সিকদার আমিনুল হক-এর নির্বাচিত ২৫ কবিতা | ভূমিকাঃ সালমান তারিক

গত রাতে যখন বাবার কবিতা নির্বাচন করতে বসেছি তখন থেকেই বাবার স্মৃতিগুলো জড়ো হচ্ছে। বাবাকে আবছা দেখতে পাচ্ছি। বহু বছর আগে ঢাকার নিউ এলিফ্যান্ট রোডে চার তলার দক্ষিণের এক ঘরে বাবা লিখতে বসেছেন। যখন লেখা আসছে না, পায়চারি করছেন। হঠাৎ করে ঐশ্বরিক পংক্তি যখন তাকে ধরা দিল কি আনন্দই না তার। সিকদার আমিনুল হক, আমার বাবা কবিতার মধ্যেই ডুবে থাকতেন। কবিতা, হ্যাঁ, একমাত্র কবিতাই ছিল বাবার ধ্যানজ্ঞান।

বাবার মৃত্যুর পরে এক দীর্ঘ কবিতায় সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন ‘তোমার মত কেউ কবিতা লিখত না, লিখবে না’। এই একটি পংক্তি দিয়েই সনাক্ত করা যায় সিকদার আমিনুল হককে। শুরু থেকেই কবি হিসাবে তিনি স্বতন্ত্র, আলাদা। বাবার লক্ষ্য ছিল ‘মহৎ কবিতার সমগ্রতা’র শিখরে আরোহণ। তাঁর সময়ের কবিতাকেন্দ্রিক যে উচ্চ কোলাহল আর সংঘের রাজনীতি তা থেকে তিনি ছিলেন বহু দূরে। এজন্য কঠিন উপেক্ষা ও নিঃসঙ্গতার শরে বারবার তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন। কিন্তু কোন কিছুই তাকে টলাতে পারেনি। তিনি ছিলেন আপোষহীন ও অবিচল। একজন খাঁটি, প্রকৃত কবির প্রতিকৃতি আমার বাবা কবি সিকদার আমিনুল হক। তাঁর কবিতা পাঠকদের নিয়ে যায় অনির্বচনীয় এক জগতে, যেখানে তুষার ছড়িয়ে ফেরে শীতার্ত আপেল, যেখানে বন্ধুরা শুধু জানে শরীরের ভেতর কী রকম মুগ্ধ মৃত্যুভয়, তারা জানে ঘরের ভেতর জেব্রারা কেন হেঁটে যায়, যেখানে তুষার ছড়িয়ে ফেরে শীতার্ত আপেল, রুমালের সাথে বন্ধুত্ব হয় নিঃসঙ্গ বেড়ালের।

সিকদার আমিনুল হক সফল নির্জনের কবি। তিনি আমাদেরকে শিখিয়েছেন নির্জনতাকে, উপেক্ষাকে ভালবাসতে। অনেকেই বাবাকে কবিদের কবি বলে থাকেন। এটা অনস্বীকার্য তিনি কবিদের কবি; তবে তিনি কবিতা লিখেছেন পাঠকের জন্য যে পাঠক মূলত কবি। কবিতা নিয়ে বাবার পথচলা ছিল রীতিমত বিস্ময়কর ও স্বতন্ত্র। সময়-সাময়িক ও অনুজ কবিদের মতো তাঁর বাস্তব জগতের পরিধি খুব বিস্তৃত ছিল না। নিরিবিলি, উপেক্ষিত স্বেচ্ছা নির্বাসনের পথ তিনি কাটিয়ে গিয়েছেন।

কবিতা নির্বাচনকালে আমার পছন্দের তো বটেই, আমি চেয়েছি সে সব কবিতা নির্বাচন করতে যা ইতঃপূর্বে কোন পত্রিকায় বা অনলাইন ম্যাগাজিনে ছাপা হয়নি। শিরিষের ডালপালার দশকপূর্তি বিশেষ সংখ্যায় আমার নির্বাচিত বাবার কবিতাগুলো পাঠকদের আবারো তাকে নতুন করে আবিষ্কার করার সুযোগ করে দিল। আমার ভালবাসা ও কৃতজ্ঞতা শিরিষের ডালপালাকে।

— সালমান তারিক

 


আলাপ


প্রহসনের জ্বলন্ত অঙ্গারে যারা ঘ্রাণ নাওনি
তারা আমাকে জানো না— 

প্রতীক্ষায় ছিলো শিশু, জন্ম নেবে রোমশ ঋতু
তারা আমাকে দ্যাখোনি— 

হয়তো নীল সমুদ্র, কিন্তু গভীরে ওত পেতে আছে
বর্বরতা…

আমাদের রাত্রি, ভোরের মুখোশে মুসাফির
দাম্ভিক আর নির্লজ্জ;

এই গাছ কতদূর সবুজার্দ্র, নদী গাঢ়তর
হে জীবিত, তোমাদের বলবো না।

নত হও, দেখবে, নত হও, তুমিও দেখবে।


বিষ্ণু দে, এক লাল কমলের স্মৃতি


একদা তোমার সঙ্গে ছিলাম সন্ধ্যায় নিরিবিলি
গৃহস্থের ছোটো ঘরে, অথবা শিল্পিত সারা বিশ্বে
স্বপ্নাবেশে পাশাপাশি। প্রাচীণ গ্রামোফোনে
কখনো সাহানা দেবী আবার কখনো বিথোভেন
দিয়ে গেলো উপভোগ্য অবসর; কিংবা বাস্তবিক
রহস্যের বিপণ্ণতা, শব্দমালা বিস্ময় সত্তায়।
সেদিনই জেনেছি আমি মার্কসের ব্যক্তিত্ব প্রখরতা
আর মমত্বের অর্থ; তোমার চৈতন্যে যে-প্রতীক
আনে স্মিত উর্বরতা, প্রাণের গঙ্গায় লক্ষ প্রাণ—
কী তার বৈশিষ্ট্য আর বিচিত্র সত্তার ডালপালা
কতদূর প্রসারিত। তুমি নও শুধু উপাখ্যান
শিল্প আর বৈদগ্ধের তুমি ছন্দ খোদাই মূর্তিতে।
গোলাম মোহাম্মদ রোডে কষ্ট নেই কলকাতার গ্রীষ্মে!
খোলামেলা গালগল্পে নিজেকে ভীষণ দামী মনে
হতো রাজসিক স্পর্শে; দেখতাম সম্পর্দ ঐশ্বর্য
কত ঝুটা! কেননা এ-ঘর কলকাতার অবান্তর
অংশের সেকেলে প্রতিনিধি; কিন্তু যদি জনান্তিকে
দৃষ্টি দিই, তবে এই মনুষ্যত্ব রাষ্ট্রীয় প্রতীক।


