আরাফাত করিমের গ্রাফিতি প্রথম দেখি ফেসবুক মারফত। ভাষা আন্দোলনের শহীদ বরকত নিয়ে ছিল গ্রাফিতিটা। এরপর দেখি চারুকলায় ব্যাঙ্কসিকে নিয়ে লিফলেটটা। বরকতেরটা আরাফাত নিজে ফেসবুকে পোস্ট করাতে বুঝতে সমস্যা হয় নাই। কিন্তু লিফলেটটা পুরাই আননৌন ছিল।মানে আমার কাছে। দেখেই ইন্টারেস্টিং লাগে। তো, বরকতের সেই গ্রাফিতিটার সুবাদে আরাফাতের ইন্টারভিউ নেয়ার প্ল্যান করি। একদিন বারডেমে এক রোগী দেখতে গিয়েছিলাম। এরপরে আরেকটা কাজ ছিল। অইদিকেই। অইটা আরো দেরিতে। মাঝখানে ঘন্টাখানেক সময়। অই সময়টা কীভাবে কাজে লাগাই ভাবতে ভাবতে আরাফাতকে ফোন দিই। আরাফাতের তখন কাজের ব্যস্ততা। তারপরও রাজি হন। ছিলেনও কাছে। প্রথম আলো অফিসে, কারওয়ান বাজারে। তাই দেরি না করে, প্রথমার দোকানের পাশে ইন্টারভিউ নিয়ে ফেলি। ফোন রের্কডিংয়ে। বেশ কয়েক বছর আগে।। আশা ছিল, সত্বর আমরা গ্রাফিতি সংখ্যাটা করে ফেলতে পারবো। পারি নাই। নানান কারণেই হয় নাই। মাঝখানে ফোন নষ্ট হয়। ভাবছিলাম, ইন্টারভিউটাও গেল বুঝি। কিন্তু ফোন হারাইলেও ইন্টারভিউটা হারায় নাই। এরপর ইন্টারভিউটা একটু একটু করে ট্রান্সক্রিপ্ট হইতে হইতে, ঘষামাজা করে রেডি করতে করতে মেলা সময় কেটে যায়। ট্রান্সক্রিপ্ট করতে আমারে সহযোগিতা করে সুবর্না । তাকে ধন্যবাদ দেয়ার কিছু নাই। তবে সব ক্রেডিট আরাফাতের। উনি আরো চমৎকার চমৎকার সব গ্রাফিতি করুক। উনার জন্য শুভ কামনা।
আসুন আরাফাতের কথা শুনি।
— রাজীব দত্ত
গ্রাফিতি নিয়ে আপনার আগ্রহ কবে থেকে?
– গ্রাফিতি নিয়ে আমার আগ্রহ অনেক আগে থেকে তা বলব না, আমি তখন অনার্সে। ফোর্থ ইয়ার শেষ, মাস্টার্স শুরু হবে। তখন ভাবতেছিলাম, আমরা যে কাজগুলা করি, কনসেপচুয়াল বা এক্সপেরিমেন্টাল, এ কাজগুলা কতটা বুঝে করতেছি বা এ কাজগুলা দিয়ে কতটা পৌঁছাইতে পারতেছি। এ নিয়ে একটা দ্বন্দ্ব ভিতরে ছিল। তখন সার্চ করে বুঝলাম যে গ্রাফিতির ভিতর রিয়েল একটা ব্যাপার আছে।
মানে কমুনিকেটিভ?
