মাঠটা পেরিয়ে যখন আমার বাবা ফিরে আসছিলেন, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া ছেলেটা ছিলো তাঁরই কোলে। বাবার সাথে আরও কয়েকজন ছিলেন, ছেলেটার খোঁজে বেরিয়েছিলেন তারাও, কিন্তু আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে, আমার বাবাই মৃত ছেলেটাকে কোলে করে নিয়ে আসছিলেন। সবার কাদা মাখা শরীরগুলো খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো, প্রত্যেকে মাথা নিচু করে লজ্জিত একটা ভঙ্গি করে হেঁটে আসছিলো আমাদের বাড়ির দিকে। কয়েক ঘন্টা আগে ছেলেটার খোঁজে বের হওয়ার সময় যে কুকুরগুলো খুব চেঁচামেচি করছিলো, নদীর ঠান্ডা পানিতে ভিজে তারাও কেমন নেতিয়ে পড়েছিলো। খোঁজে বের হওয়া লোকগুলোও তাই, যখন বের হচ্ছিলো সবার মধ্যে ছিলো চাপা উত্তেজনা, চেহারায় দৃঢ সংকল্পের ছাপ। তাদের উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিলো পুরো পরিবেশটায়, যেন বোঝাই যাচ্ছিলো কোন দুঃসংবাদের খোঁজেই তারা বেরোচ্ছে।
ছেলেটার নাম ছিলো স্টিভ গ’লি, আট বছর বয়স। কাদা লেগে ওর চুল আর জামা মেটে রঙের হয়ে গিয়েছিলো, তখনও ওর শরীরের এখানে ওখানে গাছের মরা পাতা, ঘাস আর শ্যাওলা লেগে ছিলো। ওকে দেখাচ্ছিলো সমস্ত শীতকাল জুড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা একটা পুরোনো ফার্নিচারের মতন। ওর চেহারা দেখতে পাচ্ছিলাম না আমি, আমার বাবার বুকের দিকে ওর মুখটা ফেরানো ছিলো, কিন্তু যতদূর মনে পড়ে ওর নাকটা আর একটা কান আমি দেখতে পেয়েছিলাম, শ্যাওলা ঢুকে সবুজ হয়ে আছে।
আমি জানি না। আমি জানি না, আসলেই এত কিছু আমি দেখেছিলাম কিনা। আমার বাবা ছেলেটাকে কোলে করে নিয়ে আসছেন, তার পিছু পিছু আসছে বাকী লোকেরা আর কুকুরগুলো, এটুক দেখা পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু মৃত ছেলেটার এত কাছে গিয়ে তার নাকের ভিতর লেগে থাকা শ্যাওলা কাদা দেখাটা বিশ্বাসযোগ্য না, আমাকে মৃতদেহের এতটা কাছে যেতে দেওয়ার কথা না। হয়তো কারও কাছে শুনে, নিজেই দেখেছি কল্পনা করে নিয়েছি। মৃত স্টিভ গ’লির এটুক স্মৃতিই আমার মাথায় এখনও বেঁচে আছে- নাকের ভিতর ঢুকে থাকা ঐ সামান্য শ্যাওলা-কাদা; ওর চেহারার কথা ভাবলে স্টিভের বেঁচে থাকবার সময়ের মুখটাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তীক্ষ্ণ আর ধূর্ত চেহারার চিরচেনা স্টিভ গ’লি। মরে যাওয়ার পর তখন নিশ্চয়ই ওর চেহারাটা অতটা স্বাভাবিক ছিলো না। এতক্ষণ পানির নিচে পড়ে থেকে পুরো শরীরটাই নিশ্চয়ই ফুলে উঠেছিলো।
ছেলের ফিরে আসবার জন্য প্রতীক্ষারত পরিবার, বিশেষ করে তার মায়ের কাছে ছেলের মৃত্যু সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বের অসহ্য ভারই যে কারও হাঁটার গতি ধীর করার জন্য যথেষ্ট, কিন্তু সেদিনকার ব্যাপারটা, মৃতদেহ নিয়ে ফিরতে থাকা লোকগুলোর জন্য ছিলো আরও বেশি কঠিন। সেদিন স্টিভ গ’লির মৃতদেহ গ্রহণ করে, যেকোন মৃতদেহের প্রাপ্য শোক প্রকাশের জন্য কোন মা কিংবা অন্য কোন মেয়ে মানুষই ছিলো না সেখানে। মা-খালা, বোন, দাদী-নানী কেউই না। স্টিভের বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক, ভাড়ায় কায়িক শ্রম খাটতেন। মদ খেতেন প্রচুর, কিন্তু পাঁড় মাতাল বলতে যা বোঝায় তেমন ছিলেন না। একটু অস্বাভাবিক ধরণের লোক ছিলেন, কিন্তু মানুষকে মজা দেওয়ার মতন পাগলামিও করতেন না কোনরকম। কারও সাথেই খুব বন্ধুত্ব ছিলো না তার, আবার ঝামেলাও করতেন না কারও সাথে। তিনি যে একটা ছেলের বাবা, এ ব্যাপারটাই তার সাথে বেখাপ্পা লাগতো কেমন যেন। সত্যি বলতে, স্টিভের মা চলে যাওয়ার পর বাপ-ছেলে দু’জন যে একই ছাদের নিচে বাস করতো এই ব্যাপারটাই স্বাভাবিক মনে হতো না কারও কাছে। প্রায় কুঁড়েঘরের মতন একটা বাড়িতে এখানে-ওখানে মেরামত করে তারা দু’জন থাকতো। দু’জন কখনোই একসাথে খাওয়া-দাওয়া করতো না, এমনকি একজন আরেকজনের জন্য রান্নাও করতো না, কিন্তু তিনবেলা খাওয়ার মতন খাবার ঠিকই থাকতো তাদের ঘরে। মাঝে মাঝে স্টিভের বাবা ওকে খাবার কিনে আনতে দোকানে পাঠাতো, দোকানে গেলে দেখতে পেতাম স্টিভ প্যানকেক কিংবা ম্যাকারনি কিনছে।
স্টিভ গ’লিকে আমি বেশ ভালোভাবেই চিনতাম। যতটা না পছন্দ করতাম, তার চেয়ে ওকে অপছন্দই করতাম বেশি। আমার চেয়ে দু’বছরের বড় ছিলো বয়সে। প্রায়ই শনিবার সকালে আমাদের বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। আমার প্রতিটা খেলায় বিরক্ত হতো, কিন্তু আমাকে রেখে চলেও যেতো না। ও ধাক্কা না দিলে দোলনায় দোল খেতে পারতাম না, ওকে ধাক্কা দিতে বললে মাঝে মাঝে এসে এমন জোরে ধাক্কা দিতো যেন পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙে আমার। আমাদের কুকুরটাকেও কোন কারণ ছাড়াই ক্ষ্যাপাতে থাকতো। ইচ্ছে করেই আমাকে বিপদে ফেলতে চাইতো। আমাকে দিয়ে এমন সব কাজ করিয়ে নিতো যে ও সাথে না থাকলে যেগুলো করার চিন্তাও হয়তো আমি করতাম না। ওর কথা শুনে আমাদের আলুর বাগান থেকে মাটি খুঁড়ে আলু বের করে দেখতাম ওগুলো কত বড় হয়েছে, ওরই পাল্লায় পড়ে ফায়ারপ্লেসে দেওয়ার জন্য রাখা কাঠ বাড়ির উঠোনে নিয়ে এসে জমা করতাম যেন কাঠের স্তুপের উপর উঠে সেখান থেকে নিচে লাফ দিতে পারি। স্কুলে কিন্তু আমরা একজন আরেকজনের সাথে কথা বলতাম না। বেশিরভাগ সময় একাই থাকতো ও, কারও সাথে তেমন মিশতো না। শনিবার সকালবেলায় যখন দেখতাম ওর রোগা পাতলা শরীরটা আমাদের বাড়ির সামনের বেড়ার ফোঁকর দিয়ে বের করে আনছে, তখনই বুঝে নিতাম একটু পর কিছু একটা ঘটতে চলেছে, কী ঘটবে সেটা ঠিক করবে স্টিভই, আর বেশিরভাগ সময়ই ও মজার কিছুই ঘটাতো। আমরা হয়তো কখনো রাখাল সাজতাম, বুনো ঘোড়াদের পোষ মানানো যাদের কাজ। স্টিভ নদীর যে জায়গাটায় ডুবে গিয়েছিলো, তার কাছেই নদীর পাড়ে আমরা খেলতাম। সে খেলায় অশ্ব এবং অশ্বারোহী আমরা নিজেরাই হতাম, দক্ষিণ ওন্টারিওর এক নামহীন নদীর ধারে, অশ্বের মতন চিঁহি ডাক কিংবা অশ্বারোহীর মতন চিৎকার দিতে দিতে আর গাছ থেকে কেটে নেওয়া কোন ডালকে তলোয়ার বানিয়ে নিয়ে বাতাসে ঘোরাতে ঘোরাতে খেলতাম আমরা দু’জন।
স্টিভের শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটা আমাদের বাড়িতেই হয়েছিলো। এত লোককে বসানোর মত জায়গা ছিলো না স্টিভদের বাড়িতে। আমার স্মৃতিতে এখনও সেদিনের ঘর-ভর্তি লোকের ছবি গেঁথে আছে। কিন্তু স্টিভের কফিন, কোন যাজক এসেছিলেন অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে কিংবা ফুলের ডালা কোথায় রাখা হয়েছিলো এগুলোর কিছুই মনে নেই। ঘরের এক কোনায় আমি একটা শাদা ড্যাফোডিল ফুল হাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাগানে বোধহয় তখনও গাঁদা ফুল ধরেনি। আমার সাথে আরও কয়েকটা বাচ্চা ছিলো, প্রত্যেকের হাতেই একটা করে ড্যাফোডিল। আমরা সকলে মিলে বাচ্চাদের একটা স্তবসঙ্গীত গাইলাম। কেউ একজন পিয়ানোতে সুরটা তুলেছিলো, “কখন আসবেন ত্রাতা, কখন আসবেন তিনি”। একজোড়া শাদা মোজা পরেছিলাম আমি, সেই মোজার ঘষায় পায়ের গোড়ালিতে খুব চুলকোচ্ছিলো। আমার স্মৃতিতে পায়ের ঐ খচখচে অনুভূতিটার সঙ্গে আরও একটা অনুভূতি মিশে আছে। অনুভূতিটা ঠিক কেমন তা লিখে বোঝানো কঠিন। আমার বাবা-মার প্রতি কেমন একটা বোধ হচ্ছিলো আমার, শুধু আমার বাবা-মা’র প্রতিই নয়, ওখানে উপস্থিত সমস্ত বয়স্ক লোকদের প্রতিও, কেবল আমার নিজের বাবা-মা’র প্রতি একটু বিশেষভাবে। সেই বাবা, যিনি সেদিন স্টিভের মৃতদেহটা নদী থেকে বয়ে নিয়ে এসেছিলেন, আর আমার মা, যিনি সেদিনের শেষকৃত্যানুষ্ঠান পুরোটা আয়োজন করেছিলেন। অনুষ্ঠানে আমার বাবা পরেছিলেন একটা গাঢ় নীল রঙের স্যুট আর মা পরেছিলেন বাদামি রঙের ভেলভেট ড্রেস। তারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে স্তবসঙ্গীতের সাথে ঠোঁট নাড়ছিলেন, আর আমি তাদের থেকে দূরে, সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে, বাচ্চাদের সারিতে দাঁড়িয়ে তাদের দেখছিলাম। ঠিক তখনই ওদের দু’জনের প্রতি আমার প্রচণ্ড একটা রাগের বোধ হলো। সব বাচ্চাদেরই বোধহয় কখনো কখনো বড়দের প্রতি তীব্র ঘৃণার একটা বোধ হয়- বড়দের বিশাল আকার, বিকট গঠন আর তাদের প্রবল ক্ষমতার প্রতি। এমনকি তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, তাদের স্থূল আর লোমশ শরীরের প্রতিও। কিন্তু আমার সেদিনের অনুভূতিটা ছিলো এসবের চেয়েও বেশি কিছু। যে প্রচণ্ড রাগ আমার ভিতরে অনুভব করছিলাম তা যেন অন্য কোন জগৎ থেকে উঠে আসা। শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে এসেও অনুভূতিটা আমাকে ছেড়ে যায়নি। এখনও সেদিনকার সেই অনুভূতি কাউকে বোঝানো আমার পক্ষে কঠিন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সে প্রচণ্ড অনুভূতি অন্য কোন ভারী অনুভূতির নিচে চাপা পড়ে গেছে, তবে মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা সন্দেহের মতন মাঝে মাঝে তার স্বাদ, চকিত একটা গন্ধ টের পাই এখনো।
