এন্নিও মোরিকোনের সাক্ষাৎকার | ভাষান্তর : উপল বড়ুয়া

ইতালিয়ান কম্পোজার এন্নিও মোরিকোনকে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছুই নেই। যারা সার্জিও লিয়নের স্পেগেত্তি সিরিজের ভক্ত, তারা জানেন ছুটন্ত ঘোড়া কিংবা বন্দুকবাজির রোমাঞ্চকর মুহূর্তটাকে কিভাবে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে ভাসিয়ে দিতেন মোরিকোন। ২০২০ সালের ৬ জুলাই, ৯১ বছর বয়সে মারা যান তিনি। হলিউডের অনেক আইকনিক স্কোর করে কিংবদন্তিতুল্য হয়ে আছেন মোরিকোন। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী মিউজিশিয়ান হিসেবে গণ্য করা হয় ওনাকে।

 

ফিল্মের জন্য পাঁচশ’র বেশি স্কোর করেছেন তিনি। জীবিত সময়ে ছিলেন অতিপ্রজ মিউজিশিয়ানদের মধ্যে সবার উপরে। মোরিকোনের জন্ম ১৯২৮ সালে, রোমে। ১৯৬২ সালে সাউন্ডট্র্যাক শুরুর আগে শহরের সবচেয়ে প্রেস্টিজিয়াস সঙ্গীতাঙ্গন আকাদেমিয়া ন্যাশিওনাল দি সান্তা সিসিলিয়া’তে শিখেছেন ট্রাম্পেট বাজানো ও সঙ্গীত নির্দেশনা। দুই বছর পরে, ডিরেক্টর সার্জিও লিয়নের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর, প্রস্তাব পান আ ফিস্টফুল অব ডলার্স’র স্কোর লেখার। এখান থেকেই শুরু দু’জনার সম্পর্ক। এরপর মোরিকোন স্কোর করেন লিওনের ওয়েস্টার্ন জনরার ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা ও দ্য গুড, দ্য ব্যাড অ্যান্ড দ্য আগলি’তে। এছাড়াও তিনি ব্রায়ান ডি পালমার গ্যাংস্টার ব্লকবাস্টার মুভ্যি দ্য আনটাচেবল এবং গুইসেপ্পে তোর্নাতোরের আর্টহাউজ ক্ল্যাসিক ‘সিনেমা প্যারাডিসো’তে স্কোর করেছেন।

 

মোরিকোনের এই সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালের জুলাইয়ে। ফ্যাশন, আর্ট, মিউজিক, ফিল্ম ইস্যুভিত্তিক পোর্টাল ডেইজড-এ। লন্ডনে হ্যামারস্মিথ অ্যাপোলো’তে এক কনসার্টের আগে মোরিকোনের সাক্ষাৎকারটি নেন লেখক দিনো গোলিনিক। পরে ওনার মৃত্যুর পর তা আবারও প্রকাশ করা হয় গত বছর। মিউজিক কম্পোজের পাশাপাশি মোরিকোনের জীবন হোটেল থেকে সাবান সংগ্রহ, স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্ন এবং বিষণ্ণতায় ভরা ছিল।

 

কেনো মৃত্যুর পর মোরিকোনের সাক্ষাৎকার অনুবাদ; এমন প্রশ্ন ওঠার আগে বলতে চাই, আমিও ওনার মিউজিকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি বেশিদিন হয়নি। তবে আকৃষ্ট হওয়ার চেয়ে বলা উচিৎ, উনার মিউজিক শোনা শুরু করে একটা ঘোরে পড়ে গিয়েছিলাম। সাক্ষাৎকার অনুবাদের ভেতর দিয়ে তাঁর প্রতি কিছুটা শ্রদ্ধা জানানোর চেষ্টা এটা।


 

মেটালিকা এবং দ্য র‌্যামোনেসের মতো ব্যান্ড আপনার মিউজিক ব্যবহার করায় কি আপনি গর্বিত?

 

এন্নিও মোরিকোন

সত্যি, আমি এটা নিয়ে খুবই আনন্দিত। এর অর্থ হলো আমার মিউজিক একই সময় সাধারণ এবং মূল্যবান। আদর্শে, তুলনায়, ভিন্ন বিষয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা ভাল। অন্য সময় আমি এই নিয়ে তৃপ্ত নই।

 

কখন আপনি প্রথমবার গান কম্পোজ করেন?

