টনি টাকিয়ানির আসল নাম সত্যি সত্যিই ছিলো টনি টাকিয়ানি।
কোকড়ানো চুল আর পাথর কুঁদে কুঁদে গড়ার কারণে অনেকেই তাকে আমেরিকান জাপানি মিশ্র জাতের ভাবতো। ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছু পরের, যখন এমন অনেক বাচ্চাই পয়দা হইতেছিলো। কিন্তু টনি টাকিয়ানির বাপ মা দুজনই ছিলো জাপানিজ। জাত জাপানিজ যারে বলে। তার বাবা সোজাবুরো টাকিয়ানি জ্যাজ ব্যান্ডে ট্রমবোন বাজাইতো আর বাজাইতোও খুব ভালো। কিন্তু যুদ্ধের বছর চারেক আগে তারে টোকিয়ো ছাড়তে বাধ্য করা হয়। তার দেশের বাড়ি নাগাসাকি ফিরতে ফিরতে সে ভাবে ছাড়তে যদি হয় তাহলে সে একবারেই ছেড়ে দিবে আর এই ভেবেই সে চায়না পাড়ি দিলো, হাতে শুধু তার ট্রমবোন নিয়ে। সোজাবুরোর এমন কোন বিষয় সম্পত্তি টোকিয়োতে ছিলো না। টোকিয়ো কি! পুরো জাপানে তার কিছু ছিলো না যা হারাইলে সে একটু কষ্ট পাইতো। তার মনে হইতে থাকে সাংহাইয়ে তার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। নাগাসাকি থেকে সাংহাই তখন ১ দিন লাগে নৌকায়। নৌকা যখন ইয়াংজি নদী বাইয়া সাংহাই আসতেছে, সোজাবুরো নৌকার মাথায় দাঁড়ায়ে ভোরের নতুন সূর্য দেখে, বড়ো বড়ো বিল্ডিংগুলো কেমন ঝকমক করে, সে ভাবে। এই আলো যেন তারে অনেক উজ্জলতার প্রতিজ্ঞা করে। সোজাবুরো তখন ২১ বছর বয়সী।
যুদ্ধটারে সে হালকাভাবেই নিয়েছিলো। চায়নায় জাপানের হামলা, পার্ল হারবারে জাপানের হামলা, দুইটা পারমানবিক বোমা জাপানে পড়া, কোনটাই তারে বিশেষ নাড়া দেয় নাই। সে তখন নাইট ক্লাবে ট্রমবোন বাজায়। সোজাবুরো টাকিয়ানি ইতিহাসে খুব একটা আগ্রহী লোক না কিংবা এর থেকে অনুপ্রেরণা নিবে তেমনও না। সে শুধু ট্রমবোনটা ঠিকঠাক বাজইতে চাইতো, তিনবেলা ঠিকঠাক খাবার আর সুন্দরী সব নারীর সঙ্গ চাইতো। সে একই সাথে বিনয়ী আর দাম্ভিক। আত্নকেন্দ্রিক হইলেও তার আশেপাশের সবার সাথেই সে ভালো ব্যবহার করতো আর লোকজনও তারে এই জন্য বিশেষ পছন্দ করতো। যুবক মিউজিশিয়ান, দেখতে-শুনতে ভালো সোজাবুরো এতো মেয়ের সাথে শোয় যে তা গুনতির বাইরে। জাপানিজ, চাইনিজ, রাশান, বিবাহিত মহিলা, অবিবাহিত মহিলা, দেখতে সুন্দর মহিলা, দেখতে খুব সুন্দর না এমন মহিলা, গনিকা, যার সাথেই সম্ভব, দৈহিক সম্পর্ক স্থাপনে সে বিশেষ ভাবে নাই। দ্রুতই তার মিষ্টি ট্রমবোনের সুর আর ক্যাসানোভা চরিত্র সাংহাইয়ে তারে পরিচিত করে তোলে।
সোজাবুরো টাকিয়ানির একটা বিশেষ গুণ ছিলো যেটা সে হয়তো নিজেও জানতো না, তা হচ্ছে তার বন্ধুরা ছিলো ক্ষমতাধর। আর্মির উচ্চ পদধারী, কোটিপতি ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন কিছু লোক যারা যুদ্ধ চলাকালীন রহস্যময়ভাবে টাকা আয় করছিলো। এদের অধিকাংশই পিস্তল ছাড়া চলাফেরা করে না আর সবসময় চারিদিকে সর্তক চোখে তাকাতো। কোন এক অজানা কারণে সোজাবুরোর সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর যে কোন কাজেই তারা বেশ সহযোগিতা করে সোজাবুরোকে।
কিন্তু এই গুণের কারণেই তার বিপদ হয়। যুদ্ধ শেষে সোজাবুরোর বন্ধুদের সুবাদে তার প্রতি নজর পড়ে চাইনিজ আর্মির এবং তুলেও নিয়ে যায় তাকে। দিন কাটতে থাকে। যাদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো, তাদের প্রায় বিনা বিচারেই হত্যা করা হচ্ছিলো সেলগুলোতে। সেলের সামনে রক্ষীরা আসতো, একজনকে বের করে নিয়ে গিয়ে সামনের বারান্দায় গুলি করতো। সোজাবুরো ধরেই নেয় এই জেলে তার মৃত্যু হবে। কিন্তু কোনো মৃত্যু-ভয় তার কাজ করে না। মাথায় একটা গুলি করলেই শেষ। সেকেন্ডেই সব যন্ত্রণার অবসান। আমি যেভাবে চাইছি, ঠিক সেভাবেই জীবন পার করছি। ভলো খাবার, ভালো মেয়ে, ভালো সময়, সবই উপভোগ করছি। আফসোস নাই আর অভিযোগের তো প্রশ্নই আসে না। যা হবার তাই হবে। হাজার হাজার জাপানিজ মরছে এই যুদ্ধে, আমার চেয়ে অনেক খারাপভাবেও মরছে অনেকে।