***
বিশ বছর কিংবা তারও কিছু পর, আমার স্বামী অ্যান্ড্রু এবং আমি একটা নতুন গাড়ি কিনি, আমাদের কেনা প্রথম ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি। অয়েস্টার কালারের মরিস অক্সফোর্ড কার, ছোট, কিন্তু অ্যান্ড্রু, আমি আর আমাদের দুই মেয়ের বসার জন্য যথেষ্ট। আমাদের বড় মেয়ে সিনথিয়ার বয়স তখন ছয়, আর ছোট মেয়ে মেগের সাড়ে তিন।
আমাকে গাড়ির পাশে দাঁড় করিয়ে অ্যান্ড্রু আমার ছবি তুললো। শাদা শার্ট, কালো টার্টলনেক সোয়েটার আর চোখে সানগ্লাস পরেছিলাম আমি সেদিন। ছবি তোলার সময় গাড়ির দরজার পাশে কোমরটা বাঁকা করে এমনভাবে দাঁড়ালাম যেন নিজেকে আরেকটু স্লিম দেখায়।
“চমৎকার,” অ্যান্ড্রু বললো, “দারুণ, একেবারে জ্যাক কেনেডির মতন দেখাচ্ছে তোমাকে!” যে সময়ের কথা বলছি, তখন স্লিম ফিগারের কোন মেয়ে একটু স্টাইলিশ জামা পরলেই বোধহয় তাকে জ্যাক কেনেডির মতন দেখাচ্ছে বলা হতো।
অ্যান্ড্রু অনেকগুলো ছবি তুললো- আমার, বাচ্চাদের, আমাদের বাড়িটার, বাড়ির সামনের বাগানের, আমাদের সবকিছুর। ছবি তোলার বাতিক ছিলো ওর, আর ছবি তোলার পরই ওগুলোর এক কপি ওন্টারিওতে ওর মা আর খালার কাছে পাঠাতো। আমার বাবাও তখন ওন্টারিওতেই থাকতেন, উনাকে পাঠানোর জন্য আমাকেও ছবি দিতো ও। আমিও পাঠাতাম, কিন্তু ওর মতন এত ঘনঘন না। ও যখন দেখতো ওর দেওয়া ছবি পাঠাইনি, বাড়ির এখানে-সেখানে পড়ে আছে, বিরক্ত হয়ে যেতো। আত্মীয়-স্বজনের কাছে ছবি, কার্ড দেওয়া টাইপের সামাজিকতা করতে পছন্দ করতো ও।
সেই গ্রীষ্মে আমরা কোন ছবি তাদের কাছে পাঠালাম না, নিজেরাই রওনা দিলাম। আমাদের নতুন গাড়িতে করে ভ্যাঙ্কুভার থেকে রওনা দিলাম সেই ওন্টারিওর পথে যাকে আমরা তখনও ‘আমাদের বাড়ি’ বলে ডাকতাম। ভ্যাঙ্কুভার থেকে যেতে-আসতে আমাদের লাগবে পাঁচ আর পাঁচ দশদিন, আর ওন্টারিওতে থাকবো মোট দশদিন। চাকুরিতে ঢোকার পর সেবারই প্রথম অ্যান্ড্রু অফিস থেকে তিন সপ্তাহের লম্বা ছুটি পেয়েছিলো। ও তখন বি.সি. হাইড্রোর লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতো।
সেদিন ছিলো শনিবার, সাত সকালেই আমরা বিশাল একটা স্যুটকেস, কফি আর লেমোনেড ভর্তি দু’টা থার্মোফ্লাক্স, পথে খাওয়ার জন্য কিছু ফলমূল আর স্যান্ডউইচ, বাচ্চাদের ছবির বই, ছবি আঁকার ক্রেয়ন, ড্রয়িং প্যাড, পোকা মারার ওষুধ, কয়েকটা সোয়েটার (পাহাড়ে যদি ঠাণ্ডা পরে ভেবে) আর আমাদের দুই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে চেপে বসলাম। অ্যান্ড্রু বাসায় তালা লাগিয়ে দিলো। সিনথিয়া গলায় ফুর্তিভাব এনে চেঁচিয়ে উঠলো, “ বিদায় বাসা!”
ওর পাশে বসা মেগও বললো, “বিদায় বাসা।” তারপর জিজ্ঞেস করলো, “এখন থেকে কোথায় থাকবো আমরা?”
“আমরা একেবারের জন্য চলে যাচ্ছি না এখান থেকে,”সিনথিয়া জবাব দিলো ওকে, “বেড়ানো শেষ হলে আবার এখানে ফিরে আসবো। মা? মেগে ভেবেছে আমরা আর কখনো ফিরবোই না!”
“ না! আমি এমন ভাবিনি,” পিছনের সিটে বসে গাড়ির সামনের সিটে ওর ছোট্ট পা দিয়ে লাথি মেরে বললো মেগ।
অ্যান্ড্রু আর আমি চোখে সানগ্লাস পরে নিলাম। তারপর ভ্যাঙ্কুভার শহরের একেবারে মাঝখান দিয়ে লায়নগেটের উপর দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করলাম। একে একে পিছনে ফেলে আসতে লাগলাম আমাদের বাসা, এলাকা, ভ্যাঙ্কুভার শহর, ওয়াশিংটন আর ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ক্রসিং পয়েন্ট, আমাদের দেশ। আমরা আমেরিকার পূবদিকে বরাবর যাচ্ছিলাম। সামনে গিয়ে সবচেয়ে উত্তরের হাইওয়ে ধরে এগিয়ে গিয়ে সার্নিয়া, ওন্টারিওর বর্ডার দিয়ে আবার কানাডায় ঢুকবো। আমরা ওন্টারিও যাওয়ার জন্য ঐ রুটটাই কেন বেছেছিলাম এখন আর ঠিক মনে নেই। তখনও হয়তো ট্রান্স-কানাডা হাইওয়ে পুরোপুরি চালু হয়নি। অথবা এমনও হতে পারে যে যাওয়ার পথে অন্য একটা দেশ দেখার ইচ্ছা ছিলো আমাদের।
অ্যান্ড্রু আর আমি দু’জনই খুব খোশ মেজাজে ছিলাম। অ্যান্ড্রু একটু পরপরই নতুন গাড়িটার প্রশংসা করছিলো। “পুরোনো গাড়িটার চেয়ে এটা চালিয়ে অনেক আরাম। পাহাড়ি রাস্তায় আগের গাড়িটা এত সুন্দর যেতেই পারতো না, ধীর হয়ে যেতো। ওটাকে দেখতেও লাগতো অদ্ভুত, বুড়ি মহিলার মতন একটা ইমেজ ছিলো ওটার।”
“আর এই নতুন গাড়িটার ইমেজ কেমন, “সিনথিয়া জিজ্ঞেস করলো। ও আমাদের সব কথায় খুব মনো্যোগ দিয়ে শুনতো সে বয়সে। এখন যেমন ‘ইমেজ’ শব্দটা বললো, আমাদের কাছে নতুন কোন শব্দ শুনলেই এরকম করে তা নিজেও বলতে চাইতো। বেশিরভাগ সময় পারতোও তা।
“জীবন্ত,” আমি বললাম, “কিছুটা স্পোর্টস কারের মতন, কিন্তু স্পোর্টস কারের মতন আবার অতটা শো-অফ গাড়িও না।”
“একেবারে অসাধারণ কিছু না, কিন্তু ক্ল্যাসি!” অ্যান্ড্রু বললো, “ঠিক আমার নিজের ইমেজ যেমন।”
সিনথিয়া একটু ভেবে বললো, “মানে, যেরকম ইমেজ তুমি পছন্দ কর, ঠিক তেমন, তাই তো?”
এতদিন পর এমন একটা ভ্যাকেশনে বেরোতে পেরে খুব ভালো লাগছিলো। বেড়াতে সবসময়ই ভালো লাগে আমার। বাসায় প্রায়ই লুকোনোর একটা জায়গা খুঁজতাম আমি তখন। কখনও বাচ্চাদের থেকে, আর বেশীরভাগ সময়ই দৈনন্দিন কাজ, টেলিফোন আর প্রতিবেশীদের সাথে সামাজিকতা রক্ষার হাত থেকে। সবার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইতাম, যেন নিজের আরও কাছে পৌঁছুতে পারি। প্রায়ই আমার মনে হতো আমি ছোট্ট একটা জগতে বন্দী হয়ে আছি, যখন যা কিছুই আগলে রাখতে চাই, তাই হারিয়ে ফেলি। বেড়াতে বের হলে এসব ভাবনা মাথায় আসতো না। খোলা মন নিয়ে অ্যান্ড্রু আর বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে পারতাম। ওরা হাত তুলে চারপাশের যা-ই দেখাতো, দেখতাম- সাইনবোর্ডে শুকরের ছবি, মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা কোন বাচ্চা ঘোড়া, ভোক্স ওয়াগন গাড়ি সবকিছুই। এসব ছোট ছোট অপূর্ব দৃশ্য আমার মাথায় প্রজাপতির মতন ঘুরে বেড়াতো। আমার মাথার ভিতরের শুন্য অংশটা যেন পূর্ণ হয়ে যেতো। জীবন নিয়ে সকল আশাবাদ জেগে উঠতো আবার, পালকের মতন হালকা বোধ করতাম। এটা এমন এক অনুভব, যারা শুধু দূর থেকে সবকিছু দেখে যায় তাদেরই পাওয়া সম্ভব, যারা সব কিছু আঁকড়ে ধরতে চায় তাদের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
এডেরেটে পৌঁছে আমরা পূব দিকে মোড় নিয়ে একটা ঝরণার উপর উঠে গেলাম। সিনথিয়াকে ম্যাপে দেখালাম আমরা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। প্রথমে ওকে পুরো আমেরিকার ম্যাপ দেখালাম। ম্যাপটার নিচের দিকে কানাডার একটা অংশও দেখা যায়। তারপর আমেরিকার যেসব স্টেটের উপর দিয়ে আমরা যাচ্ছি, ওয়াশিংটন, আইডাহো, মনটানা, নর্থ ডাকোটা, মিনেসোটা, উইসকোনসিন এগুলোর আলাদা আলাদা ম্যাপও দেখালাম ওকে। ম্যাপের কোন লাইনটা লেক মিশিগান বোঝাচ্ছে বুঝিয়ে দিলাম, ওখানেই ফেরিতে উঠবো আমরা। ফেরি পার হওয়ার পর মিশিগান হয়ে আমেরিকা-কানাডার সংযোগ ব্রিজ পার হয়ে আমরা সোজা পৌঁছে যাবো সার্নিয়া, ওন্টারিও, আমাদের গন্তব্য স্থল।
মেগও ম্যাপটা দেখতে চাইলো।
“তুমি বুঝবে না ম্যাপ,” সিনথিয়া বললো যদিও, তবু আমার হাত থেকে ম্যাপটা নিয়ে নিলো ওকে দেখাতে।
“চুপচাপ বসো,” ম্যাগকে বললো ও, “আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।”
সামনের সিটে বসে শুনতে পাচ্ছিলাম ও কি বলছে। আমি ওকে যেভাবে বলেছি, একেবারে সেভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছিলো। আমারই মতন একটা একটা স্টেটের ম্যাপ বের করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো।
“এই লাইনটা কী বলতে পারবে?” ও বললো, “এটা হলো রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই আমরা যাচ্ছি।”
মেগ চুপ, কোন জবাব দিলো না।
“মা, এখন আমরা কোন জায়গাটায় আছি?” সিনথিয়া জিজ্ঞেস করলো।
দু’টো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাটা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম, সেটা দেখালাম ওকে। সিনথিয়া আবার সেটা মেগকে দেখালো। “এই আকা-বাকা রাস্তাটা দেখতে পাচ্ছো?” ও বললো, “রাস্তাটায় অনেক বাঁক আছে, তাই এমন আকা-বাকা করে আঁকা। বাকা লাইন হচ্ছে রাস্তার বাঁক।” তারপর নিজমনে কিছুক্ষণ ম্যাপগুলো দেখলো ও। কিছুক্ষণ পর আবার বলে উঠলো, “এখন দেখাও তো, আমরা এখন কোন জায়গাটায় আছি?” আমাকে ডেকে উঠলো তারপর, “মা ও বুঝে গেছে! ও দেখাতে পেরেছে! মেগ ম্যাপ দেখা বুঝে গেছে!”
এখন আমার মাঝেমাঝে মনে হয়, আমরা যেন আমাদের বাচ্চাদের জন্য তাদের শৈশবে, নাটকের মতন একটা করে চরিত্র ঠিক করে দিয়েছিলাম, আর ওরা সে চরিত্রে নিঁখুত অভিনয় করে গেছে। সিনথিয়ার চরিত্র ছিলো মেধাবী একটা মেয়ের- সব কাজে নিঁখুত, একটু আবেগী, বিনয়ী, চলাফেরায় সতর্ক। মাঝেমাঝে ওর অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাব নিয়ে মজা করতাম আমরা। আমাদের চাহিদা মতন ওর সব দায়িত্ব পালন করতে অস্থির হয়ে যেতো সে। ব্যর্থতা একেবারেই মানতে পারতো না। খুব ফর্সা ছিলো, বাইরের রোদ-হাওয়া, খুশি-অপমান সবকিছু আয়নার মতন ফুটে উঠতো সিনথিয়ার ঐ ফর্সা চেহারাটায়। আর মেগ ছিলো ওর থেকে একেবারে আলাদা। খানিকটা চাপা স্বভাবের, খানিকটা জেদি, আর খানিকটা বোঝা কঠিন। চুপচাপ স্বভাবের ভিতর ওর ভিতরের দৃঢ়তা বোঝা যেতো। তার পছন্দ নয় এমন কিছু করতে বলা হলে ওর ভিতরের স্বাধীনচেতা সত্তাটা বের হয়ে আসতো। সুন্দর বাদামি চুল ছিলো মেগের, আমি সোজা করে কেটে দিতাম। ওর বড় বড় চোখগুলোর দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হতো আমার, কী স্বচ্ছ একজোড়া চোখ ছিলো মেগের!
আমরা আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে খুশি ছিলাম। ওদের দু’জনের বিপরীত ধরণের চরিত্র আর ওদের কথা-বার্তা, চাল-চলনে সেগুলো ফুটে বের হয়ে আসা দেখতে বেশ লাগতো। আর দশটা গৎবাধা মা-বাবাদের মতন হওয়ার ইচ্ছা ছিলো না আমাদের। আমার মনের ভিতর প্রায়ই ভয় কাজ করতো যেন সারাক্ষণ সংসারের চিন্তা করে শরীর নুয়ে পড়া মায়েদের মত হয়ে না যাই আমি। যে পরিমাণ খাঁটুনি বেশিরভাগ গৃহিনী মায়েরা সংসারে দিতো, তাতে তাদের শরীর ভেঙ্গে পড়া ছাড়া কোন উপায় ছিলো না। সে সময়, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে কর্মজীবী মায়েদের লেখা ছাপাতো, ওসব লেখা পড়তে খুব ভালো লাগতো আমার। ওদের লেখায় পড়তাম তাদের ছেলে-মেয়েরা কেমন স্বাবলম্বী আর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গড়ে ওঠে। আর মাদেরকেও মনে হতো খুব আত্মবিশ্বাসী, নিজস্ব চিন্তা-ভাবনায় অটল। আমার পরিচিতের মধ্যে এমন মা কেউ ছিলো না, যারা ছিলো তারা সারাক্ষণ তাদের বাচ্চা নিয়ে টেনশন করা আর তাদের বাচ্চা আমার বাসায় এলো কি না জানতে একটু পরপর ফোন দিয়ে যাওয়া টাইপ।
একটা পিকআপ ট্রাকের সামনে একটা হরিণ দেখতে পেলাম আমরা, মরে পড়ে আছে।
“কেউ গুলি করে মেরে ফেলেছে হরিণটাকে,” সিনথিয়া বললো, “শিকারিরা হরিণ শিকার করে।”
“কিন্তু এখনও তো শিকারের মৌসুম শুরু হয়নি,” অ্যান্ড্রু বললো, “ মনে হয় রাস্তায় কোন গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। ঐ যে, হরিণ পারাপারের সাইনবোর্ড দেখতে পাচ্ছো?”
“আমাদের গাড়ির সাথে কোন হরিণ ধাক্কা খেলে আমি বোধহয় কেঁদেই দিবো,” সিনথিয়া বললো।
বাসা থেকে বাচ্চাদের জন্য পিনাট বাটার আর আমাদের জন্য স্যালমন-মেয়োনিজের স্যান্ডউইচ বানিয়ে এনেছিলাম, সেগুলো বের করলাম টিফিন বক্স থেকে। লেটুস পাতা আনিনি বলে অ্যান্ড্রু বিরক্ত হলো।
“বাসায় লেটুস পাতা ছিলো না,” বললাম।
“কিনে নিতে পারতে না?”
“অল্প কয়টা স্যান্ডউইচের জন্য একগাদা লেটুস কিনতে হতো, তাই ভেবেছি দরকার নেই।”
মিথ্যা কথা, আসলে আমার কেনার কথা মনেই ছিলো না।
“লেটুস থাকলে খেতে ভালো লাগে।”
“লেটুস ছাড়া যে স্যান্ডউইচ খাওয়াই যায় না, তা তো জানতাম না!” কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, “এত রেগে যাওয়ার কিছু নাই এখানে।”
“রাগি নাই, স্যান্ডউইচের সাথে লেটুস খেতে ভালো লাগে আমার, তাই বললাম শুধু।”
“সামান্য লেটুস পাতা এত দরকারি তোমার কাছে সেটা কে জানতো?”
“গাড়িতে গ্যাস ভরে না আনলে কেমন লাগতো?”
“লেটুস আর গ্যাস এক জিনিস না।”
“চলো সবাই মিলে একটা গান গাই,” বলেই সিনথিয়া গাইতে শুরু করলো,
“পাচঁটা ছোট হাঁস বের হয়েছিলো একদিন।
পাহাড়টা পেরিয়ে গিয়েছিলো বনের গহীন-
একটা হাঁস বলেছিলো, প্যাক প্যাক প্যাক
চারটা ছোট হাঁস সাঁতরে ফিরলো দ্যাখ।”
অ্যান্ড্রু আমার হাত আলতো করে চেপে ধরলো, “আমরা আর ঝগড়া না করি।”
“হুমম, তুমিই ঠিক, আমার লেটুস আনা উচিৎ ছিলো।”
“সমস্যা নেই। আমার যে লেটুস লাগবেই, তা না।”
অ্যান্ড্রু সম্পর্কে আমার ভাবনাগুলো যদি নিজের কাছেই আরেকটু পরিষ্কার থাকতো, ভালো হতো আমার জন্য। ওকে আরও ভালো করে বোঝার জন্য আমি একবার দু’টা তালিকা পর্যন্ত করেছিলাম, একটায় ওর যা কিছু আমার পছন্দ তা লিখেছিলাম, আরেকটায় অপছন্দের সবকিছু। আমাদের ঘরোয়া জীবনের সব পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে বানানো সে তালিকা দেখে নিজের কাছেই কিছু একটা প্রমাণ করতে চাইছিলাম হয়তো, আমি নিজেই জানি সেটা কি। হয়তো ওকে নিয়ে কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে চাইছিলাম আমি। কিছুক্ষণ লেখার পর দেখলাম, তালিকা দু’টো আমার নিজের চরিত্রের ভয়াবহ বৈপরীত্যই প্রমাণ করছে শুধু, অন্য কিছু না। মাঝেমাঝে ওর পায়ের সামান্য আওয়াজও আমার কাছে অসহ্য বোধ হতো, স্বৈরাচারী মনে হতো। ওর প্রতিটা কথা মনে হতো হয় দাম্ভিক নাহয় ছোটোলোকের মতন। ওর চওড়া কাঁধ আর ওর শক্ত সামর্থ্য শরীরটাকে মনে হতো পৃথিবীর সমস্ত পুরুষালী কর্তৃত্ব নিয়ে আমি ও আমার জীবনের সমস্ত সুখ, আনন্দ ও নির্ভরতার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটা বাঁধা। আর এত কিছুর পরও ওই ছিলো আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, সবচেয়ে দরকারি সঙ্গী। আমাদের সুখের দিনগুলোয় ওর ঐ শক্ত শরীরের হাড়গুলোকেই কোমল মনে হতো, ওর কাছে যা কিছু জরুরী তা আমার কাছেও জরুরী বোধ হতো। বুঝতে পারতাম আমার প্রতি ওর ভালোবাসা, আমার ভালোবাসার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভেজাল, অনেক বেশি সরল। অ্যান্ড্রুর যে একগুঁয়েমিপনা কখনো কখনো আমাকে রাগিয়ে দিতো, তাই আবার মাঝেমাঝে খুব আপন মনে হতো। একজন স্বামী হিসেবে, বাবা হিসেবে, বাসার একমাত্র উপার্জনকারী হিসেবে ওর যা কিছু দায়িত্ব খুব সহজে আয়ত্ত্বে নিয়েছিলো সে, কারও প্রতি কোন অভিযোগ না করেই। আর সে তুলনায় আমি ছিলাম গোপন অহংবোধে ভর্তি একটা শয়তান! এমনকি গোপনও না, অন্তত অ্যান্ড্রুর কাছে তো নয়-ই।
আমরা যখন ঝগড়া করতাম, একটা পর্যায়ে এসে আমাদের ভিতরে পুষে রাখা কুৎসিৎ সত্যগুলো উগড়ে দিতাম, “তুমি ভিতরে ভিতরে কতটা স্বার্থপর একটা মেয়ে আমি জানি,” অ্যান্ড্রু একবার বলেছিলো, “একেবারে প্রথম থেকেই জানতাম, আর তারপরও, সেজন্যই তোমার প্রেমে পড়েছিলাম আমি।”
“হ্যাঁ,” বলেছিলাম, খারাপ লাগছিলো আমার, সেই সাথে একটা স্বস্তিও।
“তোমাকে ছাড়াই আমি ভালো থাকতাম।”
“হ্যাঁ, এটাও জানি।”
“তুমিও আমাকে ছাড়া আরও সুখী হতে।”
“হ্যাঁ।”
ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে একসময় আমরা দু’জনের হাত ধরে হেসে ফেলতাম, হাসতাম আমাদের নিজেদের উপরই, আমাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা আমাদের অন্ধকার সত্তার উপর। সেই লুকিয়ে থাকা সত্তার সমস্ত ক্ষোভ, অসন্তোষ আর আত্মপক্ষ সমর্থনের দিকে তাকিয়ে হাসতাম। হেসে উড়িয়ে দিতে চাইতাম সেই সত্তাকে, অস্বীকার করতাম তার অস্তিত্ব। সেইসব ঝগড়ার রাতে ডিনারে ওয়াইনের বোতল খুলতাম, অথবা বাসায় ছোটখাটো পার্টিরই আয়োজন করে ফেলতাম আমরা দু’জন।
অনেক দিন হলো অ্যান্ড্রুকে দেখিনি। জানি না ও এখনও আগের মতই শুকনা-পাতলা আছে কি না, জানি না কতটা বুড়িয়ে গেছে এখন। এখনও কি আগের মতনই লেটুসের জন্য ঝগড়া করে? আগের মতন মনে যা আছে সব কিছু মুখের উপর বলে দেয়? নাকি এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে, জীবনের উপর হতাশ হয়ে গিয়েছে?
