দীন ভাই,
আমরা এমন এক সময়ে কথা বলছি যখন কোভিড-১৯-এর ভ্যারিয়েন্ট-বি.১.৬১৭ আমাদের পাশের দেশ ভারতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা আমাদের আতঙ্কিত এবং ব্যথিত করছে। অক্সিজেনের অভাবে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়েই মঙ্গলগ্রহের আকাশে ‘ইনজেনয়িটি’ উড়িয়ে দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করছে নাসা। ‘পার্সিভিয়ারেন্স’ পাঠাচ্ছে মঙ্গল গ্রহের উদ্ভূত সব ছবি। আমরা শিহরিত হচ্ছি। ছবি দেখে আমাদের মনে ভাসছে করোনায় মরে যাওয়া রাশি রাশি কবর-চিতার ছবি। মনে হচ্ছে, একসময় মঙ্গল বোধহয় পৃথিবীর মতো সবুজ ও প্রাণময় ছিল। আমাদের সমূহ অবিমৃষ্যকারিতার ফলস্বরূপ পৃথিবী মঙ্গলের মতো একটি পতিত/পোড়ো গ্রহে পরিণত হতে যাচ্ছে। একদিন হয়তো এখানের প্রাণের অস্তিত্ব-সন্ধানে আসবে অন্যকোনো গ্রহের প্রাণী বা মানুষ। ভাবছি, ভারতের মতো একটি পারমানবিক শক্তিধর দেশের মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডারের অভাবে মারা যাবে কেন? পারমানবিক শক্তি অর্জন এবং তার রক্ষণাবেক্ষণে ভারত যে-টাকা ব্যয় করে, মঙ্গল গবেষণায় আমেরিকা যে-টাকা ব্যয় করে, তা দিয়ে বা তার একটি অংশ দিয়ে ভারতের/আমেরিকার/পৃথিবীর মানুষের স্বাস্থ্যসেবার দিকটি আরো উন্নত করা যেত না? কবীর সুমনের গান মনে পড়ছে, ‘বিজ্ঞানীরা কী জুয়াই খেলতে যান/পৃথিবীর বুকে শুকিয়ে যাচ্ছে ঘাস।’
দীন ভাই, আমরা কথা বলছি লকডাউনে, মৃত্যুর জোয়ারের ভিতরে বসে। তবু আমাদের কথা বলতেই হবে। জীবনের কথা। সুন্দরের কথা। কবিতার কথা।
আপনাকে প্রথম দেখার স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে আপনার কাছ থেকে পাওয়া একটি কবিতার কথা। আমাদের একটি ছোটোকাগজের জন্য আপনি লেখাটি দিয়েছিলেন। তখনও আপনার সাথে আমাদের সেই উন্মাতাল সখ্য গড়ে ওঠেনি। তারপর ধীরে ধীরে আপনি আমাদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। আমরা মিশে গেছি। কবিতার সন্ধানে আমরা যেন দলবেঁধে নেমেছি অতল অন্ধকার খনির তলদেশে। কিন্তু আমরা ভয় পাইনি। আনন্দে উল্লাস করেছি। জীবনকে দুই হাতে উড়িয়েছি বাতাসে। এরপর চলে গেছে অনেক বছর। আমরা সবাই চল্লিশোর্ধ্ব হয়েছি। সংসার-সন্তান হয়েছে আমাদের। আমরা ব্যর্থ বা সফল হয়েছি। কিন্তু কবিতা আমাদের ছেড়ে যায়নি। কেননা আমরা প্রত্যেকেই এক-একটি কবিতা হয়ে গেছি। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ আপনি। আপনাকে স্বয়ং একটি কবিতাই মনে হয় আমার।
— মুহম্মদ ইমদাদ
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমার মাও আমাদের অঞ্চলের লোকগান, শ্লোক, লোকপ্রবাদ ইত্যাদি তাঁর খাতায় লিখে রাখতেন।
মুহম্মদ ইমদাদ : আমরা আপনার কবিতা পড়েছি। রাতভর। দিনভর। দলবেঁধে। একা একা। প্রকাশ্যে। গোপনে। আপনি আমাদের অহংকারে পরিণত হয়েছেন। আগে বলুন, এই অতিমারির কালে আপনি কেমন আছেন এবং কী করছেন?
মোস্তাক আহমাদ দীন : অতিমারির প্রথম পর্বে/ঢেউয়ে সংকটকালের মধ্যেও, আত্মপরের মতো, একা একা লেখালেখির শুরুর দিককার অবস্থায় ফিরে গিয়েছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে একই বিষয়ে অব্যাহত সময়যাপনের অভাবে যা যা করা যায়নি, এই সময়ে তা করার চেষ্টা করেছি, যা আগামী দু-এক বছরের মধ্যে প্রকাশযোগ্য করে তুলতে পারব বলে আশা রাখি। অন্যদিকে চলমান ব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ-হয়ে-ওঠারও যথেষ্ট কারণ দেখা দিয়েছিল, কখনো কখনো সরব হতে না-পারার যন্ত্রণায় কাতরও হয়েছি, যার প্রতিক্রিয়ায় রূপকাশ্রিত কিছু লেখাও তৈরি হয়েছে, যাকে অক্ষমের সান্ত্বনা বলেও অভিহিত করা যায়।
দ্বিতীয় পর্বেও কিছু কাজ করছি, তা নিয়ে এখনো বলবার-মতো কিছু হয়ে ওঠেনি।
ইমদাদ : এখন কী লিখছেন, কী পড়ছেন?
দীন : এই প্রশ্ন যখন সামনে এল, তখনই শেষ করলাম ‘শিবনারায়ণ রায়ের রবীন্দ্রমূল্যায়ন’ শিরোনামের একটি গদ্য। গত শতকের পাঁচের দশকে দেশ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ও গ্যেটেকে নিয়ে যে-তুলনামূলক প্রবন্ধটি লিখেছিলেন শিবনারায়ণ রায়, তা সেসময় তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। সেই প্রবন্ধ, চারের দশকে লিখিত তাঁর চিত্রশিল্প নিয়ে আরেকটি প্রবন্ধ এবং পরবর্তীসময়ে লিখিত আরও দুটি প্রবন্ধই আমার আলোচনার অন্তর্ভুক্ত। যেহেতু দুজনেই নানা দিক থেকে প্রিয়, তাই বহু প্রসঙ্গে নিজের বিবেচনা-অনুযায়ী নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছি।
এর বাইরে ঢিমে-তালে ফারসি ও উর্দু সাহিত্য বিষয়ে একটি কাজ করছি, সে-উপলক্ষ্যে কিছু অনুবাদও করেছি। অচিরেই বের হবে একটি সম্পাদিত বই যার নাম বাঙ্গালাদেশে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক। বইটি বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। এখন সম্পাদনা করছি ফকিরি তত্ত্বকে বিষয় করে লেখা নাগরীগ্রন্থ ভেদজহুর।
পড়ছি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নাগরিক শিরোনামের একটি বই। আর ফাঁকে ফাঁকে ফেলিনির আত্মজৈবনিক গদ্য।
ইমদাদ : আপনার কবিতা পড়ছি ২২/২৩ বছরের কম না। আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কথা ও হাড়ের বেদনা-র প্রকাশ বাংলা কবিতাভুবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বইটি হাতে নিয়ে আমরা উজ্জীবিত হয়েছি। প্রচুর আলোচনা হয়েছে বইটি নিয়ে। প্রায় সব আলোচনাই ছিল আপনার অজান্তে। দু-একটি আলোচনা আমি/আমরা আপনার গোচরে এনেছিলাম। সবগুলোই ছিল সৎ এবং সশ্রদ্ধ আলোচনা। সর্ব অর্থেই বইটি ছিল/আছে একটি নতুন বই। নতুন কবিতার বই। কবিতার নতুন বই। আমি লক্ষ করেছি, আপনার ভাষাভঙ্গিটি, যা বাংলা কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন। এবং শব্দ। অনেক পুরোনো শব্দ, আঞ্চলিক শব্দ, মরমি শব্দ আপনি অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। শুধু শব্দ নয়, শব্দগুলো যেন তাদের উৎস, প্রতিবেশ-পরিবেশ নিয়ে জীবন্ত ছবির মতো পাঠকের সামনে আছড়ে পড়ে। আপনার এই কাব্যযাত্রার উৎস এবং বইয়ের পরিকল্পনার কথাটি বলুন।
দীন : যাদের প্রথম বই পরিকল্পিতভাবে বের হয়েছে, আমি সেই সৌভাগ্যবানদের গোত্রভুক্ত নই। এখানে একথা বলা যায় যে, অব্যবহিত পূর্ববর্তী এক দশকে-লেখা নানারকম কবিতার নির্বাচিত সংকলন ছিল আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কথা ও হাড়ের বেদনা। প্রত্যেক পৃষ্ঠায় একেকটি কবিতা না-দিয়ে কবিতাগুলো টানা ছাপা হয়েছিল। আলাদা উৎসর্জনলিপিসহ তিন পর্বে বিভক্ত দীর্ঘ ও সিরিজ কবিতাসহ শতাধিক কবিতা দেখে অনেকেই বলেছিলেন, এ দিয়ে ৩টি বই হতে পারত। সেই কবিতাগুলো এতটা বিভিন্ন রকম যে, সামগ্রিকভাবে এগুলোর নির্দিষ্ট উৎস খোঁজাটা বোকামি। এই বইয়ের একটি কবিতার নাম হলো ‘মুহূর্ত, বিবিধ জানালা’, বইয়ের অধিকাংশ কবিতাকে সেইভাবেই চিহ্নিত করতে পারি। বইটি যদি তোমার ভাষ্যমতে সমাদৃত হয়ে থাকে, তার পেছনে, আমার ধারণা, একেকটি কবিতার নিজস্ব অভিব্যক্তিই ভূমিকা রেখেছে।
আমার কবিতায় শব্দের ব্যবহার নিয়ে তুমি যা বলেছ, সে-প্রসঙ্গে কিছু কথা এখানে বলা প্রয়োজন। আমার মামা ছিলেন একজন লোকগবেষক। আমার মাও আমাদের অঞ্চলের লোকগান, শ্লোক, লোকপ্রবাদ ইত্যাদি তাঁর খাতায় লিখে রাখতেন। রাধারমণের নিকট-প্রতিবেশী বলে আমাদের কিশোরী-যুবতী বোন-ভাগনিদের দিনের যেকোনো সময়ে কারণে-অকারণে ধামাইল গানে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। বাবা দেওবন্দি সিলসিলার আলেম হওয়া সত্ত্বেও ছোটোবেলায় মাকে সৈয়দ শাহনুর ও রাধারমণের গান শুনতে ও গাইতে দেখেছি। এইসব স্মৃতি নিয়ে প্রথমে স্কুলে এরপর মাদ্রাসায়, তারপর কলেজে গিয়েছি। মাদ্রাসায় পড়বার সময় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের সঙ্গে আমাদের লোকশব্দগুলোর আশ্চর্য মিল দেখে প্রথমে অবাক হয়েছি, এরপর এদের শক্তি ও ধ্বনিব্যঞ্জনা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছি। আরবি-ফারসি-উর্দু মাধ্যমে লেখাপড়া করার কারণে মাদ্রাসায়-পড়া শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের মধ্যে কথা বলেন তখন তাদের কথাবার্তায় সেইসব ভাষার শব্দের প্রাধান্য থাকে। প্রথমে আমাকেও সেই গোত্রের একজন বলে ভাবতে পারো। এই প্রভাব, এবং তারপর ঘরের/অঞ্চলের প্রভাব, তারও পরে আমার বাউলফকির-সঙ্গ—এইসব নিয়েই গড়ে উঠেছে আমার শব্দের জগৎ। কবিতা লিখতে এসে আমার পক্ষে তো এর বাইরে যাওয়া সম্ভব না। আমি যখন লিখেছি ‘তোমার ঠোঁটে আয়াতুল কুরসির গন্ধ’, তখন আয়াতুল কুরসি আর কোনো মুসলিম কিশোরীর স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের সঙ্গে পাঠকের যোগ-অযোগ দুরকম অভিজ্ঞতা হতে পারে। তবে এসব ক্ষেত্রে আমি এ-পর্যন্ত যেসব পাঠক-প্রতিক্রিয়া পেয়েছি, তাতে হতাশ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেনি।
ইমদাদ : আমরা যখন কথা বলছি তখন আপনার কবিতাসংগ্রহ এবং সে-বছরই আরও একটি কাব্যগ্রন্থ স্ফটিকচূড়ার নিচে বেরিয়ে গেছে। কবিতাসংগ্রহ-এ যুক্ত হয়েছে কথা ও হাড়ের বেদনা, জল ও ত্রিকালদর্শী, জল ও শ্রীমতী, ভিখিরিও রাজস্থানে যায় ও বানপ্রস্থের আগে। বইগুলো ভাষাভঙ্গির ক্ষেত্রে একটি যোগসূত্র আছে, আবার একটার সঙ্গে আরেকটার দূরত্বও আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আপনার কবিতা একটি স্বতন্ত্র পরিচয়বাহী। চেনা যায় আপনার কবিতা বলে। এই যে স্বাতন্ত্র্য, সেটা কি সচেতনভাবেই অর্জিত, নাকি আপনার কবিতার জগৎটাই এমন?
দীন : এই যে তুমি বলছ, একটি বইয়ের সঙ্গে আরেকটি বইয়ের দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও ভাষাভঙ্গির ক্ষেত্রে একটা যোগসূত্র রয়েছে, এ-বিষয়ে আমার দৃঢ়ভাবে বলবার কিছু নেই। তুমি যা বলছ, যদি তা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ভিটগেনস্টাইনের সহযোগ না-নিয়েও একথা বলা যায় যে, লেখক যে-জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে লিখুন-না কেন, কোনো-না-কোনোভাবে, কোনো-না-কোনোরূপে, ভাষা তার তরজমা/প্রতিনিধিত্ব করবেই।
এমনিতে, কবিতা লেখা শুরু করার কিছুদিন পর থেকে এতটুকু সাবধান হতে পেরেছিলাম যে, আমার কবিতাটি যেন আমার মতো হয়। সে-কারণে প্রথম দিককার কোনো কোনো কবিতায় শব্দ, শব্দবন্ধ ও বাক্যের গঠনে নানারকম চেষ্টা-কসরত লক্ষ করা যাবে। আমার প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থে কিছু কবিতা এখনো তার সাক্ষ্য বহন করছে হয়ত, বাকি কবিতাগুলো আরও বহু খ্যাত-অখ্যাত পত্রিকায় এখনো রয়ে গেছে, সেগুলো হারিয়ে গেলে আমি খুশি। পাঠক হিসেবে, তৃতীয় কাব্যগ্রন্থে কিছু পরিবর্তন লক্ষ করি, পরবর্তী ৩টি কাব্যগ্রন্থে তা আরো নানাভাবে বিস্তারিত হয়েছে।
ইমদাদ : নব্বইয়ের দশকের কবিতার প্রধান প্রবণতাটা কী বলে আপনার মনে হয়?
দীন : নব্বইয়ের দশকে নানারকম প্রবণতার কবিতা লেখা হয়েছে, এটাই এ-দশকের কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অনেক প্রতিভাশালী কবির আগমন ঘটেছে এ-দশকে। তবে আমার মনে হয়, এই দশকের কবিদের বেশির ভাগ যতটা স্ব-ক্ষমতা/প্রতিভা-র ওপর নির্ভরশীল ততটা পরিশ্রমী হলে আরো অন্যরকম কিছু ঘটতে পারত। আমাকেও যেহেতু এই দশকের একজন সামান্য কবিতাকর্মী হিসেবে ধরা হয় সেহেতু নিজেকেও এর বাইরে বলে গণ্য করছি না। নব্বইয়ের কবিরা যেহেতু এখনো সক্রিয়, তাই আমার কথাটিকে আত্মসমালোচনা হিসেবে ধরে নিলে ভালো।
ইমদাদ : আশির দশক নিয়ে আপনার আগ্রহ আছে। সত্তরের দশক এবং নব্বইয়ের দশকের মাঝে আশির বিশেষত্বটি কী বলে আপনার মনে হয়?
দীন : আশির দশকের যারা গুরুত্বপূর্ণ কবি তাদের প্রায় সকলেই সচেতনভাবে কাব্যচর্চা করেছেন, এখনো করছেন। এরা যেমন বিশ্বসাহিত্যের মনোযোগী পাঠক, সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সবরকম তৎপরতা বিষয়েও অবহিত। এরা আঙ্গিকচেতন, ছন্দে পারদর্শী এবং এরা অসাধারণ কিছু কবিতাও লিখেছেন। সত্তরের কেউ কেউ এখনো সক্রিয়, মাঝে মাঝে তাঁদের কবিতা পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি। গনগনে সময় অতিক্রম করেছেন বলে সেই আঁচে তাদের অনেককেই উচ্চগ্রামে অনেক কবিতা লিখতে হয়েছে, পরে তারা ফিরে এসেছেন। নব্বইয়ের দশকের কথা তো আগেই বলেছি।
ইমদাদ : বহু আগে একবার আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনার প্রিয় কবি সম্পর্কে। আপনি আস্তে করে উচ্চারণ করেছিলেন উৎপলকুমার বসুর নামটি। এ-বিষয়ে জানতে চাই।
দীন : তুমি যখন এ-প্রশ্নটি করেছিলে তখন আমি উৎপলকুমার বসুর কবিতা পড়ে একদম বিমোহিত, তাই সেসময়ে প্রিয় কবি হিসেবে তাঁর নাম যে বলেছি তা ভুল বলিনি। তবে এখন উৎপলকুমার বসু কেন, কোনো একক কবিই আর আমার একমাত্র প্রিয় কবি নন। এখন কবিদের কবিতা এবং অধিকসংখ্যক ভালোলাগা কবিতার কারণে তাদের কোনো কোনো কাব্যগ্রন্থ আমার প্রিয়, কিন্তু সমগ্র কবিতা নয়।
উৎপলকুমার বসু সম্পর্কে আলাদাভাবে কিছু বলতে চাইলে বলতে হয়, তাঁর অনেক কবিতা, মুক্তগদ্য অনবদ্য। তাঁর গ্রন্থসমালোচনা একেবারে অন্যরকম, কারও সঙ্গেই মেলে না। তাঁর কিছু অনুবাদ, বিশেষত কান্টের ‘এনলাইটেনমেন্ট’-এর অনুবাদ যতবার পড়ি, ভালো লাগে। এছাড়া একজন মানুষ হিসেবেও তাঁর গুণগ্রাহিতার তুলনা হয় না।
ইমদাদ : শঙ্খ ঘোষ প্রয়াত হয়েছেন। আপনি আপনার বই কবিতাযাপন শঙ্খ ঘোষকে উৎসর্গ করেছিলেন। বাংলা কবিতা ও গদ্যে শঙ্খ ঘোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান কী বলে মনে হয় আপনার?
দীন : শঙ্খ ঘোষকে সরাসরি না-দেখে দস্তুর-অনুয়ায়ী অনুমতি না-নিয়ে আমার কবিতাবিষয়ক গদ্যের বইটি তাঁকে উৎসর্গ করি এবং উৎসর্গপত্রে লিখি : ‘শঙ্খ ঘোষ : আমাদের কালের রাখাল’। শুদ্ধস্বর থেকে প্রকাশিত সেই বইয়ের প্রথম সংস্করণটি একসময় শেষ হয়েছে কিন্তু সেটি তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার সাহস দেখাতে পারিনি। এই উৎসর্গকে আমি একপাক্ষিক শ্রদ্ধার্পণ হিসেবে ভেবেছি, আমার মতো অখ্যাতজনের উৎসর্গে তাঁর কী এসে যায়। কিন্তু চৈতন্য থেকে কবিতাযাপন-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার পর, হয়ত বিস্মিত করার জন্য আমাকে না-জানিয়ে দুঃসাহসী প্রকাশক রাজীব চৌধুরী সেই বইটি শঙ্খ ঘোষের হাতে দিয়ে তার ছবি তুলে যেদিন মেসেঞ্জারে সেই ছবি পাঠালেন সেদিন আমি সভয় শিহরণে কেঁপে উঠলাম। যার গদ্যের শব্দ, বাক্য, বানান, যতি, পর্ব-বিভাজন, এক অনুচ্ছেদ থেকে অন্য অনুচ্ছেদে চলে যাওয়ার যুক্তি ও মুহূর্তগুলি লক্ষ করে প্রতিনিয়ত কিছু-না-কিছু শিখি, তাঁর হাতে বইটি পড়লে এর বহু অসংগতি যে চোখে পড়বে সে তো জানা কথা। সেই বইয়ে আবার তাঁর অল্পালোচিত কবিতা ‘দ্বা সুপর্ণা’ নিয়ে একটি এলোমেলো আলোচনাও আছে।
আর তাঁর কবিতা? আমার ব্যক্তিগত অভিমত, শঙ্খ ঘোষ সেই কবি, যার বহু কবিতা প্রথম পাঠে মনে হয় যেন বুঝতে পারলাম, কিন্তু পরক্ষণে তার অতল ভাবনায়, নিরাভরণ রহস্যের সামনে, নিঃশব্দ হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই। আর তাঁর গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, যে-কোনো ভাষার সাহিত্যে এমন কাব্যগ্রন্থ গণ্ডায় গণ্ডায় সৃষ্টি হয় না।
মানুষ হিসেবে, লেখকদের অভিভাবক হিসেবে, তাঁর গ্রহণযোগ্যতা বিস্ময়কর। একটা সময়ের পর থেকে ওখান থেকে যত উৎকৃষ্ট বই বেরিয়েছে, দেখা গেছে তার অধিকাংশ বইয়ের সঙ্গে, বইয়ের লেখকের সঙ্গে, তাঁর যোগ আছে।
শঙ্খ ঘোষের কাছ থেকে পাওয়া শেষ বিস্ময়কর উপহার : ইকবাল থেকে। ইকবালচর্চায় কোনো বাঙালির পক্ষে এই মূল্যায়ন ও অনুবাদকে অতিক্রম করে-যাওয়া সহজ নয়।
ইমদাদ : আপনি দীর্ঘদিন ধরে বাংলা সাহিত্য পড়াচ্ছেন। একজন কবি বা সৃজনশীল মানুষ হিসেবে একাডেমির গুরুত্ব আপনার কাছে কতটুকু? মানে ঐ প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্যপাঠ কি কোনো শিক্ষার্থীর সংবেদনশীলতাকে নাড়া দিতে পারে?
দীন : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাহিত্য-পড়ানোর পদ্ধতি সম্পর্কে সব যুগেই সমালোচনা ছিল, এখনো আছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে একাডেমির ভেতরে ও বাইরে নানাকথা জারি আছে, কিন্তু বিষয় হলো, এইসব সমালোচনা কোন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নাই। এমনিতে শ্রেণিকক্ষে কিছু কবিতা পড়ানোর সময় তার ব্যাখ্যাতীত বক্তব্য আর সৌন্দর্যের মুখোমুখি হলে শিক্ষকদের সম্পর্কে প্রমথ চৌধুরীর সেই মারাত্মক মন্তব্যের কথাটিও মনে পড়ে। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি পড়ানোর সময় শিক্ষার্থীরা সবিস্ময় তাকিয়ে থাকে, কেউ কেউ বলেও ফেলে যে, অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতা-স্ত্রী-সন্তান সবই যেহেতু আছে তবে লোকটি আত্মহত্যা করে কেন? ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এরই-বা মানে কী? আমি আমার নিজের সামান্য বোধবুদ্ধির সঙ্গে ক্লিন্টন বি সিলিসহ আরও দু-এক জনের ব্যাখ্যা এবং তাঁর নিজের একটি মন্তব্য মিলিয়ে কিছু-একটা বোঝানোর চেষ্টা করি। সেই সঙ্গে এমন অভিজ্ঞতাও তো দুর্লভ নয় যে, ক্লাসে একটি রচনা পড়ানোর পরপরই শিক্ষার্থীদেরকে সেই লেখক এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে আগ্রহী হয়ে লাইব্রেরিতে যেতে দেখেছি। এইসব বিচারে প্রতিষ্ঠানে সাহিত্যপড়ার বিষয়টির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। এছাড়া যে-পরিবার যে-সমাজ শিক্ষার্থীদের জন্য মুক্তভাবে পড়ার পরিবেশ তৈরি করে দিতে পারে না, বা তাদের আগ্রহী করে তুলতে পারে না, সেখানে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখছে বলে মনে করি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বাইরেও আমরা মনোযোগের সঙ্গে ওদুদচর্চা করতে পারলে সংকটকালে দিশা খুঁজে পেতাম।
ইমদাদ : কাজী আবদুল ওদুদ আপনার আগ্রহের চিন্তক। আপনি ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তপোধীর ভট্টাচার্যের তত্ত্বাবধানে তাঁকে নিয়ে পিএইচডি করেছেন। কাজী আবদুল ওদুদের মননবিশ্ব শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন। সেটি পরে বাংলা একাডেমি থেকে বই আকার প্রকাশিত হওয়ার পরে সমাদৃতও হয়েছে। জানতে চাই কাজী আবদুল ওদুদ সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন।
দীন : কাজী আবদুল ওদুদকে নিয়ে যে-অভিসন্দর্ভ আমি লিখেছি সেটি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নির্দিষ্ট সময়ে সম্পন্ন হয়েছে বটে, কিন্তু তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল প্রায় পঁচিশ বছর আগে। সে-আগ্রহ এখনো অব্যাহত। যেসময় থেকে নিজ সম্প্রদায়ের পশ্চাদ্পদতা বিষয়ে উৎকণ্ঠিত হয়েছি, সেই সময় থেকেই কাজী আবদুল ওদুদ এবং বুদ্ধির মুক্তিপন্থী লেখকদের লেখাপত্র পড়ে ঋদ্ধ হয়েছি এবং বহু ক্ষেত্রে স্বস্তি পেয়েছি।
কাজী আবদুল ওদুদের মূল্যায়ন তো আমার বইয়েই আছে, পরে বুদ্ধির মুক্তিপন্থীদের মুখপত্র শিখা নিয়ে লিখেছি, সামনে আরও কিছু লেখার ইচ্ছা রয়েছে। এখানে শুধু এই কথাটুকু বলতে চাই যে, ওদুদের প্রতি আমরা এখনো যথাযথ মনোযোগ দিতে পারিনি। তাঁর চিন্তামূলক বই পড়তে গেলে যে-ধৈর্য ও অভিনিবেশ দরকার তা দিনকে দিন আমরা হারাচ্ছি। তাঁর নিবাচিত সংকলন শাশ্বত বঙ্গ-এর ভূমিকায় তিনি সেই আশংকা প্রকাশ করে গেছেন। তাঁর কবিগুরু গ্যাটে, বাংলার জাগরণ, হজরত মোহাম্মদ ও ইসলাম, রবীন্দ্রকাব্যপাঠ, নজরুল-প্রতিভা, এমনকি তাঁর নির্বাচিত সংকলন শাশ্বত বঙ্গও কি আমরা পড়তে পেরেছি? বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমের বাইরেও আমরা মনোযোগের সঙ্গে ওদুদচর্চা করতে পারলে সংকটকালে দিশা খুঁজে পেতাম। একবার হিন্দু-মুসলমানের মিলনের কথা চিন্তা করে, আরেকবার বাংলার জাগরণ বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ওদুদকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, দুই বারেই শান্তিনিকেতনে যে-ভাষণ দেন ওদুদ, তার কোনো তুলনা হয় না।
ইমদাদ : সাম্প্রতিক কবিতার প্রবণতা নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। ছন্দে কবিতা লেখার একটা প্রবণতা আমরা খেয়াল করছি ইদানীং। বিশেষ করে সনেট। আপনি কি পড়েছেন? পড়ে থাকলে আপনার অভিব্যক্তি জানতে চাই।
দীন : কিছু কিছু চোখে পড়েছে, তাতে ব্যক্তিগতভাবে আমি আনন্দিত। সম্প্রতি জাকির জাফরানের সনেটগ্রন্থ জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় নিয়ে কয়েকটি সদর্থক আলোচনা পড়েছি, এর আগে মজনু শাহর লীলাচূর্ণ, শামীম রেজার হৃদয়লিপি এবং আলতাফ শাহনেওয়াজের আলাদিনের গ্রামে নিয়েও আগ্রহ লক্ষ করেছি। এগুলো ভালো লক্ষণ। শুধু সনেট নয় মাত্রাবৃত্ত ছন্দেও অনেকে লিখছেন। ছন্দে লেখার অভিজ্ঞতা থাকলে অন্য কবির অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা আস্বাদন করার সুযোগ যেমন তৈরি হয় তেমনি কবির নিজেরও উপকার হয়। ছন্দদক্ষ কবির পক্ষে নিশ্ছন্দ কবিতা লেখার যে কিছু ঝুঁকি আছে, তা এড়ানো সহজ।
ইমদাদ : আমাদের মুখের/কবিতার ভাষা বদলে যাচ্ছে/গেছে। ক্রিয়াপদের এই যে ‘করতেছি, খাইতেছি’ রূপ এটা কিন্তু চালু হয়ে গেছে। কিছু কিছু সাধু শব্দও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। ভালো/মন্দ বলছি না। বলছি যে, বিশেষ করে কবিতায় কথা বলার ভাষা চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমরা জানি/শুনি যে, আঘাত করেই ভাষাকে বাঁচাতে হয়। এই আঘাতটা কে করবে? কবিতা/সংবাদপত্র/সিনেমা নাকি অন্যকিছু?
দীন : ভাষাকে নিয়ত সজীব রাখার দায়িত্ব, তা যে-মাধ্যমেই হোক, মূলত লেখকদেরকেই নিতে হয়। কেউ কেউ সচেতনভাবে, আবার কেউ অসচেতনভাবেও সেই কাজটি করেন। ভাষাকে যে আঘাত করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়, কথাটি একসময় আমাদেরকেও খুব আকৃষ্ট করেছিল, আকৃষ্ট করার মতো কথাও বটে, কিন্তু এর জন্য ভাষাব্যবহারকারীকে অশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে হয়, না-হলে জল ভরতে গিয়ে কলস তো হারিয়ে যাবেই, ঘাটে আসার যে-মাধ্যম/অছিলা, শেষপর্যন্ত তা-ও খুইয়ে বসতে হবে। ‘করতেছি’ ‘খাইতেছি’ প্রভৃতি ক্রিয়াপদ ছাড়াও প্রতিদিনের ব্যবহৃত মুখের ভাষাও তো কবিতার বলার-ভাষা হয়ে উঠছে, সমর্থদের কবিতায় সেগুলোও ভালোও লাগছে। এইসব ক্ষেত্রে ভাষা ও বিষয় সবসময় একসঙ্গে হাত-ধরাধরি করে চলতে পারে না, বরং ভাষার চেয়ে বিষয়কে বহুমাত্রায় প্রবল হতে হয়, এবং তখন লেখককে বলে বোঝাতে হয় বেশি। এই সবকিছু মেনে নিয়েই নিশ্চয় একজন লেখক লেখেন, লিখতেই পারেন, তাতে সমস্যার কিছু নাই। পাঠক যখন দেখে লেখাটি তাকে আলোড়িত করছে, তখন সে সহজেই তা মেনে নেয়, যখন দেখবে ভালো লাগছে না, তখনই সন্দেহের চোখে তাকিয়ে খুঁত ধরার চেষ্টা করবে।
ইমদাদ : বিশ্বায়ন শব্দটার সমান্তরালে ‘দেশায়ন’শব্দটি ব্যবহার করতে চাই। ইউনিক সংস্কৃতি/সভ্যতা বলতে এখন কিছু থাকছে না। সারা বিশ্বের সকল সংস্কৃতি ব্লেন্ড হয়ে এক নতুন ধরনের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। নতুন এক সভ্যতা তৈরি হচ্ছে যেন। তেমনি একটা দেশের ভিতরে যে অসংখ্য আঞ্চলিক ভাষা আছে, সেগুলোও কিন্তু আর আঞ্চলিক থাকছে না। এক অঞ্চলের ভাষা মিশে যাচ্ছে অন্য অঞ্চলের ভাষার সাথে। এর ফলেও কি এক নতুন ধরনের কথ্যভাষা তৈরি হচ্ছে, যেটাকে আমরা ভাষার দেশায়ন বা এক-আঞ্চলিকীকরণ বলতে পারি?
দীন : কোনো ভাষা কি কখনো অবিমিশ্র ছিল? যা আপাত নিজস্ব বলে মনে হয়, তা মূলত অগোচর আর অজানা থাকবার কারণেই। পার্বতীচরণ ভট্টাচার্যের মতো যুগপৎ ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতও একই গোত্রভুক্ত এই দুই ভাষার তুল্যমূল্য আলোচনায় প্রত্যাশিতপর্যায়ে এগোতে পারেননি। এমনিতে এখন যে এক অঞ্চলের ভাষা অন্য অঞ্চলের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, তাতে নতুন একধরনের কথ্য ভাষা তৈরি হচ্ছে তা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু এখানে এ-প্রশ্নটাও তো উঠতে পারে যে, এই মিশ্র কথ্য ভাষায় আমরা যে অতিসহজেই কথা বলতে/লিখতে পারছি বা বলার সংকোচ কাটিয়ে উঠছি, তাতে হয়ত বলার সামর্থ্য বাড়ছে, কিন্তু প্রকাশসামর্থ্য কাঙ্ক্ষিতরূপে বাড়ছে কি না। সাক্ষরতার সাফল্যে স্বাক্ষর খুঁজে পাওয়া যাবে কি না, সেই প্রশ্ন এখানে, এই মুহূর্তে নাই-বা উঠল।
ইমদাদ : কবি না হলে কী হতেন বলে মনে হয়?
দীন : ‘কবি হওয়ার জন্য আপনার কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?’—প্রশ্নটা এরকম হলে কিছু আত্মসমালোচনা করা যেত। এখন শ্রেণিকক্ষে যে সাহিত্য পড়াতে পারছি তাতে খুশি। কবিতা লেখার চেষ্টা করেও যেমন শিক্ষক হতে চেয়েছি, চেষ্টা না-করলেও সেই শিক্ষকই হতাম। কীভাবে কীভাবে যেন নানাকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। আমার স্বপ্ন ছিল সারাজীবন অকৃতদার থেকে প্রাকৃতিক পরিবেশে গ্রামের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াব, নিজের মতো করে লেখাপড়া করব, কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। হওয়ার সম্ভাবনাও আর নাই।
ইমদাদ : লেখালেখি বিশেষ করে প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করার স্মৃতি কি মনে পড়ে? কবি হওয়ার পেছনে কী কী বিষয়কে দায়ী করবেন বা অনুপ্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত করবেন?
এখন আমরা যারা কবিতা লিখি, তারা মূলত কবি-চরিত্রে অভিনয় করে চলেছি
দীন : যতদূর মনে পড়ে, জীবনের প্রথম যে-কবিতাটি লিখি সেটি ছিল বিদ্রোহ-ভাবের কবিতা, অচেনা শত্রু তৈরি করে সেটি লিখিত হয়েছিল; এরপর লিখি প্রেমভাবের কবিতা। অনুপ্রেরণার কথা যদি বলতে হয় তাহলে সেই প্রেমের কথাটাই বলতে হবে, বেদনা তীব্র না-হলে, আর যা-ই হোক, ২০০১ সালে অন্তত প্রথম বইটি বের হতে পারত না।
ইমদাদ : ‘কবি হওয়া সহজ নয়’ এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন। সুখ কবি সৃষ্টি করে না। কবি সৃষ্টি করে বেদনা। বেদনায় যিনি কবি, সেই কবিকে আবার সমাজ-সংসারের টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে হয়। দুঃখ পেতে হয়। মানে ডবল দুঃখ। দুঃখে কবি। কবি হয়ে দুঃখ। এমন কোনো অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ে? কবিতা লেখার কারণে দুঃখ পাওয়ার ঘটনা?
দীন : আমাদের প্রাচীন ভারতে যাদেরকে কবি বলা হতো তাদের কথা মনে করেই এই কথাটি বলেছিলাম। এছাড়া সংসার, চাকরি, বন্ধুত্বের অন্যায্য দাবি এবং সমাজ-রাষ্ট্রের প্রতি নিরূপায় আনুগত্য—এতকিছু মেনে, এত এত আপসের মধ্য দিয়ে আর যাই হোক কবি হওয়া যায় না। সে-কারণে আমি নিজেকে কবি বলে পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত। যখন কবিতায় রূপক/প্রতীকনির্ভরতা বেশি ছিল তখনই তো লিখতে পেরেছিলাম ‘রাষ্ট্র ঝুলে আছে শূকরের দাঁতে’ এবং সেটি প্রকাশও করেছি; এখন প্রেমের কবিতার আবরণে অপ্রেমের কবিতা, ক্ষোভের কবিতা লিখতে হয়। এটা কোনো বিনয়ের কথা নয়, এখন আমরা যারা কবিতা লিখি, তারা মূলত কবি-চরিত্রে অভিনয় করে চলেছি। তারপরও যে কবিতা লিখে নির্লজ্জের মতো বইপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই, তা এই আশায় যে, যদি কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো কবিতায় সেই কাঙ্ক্ষিত কবিসত্তার ক্ষণদ্যুতি দেখা যায়।
কবিতা লিখে মাঝে মাঝে দুঃখ পেয়েছি, কখনো কখনো অবজ্ঞাও পেয়েছি, কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে এত ভালোবাসাও পেয়েছি যে, তার কাছে দুঃখও শেষপর্যন্ত আনন্দের সর্বনামে পরিণত হয়েছে।
ইমদাদ : বাউল-ফকিররা আপনার একটি বিশেষ আগ্রহের এলাকা। বিশেষ করে মরমি চিন্তা বা ভাববিশ্ব। আপনি অনেক বাউলের লেখা সম্পাদনা করে নিজ উদ্যোগে বই প্রকাশ করেছেন। আটজন (দ্বিতীয় সংস্করণে নয়জন) বাউল-ফকিরকে নিয়ে আপনার একটি অসাধারণ বই আছে আটকুঠুরি নামে। আপনি লিখেছেন মাটির রসে ভেজা গান নামে আরেকটি চমৎকার বই। সম্পাদনা করেছেন ফকিরি তত্ত্বের অন্যতম আদিগ্রন্থ মুনশি আশ্রফউদ্দিন রচিত ফকির বিলাশ। আপনার লেখায়ও তার ব্যবহার দেখি। আধুনিক কাব্যসাহিত্যের সাথে বাউল-ভাব/গান-এর কোনো যোগসূত্র কি লক্ষ করেন?
দীন : একটি সম্পাদিত বই-ই আমার জীবনের প্রথম প্রকাশিত বই, সেই বইয়ের নাম পরার জমিন, লেখকের নাম মকদ্দস আলম উদাসী। সেই বই যখন বের হয় তখন তো পুরোদমে কবিতা লেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাই অল্প বয়সে যা হয় সামান্য অভিজ্ঞতাই লেখায় প্রবেশের পথ খোঁজে। পরার জমিন সম্পাদনা করতে গিয়ে উদাসীর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা তৈরি হয়। তাঁর মাধ্যমেই এ-অঞ্চলের বাউল-ফকির ও তাঁদের গান ও গানের বিষয়-আশয় সম্পর্কে অবহিত হই, বহু জায়গায় গানের খোঁজে সফরও করেছি। পরিচয় হয় শাহ আবদুল করিম, ফকির সমছুলসহ অনেকের সঙ্গে। এভাবেই গানের বিষয়-অনুষঙ্গ আর বাউল-ফকিরদের সহজ-স্বভাব অসাম্প্রদায়িক জীবনের অনেক কিছুই আমাকে আকৃষ্ট করেছে। তবে এই প্রবণতা আমার লেখার প্রধান কোনো বৈশিষ্ট্য বলে আমি মনে করি না। এ-ক্ষেত্রে আমার লক্ষ্য সম্পর্কেও আমি সচেতন। তবে হ্যাঁ লক্ষ্য ভিন্ন হলেও আধুনিক কাব্যের সঙ্গে এর যোগসূত্র রয়েছে।
ইমদাদ : আধুনিক সাহিত্যের সাথে বাউল-চিন্তাচেতনার মেলবন্ধন কি সম্ভব?