– হ্যাঁ, কমিউনিকেটিভ। এটার ভিতর সাহসিকতার একটা ব্যাপার আছে। রিয়েল। মানে ফেক মনে হয় না। ব্যাঙ্কসির কাজ আমার তখন থেকেই ভালো লাগতো। দেখতাম। তখন হঠাৎ আমার মনে হলো যে, আমি যেটা ভাবতেছি, ঐটা সহজে এক্সপ্রেস করার জন্য গ্রাফিতি বেটার। তখন আমার গ্রাফিতির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। ঐটা ভেবে আমি ফার্স্ট একটা গ্রাফিতি করি। অইটার রিয়েকশন বলেন বা সবার সাথে যে ধরনের ইন্টারেকশন, আমার আরো আগ্রহ তৈরি হইছে। হয়তো অতোটা হতো না, রেগুলার এইটার ভিতর থাকবো, এমনটা হতো না। বাট আমার ফার্স্ট কাজটাই ক্লিক করেছে আমাকে বা আমার অন্য কাজগুলার চিন্তার ভিতরে।
ফার্স্ট কাজটা কী ছিল?
– ফার্স্ট কাজ ছিল একটু কন্ট্রোভার্সিয়াল। ঐটা চারুকলাতেই করছিলাম। সাবমিশনের প্রজেক্ট হিসাবে। অইটা ঐভাবে হয়তো গ্রাফিতিও না। আবার আমি নিজের মতো করে, ইম্পোভাইজ করে করা। ঐটা ছিল ব্যাঙ্কসির অনুপ্রেরণায়। কনসেপ্টটা এমন ছিল যে, ব্যাঙ্কসিই কাজটা করছে, বাংলাদেশে এসে। ডিটেল বলবো?
হ্যাঁ, ডিটেল বললে ভালো হয়। মানে কীভাবে আগাইলেন, করার প্রসেসটা…
– তো কন্ট্রোভার্সিয়াল ছিল ব্যাপারটা। একটু ঝামেলাও আছে।
আচ্ছা, আপনি চাইলে পরে ট্রান্সক্রিপ্ট করে পাঠাবো…
– ব্যাঙ্কসির কাজ, তার কাজের এপ্রোচ আমার ভালো লাগত। তো আমি চিন্তা করলাম যে, আমাদের যে পড়াশোনা সিস্টেম, আর্টের যে কালচার ঐগুলা নিয়ে এরকম গ্রাফিতি রিলেটেড কাজ করি। প্রথমে ভাবছিলাম, আমাদের জয়নুল আবেদিন স্যারের যে আর্দশ বা যে নীতি, যা-ই বলেন, সেগুলা তো আমাদের ভিতর আর নাই। এই জিনিসটাকে কিভাবে এক্সপ্রেস করবো। তখন আমার কাছে মনে হইলো যে, ব্যাঙ্কসি যেহেতু একজন কন্ট্রোভার্সিয়াল আর্টিস্ট, তো আমি কনসেপ্টটা এরকম করে ভাবলাম, যেন ব্যাঙ্কসি বাংলাদেশে এসে কাজটা করছে।
এটা কি টেক্সট দিয়ে লিফলেটের মতেন করে যেইটা…
– হ্যাঁ, গেট ব্যাঙ্কসি… লেখা যেটা। ভাবছিলাম, জয়নুল আবেদিনের আদর্শ যেহেতু আর আমাদের মাঝে নাই, তাই জয়নুলের একটা ফুল ফিগার, চারুকলায়, আমাদের টিচার্স রুমের পাশে…
প্রথমে কি লিফলেটের কাজটা?
– না, লিফলেটটা এটার সাথে রিলেটেড। তখন জয়নুল আবেদিনের কিছু ফটোগ্রাফ দেখে আমার মনে হয় যে, আমরা স্টুডেন্ট বা টিচার অবস্থায় যে লাইফ লিড করি, জয়নুল তো আসলে অই রকম ছিলেন না। তিনি খুবই সিম্পল একটা লাইফ লিড করতেন। উনার স্টুডেন্ট লাইফেরও বেশ কিছু ফটোগ্রাফ আমি দেখেছি। যেগুলাকে উনি একদমই সিম্পল কাপড় চোপড় পরা, সাধারণ একটা ছেলের মতোন চলাফেরা করতেন। আমাদের ভিতর যেহেতু ঐ জিনিসটা নাই, তো ঐ জিনিসটাকে আমি সবার ভিতরে আনার জন্য, জয়নুলের ঐরকম একটা ইমেজ নিয়ে আমাদের চারুকলার টিচার্সরুমের ওয়ালে গ্রাফিতিটা করি।
( আমরা লিফটের পাশে বসে কথা বলতেছিলাম বলে কিছু নয়েজ ঢুকে পড়ে তখন। আমরা কিঞ্চিৎ বিরতি দিই এবং আবার শুরু করি। আরাফাত বলতে থাকেন)
টিচার্স রুমই তো ইমপোর্টেন্ট জায়গা। ঐখান থেকেই সব হয়। তো, আমি চিন্তা করলাম টিচার্সরুমের পাশে হলেই বেশি হিট করবে। টিচারদের মধ্যে। আমাদের মধ্যে। তাই টিচার্সরুমের পাশেই জয়নুল আবেদিনের গ্রাফিতিটা করি। জয়নুলের ইয়ং কালের একটা ছবি। তিনি অনেক সিম্পল একটা ড্রেস পরা। তার হাতে… ( কেউ একজন কথা বলতেছিলেন। আবার নয়েজ ঢুকে পড়ে)
আমার কনসেপ্টটা ছিল যেহেতু ব্যাঙ্কসি এসে কাজটা করেছে, তো ব্যাঙ্কসি যে স্টাইলে গ্রাফিতিগুলা করে, একটা ফুল ফিগার নিয়ে। আমিও জয়নুল আবেদিনের ঠিক এরকম একটা ফুল ফিগার নিয়ে গ্রাফিতিটা বানাইছিলাম। জয়নুল আবেদিন দাঁড়ায় আছেন। উনার হাতে একটা স্কেচবুক।স্কেচবুকের উপর টেক্সটটা ছিল এমন : ‘লিসেন টু ইউর আর্ট।’ তোমার নিজের আর্টের কথা শোনো। এরকম একটা কনসেপ্ট নিয়ে। এবং ব্যাঙ্কসির যে সিগনেচার, ঐটাও দিয়েছিলাম পাশে। দেখে মনে হবে যেন ব্যাঙ্কসিই কাজটা করেছে। আর ব্যাঙ্কসি বার্লিন বা অন্যান্য জায়গায় যে কন্ট্রোভার্সিয়াল কাজগুলা করে, তার পিছনেও তো পুলিশ-টুলিশ অনেক লেগে থাকে। পেপারেও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়ান্টেড টাইপ নিউজ বেরোয়। তো আমি ঐরকম ফেক একটা ইমেজ দাঁড় করানোর জন্য, ঐরকম একটা ইম্প্রেশন তৈরি করার জন্য, কিছু পোস্টার ছাপাই। মানে যেটাতে গেট ব্যাঙ্কসি লেখা থাকে। মানে ব্যাঙ্কসিকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বা… তো ঐ পোস্টারটাকে আমি চারুকলা বা ক্যাম্পাসের আশেপাশে বিভিন্ন জায়গায় পেস্ট করে দিই, যাতে সবাই প্রথমে পোস্টারটা দেখে এবং জয়নুলের কাজটার সাথে রিলেট করতে পারে। এবং কাজটাতে যেহেতু ব্যাঙ্কসির সাইন আছে, অনেকেই মনে করে যে এইটা আসলে ব্যাঙ্কসিরই করা। তো এটাই কনসেপ্ট ছিল এবং আমাদের ভিতরে যে জয়নুলের চিন্তাভাবনাগুলা মিসিং এটা বুঝানোর জন্যই টিচার্স রুমের ওয়ালে গ্রাফিতিটা।
ওয়ালে করতে গিয়ে কোনোরকম বাধাটাধা পান নাই?
