প্লবতা
সুঁইয়ের পুচ্ছে বাঁধা যে লম্বা সোনালি সুতাটি,
তারই এক অনিঃশেষ আঁকাবাঁকা ভ্রমণকাহিনি
সুরেলা হাতের সুরকুশলতায়
রূপকথা হয়ে বেজে ওঠে নকশিকাঁথায়।
আর সুঁইয়ের ডিএনএ-তেই আছে কারুশিল্প
যেমন চেয়ারের মর্মে লীন হয়ে থাকে তার প্লবতাশক্তি।
চেয়ারের ওই প্লবতাশক্তিই কেদারা-নশিনকে ভাসিয়ে রাখে
ক্রমপদোন্নতির পথে।
কোলাহল-বিষে দিগ্ধ দার্শনিক ওহে,
দ্রুত হয়ে ওঠো অতিদহনে বিদগ্ধ।
নিয়তি
তবে আদিগন্ত মনোদুর্নীতিই ডেকে আনে দুর্নিয়তি প্রতিবার,
দ্রুত আরোহণ মানে ত্বরিত স্খলন।
আর এই মুষ্ট্যাঘাত? সুগন্ধি পালকে সুসজ্জিত ঘুষি?
ও কিছু না, এক দাঁতভাঙা জৈব সংলাপের সূত্রপাত মাত্র।
ঘুষি তো মূলত এক প্রকারের ঘুষই বটে, দাতার তরফ থেকে গ্রহীতাকে।
কী-ই আর থেকে যাবে শেষে? —এক অজানা গন্তব্যভীতি,
চূর্ণ-চূর্ণ উদ্বায়ী আত্মবিশ্বাস,
সম্পূরক ব্যথা, আর এই মৃদু অন্তর্হাস।
আর টিকটিকি-হারা অনাথ লেজের মতো তড়পানোর স্মৃতি।
অনাথালয়ের দুয়ারে
অনাথালয়ের দুয়ারে এসেছে নেকড়ে পালকমাতা
ফেরত চাইতে তার দুই বুনো মানবশিশুকে আজ।
শিশুদের ছেড়ে চলে গেছে পিতামাতা
নেকড়ে তাদের কুড়িয়ে নিয়েছে স্নেহে।
স্তন্য দিয়ে, শিকারের কাঁচা মাংস খাইয়ে দিনে দিনে
অন্য নেকড়ে-শিশুদের সাথে মানবশিশুকে তবু
পালন-পোষণ করেছে পশুটি নিজ সন্তানজ্ঞানে।
নেকড়ে মায়ের কাছ থেকে জোর করে
শিশু দুইটিকে ছিনিয়ে এনেছে মানুষেরা গতকাল।
অনাথালয়ের দুয়ারে পশুটি ভাষাহীন চোখে চেয়ে
ফেরত চাইছে তার দুই বুনো মানবশিশুকে আজ।
ভুবনগড়ের দুই শিশু, দুই বোন
বিবর্তনের চাকাটিকে যারা
এক ঝটকায় নিয়ে ফেলেছিল লক্ষ বছর পেছন।
ঘুরপথ
ওরা আয়ত্ত করবে কত বিচিত্র অক্ষর, অঙ্ক, পরিভাষা, জ্ঞান, ইন্দ্রজাল…
তুমি আমি না-হয় রয়েই গেলাম নিরক্ষর, নিরঙ্ক, নির্জ্ঞান।
ওসব করতে গিয়ে দিনে দিনে ওরা অর্জন করবে
কত যে দুরক্ষর, দুঃসংখ্যা, দুর্জ্ঞান, অপচ্ছায়া, কালাজাদু—
বুঝতেও পারবে না।
তারপর একদিন বিসর্জন দিতে থাকবে একে একে সমস্ত অর্জন।
কালক্রমে হয়ে উঠবে সম্পূর্ণ নগ্ন, নিরক্ষর।
ঘুরপাক খেতে খেতে ফিরে যাবে সেই সূচনাবিন্দুতেই,
বহু ঘুরপথ, ঘুরপন্থা পার হয়ে।
সমস্ত জ্ঞানের বিষক্রিয়া-শেষে জেগে ওঠে এক প্রাচীন নীরবতা।
শিশুসুলভ
কত কিছু উড়ে এসে পড়ে শিশুদের ফাঁকা মনে
আর উড়ে যায় পরক্ষণে!
নবীন মানব তাই চিরকালই অস্থির, চঞ্চল।
তাই কি তাদের বোল ফোটে অসংলগ্ন, দ্রুত, অনর্গল!
প্রশান্ত ঘুমের মধ্যে ঝলকানি দিয়ে ওঠে
নির্দন্ত মুখের হাসি, স্ফূরিত অধর…।
এভাবেই ঘুমন্ত শিশুর অবয়বে
দুলে ওঠে দেয়ালা-ভাষার রীতিবিধি—
স্বচ্ছ, সাবলীল।
এতসব কি মায়েরা জানে?
—জানে। তবে সব তো জানে না
শিশুর ভাবনার সঙ্গে তাই প্রতিনিয়ত সংলাপ চলে মায়ের বোধের।
অস্থির, অসম সে-সংলাপকালে, মাঝে-মাঝে, নবীন শিশুর
আচমকা-ধারালো ভাবনার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে
বেমক্কা কয়েক পাক ঘুরে ওঠে মায়েদের, বাবাদের বোধ।
মাসুদ খান
জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। বর্তমানে ক্যানাডায় বসবাস। শিক্ষকতা করেন টরন্টোর একটি কলেজে।
প্রকাশিত গ্রন্থঃ
পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩), নদীকূলে করি বাস (২০০১), সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬), আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১), এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪), প্রসন্ন দ্বীপদেশ (২০১৮), দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫), প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (২০১৬), গদ্যগুচ্ছ (২০১৮), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮), পাখপাখালির গান পাগলাঝোরার তান (২০১৯), ঊর্মিকুমার ঘাটে (২০২০), দুঃস্বপ্নের মধ্যপর্ব (২০২২)।