মৃত্যুর অপেক্ষায় জেলের ছোট জানালা দিয়ে সে দেখে কিভাবে ভেসে যাচ্ছে মেঘ। নোংরা দেয়ালগুলিতে সব মেয়েদের চেহারা আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আঁকতে থাকে মনে মনে। শেষমেষ দেখা যায়, সোজাবুরো সেই দুইজনের একজন যে জেল থেকে জীবিত বের হইতে পারছে এবং জাপানে ফিরতে পারবে। আরেকজন যে ছিলো, জাপান আর্মির একজন অফিসার, পাগলপ্রায় হয়ে গেছে এতদিনে। জাপান ফেরার পথে, সাংহাই দেখে সোজাবুরো, সূর্য ডুবে যাচ্ছে ইয়াংজি নদীতে। পানির শব্দ পায়, শহরের শব্দ আস্তে আস্তে আর আসে না। মনে মনে বলে, জীবন! তোমারে কখনো বুঝতে পারবো না।
তখন ১৯৪৬ সাল, যুদ্ধ শেষ হয়েছে ৯ মাস হলো। সোজাবুরোর জাপান প্রত্যার্বতন। ঠিক যেভাবে গিয়েছিলেন, ফিরেছেন তেমনি শুধু একটি ট্রমবোন হাতে। এসে জানতে পারেন, একদিন বড়ো দুইটি বোম পড়ে তার বাপ-মা সপরিবারে মারা গেছেন। একমাত্র বড় ভাই বার্মায় গেছিলো যুদ্ধে, সেই থেকেই নিঁখোজ। তো সোজাবুরো এখন একা, যদিও খুব অবাক হয় নাই বা দুঃখ সে পায় নাই। তবে কিছু একটা না থাকার অনুভূতি হইতো তার মাঝে মাঝে। সে মনে-প্রাণেই বিশ্বাস করতো যে সবাইরেই একা থাকা লাগে! আগে আর পরে। বয়সও ত্রিশের কোঠায় পড়লো। সোজাবুরোর মনে হইলো হঠাৎ করেই কয়েক বছর বয়স তার বাইড়া গেলো। এতটুকুই। এরচে বেশি কিছু তার মধ্যে কাজ করে নাই।
যেমনেই হোক বেঁচে তো সে আছে, তাই সে কীভাবে দিন পার করবে ভাবতে থাকে। কাজ বলতে সে শুধু একটা জিনিসই পারতো। তাই সোজাবুরো তার কিছু পুরোনো বন্ধুদের খুঁজে বের করে একটা জ্যাজ ব্যান্ড শুরু করে আর আমেরিকার মিলিটারি বেস-এ বাজানোর সুযোগও পেয়ে যায়।
বন্ধু বানানোর পুরোনো গুণের জোরে, সে আর্মির এক মেজর, এক ইতালিয়ান- আমেরিকান অফিসার যে কি না ক্ল্যারিনেট বাজাতো তার সাথে খাতির হয়। অবসরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা একসাথে বাজাতো। আমেরিকান মেজর ছিলেন মেরিন সৈন্যদলের অফিসার। সেই সুবাদে সে যেকোন গানের রের্কডই আমেরিকা থেকে আনাতে পারতো। সোজাবুরো যেতো সেই মেজরের কোয়ার্টারে আর শুনতো ববি হ্যাকেট, জ্যাক টিগার্ডেন, বেনি গুডম্যান, যতটা পারা যায় নিজেকে সে শেখাতো এসব গান। মেজর সাহেব সোজাবুরোকে সবরকম খাবার, দুধ, মদ খেতে দিতেন যা সেসময় দুর্লভই বলা চলে। খারাপ না, সোজাবুরো ভাবে, বেচে থাকার জন্য খুব খারাপ সময় না।
১৯৪৭ সালে সোজাবুরো টাকিয়ানি তার দূর সম্পর্কের এক বোনকে বিয়ে করেন। হঠাৎ রাস্তায় দেখা, তারপর চা-আলাপ। খুব বেশিদিন না যেতেই তারা বিয়ে করে ফেলে, হয়তো মেয়েটি প্রেগন্যান্ট তাই, অন্তত টনি টাকিয়ানি তাই শুনেছে বাবার কাছে। তার মা দেখতে সুন্দর, চুপচাপ স্বভাবের হলেও খুব স্বাস্থ্যবান ছিলেন না। টনির জন্মের তিন দিনের মাথায় মারা যান তিনি। এভাবেই তাকে চুপচাপ মাটি দেয়া হয়। মারা যাবার আগে তার কোনো সমস্যাই হয়নি। না কথা বলতে, না নিঃশ্বাস নিতে, সে শুধু শূন্যের দিকে চলে যায়। যেন কেউ ব্যাকস্টেজে গেলো আর নিভে গেলো স্পটলাইট।
সোজাবুরো টাকিয়ানির কোনো ধারণা ছিলো না সে এই ঘটনাকে কীভাবে নিবে। আবেগের কাছে সে সবসময় একজন অচেনা পুরুষ। না সে ধরতে পারছিলো মৃত্যুর স্পষ্টতা, না ধরতে পারছিলো তার বউয়ের মৃত্যু, তার মানে কি! একটা শুকনো ঢোক গেলার মত গিলে নেয় সে পুরো বিষয়টা। তার মনে হইলো কোন ভারী জন্তু তার বুকের উপর এসে বসে আছে, সমস্ত চিন্তা আটকায় দিয়ে। সে কিছুই বলতে পারলো না। পরর্বতী চার সপ্তাহ সে অন্যকিছু ভাবলো না। এমনকি হাসপাতালে পরে থাকা বাচ্চার ব্যাপারটাও।
মেজর সাহেব সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব। প্রতিদিন তারা সন্ধ্যার পর ঘাটিতেই বসতো মদ নিয়ে। “নিজেরে ঠিক করো ” সোজাবুরোরে উদ্দেশ্য করে মেজর বললেন। তোমার ছেলেরে মানুষ করো। সোজাবুরো যে কিনা কিছুই কানে নিলো না, শুধু শুধু মাথা নাড়ালো। হঠাৎ একদিন তার মেজর বন্ধু বললেন, কেন না আমি তোমার ছেলের ধর্মপিতা হই? সোজাবুরোর মনে পড়ে সে ছেলের নাম দিতেই ভুলে গেছে।
মেজর তার নিজের নাম “টনি ” সুপারিশ করে টনি, যা কিনা কোনো জাপানিজ বাচ্চারই নাম না, এটা মেজর সাহেবের মাথায় তখন আসে নাই। সোজাবুরো বাড়ি পৌঁছে একটা কাগজে নামটি লেখে “টনি সোজাবুরো”। দেয়ালে টাঙানো নামটার দিকে সে কয়েকদিন তাকায়। টনি টাকিয়ানি। আছে তো ভালোই। খারাপ না। জাপানের ওপর আমেরিকার কব্জাও খুব তাড়াতাড়ি যাবে না বলে সে মনে করে। বরং বাচ্চার এ নাম ভবিষ্যতে কাজেও আসতে পারে।