 

এন্নিও

বাচ্চাকালে শুরু করেছিলাম, যখন আসলেই আমি খুব ছোট ছিলাম। খুব ছোট্ট, সম্ভবত। যখন আমার বছর ১০, আমার সব কম্পোজিসন ফেলে দিয়েছিলাম, তাই শুরুর কাজগুলোর কোনো চিহ্ন নেই, দুঃখজনক হলো আমি এসবের কোনোটির রেকর্ড রাখি নাই। তখন জানতামও না যে টেপ-রেকর্ডার নামে কিছু আছে।

 

১৯৪০ সালে আপনি সঙ্গীত স্কুলে যাওয়া শুরু করেন। তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আপনাকে কিভাবে প্রভাবিত করেছিল?

 

এন্নিও

সত্যি বলতে ওসব আমি খেয়াল করি নাই। এমন না যে আমি যুদ্ধ দেখি নাই। তবে তা আমার কাজে প্রভাবিত করেনি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেও আমাকে কখনও কাজ খোঁজার জন্য সংগ্রাম করতে হয়নি। যেকোনোভাবে হোক, জীবনে আমি ভাগ্যবান ছিলাম। লোকজন আমাকে চিনতো কারণ আমি ভাল ছাত্র ছিলাম। রেডিও, থিয়েটার ও টেলিভিশনের জন্য আমি সঙ্গীত আয়োজক হিসেবে কাজ শুরু করি এবং ছয় কি সাত বছর কম্পোজিংয়ে লেগে ছিলাম।  

 

কী কারণে মিউজিকে কয়োটের (এক ধরনের বুনো কুকুর) চিৎকার, ঘণ্টা এবং হুইসেলের মতো অস্বাভাবিক বিষয়গুলো মেশাতে আপনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন?

 

এন্নিও

আমি ফিল্মের মেজাজটা ধরার চেষ্টা করতাম। আ ফিস্টফুল অব ডলার্সে, এক চাষীর কথা ভাবছিলাম যে গ্রামাঞ্চলে বাস করে এবং দূরের শব্দ শুনতে পায়, এক নস্টালজিক শব্দ।  

 

যখন লোকজন আপনাকে কেবল স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্নের লোক মনে করে তখন কি বিরক্ত লাগে না?

 

এন্নিও

যদি তারা ‘ইতালিয়ান ওয়েস্টার্ন’ অভিহিত করে তখন হই না। স্পেগেত্তি ওয়েস্টার্ন মনে করলে সত্যি আমি ক্রুদ্ধ হই। আমি কখনও আমেরিকান ওয়েস্টার্ন ফিল্মকে ‘ইয়াঙ্কি ওয়েস্টার্ন’ বলব তা চিন্তা করি নাই।

 

কিভাবে আপনি একজন ডিরেক্টরের সঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন?

 

এন্নিও

আমার ওপর তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস থাকতে হবে, এবং আমারও তার ফিল্ম সম্পর্কে জানাশোনা ও শ্রদ্ধা থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে, আমি ফিল্মে স্কোর করলেও তা অনেক সময় তেমন পছন্দ হয় না। স্কোরের জন্য যখন আমি প্রথমে একটা ফিল্ম দেখি, যা সাধারণত অসম্পূর্ণ থাকে, তখন মাঝেমধ্যে সত্যি ভাল হবে কি খারাপ হবে তার মানদণ্ড অনুমান করা কঠিন হয়।

 

সঙ্গীত দর্শন নিয়ে পরিচালকের সঙ্গে আপনার কতটুকু আপস করতে হয়?

 

এন্নিও

আমার কাজের একটা মজার বিষয় হচ্ছে, পরিচালকের সঙ্গে সহযোগিতা করলে অপ্রত্যাশিত ফলাফল পাওয়া যায়। এমনকি তারা যদি একই মন্তব্য শেয়ার না-ও করে। মাঝেমধ্যে পরিচালকরা এমন সব আইডিয়া তুলে ধরেন যা আপনি ভাবেনও-নি এবং এটা মিউজিককে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে পারে।

 

কখনও কি পুরোপুরি কোনো একটা সাউন্ডট্র্যাক ভুল পেয়েছেন?

