নার্সিসাস পানিতে প্রতিবিম্ব দেখে নিজের সৌন্দর্যের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন- এ গল্প হয়তো সবাই জানেন। কিন্তু আস্কিমোস আয়নায় নিজেকে দেখে ভেঙে পড়েছিলেন কান্নায়! আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিলো।
পৃথিবীর সভ্যতাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
এক. আয়না আবিষ্কারের আগের পৃথিবী।
দুই. আয়না আবিষ্কারের পরের পৃথিবী।
আর এই দুই পৃথিবীর মধ্যবর্তী ৫ মিনিট ৩৫ সেকেন্ড সময়ের মধ্যে আস্কিমোস আফ্রোদিতিকে চুমো খেয়েছিলো।
আফ্রোদিতির সৌন্দর্যের সামনে নিজের কুৎসিত চেহারা নিয়ে আর কখনোই যাননি তিনি। আয়নায় দেখা মুখ তার নিজের অস্তিত্বকে ভীষণ যন্ত্রণায় ফেলে দিয়েছিলো। পৃথিবীতে আস্কিমোস নামে কেউ ছিলো কিনা কে জানে! আমি, সোলাইমান মৃধা, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে এখন আর সুন্দর দেখি না। ফলত পৃথিবীর সুন্দরের সামনে ভীষণ মন্দ লাগে। আর নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে খুব।
২
বিয়ের সময় বরপক্ষকে কনের জন্য সাবান, তোয়ালে, আয়না, চিরুনি, তেল, স্নো, শাড়ি-কাপড় ইত্যাদি নিতে হয়। এই-ই নিয়ম। মায়ের বিয়ের সময় বাবা একটা আয়না কিনে নিয়েছিলেন। খয়েরি রঙের প্লাস্টিকের গোল ফ্রেমের আয়না। আয়নাটা বিয়ের সময় কেনা সাবান, তোয়ালে, শাড়ি, কাপড় ইত্যাদির সাথে একটা সুটকেসে তোলা আছে বহুদিন। মা সে আয়নাটা ব্যবহার করতেন না। যে আয়নাটা ব্যবহার করতেন সেটা ছিলো চৌকোনো সবুজ ফ্রেমের ছোট আয়না। সেটা ঝোলানো ছিলো আমাদের টিনের ঘরের কাঠের একটা খুঁটির সাথে। আয়নার নিচেই ওই পালাতে টানানো ছিলো জুলজানাহ’র ছবি। কিন্তু কে জানে, জুলজানাহকে আমরা বলতাম দুলদুল ঘোড়া। অথচ দুলদুল ছিলো খচ্চরের নাম। ছবিতে কারবালার প্রান্তরে শাদা ঘোড়ার গায়ে তীর বিঁধে আছে, আর রক্তাক্ত আহত ঘোড়াটি কাঁদছে। একদিন টেবিলে উঠে আয়না সরিয়ে ছবিটা দেখতে গিয়ে হাত থেকে আয়না পড়ে ভেঙে যায়। ভাঙা আয়নায় দেখি আমার অনেক মুখ। আমার দিকে অদ্ভুত তাকিয়ে আছে। ভাঙা আয়নায় সূর্যের প্রতিফলন ফুল হয়ে উঠছে। তাড়াতাড়ি টেবিল থেকে নামতে গিয়ে আচমকা পড়ে গিয়ে আমার বাঁ হাত ভেঙে যায়। একটুর জন্য ভাঙা আয়নার টুকরায় রক্তারক্তি হয়নি।
৩
দাদী বলতেন, ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে হয় না, আয়ু কমে যায়। দাদীর আয়নাটা ছিলো ছোট। শাদা প্লাস্টিকের ফ্রেমে সাঁটা আয়নার পেছনে ছিলো সিনেমার নায়িকার ছবি। রোজিনা। রোজিনার মুখে কালো তিল। হাসি হাসি মুখ। দাদী বিকেলে চুলে নারকেল তেল দিতেন। তারপর বড় কাকই দিয়ে এক হাতে চুল আঁচড়াতেন। আর হাতে ধরা থাকতো আয়না। দাদুর মুখ ঢেকে যেতো আয়নায়, দেখতাম আয়নার পেছনে রোজিনা মিটমিট হাসছে।