আমাদের যাত্রাপথে প্রথম রাতটা কাটালাম বিলাৎচি, ওয়াশিংটনে। খুব গরম পড়েছিলো, বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি হয়নি শহরটায়। ডিনার সেরে নিলাম বড় একটা গাছের উপর বানানো ট্রি হাউজের মতন সুন্দর একটা রেস্তোঁরায়। খুব ভোরে উঠে আবার রওনা হলাম। আমাদের গাড়ি চলতে লাগলো কখনো চাষ করা জমির ভিতর দিয়ে যাওয়া রাস্তায়, কখনো শুষ্ক, পাথুরে খাড়া পাহাড়ি পথে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ের মাথায় সমতল চোখে পড়ে। পাহাড়ের কিনার দিয়ে বয়ে গেছে কেইন আর কলম্বিয়া নদী। এরপর পেলাম আঁকাবাঁকা রাস্তার পাশ দিয়ে মাইলের পর মাইল শস্যক্ষেত আর সবুজ মাঠ। অনেকটা পথ যাওয়ার পর সোজা রাস্তা পাওয়া গেলো। ছোট ছোট শহরও পাচ্ছিলাম মাঝে মাঝে। একটা শহরে ঢোকার সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে- ডগলাস কাউন্টি- আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম গম উৎপাদনকারী শহর। প্রত্যেকটা শহরের রাস্তাগুলোর দু’পাশে প্ল্যান করে গাছ লাগানো। অন্তত আমার কাছে প্ল্যান করে লাগানোই মনে হয়েছে কারণ ওদিকেটায় বড় কোন বেখাপ্পা গাছ চোখে পড়েনি আমার।
চারপাশের সবকিছুই অসাধারাণ লাগছিলো, “সবকিছু এতো ভালো লাগছে কেন আমার?” অ্যান্ড্রুকে বললাম, “একদমই বুঝতে পারছি না।”
“তোমার বাড়ির কথা মনে পড়ছে,” অ্যান্ড্রু বললো, “একেই নস্টালজিয়া বলে।”
আমরা “আমাদের বাড়ি” বলতে তখনও ওন্টারিওকেই বোঝাতাম। তবে আমার আর অ্যান্ড্রুর কাছে “বাড়ি” শব্দটার মানে ছিলো অনেকটাই আলাদা। আমাদের বাড়িটা ছিলো একটা টার্কি খামার। আমার বাবা তখনও সেখানেই থাকতেন, একা। মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত মা’ও এ বাড়িতেই ছিলেন। বাড়িটা মা’র হাতেই গড়া। বাড়ি বানানো থেকে শুরু করে রঙ করা, সাজানো-গোছানো সবই মা-ই করেছিলেন। এখন অবশ্য অযত্ন অবহেলায় এর বুনো হাল হয়ে গিয়েছে। বাড়িটার এমন অবস্থা হবে মা বোধহয় কোনদিন কল্পনাও করতে পারতেন না। বেঁচে থাকলে এমন হাল মেনে নিতে পারতেন না নিশ্চিত। মা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়িতে টার্কি পালার জন্য রাখা লোকদের নিয়ে মাঝেমাঝে পার্টি দিতেন বাবা। পার্টি শেষ হলে রাতে দু’একজন থেকেও যেতো। একেবারে একা থাকার চেয়ে বাবার জন্য এমন জীবনই ছিলো ভালো। এসব নিয়ে বাবাকে কখনো আমি কোন অভিযোগ করিনি। অবশ্য কোন অভিযোগ করার অধিকারও আমার ছিলো না। অ্যান্ড্রু আমাদের বাড়িতে যেতে চাইতো না। খুব স্বাভাবিক। গ্রামের ঐ ছা-পোষা গরীব লোকের সাথে বসে ডাইনিং টেবিলে বসে সস্তা রসিকতা করার মতন লোক ও কখনোই ছিলো না। ঐসব লোকও ভয় পেতো ওকে, পছন্দ করতো না। আর বাবাও সবকিছুতে ওদেরই পক্ষ নিতেন। শুধু যে অ্যান্ড্রুই সমস্যায় পড়তো তা না, মাঝেমাঝে আমিও ওদের রসিকতায় অস্বস্তিতে পড়ে যেতাম।
বাড়িটাকে টার্কি খামার বানানোর আগের দিনগুলো, আমার ছেলেবেলার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। তখন আমাদের অনেক গরু ছিলো। আমরা মাখন তৈরির কারখানায় গরুর দুধ বিক্রি করতাম। টার্কির খামারের চেয়ে ডেইরি ফার্ম ঢের বেশি সুন্দর। টার্কির কথা ভাবলে মনের মধ্য শুধু টার্কির মাংসের কথা আসে আগে, গরু কিংবা মাঠে চড়ে বেড়ানো শুয়োরের মতন জীবন্ত কিছু চোখে ভাসে না। টার্কির খামার গরুর গোয়ালের মতন সুন্দর না। আর পাখিগুলোর মলমূত্রের গন্ধও গোবরের চেয়ে অনেক বাজে। আমাদের বাড়ির সামনের উঠোনের এক কোনায় টার্কিগুলো সারাদিন জড়ো হয়ে বসে থাকতো। এরা যে এক জাতের পাখি, মনেই হতো না তখন ওদের দেখলে, মনে হতো কেউ মাঠের উপর একগাদা কাপড়ের স্তুপ জড়ো করে রেখেছে।
একবার, মা মারা যাওয়ার কিছুদিন পর, আমার বিয়ে হয়ে গেছে তখন, ভাঙ্কুভারে অ্যান্ড্রুর কাছে চলে যাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি, দু’টো পুরো দিন শুধু আমি আর আমার বাবা বাড়িতে ছিলাম। সারা রাত প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছিলো। ভোরবেলায় দেখলাম আমাদের বাড়ির উঠোনটা পানিতে ডুবে গেছে। উঠোনের নিচু জায়গাগুলো পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিলো। মাঠটাকে দেখাচ্ছিলো একটা লেকের মতন, যার এখানে-ওখানে কিছু বিচ্ছিন্ন দ্বীপ জেগে উঠেছে। আমাদের সব টার্কি তেমনই একটা দ্বীপে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। টার্কিরা সাধারণত খুবই বোকা প্রকৃতির হয় (বাবা বলতো, মুরগী কেমন বোকা, তা তো জানিস, আর সেই মুরগীদেরই টার্কির তুলনায় আইনস্টাইন বলা যায়), এত বোকা হওয়া সত্ত্বেও, পাখিগুলো ঠিকই উঁচু একটা জায়গা খুঁজে নিয়েছিলো যেন পানিতে ডুবে না যায়। অবশ্য ততক্ষণে একটা আরেকটাকে ধাক্কাতে শুরু করেছে। পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষার সময় ছিলো না, একটা পুরোনো নৌকা নিয়ে আমরা ওদেরকে আনতে গেলাম। আমি নৌকার দাঁড় বাইলাম, আর বাবা ওদের একটা একটা করে ধরে নৌকায় তুলে আমাদের ধানের আড়তে রেখে আসছিলেন। বৃষ্টি তখনও পুরোপুরি থামেনি, আর কাজটাও সহজ ছিলো না মোটেই, তবুও আমরা দু’জনেই খুব হাসি-ঠাট্টা করছিলাম। বাবাকে ঘরের কাজে সাহায্য করতে খুব ভালো লাগছিল আমার। এ ধরণের একঘেয়ে, কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ শরীরের সব শক্তি শুষে নেয়, চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ করে দেয়, মনকে একেবারে হাল্কা করে ফেলে। হঠাৎ করে বাবার প্রতি খুব নৈকট্য বোধ করে উঠলাম, যেন এটাই আমার জায়গা, এটাই আমার কাজ। সেই গ্রামের জীবন ও আমাদের বাড়িটার প্রতি প্রচণ্ড টান বোধ করছিলাম আমি। অ্যান্ড্রু যদি কখনো আমাকে ঐ অবস্থায় দেখতে পেতো- বৃষ্টির ভিতরে সারা শরীরে কাদা মেখে একহাতে নৌকার বৈঠা ধরা আর আরেক হাতে টার্কির পা ধরে বসে আছি যেন ওরা পানিতে না পড়ে যায়, সাথে সাথে বোধহয় আমাকে ঐখান থেকে ধরে তুলে নিয়ে আসতো। গ্রামীণ স্থূল জীবনের প্রতি ওর একটা বিতৃষ্ণা কাজ করতো। এমনকি সেরকম জীবনের সাথে আমার কোন সংস্পর্শও যেন সহ্য করতে পারতো না। অ্যান্ড্রুকে বোধহয় আমার বিয়ে করা উচিৎ হয়নি। কাকেই বা করতাম? বাবার টার্কি খামারে কাজ করা লোকদের কাউকে?