– হ্যাঁ, ঐটা নিয়ে পরে একটু ঝামেলা হয়েছিল। কারণ আমি কাজটা ব্যাঙ্কসির আদলে করলেও, কাজটা ছিল আমাদের ফাইনাল সাবমিশনের প্রজেক্ট। আমি কাজটা ঐভাবেই প্রেজেন্ট করি, আমি আমার টিচারদেরকেও জানাই যে এটা আমার সাবমিশনের প্রজেক্টের কাজ। তখন তারা কাজটা ঠিক ঐভাবে পছন্দ করেন নাই। তারা আমাকে মুছে দিতে বলেন… এরকম একটু ঝামেলা হয়েছিল…. বাট আমি যেহেতু একটা মাইন্ড সেট থেকে কাজটা করেছিলাম, , তার জন্য একটু ফাইট তো করতে হবেই; কথা বলতে হয়েছিল কয়েক জায়গায়, তবে আমি আমার অবস্থান থেকে একটুও নড়ি নাই।
লাভ হইছিলো?
– লাভ হয়তো হয় নাই। অনেকটা লসই হয়ছিল আসলে … হা হা.. কী বলবো, অইটা আসলে পরবর্তীতে আমার লাইফের অনেক ক্ষেত্রে ইফেক্ট করেছে… এতে কিছু জিনিস আমাকে ক্লিক করেছে, তো তখন আমি বুঝতে পারি যে: গ্রাফিতি ইজ সামথিং… মানে একটা নরমাল আর্টওয়ার্কের চেয়েও এর বেশি ক্ষমতা আছে… এটা সবাই হ্যান্ডেল করতে পারে না। তো এর যে পাওয়ারটা আছে, এই পাওয়ারটা দিয়ে অনেক কিছু চেঞ্জ করা যায়। এবং এই ইফেক্টটা নিজের উপরও আসে। এটাকে মেনটেন করাটা খুব সহজ না।
মুছে দিতে হয়েছিল কি পরে গ্রাফিতিটা?
– গ্রাফিতিটা মুছে দিতে হয়েছিল। তবে আমি মুছি নাই। মুছে ফেলা হয়েছিল।
মানে চারুকলা থেকে?
– হ্যাঁ। এরকম কাজ আমার আরো একটা গ্রাফিতিতে হয়েছিল। মুছে ফেলা হয়েছিল।
কোন কাজটা?
– সেটা ছিল, একটা গ্যালারি সামনে। ‘আর্ট’ নিয়ে।
এটা আমি দেখি নাই। ঐটার থিম কি ছিল?
– থিম ছিল, আমাদের যে গ্যালারি সোসাইটি বা আর্ট বিজনেসের যে ব্যাপারটা সেটাকে মকারি করে। আমার আরো কয়েকটা কাজ ছিল এরকম। অবশ্য স্পেসিফিক্যালি বলাটা একটু খারাপ হয়, তারপরও যে গ্যালারিই বলেন না কেন, মানে অনেক গ্যালারিই আমি দেখছি যে, আর্টটাকে বিজনেসের মতো করে শুধু কেনা-বেচা বা কমার্শিয়ালি ইউজ করে এবং অনেকেই সেখানে এক্সিবিশন করতে যায় শুধু কাজ সেল হবে বলে। তবে উনাদের এসব ‘আর্ট’ কতটা ‘আর্ট’ সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
মানে আর্ট মার্কেটের এগেইন্সটে ছিলেন?
– হ্যাঁ, এগেইন্সটে। কোন একটা এক্সিবিশন শুরু হবে বা এমন তার আগে আগে গ্যালারির সামনে গ্রাফিতিটা করি।
ঐটা কি এখনো আছে?
– না, ঐটাও মুছে ফেলা হয়। ঐটা খুব মজার কাহিনী। ওপেনিং-এর দিনই গ্রাফিতিটা রিভিল হয় আর কি।
কিসের ওপেনিং?