মৃতের মুখের কাছে


মৃতের মুখের কাছে আমি বসলাম— একটি বিশাল মাঠের ওপর বাদামি ঘোড়ার নিঃসঙ্গতার গাম্ভীর্য সেই প্রথম আমি টের পাই।জানালায় পরিদের বসা যেন ঠিক ফুলের ওপর প্রজাপতি। কেবল তারা পরেছিলো আপাদমস্তক মসলিনের শাদা পোশাক। পবিত্র নয়, আবার নগ্নও ছিলো না। বোধ হয় মৃতের সামনে সুগোল স্তন আর খুলতে নেই! …

স্বজনই হবে আমার। অথবা একটি নাম— একজন মানুষের; যাকে এখন মনে হচ্ছে ঘরেরই অন্য একটি আসবাব। তাঁর পা মেঝে ছুঁয়ে খুঁটে যাচ্ছে পৃথিবীর বরাদ্দ অবশিষ্ট বাষ্প; কিন্তু মাথা বিশাল আকাশের দিকে উঠছে ক্রমাগত।

নক্ষত্রই তাঁকে পথ দেখায়, যাঁর ঘুমোবার প্রয়োজন— এবং বাতাসের পক্ষে যে অত্যন্ত হালকা; যেন একটি পাখির পালক।

ছোটো একটি মোমবাতি, অথচ কত বিশাল আমার রাত্রি। মধ্য-সমুদ্রের নৌকো; ফিরে আসা আর এগিয়ে যাওয়া যার সমান কথা!

দৈবই আমাকে বলেছিলো, —বসে থাকো! পতঙ্গ যেভাবে থাকে, তৃণের পাশে যে আরো মৃত! এবং যার কোনো শব্দ নেই! …

বসলাম, এবং দেখলাম সময়ের আরম্ভ। যে সময় মাতালকে দেয় হ্রস্ব যন্ত্রণা এবং পুরোহিতের জন্য ঝনঝন শব্দ! এগিয়ে চললো মুহূর্তগুলি— আসবাবের কোনো স্বপ্ন নেই; কিন্তু অন্ধকারের নিশ্চয়ই আছে। আমরা দুজনে চললাম সেই দিকে, যখন মাথা টলছিলো, তখনো।

(অংশবিশেষ)


বেঁচে থাকার জন্যে…


প্রথম বর্ষার বর্বর জলের তোড়, আর প্রথম সন্ধ্যায় এক অপেশাদার জেলের কালো নৌকার এক স্থির বিশ্রামের কথা কার না মনে আছে! এত বাতাস যে, ঠিক বাতি জ্বলে না; শুধু বাতির দিকে আদেশ জানিয়ে সে নীরবে সম্পাদন করে তার রন্ধনকর্ম। আহার বলতে বাঁশের পাতার মতো সরু আর ধারালো রুপালি কয়েকটি তাজা মাছ! আর স্বপ্ন বলতে তার জন্তুর মতো ঘুম।

সাঁকোর ঠান্ডা লোহার ওপর থুতনি রেখে কত যে নারীময় শব্দ— যা প্রকৃতই এক কিশোর কবির। পূর্ণিমার সপ্রতিভ চাঁদ স্রোতের ওপর ছড়িয়ে দিলো টাঁকশালের সব রুপালি মুদ্রা। স্রষ্টা হইনি, তবু ছন্দের অন্তর্বাস খোলার জন্যে আমার হাত কেঁপেছিলো বারংবার।

আর মনে পড়েছিলো এক আশ্চর্য লাবণ্যের কথা; কুমারী মেয়ে, ত্রুটিহীন প্রেমের প্রথম চিতা-উৎসব আর গোপনীয় প্রথম সৌভাগ্যের কথা। —আর বেঁচে থাকলে, যাযাবর যার হৃদয়, কার না এসব মনে পড়ে?

(অংশবিশেষ)


অনেক কথাই লিখিনি 


অনেক কথাই লিখিনি; কমলালেবু কিংবা রাত্রির অশান্ত হাওয়ার মতো জেব্রা অথবা পানশালার মধ্যরাত্রির হল্লার কথা।

পারদ ও জ্বরতপ্ত প্রেমিকার কপালে ভেজা ন্যাকড়ার কথাও মনে পড়েনি। এবং তুমি রাত্রির ট্রেনে কিংবা ব্যাংকের কাউন্টারে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলে— সেসব সুদ্ধ পতন আর গৌরবের ভয়ে ভুলে গ্যাছি। 

এবং ভুলে গ্যাছি এক রাত্রির নোঙর করা হোটেলের কামরায় ড্রেসিং টেবিলের দেরাজে অবহেলায় পড়ে থাকা কোনো মধ্যবয়সী রূপসীর চুলের কাঁটাটির কথা। আরো ভুলে গেছি অবাঞ্ছিত অতিথি হওয়ার পানপাত্রটিকে…যাকে পূর্ণ করার দিকে অভিজাত আর কোটিপতিদের কোনো নজর ছিলো না।

অনেক কথাই লিখিনি, সেসব হতো গল্পলেখকের নতজানু যৌনতা, কিংবা হোটেলের নিঃসঙ্গ পুরুষের সঙ্গী রগরগে কোনো সস্তা সঙ্গমের উপন্যাস। আত্মরতি আর নিদ্রার মাঝখানে যা সোচ্চার থাকে কয়েকটি ক্লান্ত মুহূর্ত। 