এরকম নাম নিয়া বড় হওয়া খুব একটা আনন্দের হয় নাই টনি টাকিয়ানির। স্কুলের বাচ্চারা তারে সংকারজাত বইলা ক্ষেপায়, কেউ কেউ তার নাম শুনে কৌতুহল ভরে তাকায়, কারো জন্য টনি নামের কারো সাথে পরিচিত পুরোনো ক্ষত চিড়ে বের করে আনে। এইসব ঘটনা বাচ্চাটারে পার্থিব বিষয়াদি থেকে দূরে ঠেলতে থাকে তাই তার বড়ো হওয়ার সময়ে তেমন কোনো বন্ধুই হয়নি। এই ব্যাপারটাতে যে টনি খুব কষ্ট পায় তা মনে হয় না। সে এটারে স্বাভাবিকভাবেই নেয়, ভাবে এইটাই বেঁচে থাকার উদাহরণ। টনির বাবা সারা বছরই ব্যান্ডের সাথে ব্যস্ত থাকতো। টনির দেখাশোনা সবই করতো এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার। ক্লাস ফাইভ না যেতেই সে সম্পূর্ণ একা থাকতে পারতো, নিজের রান্না, ধোয়া-মোছা, একা ঘুমানো। একা থাকতেই বরং তার ভালো লাগতো।
সোজাবুরো দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। তবে তার গার্লফ্রেন্ডের অভাব ছিলো না। তাদের কাউকেই সে বাসায় নিয়ে আসতো না। ছেলের মত বাবাও নিজের খেয়াল রাখায় ছিলো পারদর্শী। বাবা আর ছেলে প্রায় একই আচরণের হইলেও একে অপরের সাথে খুব একটা কথা হইতো না। তাদের দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য দেয়াল ছিলো। সত্য বলতে সোজাবুরো কোন আর্দশ বাপ ছিলো না, আর টনিও কোন আর্দশ বেটা ছিলো না।
টনি ভালোবাসতো আঁকতে, সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আঁকতে পারতো। তার পেন্সিলগুলো সবসময় থাকতো সূক্ষ্ম আর যেকোন যন্ত্র আঁকলে তা অভাবনীয় নিঁখুতভাবেই আঁকতো। সে কোনো পাতা আঁকলেও শিরাসহ স্পষ্ট আঁকতো। টনি সত্যিই আঁকতে ভালোবাসতো। আর্টে তার নম্বর থাকতো সবচেয়ে বেশি আর যেকোন আর্ট কম্পিটিশনেও সে বরাবরই প্রথম হইতো। টনির জন্য খুব স্বাভাবিক ছিলো যে সে হাইস্কুল শেষ করে আর্ট কলেজে এ্যাডমিশন নেবে। অন্য কোনো সম্ভবনার চিন্তা তার মাথাতেও আসেনি। তার বয়সী সবাই যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কি করা উচিত কোথায় যাওয়া উচিত, টনির আঁকাআকি কখনো থামেনি। সেসময় সমকালীন সব আর্টিস্টই প্রতিষ্ঠিত শিল্পের বিরুদ্ধে কাজ করছিলো, তাই তাদের কাছে টনির আঁকা মূল্যহীন মনে হয়। সহপাঠীরা বলে যে, তার ছবিতে কোনো মতাদর্শ নেই। টনি নিজেও তাদের ছবিতে তেমন বিশেষ কিছু খুঁজে পায় না, মতাদর্শরে হিসেবে নিয়েও। তার কাছে তাদের ছবি গুলো বেঠিক, নোংরা কিছু ছবি মনে হয়।
গ্রাজুয়েশন শেষে তার জীবন পাল্টে যায়। তার চরম নিঁখুত ছবির জন্য খুব একটা বেগও পেতে হয়নি চাকুরির জন্য। কেউ যন্ত্র কিংবা স্থাপত্যের কোনো ছবি তার থেকে নিঁখুত করে আঁকতে পারতো না। “এটা বাস্তবের চেয়েও বাস্তব” বলাবলি করতে থাকে সবাই, ফটোগ্রাফির চেয়েও ভালো দাবিও করে অনেকে। হঠাৎই সে প্রচণ্ড জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠে। সে সব কাজই নেয়, কি সে গাড়ির ম্যাগাজিন আর বিজ্ঞাপনের ছবি। সে এই কাজে মজাও পাইতো আর ভালোও ছিলো।
কোনো বিশেষ শখ না থাকায় বয়স পয়ত্রিশ না হতেই সে মাঝারি রকমের বিত্তবান হয়ে যায়। সেতাগায়া, টোকিয়োর নামি-দামি জায়গায় সে একটা বড়ো বাড়ি আর কিছু ছোট ফ্ল্যাট সে কিনে নেয়, যা থেকে সে ভাড়াও পেতো। তার একাউনটেন্টই এগুলোর খোঁজ রাখতো।
এই পর্যন্ত টনি বেশ কিছু নারীর সংস্পর্শে এসেছে এমনকি একটা মেয়ে ছিলো যার সাথে সে এক বাসায় ছিলো কিছুদিন। কিন্তু টনির বিয়েতে কোনো আগ্রহ ছিলো না। নিজের সব কাজই করতে পারতো আর করতোও। তার কাজের সমস্যা হলে সে বাড়ি দেখাশোনার জন্য লোক রাখতো। টনির মধ্যে তার বাবার বন্ধু বানানোর বিশেষ গুণের অভাব ছিলো। তার এমন কোনো বন্ধু ছিলো না যে এসে সাহায্য চাইবে বা তাকে কোন সিক্রেট কথা খুলে বলবে, এমনকি সামান্য আড্ডা দেবার মত বন্ধুও ছিলো না তার। বন্ধু না থাকলেও সুসম্পর্ক ছিলো সবার সাথেই। অহংকার বা দম্ভ কোনোটাই ছিলো না তার মাঝে। যারা যারা তাকে চিনতো, সবাই তাকে পছন্দ করতো। বাবা সোজাবুরোর সাথে দেখা হতো দুই তিন বছরে একবার, তাও ব্যবসার কাজে। কাজ শেষ হলে দুজন দুজনের দুনিয়ায় চলে যেতো। তাই টনি টাকিয়ানির জীবন সুখে-শান্তিতেই চলতে থাকলো।
একদিন এমন হলো, হুট করে প্রেমে পড়ে গেলো টনি। মেয়েটি একটা প্রকাশক অফিসে পার্ট টাইম কাজ করতো, টনির অফিসে এসেছিলো কিছু ছবি ডেলিভারি নিতে। ২২ বছর বয়সী মেয়েটি ছিলো প্রচণ্ড রকমের বিনয়ী, আর মুখে ঝুলে থাকতো সুন্দর একটা হাসি। কিন্তু তার ব্যাপারে কোনো একটা বিষয়, টনি টাকিয়ানির মনে হাতুড়ি পেটানো শুরু করে। প্রথম যে মুহূর্তে টনি তাকে দেখে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিলো। সে এতোটাই ঘোরে আছন্ন হয়ে যায় যে, একটা টু-শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি। লক্ষ্য করে দেখে যে বিষয়টি তার নজর কেড়েছিলো তা হচ্ছে মেয়েটির জামা। সাধারণত তেমন কোনো আগ্রহ জামা-কাপড়ের দিকে টনির ছিলো না। কিন্তু কিছু ছিলো মেয়েটির মধ্যে, যা টনির অন্তরে দাগ কেটে যায়। টনির আশেপাশে অনেক মেয়েই ছিলো যারা খুব সুন্দর আর মার্জিত করে জামা পরতে পারতো, তাদের ফ্যাশনজ্ঞানও কোনো অংশে কম ছিলো না, কিন্তু এই মেয়েটি আলাদা। সে এমন সহজাতভাবে জামা পরেছিলো যেনো এক্ষুনি কোনো যাদুকরি হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে নতুন কোনো দুনিয়ায়। টনির মনে হয় যেনো মোলায়েম সেই কাপড় তার জন্যই তৈরি, এর আগে কোন নারীকে এতো সুন্দর আর সাবলীল দেখেনি টনি।
যখন মেয়েটি অফিস থেকে চলে যায়, টনি সারাদিন আর কিছু বলেনি। সে কোনকিছু না করেই ঘরের মধ্যে বসে থাকে যতক্ষণ না সন্ধ্যা এসে ঘরটিকে অন্ধকার করে দেয়।
পরের দিন প্রকাশককে ফোন দিয়ে কিছু কাজের অজুহাত দিয়ে মেয়েটিকে অফিসে আনার ব্যবস্থা করে সে। কাজ শেষে তারা দুপুরে একসাথে খাইতে যায়। ছোট-খাটো কথাও হয় তাদেরর মধ্যে। পনের বছরের একটা ফারাক তাদের আলাদা করার চেষ্টা করতে থাকলেও আগ্রহের জায়গায় তাদের ছিলো অদ্ভুত রকমের মিল। এইরকম অনুভূতি ছিলো দুইজনের কাছেই নতুন। খাবার পরে টনি বললো
“আপনার জামা পরার স্টাইল খুব সুন্দর”
“আমার জামা-কাপড় খুব পছন্দ। আমার সব টাকাও ওখানেই যায়” বলে হাসতে হাসতে বিদায় নেয় মেয়েটি।
এরপর কয়েকবার একসাথে বের হয় তারা, বিশেষ কোথাও না, চুপচাপ কথা বলা যায় এমন জায়গায়, সেখানে তারা বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে থাকে। বিনা ক্লান্তির এমন কথা বলাতে দুজনের শূন্যস্থানগুলোও ভরে উঠতে শুরু করে। ৫ নম্বর বার দেখা করতে গিয়ে টনি তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে। কিন্তু মেয়েটি প্রেম করে, তাও সেই হাইস্কুল থেকেই। যদিও তাদের সম্পর্কের সেই ধার এখন কমে এসেছে আর প্রায় সব কথাতেই তারা এখন ঝগড়া করে। সত্যি বলতে টনির সাথে দেখা করতে মেয়েটির ভালোই লাগে। তাই বলে সে এতদিনের সম্পর্ক ভেঙে ফেলবে এমনও না। পনের বছরের বিশাল গ্যাপ, মাত্র ২২ বছরের তরুণী, এই বয়সের পার্থক্য কী হতে পারে পরে? মেয়েটি এসব চিন্তায় ডুবে যায় আর টনির কাছে উত্তরের জন্য সময় চেয়ে নেয়।
দিন যায় আর টনির মধ্যে অস্থিরতা উতলা হয়ে উঠে। কাজ করতে পারে না, ঘুমাতে পারে না, একা-একাই মদ খায় সারাদিন। তার আজীবনের পেলে-পুষে বড়ো করা একাকীত্বই যেনো তাকে ঘিরে ধরলো। জীবনরে তার একটা দুঃখ ভরা সেল মনে হতে থাকলো। সাদা ক্যাদক্যাদা দেয়ালের দিকে তাকায় থাকে সারারাত। লাল লাল চোখের কোণে ঠান্ডা লাগে তার, সে ভাবে, মেয়েটি রাজি না হইলে সুইসাইড করবে।
টনি মেয়েটিকে দেখতে যায়। সব খুলে বলে।
মেয়েটি তাকে ভালো নজরেই দেখতো আর প্রতি দেখায় টনির প্রতি তার ভালো লাগাও বাড়ে। এইটারে কি ভালোবাসা বলে কি না, সে সম্পর্কে সন্ধিহান হইলেও মেয়েটার একটা বদ্ধ ধারণা ছিলো যে এই লোকটার সাথে সে সুখেই থাকবে। বিয়ে হয়ে যায় তাদের।
টনি টাকিয়ানির একাকীত্বের অবসান ঘটলো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মেয়েটাকে না দেখলে সে অস্থির হয়ে উঠতো। এই ব্যাপারটা, এই একা থাকার ব্যাপারটা তারে খোঁচায়। কারণটা এমনও হইতে পারে যে সারাজীবনই সে একা ছিলো তাই আবার একা হয়ে যাইতে সে ভয় পায়। প্রশ্নেরা ঘুরপাক খায় কি করবো আমি? তখন টনি এসি রুমে বসেও দরদর করে ঘামতে থাকে। তবে দ্রুতই অভস্ত হয়ে পড়ে আর হুট করে স্ত্রীকে হারানোর ভয়ও কমে আসে।
