লাইকা ।। সোনালী চক্রবর্তী

ধাতব পাত্রের আধার। যাতে ক্লান্তিতে শুতে না পারি, ব্যথায় পাশ ফিরতে না পারি, মৃত্যু এলেও বসে না পড়ি, প্রতিটা অঙ্গ শিকলে বাঁধা যেন একটা নখও সামান্য স্থান পরিবর্তন করতে না পারে, পাত্রের আধার এতোটাই সংকীর্ণ। আমার মুখে পরানো আছে লৌহ নির্মিত কঠিন মুখোশ, অনেকটা রেসের মাঠের ঘোড়াদের যা পরানো থাকে, জকিরা প্রাণান্ত ছুটিয়ে যাদের দৌঁড়ের বাহবা আর গর্ব তাদের ওপর বাজি ধরা শৌখিন বড়লোকদের মুকুটে তুলে দেয়। এও তো বাজি’ই বোধহয়, নাহলে শ্বাস নেওয়া থেকে রেচন অব্দি শারীরবৃত্তীয় চক্রের প্রতিটা পর্যায়কে এমনভাবে যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত কেন রাখা হবে? কেন আঠালো রাবারের মতো খাদ্য ইঞ্জেকশান দিয়ে শরীরে ঢুকিয়ে ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে আমার ওজনের, রক্তচাপের সঙ্গে?

আজ এই নিয়ে এ অবস্থায় তিনদিন। প্রথমদিন যখন আমায় এখানে আনা হলো বরফ পড়ছিল ভীষণ।  আমার মন বলছিল প্রকৃতিকে শেষবারের মতো এই শেষ দেখা, তাই চোখ মেলে দেখছিলাম, বেশি সময় তো পারিনি। ভীষণ শিক্ষিত ও গম্ভীর দুই বৈজ্ঞানিক, যাদেরকে আমার অতন্দ্র প্রহরী হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে তারা বড়ই কর্তব্যপরায়ণ। খুব দ্রুততায় আটকে দিলেন আমায় এই আধারটায়। আমি ককিয়ে উঠতে চেয়েছিলাম। আতঙ্কে, ধাতব মুখোশ পেরিয়ে শব্দ বেরোয়নি, শিকল ছিঁড়ে গিয়ে হাত-পা সরেনি এক ইঞ্চিও। শরীরে দয়া-মায়া থাকার জন্যই হোক অথবা পরীক্ষার সাফল্যের জন্য আমায় বাঁচিয়ে রাখাটা অপরিহার্য বলেই হোক, একটা গরম জলের নল আটকে দিতে দেখেছিলাম তাদের এই পাত্রটায়। বরফ শৈত্যকে ঢাকতে তার’ই তরল অবস্থার অ্যানটিডোট আর কি। যে কোন যন্ত্রণাকেই সময় উপশম দেয় কিনা জানি না, তবে বৌদ্ধিক আর শারীরিক অনুভূতিগুলোকে ক্রমশ ভোঁতা করে দেয়,একথা ঠিক। নাহলে প্রথমদিনের থেকে দ্বিতীয় দিনে আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন ঘোর আসতো না। আর তৃতীয় দিন থেকে আমি অপেক্ষা শুরু করতাম না এই ধোঁয়াটে, ঝাপসা হয়ে আসা অবস্থাটার একেবারে শেষ হয়ে যাওয়ার। আমি স্বপ্ন দেখতে ভুলে যেতে পারতাম না এতো সহজে। সেই রাস্তার কোণটা, যেখানে প্রতি বিকেলে একজন আমায় এক ঝলক দেখার জন্য পার্কে আসতো, তাকে আর দেখতে না পাওয়ার বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে পারতাম না।

আমার শারীরিক অবস্থাকে গত তিনদিনে এমন স্তরে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে, যেখানে একটা মূল প্রশ্ন আমি নিজেকেই করতে ভুলে গেছি- “কেন আমি এখানে?” আমার নিজের কাছে এর কোন উত্তর নেই। কারণ অতর্কিত আক্রমণে শীতের রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিলো আমায়,আমি রোজকার মতো হাঁটতে-হাঁটতে রাতের খাবার চিবোতে-চিবোতে মহার্ঘ্য, অত্যাধুনিক মস্কো শহরে আমার অস্থায়ী বাসস্থানে ফিরছিলাম যখন। বুঝে উঠতে পারিনি, অজস্র আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলো মধ্যরাতের রাজপথে। ক্ষণিকের ব্যবধানে বুঝেছিলাম বহুল দামী, অনেক সরকারী গাড়ির হেডলাইট এক সঙ্গে জ্বললে বোধরাও গুলিয়ে ফেলে সূর্য না প্রযুক্তি, কার কাছে সে মাথা নোয়াবে? আমি তো পড়াশুনা করার সুযোগ পাইনি কোনোদিন। নাহলে বিনা অপরাধে আক্রমণ মারফত আমার আমিকে ছিনিয়ে নেওয়ার এই পৈশাচিক প্রক্রিয়ার জন্য বিতর্ক আনতে পারতাম রাষ্ট্রের অধিকার সংক্রান্ত। কিন্তু আমি অসহায়। যারা আমায় নিয়ে এলো, তাদের প্রয়োজন ছিলো না কৈফিয়ত দেওয়ার। আমি তো ছিলাম পরিচয়হীন ভবঘুরে। তকমা আঁটা বৈধ দোপেয়ে নাগরিক তো ছিলাম না। তাদের প্রয়োজন ছিল একটা উপযুক্ত শরীর। আমি আমার তিন বছর বয়সে প্রায় ছয় কেজি ভর নিয়ে সে যোগ্যতার মান উত্তীর্ণ হয়ে পড়েছিলাম নিজের’ই অজান্তে। তাই লুণ্ঠিত হয়েছি প্রকাশ্য জনপথ থেকে। সে খবর স্থানীয় সংবাদপত্রে বেরোয়নি। তবে সে রাতেই বুঝেছিলাম রাষ্ট্রযন্ত্র কী নিদারুণ। তার প্রয়োজনে সে তার অধিকারে থাকা যে কোন কিছুকে চরম নির্লজ্জতায় গ্রাস করার জন্য সদা তৎপর। থাক সে কথা।

যেখানে প্রথম আমায় তুলে নিয়ে আসা হলো, দেখলাম সেখানে আমি একা নই;আরও দুজন আছে, তবে তারা পুরুষ। অদ্ভুতুড়ে সব যন্ত্রপাতি ঠাসা ঘর। আমি গিনিপিগ হয়ে জন্মাইনি জীবকুলে, নাহলে হয়তো রক্ত স্রোতে বাহিত বংশানুক্রমিক জ্ঞানেই বুঝতে পারতাম কী ঘটতে চলেছে আমাদের সঙ্গে। শুরু হলো যন্ত্রণাময় সেই পর্ব। অতি উচ্চমানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা আর ফ্যান্টাসি নামের সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দিয়ে বহু তারকা চিহ্ন যুক্ত অতি নীল ছবির নির্মাণে যে মূলগত কোন ব্যবধান’ই নেই, সে বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা যদি উপন্যাসে লিখে প্রকাশ করার সুযোগ পেতাম, বেস্টসেলার লিস্টে হটকেক হয়েই যেত অন্তত কয়েক বছরের জন্য, এ দাবী আমি নিশ্চিতভাবে করতে পারি। প্রায় দিন কুড়ি সহ্য করতে হয়েছিলো সেই বিভীষিকা। শেষ দিকে শরীর থেকে বর্জ্য নির্গমন প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। যে ব্যাগ আটকে দেওয়া হয়েছিলো শরীরের সঙ্গে, ফাঁকাই থাকতো। ল্যাক্সেটিভ প্রয়োগেও কাজ হয়নি বিশেষ। ভয়ে, অবিশ্রামজনিত কারণে হৃদস্পন্দন প্রায় দ্বিগুন আর রক্তচাপ চরম সীমায় উঠে যাচ্ছিলো বার বার। শেষদিকে গবেষকের চেহারায় বেশ হতাশা দেখতাম। বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না বলেই তাদের হতাশা আমাদের আশা দিতো মুক্তির।

এই পর্বটায় ঘটা একটা বিশেষ ঘটনার কথা আমাদের তিনজনের’ই বেশ স্মরণ আছে। বিশেষ কারণ সুনিয়ন্ত্রিত ও সুশৃঙ্খলিত সিস্টেমে, সেটা ছিল “ব্যতিক্রম”। যেখানে রোজকার জীবনে শ্মশানের শান্তি আর নৈস্তব্ধ বিরাজ করে সেখানে যদি প্রথমে একজন অভিযোগের আঙুল ওঠায় কারোর দিকে, আর তা জন্ম দেয় বিতর্কের, আর বিতর্কের পারদ চড়তে চড়তে উচ্চগ্রামের কলহে রূপান্তরিত হয়, সে এক মহাজাগতিক ঘটনার মতই বিস্ময়কর নয় কি? ভাষা খুব বেশি উদ্ধার করতে না পারলেও যেটুকু বুঝেছিলাম সংঘাত মূলত রাজনীতির সঙ্গে বিজ্ঞানের, আবহমান কাল ধরে যা চলে আসছে, তার’ই নবতম সংযোজন। রাষ্ট্রনায়ক চেয়েছেন তার প্রথম সাফল্যকে ছাপিয়ে যেতে অতি দ্রুত দ্বিতীয় সাফল্যের উড়ানে; আর এক ঢিলে দুই পাখির মতো বলশেভিক বিপ্লবের ৪০ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করতে। অথচ প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নির্মাণের সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন মাত্র ৪ সপ্তাহ। ফলে বৈজ্ঞানিকদের তাদের অধীত সমস্ত জ্ঞানের বিরুদ্ধে গিয়ে সায় দিতে হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় অতি নিম্নমানের অপরীক্ষিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারে, কাঠপুতলী অথবা ক্রীতদাসের মতো। কী লাভ এই শিক্ষার? এই জ্ঞানের? আমি এই সব প্রশ্ন তোলার কে যদিও, তবু বড়ই যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়েছিলাম দেখতে দেখতে। এরাও কতো অসহায়। এতো মেধা, বিদ্যা, পাণ্ডিত্য নিয়ে ক্ষমতার কাছে কী বাধ্যতামূলক পরাজয় এদের। অনেক খুঁজেও কোন পার্থক্যই নজরে আসেনি সেদিন আমাদের তিনজনের সঙ্গে ওদের। কী এক অসম লড়াই, মানবতা আর শাসনের, অনাদি অনন্তকালের। সত্যি তিনি’ই ক্রান্তদর্শী যিনি বলে দিয়েছিলেন- power tends to corrupt and absolute power corrupts absolutely.

হঠাৎ একদিন দেখলাম সবচেয়ে বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকটি, শ্বেতশুভ্র যার চেহারা, যিনি দিনে একবারের বেশি আমাদের অন্ধকূপে ঢুকতেন না, সব শিকল খুলে বড় আদরে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। অধিকাংশ বৈজ্ঞানিক তাকে স্যার সম্বোধন করলেও তার নাম লোকমুখে শুনেছিলাম ড. ভ্লাদিমির ইয়াজদভস্কি। তার হাতের নরম স্পর্শে যখন আমার চোখ জড়িয়ে আসছিলো বহুদিনের না আসা ঘুমে, দ্বিতীয়বার আক্রমণের শিকার হলাম। অবাক হয়ে চেয়ে দেখলাম চোখের কোণ চিকচিক করলেও তিনি বাঁধা দিলেন না। বুঝে নিলাম, মুক্তির মেয়াদ এ পর্যন্তই ছিল। এই সাময়িক আনন্দ অজানা যাত্রার আগে পাসপোর্ট তৈরির বিরতি মাত্র। তার পরের ঘটনা এই ধাতব পাত্রের আধারে আমার গত তিনদিনের অবস্থিতি। কবে আমাকে তুলে নিয়ে আসা হয়েছিল খেয়াল না থাকলেও এখানে আমায় ঢোকানোর সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর মুখে একজনকে বেশ জোরেই উচ্চারণ করে খাতায় নোট নিতে শুনেছিলাম- “31st October,1957. 3 days to go”।  হারনেস পরানোয় ঘাড় ঘোরানোর সুযোগ না থাকলেও বেশ বুঝতে পারতাম এখানে

অক্সিজেন সরবরাহ আর আমার শ্বসন থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণের সব যন্ত্রপাতি মজুদ, নাহলে ছিদ্রহীন পাত্রে টিকে আছি কী করে? একটা পাখাও লাগানো আছে কিন্তু চামড়ায় ফোস্কা পড়ার মতো আধারের তাপমাত্রা বৃদ্ধি নাহলে তা ঘোরে না, স্বয়ংক্রিয় নিশ্চয়।

. . . . . . . . .

প্রায় নির্বীর্য হয়ে আসা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে এই মুহূর্তে কিছু ঘটতে চলেছে। অশুভ, চরম কিছু যা রাস্তায় ঘুরে বেড়ানোর সময় আমি টের পেতাম ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত, জলোচ্ছ্বাস অথবা, দাবানলের অব্যবহিত আগে। আমি নির্ভুল ছিলাম এবারেও। অসম্ভব একটা ঝাঁকুনি। প্রকৃতির সব প্রলয়কে একত্রিত করলে যে ধ্বংসের সৃষ্টি হতে পারে তাই যেন অনুভব করতে পারছি এখন। একি প্রাকৃতিক আদৌ না প্রকৃতির বিরুদ্ধে যাওয়ার অপ্রাকৃত প্রয়াসের ফলশ্রুতি? জানি না। শুধু বুঝতে পারছি অন্তিমকাল আসন্ন। এই তীব্র কম্পন হৃদপিণ্ডকে শরীর থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। মস্তিষ্ক তার চিন্তা প্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে ক্রমশ। আহ, অন্ধকার …

পৃথিবীর কোন এক ধর্মে আত্মার উল্লেখ আর প্রামাণ্য নথি আছে। যে অবস্থায় এখন বিরাজ করছি মহাশূন্যে, পরম নিশ্চিন্তে, নির্ভার ভাসমান তাকে ব্যাখ্যা করার সম্ভবত এই একটি’ই সূত্র আছে- “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন নায়ং ভুত্বা ভবিতা বা ন ভুয়হ/ অজো নিত্যহ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে”। প্রত্যক্ষ করছি নির্বিকল্প ঔদাসিন্যে ঐ ধাতব আধারের বাড়ির সামনে, যার নাম ‘সামরিক গবেষণা কেন্দ্র’, আমার মূর্তি বসছে। হাস্যমুখ, গর্বিত, উদ্ধত, মূর্তি আমার। হাসি-গর্ব-ঔদ্ধত্য আমার হত্যাকারীদের। আমার মৃত্যুর রহস্য উচ্চপর্যায়ের সরকারি তদন্তের শীতল মর্গে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে, যাতে অন্তত কয়েক দশক তা প্রকাশ না পায়। ভবঘুরের নাম থাকে না কিন্তু নথিতে মংগ্রেল প্রজাতিভূক্ত আমার দুটো নাম বসে যাচ্ছে। একটা গালভরা পদবী যুক্ত- “কুদরিয়াভকা”, আরেকটা শখের ডাকনাম “কার্লি”। ইতিহাস তো মনুষ্যনির্মিত বিকৃত তথ্য মাত্র, তাই উইকিপিডিয়াতে আমার পরিচয় খুঁজলেই প্রথম লাইনটা ভেসে উঠছে- “প্রথম জীবন্ত প্রাণী হিসাবে মহাকাশযাত্রার সৌভাগ্য অর্জনকারী”।

… আমি লাইকা।

শেয়ার