‘যতীন সরকার আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট চিন্তাবিদ। তিনি মার্ক্সবাদে দীক্ষিত। তিনি যা কিছু বিশ্বাস করেন, তার মধ্যে নিরন্তর থাকে সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা। নিজের সাহিত্যকর্মে তিনি এই ভাবনা ছড়িয়ে দিয়েছেন, অন্যদের লেখায়ও তা সন্ধান করেছেন। যেখানে তার সাক্ষাৎ পেয়েছেন, সেখানে উল্লসিত হয়েছেন; সাক্ষাৎ না পেলে তাকে বাতিল করে দেননি, তবে হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বাংলার লোকসংস্কৃতিকে তিনি অবলোকন করেছেন গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। এর মধ্যে তিনি খুঁজে পেয়েছেন সাধারণ মানুষের সুখ–দুঃখ, বিরহ–মিলন পরিপূর্ণ জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি, খুঁজে পেয়েছেন তাদের জীবনভাবনার ইতিবাচক দিক।…শুধু লোকসংস্কৃতির বিশ্লেষণ নয়, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির নানা দিক দিয়ে যতীন সরকার যে ব্যাখ্যা–বিশ্লেষণ করেছেন, তার মধ্যে তার শক্তির স্ফুরণ দেখা যায়।…আদর্শবাদের প্রতি পক্ষপাত ছাড়া অন্য কোনো পক্ষপাতে তিনি দুষ্ট নন। তার সর্ববিদ বিচারে জীবনের প্রতি গভীর আসক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। তত্ত্বের সঙ্গে জীবনানন্দের এই যোগ তার কাছ থেকে আমাদের বড় পাওয়া।’
– (ড. আনিসুজ্জামান, ‘জলদ’ যতীন সরকার সংখ্যা।)
যতীন সরকার বিরাশিতে পৌঁছেছেন। সুস্থ ও নীরোগ মনে তিনি উচ্চারণ করেন, ‘আমি ভালো আছি, আমার শরীরটা ভালো নেই।’ আর্থাইটিসের ব্যথায় কষ্ট পান। হাড়ের যন্ত্রণায় খুব সামান্য সময়ের জন্য হয়তো লেখালেখি থেমে থাকে। ক্লান্ত মুহূর্তগুলো পাড়ি দিতে দিতে নিজেকে নিজেই শোনাতে থাকেন, ‘এই বিপুল পৃথিবীতে যে বা যিনি লড়াই শিখেছেন, তাকে থেমে থাকলে চলে না।’ একটা দৃঢ় প্রত্যয়ে তিনি লিখতে থাকেন। শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, সচল যাত্রায় তিনি পড়তে থাকেন। একটা সুদর্শন লাঠি হাতে তেজোদীপ্ত স্টাইলে হাঁটতে থাকেন। হাঁটতে হাঁটতে নিজের লেখা কুরিয়ার করতে বাজার পর্যন্ত চলে যান। জিজ্ঞেস করলে বলবেন, ‘এইটুকু কাজ নিজেরই করা উচিত।’ তিনি হয়তো ভাবেন, সময় আর বেশি নেই। যতটুকু হাঁটা যায়। যতটুকু লেখা যায়। নৈঃশব্দ্যের একেকটি সূর্যোদয় তার জীবনকে আনন্দে আহ্বান করে। আত্মজীবন না জানলে যে কেউ পৃথিবীতে বিষণ্ণ থাকতে পারে। বিষণ্নতা জীবনের হাসিকে গিলে ফেলে। আত্মজীবনকে জানতে জানতে, আত্মজীবনকে জানাতে জানাতে যতীন সরকার সুদর্শন একটা লাঠিতে ভর দিয়ে পৃথিবীতে হাঁটতে থাকেন। এই হাঁটাটাকে তিনি দায় ও দায়িত্ব ভাবেন। বয়সের ভারে তিনি বাতিল হয়ে যেতে চান না। নিজস্ব ঘরানার একটা ছায়া সম্মিলনে তার এই হাঁটা অব্যাহত আছে।
‘আমি দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করি’— এইভাবে কথা বলা যতীন সরকারের একটা স্টাইল। এইভাবে কথা বলে তিনি হয়তো শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চান। এই ধরনের বক্তব্য শুনে দূরের লোকজনও হয়তো কাছে আসবে। আগ্রহ ও আলিঙ্গন নিয়ে বক্তৃতার অতলে ডুব দেবে। তখন তিনি বলবেন, আমি যে দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাস করি সেটা জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব নয়। আমি বিশ্বাস করি, লেনিনের দ্বিজাতিতত্ত্বে। জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব মানুষকে ধর্মীয় সীমায় বিভাজিত করে। সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরুর ব্যবধান তৈরি করে। কিন্তু লেনিন বিশ্বাস করতেন, প্রতিটা জাতির ভেতরেই দুটি জাতি আছে। ওপরতলায় আছে শোষক জাতি এবং নিচতলায় আছে শোষিত জাতি। জীবিকা আর জীবনযাপনের ব্যবধানে জাতির ভেতরেও প্রকাশ্যে কিংবা অন্তরালে একটা শ্রেণিচরিত্র গড়ে ওঠে। লেনিনের দ্বিজাতিতত্ত্বে আস্থা রেখে তিনি শোষিতের পক্ষে। তিনি মনে করেন শ্রেণিবিভাজিত সমাজে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় শোষিতের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শ্রেণির উচ্ছেদ হলেই মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা পাবে। অর্থনির্ভর এই স্বপ্নহীন সময়ে তিনি সাম্যের পৃথিবীকে প্রতিষ্ঠা করতে চান। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দেশে দেশে যখন হতাশা ও স্বপ্নভঙ্গের আক্ষেপ, যতীন সরকার তখন বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে মার্ক্সবাদকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি এই পতনের জন্য মার্ক্সবাদকে দায়ী করেননি। মার্ক্সবাদকে বুঝতে না পারা কিংবা জনমানসে মার্ক্সবাদের সত্যে পৌঁছাতে না পারার ব্যর্থতাকে দায়ী করেছেন। জনগণ থেকে দূরে সরে গিয়ে কোনো মতবাদই দাঁড়াতে পারে না। এই পতনের জন্য জনবিচ্ছিন্নতাকেই দায়ী করেছেন। সরকার, পার্টি, আমলাতন্ত্র সম্পূর্ণরূপে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। পার্টির চালক কিংবা আপন সংঘের আত্মসমালোচনা করতে করতে যতীন সরকার এর কারণ চিহ্নিত করেন।
কিন্তু মার্ক্সবাদই যেখানে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র হচ্ছে দমনের যন্ত্র’ সেখানে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র–বা দমন–পীড়নহীন থাকে কী করে? যতক্ষণ রাষ্ট্র আছে, ততক্ষণ দমন–পীড়ন থাকবেই এবং সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রও দমনের যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। অন্য সকল রাষ্ট্রযন্ত্রের মতো সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র্রেও অপরিহার্যভাবেই আমলাতন্ত্র থাকে; সেখানে আবার রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে আসে পার্টি আমলাতন্ত্র। এই দুই আমলাতন্ত্রের দ্বন্দ্বসমাসের ফলে যে পূর্ববর্তী সকল রাষ্ট্রের মতোই বিচ্ছিন্নতা উপজাত হতে বাধ্য এ কথা কে অস্বীকার করতে পারবে? তবে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রে নিজের ওপরই কিন্তু দায়িত্ব বর্তে এই আমলাতন্ত্র ভেঙে ফেলার। কী করে সে ভাঙবে এই আমলাতন্ত্র? উত্তর: আমলাতন্ত্রের মূল উৎস এই রাষ্ট্রযন্ত্রটাকেই ভেঙে দিয়ে।
আসলে এই রাষ্ট্র ভাঙাটাই হচ্ছে মার্ক্সবাদের আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। এ প্রত্যয়টিকে স্পষ্টভাবে বুঝতে হলেও মার্ক্সীয় বিচ্ছিন্নতা তত্ত্বকেই গভীরভাবে অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ধনতন্ত্রী রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতা কেমনভাবে আসে, কী করে তার স্বরূপ—মার্ক্স এসবেরই পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছেন। কিন্তু সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে তিনি কোনো কথাই বলেননি। বলার দায়িত্বও তার ছিল না। এ ব্যাপারে দায়িত্ব বহন করার কথা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের কর্ণধারদের। কিন্তু তারাই এখানে চূড়ান্ত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তারা নিজেরা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রে বিচ্ছিন্নতার অস্তিত্বকে শুধু অস্বীকারই করেননি, যারা এই বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন তাদেরকেই নিষ্ঠুরভাবে দমন করেছেন।…
১৯৯১ সালের আগস্ট মাসের তৃতীয়–চতুর্থ সপ্তাহে সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত অতি নাটকীয় ঘটনাবলির জন্য এদের কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদের ওপর দোষারোপ করলেও কণ্ঠে তেমন জোর আছে বলে মনে হয় না। অবশ্যি মার্ক্সবাদের যান্ত্রিক ভাষ্যকাররা এখন আরো অনেক জোরে ‘সাম্রাজ্যবাদ’ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ বলে চেঁচাচ্ছেন বটে, কিন্তু এত সব বিপর্যয়কর ঘটনার পরও নিজেদের ভ্রান্তির দিকে একটুও তাকিয়ে দেখার গরজ বোধ করছেন না। মার্ক্সবাদের খণ্ডীকরণের ব্যাপারটির দিকে তাদের নজরই পড়ে না। উটপাখিবৃত্তি যেন এদের স্বভাবগত।
দুই.