যদিও ভুলিনি তোমাকে, হে আমাদের মৃত্যু; তোমার রাজত্বের অবিবেচক প্রজা; প্রতি কোষ বিদীর্ণ করেছি, হৃৎপিণ্ড, যকৃত আর পাকস্থলী— হলুদ করেছি অনায়াসে শিরা-উপশিরা; উত্তেজিত করেছি স্নায়ু— ব্যবসার নগ্ন উচ্চাশায়।

কোথাও নিশ্চিতই মৃত্যু আছে; সেই ঠান্ডা, শিহরিত টেবিল কিংবা পাহাড়ি পথের মতো নির্জন ধবধবে শাদা বিছানা আমার জন্মের অনেক আগেই তৈরি।


আত্মজীবনীর এক পৃষ্ঠা


এখানে দাঁড়িয়ে আছি রাত বারোটায়। কিছু দূরে
শহরের শেষ অন্ধকার স্থির। আজ আস্তাবলে
ব্রাউন রঙের ঘোড়া সম্ভবত নেই। উট ছিলো
সিরিয়ার পথে পথে; উঁচু বুক নৈশ জানালায়।
বিপ্লব বিব্রত হলে কাফে কিংবা ঝকমকে চাঁদ
নিশ্চিত উগড়ে দেয় মৃত্যুভয় আর মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
তথাপি ভোরেই আসে শাদা রুটি। আজকাল আর
ডিম নয়। শুধু কফি। সাম্প্রতিক বৃষ্টির শহরে
ভোরের পত্রিকা আর বাল্যকাল; প্রৌঢ়ত্বের সাক্ষী
বহুক্ষণ থাকে প্রিয় প্রাতরাশে। পরে ধীরেসুস্থে
রকিং-চেয়ারে বসে গনগনে রোদ, কালো কাক
ভের্লেনের দিনপঞ্জি পড়ে পড়ে দুপুর গড়ায়।

তারপর প্রথামত সিঁয়েস্তায়। দূর থেকে তুমি
কার অন্বেষায় আছো? তুমি কি জানো না এই দেশে
আর নেই চাষবাস; সকলের ইচ্ছা স্বপ্নহীন—
কেবল ভাঁড়ের কিছু কাজ আছে। এক জোচ্চোরের
ধারালো ছুরির নিচে বিহ্বল সুখ্যাতি। বাজপাখি
চোখ শব্দ বন্দি করে। বাকি দিন আলস্যে নৃপতি।

ফলত মর্গের আগে বিশৃঙ্ক্ষলা এখন নিয়তি।
দুর্বিনীত রথী; তাই রাষ্ট্র নয়; মারণাস্ত্র আর 

বারুদের ব্যাপারীর পুঁজিবৃদ্ধি পররাষ্ট্রনীতি!
ওদিকে তেরেসা একা; বন্ধুত্বের নিরন্তর ঝুঁকি

কতটা বুঝবে তুমি দূর থেকে? এত দুর্যোগেও
কম কি আমার ভাগ্য? মেঘে-মেঘে পঞ্চাশ ছুঁয়েছি!


একটি ঝড়ের স্বপ্ন


একদিন জন্ম হবে, কিন্তু নিঃস্ব পাথরের মুখে সমুদ্রের স্বচ্ছ আবরণ। এই বালি অদৃষ্টকে আঁকড়ে থাকার উত্তুঙ্গ উপহার। এই পথে একদিন নতুন চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলাম। এই পথে তোমার মুখের মতো নারী অঘ্রাণের ঘ্রাণ নিয়েছিলাম। কত রাত্রি আর কত নিঃসঙ্গ তারার যন্ত্রনায় তীক্ষ্ণ আমাদের ভ্রমণের উন্মত্ততা। আর আজ, কত শান্ত ও শ্রদ্ধাবনত এই পৃথিবী।

নারীকে প্রয়োজনের মুহূর্তে একটি নকশা উপহার দিয়েছিলে। হয়ত নিষ্ফল হতে পারতো। কিন্তু একটি কবিতার জন্ম ভোরের বাতাসের চেয়ে অনেক বেশি ফেনিল ও সাহসী। আর ভোর, পুরুষের চিন্তার মতো বিশাল মুকুটের পৌরুষ। 

কেননা ঝড় তুঙ্গে উঠলো আর তুমি সমুদ্র থেকে ফিরে এলে। জলস্তম্ভের নিচে থামলো তোমার টগবগে ঘোড়া। কল্পনার বিশালতারও কী কোনো সৌন্দর্য নেই? আছে। পৃথিবী যেখানে রেশম আর প্রেমাস্পদের চোখের পাতার ওপরে মিতালি পাতায়, সেইখানে। নিস্তব্ধতার যে অপূর্ব গান আছে, সেইখানে। 


আজকাল


নিঃশব্দ আমাকে চায় আজকাল। ফলে রাত্রিবেলা
আমি দুরারোগ্য; আমি সমুদ্রের চেয়ে বিরাটত্বে
কেবল নির্মাণ খুঁজি; যেখানে আমিষ মাছগুলি
দূর নাবিকের মতো প্রহরায়। আর উটগুলি
প্রায়শ ফেলছে ঘাম মরূদ্যানে।… পরিশ্রমী ঘোড়া
মেক্সিকোর যত্নহীন দূর থেকে ধুলো হয়ে আসে;
যাদের রুমালগুলি গুলি ছোড়ে। আধখোলা বুক—
লেসে বাঁধা স্বপ্নপুরী। তাই হত্যা আর রমণের
সফল কাজের পরে মদ খায় তারা । হিংস্র ক্রোধ
চামড়ার থলি মুক্ত করে। অনিদ্র থাকতে হয়

যেহেতু আমাকে চায় এইসব নারকীয় দৃশ্য…
শিকারি কুকুর আর নেকড়ের ডাক? গুঁড়ি-ঘরে
শুভ্র বরফের পাশে দীর্ঘ বার্চগাছ।…ভাঙা স্লেজ
রুমাল করেছে ধন্য ফার-কোটে কবে এককালে;
অথবা জিব্রালটারে তন্বীর কোমরে হাত রেখে
আজ যারা কবরের অলস বাসিন্দা; সেই সব
শীতার্ত লোমশ হাত, নাবিকের প্রমত্ত চোখের
নিরানন্দ ভরাডুবি রোজ দেখি। শুধু পাতা নয়
ঝরার সমস্ত চিত্র, এমনকি বিড়ালের ঘুম,
রুমালের মৃতদেহ,…প্রতিটি অধ্যায় কাছে আসে।