 

এন্নিও

অনেক দিন আগে, আমি সত্যি একটা ফিল্ম পছন্দ করে কাজ শুরু করেছিলাম এবং তাতে খুব ভালোভাবে জড়িয়েও গেলাম। এটা ছিল একরকম ভারসাম্যহীন। এতে আমার উপলব্ধি হয়, যদি আপনি বিষয়গুলো নিয়ে কাজই করতে চান তাহলে কাজকে খুব বেশি ভালোবাসতে পারবেন না। 

 

আপনি কি ধার্মিক?

 

এন্নিও

হ্যাঁ। চার্চে গেলে আমি কখনও হাঁটু গেড়ে বসি না তবে নিজেকে ধার্মিক মনে করি। আমি রোমান ক্যাথলিক। তবে আমার মিউজিকে এসবের খুব একটা ভূমিকা নেই। প্রকৃতপক্ষে, লোকজন বলে আমি রহস্যময় কম্পোজার। সম্ভবত ‘দ্য মিশন’র যে কম্পোজ করেছিলাম তার জন্য এমন ধারণা।

 

মিউজিক কম্পোজিংয়ের বাইরে আর কী কী করেন?

 

এন্নিও

যখন কম্পোজ করি না, পরে কী কম্পোজ করবো তা নিয়ে চিন্তা করি। মাঝেমধ্যে দাবা খেলা নিয়ে ভাবি। আসলে, যদি আমি কম্পোজার না হইতাম তবে আমি একজন চ্যাম্পিয়ন দাবাড়ু হইতাম। আমি আসলে দাবায় খুব দক্ষ। একবার সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বরিস স্পাসকির সঙ্গে খেলেছিলাম এবং ম্যাচটা শেষ হয় ড্রয়ে।

 

দারুণ তো!

 

এন্নিও

হ্যাঁ। আসলেই দারুণ (হাসি)।

 

এটা কি সত্য যে আপনি হোটেলের সাবান সংগ্রহ করেন?

 

এন্নিও

আপনি কিভাবে জানেন? এটা সত্য! দশ বছর ধরে আমি এটা করছি এবং এখন আমার সব ড্রয়ার সাবানে ভরে গেছে। এসব রাখার জন্য আমার আর অধিক কোনো রুম নাই। তাই বলতে পারছি না, এই সংগ্রহ চালিয়ে যাওয়া যাবে কিনা। 

 

সাবান বিনিময় করতে কি আপনি অন্যান্য সংগ্রাহকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন?

 

এন্নিও

কখনও না, তবে আমি একবার এক ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলাম যিনি হোটেলের দরজায় থাকা ‘ডু নট ডিস্টার্ব’ চিহ্ন সংগ্রহ করতেন। এমন শত চিহ্ন দিয়ে তিনি দেয়াল ঢেকে ফেলেছিলেন।  

 

আপনার জীবনের সাধারণ একটা দিন কিভাবে শুরু হয়?

 

এন্নিও

ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠি। ঘর পরিস্কার করি, বাইরে বেরিয়ে চার বা পাঁচ কিলোমিটার হাঁটি। ফিরে আসি খবরের কাগজ নিয়ে। সাড়ে আটটা বা নয়টা পর্যন্ত পত্রিকা পড়ি। তারপর কম্পোজিং শুরু করি। যদি দরকার পড়ে, সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করি, অন্যথা লাঞ্চটাইমে আমি কম্পোজিং শেষ করি।

 

বয়স আপনার কাজে কেমন প্রভাব রাখে?

 

এন্নিও

যুবক বয়সের চেয়ে এখন আমি আর ভালো বোধ করি। দুর্বল লাগে না। হয়তো আমি কঠোর পরিশ্রম করি এবং হাঁটি, তার জন্য এমনটা লাগে। আমি লাইফস্টাইলে ভারসাম্য রক্ষা করে চলি। স্বাস্থ্যকর খাবার খাই। সাধারণ জিনিসপত্র পছন্দ করি, অতিরিক্ত কোনোকিছু ভাল লাগে না।

 

আপনার সবচেয়ে অস্বাভাবিক বিষয় কি?

 

এন্নিও

আমি খুবই বিষণ্ণ প্রকৃতির। নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি। ভিটামিন ও মিনারেল সল্ট খাই। প্রতিদিন ব্লাড প্রেশারও মাপি, এটার জন্য পেশাদারি মেশিনও রয়েছে আমার। এবং আপনি শুনে আনন্দিত হবেন, আমার ব্লাড প্রেশার একেবারে যথাযথ।


উপল ‍বড়ুয়া

কবি, গদ্যকার, সাংবাদিক

 

 

 

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading