কবি মরে না। আপন মাহমুদ নেই। তার কবিতা আছে। থাকবে। আপন মাহমুদ কবিতাতেই বেঁচে থাকবেন। ১৯৭৬ সালের পহেলা জানুয়ারি কবি আপন মাহমুদের জন্ম। লক্ষীপুর জেলায়। পেশায় সাংবাদিক এই কবি ২০১২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম দশকের কবি আপন মাহমুদের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ একটিই; ‘সকালের দাড়িকমা’। বইটির প্রকাশক কথা প্রকাশ। চতুর্থ মৃত্যুবাষির্কে দশটি কবিতা পুনঃপ্রকাশ করে কবিকে স্মরণ করার এই ছোট্ট প্রয়াস।
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া
মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে
শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি
মা, পৃথিবীর যেকোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা
যায় না— তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার
ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রঙের আকুতি— রঙের
সেই অপচয় ঘোচাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিলো পৃথিবীর আর
সব প্রজাপতির
মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে! অথচ, তার মুুখের দিকে
তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নি— জীবনে একটাও প্রজাপতি তার
খোঁপায় বসেছে।
দুই
গোলাপ অথবা চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল
জানি না— তবে কোনো এক শীতসকালে ঘরের পেছনে অকারণে
ফুটে থাকা কিছু ঘাসফুলের সঙ্গে মা আমার আলাপ করে দিয়ে
বলেছিলেন,‘ জীবনের যত কফ-থুথু আর উড়াল হারানোর
বেদনা আমি জমা রেখেছি এই ঘাসফুলের কাছে, এমনকি প্রসব
বেদনাও —সেই থেকে যেকোনো নীল ঘাসফুলই আমার মায়ের
প্রতিনিধিত্ব করে— যার আজো কোনো বাজারমূল্য নেই
এখনো শীত আসে পৃথিবীতে, আসে বসন্ত— গোলাপ অথবা
চন্দ্রমল্লিকারাও এখনো আলতা পরে পায়ে— তবু পৃথিবীর যত
খুন, প্রতারণা আর ব্যর্থ-প্রেমের কবিতা নিয়ে আমি সেই
ঘাসফুলের কাছেই যাই
চোখ বন্ধ করে একটু দাঁড়াই…
তিন
আমার জন্মের রাতে একটাও নক্ষত্র খসে পড়েনি মাটিতে— যদিও
আপন-আকাশ ভুলে মা আমাকেই তুলে ধরেছিলেন তার প্রার্থনার
করতলে— প্রার্থনা শেষে মা আজো চোখ মোছেন— যে চোখে খুব
কাছের নক্ষত্রটাকেও ঝাঁপসা দেখায়!
বাবা রাজমিস্ত্রি, দাদি আত্মহত্যা করেছেন পেটের পীড়ায়— তবু
আমার কখনো সাব-কন্ট্রাক্টর কিংবা এলএমএফ ডাক্তার হতে ইচ্ছে
করেনি— বরং নক্ষত্র হতে না-পারার অহেতুক বেদনা নিয়ে আমি
আজো বেজে চলেছি সেই বেহালাবাদকের আঙুলে— ঘনকুয়াশার
দিকে নিরন্তর হেঁটে যাওয়া যার অমোঘ নিয়তি
আমার জন্মধ্বনিতে কাঁপেনি আকাশ— উৎসবের একটাও বাতি
যায়নি নিভে— কেবল কোকিল, কোকিল উড়ে গেছে দূরে…
চার
মা, তোমার বেজারমুখের প্রতিবেশী আমি এক চুপচাপ বালক— নিজেকে
হারিয়ে ফেলেছি সেই কবে, নবম শ্রেণীতে— নিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছি
সেই কবে, জিল্লাল মিয়ার দিঘিতে— এখনো আনানসির মতো ঘুরছি
দ্যাখো, বন্ধুর লোভে…
মা, তোমার প্রসববেদনা থেকে সেই কবে পথের শুরু— হাঁটতে
হাঁটতে পৃথিবী দুপুর হয়ে গেছে— তবু, বন্ধুর মতো কোনো ছায়া
নেই চারপাশে— বটের ছায়াও কিনতে পাওয়া যায় না বাজারে।
পাঁচ
মায়ের কপালের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উৎকণ্ঠাটুকু নিয়ে এসেছি
আমারও নামের পাশে লেখা যেতে পারে ‘সম্ভাবনা’— সম্ভাবনার
যে দ্বার লাঙলের খুলবার কথা— তার দরোজায় আজো বসে
আছেন বাবা— যার ঘোলাটে চোখে এখনো থকথক করছে
কাদাপানির সংশয়, আড়ষ্টতা…
আড়ষ্টতার হাত ধরে কতদূর যাবে মায়ের বোবা ছেলেগুলো!