– যে গ্যালারির সামেনে কাজটা করি, তার অপজিটের যে দেয়াল, তাতে একটা ক্যানভাস আঁকছিলাম, ইজেলের উপর একটা ক্যানভাস, আর ক্যানভাসে লিখা ছিলো যে, মেক মানি নট আর্ট।
এটা বোধহয় চারুকলার ভেতরেও ছিলো।
– না। চারুকলায় না, এটা ঐ একটাই ছিলো।
তাহলে বোধহয় অইটার ছবিই দেখছিলাম।
– মজার ব্যাপার হলো, অইটা দেখার পরই, গ্যালারি কর্তৃপক্ষের হয়তো আঁতে ঘা লাগে, তারা তাড়াতাড়ি এটা মুছে ফেলে।
মুছে ফেলাটা আমার মনে হইছে পজেটিভ রিএকশান, মানে আপনার পক্ষ থেকে।
– হ্যাঁ। আমার অইটাতেই আরো বেশি মজা লাগছে। তার মানে আমি যেটা চাইছি অইটাই হইছে। তার কারণেই অইটা মুছে ফেলা হইছে। এটা আমার জন্য আনন্দের…
আচ্ছা।
– আমিও জানতাম না, মুছে ফেলা হইছে। আমি তখন আরেক জায়গায়। অন্য একটা কাজে ছিলাম। আমার এক জুনিয়র, যে আমাকে হেল্প করছিল গ্রাফিতিটা করার সময়; সে আমাকে ছবি তুলে পাঠায় বলে: ভাই, অই কাজটা মুছে ফেলা হইছে।
আচ্ছা, সচরাচর গ্রাফিতি যারা করে, মানে বোল্ড গ্রাফিতি যারা করে, তারা নিজের পরিচয় গোপন করে। আপনি তো পরিচয় গোপন করেন নাই। এটার কারণ কী ছিলো?
– আমি আসলে নিজের মতো করে নিজের এক্সপেরিয়েন্সটা শেয়ার করেছি। আমার টিচাররাও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছেন যে, তুমি এটা কী গ্রাফিতি করো, এটা তো গ্রাফিতি হয় নাই। কারণ গ্রাফিতি আর্টিস্টরা তো পরিচয় গোপন রাখে। আমার মনে হয় এটা বাধ্যতামূলক না যে গ্রাফিতি করলেই পরিচয় গোপন করতে হবে। আমার যে কাজটা আমার মনে হয়েছে জানানো উচিত; সেটা জানাইছি। এবং ফলাও করেও জানাই নাই। যখন কেউ জিজ্ঞেস করছে তখন আমি বলছি, হ্যাঁ এইটা আমার। বা যেটা আমার না সেটা আমার না বলছি।
মানে দরকার হয় নাই গোপন করার?
– বিষয়টা এমন না যে আর্টিস্ট কে প্রকাশ পেয়ে গেলেই সেটা গ্রাফিতি হবে না। প্রকাশ না পেলেই গ্রাফিতি হবে। আমার মনে হয় পুরাটাই আর্টওয়ার্কের উপর নির্ভর করে। বা আমি একটা গ্রাফিতির সাথে অনেক ইলিমেন্ট যোগবিয়োগ করেও সেটাকে আর্ট হিসেবে এপ্লাই করতে পারি। হয়তো আমি ওখান থেকে কিছু নিচ্ছি, অন্য জায়গা থেকে কিছু নিচ্ছি, যেমন আমার প্রথম গ্রাফিতিটাতে তো শুধু গ্রাফিতি করি নাই, সাথে পোস্টারিং করছি। আবার ঐ গ্রাফিতিটা পুরোটাই আমার একার ছিলো না, অইটাতে আমি পুরা বাঙ্কসি’র অনুকরণ করছি, সেটা আমি ইচ্ছা করেই করেছি। যাতে মানুষের ঐ ইলিউশনটা তৈরি হয় যে এইটা ফেইক নাকি রিয়েল!