কোন কোন দিন নিঃসঙ্গ দুপুর নামতো পৃথিবীতে। তখন দাদীর বিছানায় তার পাশে শুয়ে থাকতাম। আর দাদীর কাছে জানতে চাইতাম, আচ্ছা দাদী, ভাঙা আয়নায় মুখ দেখতে হয় না কেন? দাদী বলেছিলেন, ভাঙা আয়না মানুষকে একটু একটু করে ক্ষয়ে ফেলে। ক্ষয় শেষে ভাঙা আয়নায় বাকি থাকে মানুষের আত্মা। এইসব গল্প শুনে কেমন যেন ভয় লাগতো। দাদীকে জড়িয়ে ধরতাম। দাদীর গা জুড়ে স্নেহের ঘ্রাণ জমা হয়ে থাকতো।
একদিন খুব ভোরবেলায় দাদী মারা গেলেন। ঝকমকে রোদের দিনে ডালিমতলায় দাদীকে কবরে রেখে এসে উজ্জ্বল বিকেলে খুঁজে বের করলাম দাদীর গুপ্তধনের বাকশো। একটা টিনের ট্রাঙ্ক। তাতে একটা পুঁতির মালা, মন্তুয়া ফুলের শুকনা ঝাড়, তিনটা মার্বেল, পঁয়ষট্টিটি টাকা আর একটা রুমালে প্যাঁচানো ভাঙা একটা আয়না।
দাদী কি চুপচাপ ভাঙা আয়নায় নিজেকে দেখতেন?
৪
আমার প্রেমিকা ছিলো দূর শহরের ফুল, ইতুল। দখিনা বাতাস সেই ফুলের সৌরভ নিয়ে আসতো। কোন কোন রবিবার হাই-ইশকুল পালিয়ে বাসে চড়ে সেই দূর শহরে চলে যেতাম। শহর মানেই দীর্ঘ বাজার। সবখানেই বেচাবিক্রি। ইতুলের বাসার সামনে ছিলো দ্য প্রিন্সেস হেয়ার কাটিং সেলুন। আমি দশ টাকা দিয়ে কোন কোন দিন ছেটে নিতাম দুয়েকটা অবাধ্য চুল। কিংবা সদ্য গজিয়ে ওঠা গোঁফটাকে ছেটে একটু সরু করে নিতাম। তারপর ইতুল যখন বাসা থেকে বের হয়ে তার ইশকুলের দিকে যেতে থাকতো, আমি তার পেছনে পেছনে হাঁটতাম। রাইচরণরোডের মাথায় দীর্ঘ কদম গাছটার নিচে এসে সে দাঁড়াতো। আর আমার দিকে তাকাতো। আমি দেখতাম তার আয়নার মতো দুটি চোখ। এতো স্বচ্ছ চোখ! আমি আর কারো দেখিনি। আমার হাতে থাকতো প্রতিদিন একটি করে লিখে জমানো অনেক চিঠি। তার হাতে চিঠি তুলে দিতে দিতে ইচ্ছে করতো একটা চুমু খাই। কিন্তু চুমু খাওয়া বারণ। ফলত চিঠি রেখে, তার চোখের তারায় চোখ এঁকে ফিরে আসতাম। কে জানে কেন ফিরতে ফিরতে বুক ভেঙে যেতো। প্রেম এক গভীর আবছায়া আয়না, যেখানে স্পষ্ট করে কিছুই দেখা যায় না।
এক রবিবার, আমি দ্য প্রিন্সেস হেয়ার কাটিং সেলুনে ছেঁটে নিয়েছি গোঁফ, তারপর দশটার দিকে চলে গেছে ঘড়ির কাঁটা। কিন্তু ইতুল আসে না। যখন ঘড়ি দশটা পঁচিশ ছাড়িয়েছে একটা ছেলে এসে জানতে চাইলো, আপনি সোলায়মান? আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি সোলাইমান মৃধা। তারপর ছেলেটা বললো, ‘আসেন।’ আর আমিও যেতে থাকছিলাম ছেলেটার সাথে। সে আমাকে নিয়ে যায় একটা ঘরে। ঘরে একটা ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসেছিলো ইতুল। সে আয়নায় আমাকে দেখছিলো, আর পেছনে দাঁড়িয়ে আমিও আয়নায় তার মুখ দেখছিলাম। তার ঠোঁটে কালো লিপস্টিক। তার দীঘল চুল ফ্যানের বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছিলো। সে বললো, আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।
এই শুনে আমার পৃথিবীর সমস্ত আয়না ভেঙে খানখান হয়ে গেলো। প্রেম ভাঙার আগে মূলত মানুষের আয়না ভেঙে যায়।
৫