আমারও উদ্দেশ্য ছিল দূর— অথচ, ঘরের কাছেই বুনোফুল দেখে
থমকে দাঁড়াতে হলো— দাঁড়িয়ে আছি
শুনেছি, দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে আসে।
ছয়
স্বপ্ন থেকে মাইল খানেক দূরে আমাদের ঘুড়ি উড়ছিল— ঘুড়িতে
আঁকা ছিল চোখ— চোখে ছিল বোকা চাউনি— শেষবার নারী
থেকে বেরিয়ে আসার পথে মায়ের সঙ্গে দেখা— মা তখনো
বাবা ও তার সম্পর্কের দূরত্ব মাপছিলেন— মাপছিলেন
সংসার নিয়ে দেখা তার প্রথম ও শেষ স্বপ্নের পরিধি— জানি না,
মায়ের সমূহ-স্বপ্নের যোগফল কত। তবু কলসি কাঁখে
কোনো এক মৃত পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের ছবি— আমাকেই
তাড়া করে— আমাকেই পিপাসাবার্তা পাঠায়!
আমি আছি সেই সব মেঘের দিকে তাকিয়ে— বৃষ্টি না হয়ে
যারা কেবল মেঘদূত হতে ভালোবাসে।
সাত
আমার মায়ের মুখ মনে করে পৃথিবীতে শ্মশান
নেমে আসে— চিড়িয়াখানার হরিণশূন্য খাঁচাটিও
এগিয়ে আসে কাছে— আমি বরফ-রাজ্যের সর্বশেষ
অধিপতির মতো পায়ের তালুতে হাত রেখে মেপে
নিই পথ— বুঝে নিই প্রশান্তি ও মৃত্যুর তফাত
ভাবি, এবার আত্মমুখী বন্ধুরা এলে বলবো : তোমাদের
জন্য রয়েছে অবারিত শ্মশান আর গোরখোদকের
ভাবলেশহীন হাসি— যে যার পাওনা বুঝে নিতে পারো।
আট
মায়ের মুখ মনে এলে নিজেকে রক্ষকশূন্য গোলবার মনে
হয়— মনে হয় সব কটি গোলই হয়ে যাচ্ছে— কিছুতেই
ঠেকাতে পারছি না— অথচ, রেফারির বাঁশি যে পক্ষেই
বাজুক তারই জেতার কথা
হার-জিত প্রসঙ্গে ইদানীং মা খুব একটা কথা বলেন না,
মাঝেমাঝে দূর দীর্ঘশ্বাসের পালক ঝরাতে ঝরাতে
বলেন, ‘যারা জিততে জিততে জিততে ভুলে গেছে— যারা
হারতে হারতে হারতে ভুলে গেছে— তাদের সবার উচ্চতাই
সমান’
মানুষের উচ্চতা সমান ভেবেই আমাদের গান শুরু করার
কথা— অথচ রেফারির বাঁশি কেবল জেতাবার জন্যই
বাজে— হারাবার জন্যই বাজে!
নয়
মায়ের পান-খাওয়া ঠোঁটে যেদিন অনেক ভ্রমরের কাতরতা
ছিলো —সেদিনও বাবা বিড়ির আগুনে সেলাই করছিলেন
কোনো এক বিধবার সাদাশাড়ি—বিধবার শাড়ি থেকে ছড়ানো
মেঘে আর যাদের আকাশে উঠেছিলো ঝড় — আর যারা
হারিয়েছিলো প্রজাপতি-শৈশব— তাদের কেউ কেউ আমার
বন্ধু— বন্ধুদের কেউ মায়ের কাছে থাকে— কেউ হোস্টেলে,
কেউ বা হতাশার মোড় থেকে প্রায়ই আত্মহত্যার দুয়ার পর্যন্ত
যাওয়া-আসা করে— অথচ, এসব দেখেও এখনো কোনো
কোনো বাবা মায়েদের লাল ঠোঁট উপেক্ষা করে!
আমরা মাঝেমধ্যেই রাধার বাঁধভাঙা ব্যাকুলতা নিয়ে কথা
বলি— কথা বলি মানুষের নগ্ন হবার সহজাত প্রবণতা
নিয়ে— যদিও আমাদের কারো জানা নেই, কৃষ্ণ ও তার
বাঁশির মধ্যে কে বেশি প্রভাবক।
দশ
পাতা ঝরার শব্দ হতে ফুল ফোটার শব্দ পর্যন্ত হেঁটে
যেতে হবে— এরকমই ইঙ্গিত ছিল হাতের— হাত ছিল
নিজের কাঁধে—কাঁধে ঝুলে ছিল ব্যাগ— ব্যাগে ছিল
মায়ের ছবি— মায়ের ছিল তাকিয়ে থাকা— তাকিয়ে
থাকা মানে বয়ে যাওয়া নদী
মা আমার যাচ্ছেন বয়ে, নিরবধি…