সদর্পে, সগর্বে তিনি নিজেকে ‘মৌলবাদী’ বলেন। এইটাও তার কথা বলার স্টাইল। তার এই উচ্চারণে যে কেউ আঁতকে উঠবেন। তার সুদীর্ঘ পাঠ ও অভিজ্ঞানের ওপর প্রশ্ন রাখবেন। সাধারণ চোখে তাকিয়ে জনতা প্রশ্ন রাখবে, এই শতাব্দীতে লোকটা ধুতি-পাঞ্জাবি পরবে কেন? ধুতি তো একটা সম্প্রদায়ের পোশাক। একজন প্রজ্ঞান মানুষ সম্প্রদায়ের একটা পোশাকে আটকে থাকবে কেন? এই রকম কৌতূহলী জনতা কিংবা বাঁকা চোখের জিজ্ঞাসুদের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
‘এই ধুতি পরাটাও আমার একটা স্টাইল। পোশাক কখনোই একটা সম্প্রদায়ের প্রতিমূর্তি হতে পারে না। হিন্দু–মুসলিমনির্বিশেষে বাঙালিরা একসময় ধুতি পরত। এটা ছিল এলিট বাঙালির পোশাক। সাধারণ বাঙালির পোশাক ছিল লেংটি। সুতরাং ধুতিটা কোনো ধর্মীয় পোশাক নয়। এই ধুতি পরাটাকে আমার স্টাইল এবং প্রতিবাদও বলতে পারো। আমি কিন্তু কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে প্যান্ট–শার্ট পরেছি। ১৯৬৪ সালে আমি নাসিরাবাদ কলেজে যোগদান করি। তার আগে আমি গৌরীপুর হাইস্কুলে ৮ মাস চাকরি করেছি। কলেজে যোগ দেওয়ার আগে স্কুল থেকে ফেয়ারঅয়েলের উপহারস্বরূপ আমাকে তিন–চারটি ধুতি উপহার দেওয়া হয়। এই ধুতি পরে আমি তখন কলেজে গেলাম। দেখি, আমার কলিগদের কেউ কেউ বলাবলি করছিল, দেখেন, ‘লোকটা কেমন সাম্প্রদায়িক, ধুতি পরে কলেজে এসেছে।’ একটা জেদ চেপে গেল। ধুতিটাই হয়ে গেল নিত্যদিনের পোশাক। এর পরে যে আমি প্যান্ট পরিনি; এমনটা নয়। কিন্তু প্যান্ট পরলে ছাত্ররা রাগ করে। ছাত্ররা আমাকে বলে, ‘স্যার, আপনাকে প্যান্ট–শার্টে আমরা দেখতে চাই না।’ বাসায় সব সময়ই লুঙ্গি পরি। আমার ধুতি পরার জন্য কেউ যদি আমায় সাম্প্রদায়িক বলেন তাতে আমার কিছুই আসে যায় না। আমার ধুতি পরাটা আমার স্টাইল। বলতে পারো, এইটাও আমার আত্মপরিচয়। এইটাও আমার বাঙালিত্বের চর্চা।’
তিনি সগর্বে বলেন, আমি মৌলবাদী। মৌলবাদী এবং সাম্প্রদায়িক শব্দ দুটি নিন্দনীয় কিছু নয়। তিনি মানবীয় মৌলবাদের পক্ষে। তিনি ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদের বিপক্ষে। মানুষের ধর্মকে অস্বীকার করলে মানবসভ্যতাকে অস্বীকার করা হবে। এই মৌলই মানুষের মূল বিষয়। ইংরেজি ‘রিলিজিয়ন’ শব্দের সাথে বাংলা ধর্ম শব্দটিকে কোনোভাবেই মেলানো যাবে না। প্রত্যেক মানুষের মৌল কিছু বিষয় আছে। তলস্তয়ের ‘এসেন্স অব রিলিজিয়ন’-এর প্রসঙ্গের উল্লেখ করে তিনি সব ধর্মের মর্মমূল খুঁজে বের করার কথা বলেন। সারা জীবন এই মৌলধর্মকেই খুঁজে ফিরেছেন তিনি। তিনি তাই মৌলবাদী। ‘ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদ’ মানুষের মধ্যে বিভাজন-রেখা তৈরি করে। বিভেদ-বিভাজন-হানাহানি মানুষকে বিকশিত হতে দেয় না। মোল্লা-পুরোহিত-যাজকের হাতে বন্দী মানুষের ধর্ম। মানুষের ধর্মের মর্মমূলকে মুক্তি দিতে হবে।
তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টাও সমাজের ভদ্রলোকদের তৈরি। শোষণস্বার্থে তারাই সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষেরা, প্রাকৃতজনেরা মানুষ ধর্মের মর্মমূলের চর্চাই করে। রাজনৈতিক স্বার্থে, অভিজাততন্ত্রের স্বার্থে রাষ্ট্রও হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে যায়। ওপরতলার মানুষের স্বার্থে সাধারণ মানুষের ভেতরে সাম্প্রদায়িক বিভেদ কীভাবে কাজ করে বক্তৃতায় ও লেখায় যতীন সরকার তাই প্রচার করেন। তিনি সাধারণ মানুষের লোকায়ত সংস্কৃতির ভেতরে যে উদার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি আছে, সেই সংস্কৃতির পাঠ নিতে বলেন। লোকায়ত সংস্কৃতির ভেতরে তাকিয়েই তিনি মানুষের মর্মমূলের সন্ধান করেন। সবাইকে এই মানুষের মর্মমূলকে সন্ধানের আহ্বান জানান।
তিন.
যতীন সরকারকে আমি প্রাকৃতজনের বুদ্ধিজীবী হিসেবেই চিনি। পুরো জীবনে তিনি প্রথাবিরোধী লেখক তকমায় বন্দী হয়ে জনবিচ্ছিন্ন কোনো মতাদর্শ গড়ে তুলতে চাননি। প্রথার ভেতরে থেকে সামাজিক মানুষ হয়ে উচ্চারণ করেছেন তার বোধ ও উপলব্ধির কথা। প্রাকৃতজনের জীবনবোধ ও উপলব্ধির কথাই তিনি শোনাতে চান। কথা শোনানোর ব্যাপারে তার আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। তিনি মনে করেন, একটা মতাদর্শিক সংঘ এবং অবস্থান না থাকলে সময়টাকে বদলানো যায় না। তিনি সময় ও সমাজটাকে বদলাতে চান। তিনি মনে করেন, ইতিহাসের একটি সচল চাকা আছে। স্পাইরাল গতিতে ইতিহাসের চাকাটা ঘুরছে। মানুষই ইতিহাসের চাকাটা ঘোরাচ্ছে। তিনি তাই কথা বলাটাকে দায়িত্ব মনে করেন। সময় বদলানোর জন্য, ইতিহাসের চাকাটা ঘোরানোর জন্য কথা বলাটা তার কাছে খুব জরুরি। তিনি জানেন, একা একা কিছুই করা যায় না। তাই, একাশি বছর বয়সেও লাঠি হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। তার আচরণের চারপাশে তারকাখ্যাতির ঝংকার ও মোহ না থাকায় আমি তার ছাত্র হওয়ার চেষ্টা করেছি। একটা নির্ভেজাল আবেগে তার মননের চারপাশকে জানা-বোঝার চেষ্টা করেছি।