একটা বড় আয়নার শখ ছিলো আমার মায়ের। ঠিক বড় আয়না না, ড্রেসিং টেবিলের শখ ছিলো আর কি! তখন বাবার চাকরিসূত্রে আমরা সরকারি কোয়ার্টারে থাকতাম। কোয়ার্টারে সবার বাসাতেই ড্রেসিং টেবিল ছিলো। ছিলো সোফা ও ডাইনিং টেবিল। আমাদের ছিলো না। আমরা ফ্লোরে মাদুর পেতে খেতাম। কিন্তু মা হয়তো বাবাকে বলেছিলেন, একটা ড্রেসিং টেবিল হলে ভালো হয়। তাই মজুমদার’স ফার্নিচারে কাঁঠাল কাঠ দিয়ে বাবা মায়ের জন্য ড্রেসিং টেবিল বানাতে দিয়েছিলেন। সেই সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা নাটক প্রচারিত হয়েছিলো; সে নাটকে আফসানা মিমির একটা ড্রেসিং টেবিলের শখ হয়েছিলো। টানাটানির সংসারে একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে ফেলাটা স্বামী আজিজুল হাকিমের পক্ষে খুব কঠিন ছিলো। তারপরও কষ্টে-শিষ্টে ড্রেসিং টেবিলের অর্ডার দেওয়া হয়। ড্রেসিং টেবিল কেনা হচ্ছে এই উপলক্ষ্যে আফসানা মিমি প্রতিবেশীদের চায়ের নিমন্ত্রণ জানান। ড্রেসিং টেবিল ঘরে আসার দিনে প্রতিবেশীরা যখন চা খাচ্ছিলেন, তখন যে ভ্যানওয়ালাটা ড্রেসিং টেবিল আনছিলো সে ভ্যান নিয়ে উল্টে পড়ে আর সাথে সাথে ভেঙে পড়ে ড্রেসিং টেবিল। আফসানা মিমির শখের ড্রেসিং টেবিলটা আর ঘরে আসে না।
এই নাটক দেখার পর প্রতিবেশীরা মাকে বললো, ‘চা খাওয়াতে হবে ভাবী। নতুন ড্রেসিং টেবিল আসছে আপনার। না হলে কিন্তু নাটকের মতো আপনার ড্রেসিং টেবিল আনার পথে ভেঙে পড়বে।’ কে জানে কেন আমার মনে হয়েছিলো, সত্যি সত্যি বুঝি মায়ের সে আয়নাও বোধ হয় ভেঙে-টেঙে যাবে। কিন্তু মাকে বলিনি। মা মন খারাপ করবেন ভেবে। আয়না ভেঙে পড়বে ভেবে আমার কিছুই ভালো লাগতো না। আয়না ঘরে আসা না অবধি আমি ঘুমাতে পারিনি শান্তিতে। আমার ভাবনা ভুল ছিলো। ঠিকঠাকই ড্রেসিং টেবিল আসলো আমাদের ঘরে। প্রতিবেশীরাও পায়েস শেষে টোস্ট বিস্কিট ভিজিয়ে চা খেলো।
ঘটনা ধরা পড়লো আরও কিছুদিন পর। ওই আয়নায় বড় বেশি সুন্দর লাগে। খুব বেশি উজ্জ্বল দেখায়। পাশের বাসার সোহেলীর আম্মু মাকে বললেন, ভাবী আপনার আয়নায় সমস্যা আছে! আমি কিন্তু মোটেও এতো সুন্দর না! কিন্তু আপনার আয়নায় এতো সুন্দর লাগে নিজেকে!! মা ভাবলেন, রসিকতা। হাসলেন। কিন্তু কিছুদিন পরও বোঝা গেলো, কথা সত্য। আয়নাটায় যে শুধু বেশি সুন্দর লাগে, তা নয়, আয়নায় দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। কিছুদিনের মাঝে ব্যাপারটা মা-ও ধরে ফেললেন। আয়নায় যেন সহসা চোখ না পড়ে তার জন্য একটা পর্দা টানিয়ে দিলেন। হলুদ রঙের। তাতে সেলাই করে লাল লাল ফুল তুললেন মা। এতো ঢেকেও ফেরানো গেলো না আনিতা আন্টিকে। পাশের বাসার আনিতা আন্টি ঠিকই আমাদের আয়নার প্রেমে মজে গেলেন। তিনি প্রায়ই সেজেগুজে আমাদের আয়নায় নিজেকে দেখতে আসতেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যেতো এই আয়নার সামনে। কোন কোন দিন আনিতা আন্টির স্বামী অজিত আংকেলের রাগান্বিত কণ্ঠ শুনতাম, ‘ওই বাসায় কী এতো তোমার? বুঝি না মনে করেছো! সব বুঝি আমি!’
