পাঁচটি কবিতা | সোহেল হাসান গালিব


অয়ি চণ্ডি


অয়ি চণ্ডি, তোমাকেই বাঞ্ছা করি—হরিতকী, জবা,
শালবনে নয়—জনারণ্যে। ডাকে ত্রাসপাখি ওই—
সর্বনাশপন্থি বাঁশিটির সুরে। দেখি ধ্যানভঙ্গ
রাত্রির নিশ্বাসে শঙ্খ-লাগা দুটি মেঘের চূড়ায়
আততায়ী জোছনার তির এসে বেঁধে। ঘুমহীন
এ চত্বরে গুম হয়ে থেমে যায় পথের বাতাস।
মুঠিতে লুণ্ঠিত হতে জ্বলে ওঠে প্রতিটি লন্ঠন;
ফুল-তোলা নারীটিও খোঁজে তার আঁচলে দস্যুতা।

দস্যু রত্নাকর আমি নই। তুচ্ছ ব্যাধের জীবন
কাটে পৃথিবীতে। ক্রৌঞ্চ সাক্ষী, আমি সেই কালকেতু,
শিকারির বেশে এসে যে নিজেই হয়েছে শিকার।
একটি গোসাপ ধ’রে ঘরে এনে দেখি—ফেলে দিয়ে
ছদ্মবেশ, ফুঁসে ওঠে বিষাক্ত সাপিনী। ফণা তুলে
ডাকে : ‘আয়।’ ভাবি, আজ ভয় কাকে, যদি শিখে থাকে
বিষহর চুম্বনের কলা—ওই রূপসন্ন্যাসিনী?
অথচ সে কেন দাঁড়ায় না ঘুরে, যে মানুষ পারে
উল্টোরথ টানা! চণ্ডি, এই চণ্ড-চাঁড়ালের দেশে
তোমারই আসন মানি, কবি আমি, নিজ-চণ্ডী-দাস।


চৌষট্টি পাখুড়ি


চুরাশি চুম্বনে ফোটা পাপড়িটিকে আজ পেয়ে যাই
গ্রন্থের ভিতর। সিদ্ধাচার্য আমি নই, নই সেই
পদকর্তা—একটি পদ্মের বুকে শিখি নি চৌষট্টি
পাখুড়ির নাচ। লিপ্সাহত এই জীবনের তুচ্ছ
ভণিতায় আমি জীবনপা, মৃত্যু-গোধূলির চর।
তুলোট পৃষ্ঠার ভাঁজে পড়ে থাকা ছেঁড়া পাপড়ি তাই
ছুঁয়ে দেখি। চটে গেছে রঙ তার, মিলিয়েছে গন্ধ,
শুয়ে আছে যেন এক ফুলের ফারাও, মমি হয়ে—
কত কীট আর কাঁটাবন তবু সে পেরিয়ে এল
স্তব্ধতার মুখে তুলে দিতে এক ফোঁটা সম্ভাষণ।

অনেক শব্দের ঢেউ ভেঙে ছুটে আসা, খুব মৃদু
ধ্বনিটির ইঙ্গিতেও যে নির্ভুল সাড়া জাগে মনে,
যেমন সম্ভব আজও গড়ে নেয়া, মর্ম-মূর্তি নয়,
স্মৃতির টুকরো আলো পথে পথে কুড়াতে কুড়াতে
শৈশবের একটি ম্যুরাল, তেমন কি হতে পারে—
হাত বেয়ে, আসবে শরীরে উঠে তোমার স্পন্দন
স্পর্শহীন? যদিবা সে উঠে আসে, উড়ন্ত ডানার
ছায়া কিন্তু পড়ে না মাটিতে—যেই ডানা শূন্যে লীন।


দেবলীনা


কেবল তোমার নামটিকে
আলতোভাবে ছুঁয়ে ধর্ম ও রাষ্ট্রের ভেদ আমি
কিছুটা বুঝেছি…

শুনেছি তৈমুর লঙ বহু গিরিপথ পাড়ি দিয়ে এসে
ছোট্ট এক সরোবরে থমকে দাঁড়িয়েছে

দেখতে স্নানদৃশ্য, ভীল রমণীর

মানুষেরা আর কত পড়বে গ্রন্থ, যদি নাই খুলবে
গ্রন্থি, হৃদয়ের

দেবলীনা, সেই কবে থেকে তুমি
ভাষাকে কেবলই টানছো বর্ণের ভিতর

আমি খুঁজছি আদিগন্ত পৃষ্ঠা মেলে
নৈশব্দের পরাগচুম্বন—

এইখানে, পাথরে ও তৃণে

নামকে ছাপিয়ে দেহ আজও
            ফুটল না। ফুটবে না তবে
                            কোনো হরফেই?


দেহযান


ক’মাইল পর ভালোবাসার রঙ পাল্টায়, মানুষের স্বেদ ও স্বস্তি কি তা জানে! বীজের দিকে লক্ষ করি, পাখির নীলচে ডিমের দিকে—

জন্ম ও বিকাশ: একটি অলস হাসি-বিনিময় থেকে ছাড়া পাওয়া। নীড়ের সম্পর্ক থেকে দূরে এই অলসতা, আনন্দসেতু—পারাপারহীন, জলকল্লোলে রচিত।

তারই উপর দিয়ে দেহযান—ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে তরঙ্গ, হাওয়া, প্রত্যাশা, প্রশ্ন ও ক্ষুধা। দুলছে কাশবন। প্রসন্ন প্রচ্ছদপট। অবসাদ-গন্ধে ভরা।

ভাবনা-ভূগোল তাতে চোট পায় বলে ঘোরে। ঘূর্ণি, জানি না কোন সৌর-সংকেতে তমসা-তল্লাশ করে, কেবলই দূরে সরে যায়…


ব্যাধি


তোমার নগ্নতাটুকু না-হয় আমিই ঢেকে দেব। বাঘের সমস্ত ক্ষুধা নিয়ে আহত হরিণকে দেব শুশ্রূষা—ঘাস চিবিয়ে সবুজ রস লাগাব তার জখমে।

তাই বলে সন্ত আমি নই। আছে হস্ত-পদ-স্কন্ধে তালের মতন এক মস্তকের ভার। আছে এ দেহের অন্ধকূপে অনন্ত পিপাসা। তৃষ্ণার্ত কুকুর হয়ে তবু—জলে শুধু মুখ দেখে ফিরে যাব—

ফিরে যাব আমি, একসিন্ধু জলাতঙ্ক নিয়ে।


সোহেল হাসান গালিব

galib.uttara@gmail.com

+8801715255214

শিক্ষা : বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)

পেশা : প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ, নায়েম
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা

প্রবন্ধ : বাদ-মাগরিব (ভাষা-রাজনীতির গোপন পাঠ) [অগ্রদূত ২০১৮]

কাব্য :
দ্বৈপায়ন বেদনার থেকে [শুদ্ধস্বর ২০০৯]
রক্তমেমোরেন্ডাম [ভাষাচিত্র ২০১১]
অনঙ্গ রূপের দেশে [আড়িয়াল, ২০১৪]
তিমিরে তারানা [অগ্রদূত ২০১৭]
ফুঁ [বাতিঘর ২০২০]
চৌষট্টি পাখুড়ি [আদর্শ ২০২২]
দরজায় আইভিলতা [ঐতিহ্য ২০২৩]
প্রেমের কবিতা [ক্রিয়েটিভ ঢাকা ২০২৩]

সম্পাদনা :
শূন্যের কবিতা (প্রথম দশকের নির্বাচিত কবিতা) [বাঙলায়ন ২০০৮]
কহনকথা (সেলিম আল দীনের নির্বাচিত সাক্ষাৎকার) [শুদ্ধস্বর ২০০৮]

সম্পাদনা [সাহিত্যপত্রিকা] : ক্রান্তিক, বনপাংশুল

ওয়েবজিন : পরস্পর [poros-por.com]

শেয়ার