হুম, সেটা সমস্যা না।
– আবার কোন ক্ষেত্রে আমি শুধু টেক্সট ইউজ করছি, আবার কোন ক্ষেত্রে হয়তো কোনো আর্টওয়ার্ক, মানে একাডেমিক সার্টিফিকেট ফ্রেমসহ দিয়ে সাথে গ্রাফিতি করেছি।
এশিয়ান’এর যেটা?
– হ্যাঁ, এশিয়ান-এর যেটা। আবার ওটা আমি ইচ্ছে করেই একটা পাবলিক স্পেস থেকে আর্ট এক্সিবিশনের প্লেসে মানে গ্যালারিতে নিয়ে গেছি।
ব্যাঙ্কসি’রও এরকম আছে।
– হ্যাঁ। তো আমার কাছে এইটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হয়।
আচ্ছা, এশিয়ানটা নিয়ে বলি। আমাদের এইখানে যেকোন আর্ট কম্পিটিশনে তো জুরি বোর্ড থাকে। তাদের কাছে কাজ সাবমিট করতে হয়। এশিয়ানেরটা কীভাবে সাবমিট করছিলেন?
– আমি এশিয়ানে ঐ একটা কাজই দিয়েছিলাম কারণ আমার মনে হইছিল যে, যদি সিলেক্ট হয় হবে আর না হলে নাই। ভাবছিলাম সিলেক্ট হবে না। মজা করে সাবমিট করেছিলাম। বাট ফরচুনেটলি ওখানে কাজটা সিলেক্ট হইছে, তো আমি তখন মজা পাইছি যে কাজটা টিকে গেছে, মানে ওরা কাজটা নিছে।
আচ্ছা, সাবমিট করার প্রক্রিয়াটা কী ছিলো?
– সাবমিটটা আসলে আমি ইন্সটলেশন ফরম্যাট যেটা থাকে ওর মধ্যে দিয়েছিলাম, পেইন্টিং- স্কালপচার যেইভাবে দেয়।
ইমেজটা কিভাবে রেডি করছিলেন?
– ইমেজটা আমি ফটোশপেই করছিলাম, মানে আমি নিজে ড্রয়িং করে, নরমাল যে প্রসেস আরকি। ইন্সটলেশন আর্টিস্টরা যেরকম তাদের লে-আউট দেয়, আমিও জাস্ট আমার লে-আউটটাই দিয়েছিলাম। বাট কনসেপ্টটা খুব ক্লিয়ারলি দিয়েছিলাম। মানে আমার কন্সেপ্টটা যদি কন্ট্রোভার্শিয়াল কন্সেপ্টও হয় সেটা আমি ক্লিয়ারলি তাদেরকে এপ্রোচ করেছি।
আচ্ছা, আচ্ছা।
– তো সে অনুযায়ী তারা কাজটা সিলেক্ট করছে।
আচ্ছা, আর যে দুইটা গ্রাফিতি দেখালাম, একটা মনে হয় সিল মোহরের, এগুলা করতে গিয়ে কোন বাধা পাইছিলেন?
– অইটায় আসলে কোন বাধা পাইনি। অইটা তো ওপেন স্পেসেই ছিল, আমাদের চারুকলার ক্যান্টিনের ঐখানে। ওখানে অনেকে পোস্টার লাগায় বা ছবি আঁকে বা দেয়ালে কিছু করে। তো ওখানে সেভাবে আমি আমার মতো করে কাজটা করছিলাম, তার জন্য কারও পারমিশন নিই নাই। অইটাও ‘আর্ট’ ইস্যু নিয়ে, মানে আর্ট মার্কেট-টার্কেট এসব নিয়ে করছিলাম।
আমার এরকম গ্রাফিতি করার কারণে কিছু বাধাবিপত্তি হইছিল, বা কথা শুনতে হইছিল, যে কারণে তখন আমার মধ্যে একধরনের ফ্রাস্ট্রেশন তৈরি হয়।
কথা কি ডিপার্টমেন্ট থেকে শুনতে হইছে?
