন্দম খাওয়া থেকে যদি সেই ইতিহাসের শুরু হয়ে থাকে, আধুনিক পৃথিবী নির্মাণে সমস্ত বিপ্লবীরাই তাদের মতোই প্রথা ভাঙার কারিগর। ক্ষেত্র বিশেষে তা ভিন্ন হয় বৈকি, কিন্তু চরিত্রের ধরন ও মানসিকতা মোটেও বদলায় না।

ফ্রয়েড যেমন সবকিছুর একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে ঘটনার প্রতি তার আদি ও অকৃত্রিম চিন্তার উৎস খুঁজে পায়, তেমনি সমস্ত নিয়ম বহির্ভুত কাজেও এমন একটা নিয়মিত ও রুটিন জীবনের ছাপ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে খুঁজে পাওয়া যায়।

পৃথিবীর ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও আধুনিক গ্রাফিতির জন্মটা ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে। আস্তে আস্তে ডালপালা ছড়িয়ে যে নানান আকার ধারণ করেছে, তার কতটাই-বা আমাদের জানা আছে? এইখানে জানার প্রশ্নটার সাথে কিছুটা মুক্ত বাণিজ্যের প্রশ্নও চলে আসে বলে আধুনিক গ্রাফিতির গল্প বলনেওয়ালার একটু বাজার চর্চা করা বাধ্যতামূলক। এইখান থেকে পৃথিবীর আরও এক অন্তরঙ্গ গল্প পৃথক হয়ে যায়। অন্তরঙ্গ বলছি এই কারণে, এই গল্প সত্যিই অনেকটা অন্তরের। কেবল বিবেক, ভাবনা, রাজনীতি-অর্থনীতির না। আরও বেশি দ্রোহ, ক্ষোভ ও বিদ্রুপেরও। সেই দেয়ালচিত্রের নাম ‘পিক্সো’।

এইবার একটু আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কথা বলা যাক। কিছুটা নিয়মতান্ত্রিক ধরনও বলা যায়। একবাক্যে বললে ‘পিক্সো’ হচ্ছে সমাজে প্রচলিত ধারার গ্রাফিতির বাইরে আরও বেশি প্রতিবাদি একটা ধরন। ‌‘গ্রাফিতি’র চেয়ে একটু রাগী, একটু কঠিন। বলা যায় সাধারণের চোখে যেইটা অনেকটা দুর্বোধ্য। যেইটাকে ‌‘পিক্সোনিয়ান’রা আবার নিজেদের সমাজের ভাষা বলে দাবিও করে। এ কারণে ‘পিক্সো’ একটা সমাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষাবিজ্ঞানের সূত্রমতে পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট দূরত্বের পরপরই মানুষের মুখের ভাষা পরিবর্তন হয়। কিন্তু পিক্সোনিয়ানদের এই ভাষা পরিবর্তনের কোনও যোগসূত্র পাওয়া যাবে না। তবে এই লিখিত ভাষাটা ভাঙা ভাঙা অবস্থায় তাকালে চোখে পড়বে এইটা পৃথিবীর আদি ভাষাগুলোর মতো। ভাবতেই অবাক লাগে না, একবিংশ শতকেও কেউ সেই পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর সময়কার ভাষাকে আগলে রেখেছে! কিন্তু এর পেছনেও অনেক গল্প রয়েছে। যার সবটা আমাদের জানাশোনার মধ্যেই নাই। এইটা এক অন্ধ গলির মতো, যারা ওই গলিতে বাস করে তারাই কেবল বলতে পারবে ওই গলির কোথায় কী! এসবের পরও যেটুকু ইতিহাস সম্পর্কে প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া যায় তা হলো ‘পিক্সো’ ব্রাজিলের এক ইউনিক দেয়ালচিত্র। হ্যাঁ, যেই দেশে গ্রাফিতি রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত সেই দেশে এর চেয়ে কঠিন কিছু থাকবে তা’ই স্বাভাবিক না? অনেকটা তাই।