কারা বাংলার প্রাকৃতজন? কেন এবং কীভাবে তারা প্রাকৃতজন? এই প্রাকৃতজনের আকৃতি, প্রকৃতি ও মর্মসাধনাটাই-বা কী? কর্ম, সাধনা, জীবনযাপন ও উপলব্ধির ধরনটাই বা কী? কাল থেকে কালান্তরে কীভাবে তারা আত্মজ্ঞানের বোধকে, লোকজ্ঞানকে উত্তরাধিকারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন? কারা বাংলার মেহনতি আর মাটিবর্তী নির্মল পুরুষ? কেন এবং কাদের শাসনে তারা অচ্ছুত ও নিগৃহীত? প্রাকৃতজনের দার্শনিক হয়ে যতীন সরকার এই সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন। বাঙালির প্রকৃত অভিজ্ঞান কী! যাপিত জীবনের দলিল ও লৌকিক সত্যের স্বরূপটাই-বা কী! দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদীর আদর্শে যতীন সরকার প্রাকৃত সমাজের এই লোকজ্ঞানকেই আবিষ্কার করেছেন। তিনি মনে করেন ‘দর্শন’ কেবলই ‘বিদগ্ধ’ ও ‘পণ্ডিতজনে’র মননচর্চার বিষয় নয়। ‘পণ্ডিতজনে’র একাডেমিক পরিভাষার বাইরে থাকলেও বাংলার প্রাকৃতজনও দার্শনিক। জগৎ-জীবন ও সময়কে তারা নিজেদের মতো করে দেখেন, ভাবেন, বিশ্লেষণ করেন এবং যাপন করেন। বাংলা মুল্লুকে চিরনির্জনতায় বহমান সাধুদের প্রাকৃত জীবনের ধারণাটির প্রতি আস্থা রাখেন যতীন সরকার। তিনি বলেন,
আক্ষরিক অর্থে ‘দর্শন’ মানে দেখা। শব্দটির অর্থও এর আক্ষরিক অর্থকে যে একেবারে খারিজ করে দিয়েছে, এমন কথা নিশ্চয়ই বলা যাবে না। যুক্তি দ্বারা কারণ থেকে কার্যে এবং কার্য থেকে কারণে পৌঁছার নামই দর্শন। ‘কিংবা দর্শন হলো কার্যকারণ সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান’— দর্শনের পণ্ডিতজন–সমর্থিত এ রকম বিশেষ অর্থগুলো লক্ষ করলেও প্রতীতি জন্মে যে, কোনো বিষয়কে ভালো করে দেখা বা দেখতে চাওয়াই আসলে দর্শন।… প্রাকৃতজনও অবশ্যই তাদের নিজেদের সাধ্যমতো পারিপার্শে¦র বা জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়কে ভালো করে দেখতে চায়, সেসব বিষয়ের কার্যকারণ সম্পর্ককে খুঁজে বার করতে চায়। এই চাওয়ার আর্তি থেকেই গড়ে ওঠে প্রাকৃতজনের দর্শন, বিদগ্ধ পণ্ডিতজনের নিকট তা যতই হোক না কেন অবজ্ঞার বিষয়। তবে সেটি বিদগ্ধজনের দর্শনের মতো নিছক বিশুদ্ধ জ্ঞানানুসন্ধান নয়, যে কঠোর শ্রম দিয়ে প্রাকৃতজন জীবিকা অর্জন করে সেই শ্রম প্রক্রিয়ার সঙ্গে একান্তভাবে যুক্ত তার দর্শন।’
প্রতিদিনের আত্মজীবনের লড়াইটাই অন্ত্যজ শ্রেণির জীবনদর্শন। জীবনসংগ্রামের চালচিত্রটাই বাংলার প্রাকৃতজনের চিন্তা ও সাধনার জগৎ। জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের প্রয়োজনে মানুষ তার ভাবনাকে সম্প্রসারিত করে। নিম্নবর্ণের অচ্ছুত ও মেহনতি মানুষের ভেতর থেকেই উঠে এসেছিলেন সিদ্ধাচার্য, সাধু, চিন্তক ও দার্শনিক। জীবনকে তারা জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছেন। দেহের বাইরে অদেখা জগতের অস্তিত্বকে এরা স্বীকার করে না। শঙ্করাচার্য বলেন,
‘ইতর জনগণ বা প্রাকৃতজন এবং লোকায়তিকেরা চৈতন্যবিশিষ্ট দেহকেই আত্মা বলে মনে করে।…ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে বস্তুবাদ বনাম ভাববাদের বিতর্কটা প্রধানতই আত্মা নিয়ে। দেহাতিরিক্ত আত্মা অস্বীকার করাটাই চরম বস্তুবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এর প্রধান যুক্তি এই যে, পরলোকগামী আত্মা বলেই যদি কিছু না থাকে, তাহলে পরলোকের কল্পনাও তো অবান্তর। এই অর্থেই বস্তুবাদ ইহলোকসর্বস্ব দর্শন।’
বস্তুজগতের সাথে নিবিড় পরিচিত এই সব দলিত সমাজের ভেতরে ছিলেন ব্রাত্য ও সাধারণ। যতীন সরকার মনে করেন, “প্রাকৃত বাঙালির দর্শনচিন্তার লিখিত রূপ সম্ভবত সর্বপ্রথম পাওয়া যায় ‘দোহাকোষ’ ও চর্যাপদে। দোহা ও চর্যা রচয়িতারা অধিকাংশই ছিলেন সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষ।” তিনি মনে করেন, আর্যগন্ধি এই নামগুলোও তাদের ভিক্ষু-জীবনের পরিবর্তিত নাম কিংবা প্রাকৃত জীবনের সাধু জনসংস্কৃতির গুপ্ত নাম। রাজানুগৃহীত ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শের বিরোধী ছিল এদের উচ্চারণ। সমাজের ভেতরে এরা গুপ্ত ও নির্জন। সমাজের ভেতরে এরা প্রাকৃত ঘরানার সহজিয়া সমাজ।
কৃষিই বাঙালির আদি পেশা ও শ্রম। এই শ্রম ও পেশাই তৈরি করে দিয়েছিল বাঙালির মন ও মনন। যতীন সরকার মনে করেন, জীবিকা ও শ্রমনির্ভরতার ভেতর থেকেই উঠে এসেছে প্রাকৃতজনের চিন্তন কিংবা দার্শনিকতা। কৃষক সমাজের ভেতরেই জন্মেছেন তিনি। পিতা ছিলেন গ্রামীণ পরিমণ্ডলের হোমিও চিকিৎসক। পিতামহ স্কুলশিক্ষক। পিতা ও পিতামহের দীক্ষিত একটা উদার মনন নিয়ে খেতের আলে দাঁড়িয়ে দেখেছেন কৃষকের শ্রমজীবন। কৃষকের যাপিত জীবনের দিকে দৃষ্টি, মনন ও রাজনৈতিক পাঠ নিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন কৃষকের বোধ, বিশ্বাস ও মানসজগৎ। এই কৃষকই বাংলার প্রাকৃতজন। কৃষি ও কৃষকের অভিজ্ঞানের ভেতরেই আছে বাংলা লৌকিক দর্শন। কৃষকের জীবনাঙ্গনকেই তিনি বাঙালি সংস্কৃতির উৎসমুখ ভাবেন। উৎসমুখের দিকে তাকিয়েই পথিককে গন্তব্য নির্ধারণ করতে হবে।
‘কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের জীবনসংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত হয়েছে তাদের ভাবাদর্শ ও দর্শন। প্রাচীন ভারতের ‘লোকায়ত’ মত অনুসারে ‘বার্তা’ই ছিল একমাত্র বিদ্যা। এই ‘বার্তা’ শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে কৃষিকর্ম। এই কৃষিকর্মই প্রাক্–আধুনিক বাংলার প্রাকৃতজনেরও মূল উপজীবিকা বলেই তাদের জীবনভাবনাজাত দর্শনও প্রাচীন লোকায়ত দর্শনেরই সগোত্র। এ দর্শন সমাজের উচ্চকোটিতে অবস্থিত ব্রাহ্মণদের দর্শন থেকে আলাদা। কারণ ব্রাহ্মণরা নিজেদের জন্য কৃষিকর্মকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। মনুসংহিতাতে তো অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই এই নিষেধ বিধির কথা উল্লেখিত রয়েছে। ব্রাহ্মণরা উৎপাদন কর্মের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না, তারা ছিলেন মূলত পরশ্রমজীবী। পরশ্রমজীবীদের দর্শন পরিশ্রমজীবীদের দর্শন থেকে আলাদা না হয়েই পারে না। পরশ্রমজীবীরা বস্তুর চেয়ে ভাবকেই প্রধান করে তোলেন, তাদের দর্শন হয় মূলত ভাববাদ আশ্রয়ী। আর পরশ্রমজীবীরা জীবনসংগ্রামের সূত্রেই নিরেট বস্তুজগতের সঙ্গে সংযুক্ত বলে তাদের দর্শনে থাকে বস্তুবাদেরই প্রাধান্য। আধুনিক বিজ্ঞান যেভাবে বস্তুর স্বরূপ নির্ণয়ে সক্ষম হয়েছে, সেকালে তেমনটি সম্ভব হয়নি। তাই আধুনিক যুগের বস্তুবাদী দর্শনের সঙ্গে সেকালের প্রাকৃতজনের বস্তুবাদী দর্শনের প্রতি–তুলনা চলে না। তাদের বস্তুবাদ একধরনের সরল বস্তুবাদ (native materilism)। তবু তা বস্তুবাদই।’
প্রাকৃতজনের চিন্তা ও যাপনকে অস্বীকার করে একটি সমাজ ও সংস্কৃতি কখনোই দাঁড়াতে পারে না। বিশ্ব পুুঁজিবাজারের অর্থনৈতিক লোভাতুর মনন কখনোই বাঙালির কৃষক ও কৃষি সংস্কৃতিকে গিলে ফেলতে পারবে না। আপন সংস্কৃতির ভাষা, আবেগ ও যাপন পদ্ধতি রক্ষায় বাংলার কৃষকসমাজ চিরকাল লড়াই করে এসেছে। যতীন সরকার সংস্কৃতির বিলুপ্তিতে নয়, সংস্কৃতির রূপান্তরে বিশ্বাস করেন। কৃষিই ছিল বাঙালির প্রথম ও একমাত্র অর্থনীতি। এই কৃষি ও কৃষকই বাঙালি সংস্কৃতির আদিপিতা। প্রকৃতির ভেতরে কৃষকের বসবাস। এই প্রকৃতিই সংস্কৃতির জননী। প্রকৃতিতে শ্রেণিবিভাজন নেই। মানুষে মানুষে জাতি-বর্ণ বিভেদের চিন্তা নেই। লোকধর্ম হচ্ছে মাটি-মানুষের জীবনাচারের বিজ্ঞান। লোকধর্ম হচ্ছে, লোকজীবনের বিজ্ঞান। যতীন সরকার বলেন, বেদ মানে বিদ্যা। একটা সময়ের প্রাজ্ঞজনের চিন্তার ইতিহাস। সময় ও সমাজের সুযোগ-সুবিধাগুলোকে আয়ত্ত করে প্রাকৃতজনের নিত্য জীবনকে তথা সংস্কৃতিকে গিলে খাচ্ছে অভিজাততন্ত্র। অর্থনীতির বিপুল অহংকারে শ্রেণিবিভাজনকে প্রতিষ্ঠা করেছে কুলীনতন্ত্র। এই শ্রেণিবিভাজন অন্ত্যজ শ্রেণিকে কিংবা প্রান্তিক জনকে কিংবা শ্রমিকজনকে শাসন করার একটা কৌশলমাত্র।
প্রকৃতির বিজ্ঞানকে অনুভবের একটা দায়বোধ থেকে তিনি প্রাকৃতজনের চিন্তার জগৎকে সামনে নিয়ে এসেছেন। ভূমির জাতিস্মর হয়ে তিনি ভূমির কথা বলেন। বুদ্ধিজীবীর কাজ প্রকৃত প্রজ্ঞা ও সত্যটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এটি কোনো সাধারণ লোকদেখানো জীবিকা নয়। নিয়মমাফিক টেলিভিশন নামক মেকাপ বাক্সের ভেতরে ঢুকে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে কথা বলা নয়। এটি সত্য অনুভবের দায়। রাষ্ট্রের ভেতরে থেকেও বুদ্ধিজীবী তাই সত্যপাখি হয়ে একা একাই