এইসব শুনে মা আন্টিকে আসতে মানা করতেন। কিন্তু আন্টি মানতেন না। হয়তো একটা সবুজ শাড়ি পরে এসে আয়নার সামনে দাঁড়াতেন। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে মুগ্ধ হয়ে দেখতেন। কিংবা লাল টুকটুকে একটা শাড়ি পরে নিজেকে দেখতেন আমাদের আয়নায়। এতো সুন্দর ছিলেন আনিতা আন্টি! একরাতে আনিতা আন্টিদের বাসায় ভীষণ ঝগড়া হলো। একসময় কেউ কাউকে মারছে এমন শব্দ এলো। আনিতা আন্টির কান্নার শব্দ পেলাম। মা বাবাকে বললেন, মেয়েটাকে মারছে, গিয়ে থামাও। বাবা বিব্রত হয়ে রইলেন। দরজার কাছে গিয়েও ফিরে এলেন।
ভীষণ মনখারাপ নিয়ে ঘুমাতে গেলাম সেদিন। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো ঝনঝন কাচ ভাঙার শব্দে। উঠে গিয়ে দেখি বাবা দাঁড়িয়ে আছেন ঘরের মাঝখানে আর মা পা ঝুলিয়ে বসে আছেন বিছানায়। দু’জনের চোখ-মুখ শক্ত। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেন না। ড্রেসিং টেবিলটার আয়না ভেঙে পড়ে আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
৬
বিয়ের পর সে বললো, তার একটা আয়না দরকার। বড় আয়না। যেখানে সম্পূর্ণ নিজেকে দেখা যায়। বিয়ের পর তার বড় ভাইয়ের সাথে আমাদের সাবলেট সংসার। একটা ঘর, একটা ওয়াশরুম। ঘরের সাথে ছোট্ট একটা বারান্দা। সে বললো, তার একটা আয়না হলেই হবে, আপাতত তেমন কিছু চাই না। পরে আলাদা বাসা নিলে আর সব ফার্নিচার। আমি বললাম, ব্যাপার না। আয়না আর এমনকি!
আমি সোলাইমান মৃধা। যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়না ভেঙে পালিয়ে এসেছিলাম। আর ফেরা হয়নি। কোনমতে বিএ পাশ। ফলত ছোটখাটো চাকরি করি। বেতন কম। আমি চাইলেই একটা ড্রেসিং টেবিল কিনে ফেলার ক্ষমতা রাখি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়না ভাঙার গল্পটা আগে বলে নিই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স না পেয়ে, ভর্তি হয়েছিলাম একটা অসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কম্পিউটার বিজ্ঞানে স্নাতক পড়ছিলাম। দুইটা সেমিস্টার বেশ ভালোভাবেই শেষ হলো। তৃতীয় সেমিস্টারের একটা কোর্স ছিলো অবজেক্ট অরিয়েন্টেড প্রোগ্রামিং। কোর্স শেষে জাভার প্রেজেন্টেশন ছিলো। আমি ইংরেজি বলতে পারি না হেতু বাংলায় প্রেজেন্টেশন দিচ্ছিলাম। কোর্স টিচার খুব রেগে গিয়েছিলেন। সকলের সামনে খুব বিশ্রিভাবে বকলেন। বললেন, ক্ষেতগুলো কোথা থেকে আসছে! কী লেখাপড়া করে আসছে! ইংরেজি বলতে পারে না! লজ্জায় ম্লান হয়ে গেলাম। ক্লাস থেকে বের করে দিলেন। জীবনে এতো অপমান কখনও লাগেনি। ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। সেইবার প্রথম লক্ষ্য করলাম আয়নায় দীর্ঘক্ষণ নিজের চোখের দিকে তাকানো যায় না। কিছুক্ষণ নিজের চোখের দিকে তাকালে মাথায় সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভূত হয়। মনের ভেতর কী ঘটেছিলো কে জানে একটা পাথর ছুঁড়ে আয়না ভেঙে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। আর কোনদিন ফিরে যাইনি।