ব্রাজিলের সাও পাওলোতে রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় দেয়ালচিত্র নয়, দেয়ালে স্লোগান লেখার প্রচলন হয় ১৯৩০ এর পর থেকে। ৪০ ও ৫০-এর দশকে সাও পাওলোর দেয়ালে দেয়ালে রাজনৈতিক স্লোগানগুলো রূপান্তরিত হয় ‘পিচকাও’ নামে। ৬০-এর দশকে যখন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের বিক্ষোভে উত্তাল সাও পাওলো, তখন এই ‌‘পিচকাও’ হয়ে ওঠে রাজনৈতিক হাতিয়ারের অন্য রূপ। দ্রুত সময়ে দেয়ালে স্বৈরাচার বিরোধী স্লোগান লেখার জন্যে তখনকার আন্দোলনকারী ছাত্ররা স্প্রে রং ব্যবহার করতে শুরু করে। যার মধ্যে সবচেয়ে ছড়িয়ে পড়া স্লোগান ছিলো  “abaixo a ditatura” বা ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’। ত্রিস্তান মানচো নামের এক ব্রাজিলিয়ান ডিজাইনার ও লেখকের লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘গ্রাফিতি ব্রাজিল’ বইয়ে ওই সময়ের ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে চমৎকার একটা বর্ণনা আছে। যা মোটামোটি অনেকটা এই রকম- “নগরে তরুণ-যুবাদের নিজেদের অস্তিত্ব ও সক্ষমতা বোঝানোর জন্য এইটা একটা চমৎকার মাধ্যম, যা কিনা কাজ করছে রীতিমত আওয়াজ করেই। সামাজিক প্রতিবাদ হিসেবে পিচকাও অনেক নিষ্ঠুর, শক্তিশালী এবং এর কোনও পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াও নেই। সম্পদের সুষম বণ্টনের এত জঘন্য ব্যবস্থা ব্রাজিল ছাড়া আর কোথাও নেই। বড়লোকদের জন্য এখানে দারুণ সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং আছে। কিন্তু দরিদ্রদের জন্য ঝুপড়ি ছাড়া কিছুই না! পিচকাও সেইসব সম্পদের ওপর নিজেকে এত গভীরে প্রবেশ করে বসে আছে যে প্রতি মুহূর্তে তাদের মগজে ঢুকিয়ে দিচ্ছে, এই জগৎ তোমার একার জন্য নয়।”

অথচ এই প্রতিবাদী ভাষাটা ৭০-এর দশকে এসে হারিয়ে গিয়েছিলো। আবারো রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেই দারুণভাবে ফিরে আসে পিচকাও। ১৯৮০-এর দশকে ব্রাজিল যখন গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের দিকে আগাচ্ছে, ব্রাজিলের বা সাও পাওলোর তরুণদের কাছে রাজনৈতিক চিন্তাই যখন একমাত্র ভাবনার বিষয় ছিলো না, তখন আবারো দেয়ালে দেয়ালে ফিরে আসে পিচকাও। বিশ্বব্যাপী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যখন হেভি মেটালের আবির্ভাব, তখন ব্রাজিলিয়ান তরুণরা স্ক্যান্ডেনেভিয়ান শিল্প দর্শন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আবারো এই ‌‘গ্রাফিতি’র শুরু করে।

১৯৯১ সালে সাও পাওলো থেকে দুই যুবক রিও ডি জেনিরোতে গিয়েছিলো কেবল কোভাডো পিকে গিয়ে পিচকাও এর মার্ক করতে। ২০১০ সালে স্ট্যাচু অব ক্রাইস্ট রিডিমারের গায়েও পিচকাও লিখে দুই যুবক। জানা যায় তারাও সাও পাওলো থেকেই ওইখানে গেছিলো। ক্রাইস্ট রিডিমার তখন রেস্টোরেকশন চলতেছিলো। এই সুযোগে তারা ওই কাজ করছে গিয়া। তাদের চিন্তা ছিলো তাদের বার্তাটা ব্রাজিলময় ছড়িয়ে দেওয়া। ওই সময় তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। তখনকার রিও’র মেয়র এদোয়ার্দো পেস বলেছিলেন, এই অপরাধীদের এর মূল্য দিতে হবে। তাদেরকে জেলখানায় যেতে হবে। রিও ডি জেনিরো এই অপরাধ প্রত্যাশা করে না। ঘটনার পর গ্রেফতারকৃত দুই পিক্সোনিয়ানকে কারাদণ্ড দেয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ব্রাজিল সরকার পিচকাওকে পরে নিষিদ্ধ করে। এর জন্য আইনও করে দেশটি।