বসবাস করেন। একটা অনিরাপত্তার খড়গের ভেতরে চিরকাল সঞ্চিত হয়েছে মানুষের চিন্তাচর্চার ইতিহাস। সচেতনতার একটা সচল চক্ষুতে বসবাস করেন বুদ্ধিজীবী। মৌলিক ভাবনার বিপুল দিগন্তে তিনি কারো দলের তালিকাভুক্ত চিন্তাশিল্পী হতে পারেন না। সময় ও সমাজকে বোঝানোর একটা দায়ে তিনি বসবাস করেন। সময়কে বোঝাতে না পারা কিংবা সময়ের নাগরিককে বোঝাতে না পারার একটা ব্যাকুলতার ভেতরে একজন চিন্তককে বসবাস করতে হয়। শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে, জাগ্রত ও জাত চিন্তার কণ্ঠস্বরে চিন্তক তখন মাঠে নামেন। কে কী বলবে, কীভাবে আঘাত করবে, এই অস্থিরতায় মানুষের চিন্তাচর্চার ইতিহাস থেমে থাকে না। সময় ও জাতির প্রতিনিধি হয়ে যতীন সরকার তাই লিখেন, বক্তৃতা করেন, ছাত্র ও জনতাকে ক্লাসরুমের বাইরে ডেকে শিক্ষকতা করেন। এটা কোনো পেশা নয়, এটা জীবন ও জীবনানন্দ। এটা দায় ও দার্শনিকতা।
চার
শেষাংশে জানিয়ে রাখি, যতীন সরকার নাগরিক তকমায় বিকশিত হননি। একঝাঁক নবীন জীবনের সাথি হয়ে তিনি সব সময় মফস্বলবাসী। চিলির কবি পাবলো নেরুদা একবার নিজের শহর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি এই শহরে বেড়ে উঠেছি। এখানকার পাহাড় ও নদীর ফাঁকে ফাঁকে আমার কবিতা জন্ম নিয়েছে। এখানকার বৃষ্টি থেকে আমার কবিতা তার কণ্ঠ খুঁজে নিয়েছে। এখানকার গাছপালার মতো আমার কবিতা বনে বনে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে।’ তিনি এই মাটির সন্তান। ভূমিজ সন্তানদের চিন্তক হয়েই তিনি জন্মেছেন। সমাজের একটা দায়ের ভেতরে থাকে তার চিন্তনপ্রক্রিয়া। ভূমিজাত একটা মৌলিক ভাবনায় তিনি চলতি ও সনাতনী ভাবনাগুলোকে করাতকলে কাটেন। ইতিহাস দিয়ে সময়কে বিবেচনা করার একটা চেতনাসূত্রে তিনি বসবাস করেন। তরুণদের তিনি এই চেতনাসূত্রে ডাকেন।
সুবিখ্যাত ও সর্বজনবিদিত সমাজগোষ্ঠীর প্রচল পথে হেঁটে বুদ্ধিজীবী তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। সত্য ও ঐতিহ্যের একটা ধারাকে বুদ্ধিজীবী অনুসন্ধান করেন। যতীন সরকার মার্ক্সবাদের দার্শনিক সত্যকে জেনেছেন। তিনি গতি ও রূপান্তরের বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করেন। রাজনৈতিক আদর্শের বিচারে তিনি রক্ষণশীল ও কট্টর নন। তিনি আত্মসমালোচনা করতে জানেন। ভুল স্বীকার করে তিনি নতুন দিনের পাঠ নেন। দলীয় কিংবা সামাজিক বুদ্ধিজীবী হয়ে তিনি টক শোর নামে প্রতিদিন টিভি বাক্সের ভেতরে ঢুকে যাননি। একটা লাঠিতে ভর দিয়ে তার বিশ্বাস ও যাপিত জীবনের কথাগুলোই তিনি বলে যাচ্ছেন।
লেখক:
সরোজ মোস্তফা।
কবি, গদ্যকার। কর্মস্থল: বাংলা বিভাগ, নেত্রকোণা সরকারি কলেজ।