একদিন তার বউ তাকে সোজাবুরো সম্পর্কে প্রশ্ন করে, কি করে, কি গান গায়, তারে দেখতে গেলে রাগ করবে কি না।
টনি রাজি হয়ে যায় যেতে। গিনজা নাইট ক্লাব যেখানে সোজাবুরোর বাজানোর কথা, সেখানে পৌঁছায় তারা। মেয়েটির সাথে সাথে টনিরও এই প্রথম বাবার পারর্ফম্যান্স দেখা ছিলো এটা। সোজাবুরো সেই আগের মতই গান বাজাচ্ছিলো, বহু বছর পুরোনো সব সুর। টনি পুরোনো রের্কডে শুনেছে এই গান। সোজাবুরো যা বাজাইতো তা ঠিক আর্ট না, এটা হচ্ছে এক জোড়া দক্ষ হাতের কারিগরি। তবে সবাইকে একটা ঘোরের মধ্যে আনার জন্য তা যথেষ্ট ছিলো।
টনি অনুভব করলো তার নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। যেনো চৌবাচ্চার মত ভরে উঠছে শরীর। বসে থাকলেও কেমন লাগা শুরু করে। বারবার মনে হতে থাকে, ছোটবেলার সব গানের সাথে এর বিস্তর ফারাক। সবকিছু আলাদা মনে হতে থাকে। বিষয়টা তাকে এমনভাবে ঘিরে ধরে যে সে চিল্লায়ে বলতে চায় বাবা এইটা কি বাজাচ্ছেন? এটাই কি আপনি আগে বাজাইতেন? হ্যাঁ, এমন কিছুই সে করেনি যা তার স্বভাবের বাইরে। সে ওইখানে বসে বাকিগানও শুনলো, হুইস্কি খেলো, স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশিই খেলো, গান শেষ হইলে হাততালি দিয়ে এই দম্পত্তি বাড়ির দিকে রওনা দেয়।
টনি আর তার স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া দেখা যায় না কখনোই, তর্কেও জড়ায় না তারা। একসাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারে তারা। টনি টাকিয়ানির ব্যবসা বেশ ভালো চলছিলো আর তার স্ত্রী বয়সের তুলনায় অনেক দক্ষতার সাথেই ঘর সামলাইতে থাকলো। তবে সবকিছুর মধ্যে একটা বিষয় টনি টাকিয়ানির চিন্তা হইতো, সেইটা হচ্ছে তার বউয়ের জামা-কাপড় কেনার ইচ্ছা। কোনো জামা দেখলেই তার ডিফেন্স ভেঙে যাইতো। চেহারা উল্টায়-পাল্টায় যাইতো, অনেক সময় কণ্ঠও। হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভাববে মেয়েটি বোধহয় অসুস্থ। টনি আগেও লক্ষ্য করেছে ব্যাপারটা কিন্তু হানিমুনে গিয়ে এটা কত সিরিয়াস তা আঁচ করতে পারলো। ইউরোপে গিয়ে সে আশ্চর্যরকমের বেশি জামা-কাপড় কিনতে শুরু করে।
মিলান কিংবা প্যারিস, সে হিপনোটাইজের মত দোকান-দোকান ঘুরে জামা কিনতে শুরু করে। দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার সুযোগও রাখে নাই। ডুনমো কিংবা ল্যুভ বাদ দিয়ে ভ্যালেনটিনো, গিভেনচি, আরমানি ঘুরতে থাকলো আর টনির বউ হাতের কাছে যা পেলো সেটাই কিনে নিলো। জাপান ফিরেও এই কেনাকাটার জ্বর থেকে সে বের হতে পারে না। প্রত্যেকদিন নতুন জামা কিনতে থাকে মেয়েটি। টনি বড়ো বড়ো আলমারি আর জুতা রাখার তাক বানায়ে তারে উপহার দিলো। কিন্তু তাতেও যখন আর জায়গা হলো না তখন বিশাল একটা রুম তার জামার জন্যই তৈরি করলো। আলিশান বাড়িতে রুমের খুব অভাব ছিলো না আর টাকার অসুবিধাও ছিলো না বিশেষ। কেউই তো আর পারফেক্ট না, টনি নিজেকে বলে, আর যাই সে পরে তাকে মানায় এজন্য টনিও বিশেষ অভিযোগ জানায় না।
মেয়েটির কেনা জামা যখন ওই বিশাল রুমেও ধরছিলো না, টনির তখন ভয় লাগতে শুরু করে। একবার মেয়েটি বাইরে থাকতে টনি ওই রুমে গিয়ে জামা গুনতে থাকে। হিসাব করে দেখে, মেয়েটি যদি দিনে দুইবার জামা পাল্টায়, তারপরেও দুই বছরে তার একই জামা পরার দরকার পড়বে না। সে কিনতে এতোই ব্যস্ত যে জামাগুলো পরতে ভুলে যায়। টনি ভাবে যে এটা হয়তো কোনো মানসিক রোগ। যদি তাই হয়, তাহলে এই অভ্যাসকে তো আর চলতে দেয়া যায় না।
অনেক সাহস করে রাতে খাবারের সময় টনি তাকে বললো “আমার মনে হয় তোমার কেনাকাটা কমানো উচিত। এটা টাকার ব্যাপার না, আমি সেটা বলছিও না। তোমার যেটা দরকার সেটা তুমি কিনবে এতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমারও খুব ভালো লাগে যখন এই জামাগুলোতে তোমাকে সুন্দর দেখায়। কিন্তু তোমার কি সত্যিই এতো জামা দরকার?”
