কিম কি দুককে যখন আমি ২০১৩ সালে আবিষ্কার করলাম, আমার মধ্যে আগুন আবিষ্কারের অনুভূতি হইলো। একটা নতুন দুনিয়া, কবিতা, গল্প, চিন্তা। আমি আর নিজের হয়ে ভাবতে পারছিলাম না। আমার চিন্তার সিংহভাগ নিয়ে বসেছিলো এই মুভি ডিরেক্টর। সাউথ কোরিয়ান এই ডিরেক্টর হচ্ছেন সিনেমার একজন মডার্ন মায়েস্ত্রো। তার সিনেমার মধ্যে কেমন জানি অস্থিরতা বিরাজ করে। যেমনটা সব আর্টেই করা উচিত বলে মনে হয়। কিম কি দুক মারা গেলেন এ বছর ১১ ডিসেম্বর, লাটভিয়ার শান্ত, নির্জন একটা শহরে। মানুষের প্রবণতা আছে যে কেবল মারা গেলেই একটা শিল্পীকে সম্মান দেখায়। কিমকে আমি আগেই ভালোবাসতাম, এটা আমার নিজের প্রতি কনফেশন। ২০ তারিখ পর্যন্ত বাঁচলে তার বয়স হতো ৬০। জন্মদিনের শুভেচ্ছায় ‘ডিভিডি টক’ এর রিপোর্টার ইয়ান জেনকে দেয়া কিমের ইন্টারভিউটা অনুবাদের চেষ্টা করা হলো। ২০০৪ সালে পুরো ইন্টারভিউটিই হয়েছিলো ইমেইলে। —তন্ময় হাসান
প্রকৃতি সবচেয়ে গভীর আর জাঁকজমকপূর্ণ ম্যাথ, সায়েন্স, ফিলোসফি
ইয়ান : আপনার সিনেমায় ইমোশনের উপস্থিতি প্রচণ্ড, কখনো প্রেম, কখনো ঘৃণা আবার দুইটা মিশাইয়া নতুন কিছু। এইসব অনুভূতি নিয়া সিনেমা বানানোর প্রেরণা পান কই থেকে? ফিল্মমেকার হিসেবে কোন জিনিসটা আপনাকে বাধ্য করে এইটা করতে?
কিম: আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে বহু রকমের অনুভূতি থাকে। একটা মানুষের বর্তমান প্রেম, ভালোবাসা, ঘৃণা, রাগ কিংবা হত্যাপ্রবণতার মত অনুভূতি তার মধ্যে বেড়ে ওঠে যেমন শিক্ষা, পরিবেশ, পরিবার এবং জেনেটিক উপাদান সাথে নিয়ে সে বেড়ে ওঠে। সিনেমার ক্ষেত্রে আমি একটা থিওরি মেনে চলি, “সাদা আর কালো একি রকম।” আমি কোনো জিনিসকে একটা অর্থে প্রকাশ করার চেষ্টা করি না। বরং তার উল্টাটা চেষ্টা করি বলতে পারেন। যেমন একটা লোক যে খুব ভালো মারামারি করতে পারে আর মাঝেমাঝেই সে এটা করে, তার কারণ এই না যে সে এটা খুব ভালো পারে, এর কারণ এমন হইতে পারে যে সে ভয় পায়।
ইয়ান : আপনার সিনেমায় ডায়লগ খুব কম, এটা আপনার সিনেমার বৈশিষ্ট্য হিসেবেও মানে অনেকে। ডায়লগ কম থাকা সত্ত্বেও আপনার সিনেমা একটা শক্তিশালী চিত্র তুলে ধরতে পারে। কেনো আপনার সিনেমার চরিত্ররা এতো চুপচাপ?
কিম : আমার মনে হয় না মুখ দিয়া বলা কথাই সব সমাধান করতে পারে। মাঝে মাঝে নীরবতা সবচে সত্য অনুভূতি প্রকাশ করে, যেখানে মুখের কথা অনুভূতির প্রকাশে ব্যর্থ হয়।
ইয়ান : অনেক সময়, সিনেমার শেষে, ব্যাখ্যাটা দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করে দেন—আপনার নতুন সিনেমা (দি বো- The Bow) এর আর্দশ উদাহরণ। আপনি একটা অনিশ্চিত শেষের দিকে কেন ঝুঁকেন, নির্দিষ্টতা ছেড়ে?