প্রাইভেটে বিএ পাশ। লোক ধরে অসরকারি একটা ব্যাংকের ক্যাশিয়ারের চাকরি পেয়েছি। বেতন সাকুল্যে তের হাজার ছয়শত পঁচানব্বই টাকা। ফলত চাইলেই একটা ড্রেসিং টেবিল হুট করে আমি কিনে ফেলতে পারি না আমার স্ত্রীর জন্য। বড় একটা আয়না, যেখানে সম্পূর্ণ দেখা যাবে নিজেকে, এমন আয়নার আর কয় টাকা দাম! এক ছুটির দিন তাকে নিয়ে বের হলাম। বললাম, তোমাকে আজ আয়না কিনে দেবো। সে হয়তো ভেবেছিলো, আমি তাকে ড্রেসিং টেবিলই কিনে দিতে চাচ্ছি। আনন্দে গদগদ হয়ে সেজেগুজে সে আমার সাথে চললো। রিকশায় উঠে সে তার ফোনে একটা ড্রেসিং টেবিলের নকশা দেখালো, ‘এই রকমটা আমার পছন্দ’। তখনও আমরা আমাদের পড়তে শিখি নাই। দেখি নাই নিজস্ব আয়নায় নিজেদের রূপ। তাই পরস্পরের চাহিদা ও স্বপ্ন তখনও অধরা। বললাম, ‘আমরা ড্রেসিং টেবিল কিনছি না। একটা বড় আয়না কিনতে যাচ্ছি। আরও পরে যখন পয়সা হবে, তখন যদি প্রয়োজন হয় তবে আমরা একটা ড্রেসিং টেবিল কিনবো।’ সে মন খারাপ করে বসে থাকলো সারাটা পথ। নিউমার্কেট গেলাম। আয়নার ফ্রেম পছন্দ করতে বললাম। কোন কথা বললো না। চুপ করে থাকলো। আমিই ফ্রেম পছন্দ করে সাড়ে সাতশো টাকায় একটা আয়না কিনে নিলাম। রিকশা করে ফিরছিলাম। ঝুম বৃষ্টি নামলো তখন। এমন বৃষ্টি! রিকশাওয়ালা কোথাও কোন খন্দে তার রিকশার চাকা ফেলে দিলো। আর ঝুনঝুন করে ভেঙে পড়লো আয়নাটা। আয়নার ভেঙেপড়া শব্দে খিলখিল হেসে উঠলো সে। প্রথমবারের মতো তার আয়নায় নিজেকে দেখতে পেলাম। আর আৎকে উঠলাম।
৭
মানুষের চোখই ছিলো পৃথিবীর প্রথম আয়না। এরপর আয়না হয়ে ওঠে জলের আঁধার, কালো পাথর অবসিদিয়ান, ধাতব টুকরা। আয়না কি কেবল পারদের প্রলেপ দেওয়া কাঁচের টুকরা? ধরি, যা প্রতিবিম্ব তৈরি করে তাই আয়না। পৃথিবীতে আয়নাই মূলত প্রথম আত্ম-সৌন্দর্যের ধারণা তৈরি করে। এবং আয়নাই প্রথম ভেঙে দেয় মনের আয়না ঝুনঝুন করে। আয়নায় প্রথম নিজেকে দেখার পর মানুষ প্রথমে কী ভেবেছিলো! আয়নায় নিজেকে দেখার আগে মানুষের ধারণা ছিলো সে হয়তো দেখতে তার প্র্রিয় কোন মানুষের মতো। কিন্তু আয়না সে ধারণা ভেঙে দেয়। ফলত সে জানতে পারে সে আদতে অমুকের চেয়ে সুন্দর বা তমুকের চেয়ে সুন্দর নয়। আয়না দেখার পরও মানুষ নিজেকে চিনতে পারেনি।
নিজের সত্তাকে দেখার একটা আয়না মানুষ খুঁজে গেছে বছরের পর বছর। রুমির আক্ষেপ, ‘সারা জীবন একই ভুল করলাম। নিজের চেহারার ধুলো না মুছে, আয়না মুছে গেলাম।’
আমি সোলাইমান মৃধা। কখনও নিজেকে দেখতে চাইনি আর। আদতে নিজেকে দেখার আর সময় হয়ে ওঠেনি। সামান্য ব্যাংকের ক্যাশিয়ার থেকে সফল শিল্পপতি। নিন্দুকেরা বলে মাত্র সাত বছরেই আমার নাকি আঙুল ফুলে অশ্বত্থ। কিন্তু আমি জানি, এই সাতটি বছর আমাকে কী পরিমাণ বিক্রি করতে হয়েছে নিজেকে। আমি নিজেকে বেচেছি, আবার নিজেই কিনে নিয়েছি, ফের বেচে দিয়েছি। বিশ্বাস করুন, পৃথিবীতে কেনাবেচা ছাড়া আপনি একদিনও টিকতে পারবেন না। এতোটাই বাজার হয়ে উঠেছে পৃথিবী!