বিড়াল ও মানুষের কবিতা


রাস্তার ওপরেই ওষুধের দোকান। লন্ঠনের নিচে
বসে থাকে একটা লোক। তার চুল শাদা। মুখ অন্ধকার।
আর বয়স বিমর্ষ হওয়ার দিকে। তার চোখ খুব ছোটো।
ঘুম না জাগরণ, কিছুই জানতে চায় না মধ্যরাত্রির ক্রেতা।

একটা বিড়াল ঘুরঘুর করে। দোকানের ভাঙা বোতল আর
মরচে পড়া পেরেকগুলি পর্যন্ত তার খুব চেনা। লোকটার
গন্ধ, ছেঁড়া জুতো, আর ছাতির কাপড়ের সবগুলি ছিদ্র তার
চেনা। খুব নিঃশব্দে সে ঘরটার উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিম
প্রদক্ষিণ করে।

লোকটা এত সরু যে, তার সহজে খিদে পায় না। অথচ
অলস আর ভারী। লোকটার কালো রঙ আর বিড়ালের
কালো রঙ প্রায় কাছাকাছি। যদিও দোকানে যারা আসে
তারা ঠিকই চিনতে পারে। একটা বিড়াল। অন্যজন মানুষ।

লোকটা আমিষ ছেড়েছে আট বছর আগে। শাকসবজি
আর ঠান্ডা ভাতে বিড়ালের আয়ু অল্প! তবু সে আছে।
এই ঘরে। সাত বছর আগে তার মা’র মৃত্যুর পর থেকেই।

লোকটা ঠান্ডা-মারা ধরনের লোক। তার ঘরে চিরুনি
পর্যন্ত নেই! লোকে কুকুর-বিড়ালের নাম রাখে! কেবল
এই বিড়ালটারই কোনো নাম নেই!


কবির কিছু ব্যক্তিগত বিশ্বাস


ক্রমশ আমাকে দ্যাখো : সম্রাটের মতো বসে আছি
আমি আজ সব দিকে, সব তর্কে আমি প্রাসঙ্গিক;
এমনকি মহিলারা গল্প করে সমিতির ঘরে—
আমার কবিতা নাকি দূরে নয়, খুবই শারীরিক।
তাই পতাকার নিম্নে রাখা হবে, রাষ্ট্রীয় বাড়িতে…
এবার শীতের শেষে আমি হবো সম্মানিত কবি।
যারা মদ খাও, তারা ছেড়ে আসো, এই দুর্বলতা!
কবিতা কি মদ্য নয়? বিস্মরণে পৌঁছে দেয় অগণন সাকি।

উপেক্ষা দিয়েছে স্বাস্থ্য— যত লিখি তত ক্রমাগত
উঠে যাই অমরত্বে।  —মনে পড়ে, সেই অন্ধকার
যখন অচেনা হেঁটে হতাশায় বাড়ি ফিরতাম…
দেখতাম কত সুখী, মোটা হচ্ছে তাদের গৃহিণী।
এখন আমারই স্বপ্নে বাতাসের ফ্রক উড়ে আসে;
তাতে থাকে কর্পূরের গন্ধ— বালিকার অন্ধকার।


রাত্রি আর তার গল্প


এক একদিন উপভোগ করি এই রাত! … পাতা ঝরে। উটগুলি আসে লক্ষ মাইল দূর থেকে। তাদের চোখ থেকে ঘাম ঝরে! চামড়ার কালো ধুয়ে যায় জ্যোৎস্নায়। বাতাস থাকে; কল্পনায়, গন্ধে আর বিশ্রামের মতো ঠান্ডা বিস্ময়ের ভয়ে। রান্নাঘরে পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ বাবুর্চির আত্মবিশ্বাসের মতো শুষ্ক!…

এই রাত নাটকীয়। সন্তুর-বাজিয়ে তার প্রেমিকাকে বলে, —’অবিচল থেকো!’ যে কোনো বেলেল্লাপনাই আমি বুঝতে পারি। কটাক্ষ আর শরীরের পরিমাপ দিয়ে। নরকের নিচে সুখ নেই। পাপ হচ্ছে বৃদ্ধ বয়সের শত্রু!’… নর্তকী তার বাদক-প্রেমিককে জিভ দিয়ে আলগা ধাক্কা দিয়ে বললো, ‘রাক্ষসের এত হিংসে!…ঠিক আছে বাবা! আমি থাকবো পোর্সেলিন থালার মতো পরিষ্কার।’

আশ্বাসবাণীর এই ঘাগরা ভিড়ে মিশে যাওয়ার আগে একজনের বন্য হাত, পরে কটুগন্ধ একে বৃদ্ধের গরম নিশ্বাস ও আরো পরে বেঁটেমতো এক বদমাশ মশলা-ব্যবসায়ীর নখের আঁচড় খেতে খেতে ক্রমশ অন্ধকার হয়ে গেলো তার তকতকে পরিচ্ছন্নতা। রুগ্ণ এই রক্ত চাটাচাটির মধ্যে সে ভাবে, —’হায় আল্লাহ! এত কিছুর মৃত্যু হয়! কিন্তু রাত্রে থাকে সুস্থ! আর কার

বিলাসিতা মানে জিল্লাতির বিলাসিতা!…’


এই অন্ধকার


কাটে না আমার চেনা অন্ধকার। রাষ্ট্র মাঝে মাঝে
তার চাল বদলায়, সেই সঙ্গে দেখি মানুষের
উত্থান-পতন আর রাতারাতি নিজস্ব ঠিকানা
বদলের কত ভোজবাজি! যারা সুদূর দক্ষিণে
ছিলো, চলে যায় উত্তরের ঠাট-ঠমকের দিকে।
ছোটো ঝাড়বাতি, রাতারাতি বড়ো হয়। কার্পেটের
কত যে বিচিত্র রঙ ঘরে ঘরে, আর আসবাব
এত ঝকঝকে, যেন পূর্ণিমার চাঁদ। সুপ্রশস্ত
বাগানে দৌড়োয় রোজ অনুগত শাদা খরগোশ।
লম্বা বারান্দায়, পোর্চে, দোল খায় অর্কিডের ঝাড়।

