অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৫ এ প্রকাশিত হয়েছে বিপ্লব রায়-এর দুটো কবিতাগ্রন্থ : বৈভব থেকে ‘ব্রা-কেটে কিছু নেই‘, প্রচ্ছদ করেছেন রাজীব দত্ত। পাওয়া যাবে ঢাকা বইমেলা, বৈভব, ৫৭৫-৫৭৬ নং স্টলে। এবং বৈতরণী থেকে ‘মেঘ, ময়ূরের নির্বাসন‘। পাওয়া যাবে বৈতরণী, স্টল ৪৫১-তে।
ব্রা-কেটে কিছু নেই পাণ্ডুলিপি থেকে—
স্যানিটারি ন্যাপকিন
এই দাউদাউ সংসারে তুমি এসে একমুহুর্ত দাঁড়ালে
দেখতে, ডানা-ভাঙা দাঁড়কাকও কতটা পড়শী!
গরম পানিতে ঝলসে যাওয়া কুকুরের চোখে-মুখে বিস্ময়,
অভুক্ত বেড়ালটাও নির্বিকারে গর্ভবতী হয়।
অসুখের স্বৈরাচার যেখানে ভয়ার্ত সাইরেন
দেনাডোবা মানুষেরা রোজ সাঁতার ভুলে যায়,
সেখানেও অপ্রাসঙ্গিক, নিখুঁত, মন্ত্রবিলাসে,
একা একা গান গায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেখানে দাঁড়িয়ে তুমি অনুষঙ্গে ঠোঁট মেলাতে পারতে
ডেটলের গন্ধ ছাপিয়ে সেই চন্দ্রমল্লিকার হাসি!
রৌদ্র ঝলসানো দিনে আরো এক সূর্যরাক্ষসী
আমার একাকীত্বকে তুমি শুষে নিতে পারতে,
যেভাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন তোমার
নারীত্বকে শুষে নেয়।
আত্মমিথুন
এক তীব্র বিষের মতো জীবন আমি চেয়েছিলাম!
আমার প্রেমিকা বহুগামী, তবু বেশ্যা নয়।
তার অভাব আমাকে পোড়ায়, তবু ছাই করে না।
আমি ভস্মের ভিতর দাঁড়িয়ে আরেকটি পিচ্ছিল জন্ম চেয়েছিলাম।
আমি ধর্মগ্রন্থ ভুলে যৌন উত্তেজক হয়ে পড়েছিলাম
আমার ঈশ্বর মাতাল, দেখা হয়েছিল শুঁড়িখানায়।
সে পুরুষ, নাকি নারী, নাকি অর্ধ-নারীশ্বর আমি বুঝিনি!
কৈশোরের দুপুরে আত্মীয়া মেয়েটির নরোম স্তনের ভেতর
লুকিয়ে রেখেছি আমার প্রথম পাপের কাহিনি!
আমি শুদ্ধ হতে পারিনি,
শূদ্রের স্বভাবে ছুড়ে ফেলেছি এই অলীক বিশুদ্ধতা!
আমি যাকে পাই না, সে এক দারুণ রেপ্লিকা
ছড়িয়ে রয়েছে যত শোরুমে-দোকানে,
তবু সিনট্যাক্স ভেঙে আমি কবিতার ভেতরে
আরেকটা কবিতাকে ভেবে আত্মমিথুন করি।
বাসরঘরের কবিতা
অনেক ফিসফিস চুপচাপ সন্ধ্যা পেরিয়ে তুমি এসেছ
অনেক আড়চোখ; লুকোছাপা, ভাঁজ-করা বই থেকে তুমি এসেছ
পাড়াতুতো বড় ভাই আর দুঃসম্পর্কের বড় আপা থেকে এসেছ
গুগল, মেগাবাইট আর নিষিদ্ধ সাইট থেকে এসেছ
ফাঁকাছাদ, বৃষ্টি, প্রথম চুমু পেরিয়ে এসেছ
টয়লেট, গ্রাফিত্তি, ছোটখাট স্ল্যাং-এর ভেতর দিয়ে এসেছ
স্বমেহন, সন্ধ্যা, স্বপ্ন আর স্বপ্নদোষের ভেতর দিয়ে তুমি এসেছ।
হে মহান দেবী, যৌনভারাতুর এই নড়বড়ে সংসারে
তোমাকে স্বাগতম!
প্রকৃত চুম্বন
প্রকৃত চুম্বন নেই— শুধু সিঁড়িমুখো কিছু ব্যস্ত ওঠানামা
আমাদের সচলতা বোঝে।
একটা ছুটির সকাল লাল হয়ে আছে ক্যালেন্ডারের ভাঁজে।
জমানো কয়েন থেকে ঠিকরে উঠছে কিছু দুর্ভাবনা।
তুমি ভাবো, একটা শরীর ভেঙে কীভাবে জেগে উঠবে
এইসব বিবিধ বানান।
লুকাতে গিয়ে আমি এলোমেলো করেছি
একবুক অসুখ, ম্যাটিনি-শো’র টিকিট।
চলচ্চিত্র উৎসবের নামে শহরে উঠেছে এক গোলগাল চাঁদ
কিসের আশ্বাসে? অন্যমনস্ক এই স্ট্যান্ডম্যানের জীবনে
প্রকৃত চুম্বন নেই—
আছে চুম্বনদৃশ্যের নামে কিছু কপটতা।
শরীর, স্বৈরাচারে
তোমার চম্পকবনে দোপাটি ফোটে কিনা রোজ
জানি না।
ওপথে আজকাল কারা পথসভা করছে?
কীসের দাবি তাদের? তোমার নাভির কাছে তিল।
সমস্ত এলোমেলো মিছিল ঢুকে পড়বে অন্তঃপুরে।
তোমার পতনের শিস— ঠোঁটে ঠোঁটে বাজে
যেকোনো সন্ধিপ্রস্তাব তুমি ফিরিয়েছ ঝরাপাতায়!
তোমার একরোখা এই স্বভাবের শহরে
শরীরও স্বৈরাচার ছেড়ে, গণতন্ত্র চায়!
‘মেঘ, ময়ূরের নির্বাসন’ পাণ্ডুলিপি থেকে—
জলসাঘর
একটা নিচু মুদি দোকানের গল্প লিখতে পরিনি বলে
রাস্তা পেরোতে আমার এতো সংকোচ হয়।
আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে একটা পাগলের চোখ
স্বপ্নের ভেতরও, অর্থ খুঁজে দাও, অর্থ খুঁজে দাও!
অভিধানের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে কেমন
বিবর্ণ হচ্ছে শোক।
মানুষ পড়তে পারিনি বলেই তো এই রক্তাক্ত হোঁচট,
এত বিবমিষা!
স্বপ্নের ভিতরও স্বাদু সেই অন্ধ নারীর ঠোঁট
কী সংকেত পাঠায়!
শরীরকে শরীর দিয়ে আমি কখনো তৃপ্ত হতে পারিনি,
সেই মৃদু হরিণীর কথা কোথাও লেখা নেই।
কেবল আলগোছে তার পায়ে ভেঙে যাওয়া প্রতিটি ভোর
ছলকে যাওয়া যতো ঘুঙুর পাঠায়!
ঘুঙুরের কোনো ভাবার্থ হয় না পৃথিবীতে
যদিও জলসাঘরে রোজ টিকিট বিক্রি হয়।
নির্জন
কারা আজকাল জ্বালিয়ে দিয়েছে যত নির্জন মশারি।
ভেতরে ভেতরে ঘুম বালিশবদল করে।
মশারা আয়ু বেচে জমিয়েছে বিষণ্ন হালখাতা,
এসো হে আত্মজ, এসো হে রক্তজ, রক্তাভ ছারপোকা
মিটিয়ে দিও কিছু ঋণ, জীবিকার!
আমার চোখের ভিতর যত স্বপ্নের আলোড়ন
নিভিয়ে দাও, চুলের ঝাউবনে মত্ত ঝিঁঝিঁর বিলাপ
উসকে দিয়েছ বলেই এই রাজকীয় নাদ
বিদীর্ণ সংগীত! শোনো প্রার্থিতা, রমনকৌশলের চেয়ে
আরো বাস্তবিক, রাত্রিরের শোকগানে
প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক, ঘামের লবণ, অশ্রুর দাগ!
পাতার পুরাণ
শরীরের পাতা ঝরে যাচ্ছে, তুমি আর খোঁজও রাখো না।
নতুন পাতার নিচে চাপা পড়ে পুরনো পাতার শোক,
ক্লান্ত পিঁপড়ের সারি, অজস্র অভিমুখ।
আমি কোনদিকে যাবো? যেদিকে সোনার মিনার?
গির্জাঘড়িতে রোজ দোল খায় আমার শুভ ও অশুভ
পাঁজর ভাঙার সংকেত বুঝে নেয় সব শিকারী ও শিকার ।
পাতার নিচে এখন লুকিয়ে রেখেছি কিছু সাপের ফণা
চারপাশে হাওয়া, ঘাসবনের উল্লাস, পথিকের ভুল।
গ্রীনরুমে
একটি পোশাক থেকে আরেকটি পোশাকের দিকে এই যাত্রা
মূলত জন্মান্তর, শোনো, অন্ধবণিক
সারেং-এর ইচ্ছে বোঝে নীলাভ সাগর-জল!
ভেসে যাওয়া কচুরিপানার ফুলে যে মুগ্ধতা দোলে
ক্ষণিক আলোড়ন, তাকে তুমি দূরবীনেই রাখো,
এই মঞ্চসফল পালাগানে দোহারেরা অবান্তর।
তবু মহড়ার ঘ্রাণ কিছু লেগে থাকে শরীর ও মগজে
ঘষে-মেজে মুছে ফেলা বিগত সম্পর্কের দাগ,
বাইরে হর্ষধ্বনি, উলুধ্বনি, দর্শকেরা অপেক্ষায় অধীর।
গ্রীনরুমে নগ্নতা কাঁদে,
ফের, শুরু হবে অভিনয়।
হেকিমপুর
ছিপি খুলে মেপে মেপে নিচ্ছি
রঙিন বোতলের ভিতর অজানা জীবন।
কিছুটা আরোগ্য পাবো সামান্য উপশম
এই ভেবে ভেবে হেকিমপুরের দিকে
আমার পথ বেঁকে যায়।
আমার ব্যথাগুলো বুকের ভিতর পুষে
একা বৈষ্ণবী
এখনো সুরেলা সহজ, সহজিয়া জীবন
পেরিয়ে যাচ্ছে রোজ পদাবলীর উঠোন,
গলার কাছে বিঁধে আছে বোবা দোতারা।
আমার পারাপার নেই, আরোগ্য নেই
তবু হেকিমের বাক্স ভেঙে আমি বের করে আনি
একটা চাঁদের ট্যাবলেট, এক শিশি নদী।
বিপ্লব রায়
কবি
জন্ম ১৯৮৭, খুলনায়। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। পেশায় সহযোগী অধ্যাপক, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ : শামুকখোলে শিস, স্বরচিত ধানক্ষেত, ধর্মান্তরিত আগরবাতি।
সম্মাননা : বামিহাল তরুণ কবি পুরষ্কার (২০২৩), ফুলকলি পুরষ্কার (কবিতা) (২০২৪)