– সিনিয়রদের কাছ থেকে। তখন অই ফ্রাস্ট্রেশনটা আমি আর্টের মাধ্যমে এক্সপ্রেস করি মানে গ্রাফিতি র মাধ্যমে।
আমার যেটা সবচেয়ে ভালো লাগছে, মানে, আপনার যে বিষয়টা এপ্রিশিয়েট করি, আপনার একাডেমিক রেজাল্ট কিন্তু বেশ ভালো। এই সময়ে গিয়ে দেখা গেল আপনি ক্লাশের সাবমিশনে… মাস্টার্সের সাবমিশন ছিল না?
– জ্বি। এরকম সময়ে, তাও সাবমিশন প্রজেক্ট হিসাবে গ্রাফিতি করাটা কিন্তু বেশ রিস্কি। আমি আসলে ঐ রিস্কে পড়ে গেছিলাম।
এইটা আমার কাছে পছন্দ হইছে আর কি।
– কিন্তু আমার মনে হয় রিয়েল কিছু করতে গেলে তো রিস্ক নিতেই হয়।
আমাদের এইখানে যেটা হয় কি, ধরেন কেউ পেইন্টিং করবে, সে তার পেইন্টিংয়ে পর্যন্ত চায় যে তার টিচারদের খুশি করবে। অই জায়গায় আপনি গ্রাফিতি করাটা… অনেক বোল্ড।
– হ্যাঁ, আমারও মনে হয়েছে আমি ঐসময় একটা বোল্ড ডিসিশন নিয়েছিলাম। প্রথমেই বলেছি, গ্রাফিতির তো একটা পাওয়ার আছে, এইটা হ্যান্ডেল করাটা টাফ, তো আমি ঐটাই ডিল করছি, কষ্ট হইছে কখনো কখনো… তবু আমি আমার জায়গাটায় শক্ত থেকে কাজ করার চেষ্টা করছি।
এখন নেক্সট প্রশ্ন, বরকতের যে গ্রাফিতিটা, ঐ আইডিয়াটা কীভাবে আসছে?
– ঐ আইডিয়াটা আসলে খুব নর্মালি চিন্তা করতে করতেই আসছিল।
মানে এখন পর্যন্ত যেসব গ্রাফিতির কথা বললেন, সবই আর্ট-আর্ট মার্কেট এসব নিয়ে। এইটা দেখলাম টোটালি ডিফারেন্ট।
এইটা একটা ইস্যুভিত্তিক কাজ ছিল। তখন একুশে ফেব্রুয়ারির আগে আগে। আপনি জানেন মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারিকে নিয়ে চারুকলায় একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। আলপনা করবে, ম্যুরাল করবে এইরকম। প্রতিবছর একই জিনিস হয়। আমি ভাবতেছিলাম, তখন অন্যরকম কী করা যায়। তখন আমি একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করি। গুগলে, এমনিতে। তখন শহীদ বরকত নিয়ে একটা লেখা, খুব টাচ করে আমাকে। তিনি মিছিলে গুলি খাওয়ার পর কয়েকটা কথা বলছিলেন। পড়ে মনে হল, এ কয়েক লাইন কথার যে পাওয়ার, যে শক্তি, তা অনেক কিছুতেই নাই। এই কয়েক লাইনই যেন পুরা বিষয়টাকেই তুলে আনে। তো ঐ লাইনগুলা নিয়ে কাজ করার প্ল্যান করি। কয়েকজন ফ্রেন্ডকে বলি। টিচারদেরও বলি। টিচাররা বলেন, তোমার নিজের কোন প্ল্যান থাকলে, তোমার নিজের খরচে করতে হবে। তখন এমনিতে এসব কাজের জন্য বিভিন্ন ফান্ড-টান্ড থাকে। আমিও ঠিক করি নিজের খরচেই করবো। কত টাকা আর! আমতলার যে গেটটা, একুশে ফ্রেবুয়ারির মিছিলটা যেইখান দিয়ে বের হয়, ঐখানের ওয়ালে-ফ্লোরে, মেডিকেল কলেজের আরো বিভিন্ন জায়গায়, বরকতের ঐ কথাগুলো ইউজ করে কাজটা করি। কথাগুলা ছিল এমন, ‘‘অনেক কষ্ট হচ্ছে! একটু খবর পৌঁছে দিবেন? বিঞ্চুপ্রিয়া ভবন, পুরানা পল্টন।’’ উনি তো মিছিলে গুলি খাইছিলেন। এটুকুই উনি শুধু বলতে পারছিলেন, গুলি খাওয়ার পর। সাথে একটা ফিগার দিয়ে, গুলি খাওয়া একটা ফিগার। আমার ইমাজিনেশন থেকে। আধা পড়া ফিগারটা। এরকম ছিল কাজটা।
ইমপ্যাক্ট কেমন ছিল?