তাছাড়া আমি ওখানে সারা জীবনের জন্য থেকে যেতে কখনোই চাই নি। বাড়ি ছেড়ে চলে আসবার সময় আমার খারাপ লাগছিলো, কিন্তু কেউ জোর করে আমাকে ওখানে রেখে দিতে চাইলে তার চেয়েও বেশি খারাপ লাগতো।
অ্যান্ড্রুর মা থাকতেন টরেন্টোতে, মু’র পার্কের দিকে মুখ ফেরানো একটা এপার্টমেন্টে। বাসাটা ছোট, অ্যান্ড্রু আর ওর বোন একই সময় বাড়িতে বেড়াতে গেলে ভদ্রমহিলাকে ড্রয়িংরুমে ঘুমাতে হতো। উনার স্বামী ছিলেন পেশায় ডাক্তার, ওনাদের বাচ্চারা স্কুলে ভর্তির আগেই মারা গিয়েছিলেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর উনি একটা কেরানীর চাকুরিতে ঢোকার ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হন আর যে বাড়িটায় উনারা থাকতেন সেটা সস্তায় বিক্রি করে দিয়ে বাচ্চা-কাচ্চাসহ এই এপার্টমেন্টটায় ওঠেন। দুই বাচ্চাকে মানুষ করেন তার বোন ক্যারোলিন আর বোন জামাই রজারের আর্থিক সহায়তায়। অ্যান্ড্রু আর ওর বোন দু’জনেই প্রাইভেট স্কুলে পড়েছে। এমনকী স্কুলের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পেও যাওয়ার সুযোগ হতো ওদের।
একবার, ছেলেবেলায় ওরা খুব গরীব ছিলো বলায় মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো আমার। “প্রাইভেট স্কুলে পড়তে কী তাহলে সরকারী টাকায়?” বলেছিলাম। অ্যান্ড্রুর শহুরে শৈশবটাকে খাঁচায় বন্দী জীবন মনে হতো আমার। ওর মা সারাদিন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের অফিসে প্রচণ্ড গরম আর তীব্র আলোর ভিতর কাজ করে মাথা ব্যাথা নিয়ে প্রতিদিন বাসায় ফিরতেন। তবু তাঁর এই জীবনকে কঠিন কিংবা প্রশংসা করবার মতন কিছু বলে মনে হতো না আমার। মনে হয় না, তিনি নিজেও তা ভাবতেন। নিজের জীবনটাকে একটা দুর্ভাগ্য হিসেবে মেনে নিয়েছলেন তিনি। অফিস করা, কাপড়-চোপড় ধোয়া, রান্না-বান্না, বাচ্চাদের নিয়ে দুশ্চিন্তা, এই নিয়ে ছিলো তার জীবন। তবে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করতেন ক্যারোলিন আর রজারকে নিয়ে, ওরা কী ভাবছে তা নিয়ে।
ক্যারোলিন আর রজার থাকতো পাথরের তৈরি বিশাল এক বাড়িতে, মু’র পার্কে পূব দিকে। রজার ছিলেন দীর্ঘকায় পুরুষ, মাথায় টাক, পেটানো শরীর। গলায় কী এক অপারেশনের জন্য স্বর নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো ওর। ফিসফিস করে কথা বলতো। সবার কাছে সেই ফিসফিসে কণ্ঠেরই গুরুত্ব ছিলো অনেক। এক ডিনারে ওদের বাড়ির বিশাল ডাইনিং রুমে বসে রজারকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, হুইটেকার চেম্বারের একটা গল্প নিয়ে বোধহয়। শনিবারের ইভনিং পোস্টে ছেপেছিলো গল্পটা। প্রশ্নটা করেছিলাম অনেকটা হালকা চালেই, কিন্তু উনি ধরে নিলেন ওনাকে আক্রমণ করতে জিজ্ঞেস করেছি। আমাকে মিসেস গ্রোমাইকো বলে কটাক্ষ করলেন, তার প্রতি আমার পক্ষপাতীত্ব আছে ভেবে। মনে হচ্ছিলো গায়ে পড়ে ঝগড়া করতে চাইছেন আমার সাথে। খেতে খেতে খেয়াল করলাম, ওর মায়ের সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার সময় অ্যান্ড্রুর হাত কাঁপছে। রজার ওর পড়াশোনার সব খরচ যুগিয়েছিলো, ছিলো বেশ কয়েকটা কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডের মেম্বার।
“উনি বুড়ো মানুষ, চিন্তা-ভাবনা সব সেকেলে,” অ্যান্ড্রু আমাকে পরে বলেছিলো, “ওনার সাথে তর্ক করার কোন মানে হয়?”
আমরা ভ্যাঙ্কুভার ছাড়ার আগে পাওয়া অ্যান্ড্রুর মায়ের চিঠিতে দেখলাম উনি লিখেছেন, “তোমরা এত ছোট কার কিনেছ শুনে রজার খুব অবাক হয়েছে!” বিস্ময়বোধক চিহ্নটা বোঝাচ্ছিলো রজার পছন্দ করেননি ব্যাপারটা। সে সময়, বিশেষ করে ওন্টারিওতে, বড় আমেরিকান গাড়ি না কিনে ইউরোপিয়ান ছোট সাইজের গাড়ি কেনাটা ছিলো প্রথা ভাঙ্গার ঘোষণার মতন, যা রজারের পছন্দ হবার কোন কারণ নেই।
“আমাদের গাড়িটা তো অতটা ছোটও না, কী বলো?” অ্যান্ড্রু অপরাধীর গলায় বললো।
“গাড়িটা বড় না ছোট, সেটা বিষয় না,” আমি বললাম, “বিষয় হলো, এ নিয়ে নাক গলানোর উনি কে?”
***
দ্বিতীয় রাতটা আমরা কাটালাম মিসৌলাতে। স্পোকেনের এক গ্যাস স্টেশনে গাড়ির গ্যাস ভরতে গিয়ে শুনলাম হাইওয়ে-২ এ রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে, অনেক ধুলোবালি হবে ঐ রাস্তায়। তাই আমরা আর হাইওয়ে-২ এ না উঠে চোয়েব ডি’ অ্যালেন আর বেলগের ভিতর দিয়ে মন্টানার দিকে রওনা হলাম। মিসৌলা পার হয়ে সরাসরি বুটে সিটির দিকে না গিয়ে, স্টেট ক্যাপিটাল হেলেনা দেখার জন্য ঘোরা পথে চললাম। গাড়িতে সবাই মিলে ‘বলো, আমি কে?’ খেললাম আমরা।
খেলার নিয়ম হলো, একজন একটা কিছু সাজবে, অন্যদের মোট ষোলটা প্রশ্ন করে বুঝতে হবে সে কী সেজেছে। প্রথমে সাজলো সিনথিয়া। সাজলো মৃত একজন আমেরিকান মেয়ে বা মহিলা। সে কোন গল্পের চরিত্র না, টিভিতেও তাকে দেখা যায় না, সিনথিয়া কোন বইয়েও তার কথা পড়ে নি, ওর স্কুলের কোন মেয়েও না, ওর কোন বন্ধু কিংবা আত্মীয়ও না।
“সে কি কোন মানুষ?” অ্যান্ড্রু জিজ্ঞেস করলো।
“না! এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞেস করনি তোমরা এতক্ষণ।”
“একটা প্রাণী তাহলে!” আমি বললাম।
“এটা কি প্রশ্ন ছিলো? ষোলটা প্রশ্ন কিন্তু মোট।”
“না, প্রশ্ন না, চিন্তা করছি আমি। একটা মরা প্রাণী।”
“ঐ হরিণটা,” মেগ বলে উঠলো, ও খেলছিলো না, এতক্ষণ চুপ করে ছিলো।
“হবে না,” সিনথিয়া বললো, “ মেগ তো খেলাতেই নেই।”
“কোন হরিণটা?” অ্যান্ড্রু জিজ্ঞেস করলো।
আমি জবাব দিলাম, “গতকালকের রাস্তায় মরে পড়ে থাকা হরিণটা।”
“কালকের না, পরশুর,” সিনথিয়া বললো, “মেগ যেহেতু খেলায় নেই, তাহলে কেউ পারেনি।”
“ট্রাক চাপা পড়া হরিণটা!” অ্যান্ড্রু বললো।
“হুমম। হরিণটা মেয়ে ছিলো, কারণ তার মাথায় শিং ছিলো না। ওটা আমেরিকান ছিলো আর এখন মৃত,” সিনথিয়া বললো।
অ্যান্ড্রু বললো, “একটা মরা হরিণ সাজা ব্যাপারটা কেমন না? ডিপ্রেসিং।”
“আমি কিন্তু বলতে পেরেছি!” মেগ বললো।
সিনথিয়া বললো, “আমি ডিপ্রেসিং এর মানে জানি- মন খারাপ।”
সকাল বেলার কড়া রোদ্দুরেও রূপোর খনির শহর হেলেনাকে ধ্বংসস্তুপের মতন মনে হলো। হেলেনা পার হওয়ার পর পথে পড়লো বোজেমান আর বিলিন্স শহর, এগুলো আবার হেলেনার একেবারে বিপরীত- প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। রাস্তার দু’পাশে মাইলের পর মাইল পুরোনো গাড়ির সারাইখানা। প্রচণ্ড গরমে এত ক্লান্ত লাগছিলো যে, ‘বল, আমি কে?’ খেলার শক্তিও ছিলো না আর কারও শরীরে। এই কর্মব্যস্ত, গদ্যময় শহরগুলো ওন্টারিওর কতগুলো জায়গার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলো আমাকে। কী অপেক্ষা করছে ওন্টারিওতে আমাদের জন্য? একদিকে রজার আর ক্যারোলিনের রাজসিক ডাইনিং রুম, যেখানে ডিনারে পড়ার জন্য বাচ্চাদের কাপড় ইস্ত্রি করে দিতে হবে, ওদেরকে বারবার সতর্ক করতে হবে যেন খাওয়ার সময় ঠিকভাবে চামচ ব্যবহার করে, আর অন্যদিকে আমার বাবার বাড়ির ডাইনিং টেবিল, যেখানে শুনতে হবে বাবার টার্কি খামারে কাজ করা লোকদের সস্তা রসিকতা। একটা পুরোনো ধাঁচের দোকানে বসে কোক খেতে খেতে বাইরের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, যে আনন্দের খোঁজে আমরা বের হয়েছিলাম, তাকে এই দুই বিপরীত পরিবেশ থেকেই খুঁজে নিতে হবে।
“মেগ ঘুমিয়ে পড়েছে,” সিনথিয়া বললো, “ওর গা গরম। ওর গায়ের গরমে আমারও গরম লাগছে।”
“জ্বর উঠে যায়নি তো আবার?” পিছনের দিকে না তাকিয়েই বললাম।
কেন যাচ্ছি আমরা ওন্টারিওতে? কিছুটা লোক দেখানোর জন্য নয় কি? অ্যান্ড্রুর মা আর আমার বাবাকে তাদের নাতনীদের দেখিয়ে খুশী করতে চাই আমরা, এতে দোষ নেই, সন্তান হিসেবে এ আমাদের দায়িত্ব, কিন্তু এর বাইরেও আমরা ওনাদের আরও কিছু দেখাতে চাই। তাদের দেখিয়ে দিতে চাই কত কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের মানুষ করছি আমরা, আমি আর অ্যান্ড্রু, আর সেজন্য আমাদের বাবা-মাদের সামান্য প্রশংসা পেতে আমরা মরিয়া। দেখিয়ে দিতে চাই কারণ তারা যেন কখনো ভেবেছিলো জীবনের এই সব সাধারণ তুচ্ছ সাফল্যগুলোও আমাদের নাগালের বাইরে। রজার যেমন ধরণের লোক, হয়তো আমাদের প্রতি এমন কোন মন্তব্য সরাসরি করেই বসেছিলো, কিন্তু অ্যান্ড্রুর মা কিংবা আমার বাবা তো এমন ভাবার মানুষই না। আমাদের প্রতি তাদের একটাই উপদেশ ছিলো- “সাবধানে চলো, এগিয়ে যাও।” আমি যখন হাইস্কুলে পড়ি, বাবা একবার মজা করে বলেছিলেন, তুমি এতই স্মার্ট যে তোমার কখনো বয়ফ্রেন্ডই হবে না, উনি হয়তো বলার ক’দিন পরই ভুলেও গিয়েছেন কথাটা, কিন্তু আমি ভুলিনি, অ্যান্ড্রু কিংবা আমি কখনোই কিছু ভুলি না, সমস্ত অপমান মনের ভিতর সযতনে জমা করে রাখি।
“একটা সি-বিচ থাকতো এখানে!” সিনথিয়া বললো।
“সি-বিচ সামনেই আছে,” অ্যান্ড্রু বললো, “সামনের মোড়টা ঘুরলেই।”
“সামনে কোন মোড় নেই,” সিনথিয়া বললো ঠাণ্ডা গলায়, বাবার কৌতুকে অপমান বোধ করেছে যেন।
“তাহলে সি-বিচও নেই।”
“লেমোনেড শেষ। আরও বেশি করে আনা উচিৎ ছিলো।”
“আমার জাদুর কাঠি নাড়লেই এসে যাবে আরও লেমোনেড,” বললাম, “সিনথিয়া, আঙ্গুরের জুস হলে চলবে? নিয়ে আসবো?”