মাথা নিচু করে মেয়েটি কি যেনো ভাবলো তারপর বলে উঠলো “তুমি ঠিক বলেছো। আমার এতো জামার দরকার নাই অবশ্যই, কিন্তু নতুন জামা দেখলে আর আমি নিজেকে সামলাইতে পারি না, ভেতর থেকে কে যেনো বলে এটা কেনার জন্য। এভাবে কিনতে থাকলে পুরো বাড়িই ভর্তি হয়ে যাবে আমার কাপড় দিয়ে। এই বলে সে কেনাকাটা কমাবার প্রতিজ্ঞা নিলো।
এরপর সে এক সপ্তাহ বাসা থেকে বের হইলো না। ঠিক বের হইলো না বললে ভুল হবে, সে একরকম নিজেকে বন্দি করে রাখলো দোকান থেকে নিজেকে দূরে রাখার জন্য। এই সময়টা মোটেও তার জন্য সুখের মনে হয় নাই। তার মনে হচ্ছিলো যেনো পৃথিবীতে বাতাস কমে আসছে আর সে কোনো পাতলা কাচের উপরে হেটে যাচ্ছে। সারাদিন সে ওই জামার ঘরেই পড়ে থাকলো। একটি করে জামা নিচে নামাইতো, কিছুক্ষণ দেখতো, সুতায় হাত বুলায়ে জামার গন্ধ নিতো, আয়নাতে নিজেকে দেখতো দুই একবার, তারপর আবার তুলে রাখতো। কিন্তু যতই সে দেখতে থাকলো ততই তার নতুন কিছু কেনার ভূত চেপে বসলো। এই ইচ্ছা তাকে না বসতে না ঘুমাইতে দিচ্ছে, সে পাগলের মত হয়ে উঠতেছিলো এক সপ্তাহে।
তবে যত যাই হোক টনিকে সে ভালোবাসতো, তার জন্য সম্মানও ছিলো অগাধ। সে জানতো টনি ঠিক কথাই বলেছে, এজন্য সে প্রিয় এক বুটিকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো যে দশদিন আগে যে জামাগুলো নিয়েছে তা ফেরত দেয়া যাবে কি না। বুটিকের সেরা খরিদদারের এ কথাতে মালিক রাজি হয়ে গেলো খুব সহজেই। কোট আর ড্রেসটাকে গাড়িতে নিয়ে নীল রঙা রেনোল্ট করে বেরিয়ে পড়লো বুটিক শোরুমের দিকে। ফেরত দিয়ে প্রায় দৌড়ে গাড়িতে ফিরলো সে। কোনদিকে মনোযোগ না দিয়ে গাড়ি চালাতে থাকলো। নিজেকে বুঝাইতে থাকলো যে তার আসলে নতুন জামার কোনো প্রয়োজন নাই। সারাজীবনের জন্য যথেষ্ট আছে। কিন্তু সিগন্যালে থেমে থেকে সে অন্য কিছু ভাবতে পারছিলো না। জামাগুলোর প্রতিটি সুতা, রঙ তার মনে পড়তে থাকলো। যেনো চোখের সামনেই আছে সব। চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টাও করলো। চোখ খুলতেই দেখলো গ্রীন লাইট।
একটা কার্গো ট্রাক হলুদ লাইট থাকতেই রাস্তা পাল্টাইতে গিয়ে সোজা ধাক্কা দিলো ওই নীল রেনোল্টে। কোনো অনুভূতি হবার অবকাশ ছিলো না। কোন ফ্ল্যাশব্যাকও ভেসে উঠতে পারেনি মেয়েটির মনে।
টনি টাকিয়ানি পড়ে রইলো ঘর ভর্তি সাইজ-২ জামা আর ১১২ জোড়া জুতা নিয়ে। তার কোনো ধারণা ছিলো না এগুলো দিয়ে কি করা সম্ভব। একজন ডিলারকে ডেকে টুপি ও অন্যান্য জিনিসপত্র প্রথম দামেই বেচে দিলো। আন্ডারওয়্যারগুলো সে বাগানের আগুনে পুড়িয়ে ফেললো। কিন্তু জামা আর জুতার পরিমাণ এতো অস্বাভাবিক বেশি ছিলো, তাই সেগুলোকে ও অবস্থায় রেখে দরজা আটকে দিলো। শেষকৃত্য শেষে টনি ওই ঘরে গিয়ে বসে থাকলো আর ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত জামাগুলো দেখতে থাকলো।
দিন দশেক পরে, টনি টাকিয়ানি পত্রিকায় মহিলা সহকারীর জন্য একটা বিজ্ঞাপন দিলো, সাইজ-২ জামা, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির মত উচ্চতা, জুতার সাইজ ৬, ভালো বেতন আর চাকরির আদর্শ পরিবেশ। বেতনটা এই চাকরির জন্য বেশি থাকায় ১৩ জন মেয়ে হাজির হলো ইন্টারভিউর জন্য। পাঁচজন ছিলো যারা অবশ্যই ড্রেস সাইজ নিয়ে মিথ্যা বলছিলো, বাকী আটজনের মধ্যে সে এমন একজনকে বেছে নিলো, যে তার বউয়ের জামাগুলোতে ঠিকঠাক এঁটে যাবে। মেয়েটি ত্রিশের কাছাকাছি, সাধারণ চেহারারর একজন, তার জামা-জুতো পরিষ্কার হলেও ছিলো পুরনো।
টনি মেয়েটিকে বললো “কাজটি এমন কঠিন কিছু না, নয়টা-পাঁচটা অফিস, ফোন ধরতে হবে, আমার জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখতে হবে। তবে একটা শর্ত আছে, আমার স্ত্রী সদ্য মারা গেছেন আর তার অসংখ্য জামা আমার কাছে পড়ে আছে, যার সবই নতুন। তুমি তার রেখে যাওয়া জামাগুলো অফিসে ইউনির্ফমের মত পড়বা। এইটা একটা অদ্ভুত কথা মনে হইতে পারে তোমার কাছে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারো আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমার স্ত্রী যে আর নেই এই চিন্তার সাথে অভ্যস্ত হবার জন্য এ কাজ করা। তুমি আশেপাশে তার জামা পরে ঘুরে বেড়ালে আমি নিশ্চিত একদিন আমি বেপারটার সাথে মানিয়ে নিতে পারবো।”