– এটার ইমপ্যাক্টটা খুবই ইন্টারেস্টিং ছিল। আমি খুব মজা পেয়েছিলাম। আমার সাথে দুই-তিনজন ছেলে ছিল। চারুকলার জুনিয়র। ফাইয়াজ, সৈকত, তন্ময়- ওরা তখন হেল্প করছিল আমাকে। খুব ইন্টারেকটিভ হয়েছিল কাজটা। একুশে ফ্রেব্রুয়ারির কারণে অনেক প্রটোকল তখন অইখানে। অনেক মানুষ। সবার কৌতুহল। দিনমজুর থেকে পুলিশ, নানান রকম মানুষ। লোকজন এসে এসে জিজ্ঞেস করতেছিল, ভাই কী হয়েছে, ঘটনা কী, মানে কী কথাগুলার? আমাকে তখন প্রায় সবাইরে বুঝায় বলতে হয়েছিল পুরো ঘটনাটা। তারাও আগ্রহ নিয়েই শুনছিল ঘটনাটা
কোন বাধা আসছিল করার সময়?
– না, কোন বাধা পাই নাই করার সময়। সবাই তো একুশে ফ্রেবুয়ারির ম্যুরাল-আলপনা এসবেই ব্যস্ত ছিল। আমি কাজটা একুশে ফ্রেবুয়ারির আগের দিন মানে ২০ তারিখ করছিলাম।
আপনার নেক্সট প্ল্যান কী? গ্রাফিতি নিয়ে।
– প্ল্যান বলতে… গ্রাফিতি নিয়ে অইরকম স্পিসিফিক কোনো প্ল্যান নাই আপাতত। কোন ইস্যু পেলে করে ফেলব হয়তো। প্রি-প্ল্যান নিয়ে অইভাবে কিছু করা হয় নাই। ও হ্যাঁ, এশিয়ানের যেই কাজটা, অইটা আমার প্রি প্ল্যানের কাজ ছিল। অনেক গুছানো কাজ ছিল। ফাইন ফিনিশিং।
ঐটার ইমপ্যাক্ট কী ছিল?
এটার ইমপ্যাক্ট তো আর সরাসরি পাওয়া যায় নাই। কেউ বুঝছে, কেউ হয়তো বুঝে নাই। কেউ হয়তো ভিজুয়ালের কারণে, লাইভ সাইজ ফিগার, মজা পাইছে। তবে শিল্পকলাকেন্দ্রিক এরকম শো গুলাতে তো এরকম কাজ থাকে না সচরাচর, তো সেদিক থেকে বলতে গেলে, একরকম আলাদাই ছিল পুরো কাজটা। এটাও ঠিক, গ্রাফিতিকে পাবলিক প্লেসেই বেশি ভালো দেখায়। এটাকে যখন শিল্পকলায় করি, একটা স্ট্রাকচারের ভিতর নিয়ে আসি, তখন এটার ভাষাও চেঞ্জ হয়ে গেছে।
আচ্ছা। এটুকুই আমাদের আলাপ। আপনাকে ধন্যবাদ।
-আপনাকেও ধন্যবাদ।