এই বাজারেই একদিন ঘটনাটা ঘটলো! সোহরাব একটা সিনেমা বানাবে। সোহরাব আমার একটা ব্যবসার পার্টনার। তার ছবির শুভমহরতেই পরিচয় হয় হিয়া আনিকার সাথে। সে এক সিনেমা-নায়িকার কাজিন। বয়স ১৬/১৭ হবে। দেখতে কৈশোরে দেখা ইতুলের মতো। চল্লিশ পেরুনো আমি সেই ষোড়শীর প্রেমে পড়ে গেলাম। প্রেম মূলত এমন অনল যা জ্বলতে কোন জ্বালানি লাগে না। এখন আমার হাতভর্তি টাকা। জ্বালানির অভাব নেই। হিয়া আনিকার সাথে বেশ জমিয়ে ফেলা যায়। এখানে সেখানে লং ড্রাইভ, কখনও রেস্তোরাঁয়।
ওর বয়স এতো সুন্দর! বয়সটাকে ভালোবাসি। কিন্তু সে কি ভালোবাসে আমাকে? নাকি আমার টাকার জন্যই সে এমন ঘন হয়ে নামে! আমার সন্দেহ হয়। একদিন বৃষ্টির দিনে এক বহুতল ভবনে তাকে খাঁচায় আটকে ফেলি। দেখি যে সে ছটফট করে। সে চিৎকার করে। আমি জানতে চাই, তুমি ভালোবাসো না আমাকে? সে বলে, না। আমি আহত হই। আমি ক্ষোভে ফেটে পড়ি, ‘চিনিস আমাকে! আমি সোলাইমান মৃধা।’ কী এক দুর্দান্ত সাহস নিয়ে হিয়া আনিকা থুথু ছিটিয়ে দেয় আমার দিকে, বলে, তুই একটা বাল! কিন্তু এই বাজারে আমার বিনিয়োগের হিসেব বলে আমার প্রাপ্য আরও বাকি। আমাকে লাভ তুলে আনতেই হবে। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ি। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নখ বসিয়ে দেয় আমার শরীরে। চিৎকার করে বলে, ‘আয়নায় নিজের মুখ দেখছিস শুয়োর!’ তারপর খোলা ব্যালকনি দিয়ে পৃথিবীর দিকে লাফিয়ে পড়ে।
পৃথিবীতে নাকি অসংখ্য পাখি আত্মহত্যা করে। তাতে কার কী আসে যায়। আমার ফাও কিছু খরচ হয়ে গেলো। পৃথিবীতে অসংখ্য পাখি। প্রতি সন্ধ্যায় নেমে আসে উপল-সন্ধ্যা-বন। কিন্তু এরপর থেকে আমি আর আয়নার দিকে তাকাতে পারি না। কে জানে কেন আমি আয়নায় আমাকেই দেখতে পাই!
কৃষ্ণ জলেশ্বর
জন্ম: গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ময়মনসিংহে।
প্রকাশিত বই : আনোহাবৃক্ষের জ্যামিতি, ভাঙা আয়নায় দেখা মুখ, দূর গল্পপুর