সাও পাওলোকে বলা হয় সিটি অব ওয়ালস। গত কয়েক দশকে সাও পাওলোতে প্রচুর পরিমাণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ঠিক উল্টোদিকে বেড়েছে দারিদ্রের পরিমাণ ও দরিদ্র মানুষের সংখ্যাও। পিক্সোর সাথে এইখানেই সাও পাওলোর সম্পর্ক। মূলতঃ ক্ষুধা ও দারিদ্রের বৃদ্ধির ফলে তারুণ্যের মাঝে যে হতাশার তৈরি হয় তার একটা বড় অংশই ক্ষোভ প্রকাশ করার সুযোগ পায় না। এই পরিস্থিতিতে কেউ কেউ দ্রোহ প্রকাশের জন্য বেছে নেয় এই মাধ্যম। ২০১০ সালে আরেকটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ব্রাজিলে। তা হলো সাও পাওলো বিয়েন্নাল। ওই সময় বিয়েন্নালের সময় পিচকাও-এর মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিবাদের স্লোগান উঠে আসে জনসম্মুখে। পিক্সোনিয়ান ভাষায় লিখা হয়, স্বৈরাচার নিপাত যাক। একই বছর সেই সাও পাওলোতে একটা হাইরাইজ বিল্ডিং এ পিক্সো (পিচকাও) করার সময় পুলিশের গুলিতে মারা যায় দুই জন। ঘটনার জন্য পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তাকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতারও করা হইছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে তারা ছাড়া পেয়ে যায়।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সমাজের ভেতরে মানুষের যে ক্ষোভ তাকে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই পিক্সো ব্যবহার হচ্ছে বলা যায়। সাও পাওলো বিয়েন্নালের পর তুলনামূলক পিক্সোনিয়ান বেড়েছে বলে দাবি করেছে একাধিক গবেষক। সমাজতাত্ত্বিক গবেষক পলা লারুসকাহিম এবং পল সিউজগার বলছেন, সাও পাওলোর পিচকাও (পিক্সো) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এটা যতটা না সৌন্দর্য্যের জায়গা থেকে তারচেয়ে বেশি সমাজের নীপিড়িত মানুষের ভাষা প্রকাশের একটা মাধ্যম হিসেবে। ফলে সমসাময়িক শিল্প বোদ্ধারা পিচকাওকে বিকল্প শিল্প মাধ্যম হিসেবেও ভাবতেছে। উল্লেখ্য, ব্রাজিল জুড়েই দেয়াল শিল্প বলতেই গ্রাফিতিকে চিহ্নিত করা হয়।

পিক্সো শব্দটা মূলতঃ মডার্ন রূপ, যার মূল শব্দ পিচার (pichar)। পর্তুগিজ শব্দ পিচার একটা ক্রিয়াপদ। যার একাধিক অর্থ হয়, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দূষিত করা। যেহেতু এইটা স্বচ্ছ বা সৌন্দর্য্য বর্ধনের কাজে ব্যবহার হয় না সেই দিক থেকে এইটা এক প্রকার দূষণের মতোই দেখা যেতে পারে। পিক্সো নিয়ে ডকুমেন্টারিটা দেখলাম, তাতে একজনের একটা বাসার দেয়ালে অনেক আঁকিবুকি করার পর বাড়ির মালিক এসে রীতিমত পিক্সাডোরদের চৌদ্দগোষ্ঠী তুলে গালাগালি পারতে শুরু করলো। যেন ২৮টা খুন করে ফেলছে তারা। বিষয়টা কোনভাবেই মানতে পারতেছিলো না পিক্সো আঁকা বাড়ির মালিক। বলতেছে আমার বাড়িটার দেয়ালটারে নষ্ট করে দিলো! কিন্তু এই যে নষ্ট করে দেয়ার মাঝ দিয়েও তার সম্পদ বা বিত্তের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করা এইটাই পিক্সোর মূল স্পিরিট আসলে। যেই গ্রাফিতিরে ল্যাটিন ইতিহাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মার্কিন গবেষক মারসিও সিওয়ি বলেছেন ‘অ্যাংরি গ্রাফিতি’ । গ্রাফিতি বলতেই আসলে যে দুর্নিবার চিন্তাটার কথা মনে আসে। তা তো আসলেই কিছুটা অ্যাংরিই। আর এইটার এতই বেশি এইখানে যে অনেকটাই দুর্বোধ্য। তবে একান্তই স্বকীয়।

x

x

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading