পাঁচটি কবিতা | সরোজ মোস্তফা


মৃত্যুকে


মৃত্যুও দেখছি ডালিম ফুলের মতো ছোট।
ঘরে, আসবাবপত্রে না-রাখার মতো ছোট।

মৃত্যু হচ্ছে সাদা পায়রার শুয়ে থাকা
সাদা টগরের অন্যত্র যাওয়া।
হাশরের মাঠে কিংবা পুনর্জন্মে আসার ইচ্ছেতে
পৃথিবী নামের ট্রাংকে প্রত্যেকেই ঘুমে থাকে।
শেষবার আমারও এমনটাই হবে।


স্তব্ধতার পাশে


রাতের শেষ ট্রেনটা চলে যাওয়ার পর
ছোট চায়ের দোকানে
ভালোবাসা অপেক্ষা করছে।

সেখান থেকেও
একটা অটোতে বসে
চলে যাবো হাওরের ঘাসে!
যেতে যেতে মনে হবে মানুষেরা প্রেমের কাঙাল
রোদনেও একা থাকতে পারে না।

এতো যে সঙ্গের কথা বলি
দেখি, একটা মানুষের মরণে
জেগে ওঠে আরেক মানুষ।
এক মানুষের বাঁচায়-থাকায়
ছুরি শানে আরেক মানুষ।

এইসব সামাজিক তাড়া খেয়ে
আকাশ দুভাগ করে উড়ে যায় বিকালের পাখি।
বকুল ফুলের স্তব্ধতায়
ঝরা রঙে মিলেমিশে
নির্জন নদীর পাশে বৃষ্টির ঝিলিকে
হাসান ভাইয়ের গজলে
ভালোবাসা অপেক্ষা করছে।


করজোড়ে


বাদাম ক্ষেতের বিস্তীর্ণ বিকালে
শীত সুরমাকে করজোড়ে চাইতে হয়।

পলিথিন উড়ানো বাতাসে
না চাইলে পাওয়া যায় না কিছু।

গণতন্ত্র নামের সময়ে
অরক্ষিত মনে হয় পৃথবী-ভ্রমণ।
ভয় হয় রাজবাড়ি, রাজনিমন্ত্রণ।
দাওয়াত গিলে যদি গ্রেফতার হতে হয়।
শেষে যদি মানুষকে পলাতক হতে হয়।

যতদূরে যাই, যে নামে তাকাই
আশ্চর্যময়ীর চিহ্নিত স্রোতের দিকে
জুবিলী স্কুলের ঘন্টা ক্রমাগত  ডাকে।

জলের তালায় বোকা কালবাউশের মতো
পীর-মুর্শিদের কাছে করজোড়ে
সমর্পণ করি নিজ নাম।

কাসার বাটিতে খোদাই করেছি দুগ্ধবতী নাম
নাম কি ধানের গুছি, জমিনের প্রেম।

মেলার জুয়ায় সব দিয়ে
চাঁদনি পশরে তোমার দোয়ারে
বসে আছি একগ্লাস পানির আশায়।
যে নামেই ডাক,  সাড়া দিব।
বুঝি, যে কোনো খেলা আকস্মিক।


তোমরা থাকবে


বরুণ গাছের নিচে
এ-দেহ পচবে। শিশির মাখবে।
ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে।

দুপুরের ডুপি পাখি
তোমরা থাকবে, বিকেল দেখবে
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনে, আখড়ায় রাধা-কৃষ্ণ হবে
হুজরাবাড়ির কাফেলায়
মানুষ নিজের দুঃখ জানতে জানতে
নতুন আলুর ঝোলে দেশি মুরগির রান খাবে
গজল শুনবে পূর্ণিমায়।

এ দেহ পচবে। শিশির মাখবে।
এই কথা আমি মানতে পারি না।
এ-লোকালয় মূলত মাটির পিঞ্জর

কোনোমতে বেঁচে থেকে সরোজের চক্ষু
এক জায়গায় এসে থেমে গেল।
মানুষ চিনতে চিনতে দিন কেটে গেল।


নিরুপায়


কে কাকে পীড়িত করে!
করচ বনের স্বরে
মানুষের দুঃখ প্রাকৃতিক।

একলা পাখির দুঃখ কখন আসবে
কিছুই জানি না।
অনেক ডানায় ঘুরে
কোথাও যাব না ভেবে স্থির
একা একা থাকতে শিখেছি।
তবু, মানুষের ডাকে নিরুপায় আনারস ফুল।

দগ্ধবতী বৃক্ষের পেখমে
মধুপুর কিংবা শ্রীমঙ্গলে বসে আছি।


সরোজ মোস্তফা
কবি ও গদ্যশিল্পী

গারো পাহাড়ের নদী মগড়ার তীরে ছোট শহর নেত্রকোণায় জন্ম, ১৯৭৬ সালে। কর্ম ও পৈত্রিক পরিচয়ে এই ক্ষীণস্রোতার পাশাপাশি স্বচ্ছ বসবাস। পেশায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। হাওরাঞ্চলের ভাবুকতা, ধ্যান ও জনসংস্কৃতিকে তিনি যাপন করেন। লিখেন।

‘সকাল সন্ধ্যার বীজতলা’, ‘কাগজে সমুদ্র লিখি’, ‘লাল রক্তের ব্রহ্মাংশ’, ‘হলুদ খামের হিমঘর’ ‘সুরমা নদীর দস্তখত’ কবির প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ। ‘যতীন সরকারের মাস্টারি’, ‘গৌরাঙ্গ আদিত্যের জীবন ও সাধনা’, ‘বিপ্লব চক্রবর্তী : গায়েনের সংগীতযাপন’ তার প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ।

শেয়ার