মেয়েটি এই প্রস্তাবটি ভেবে দেখলো। হ্যাঁ, লোকটার কথামত এইটা একটা অদ্ভুত আবদার, এতোটাই অদ্ভুত যে পুরোটা তার মাথাতেই ডুকেনি। সে বুঝলো যে তার স্ত্রী মারা গেছে আর অনেক জামা কাপড় রেখেই মারা গেছে কিন্তু সেই জামায় কেনো অফিস করতে হবে এটা আর সে হিসাবের মধ্যে আনতে পারলো না। তার ধারণা করা উচিত ছিলো যে এর পেছনে অবশ্যই কোনো মতলব আছে। কিন্তু লোকটাকে দেখে তার এমন কিছু মনে হলো না। হয়তো বউ মারা যাওয়ায় মাথায় গন্ডগোল হয়েছে কিন্তু অন্যের ক্ষতি করা তার পক্ষে সম্ভব মনে হলো না মেয়েটির। তাছাড়াও অনেকদিন হলো সে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে আর এমন বেতনের চাকরি সে দ্বিতীয়টি পাবে বলেও মনে হলো না তার।
“আমার মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি ” মেয়েটি বললো। “আর যা বলেছেন তা করতেও পারবো। তবে আমার মনে হয় ড্রেসগুলো একবার দেখে নেয়া উচিত।” অবশ্যই, বলে টনি টাকিয়ানি তাকে বাসায় নিয়ে এলো। মেয়েটি আগে কখনো এত ড্রেস একসাথে দেখেনি আর প্রত্যেকটিই ভীষণ সুন্দর আর দামি। তার মনে হইলো হার্টবিট ফাস্ট হয়ে গেছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে, যেনো একটা সেক্সুয়াল উত্তেজনা।
টনি মেয়েটিকে একা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। মেয়েটি কয়েকটি জামা পরে দেখলো আর কয়েকটি জুতা। সবকিছু যেন তার জন্যই বানানো হয়েছে বলে মনে হলো তার। ঘরটাকে তার কোনো যাদুকর বুড়ির চকলেট দিয়ে তৈরি ঘরের মত মনে হতে লাগলো, সবকিছু এতোই পারফেক্ট। একটার পর একটা পরতে থাকলো, কাপড়গুলোর উপর হাত বুলাতে বুলাতে কান্না চলে আসলো। এক জায়গায় স্থির হয়ে কাঁদতে থাকলো সে, কোনভাবেই কান্না থামাতে পারছিলো না।
কেনো কাঁদছো তুমি? টনি এসে জিজ্ঞেস করলে মেয়েটি বললো “আমি জানি না, হয়ত এত সুন্দর জামা একসাথে আমি আগে দেখিনি তাই। আমি দুঃখিত” বলে সে চোখ মুছতে লাগলো।
“তোমার যদি সব ঠিকঠাক মনে হয়, আমি চাই কালকে থেকে তুমি অফিস শুরু করো আর এক সপ্তাহের জন্য প্রয়োজনীয় ড্রেস, জুতা তুমি বাড়ি নিয়ে যাও ” টনি স্বাভাবিক স্বরে বললো।
মেয়েটি অনেক সময় নিয়ে ৬টি ড্রেস আর ম্যাচিং করে ৬টি জুতা একটা স্যুটকেসে ভরে নিলো।
“একটা কোটও নিয়ে নাও ” টনি বললো।
মেয়েটি গরম দেখে একটি ক্যাশমেরি কোট পছন্দ করে নিলো। পালকের মত হালকা কোট সে আগে কখনো দেখেনি বলেই তার ধারণা।
মেয়েটি চলে যাবার পর টনি ঘরে ফিরে এলো। শূন্যভাবে তাকিয়ে রইলো জামাগুলোর দিকে। কোনভাবেই আঁচ করতে পারলো না মেয়েটি কাঁদলো কেনো। টনির কাছে জামাগুলো তার সদ্য প্রয়াত স্ত্রীর ফেলে যাওয়া ছায়া। সাইজ ২ এর ছায়া দিয়ে ভর্তি একটা ঘর। এইজামাগুলো তার স্ত্রীর শরীরে লেপ্টে থাকতো আর গায়ে জড়ালেই শুধুমাত্র তারা জীবিত হয়ে উঠতো। কিন্তু এখন আর তাদের সেই ক্ষমতা নেই, যেনো একটা গাছের শিকড় কেটে ফেলে রেখেছে কেউ। জামাগুলোর রঙে হালকা রোদ পড়লেই রঙের খেলা শুরু হয় পুরো ঘরে। টনির নাক-মুখ জ্বলে ওঠে এত রঙে। বোতাম, ফিতে, সুতোগুলো ঘর থেকে সব বাতাস নিজেদের করে নিচ্ছিলো লোভী জন্তুর মত যতক্ষণ না টনি আর শ্বাস নিতে পারে। জামাগুলো থেকে রেশম পোকার মিহি গন্ধ যেনো মনে হচ্ছিলো ঘরে মৌ মৌ করছে। জামাগুলোর প্রতি ঘৃণা জন্মে যায় টনির। হাত দিয়ে দেয়ালে থাপড়াতে থাপড়াতে বসে পড়লো। চোখ বন্ধ করতেই টনি বুঝতে পারলো একাকীত্ব গলা বেয়ে ডুকে গেলো অন্তরের শূন্যতায়। সব শেষ, সে বলে উঠলো, আমি যা-ই করি, সব শেষ।
নতুন চাকরি দেয়া মেয়েটিকে ফোন করে বললো চাকরিটার আর দরকার নাই। সে প্রয়োজন ফুরায়ে গেছে। সাথে ক্ষমাও চেয়ে নিলো ।
“তা কি করে হয়? “মেয়েটির আশ্চর্যের সীমা পার করে গেলো।
“আমি দুঃখিত, পরিস্থিতি আর আগের মত নাই। তুমি যে জামা জুতা আর স্যুটকেস নিয়ে গেছো তা তুমি রেখে দিয়ো আর যা হয়েছে ভুলে যেয়ো প্লিজ ।”
মেয়েটি অবাক হয়ে কথাগুলো শুনলো কিন্তু কোনো অর্থ বের করতে পারলো না। যতই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলো, ততই মনে হলো বৃথা চেষ্টা, শেষে “তাই বুঝি ” বলে সে ফোন কেটে দিলো।
কয়েক মিনিটের জন্য ভীষণ রাগ হলো মেয়েটির। কিন্তু পরে ভাবলো যা হয়েছে তা ভালোর জন্যই হয়েছে, শুরু থেকে এমনিতেও খটকা লাগছিলো। চাকরিটা হারিয়ে কষ্ট পেলেও কোনো না কোনভাবে ঠিক চলে যাবে তার।
নিয়ে আসা ড্রেসগুলা খুলে, সাট করে আলমারিতে তুলে রাখলো, আর জুতোগুলোকে রাখলো দরজার পাশের বক্সে।তার নিজের জামার সাথে তুলনা করতে গিয়ে মনে হলো এগুলা অন্য বস্তু। ব্লাউজ, স্কার্ট খুলে ফেলে ঘরে পরার জামা পরে নিলো মেয়েটি। কিন্তু তার মাথার ভেতর সেই জামাভর্তি ঘরটির কথা মনে হতে থাকলো। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো এই এপার্টমেন্টের চেয়েও বোধহয় ওই ঘরটা বড়ো। কত টাকা লাগার কথা এত জামা কিনতে? কত সময়? আর এত জামা যে কিনেছে সেই মেয়েটি আজ মৃত! কেমন লাগার কথা এতোগুলো জামা ফেলে রেখে মারা যেতে?