ও চুপ করে থাকলো। খারাপ লাগলো আমার, এতটা মজা করা উচিৎ হয়নি। “হয়তো পরের শহরটাতেই কোন পুল পেয়ে যাবো আমরা,” বললাম। ম্যাপ খুলে দেখলাম, “সামনেই মাইলস সিটি, ওখানে নিশ্চয়ই ঠাণ্ডা কিছু পাওয়া যাবে।”
“কত দূরে মাইলস সিটি?” অ্যান্ড্রু জিজ্ঞেস করলো।
“খুব বেশী দূর না, ত্রিশ মাইলের মতন হবে।”
“মাইলস সিটিতে,” সিনথিয়া যেন রূপকথার বই পড়ছে এমন স্বরে বললো, “বাচ্চাদের জন্য চমৎকার একটা সুইমিং পুল আছে। সে পুলের পানি দারুণ স্বচ্ছ আর নীল। আর আছে শান্ত একটা পার্ক, ফুল-ফল আর গাছ-গাছালিতে ভর্তি।”
অ্যান্ড্রু আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “দিয়েছো তো ওর মাথাটা খারাপ করে!”
***
সত্যিই শহরটাতে একটা সুইমিং পুল ছিলো, সেই সাথে একটা পার্কও, যদিও পুরোপুরি সিনথিয়ার কল্পনার পার্কটার মত না। তুলা, প্রেইরি, পপলার গাছ আর একটা উঁচু কাঁটাতারের বেড়া ঘিরে রেখেছিলো পার্কটাকে। ঘেরার ভেতর একটা সিমেন্টের দেওয়াল, তখনও পুরোটা ওঠেনি। কোন জনমানুষের সাড়াশব্দ পেলাম না আশেপাশে। সুইমিং পুলের গেইটের কাছে পৌঁছুতে একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম, লেখা- “সুইমিং পুল বন্ধের সময় প্রতিদিন দুপুর বারোটা থেকে দু’টা।” ঘড়ি দেখলাম, বারোটা পঁচিশ।
তারপরও আমি উঁচু গলায় ডাকলাম, “কেউ আছেন?” ভিতরে নিশ্চয়ই কেউ আছ, গেটের সামনে রাখা একটা রোটো-রুটার ট্রাক দেখে আন্দাজ করলাম। ট্রাকটার গায়ে বড় করে লেখা- “ We have the brains, to fix our drains (We have Roto-Rooter too)”
সাঁতারের পোশাক আর লাইফ জ্যাকেট পরা একটা মেয়ে ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো।
“দুঃখিত, পুল বন্ধ এখন।”
“আমরা অনেক দূরের অন্য একটা শহর থেকে এসেছি,” বললাম।
“আমাদের পুল বারোটা থেকে দু’টো পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, দেখুন,” মেয়েটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলো।
“সাইনবোর্ড দেখেছি আমি,” বললাম, “কিন্তু, সারাদিন জার্নি করছি আমরা, পথে এই প্রথম কোন পুল পেলাম। বাচ্চারা গরমে কষ্ট পাচ্ছে খুব। পানিতে দু’একটা ডুব দিতে পারলেই ঠিক হয়ে যেত। পাঁচ মিনিটও লাগবে না, আমরা নিজেরাই দেখবো ওদের।”
একটা ছেলে এসে মেয়েটার পিছে দাঁড়ালো। জিনস আর টিশার্ট পরা। ছেলেটার টিশার্টেও “রোটো-রুটার” লেখা।
বলতে যাচ্ছিলাম ব্রিটিশ কলম্বিয়া থেকে আসছি আমরা, যাচ্ছি ওন্টারিওতে, পরে ভাবলাম থাক, এসব কানাডিয়ান নামে আমেরিকানদের কিছু যায় আসে না। “আমরা পুরোটা দিনই রাস্তায়,” বললাম, “পুল খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করার মত সময়ও নেই আমাদের হাতে। চাইছিলাম বাচ্চারা একটু গোসল করে ঠাণ্ডা হয়ে নিক।”
সিনথিয়া খালি পায়ে দৌড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো, “মা, আমার সুইমিং কস্টিউম খুঁজে পাচ্ছি না, কোথায় রেখেছো?” জিজ্ঞেস করেই চুপ করে গেলো। বুঝতে পেরেছে বড়দের আলাপ চলছে। মেগের ঘুম ভেঙেছে, গাড়ি থেকে নেমে এসেছে। ওর জামা উপরে উঠে গিয়ে গোলাপী পেটটা বের হয়ে আছে।
“এই দু’জনই শুধু?” মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ, শুধু এই দু’জনই। আমরা নিজেরাই খেয়াল রাখতে পারবো ওদের।”
“নাহ, বড়দের ঢোকানো যাবে না এখন। যদি শুধু এ দু’জনই হয়, আমিই দেখতে পারবো। লাঞ্চ করছি আমি,” সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো তারপর, “কি, পুলে নামতে চাও?”
“হ্যাঁ, চাই,” সিনথিয়া জবাব দিলো।
মেগ চুপ, মাথা নামিয়ে নিলো ওর।
“অল্প কিছুক্ষণ শুধু, কেমন? পুল আসলেই বন্ধ এখন,” আমি বললাম ওদের। তারপর মেয়েটাকে বললাম, “অনেক ধন্যবাদ। খুবই উপকার করলেন।”
“সমস্যা নেই। যদি শুধু এ দু’জনই হয় তাহলে ওরা পানিতে নামুক, আমি পাশেই থাকবো, লাঞ্চটা সেরে নেই,” আমাদের গাড়ির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো মেয়েটা, যেন সন্দেহ করছে আমরা না আবার গাড়ি থেকে আরও দু’চারটা বাচ্চা বের করে আনি!
সিনথিয়ার সুইমিং কস্টিউম খুঁজে বের করে দিতেই ও সেটা নিয়ে চেঞ্জ রুমে ঢুকে পড়লো। ও এমনকি মেগের সামনেও কাপড় বদলাতে চায় না। আর মেগকে গাড়ির সামনের সিটে দাঁড় করিয়ে কাপড় পরিয়ে দিলাম। সামনে বোতাম লাগানো গোলাপি একটা ড্রেস।
“ওর গা গরম,” আমি বললাম, “কিন্তু জ্বর না বোধহয়।”
মেগকে জামা পরিয়ে দিতে ভালো লাগতো আমার। তখনো এই ছোট্ট শরীরটা যে ওর একান্ত নিজের সে বোধটা ওর তৈরি হয়নি। বাচ্চাদের গায়ের মিষ্টি যে গন্ধটা থাকে, সেটা তখনও পাওয়া যেতো। সিনথিয়ার শরীরটা ততদিনে ওর নিজস্ব শরীর হয়ে গেছে, আমাদের শুধু শুধু ধরার অধিকার আর নেই। কিন্তু আমরা যখন-তখন মেগকে জড়িয়ে ধরতাম। ও বিরক্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়তো। তা দেখে আরও বেশি মজা পেতাম!
অ্যান্ড্রু আর আমি জানালা খুলে গাড়িতেই বসে রইলাম। রেডিওর শব্দ ভেসে আসছিলো, মেয়েটা কিংবা তার বয়ফ্রেন্ডের হবে হয়তো। পিপাসা পেলো আমার, আশেপাশের রাস্তায় কোন সফট ড্রিঙ্কস মেশিন আছে নাকি খুঁজতে গাড়ি থেকে নামলাম। শর্টস পরা ছিলাম, রোদে আমার পায়ের ঘাম চিকচিক করছিলো। পার্কের অন্য পাশে একটা মেশিন দেখতে পেয়ে সেটার দিকে হাঁটতে থাকলাম। একটু ঘোরা পথ হলেও, গাছের ছায়া পড়েছে যে দিকটায় সে পথটায় গেলাম। ঘুরতে বের হলে কোথাও, গাড়ি থেকে না নামা পর্যন্ত কোন জায়গাকে বাস্তব বলে বোধ হয় না। সূর্যের প্রচণ্ড তাপে পায়ের নিচের রাস্তা পুড়ে যাচ্ছিলো। খুব ধীর গতিতে হাঁটছিলাম আমি। রাস্তায় পড়ে থাকা শুকনো পাতা কিংবা গাছের গায়ে লাগানো ট্র্যাশ ক্যান সবই চোখে পড়ছিলো। অনেকক্ষণ পর গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এলে এমন হয়, প্রত্যেকটা তুচ্ছ জিনিসের আলাদা আলাদা অস্তিত্ব, তাদের অবস্থান আর ঠিক ঐ মুহূর্তে সেসব দেখার জন্য নিজের উপস্থিতি সব যেন অনুভবে একসাথে ধরা দেয়, আশ্চর্য লাগে সবকিছু।
বাচ্চারা কোথায়?
কথাটা মনে আসতেই কাঁটাতারের ঘেরাটার যেদিকটায় সিমেন্টের দেওয়ালটা এখনো পুরোপুরি উঠেনি সেদিকে জোর কদমে হাঁটতে শুরু করলাম আমি। কাছে পৌঁছে পুলের ভিতরে উঁকি দিতে সুইমিং পুলের ভিতরের একটা অংশই চোখে পড়লো। ওখানে দাঁড়িয়ে ভিতরের একটা পাশই দেখা যাচ্ছিলো, সিনথিয়াকে দেখতে পেলাম, কোমর পানিতে দাঁড়ানো, দু’হাত পুলের পাড়ে রাখা, হা করে তাকিয়ে আছে পুলের অন্য প্রান্তের দিকে। আমার ওখান থেকে ও কী দেখছে দেখা যাচ্ছিলো না। ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গি, হা করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দেখে মনে হলো লাইফগার্ড মেয়েটা আর তার বয়ফ্রেন্ডের কোন কাণ্ড দেখছে ও। মেগকে দেখতে পেলাম না কোথাও। ভাবলাম সুইমিং পুলের অগভীর দিকটায় হয়তো আছে- ওখানে দাঁড়িয়ে পুলের শুধু মাঝের অংশটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, গভীর আর অগভীর কোন দিকই দেখা যাচ্ছিলো না।
“সিনথিয়া!” দু’বার ডাকার পর ও টের পেলো আমি কোথা থেকে ডাকছি ওকে, “সিনথিয়া, মেগ কোথায়?”
সেদিনের দৃশ্যটা মনে পড়লে আমার এখনো মনে হয় সিনথিয়া একটা অভিজাত ভঙ্গি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিলো, তারপর চারপাশে এমন করে মেগকে খুঁজলো যেন পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে নাচের কোন মুদ্রা দেখাচ্ছে আমাকে, তারপর হাত তুলে স্টেজে নর্তকীরা যেভাবে দর্শকদের অভিবাদন জানায় সেই ভঙ্গিমায় বললো, “নে-ই”
সিনথিয়ার চাল-চলন, কথা-বার্তা একটু অভিজাত ঘরানার ছিলো সবসময়ই, নাচের স্কুলে নাচও শিখতো ও, সেদিন ওর অঙ্গ-ভঙ্গিমা অমন হওয়াটা খুব অস্বাভাবিক ছিলো না, কিন্তু পুলের চারপাশ তাকিয়ে দেখে যে উদ্বেগহীন, কৃত্রিম ভঙ্গিতে ‘নেই’ বলেছিল, হয়তো সেটা আমার কল্পনাই হবে শুধু। মেগকে দেখতে না পেয়ে যে প্রচণ্ড ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিলো, (যদিও নিজেকে আমি তখনও বোঝাচ্ছিলাম ও পুলের অগভীর দিকটাতেই আছে) সে ভয়ের কারণেই হয়তো সিনথিয়ার অঙ্গভঙ্গিকে আমার অসহ্য রকমের ধীর মনে হয়েছিলো। আর কী বলছে তার গুরুত্ব না বুঝেই (নাকি ও কোন অপরাধবোধ লুকোচ্ছিলো?) যে স্বরে, ‘নেই’ বললো, সেই স্বরটাকে মনে হলো ভয়ংকর রকম আত্মকেন্দ্রিক।
আমি চিৎকার করে অ্যান্ড্রুকে ডেকে উঠলাম, আর ঠিক তখনই লাইফগার্ড মেয়েটাকে চোখে পড়লো। সে পুলের গভীর প্রান্তটার দিকে হাত তুলে দেখালো। “ঐ যে, ওটা কী?”
মেগের গোলাপী জামাটা চোখে পড়লো আমার, পানিতে ভাসছে। আমি জানি না, বাচ্চা একটা মেয়েকে পানিতে ডুবে যেতে দেখেও একজন লাইফগার্ড কেন লাফ দিয়ে পানিতে না নেমে জায়গায় দাঁড়িয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করবে ওটা কী! এবং এরপরও সে পানিতে নামলো না, পুলের পাড় ধরে দৌড়ে গেলো মেগের দিকটায়। কিন্তু ততক্ষণে অ্যান্ড্রু দেওয়াল টপকে ভিতরে ঢুকে পড়েছে। সেদিনের অনেক কিছুই এখন ভাবলে অবিশ্বাস্য লাগে- সিনথিয়ার অমন অদ্ভুত আচরণ, লাইফগার্ডের পানিতে না নামা, অ্যান্ড্রুর দেওয়াল টপকানো, একলাফে সাত ফিট উঁচু দেওয়ালটা কীভাবে টপকেছিলো ও? খুব সম্ভবত দেওয়ালের উপর দিকে লাগানো কাঁটাতার ধরে বেয়ে উঠেছিলো, লাফ দিয়ে না।
আমার পক্ষে ওভাবে যাওয়া সম্ভব হলো না, দৌড়ে গেইট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে আরও একটা ছোট গেইট ছিলো, তালা দেওয়া। ঐ গেটটা বেশী উঁচু ছিলো না, লাফ দিয়ে টপকে গেলাম। তারপর সিমেন্টের করিডোর ধরে দৌড়ে পুলটার কিনারায় এসে পৌঁছুলাম।
নাটক ততক্ষণে শেষ।
অ্যান্ড্রু ততক্ষণে মেগকে পানি থেকে টেনে তুলে এনেছে। ওর কাছে গিয়ে ওকে জাপটে ধরা তুলে আনা ছাড়া অ্যান্ড্রুর আর কিছুই করা লাগেনি, এমনকি পানিতে পর্যন্ত নামতে হয়নি। মেগ ওর ছোট্ট মাথাটা পানিতে ডুবিয়ে, কোন এক দৈব উপায়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে পুলের কিনারায় চলে এসেছিলো। আমি যখন পৌঁছুলাম তখন অ্যান্ড্রু মেগকে কোলে নিয়ে আমার দিকে হেঁটে আসছে, আর ওর পিছন পিছন আসছে লাইফগার্ড মেয়েটা। সিনথিয়া পুল থেকে উঠে এসে দৌড়ে ওদের কাছে চলে এলো। পুরো দৃশ্যটায় অনুপস্থিত ছিলো শুধু লাইফগার্ডের বয়ফ্রেন্ড। সে তখনও পুলের অগভীর প্রান্তটায় রাখা একটা বেঞ্চে বসে মিল্কশেক খাচ্ছে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো সে। বিপদ ততক্ষণে কেটে গেছে, তবুও ওর হাসিটা ভালো লাগলো না আমার, অনুভূতিহীন মনে হলো লোকটাকে। খেয়াল করলাম রেডিওটা তখনও বন্ধ করেনি সে, কেবল সাউন্ডটা কমিয়ে দিয়েছে।
মেগের পেটে কোন পানি ঢোকেনি, এমনকী ভয়ও পায়নি কোনরকম। ভেজা চুলগুলো মাথায় লেপ্টে ছিলো, আর চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিলো আমাদের দিকে, যেন খুব অবাক হয়ে গেছে!
“আমি চিরুনিটা উঠাতে যাচ্ছিলাম,” ও বললো, “বুঝতে পারিনি, ওখানে অত বেশি পানি।”
অ্যান্ড্রু বললো, “ও সাঁতার কাটছিলো! বিশ্বাস করো, ও নিজে নিজে সাঁতার কাটছিলো। আমি নিজের চোখে দেখলাম ও সাঁতরে কিনারের দিকে আসছে!”
“আরেকটু হলেই ডুবেই যেতো ও,” সিনথিয়া বললো, “তাই না? প্রায় ডুবেই গিয়েছিলে তুমি, মেগ।”
“বুঝতে পারছি না এমন হলো কিভাবে,” লাইফগার্ড মেয়েটা বললো, “এক মুহূর্ত আগে দেখলাম খেলছে ও, পর মুহূর্তে দেখি নেই।”
মেগ পুলের অগভীর দিকটাতেই নেমেছিলো, তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গিয়েছিলো গভীর পানির দিকে। পানির নিচে একটা চিরুনি পড়ে থাকতে দেখেছিলো, কেউ ফেলে চলে গিয়েছিলো হয়তো। ওখানে পানি কতটা গভীর বুঝতে পারেনি, হাঁটু গেড়ে বসে চিরুনিটা তুলে নিতে হাত বাড়াতেই স্লিপ খেয়ে, টুপ করে শব্দ তুলে তলিয়ে যায় পানির তলায়, যে শব্দ কেউ শুনতে পায়নি, না লাইফগার্ড, যে তখন ব্যস্ত ছিলো তার বয়ফ্রেন্ডকে চুমু খাওয়াতে, না সিনথিয়া, যে একমনে ওদের চুমু খাওয়া দেখছিলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পার্কের পাশের গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আমার হুট করে মনে পড়ে বাচ্চাদের কথা, ঠিক সেই একই মুহূর্তে, যখন মেগ তলিয়ে যাচ্ছে, অবাক হয়ে, ঐ বিশ্বাসঘাতক নীল পানির গভীরে।
“ ঠিক আছে,” লাইফগার্ড মেয়েটাকে বললাম, প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা ওর তখন, “ও এমনই, খুব ছটফটে।” (অবশ্য আমরা বলতাম উল্টোটা, বলতাম, মেগ যাই করে, ধীরে-সুস্থে সময় নিয়ে করে)
“মেগ তুমি সাঁতার কাটছিলে!” প্রশংসার সুরে সিনথিয়া বললো (চুমুর ব্যাপারটা ও আমদের পরে বলেছিলো।)
“মা, আমি বুঝতে পারিনি, ওখানটা যে অত গভীর,” মেগ বললো, “কিন্তু মা, আমি কিন্তু ডুবিনি, তাই না?”
***
একটা রেস্টুরেন্ট থেকে হ্যামবার্গার আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই কিনে নিয়ে হাইওয়ের পাশেই একটা খোলা মাঠে পিকনিক টেবিল বসিয়ে লাঞ্চ সারলাম আমরা। উত্তেজনায় মেগের জন্য আলাদা করে প্লেইন বার্গার কেনার কথা মনে ছিলো না, ওর খাওয়ার জন্য তাই বার্গার থেকে মরিচ সরিয়ে দিলাম, আর ভিতরের মাংসটা পেপার ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নিলাম। খাওয়া শেষ করার পর ট্রাশ ক্যানটা দিয়ে আমাদের কারের গ্লাস মুছে দিলাম। তারপর গাড়ির সামনের দু’টো সিটের জানালা খোলা রেখে পূব দিকে যাত্রা শুরু করলাম আবার। পিছনের সিটে সিনথিয়া আর মেগ ঘুমিয়ে পড়েছে।
অ্যান্ড্রু আর আমি ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম, নিচু স্বরে, যেন ওদের ঘুম না ভেঙে যায়। যদি ঠিক ঐ মুহূর্তে বাচ্চাদের কথা মনে না হতো আমার? আমরা তো সফট ড্রিঙ্কস কিনে আনতে শহরের দিকে যাবো কিনা ভাবছিলাম, যদি সত্যিই চলে যেতাম? অ্যান্ড্রু অত উঁচু দেওয়ালটা টপকালো কী করে? লাফ দিয়ে নাকি তার ধরে বেয়ে উঠেছিলো (ওর মনে নেই)? এত দ্রুত মেগের কাছে পৌঁছুলোই বা কী করে? আর লাইফগার্ড মেয়েটা? কোন খেয়ালই রাখেনি ওদের। সিনথিয়াও সব ভুলে ওদের চুমু খাওয়া দেখছিলো, আর কিছুরই খেয়াল ছিলো না ওর, দেখতেই পায়নি মেগ পানিতে ডুবে যাচ্ছে।
নে-ই।
কিন্তু মেগ সাঁতার কেটে গেছে। নিঃশ্বাস আটকে রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাঁতার কেটে গেছে মেগ।
ভাগ্য ছাড়া আর কী বলা যায় একে?