তাদের রয়েছে বহু বৈধ বা অবৈধ একঝাঁক
মদিরার মতো উগ্র দারুণ রূপসী। খায়দায়
গর্বিত-কুচিন্তা করে মালিকের চারপাশে। দেখি,
মোট কথা বদলায় দিন আর ভাগ্যরেখা দ্রুত।
এদিকে আমার ঘরে, কিছু প্রেত নাচানাচি করে
সারা রাত। অচেনা ভাষায় তারা হাসে, গান গায়;
থালার ওপরে থাকে বাসি-রুটি, মরা তেলাপোকা,
চুরুটের ছাই আর চামড়া-ওঠা হরিণের লাফ;
হাড্ডিসার গাছগুলি নাক ঘষে; আমার দেয়াল
এক্ষুনি পড়বে ভেঙে, ব’লে, হাসে বেড়ালের লাশ।
সুঠাম মৎস-নারী নাকি কঙ্কালের মতো মৃদু ফরসা?
— পাই না সঠিক চিত্র। কাঠের জাহাজ থেকে নামে?
নাকি ক্র্যাচ-ভর করে আসে? অর্জুনের গাছ থেকে
বাসা ছেড়ে অনর্থক; উড়ে যায় ভবনের ছাদে।
ভোর হয়। যুক্ত হয় যুক্তি। কল্পনার অবসান।
আগত রাত্রির ভয়ে, সারা দিন একা শুয়ে থাকি!


রাত্রির বিড়াল


রাত্রির বিড়াল কাঁদে, ইদানীং জনশ্রুতি তাই!
কারা যেন কেঁড়ে নেয় মুখ থেকে এক থালা ভাত;
কিছুটা মাছের ঝোল, মাছ নয়, এই তো সংবাদ!
তাতেই জটলা হয়; পরে ক্রন্দনের সমর্থনে।

নক্ষত্রের বৃষ্টি হয়, ট্রেন থামে চমক জাগিয়ে—
ভুতুড়ে জ্যোৎস্না নিয়ে আসে একদল দক্ষ মিস্ত্রি;
সারা রাত কাজ চলে, সারা রাত পিতলের কীর্তি;
মাঝে থাকে লৌহ, টিন, ইস্পাতের সঙ্গে শক্ত কাঠ।

বিশ্বের বিড়াল সব ছায়াবৃত, ফলত সফল।
ভুলক্রমে একদিন কাঁদা যায়, কিন্তু প্রতিদিন
এই স্বেচ্ছাচার কেন ক্রমাগত ডিঙোবে চৌকাঠ
রাত্রির প্রথম লগ্নে, পরি অবিরত ঘটা করে?


আব্দুল মান্নান সৈয়দ


র‌্যাঁবো সবান্ধব। তবে মান্নান সৈয়দ একা একা
হাঁটতেন অপরাহ্ণে কিংবা রাত্রিবেলা। সারা দিন
পরে, চেনা গ্রিন রোড আর নেই। ব্যস্ত বুলভারে
হাঁটছেন ভিন্ন কবি। অবচেতনার হিমঘর
থেকে আসে তাঁর জ্যোৎস্না কিংবা শাদা করোটির হাসি;
স্তব্ধ সমুদ্রের ঘোড়া, নীল উট, বিসর্পিল নারী!
স্বাভাবিক স্বস্তি নয়, চিত্রকল্প এক পৃষ্ঠা হ্রদে
কী করে বিমর্ষ হবে এই চিন্তা ক্ষয় করে তাঁকে।

সাটিনের জামা গায়ে হেমন্তের রাত্রি নেমে আসে।
স্লেজগাড়িগুলি ভদ্র, অন্ত্যমিল রেখে যায় বাক্সে।
বরফ পড়ছে বলে নেকড়ের দল উদ্ভ্রান্ত
দৌড়ে গেলো পান্থপথে। সাঁজেলিঝে থেকে রেসকোর্স
বিভাজন করা শক্ত। রাজহাঁস কেন নয় হাঁস?
স্বীকার করে না কেউ এই অন্ধকার। হৃদরোগে
গভীর অরণ্যে তার শান্তি ছিলো। আর জেনেছিলো
হরিণের চেয়ে বেশি তার রৌদ্র, মৃত্যুভয় কম।


কবি

(আবুল হাসানকে)


কবিদের মতো ভালো, সুষ্ঠু আর কিছু আছে নাকি?
অন্যদের দ্যাখো কাছে গিয়ে, মিশে, পুঁথি পড়ে দ্যাখো
তোমার নিকটে যারা, মুৎসুদ্দিকে অথবা নফর
গিয়ে দ্যাখো কত হিংস্র, হাত থেকে রক্ত ঝরে পড়ে
গোপন ঝরনার পাশে, আড়তে-শহরে দূর গ্রামে।
খায় রূপসীর গুচ্ছ, যন্ত্রণায় প্রাণপনে ফিরি করে
অথবা খবর খুঁড়ে বাড়ি ফিরে মাংস-ভাত খায়;
কেউ কেউ পীড়নের জন্যে যায় জঙ্গলে কদিন।
ওদের হাতের চাপে দূর্বাঘাস কবে মরে গ্যাছে
এই নম্র পৃথিবীর! অথচ কবির কত কষ্ট
একপাশে শুয়ে থাকে অন্ধকারে, বিড়ালের পাশে—
আঘাতে কাঁদে না একা মানুষের সঙ্গে মিশে কাঁদে।


কবিতা যখন ওড়ে


মৃত পায়রার মতো পড়ে আছে একশ কবিতা
আমার পায়ের কাছে, বন বিভাগের বারান্দায়—
এক রাত্রি নাকি লক্ষ বছরের কৃষ্ণ হতাশায়
গ্যাটে—কালিদাস—দান্তে দিয়ে গ্যালো আজকের চিতা।

মৈথুনের চেয়ে ক্লান্তি, তবু নেই হতাশার চিহ্ন;
একটি রাত্রির মধ্যে উষ্ণতার লক্ষ আয়োজন;
থাই সিল্ক, মসলিন; অক্ষরবৃত্তে সব যেন ভিন্ন;
কখন ঘুমিয়ে গ্যাছে কালো কফি, আহারের
                                                  শুদ্ধ প্রয়োজন।

আতর যেভাবে ওড়ে জলসায়, উড়েছিলো কবিতা বিদ্যুৎ!
এত কি উচিৎ হচ্ছে? এ তো চুম্বনের চেয়েও অন্যায়।
পাতা ঝরে পাটাতনে— আমার এ-ঘরে কবিতার দূত;
আমি ঘেমে উঠি পৌষে, নর্তকীর কটাক্ষ বন্যায়।

পৃথিবী কবিতা চায়। নক্ষত্রের চেয়ে বেশি কবি
দিয়েছে সুঠাম আর সুদেহীর পায়ে এই হীরে;
রুটি-মাংস খেয়ে সঙ্গী সব গেলো নিদ্রা নীলিমায় :
আমি লণ্ঠনের নিচে হয়েছি গর্ভিণী ধীরে ধীরে।

একটি কবিতা হাঁস, শালিকের ডিম, হয়তো সবই—
সবুজ চুলের নারী, তৃণগন্ধ— সম্রাজ্ঞীর গ্রীবা
আমার ভেতরে ছিলো ইতস্তত, মরে যাক অগণন কবি;
আমি পেলে সকলের জয়; একা নয় বিশিষ্ট প্রতিভা।


শেলী, তুমি দেখোনি আমার দেশ


এ বড়ো আশ্চর্য দেশ, অবাক হইনে আজ তাই
কিছুতেই। সেলুকাস কাছে নেই, প্রশ্নও পুরোনো,
এ কেমন অন্ধকার দেশ, আর কেমন স্তম্ভিত—
অসহ্য যন্ত্রণা পায় প্রশ্নকর্তা আর প্রশ্ন নিজেই।

এখানে বধির মাত্র ফৈয়াজের একনিষ্ঠ শ্রোতা,
এখানে অন্ধেরা নাকি দূরদ্রষ্টা গলিত সমাজে;
যাদের মাস্তুল দীর্ঘ, তাদের ইঙ্গিতে নীলাকাশে
ঝিমোয় বিমর্ষ রৌদ্র, ঝড় ওঠে সুনীল দুপুরে।

টিভিতে তাঁরাই বক্তা, রেডিওর নব ঘোরালেই
দেখা যায় তাঁরা স্থায়ী, আমাদের ক্ষণস্থায়ী সব
তাঁরা আছে তাই দেশ, তাঁরা রুদ্ধ, সমস্ত শ্মশান—
তারা আজ দেবতুল্য, তুমি শুধু জনসাধারণ।

অবাক হইনে তাই, যদি দেখি প্রকাশ্য নিলামে
গরিষ্ঠরা হেরে যায়; যদি দেখি ইঁদারার ব্যাঙ
মুহূর্তে পেরিয়ে যায় স্তব্ধ জল, সমুদ্রে লাফায়—
পলাতক ফিরে এসে প্রায়শই উঁচু করে মাথা,
যেহেতু সত্বর ঘটে এই দেশে মুখোশের রঙ।

সবাই মঙ্গল চায়, এমনকি সেও আজ চায়!
ব্রাত্য আজ কেউ নয়, একাকার কাদা ও ঝরনায়;
যে-হতো কেরানি কিংবা আপিসের কনিষ্ঠ সাহেব
তাঁর ডাকে আজকাল সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সম্ভব!

কে বলে অযত্নে ফুল, আর কত প্রতিভার মৃত্যু
ঘটে গেছে বারবার! শেলী, তুমি নিতান্ত সাবেকি
দেখোনি আমার দেশ, মনীষা— আলোক যার আছে
তাঁর ঘরে কুঁপি জ্বলে, অতিমূর্খ এখানে সবাক।


বন্য আগুনের সামনে


রেশমের মতো পাতলা শীত। তবু সব রাত্রি এরকম ভাষায় কথা বলে না।  যৌবনের পাপ ছিলো অহংকারের মতো লাল; এবং তাতে ছিলো অন্ধকারের গন্ধ। আজকের ক্ষুদ্র পাপগুলি যেন কবরের ঘাস, ডিসেম্বরের অল্প বাতাসেই কেঁপে ওঠে!…

এই বর্ষায় তুমি মেঘ। কার্পেটের ওপর জমে আছো। বাগানের সবুজ ধার্মিক অপেক্ষার মতো এই পবিত্রতা। বহু গোলাপের লাল তোমার অশুভ চোখ। ক্ষুধার্ত।

ভালো স্বভাবের স্ত্রীলোকেরা কখনো হাসে না। তারা জমাট বরফের মতো শ্রমহীন। ফকফকে দাঁত ও ক্রোধের অতর্কিত সৌন্দর্য।

কতকিছু বললাম তোমাদের। সবকিছুর অর্থ নেই। অথচ বাস্তব। বিমূর্ত কিছুরই কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি অন্ধকারও অতিবাস্তব। লিখতে পারি এ জন্যে যে, রাত্রি আমাদের ডাকে।…

যা কিছু আকারের জন্যে উন্মুখ আর দীর্ঘ বিস্তারের জন্যে শায়িত; সব আমাকে আলোড়িত আর উদগ্র কামনায় জর্জরিত করে শীত-সন্ধ্যায়।… কোনো সেরিনাদ ছিলো না কমলা-রং জানালার নিচে। 

তুমি গলে গেলে তথাপি অতি-হাওয়ার রাতের অর্ধেক উদ্ভ্রান্ত মোমের মতো। দ্রুত। ঘণ্টারও অনেক আগে।


সেলুনে একটি লোক


একটি সেলুনে দেখি একজন লোক প্রতিদিন
অপ্রস্তুত বসে থাকে বহুক্ষণ। দৃষ্টি আয়নায়।
এরকম দেখা যায় ধু-ধু লোক সস্তার সেলুনে।
মুখের সাবান তার উড়ে গেছে ক্ষুরের আঘাতে
অতএব ভাঙা মুখ এখন প্রকট! আয়নায়
কী যে দ্যাখে! মুখ নয় সম্রাটের মতো; আর ভাঁড়ও
ফুলো-গাল হয় জানি সার্কাসের! তবে কি অতীত
ভাবনা বিন্যাস করে নিজ হাতে? একটি কিশোরী
অবেলা পুকুরপাড়ে দয়া করে প্রথম কৈশোরে
নিয়েছিলো এই মুখ নিজ হাতে। চাপাচাপি করে

একটি চুম্বন পেয়ে সাত দিন উড়েছে আকাশে।
অনেক কথাই তার মনে পড়ে। চৌকো আয়নায়
দেখে তার শাদা চুল, চিমসে মুখটা অবিকল
বাড়ির দালাল কিংবা ধূর্ত চোরাচালানির মতো!
কিন্তু কেন ভুলে যায়, প্রিয় সেই বাইজির কথা!
আতর উড়তো যার দেহ থেকে; তার কাছে গেলে
সহস্র চুমোয় ভরে যেতো এই মুখ। আর আজ
সব অনটন যেন এই মুখে, তাই কি বিব্রত?


শৈশবের জ্বর


লাল বনমোরগের সামনে হলুদ ছত্রাক। আমি একটু একটু হাঁটতাম, আমার নার্স অন্ধকার থেকে ক্রমেই আলোতে ফিরে আসতো। আসতো মানে, খুশি হতো! তার পর থেকে শাদা খরগোশ থাকে ঠিক পাশাপাশি। আর গ্রীষ্মকালে লম্বা দুপুরের রোদ। কচি ঘাসগুলি আর নেই। বড়ো বড়ো পাতাদের মানসিক ভাষা আমি বুঝি না!

আমার খুব কষ্ট হয়। লাল টালির ছাদে কাক বসে আছে। তার সর্দি-কাশি নেই। রোজ আসে। অ্যান্টেনার ওপর বসে কিছুক্ষণ উন্মোচিত হয়; কিছুক্ষণ পড়ে থাকে চলচ্ছক্তিহীন ঘুমে।…এসব দেখলে মনে হয় আমার জ্বরটা থাকবে না। কিন্তু যেই রাত্রি হয়, দেখি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে আমার সব প্রিয় গন্ধ। বিছানা, বালিশ, বই; আর বাঁচবার সব চেষ্টা!


একদল জিরাফের সঙ্গে


তোমার বন্ধুরা?
ঐ শব্দের অর্থ আমি কখনো জানিনি।

-শার্ল বোদলেয়ার : অচেনা মানুষ

শুরুতে ছিলাম অন্ধ। সকলকেই মনে হতো এক।
পথ ছিলো আগুনের, পরে এলো বরফের দিন;
ভাবিনি রাত্রির কষ্ট, আর পান্থশালা অপরিসর;
দূরত্বের ক্ষত শেষ, সেই-ই সান্ত্বনার জয়।

পরে, অবশেষে দেখি আমাদের দিনের অর্জন
নিয়েছো বন্টন করে, শুধু এক পাশে একটি খর্জূর,
আমার শিয়রে রাখা। স্বার্থপরতার নাম পথ!
কাল ছিলো বাজে দিন, আজ ক্রুব্ধ তোমাদের মুখ।

প্রথমে পাহাড় ছিলো। তারপর শক্ত সমতল।
অরণ্যের ঠোঁটে এলো আফ্রিকার রাত্রি, যার বালু
মনে হলো মখমল; জেগে দেখি বিশ্রী মরুভূমি!
তোমরা লুকিয়ে খাও অতঃপর মশকের পানি।


দুজন ভাবুকের মৃত্যু


তুমি কি কখনো শোনো ক্লান্ত ট্রামে তার ঘর্ষণ?

আমি শুনি। মধ্যরাত। জীবনানন্দের ট্রাম যায়।

খুব ভয়াবহ নয়; ধীরে-সুস্থে যায় দক্ষিণের

থেকে উত্তরের দিকে।…ঘাম, রক্ত, মৃত্যু সাথে থাকে!
তোমার অতল প্রেমে সাড়া দেবে মূর্খ এক দাসী

কী করে ভাবলে তুমি কাওয়াবাত? মৃত্যু কিন্তু দ্যায়;

অন্তত রাতের মৃত্যু! ফাঁকা ট্রাম, ঘর্মাক্ত মানুষ

দেখল ফতুয়া গায়ে পড়ে আছে অর্ধমৃত দেহে

তাদের মতন কেউ! কত লোক, কলকাতা জানে

উপদ্রব খুব বেশি। মর্গে গিয়ে ঈশ্বরের হাত 

যারা ধরে তারা খুব অন্তর্গত!…কবি-টবি হবে,

ভাবলো যাত্রীর মধ্যে একজন। নাও হতে পারে!

চুল ছোটো, খাটো ধুতি, বড়োবাজারের ব্যবসায়ী…

কী যন্ত্রনা! ট্রাম বন্ধ! — উন্মাদের মতো কাজ করে!

পাতাও ঝরবে বাপু; বুদ্ধিমান অপেক্ষায় থাকে।
দাসী মারে, ট্রামও মারে, তবে কেন এত আলোচনা?


অন্য এক দিনপঞ্জি থেকে…


নগ্ন নারীর দিকে তাকানো নবজাত অশ্রুর অভিজ্ঞতায় ভয় পেয়েছিলো পৃথিবীর রাত্রি। —তবু আশ্চর্য, প্রথম মুকুট-পরা অনভ্যস্ত প্রেমের গৌরবে পুরুষ আর নারী কথা বললো সারা রাত্রি।…

অনেকেই প্রাক-বসন্তের প্রথম নারীকে পেয়েছে খোলা আকাশের নিচে। যখন খোলার প্রয়োজন হয়, চাঁদের মতো নক্ষত্রও তা দ্যাখে। ওরা যখন অনবহিত, তখনো পাথরের ওপর পড়ে অশরীরীর দীর্ঘশ্বাস! চাঁদের আলিঙ্গনাবদ্ধ হাওয়া রাত্রিকেও টেনে আনে আঘাত ও মৃত্যুর সামনে। আর পুরুষকে আড়াল করে শুধুই নগ্ন নারীর দিকে তাকাতে বলে।

(অংশবিশেষ)


সবকিছুর নিজস্ব প্লাতেরো…


 হাঁসগুলি শাদা আর আমার কল্পনা পবিত্র এবং অবশ্যই কার্পাসের মতো শুভ্র!…আমার যদি কোনো প্লাতেরো থাকতো তবে তাকে নিশ্চিতই দেখতাম।

ধরো, যদি থাকতো আমার একজন প্লাতেরো; আর আমি বর্ণনা নিপুণ, তবু কি সবকিছু দেখা যেতো, যেমনটি আমি দেখি?…বা ভাবি যেমনটা আমি দেখছি? মৃত্যু আর সমস্ত বিলীন হবার আগে কিছুই তবে জানবার নেই!

উপভোগ করা কি প্রকৃত দেখার নিকটবর্তী? কে আর কবে নিজের নারীর স্তন, নরম আব্রু আলোর নিচে দেখেছে অবিকল সমগ্রতায়! তুঙ্গ মুহূর্তের ক্রোধ আর উচ্ছ্বাসবর্জিত দেখা, সে কেবল ঈশ্বরের আর আমাদের মৃত্যুর পরে। হয়তো স্নায়ুর একটি বিরাট আঘাত আর পতনের ক্ষণিক মুহূর্ত মাত্রের অতি বিশালতায়।

দেখার ফাঁকগুলো পথচলার সময় আমি অভিজ্ঞতা দিয়ে যথাসাধ্য পূরণ করতে করতে চলবো; আর প্লাতেরো তুমি— পশুর উপলব্ধি দিয়ে আমার প্রতারণায় মৃদু মৃদু হাসবে!

জানো তো প্লাতেরো, বোকামি আর নির্বুদ্ধিতার জন্যে পশু কেন, একজন গোবেচারা গাছেরও হাসি পায়!…


হাওয়ার একটি সন্ধ্যা…


হাওয়ায় একটি সন্ধ্যা ছাড়া কোনো স্বাধীনতা আমাদের নেই। ঘরের বাইরে আমাদের নির্দেশ, অবাধ্যের জন্যে তাক করে বেয়নেট— শুধু ঘরের ভেতরে নিজের কবিতা উচ্চারণ করার অন্ধকার সিঁড়ি।

কাফকা আর প্রুস্তের গ্রন্থগুলি পড়েছি; সেই থেকে আমাদের বন্ধ জানালায় ধুলো আর অতি গর্বিত মাকড়সার জাল। গ্রিক নাটকগুলি পশুত্বের মিথুন আর রক্তগৌরবের বিশাল চিৎকার। স্বাধীনতা, ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে কী রকম ছিলো, আমরা তা কখনোই স্পষ্ট করে বলতে পারবো না।

তবু হাওয়ার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকার সম্ভাবনা তীর্থযাত্রীদের জন্যে এখনো সম্ভব। সমুদ্রের ফসফরাস স্পর্শ করা ছোট বাড়িগুলির ওপর অশান্ত পাখিদের শাদা বা বাদামি পালকের দিকে তাকিয়ে থাকা প্রেমিক-দম্পতি এখন মাধুর্যের কিছু কথা সংগমের অভিলাষ ছাড়াই বলতে পারে। তারা ধর্মের জটিলতার সামনে এখনো সশ্রদ্ধ কিছু খেইহারা।

দেবদারু গাছ মাথা নাড়ে। তারা সাড়া দেয়। সমুদ্রের টাটকা মাছ ও ফলের অপরাধ ভুলে গিয়ে খাবার টেবিলের নীল টেবিলক্লথের ওপর মদের গ্লাস নিঃসংশয়ে ঢেলে দিয়ে আদিম গুহা মানবের মতো খুশিতে চিৎকার করে।

পরে তারাই বারান্দায় জড়ো হয়। স্বাধীনতার কথা বলতে চায়, অথবা লাতিন আমেরিকার স্বৈরতন্ত্রের শেষ কাপুরুষটির খুন করবার ধরন-ধারণ ও কর্কশ ছুরির আকার ও তার (শাসকের) ছেলেবেলার শিশ্ন ব্যবহারের রসাল গল্প বলতে বলতে রাত্রির তৃতীয় যামে চাঁদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের পরিচয় ভুলে ক্লান্তির হাই তোলে।


সিকদার আমিনুল হক

জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৪২; কলকাতার কাঁচড়াপাড়ায়। মৃত্যু ১৭ মে ২০০৩; ঢাকায়। পৈতৃক নিবাস কুমিল্লার মতলব থানার মাদারতলি গ্রামে। ঢাকার জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে বিএ পাস করেন।

দেশি-বিদেশি একাধিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়। কিন্তু কোথাও থিতু হননি। ষাটের সাড়া জাগানো সাহিত্যপত্রিকা ‘স্বাক্ষর’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। মূলত কবি। কবিতা, ছড়া ও প্রবন্ধ মিলিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ কুড়িটিরও বেশি। দূরের কার্ণিশ (১৯৭৫); তিন পাপড়ির ফুল (১৯৭৯); পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা (১৯৮২); আমি সেই ইলেকট্রা (১৯৮৫); বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকার (১৯৮৭); পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল (১৯৮৭); এক রাত্রি এক ঋতু (১৯৯১); সতত ডানার মানুষ (১৯৯১); কাফকার জামা (১৯৯৪); সুলতা আমার এলসা (১৯৯৪); রুমালের আলো ও অন্যান্য কবিতা (১৯৯৫); লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেলো (১৯৯৭) সিকদার আমিনুল হকের কবিতার বই। এছাড়া শ্রেষ্ঠ কবিতা ও রচনাবলিও প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসাবে পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও কবি আহসান হাবীব পুরস্কার।

শেয়ার