কিম : ডিরেক্টরের সব বলা উচিত না। আমার জন্য, সিনেমা একটা প্রশ্ন যেটা আমি অন্যদের / দর্শকদের মুখোমুখি হইতে বাধ্য করি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করতে চাই যে আমার এই চিন্তা নিয়া তাদের কী মত? তাদের সাথে আলোচনা করতে চাই। এইজন্য সিনেমা এতো মজার একটা মাধ্যম। আবার এইজন্যই আমার সিনেমার কোন নির্দিষ্ট, নিশ্চিত উত্তর নাই। কিন্তু উত্তর দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সবসময় পাল্টাইতেছে।
ইয়ান : আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড যতটা না ফিল্মমেকিং-এ, তারচেয়ে অনেক বেশি পেইন্টিং-এ। এইটা একটা কারণ যার ফলে আপনার অনেক কম্পোজিশন স্থিরচিত্রের মতন লাগে। আপনার কি মনে হয়, আর্টের এই ব্যাকগ্রাউন্ড আপনার কাজটাকে সহজ করে তুলছে?
আমি চাই আমেরিকার উঠতি বয়সের ছেলেরা জানুক তৃতীয় বিশ্বের একটা তরুণ কিভাবে বেঁচে থাকে
কিম : হ্যাঁ, করছে তো। আমি ছবি আঁকি, ছবিও তুলি অনেক আগে থেকেই। একটা ফ্যাক্টরির প্রায় সব সেক্টরেই কাজ করছি আমি, তাই আমি জানি কিভাবে মেশিনটা চলে। অবশ্যই, ব্যাকগ্রাউন্ড অনেক সাহায্য করছে। সিনেমাকে একই তাত্ত্বিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে দেখা উচিত। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা আমি মনে করি, সেটা হলো বিভিন্ন ধারার জীবনের সাথে মেশা এবং এতে অভিজ্ঞ হওয়া।
ইয়ান : একইভাবে, কোরিয়ান মিলিটারির যে ব্যাকগ্রাউন্ড আপনার আছে, তার কোন প্রভাব আছে আপনার সিনেমায়?
কিম : নৌ-বাহিনীতে ছিলাম ৫ বছর। অনেক অভিজ্ঞতা হইছে, অনেক রকম মানুষ দেখছি। অর্ডার, হিংস্রতা, আর্দশ নিয়ে শিখতে গিয়ে আমি অনেক কনফিউজড ছিলাম। বিশেষত, আমি নর্থ কোরিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নিচ্ছিলাম। যখন রিটায়ার করলাম, তখন ধীরে ধীরে সত্যটা বোঝা শুরু করলাম। আর একই সাথে এগুলোকে সিনেমায় ব্যবহার শুরু করলাম। একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হইলো, দুর্ঘটনা তখনই ঘটে যখন মানুষ পরস্পরকে সম্মান করে না, আর আমরা এর মধ্যে কষ্ট পাইতে থাকি কারণ আমরাও একটা ঘোরে বসবাস করি।
ইয়ান : আপনার সিনেমা প্রায়শই বহিরাগতদের দেখায়, যারা সমাজের নিয়মের মধ্যে খুব একটা মানায় নিতে পারে না। যেমন ধরেন “থ্রি আয়রন” এর মেইন চরিত্র কিংবা “ব্যাড গাই” এর প্রস্টিটিউট এর চরিত্রটা। এমন দুর্ভাগা চরিত্রগুলার উপর এতো মনোযোগ কেনো?
কিম : সমসাময়িক হিসেবে তাদেরও সম্মান করা উচিত। যদিও তারা অসুখী, তাতে তাদের অসুখী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করার আমাদের কোনো অধিকার আসে না। আমি তাদের অবাধ জীবন-যাপন দেখাইতে চাই আমার সিনেমার সাহায্যে।
ইয়ান : কোন সিনেমাটা নিয়ে আপনার সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ হয়? আর কেনো?
কিম: কোনোটা নিয়াই গর্ববোধ কাজ করে না। ভবিষ্যৎ-এ যেগুলো বানাবো তা নিয়ে অবশ্য থাকবে কারণ তাতে এমন কিছু জীবনবোধ থাকবে যা সম্পর্কে আমি এখনো জানি না। কি ধরনের দর্শন আর চিন্তা নিয়ে আমি বেড়ে উঠবো, এ নিয়ে আমি বেশ কৌতুহলী। তুমি যদি তাও বলো একটা বেছে নিতে, তাইলে আমি “এড্রেস আননোন (Adress Unknown) টা বেছে নিবো আমেরিকান দর্শকদের জন্য। আমি চাই আমেরিকার উঠতি বয়সের ছেলেরা জানুক তৃতীয় বিশ্বের একটা তরুণ কিভাবে বেঁচে থাকে।
ইয়ান : “ব্যাড গাই” সিনেমাটা কোরিয়াতে আপনার বাকিসব সিনেমার চেয়ে ভালো করছে। অন্যগুলার চেয়ে এইটা এমন ভালো করার কারণ কি বলে মনে করেন? এটা কি গল্প নাকি চো-জি-হায়েন (সাউথ কোরিয়ান সুপারস্টার) এর উপস্থিতি?
