রাতকুকুরের চোখে চোখ রেখে ।। সরোজ দরবার

ঘুমের ছায়া চাঁদের চোখে নামলে বাড়ি ফেরার রাস্তা যেন অখিলবন্ধু ঘোষের গান হয়ে ওঠে। দূর আকাশে তারার গায়ে মিটমিট করে ক্লান্তি। এ বড় মৃদু, নরম সময়। এ বড় সময় খতরনাকও। এই যে নারকেল পাতার জানলা ছুঁয়ে রাস্তায় চুঁইয়ে পড়েছে জ্যোৎস্না, হালকা হাওয়ায় ঝিরিঝিরি দুলে উঠছে পাতার ছায়ারা। এ ছায়া মায়ামাখা। তবু ভ্রমমাত্র। পাতার গায়ে কত কীট, কত ফোঁপরা, ময়লা সে সবের খবর কী ছায়া দেয়। এই যে আমার ছায়া আমার আগে আগে চলেছে, এও কী চেনাতে পারে আমাকে! আমার সব পরিচয়পত্র কি চেনে আমাকে? চেনে অবশ্য একরকম, যে চেনা না-চেনার মতোই। এই না-চেনা আমির ছায়ার সঙ্গেই হেঁটে যাই আমি। আর আমার চোখের দিকে তাকায় একটি কুকুর। তার ক্লান্তিহীন চোখে প্রশ্ন, তুমিই কি সেই?

কুকুরকে আমি কখনও বিস্কুট দিইনি। ওতো সুবিধা নেওয়ার ছল। নাহ, কোনও পশুপ্রেম-টেম বলে আমার মনে হয় না। চা দোকানের সামনে যারা কুকুরের দিকে আধখানা বিস্কুট ছুঁড়ে দেয়, তারা আসলে আনুগত্য কেনে। এই হুট করে গায়ে পা পড়ে গেলে যেন কেঁউ করে থেমে যায়। দাঁত-নখ যেন না বের করে। কুকুরকে আমি কখনও তাই বিস্কুট দিইনি।

প্রেমিকা সঙ্গে থাকলে প্রেমিকরাও কুকুরকে বিস্কুট খাওয়ায়। উলঝুলু করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সেও তো আসলে কুকুরকে ব্যবহার করা। কুকুর কি তা জানে না? জানে। তবু পৃথিবীতে কে কার, এই ভেবে শেষমেশ বিস্কুটে কামড় বসায়। কুকুরকে অবিশ্যি আমি কখনও বিস্কুট খাওয়াইনি। প্রশ্ন হলো, জেনেবুঝে কুকুর কেন এসব আমল দেয়। উত্তর খুঁজেছি দিনের কুকুরের চোখে। দেখেছি স্রেফ রসিকতা। কে ব্যবহার করলো, কে আনুগত্য চাইলো সেটা ওদের কাছে ম্যাটার’ই করে না। ম্যাটার করে রাতকুকুরের কাছে। রাতকুকুর বিস্কুট চেনে না। কোনও পরিচয়পত্রই চেনে না। হলদেটে আলোর নিচে ওদের চোখ জেগে থাকে পরীক্ষক হয়ে। পরীক্ষা মানে, কতখানি সংক্রমণ ছড়িয়েছে নিজের ভেতরে।

অন্যকে ঠকানোটা আজ আর তেমন বড় কী ব্যাপার। কতটা নিজেকে ঠকাচ্ছি সেটা এখনও খানিকটা গুরুত্ব দাবি করে। রাতের কুকুরের চোখ তাই ফাঁকি দেওয়া যায় না। যখন ওদের সম্মতি ছাড়া আমিই নিজেকে আমি বলে প্রমাণ করতে পারি না, যখন ওরা পথ না ছাড়লে আমার পাড়াই আমার বলে ঘোষিত হয় না, তখন এক চরম পরীক্ষার মুখে পড়তে হয় আমাকে। ওই সেই চিরকেলে আমির প্রশ্ন। তবু প্রতিজনের কাছে জীবনের প্রতি পর্বে তা আলাদা হয়েই দেখা দেয়। এই খাওয়া-পরা-ঘোরার আমিটাকে এই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় জেগে থাকা কুকুরের চোখ।

অবশ্য মানুষ পারে না এমন কাজ নেই। আইন বানিয়ে আইনের ফাঁক খোঁজা মানুষ সতর্ক কুকুরের চোখেও ফাঁক খুঁজে পায়। ভাবি, আমি ভেতরে বদলে গেলেও কি কুকুর তা ধরতে পারছে নাকি? ও তো বাইরের মানুষটাকেই চেনে। আর ঠিক এইখানেই সেই নিজেকে ঠকানোর সংক্রমণে পড়ে যাই আমি। আমাকে বাজিয়ে দেখে নিয়ে সরে যায় পরীক্ষক কুকুর।

তাহলে কে কাকে সরালো? আমি কুকুরকে নাকি কুকুর আমাকে? অফিস থেকে বেশি রাতের দিকে বাড়ি ফিরতে ফিরতে বহুবার ভবেছি সে কথা। তারপর এই ডিনার শেষের রাত্তির থেকে যা উত্তর পেয়েছি তা লিখে রেখেছি এইভাবে-

পাড়ার কুকুর চেনে না বৈধ পরিচয়পত্র,
গায়ের গন্ধ চেনে, মুখও চেনে বোধহয়;
রাত করে বাড়ি ফেরার সময়
ওদের চোখে চোখ রাখলে
লহমার বিচারে ওরা ফেরার সম্মতি দেয়।
এটুকু ছাড়া যেন আমি, আমি-ই নই
যেন আমার ঘরে ঢোকার অনুমতি নেই আমার।

কুকুরের সামনে টেকে না বৈধ পরিচয়,
টেকে শুধু গায়ের গন্ধটুকু
ভেতরে মানুষটা বদলে গেলেও তেমন কিছু নয়।

ওদের নীরব সম্মতিতে
একটু কি ব্যঙ্গও থাকে তবে,
প্রতিবার মুখ নামিয়ে নিয়ে ওরা কী বলে,
‘হয়, সংসারে তো এমন আকছার’ই হয়!’

শেয়ার করুন

One thought on “রাতকুকুরের চোখে চোখ রেখে ।। সরোজ দরবার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!

Discover more from

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading