অভিলাষ
এই জনসমুদ্রে মানুষের কালো কালো মাথাগুলো
যেন বারুদের শান্তশিষ্ট কাঠি-
একটা থেকে অন্যটাকে পৃথক করা যায় না।
কাক ও আলকাতরার রং যেখানে একই
যেমন আলাদা করা যায় না দুইটা মহাসাগরের জল
যেখানে মেলে। প্রেমিক ও আততায়ী
এখানে এক হয়ে মিলে গেছে, কার পকেটে পিস্তল
আর কার পকেটে গোলাপের অতল বাগান
বাইরে থেকে ঠাহর করা যায় না। তাই এই কুয়াশা-সন্ধ্যায়
চলো কবি, একসাথে হাঁটি আর পুরানো দিনের মতো
বিড়ি ফুঁকি। যেখানে মই ও মইয়ের গায়ে পিছলানোর
তেলের ডিব্বা- সেসব ফেলে মাঠে নেমে যাবো।
অচেনা অজানা গাঁয়ের ধূধূ প্রান্তরে
জোনাকি হয়ে পথিককে পথ দেখাবো।
শীতের রাতে বৃষ্টি
এইসব শীতের রাতে বৃষ্টি পড়ে
যেন ড্রামের উপর স্টিকের তালে তালে…
শিশু হয়ে যাওয়া সবচেয়ে ভালো
অধরা রূপকথা কাছে আসে।
শীতের রাতের বৃষ্টির চেয়েও শৈত্য
জমে আছে মানুষের হৃদয়ে। শৈত্য নাকি সত্য?
মানুষের বাড়িগুলো একে অপরের থেকে ক্রমশ
দূরে সরে যায়, যেমন চলন্ত ট্রেনের দৃশ্য!
এই মনে হয় মৃত, এই আবার জীবন্ত
যেন ছোট ছোট ঈগলু, টোকা দিলেই জেগে উঠবে
ঘুমন্ত রাজকন্যা। কিছু পাখি খাঁচায় দেয় ডিমে তা
কিছু মানুষের পায়ে গজায় ডানা।
কিছু দেশ পুড়ে অঙ্গার, মলিন
কিছু দেশ সেই অঙ্গারের আলো দিয়ে সাজায় বড়দিন।
আর তুমি কাউকে চিঠি লিখবে বলে
শীতের রাতে মেঘদূত হয়ে বৃষ্টি নামে।
পৃথিবীর সব যুদ্ধ বিগ্রহ, প্রেম বা বিচ্ছেদ
পৃথিবীর সব অনুতাপ, আশীর্বাদ, আক্ষেপ
সদ্য জন্মানো নাদুস-নুদুস কুকুরছানার মতো
আগুন পোহায় তোমার সাথে, এমন শীতল বৃষ্টিরাতে।
পৃথিবীতে ভালোবাসার বয়স
বয়সের কথা ভুলে যাও- বরং তুমি ভাবতে পারো
পৃথিবীতে ভালোবাসার বয়স হলো ঠিক কতো বছর?
কবে তার জন্মদিন- উইশ করবে বলে সারাবছর
তক্কে তক্কে থেকে জন্মদিনটা যখন আসলো
ঠিক তখনই ভুলে গেলে তুমি। মনে পড়ে এমনই ছিল
সেই অভিমানী, বারবার তুমি যার জন্মদিন ভুলে যেতে
আর সে অভিমানে কখনোই তোমাকে মনে করিয়ে দিতো না
সে কথা। সে কথা আজ তোলা থাক। তোমার অস্তিত্বের নাম
যদি হয় ভালোবাসা, তাহলে আমি তোমার বয়স খুঁজবো না,
খুঁজবো ভালোবাসার বয়স। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর দিয়ে
উড়ে যায় যে নীল বাতাস, আমি তার বয়স জানতে
চেয়েছি কখনো? কিংবা যে মুক্তা লুকিয়ে থাকে
ঝিনুকের মাংসল দেহে- তার বয়স জানার কখনো
হয়নি প্রয়োজন। যে প্রজাপতিরা হেমন্তের বাগানে
খেলা করে ঝরে পড়া পাতাদেরকে কোলে নিয়ে-
তুমি তো ছিলে চিরকাল তাদের ডানার রঙেই তুষ্ট।
তাহলে এই সমুদ্রের অতলে বসে বসে ভালোবাসার
গভীরতা না মেপে, মাপছো কেন উটকো বয়স?
ভ্যানগগের ছবিগুলোর অনেক বয়স- তবু তারা প্রতিরাতে
এখনো আকাশ ভর্তি করে তারাদের পিদিম জ্বালিয়ে রাখে।
বহু আলোকবর্ষ আগের ভবিষ্যতে সমুদ্র তীরে
[বহু আলোকবর্ষ আগের ভবিষ্যতে সব যখন প্রাণহীন, ছাইয়ের নীলচে গুঁড়ো হয়ে পড়ে আছে বিশাল স্থাপনায় চাপা পড়া কোন চিঠির মতো, তখন কয়েকটা ছায়া সমুদ্রের গন্ধ শুঁকে জন্মান্ধ নেকড়ের মতো হামাগুঁড়ি দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল সামুদ্রিক সিজোফ্রেনিয়ার বেগুনি জলাতঙ্কে। কারণ তারা শুনেছিল, এখানেই কোন এক পাথরের মগজে এক ফোঁটা শিশির হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাণ…]
চুক্তি করে প্রেম করার মতো প্ল্যান করে বহুবার পালাতে ব্যর্থ হয়ে
হঠাৎ একদিন সত্যি সত্যি পালালাম। দূরে যেখানে কুয়াশার দূরবীনে
সমুদ্র দেখা যায়, তোমার শহরের আলোর কারখানায়
ভবঘুরে চোখ অন্ধতাই ফিরে পায়। তিমিমাছের ফসিলের স্ট্রাকচার নিয়ে
পিছনে পড়ে থাকে বাক্সবন্দী নাগরিক জীবন, আমি তার মরণ হয়ে
বিষাক্ত পাকস্থলী ছিঁড়ে বেরিয়ে যাই সমুদ্রদানবের গর্জন শুনে ঘুমানোর ইচ্ছা পূরণ করতে।
যাত্রার মাঝখানে বারবার যাত্রাবিরতি। বিরতি পেলেই ড্রাইভার কাশতে কাশতে ভাত খায়,
তারপর পান চিবাতে চিবাতে একটা সিগারেট ধরায়। আর আমরা
শুকনো পপি ফুলের নির্যাসে নিঃশ্বাসের খাল কেটে কুমির আনি।
কুমির তো নিরীহ খাদক একটা প্রাণী। যেখানে হাঙর, স্কুয়িড, চোরাবালি,
লাল পতাকা- যাচ্ছি সেইখানে সমুদ্র সঙ্গমে।
এখানে মানুষ আর পণ্যের সঙ্গমে রংধনুর সেতুগুলো পুড়ে পুড়ে ছাই,
ছাইয়ের সেতু ধরে আসে না কোনো আগুনের শিখা হাতে আগন্তুক।
আয়নাটা সরে গেলে সামনে দেখি ক্যালকুলেটর জীবনের না দেখা নীল সমুদ্র।
হাজার হাজার শ্রমিক যেমন তাদের শ্রমের ঘামরং দিয়ে টাইলসে ফুল, পাখি
এঁকে বানিয়েছিল তাজমহল, সেরকম পৃথিবীর সব নীল চাষীরা তাদের
ক্ষেত থেকে নীলফল তুলে গুলে দিয়েছে এই সমুদ্রে।
নীলের গাঢ়ত্বে কালচে হয়ে যাওয়া পানিতে ফসফরাস জ্বলা ঢেউয়ের বর্ডার,
যেন এক সারি গাংচিল একসাথে উড়ে গেল কোন পাখি শিকারীর পায়ের শব্দে।
সাথে সাথে নিঃশব্দে ঝরলো একটা তারা, পাশের বন্ধুটা বললো: উইশ কর, উইশ কর!
আকাশের বাগানে এক জায়গায় অনেক অনেক চারা গজানোর মতো তারাদের গ্যাংব্যাং,
মহাকাশে লেজার লাগানো মৌচাকের মতো ঝুলে আছে। নিচে পাশাপাশি চেয়ারে
আমরা সিঙ্গেল কুয়োর ব্যাঙ, নিশ্চল চোখে তাকিয়ে দেখি সমুদ্রের নড়াচড়া।
রাতে সমুদ্রটা তারাদের থেকে নিক্ষিপ্ত আলোয় যেন কোন এলিয়েন টেলিভিশন।
তার মাল্টিকালার ডিসকভারি চ্যানেলে রিমোট কন্ট্রোল ছাড়াই
দেখছি যে যার জীবনের সাদাকালো ডকুমেন্টারি।
বহু প্রতীক্ষিত প্রেম কাছে আসলে বুঝি তা খুবই সাধারণ।
যেমন সমুদ্রপারের শিশুদের কাছে বালুতে আটকে পড়া কোন স্টারফিশ-
চোখের কালো তারায় জ্বালে না বিস্ময়ের মোমবাতি।
কাঁকড়ার পায়ের ছাপের দিকে তাকালে ঢেউ এসে ভরে দেয় বালু আর জলে।
‘কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না’ কোরাসে বাতাস বলে।
নেই আক্ষেপ পুরনো গিটারের, আছে অপেক্ষা নতুন গানের।
ব্যাগের মধ্যে জলরং, কাগজ কলম অব্যবহৃত কনডমের মতো
পড়ে থাকে। কারণ আমরা মহা আনন্দে নিজেদের ব্যবহার করছি
সমুদ্রের প্রোটেকশনহীন মিলনে।
সমুদ্রে দেয়নি তো বাঁধ লবণচাষী। অথচ, নাগরিক স্বভাবে
স্বার্থের বাঁধে কম কম লবণের দানা পড়লে চেঁচিয়ে উঠে গুষ্টি উদ্ধার করি।
ঝগড়ার ঝড়ে খসে পড়ে হলুদ পাতার মতো আলগা মুখোশ।
নিজেরাই বিরক্ত হই নিজেদের ওপর। ঝড় থেমে গেলে
রোদ পড়ে ভাঙা পালে, জংলী শূকরীর ছানাগুলো যেমন স্তনের ভাগাভাগি নিয়ে
যুদ্ধ করে শেষপর্যন্ত ঘুমিয়ে পড়ে একজন অন্যজনের শরীরের গোলাপি পশমে।
ঝাউবনে ছায়া নামে সবার আগে। সেই ছায়া লেগে অন্ধকার আমাদের মুখ।
মাকড়সার মতো যে রঙিন উলের গুটি ছাড়তে ছাড়তে চলে গিয়েছিলাম সমুদ্র, না কি
সামুদ্রিক তৃষ্ণার কাছে, তা গুটাতে গুটাতে ফেরার পথ ছোট হয়ে আসে।
কাছে চলে আসে জ্যাম, ক্লান্তি, বিচ্ছিন্নতাবোধ, হৃৎপিন্ড জুড়ে গজিয়ে ওঠা ক্যাকটাস।
তবু জেনে গেছি ফেলে আসা সমুদ্র তীরে কোন এক পাথরের মগজে
এক ফোঁটা শিশির হয়ে লুকিয়ে আছে প্রাণ…
যাব সাধুর চরণ খুঁজে
এমন বৈরাগ্য নীল রাতে সাধুর চরণের কথা মনে পড়ে। সবকিছু হারিয়ে কাঁদতে আর কোথায় বা যেতে পারি সাধুসঙ্গ ছাড়া। হাতে হাতে ফেরা অগ্নিকুণ্ড দেবে পাহারা। যেন চোখ থেকে এক ফোঁটা জল না ঝরে। অশ্রু যে অমূল্য। তাদেরকে জমিয়ে রাখতে হয়, যেভাবে কৃপণ সঞ্চয় করে রাখে চার আনা, আট আনা। আমার ষোলো আনাই বিসর্জন যেতে বসেছে মানুষকে বিশ্বাস করে করে। বিশ্বাস ফিরে পেতে যেতে হবে আলোর শহরে না, অন্ধকারের বসত বাড়িতে। যেখানে গোল হয়ে বসে গান, তত্ত্ব আলোচনা আর ব্রহ্মাণ্ডকে একটা শিশুর মতো কোলের মধ্যে পাওয়া। যাব সেই অচিনপুর, জোনাকিপুর। গোল হয়ে বসব যেভাবে সূর্যকে ঘিরে বসে গ্রহ, নক্ষত্রমালা। সাধুকে বলব: আমার ভজন সাধন কিছুই হলো না এই পোড়ো সময়ের ঘূর্ণিপাকে। এবার যেন সে চরণে একটু আশ্রয় দেয় আর আমি যুদ্ধের ইতিহাস থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারি শান্তির ভূগোলে।
লুবনা চর্যা
জন্ম ও বেড়ে ওঠা খুলনায়। পড়াশোনা ইংরেজি সাহিত্যে। এরপর ঢাকায় এসে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ করা। কিন্তু বিজ্ঞাপনী সংস্থায় অনেক বেশি সময় দিতে হতো বলে আর তার নিজের কাজগুলো করা হচ্ছিল না দেখে চাকরি ছেড়ে টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং করছেন দুই/একটা পাবলিশিং হাউজের সাথে। ২০০৪ সালে করেন বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাচর্য বিনিশ্চয়ের অনুবাদ সমসাময়িক বাংলায়। তার প্রকাশিত কবিতার বইয়ের সংখ্যা পাঁচটি। সেগুলো হলো যথাক্রমে: জিওগ্রাফি ইন অ্যা জ্যু…, শয়তানের অভিনব কারখানা, পপকর্ন, চিন্তাশীল মেশিন ও হেমন্ত’কে বলা এলোমেলো কথা। এছাড়া ‘সহজ’ নামে একটা লিটল মাগাজিন সম্পাদনা করতেন।
কবিতা লেখার পাশাপাশি ছবিও আঁকেন তিনি। এ পর্যন্ত তার সলো এক্সিবিশনের সংখ্যা তিনটি। অংশগ্রহণ করেছেন কয়েকটি গ্রুপ এক্সিবিশনেও। তার জন্ম ৩ ডিসেম্বর, ১৯৮৩ সালে।