দীন : গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে বাউল চিন্তাধারা থেকে আধুনিক সাহিত্য অনেক কিছুই গ্রহণ করতে পারে। এতে ভাষা ও সাহিত্য উভয়ই সমৃদ্ধ হবে এবং প্রকাশসামর্থ্য বাড়বে।
ইমদাদ : রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কবিতায় সেই অর্থে মরমি চিন্তার প্রকাশ ঘটেনি। বরং তার উল্টোটাই ঘটেছে। সর্ব অর্থেই একপ্রকার নাস্তিচেতনা লক্ষ করা যায়। এটা কি বাংলা কবিতার বিশেষ কোনো দুর্বলতা? আপনি লক্ষ করবেন হাফিজ, রুমি, সাদি কিন্তু বিশ্বে ব্যাপকভাবে পঠিত।
দীন : রবীন্দ্রনাথের পর অমিয় চক্রবর্তী সচেতনভাবে তার চর্চা করেছেন, নজরুল করলেন ওমর খৈয়ামের অনুবাদ, মার্কসবাদের চর্চা করেও হাফিজের অনুবাদ করেছেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের বইয়ের নাম মরমি করাত, তাঁর বিখ্যাত পঙক্তি ‘বন্ধুরা বিদ্রুপ করে তোমাকে বিশ্বাস করি বলে’, শঙ্খ ঘোষ করলেন ইকবাল নিয়ে দৃষ্টান্তযোগ্য কাজ, সৈয়দ শামসুল হক করলেন হাফিজের অনুবাদ, তাই ‘সর্ব অর্থে’ কথাটা মেনে নেওয়া যায় না। তবে, একথা ঠিক এরা এখনো এখানে ব্যাপকভাবে পঠিত নন। এর কারণ, একসময়কার মার্কসবাদী চিন্তার প্রভাব আর অন্যদিকে শরিয়তপন্থীরা যেভাবে এই মহৎ কবিদেরকে কেটেছেঁটে পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছে, তাতে এঁদের প্রতি শিক্ষার্থী ও আমপাঠকের সদর্থ মনোভাব এখনো তৈরি হয়নি। এখন যেহেতু ইংরেজি তরজমা এবং মূল ভাষার পাঠও খুঁজে পাওয়া যায়, তাই এখন অবস্থার পরিবর্তন হবে বলেই আমি আশাবাদী
ইমদাদ : কবির কি কোনো দেশ হয়? জীবনানন্দের কি কোনো দেশ ছিল? জীবিত থাকা অবস্থায় তাঁর প্রকাশিত কবিতাগুলোতে আমরা কোনো দেশ দেখি না। মৃত্যুর পর আবিষ্কৃত ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’য় আমরা শুনলাম সম্পূর্ণ নতুন এক দাশ-কন্ঠস্বর। আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়…
নিজের দেশকে অতিক্রম না-করতে পারলে নিজের কালকেও অতিক্রম করা যায় না
দীন : আর সবার মতো কবিরও যেহেতু জন্মস্থান থাকে সেহেতু তার লেখায় সেই স্থানের প্রভাব থাকবে সেটাই স্বাভাবিক, জীবনানন্দের কবিতায়ও তা আছে, কোনো কোনো লেখায় তা প্রবলভাবেই আছে। ‘দেশ’ কথাটাকে দার্শনিক অর্থে ধরে নিলে, বলতে পারি, কবির নিজের একটি দেশ থাকলেও কবিতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অনুযায়ী শেষপর্যন্ত তিনি নির্দেশ। নিজের দেশকে অতিক্রম না-করতে পারলে নিজের কালকেও অতিক্রম করা যায় না। সেই পরিপ্রেক্ষিত-অনুযায়ী ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ বা ‘রূপসী বাংলা’ যা-ই বলি না কেন, তা নিয়ে জীবনানন্দ দাশের দ্বিধা ছিল। রূপসী বাংলা-য় দেশকাল-অতিক্রমী ব্যঞ্জনা থাকলেও এর স্থানিকতা নিয়ে সকলেই একমত, ব্যাক্তিগত স্মৃতির উল্লেখ কর লেখা পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের একটি প্রবন্ধে এই বিষয়টি সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে, এই স্থানিকতার কারণেই হয়ত জীবনানন্দের মতো উচ্চাশাপ্রবণ কবির দ্বিধা ছিল। রূপসী বাংলার কবিতাগুলি যে-সময়ে লিখেছিলেন জীবনানন্দ, সেইসময়কার অন্য কবিতাগুলি মননসূত্রের কথা বিবেচনায় আনলে এ-কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।
ইমদাদ : পশ্চিমবাংলার কবিতার ভাষাভঙ্গি আর বাংলাদেশর কবিতার ভাষাভঙ্গির মধ্যে কোনো পার্থক্য লক্ষ করেন?
দীন : দুই বাংলার কবিতার ভাষা যে আলাদা, এখন তা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়। এক্ষেত্রে শুধু দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য নয়, এর পেছনে স্থানের/ভূচিত্রের ভূমিকা রয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে সুলক্ষণ।
তবে সেই সঙ্গে, যা আমাদের জীবনব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত নয়, আছে সেরকম কিছু অস্থানের ভূমিকাও। উপযুক্ত ও সাহসী সমালোচনার দৈন্যে সেই প্রবণতা ক্রমশ লাই পাচ্ছে এবং তার অনুসারী তৈরি হচ্ছে। জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদদীন, ফররুখ আহমদ এবং আল মাহমুদ—এই চার কবির কবিতা, তার বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি মুক্তভাবে বিবেচনাশীল থেকে, শিক্ষা নিয়ে, যদি সতর্ক না-হই, তাহলে আমাদের অনেকের কাব্যচর্চা একসময় উৎকেন্দ্রী বিষয়চাতুর্যের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে।
ইমদাদ : কবিতায় মননশীলতা/দার্শনিকতার স্থান কতটুকু/কোথায়?
দীন : কবিতা দর্শনচর্চার জায়গা নয়, কিন্তু কবিতায় দর্শন থাকে। এমনিতে নির্দিষ্ট দর্শন/তত্ত্ব-এর আলোকে যখন কবিতার আলোচনা হয় তখন সেইসব আলোচনা প্রায়ই ব্যর্থ হয়, কারণ কবিতায় কবির নানা ভাবের জটিল/বিজড়িত দর্শন বা দর্শনের ছায়া-প্রচ্ছায়া থাকে।
আর কবিতা কি কখনো মননহীন হয়? কবিতায় সময়-ইতিহাস-নৃ-পুরাণতাড়িত কবির সংবদেনশীল মনন সক্রিয় না-থাকলে কবিতা কাল-অতিক্রমের দাবি করতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ কবির আপাত/দৃশ্যত একটি প্রেমের কবিতায়ও সেই ইঙ্গিত বা যোগসূত্র থাকে বলেই আমরা পড়ে আলোড়িত হই।
ইমদাদ : আপনার অনেক কবিতা, কবিতার পঙক্তি আমাদের মনে পড়ে, আওড়াই। অনেক কবিতা পুরোটা মনে না-পড়লেও ছবি মনে পড়ে। আপনার অনেক কবিতা স্মরণীয়। নিজের কোন কবিতাটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
দীন : কোনো কোনো কবিতার সঙ্গে নিজের নানা স্মৃতি ও গল্প জড়িয়ে আছে বলে মাঝেমধ্যে সেগুলির কথা মনে পড়ে, একটুআধটু পড়েও দেখি, এর বাইরে কোন কবিতা সবচেয়ে প্রিয় সে-বিষয়ে আলাদাভাবে চিন্তা করিনি।
ইমদাদ : আপনার এ-পর্যন্ত প্রকাশিত নিজের প্রিয় বই কোনটি?
দীন : প্রত্যেকটি বইয়ের কিছু কবিতার প্রতি সাময়িক আগ্রহ তৈরি হয়, কিন্তু কোনো বই-ই স্বপ্নের মতো পূর্ণাঙ্গ মনে হয় না। প্রতিবারই ভাবি, সময় নিয়ে ভালোভাবে বেছে-বুঝে এমন একটি বই করব যেটিকে প্রিয় বই বলতে পারব, কিন্তু শেষপর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠে না। হয়ত এই অতৃপ্তির মধ্য দিয়ে জীবন শেষ হয়ে যাবে।
ইমদাদ : বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের কাদের লেখা আপনাকে আকৃষ্ট করে?
দীন : কোনো কবিরই সব কবিতা বা অধিকাংশ কবিতা শেষপর্যন্ত আর পছন্দের তালিকায় থাকে না। একেকটি গুচ্ছের মধ্যে একটি-দুটি কবিতা বা একটি কবিতার একটি পঙক্তিও যদি ভালো লাগে, তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। আমি আমার এইসব পছন্দের কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে লিখেছি, ভবিষ্যতেও আরও লেখার ইচ্ছা আছে, আমি নাম বলায় অনাগ্রহী, কবিতার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আগ্রহী।
ইমদাদ : লেখার সময়/সুযোগ সবই সংকীর্ণ হয়ে আসছে। দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে কখন লিখেন বা পড়েন?
দীন : চাকরিবাকরি এবং সাংসারিক দায়িত্বের বাইরে বাকি সময় এটা-ওটা পড়েই কাটে। সন্ধ্যা থেকে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত যেহেতু এটুকুই সময়, এবং যেহেতু অন্য-কোনো সঙ্গ বা সঙ্ঘের তাড়না নাই, তাই এখানেও কিন্তু সময় একদম কম না। গদ্য বেশির ভাগই সম্পাদকদের তাড়নায় লিখি, তাই যখন লিখতে শুরু করি তখন ঘুমের সময় কমাই এবং পড়াও হয় কম। তবে কবিতা লেখার জন্য কোনো নির্দিষ্ট সময়ের যে দরকার পড়ে না, এটাই সবচেয়ে স্বস্তির কথা।
ইমদাদ : আপনার প্রিয় লেখক ও কবিদের নাম জানতে চাই, দেশে ও বিদেশে।
দীন : এর উত্তর আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। আমার অসংখ্য প্রিয় লেখা আছে, কিন্তু প্রিয় লেখক নাই। কাউকে প্রিয় বলে তার নিরঞ্জনত্ব নিরূপণের জন্য অহেতু আস্ফালন করতে রুচিতে বাধে।
ইমদাদ : কোন বইটি বারবার পড়েন?
দীন : ইচ্ছে থাকলেও বই এখন আর বারবার পড়া হয় না, তবে কিছু ধ্রুপদী বইয়ের নানা অংশ মাঝে মাঝে পড়তে হয়, না-পড়ে উপায় থাকে না। আসলে এত এত আগ্রহের বই এখন সহজে পেয়ে যাচ্ছি যে, সেগুলোই পড়েই সময় চলে যায়, অন্য দিকে তাকানোর ফুরসতই হয় না।
কবিতার নিহিত বাস্তবতা তো, অন্য পাঠকের কাছে, এক অর্থে, রূপকই
ইমদাদ : কবিতাযাপন নামের আপনার অসাধারণ গদ্যের বইটি পড়ে কবিতাকে দেখার, কবিতা পড়ার ধরন পাল্টে যায় পাঠকের। আপনার নিজস্ব কবিতাযাপন নিয়ে যদি কিছু বলেন।
দীন : আমি কৃতজ্ঞ যে কবিতাযাপন বইটি নিয়ে একসময় তুমি উত্তরাধিকার-এ দীর্ঘ আলোচনা লিখেছিলে। আসলে অন্য সময়ে যা-ই করি না করি না কেন, পঠিত কবিতার ভাব-ব্যঞ্জনা নিয়ে কারও সঙ্গে বারবার আলাপ না-করে বা সে-বিষয়ে কোনো জায়গায় না-লেখার আগ পর্যন্ত আর স্বস্তি পাওয়া যায় না। এই বইটির বেশির ভাগ লেখা সেই তাড়না থেইে লেখা। আমার কবিতাযাপনও তো তা-ই। এর বাইরে নিজের কবিতা-বিষয়ে একা একা যা ভাবি, তাও মাঝে মাঝে কোনো-না-কোনো সময় কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। সে-কারণে আমার কবিতাবিষয়ক কবিতার পরিমাণও একেবারে কম না। এর বাইরে নিজের রন্ধনশালার ছবি বাইরে প্রদর্শন করতে ভালো লাগে না আমার।
ইমদাদ : আপনার প্রথম বই কথা ও হাড়ের বেদনা-র প্রথম কবিতা ‘জন্মলজ্জা’। কবিতাটির ‘কবিতার মুহূর্ত’ জানতে চাই।
দীন : ‘জন্মলজ্জা’ কবিতার জন্ম নিয়ে আমার নিজের একটা গোপন অপরাধবোধ আছে বলে তার জন্মমুহূর্ত নিয়ে একবার বিস্তারিত লেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষা না-দিয়ে একাডেমিক লেখাপড়া চাঙে তুলে নানা বাহানায় কয়েক বছর গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে মাঝে মাঝে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি আর বই-কেনার জন্য মাসে দু-একবার সিলেটে যাওয়া ছাড়া প্রায় পুরোসময় বাড়ির চিলেকোঠায়ই কাটাচ্ছি। এতে মায়ের যে প্রশ্রয় ছিল না, তা নয়, তবু, এখানে-বলা-যাবে-না এমনই এক কারণে এক ঝিম-মারা দুপুরে তীব্র অভিমানবশত একটানে কবিতাটি লিখে ফেলি। কিন্তু পরে জানতে পারি, যে-অভিমানে কবিতাটি লিখিত, তা সত্য নয়, এতে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। অর্থাৎ পুরো কবিতাটির সত্য দাঁড়িয়ে আছে একটি মিথ্যে সত্যের উপরে। তখন ভাবি কবিতাটি চিরতরে বাতিল করব। কিন্তু ইতোমধ্যে যে-পত্রিকায় কবিতাটি ছাপা হওয়ার কথা—লিয়াকত শাহ ফরিদীর সম্পাদিত নির্ব্যাজ—তার পেস্টিং হয়ে গেছে। কিন্তু পেস্টিং হওয়ার পরও যখন দেখলাম মাসের পর মাস যাচ্ছে পত্রিকাটি আর বের হচ্ছে না, ভাবলাম, বাঁচা গেল। শেষমেশ বন্ধু আহমদ মিনহাজ ও টি. এম. আহমেদ কায়সার ‘জন্মলজ্জা’ সহ অন্য কবিতাগুলো হাবিবুররহমান এনার সম্পাদিত খোয়াব-এ নিয়ে এল, আর আমিও সে-যুগের যোগাযোগের অসুবিধার কারণে কবিতাটিকে আর সরানোর সুযোগ পাইনি। তাই, খোয়াব-এ তো ছাপা হলোই, পরে শুভেন্দু ইমাম ও আহমদ মিনহাজের পরামর্শে বইয়ের প্রথমেই রাখা হলো কবিতাটি, সেই সূত্রে কবিতাসংগ্রহ-এর শুরুতেও। আজ এতদিন পরে মনে মনে সান্ত্বনা এটুকুই যে, এখনো তো মায়ের সঙ্গেই আছি, প্রতিদিনই ভালোবাসছি, অভিমান করছি, মা কি আর এসব কিছু কখনো মনে রাখেন?
এছাড়া, কবিতার নিহিত বাস্তবতা তো, অন্য পাঠকের কাছে, এক অর্থে, রূপকই।
ইমদাদ : নতুন কবিদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
দীন : আমিও তো নতুনই, যা আগে ছাপা হয়ে গেছে তা-তো এক অর্থে বাতিলই, তাই নিজের উদ্দেশে নিজে কিছু নাই-বা বললাম। অথর্ব হয়ে গেলে, কেউ কখনো লেখা না-ছাপতে চাইলে, সেই দুরবস্থার কথা না হয় তখন বলা যাবে।
ইমদাদ : অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।