মেয়েটির বন্ধুরা তার অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলো। প্রত্যেকবার দেখা হলে আলাদা জামা আর প্রত্যেকটিই দামি আর মার্জিত। এ দেখে তারা প্রশ্ন না করে থেকে পারলো না। “কোথায় পাইলা তুমি এতো দামি জামা? “
“আমি কথা দিছি বলবো না, আর বললেও তোমরা বিশ্বাস করবা না” হাসতে হাসতে বললো মেয়েটি।
টনি টাকিয়ানি আবার একজন ডিলারকে ডেকে সব জামা-জুতো বিক্রি করে দেয়। যা দাম হবার কথা তার পাঁচ ভাগের এক ভাগও পায়নি সে। কিন্তু টাকা তার কাছে বড় ব্য পার ছিলো না, জামাগুলো থেকে বিদায় পাওয়াই ছিলো তার উদ্দেশ্য। যদি বিনামূল্যে দেয়া লাগতো, তাতেও রাজি ছিলো সে, যতক্ষণ সে নিশ্চয়তা পাচ্ছে যে জামাগুলোকে আর দেখা লাগবে না।
কিছুদিন পর পর টনি সেই ফাঁকা রুমে গিয়ে বসে থাকতো। কিছু করতো না। ফাঁকা দেয়াল, সিলিং, মৃত স্ত্রীর সাইজ ২ এর ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকতো। কয়েকমাস যেতেই সে আর তেমন কিছু মনে করতে পারতো না। সময়ের সাথে তার স্মৃতির উপর ধুলার পারদ পড়ে গেছে। বসন্তের বাতাসের মত তার স্মৃতিও প্রত্যেকবার নতুন নতুন সময়ের সাথে পরির্বতন হতে থাকলো। প্রত্যেক পরির্বতনের সাথে আরো দূরে সরে যেতে থাকলো সমস্ত স্মৃতি।
মাঝে মাঝে তার স্ত্রীর ছবি সে মনে করতে চেষ্টা করতো, কিন্তু পারতো না। যেটা মনে করতে পারতো সেইটা হলো একটা আজনবী মেয়ে তার স্ত্রীর জামাগুলো দেখে অঝোরে কাঁদছে। টনি সেই মেয়ের সাধারণ চেহারা, ধুলো পড়া জুতো, পুরানা জামা সব মনে করতে পারতো। বাকী সব স্মৃতি ক্রমশ ভুলে উঠলেও মেয়েটির চেহারা কিভাবে যেনো টনি এখনো ভুলে উঠতে পারেনি।
২ বছর পর, টনি টাকিয়ানির বাবা সোজাবুরো টাকিয়ানি ক্যান্সারে মারা যায়। তেমন ভোগান্তি হয়নি তার আর হাসপাতালের সময়টাও ছিলো অল্প। মারা যাবার সময় মনে হচ্ছিলো যেনো সে ঘুমাতে যাচ্ছে। তবে শেষ পর্যন্তই সে জীবনকে উপভোগ করেছে। অল্প কিছু টাকা আর স্টক সার্টিফিকেট বাদে সম্পত্তি বলা যাবে এমন কিছু তিনি রেখে যাননি। তবে তার বাদ্যযন্ত্র আর প্রচুর জ্যাজ মিউজিকের রের্কড রেখে যান। কুরিয়ারে এসব এলে, টনি এগুলোকে ফাঁকা ঘরটাতেই রেখে দেয়। রের্কডগুলো পুরনো হওয়ায় কেমন গন্ধ হয়ে যায় তাই টনি মাঝে মাঝে গিয়ে জানালা খুলে দিতো কিছুক্ষণ। এছাড়া সে ওই রুমে যেতো না কখনো।
আরো এক বছর কেটে যায়, পাশের রুমে রাখা রের্কডগুলো তাকে কুড়ে খেতে শুরু করে। মাঝে মাঝে ঐ রের্কডগুলোর শুধু অস্তিত্বও টনিকে দমবন্ধ করে তুলতো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুমাতে পারতো না সে। স্মৃতিগুলো অনেক দূরে চলে গেলেও, আছে! আর আছে সম্পূর্ণ শক্তি নিয়েই। টনি আবার রের্কড ডিলারকে ফোন দিলো। রের্কডগুলো দুঃষ্প্রাপ্য হওয়ায় সে বেশ মোটা অংকের টাকা পেলো, যা দিয়ে একটি ছোটখাটো গাড়ি কেনা সম্ভব। কিন্তু টাকা আয় টনির উদ্দেশ্য ছিলো না, সেটা তার ভালোই আছে।
যখন রের্কড কোম্পানি এসে সবগুলো রের্কড নিয়ে গেলো, টনি টাকিয়ানি তখন সম্পূর্ণ একা হয়ে উঠলো।
তন্ময় হাসান
কবি, অনুবাদক