পাণ্ডুলিপি থেকে : নিকোলাই রুবৎসভ – শ্রেষ্ঠ কবিতা | অনুবাদ : শামসুদ্দোহা তৌহীদ

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ

(জানুয়ারি ৩, ১৯৩৬- জানুয়ারি ১৯, ১৯৭১)


রাশিয়ার জনপ্রিয় কবি নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ ১৯৩৬ সালের ৩রা জানুয়ারি রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলে (বর্তমানে আরখানগেলস্ক অঞ্চল যেখানে রাশিয়ার সবচেয়ে বড়ো কাঠ রপ্তানি বন্দর আছে) হলমোগোরি জেলার ইয়েমেৎস্ক নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মিখাইল অ্যানড্রিয়ানোভিচ ছিলেন স্থানীয় ফরেস্ট্রি এন্ট্রারপ্রাইজের প্রধান। পরবর্তীতে তাদের পরিবার ভলগোদা নামক গ্রামে স্থানান্তর করে বসবাস শুরু করে। এই ভলগোদা গ্রামে কেটে যায় কবির শৈশব আর তাই এই ভলগোদা গ্রাম বারেবারে ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায়।

নিকোলাই মিখাইলোভিচ রুবৎসভ

১৯৪১ সালের জানুয়ারিতে নিকোলাই রুবৎসভের বাবা ভলগোদা শহরের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ভলগোদায় রুবৎসভ পরিবারকে যুদ্ধকালীন সময়ে নানা দুর্যোগের সম্মুখীন হতে হয়।

যুদ্ধ শুরু হতেই রুবৎসভের বাবা ফ্রন্টে যোগ দেন, আর মা হঠাৎই মৃত্যুবরণ করেন। এরপর ছয় ভাইবোনকে বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। প্রথমে তারা ক্রাসকোভো গ্রামের এতিমখানায় ছিল, পরে একে একে আলাদা শহরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে তারা একে অপরকে চিরতরে হারিয়ে ফেলে। নিকোলাইকে ভলগোদা অঞ্চলের তোতেমস্ক জেলার নিকোলস্ক গ্রামে এতিমখানায় পাঠানো হয়, যেখানে তিনি ১৯৪৩ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫০ সালের জুন পর্যন্ত ছিলেন। সেখানেই তিনি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি সবসময় আশা করতেন যে তার বাবা একদিন তাকে বাড়িতে নিয়ে যাবেন। কিন্তু এখানেও তার জন্য ছিল হতাশা—বাবা নতুন পরিবার গড়ে তোলেন এবং প্রথম পক্ষের ছয় সন্তানকে পুরোপুরি ত্যাগ করেন। পরে কবি স্মৃতিচারণ করেছিলেন যে এতিমখানাতেই তিনি তার প্রথম কবিতা লিখেছিলেন।

কিন্তু কবিতা লেখার আগে তিনি জীবন আরও অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি তোতেমস্কের বন-প্রযুক্তি কলেজে পড়াশোনা করেন। ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ সালে তিনি আর্কটিক ট্রলার ফ্লিটে কাজ করেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি মুরমানস্ক অঞ্চলের কিরোভস্ক শহরে খনি-রাসায়নিক প্রযুক্তি কলেজে পড়াশোনা করেন। এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি সামরিক পরীক্ষামূলক কেন্দ্রে একজন শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৫৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিনি নৌবাহিনীতে কাজ করেন। এরপর লেনিনগ্রাদে ফিরে এসে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হন—কখনো মিস্ত্রি, আবার কখনো কারখানার শ্রমিক।

তবে জীবনের সব প্রতিকূলতার মাঝেও কবিতার প্রতি তার ভালোবাসা অটুট ছিল। কবিতা তার জন্য একান্ত আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল। লেনিনগ্রাদে তিনি “নারভস্কা জাস্তাভা” নামক সাহিত্য সংঘে যোগ দেন। তরুণ কবিদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন এবং ১৯৬২ সালে তার প্রথম কবিতা সংকলন “তরঙ্গ এবং শিলা” প্রকাশ করেন। একই বছরে তিনি মস্কোর মাক্সিম গোর্কি সাহিত্য ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন এবং সেখানে ভ্লাদিমির সোকোলভ, স্তানিস্লাভ কুন্যায়েভ প্রমুখ লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের সহযোগিতায় ১৯৬০-এর দশকে তার প্রথম বইগুলো প্রকাশিত হয়।

১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় “মাঠ-জ্বলা তারা” কাব্যগ্রন্থটি। এ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালে সাহিত্য ইনস্টিটিউট থেকে স্নাতক শেষ করার পর তিনি “ভলগোদা কমসোমোলেটস” পত্রিকার কর্মী হিসেবে কাজ করেন। 

এর মাঝে তাঁর বিবাহ হয়। কিন্তু কবি নিকোলাই রুবৎসভ মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়েন। সাংসারিক জীবনের টানাটানি, কর্জ – এসব কিছু মিলিয়ে তিনি সাইবেরিয়াতে পাড়ি জমান৷

পরবর্তীতে তিনি উঠতি নারী কবি লুদমিলা দারবিনার সাথে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন এবং তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের দিনেই অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৯শে জানুয়ারি  দ্বিতীয় স্ত্রী লুদমিলা দারবিনা দাম্পত্য কলহের জেরে তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগেই তিনি যেন ভবিষ্যৎ বাণী করে লিখেছেন, “I will die in Epiphany Frosts. I will die  when the birches crack.”

তাঁর মৃত্যুর পরে বিশটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সারাবিশ্বে তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মূলত তাঁর মৃত্যুর পরে।

নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা সমালোচকদের মতে, তাঁর কবিতা সহজ ভাষা ও গভীর ভাবনার সংমিশ্রণে অনন্য। তার লেখার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ছিল তাঁর প্রিয় ভলগোদা ও রুশ উত্তরাঞ্চল। এ অঞ্চলেই তিনি নিজেকে বিকশিত করেন আর অনুভব করেন মানবজীবনের এক সূক্ষ্ম বোধ।

রাশিয়ার মহান জাতীয় কবি আলেক্সান্দর পুশকিনের কবিতাগুলো এত ছন্দময় আর গীতল যে ধীরে ধীরে রুশ জনগণের মুখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। পুশকিনের প্রভাবেই রুশ কাব্যভাষা জনগণের মুখের বুলির কাছাকাছি চলে এসেছে। আর তাই রুশ কবিতায় কথ্য ভাষার চেয়ে ভিন্ন ধরনের বাক্যগঠন রীতি প্রয়োজন হয় না। আর রুশ শব্দ ভাণ্ডার এত বিস্তৃত যে সহজেই সমার্থক শব্দ খুঁজে কবিতায় ছন্দ দেওয়া যায়। পুশকিনের পরে ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি, আন্না আহমাতভা, মিখাইল লেরমেন্তভ, রসুল হামজাতভ, বরিস পাস্তেরনাক, সের্গেই ইয়েসেনিন, আলেকজান্দর ব্লক প্রমুখ কবিরা রুশ কবিতার জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন।

রুশ গীতিকবির মধ্যে যিনি আজ অধিক জনপ্রিয়, তিনি হলেন নিকোলাই রুবৎসভ। তিনি সোভিয়েত আমলে কবিতা লিখেছেন এবং আজও তিনি তুমুল জনপ্রিয় রুশ জনগণের কাছে৷ তাঁর অসংখ্য কবিতা গানে পরিণত হয়েছে এবং দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাঁর কবিতা। নিকোলাই রুবৎসভের কবিতা একদৃষ্টিতে খুবই সাধারণ মনে হয়। একজন বালক যেমন নতুন কিছু দেখে চমকে ওঠে, তেমনই চমকে ওঠা দৃষ্টিতে সাধারণ অনুষঙ্গ নিয়ে কবিতা লিখেছেন তিনি। তবে সেই ছন্দময় কবিতাগুলো পাঠকের অনুভূতির খুব কাছের হয়ে ওঠে। যখন কবি ঘাস নিড়ানোর সময় বুনোফুল কাটা পড়লে অনুশোচনায় বিদ্ধ হতে থাকেন, তাঁর সেই স্মৃতি যেন কবিতার চরণে চরণে কেঁদে ওঠে। কবি ভালোবাসেন নদীর পাড়ে থাকা কুপাভা ফুল, ভাঁটফুলকে৷ কখনো কখনো কবি জীবনানন্দ দাশের সাথে ভীষণ মিল খুঁজে পাই নিকোলাই রুবৎসভের জীবনদর্শন অনুভব করে।

পিতৃ-মাতৃহীন শৈশব কৈশোর পার করেছিলেন তিনি। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে কত রকম পেশা, যুদ্ধের নারকীয় পরিণতি দর্শন, রাশিয়ার অপরূপ শোভা সবকিছু মিলে তাঁকে তৈরি করেছে আমাদের জীবনের কাছের এক স্নিগ্ধ কবিতে৷

তুষারপাতে পথহারা পথিককে পথের দিশা দেয় কুটিরের যে নিভুনিভু আলো, তুষার পীড়িত একটা কাকের কষ্ট এসব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম অনুভূতি ধরা পড়ে তাঁর চোখে। তাঁর কবিতা খুব সরল। এটাই হয়তো তার কবিতার মুক্তোদানা। শব্দের পরে শব্দের খোল সরিয়ে আমরা টের পাই ঝিনুকের মাঝে মুক্তোর আলো।

‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত ‘নিকোলাই রুবৎসভ – শ্রেষ্ঠ কবিতা’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপি থেকে একগুচ্ছ কবিতা রইলো শিরিষের ডালপালা-র পাঠকদের জন্য। গ্রন্থটি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন শামসুদ্দোহা তৌহীদ। মূল রুশ থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন, ইয়েভগেনি স্পিরিন।


পানসি ফুলের দুঃখ

শিশির ধোয়া সাতসকালের ফুল
কেমন করে ফোটে!
কেমন করে পাপড়ি মেলে!
ঘাস নিড়ানো কাস্তে দিয়ে যখন গেল কেটে
শুধাই, ‘ওগো ফুল,  তোমার নাম কী ছিল?’
এই গোপন খুনের কথা লুকিয়েছি কত দিন!
সবুজ ঘাসের বুকে আমার  নীল নয়না ফুল
অভিমানী  ‘অ্যানার আঁখি’ বলে তোমায় আমি ডাকি।

Цветы
Flowers


 

অক্ষয় স্মৃতি

নিস্তরঙ্গ জল যেন কাচের অধিক
আলো মিটমিট জলের গহীন
বর্শার মতো ঘাই মারে পাইক
জলের এই  দৃশ্য বড্ড রঙিন!

বার্চবন
পাহাড়ের কোলে ছোট্ট কুটির
আকাশের শত কোটি তারা
জলের গায়ে আঁকে স্বপ্ন।
ঈশ্বরের গড়া স্বর্গ মন্দির
ভেসে যায় জলের মিনার!
রাশিয়া!  তুমি বড়ো বাজিকর!

তোমার আকাশে জ্বলে মুঠো মুঠো তারা
কেটে যাক কয়েক শতাব্দী এমন চুপে
এই আদিম রূপ দেখেছে যারা
এই দৃশ্য অক্ষয়- তাদের হৃদয়ে রবে।

Душа хранит
The soul retains memories


বিদায়ের গান

এই পুরাতন গাঁ ছেড়ে চলে যাব আমি
শিগগিরই বরফে ঢেকে যাবে নদী
দরজায় চিড় ধরে এইসব রাতে
আর উঠোন ভরে যাবে পলিতে।

তুমি এলে এই বিদায় বেলায়
ধূসর জমিতে  নামে মলিন শরৎ ও।
বার্চের দোলনায় এই রাত দোলায়
তুমি কেঁদে গেলে এই রাত কত!
দুষছিলে নাকি আমায়, ওগো প্রিয়?

কেন তবে নত হয় তোমার আঁখি?
নিরালা জলার কাছে কোন সুখে
ক্রানবেরি তুলে দিলে আমার মুখে
যেন আমি এক আদুরে পাখি!

শুনতে কি পাও বাতাসের শিস গোলাঘরের কাছে?
মেয়ে তোমার হেসে ওঠে কোন স্বপনে?
হয়তোবা খেলছে পরীদের সাথে
তাদের সাথে উড়ে যায় স্বর্গের পানে।

কেঁদো না প্রিয়, এই জাহাজঘাটায়
বসন্তে আর চেয়ে থেকো না ষ্টীমারের জন্য,
চলো আজি পান করি এই বিচ্ছেদ-বেদনায়
আমাদের এই ক্ষয়িষ্ণু প্রেমের জন্য।

তুমি আর আমি হলাম ভিন্ন ডেরার পাখি
তবে কেন অপেক্ষা পরস্পরের প্রতি?
হয়তো ফিরব কোন একদিন
হয়তোবা কখনও ফিরব  না আমি।

তুমি জানো না গো প্রিয়
যেখানেই আমি যাই
শুনি আমার পিছুপিছু  অপয়ার পায়ের আওয়াজ
এমনকি বিকারেও।

এই বেদনাবিধুর গাঁয়ে তোমার প্রেমের পরশ
আর বেরি ফলের দিনগুলোর কথা
যেদিন আমার পড়বে মনে
আমি পাঠাবো পরীর মতোন পুতুল
যেন আমার বলা শেষ রূপকথা।

আর তোমার মেয়ে যখন খেলবে পুতুল
কেটে যাবে দিন পুতুলের সাথে,
আর বলবে,‘আম্মু, আম্মু, কত্ত সুন্দর পুতুল!
কিন্তু শুধু কাঁদে আর কাঁদে।’

Прощальная песня
A Farewell Song


ইনসমনিয়া

আবছা আলোয় জ্বলে বাতায়ন,
রাতের বুকে নামে ঝড়
শন শন, শন শন।
শ্রান্তি ভর করে চোখের পাতায়
আজ বড়ো একাকী এই ঘর!

আমি এক হারানো অতীত
এই ঘর আজ জাহাজের কেবিন
জলডুবি রাত আর জলডুবি দিন
ঈশ্বর জানে এই মিথ!

এই ঘর আর বাতায়ন উধাও
চারপাশে জমেছে পাঁক
দৃশ্যেরা করে কিলবিল
তুমি অনাহুত!
দূর হয়ে যাও।
ঘুম! আমাকে তোমার বাহুডোরে নাও।

ভাবনায় ডুবে যাই
ধরা দেয় সবকিছু যা ছিল তুচ্ছ!
আনন্দের বদলে ভয়
বিশ্রামের বদলে পীড়ন!

Бессонница
Insomnia

গ্রামের বাড়ি

যদিও আগন্তুক অভিশাপ দেয় নদীপাড় ঘেঁষা মেঠো পথকে
তবুও আমি ভালোবাসি আমার গ্রাম নিকোলাকে
আমার ইসকুলের দিনগুলো কেটেছে সেখানে।

আগন্তুকের পিছুপিছু দৌড়ে যায় যে কৌতূহলী বালক,
ধুলা মাখা গায়ে তারও সাধ জাগে
যদি ছেড়ে যেতাম এই গাঁ!

বালকটি ঘোষণা দেয় মেয়েদের ভীড়ে
‘এই গাঁয়ে খালি পায়ে হাঁটবো  না আর
আমি রাজধানীতে চলে যাব এই গাঁ ছেড়ে।

সময় গড়াবে যখন কালের খেয়ায়
তার মনে পড়বে ইসকুলে যাওয়ার দিন
চোখ ভিজে আসবে নিকোলার মায়ায়!

Родная деревня
Home Village

উইলো

উইলো, কেন তুমি বাড়ো নাব্য নদীর কূলে?
কেন তুমি চুমু খাও নদীর ঘোলা জলে?
যেন অথৈজল শান্ত করো এক মায়াবী ছলে

ইস্টিমারের ঢেউ ভেঙে  যায় তোমার কাছে এসে
তোমার প্রেমের বেদী ক্ষয়ে যায় নীরবে
যদি তুমি তা জানতে!

দূর পাহাড়ের কোলে এক গির্জার তলে
রোদ ঝলমল করে দীঘির শান্ত জলে
তোমার বোন উইলো জলকেলি করে
ভালোবাসার নীরব প্রশ্রয়ে!

ИВА
Willow

 

পপলার গাছের পাতা ঝরে যায়

পপলার গাছের পাতা ঝরে যায়
এ যে জগতের নিত্যকার ঘটনা
কিন্তু ঝরা পাতার জন্য দুঃখ করো না প্রিয়
দুঃখ করো না
আমার ভালোবাসার দিকে একটিবার তাকাও
পপলারের পাতা ঝরেছে, ঝরুক না!
তুমি তুষারঝড়কে অভিশাপ দিও না।
গাছের পাতা ঝরে যায়
এতে কার দোষ আছে বলো?

Улетели листья.
The leaves have flown away

রাশিয়ার জ্যোতি!

এক.

এমন প্রবল তুষারপাতে অবশ হয়ে যাচ্ছি আমি
আমায় ডুবিয়ে দেয় এক অসাড়তায়
স্তব্ধতা ভর করেছে দেবদারুর নবীন শাখায়
শূন্যতা নিয়ে থমকে আছে আকাশ
তারা নেই!

আমার চারপাশে বিপন্নতা খেলা করে
আমি এক একলা প্রাণ
এই অন্তহীন জড় প্রান্তরে।

আচমকা কোথাও দেখা যায় টিমটিমে আলো
হয়তোবা স্বপ্ন!
আলো! তুমি মরুদ্যানের ফুল হয়ে ফোটো!

তুষার মানবের বেশে আমায় লাগছিল তাগড়াই
যখন  জীর্ণ কুটিরের চৌকাঠ মাড়াই
এই বাড়ি আজ আমার শেষ আশ্রয়
গায়ের ওপর থেকে যখন তুষার ঝারি
গৃহকর্ত্রী গরম কাপড় এনে দিয়ে বলেন,
“আয় বাছা, আগুনের কাছে আয়।”
আমার দিকে চেয়ে রয় তার নিষ্প্রাণ আর ক্লান্তিমাখা মুখ
কিন্তু তার চোখে ভাসে অপত্য করুনা।
ধীরে ধীরে  করুনাময়ীর চোখে ঘুম নামে।

 

দুই.

হলুদাভ এক পারিবারিক ফটোগ্রাফ দেয়ালে ঝোলানো
আমি বুঝি এইসব ছবির মর্ম
আমিও যে বাপ-মা হীন অনাথ!
আজ যুদ্ধ আর ঘৃণার আগুনে জ্বলছে পৃথিবী!
শোকাচ্ছন্ন হৃদয় জানে না কোথা আছে প্রাণ নাথ!

গৃহকর্ত্রী শুধালেন, ‘বাছা, যুদ্ধ কি শেষ?”
আমি জবাব দিয়েছি, “হয়তো হবে না”।
‘ঈশ্বর মাপ করুন, ঈশ্বর মাপ করুন’।
কারণ যুদ্ধ ন্যায্য হিস্যা করতে পারে না
কোনোদিন কেউ জয়ী হয়নি এই শত্রু-শত্রু খেলায়!
তিনি আবারও শুধালেন, ‘যুদ্ধের শেষ হবে না বলছ?”
‘না, বলেছি  হয়তো হবে না।’
‘ঈশ্বর মাপ করুন, ঈশ্বর মাপ করুন।’
তিনি কিছু বললেন না আর
যেন তিনি হয়ে গেলেন মুক ও বধির।
তিনি মাথা না তুলে স্থানু হয়ে রইলেন চুল্লীর কাছে।
তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন?
নাকি পুরো পৃথিবী তার কাছে এলো স্বপ্ন হয়ে?
আমার পকেটে কয়েকটি রুবল নাড়াচাড়া করতেই
ভেঙে যায় তার প্রাচীন মগ্নতা।
‘ঈশ্বর তোমার সহায় হোন, বৎস!
আমরা পয়সা নেই না!’
‘ঈশ্বর আপনাকে ভালো রাখুন’
সুন্দরের বিনিময় শুধু  সুন্দরেই
ভালোবাসার বিকিকিনি হয় ভালবাসাতেই!

 

তিন.

এই হৃদয় চিরকাল ঋণী
জেনে রেখো রাশিয়ার জ্যোতি!
দিক ভুলেছে যে পথিক
বহুদূরে রয়েছে যার স্বজন
সতত শঙ্কিত তুমি
তোমার আলোয় তারে দিয়েছ ঠাই!
এমন করেই জ্বলো চিরকাল
তোমার তো ছুটি নেই
হে রাশিয়ার জ্যোতি!

Русский огонёк.
Russian Light


অনুবাদক
শামসুদ্দোহা তৌহীদ

জন্ম – ২৬ শে জুলাই, ১৯৯২। বেড়ে ওঠা বরিশালে। পেশায় চিকিৎসক। প্রকাশিত বই :  ডিঙ্গো- রুভিম ফ্রেয়ারম্যান, রাশিয়ান কিশোর উপন্যাস।

শেয়ার