আর এটা নিয়েই আমরা সবসময় কথা বলি- ভাগ্য। কিন্তু আমি তখন আমাদের সৌভাগ্যের কথা না ভেবে বরং উল্টোটার কথা চিন্তা করলাম, হয়তো এই মুহূর্তে আমাদের ফর্ম পূরণ করতে হতো, মৃত মেগের ছোট্ট শরীরটাকে শিপমেন্টের জন্য রেডি করতে হতো। কোথায় নিয়ে যেতাম ওকে আমরা? ভ্যাঙ্কুভারে? যেখানে কোনদিন কোন কবর চোখে পড়েনি আমার? নাকি ওন্টারিওতে? যে এলোমেলো ছবিগুলো এঁকেছিলো আজ সকালে, সেগুলো তখনও গাড়ির পিছনের সিটেই পড়ে থাকতো। একটা মুহূর্তে মানুষের জীবনে কত কী ঘটে যায়, কীভাবে মানুষ সব কিছু সহ্য করে নেয়? ওর ঐ ছোট ছোট হাত পা, নরম ঘাড়, কালো চুলগুলো, ওর চেহারায় খুশি হওয়ার ভঙ্গি সবই তো তখনও আগের মতই থাকতো! এর চেয়ে স্বাভাবিক, সাধারণ দুর্ঘটনা বোধহয় আর নেই। এক উজ্জ্বল দুপুরবেলা সুইমিং পুলে গোসল করতে নেমে শিশুর মৃত্যু। এরপর সবকিছুই আবার দ্রুত ঠিক হয়ে যেতো। দু’টো বাজলে সুইমিং পুলটা আবার খুলে যেতো লোকেদের জন্য। লাইফগার্ড মেয়েটার হয়তো একটু খারাপ লাগতো, হয়তো আজকের দিনটা পুল থেকে ছুটি নিয়ে বয়ফ্রেন্ডের রোটো-রুটার ট্রাকে চড়ে ঘুরে আসতো কোথাও। মৃতদেহটা পড়ে থাকতো কোন শিপিং কফিনে। সিডেটিভ, ফোন কল, মৃতদেহ নেওয়ার আয়োজন। একটা হঠাৎ শূন্যতা। মাঝেমাঝে একটা অন্ধকারে ডুবে যাওয়া। ঘুমের ওষুধ খেয়ে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থেকে জেগে ওঠার পর এক মুহূর্তের জন্য হয়তো মনে হতো, কিছুই ঘটেনি, সব ঠিকই আছে। কিংবা ভাবতাম, আমরা যদি পুলটায় না দাঁড়াতাম? যদি ঐ রাস্তা দিয়েই না যেতাম আমরা? ওরা যদি পুলে ঢুকতে না দিতো আমাদের? কোনদিন হয়তো কেউ জানতোই না মাইলস সিটি, মন্টানার কোন এক সুইমিং পুলের গভীরে একটা চিরুনি পড়ে আছে।
এরকম কী ঘটতে পারতো তা ভাবার মধ্যে একটা বাজে ব্যাপার আছে, লজ্জার। ইলেকট্রিক শক খেয়ে মারা যেতে কেমন লাগে দেখার জন্য ইলেকট্রিক তার হালকা ছুঁয়ে হাত সরিয়ে নেওয়ার মতন। অ্যান্ড্রু এসব ব্যাপারে আমার চেয়ে অনেক সেনসিটিভ, ওকে দেখলাম, ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে অন্য কিছু ভাবার চেষ্টা করতে।
স্টিভ গ’লির শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দূরে দাঁড়িয়ে যখন আমার বাবা-মাকে দেখছিলাম, একটা নতুন, অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিলো আমার, যেন জীবনে প্রথমবারের মতন তাদের সম্পর্কে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম আমি। একটা ভয়ংকর সত্যি। আমার মনে হচ্ছিলো তারা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী। তারা তাদের এই বিশাল শরীরগুলো নিয়ে আমি ও আমার মৃত্যুর সামনে দাঁড়ায় না, এসে দাঁড়ায় না কোন মৃত্যুর সামনেই। বরং তারা নীরবে মৃত্যুকে সায় দেয়। কোন কিছু বলে কিংবা কোন কিছু ভেবে তারা আমার এবং সমস্ত শিশুদের মৃত্যুকে সায় দেয় না, বরং এসব শিশুদের জন্ম দেওয়ার মাধ্যমেই তারা প্রকাশ করে মৃত্যুর প্রতি তাদের সম্মতি। তারা যদি আমার জন্মের কারণ হয় তবে তারাই আমার মৃত্যুরও কারণ। যত শোকই তারা প্রকাশ করুক, যত দুঃখই তারা বয়ে বেড়াক, সেই সাথে তাদের মনের কোন না কোন অংশে জেগে থাকে এইসব শিশুদের মৃত্যুর সম্ভাবনার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। যদিও আমি বুঝতে পারছিলাম না এ নিয়ে তাদের অভিযুক্ত করা যায় কিনা।
কিন্তু আমি তাদের অভিযুক্ত করছিলাম, আমি তাদের অভিযুক্ত করছিলাম তাদের ঔদ্ধত্য আর কপটচারীতার জন্য। আমার অভিযোগ ছিলো স্টিভ গ’লির পক্ষ থেকে, আমার অভিযোগ ছিলো প্রতিটা শিশুর পক্ষ থেকে, যাদের অধিকার ছিলো একটা মুক্ত, স্বাধীন জীবন পাওয়ার, অধিকার ছিলো এইসব পরাজিত পূর্ণবয়স্কদের যৌনতা আর শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বন্দী জীবন নয় বরং নতুন, অন্যরকম একটা জীবন যাপনের।
স্টিভ গ’লি মারা যাওয়ার পর লোকজন বলতো ছেলেটা বলতে গেলে এতিম ছিলো, দেখার মতন কেউ ছিলো না তাকে, তাই মরেছে। কেউ যদি তাকে চোখে-চোখে রাখতো, ঘরের কাজকর্মে লাগিয়ে দিতো তাহলে নদীতীরের ঐ গাছটা থেকে নদীতে পড়ে ডুবে মরতে হতো না তাকে। ওর প্রতি অবহেলার কারণেই ছেলেটা মরেছে। আর ওর বাবা ছেলের মৃত্যুটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা হিসেবে নিয়েছিলেন, যেমন একটা কুকুরেরও হতে পারে। শেষকৃত্যানুষ্ঠানে পরার মত একটা ভালো স্যুটও ওনার ছিলো না। শেষ প্রার্থনাতে তিনি মাথাও নোয়াননি। কিন্তু এত লোকের মাঝে তিনিই ছিলেন একমাত্র যাকে আমার দোষী মনে হয়নি। তিনিই ছিলেন একমাত্র যাকে দেখে মনে হয়েছিলো এ মৃত্যুতে তার সায় নেই। তিনি কোন কিছু আটকাতে পারেননি, কিন্তু কোন দায়ও যেন ছিলো না তাঁর- অন্যদের মতন, যারা সেই মুহূর্তে তাদের অস্বাভাবিক ভারী গলায় প্রার্থনার নামে তাদের ভিতর জমে থাকা সমস্ত ধর্ম আর অসম্মান উগড়ে দিচ্ছিলো।
***
নর্থ ডাকোটা থেকে সামান্য সামনে গ্লেনডাইভে পৌঁছানোর পর আমাদের সামনে যাওয়ার মত দু’টো পথ ছিলো- যেদিক দিয়ে এসেছি সোজা সে পথেই এগিয়ে যাওয়া অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে উইনিস্টনে গিয়ে রুট ১৬ তে উঠে, আরেকটা সেকেন্ডারি রোড ধরে হাইওয়ে-২ এ ওঠা।
আমরা ঠিক করলাম ইন্টারস্টেট দিয়ে সোজা যাবো, এই পথেই তাড়াতাড়ি হবে, আর সেটাই ভালো। রাস্তায় যত দেরী হচ্ছিলো, খরচ তত বাড়ছিলো। যাই হোক, হাইওয়ে-২ এর দিকে না যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম।
“এটাই ভালো হয়েছে,” বললাম আমি।
অ্যান্ড্রু বললো, “শুরুতে কিন্তু প্ল্যান ছিলো এ পথ দিয়ে যাওয়ারই।”
“ক্যালিস্পেল আর হাভরে দেখা হলো না। উলফ পয়েন্টও না। নামগুলো সুন্দর, তাই না?”
“ফেরার সময় যাবো ওদিকে।”
‘ফেরার সময় যাবো’ কথাটা শুনে হঠাৎ করে মন ভালো হয়ে গেলো আমার। হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি, আমরা আবার ফিরবো এই পথ দিয়ে, বাকী পথ পাড়ি দিয়ে, আমাদের সব দায়িত্ব, সব সমস্যা মোকাবেলা করে, আমাদের নতুন গাড়ি, আমাদের জীবন আর আমদের পরিবারকে অক্ষুন্ন রেখে নিশ্চয়ই আমরা আবার ফিরে আসতে পারবো। তবু অ্যান্ড্রুর মুখ থেকে বের হওয়া শব্দ ক’টা যেন আমাকে স্বস্তি দিলো।
“আমি এখনও বুঝতে পারছি না,” অ্যান্ড্রু বললো, “তুমি টের পেয়েছিলে কী করে? বাচ্চাদের নিয়ে মায়েদের যে বিশেষ একটা অনুভূতি থাকে, এটা বোধহয় তাই, ঠিক না?”
আমার মনের একটা অংশ ওর কথা বিশ্বাস করতে চাইলো, গর্ববোধ করতে চাইলো নিজের মাতৃত্বের বিশেষ অনুভূতির উপর। আর একটা অংশ ওকে এবং আর সবাইকে সতর্ক করে দিতে চাইলো- কখনোই যেন কেউ এই অনুভূতির উপর নির্ভর না করে।
“আর আমি বুঝতে পারছি না,” আমি বললাম, “তুমি দেওয়ালটা পার হলে কীভাবে?”
“আমিও না।”
আমরা চলতে লাগলাম, পিছনের সিটে আমাদের দুই সন্তানকে নিয়ে, যারা আমাদের উপর পূর্ণ আস্থা রাখে, কারণ তাদের আর কোন উপায় নেই; আর আমরা, আমরা আস্থা রাখছি তাদের ক্ষমার, যখন এই শিশুরা আমাদের সকল বাগড়ম্বরিতা, খামখেয়ালীপনা, অমনোযোগিতা, অনুভূতিহীনতা সহ আমাদের সমস্ত সাধারণ আর অসাধারণ ভুলগুলো দেখতে পাবে এবং আমাদের অভিযুক্ত করবে সেসবের জন্য।
এলিস মুনরোঃ
এলিস মুনরোর জন্ম ১০ জুলাই, ১৯৩১, ওন্টারিওতে। ছেলেবেলায় হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এন্ডারসেনের “ দা লিটল মারমেইড” পড়ে ক্ষুদে জলকন্যার করুণ পরিণতি মানতে পারেননি ছোট্ট এলিস, বাড়ির চারপাশে হাঁটতে হাঁটতে কল্পনা করে নিয়েছিলেন জলকন্যা আর রাজপুত্রের বিয়ে হয়েছে, তারপর সুখ-শান্তিতে কাটিয়েছে তারা সারাটা জীবন। সেদিনই হয়তো নিয়তি ঠিক করে দিয়েছিলো এই দুঃখী গ্রহের মানুষগুলোরও সমস্ত বেদনা বহন করে যেতে হবে তাকে, বাকীটা জীবন লিখে যেতে হবে পরাজিত মানুষের গল্পগাঁথা। তাঁর চোদ্দটি গল্পগ্রন্থ সাক্ষী দিচ্ছে নিয়তির দেওয়া সে দায়িত্ব কতটা সততার সাথে চুকিয়ে গেছেন তিনি। আর নোবেল কমিটি এই মহৎ কথাসাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে তাদের দায়িত্ব সম্পাদন করেছে ২০১৩ সালে।
জি এইচ কুন্ডুঃ
জন্মঃ ১৫/০১/১৯৮৮
প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থঃ দা স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি (হারুকি মুরাকামি)