কিম: সিনেমায় একজন সুপারস্টারকে দেখার আশায় এখনো অনেক কোরিয়ান সিনেমা হলে যায়। চো-জি-হায়েন না থাকলে সিনেমাটা দশ ভাগের এক ভাগ লোক দেখতো। কিন্তু আমার মনে হয়, বেশি মানুষ আমার সিনেমা না দেখাই ভালো। কোরিয়ানরা আমার নাম জানে, আমি কি করি জানে, কিন্তু আমার সিনেমা দেখে না। সবাই ভালোবাসে এমন সিনেমা বানাইতে আমার ভালো লাগে না। আমি অল্প দর্শক চাই, যারা জীবনে দুঃখ পাইছে, জীবন নিয়ে চিন্তিত, যন্ত্রণা, বিষাদ নিয়ে সিনেমাগুলা দেখবে।
ইয়ান : ফিল্ম ক্রিটিক, যারা আপনার সিনেমাগুলারে হিংস্র কিংবা শোষণমূলক বলে আ্যাখ্যা দেয়, তাদের সম্পর্কে আপনার কি মতামত? অথবা ওইসব মানুষের প্রতি যারা বলে আপনার সিনেমা সেক্সিষ্ট বা নারী-বিদ্বেষী?
কিম : আমার মনে হয় এটা সম্ভব। তাদের শিক্ষা এবং ব্যাকগ্রাউন্ড আমার থেকে আলাদা, যার কারণে তারা একরকমের বাধ্য হয় আমার সিনেমাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু ক্রিটিকেরা বেশ সচেতন আচরণ করছে যেহেতু আমি এখন ফেমাস আর কয়েটা অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি। আমার মনে হয় তারা নিজেদের চিন্তা আরেকবার ভাবছে। আমি আশা করি তাদের এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাবে, তবে তার জন্য সময় লাগবে।
ইয়ান : একবার পড়েছিলাম যে, আপনি মিনিস্টার (ধর্মীয় পদে) হতে চান, ধর্ম আপনার কাজকে কিভাবে প্রভাবিত করে? ধর্ম কিভাবে আপনার সিনেমায় বিদ্যমান?
কিম : খোদা আমার কাছে প্রকৃতি, যে প্রকৃতি আমরা চোখ দিয়ে দেখি আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করি। প্রকৃতি সবচেয়ে গভীর আর জাঁকজমকপূর্ণ ম্যাথ, সায়েন্স, ফিলোসফি।
ইয়ান : হলিউডে বা নর্থ আমেরিকায় কাজ করার আগ্রহ আছে আপনার? হলিউডের যে প্রতিষ্ঠিত স্টাইল তার সাথে আপনার কাজের সংযুক্তি কেমন হবে?
কিম : এখনো না, যে সিনেমা আমি কোরিয়াতে বানাই তা যদি আমেরিকান বক্স অফিসের জন্য উপযুক্ত হয়, তবে তা আমেরিকায় রিলিজ দেয়া যায়। আমি যদি পারি, তাইলে বড় বাজেটে সব সুপারস্টার নিয়ে একটা সিনেমা করবো পরে। যে গল্পটাকে আমি সিনেমা করতে চাই তা হলো বুদ্ধ ধর্মের মধ্যে এশিয়ায় চলমান যুদ্ধ।
ইয়ান : কোন কোরিয়ান বা হলিউড অভিনেতা আপনার মনে ধরেছে যার সাথে আপনি কাজ করতে চান? আর কেনো?
কিম : কেউ নাই এখনো। আমেরিকান অভিনেতা নিয়ে সিনেমা বানানোর কথা আমি ভাবিনি কখনো। আর কে আমার সাথে কাজ করতে চায়? যদি এমন কেউ জানা থাকে, তবে আমাকে জানিয়ো।
ইয়ান : “দি বো(The Bow) এর কাজ তো শেষ। বর্তমানে কি কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন?
কিম : আমি একটা সিনেমা নিয়ে ভাবছি যার প্রধান চরিত্র একটা হ্যান্ড গান। পুশান আর্ন্তজাতিক ফেস্টিভালের জন্যও একটা কাজ করতে চাই যেখানে একজন নারী তার সুন্দর চেহারা বর্জন করার চেষ্টা করে।
টীকা: একজন নারী তার সুন্দর চেহারা বর্জন করে, এমন গল্পের ছবিটার নাম বিউটিফুল।